সতেরো
আমরা দুইদিন থাকলাম স্ট্রীটলিতে। কাপড়জামাগুলো ধোলাই করালাম। কাজটা আমরা নিজেরাই নদীতে জর্জের তত্ত্বাবধানে করতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু চেষ্টাটি ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে ওটা ছিল ব্যর্থতার চেয়েও বেশি, কারণ, ধোয়ার পরে কাপড়গুলার অবস্থা আগের চাইতে খারাপ হয়ে পড়েছিল। ধোয়ার আগে ওগুলো অতি নোংরা ছিল একথা সত্য, কিন্তু কোনমতে পরা যেত। ধোয়ার পরে—কি আর বলব, রীডিং আর হেনলির মধ্যবর্তী নদীটা আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে যায়। রীডিং আর হেনলির মাঝখানে নদীর মধ্যে যত ময়লা ছিল সব আমাদের কাপড়গুলোর ভেতরে ঢুকে পড়ে।
স্ট্রীটলির ধোপানীটা বলে যে নিজের খাতিরে আমাদের কাছে প্রচলিত মজুরীর চেয়ে তিনগুণ বেশি সে দাবি করছে। সে বলে যে ওটা কাপড় ধোলাইয়ের মত নয়, অনেকটা খনন কাজের মত ব্যাপার ছিল।
টু শব্দটি না করে আমরা বিলটা পরিশোধ করি।
স্ট্রীটলি আর গোরিং-এর আশপাশের এলাকাটা মাছ ধরার এক বড় কেন্দ্র। বেশ চমৎকার মাছ ধরা যায় এখানে। নদীর ঠিক এখানটায় প্রচুর পাইক, রোচ, ডেস, গাজন এবং বান মাছ রয়েছে। সারাদিন বসে বসে ওগুলো ধরার চেষ্টা করা যায়।
কেউ কেউ বসে থাকেও। কোনদিন ওরা মাছ পায় না। আমি এমন কাউকে দেখিনি যে টেম্স নদীতে পোনা মাছ বা মরা বেড়াল ছাড়া আর কিছু ধরতে পেরেছে। এর সাথে অবশ্য মৎস্য শিকারের কোন সম্পর্ক নেই! স্থানীয়, মৎস্য শিকারীদের গাইডবুকে কোন কিছু ধরার বিষয়ে একটা কথাও বলা হয়নি। ওতে শুধু বলা হয়েছে যে জায়গাটা ‘মাছ ধরার একটি চমৎকার কেন্দ্র।’ জায়গাটার যতটুকু আমি দেখেছি তাতে আমি বলতে পারি যে ওই কথাটি সত্য।
দুনিয়ায় এর চেয়ে বেশি মাছ ধরার কিংবা এর চেয়ে বেশি সময় ধরে মাছ ধরার জায়গা আর নেই। কোন কোন মৎস্যশিকারী একদিনের জন্য এখানে এসে মাছ ধরে। অন্যেরা এসে গোটা মাস মাছ ধরে। কেউ ইচ্ছা করলে বছর তক থেকে গিয়ে মাছ ধরতে পারে। ফলাফল একই হবে।
টেম্স্-এর মৎস্যশিকারীদের গাইড’ বইতে লেখা আছে ‘এখানে জ্যাক আর পার্চও পাওয়া যায়।’ কথাটা ভুল। জ্যাক আর পার্চ এখানে থাকতে পারে বটে। বস্তুত আমি জানি যে ওরা ঠিকই আছে। নদীতীরে হাঁটলে দেখা যায় ওরা ঝাঁক বেধে ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষ দেখলে তীরের কাছে এসে পানির ওপর দেহের অর্ধেকটা ভাসিয়ে হাঁ করে দাঁড়ায় বিস্কুটের জন্য। স্নান করতে নামলে ওরা দলে দলে এসে চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, বিরক্ত করে। কিন্তু বড়শীতে কেঁচো বা ওরকম কিছু গেঁথে ওদেরকে ‘ধরা’? সেটি কখনও হবার নয়!
আমি নিজে ভাল মৎস্যশিকারী নই। এক সময় বিষয়টার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছিলাম এবং মনে করতাম যে বেশ ভালই চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রবীণ মেছুয়ারা আমাকে বলেছিল যে আমি কোনদিনও ভাল মৎস্যশিকারী হব না। ওরা আমাকে উপদেশ দেয় ওটা ছেড়ে দেয়ার জন্য। ওরা বলে যে আমি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বড়শী ছুঁড়তে পারি এবং ওই কাজের জন্য যথেষ্ট বিচক্ষণতা আর দৈহিক আলস্যও আমার রয়েছে বলে মনে হয়। তবু তারা নিশ্চিত যে আমি কোনদিন মৎস্যশিকারী হতে পারব না, কারণ আমার প্রচুর পরিমাণ কল্পনাশক্তি নেই।
তারা আরও বলেছিল যে একজন কবি, চমকপ্রদ কাহিনীর সস্তা লেখক, রিপোর্টার, অথবা ওই জাতীয় কিছু হিসাবে আমি হয়তো সন্তোষজনক হয়ে উঠতে পারি, কিন্তু ওটা—অর্থাৎ টেমস্-এর মৎস্যশিকারী হিসাবে কোন স্থান পেতে হলে আমার যতটা আছে বলে মনে হয় তার চাইতে বেশি কল্পনাশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকা দরকার।
কোন কোন লোকের ধারণা এই যে ভাল মৎস্যশিকারী হবার জন্য দরকার শুধু নির্লজ্জভাবে মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কিন্তু এটা ভুল। কেবল নগ্ন মিথ্যা গালগল্প দিয়ে কাজ হয় না। ওরকম মিথ্যা গল্প ফাঁদতে যে কোন শিক্ষানবীশও পারে। অভিজ্ঞ মৎস্যশিকারী চেনা যায় তার গল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদ বর্ণনা, সম্ভাব্যতার সুশোভিত স্পর্শ এবং প্রায় পাণ্ডিতিক ধরনের ত্রুটিশূন্যতা দ্বারা।
যে কেউ এসে বলতে পারে, ‘আরে গতকাল বিকেলে আমি পনেরো ডজন পার্চ ধরেছি’ অথবা ‘গত সোমবার আমি একটা গাজন ধরেছি, ওজনে আঠারো পাউণ্ড এবং মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বায় তিন ফুট।’
এ ধরনের জিনিসের জন্য কোন আর্ট, কোন দক্ষতার দরকার পড়ে না।
না, পাক্কা মৎস্যশিকারী ওভাবে মিথ্যা বলতে ঘৃণা করে। তার পদ্ধতিটা লক্ষ্যণীয়।
হ্যাট মাথায় নীরবে ঘরে এসে সে দখল করে নেয় সবচেয়ে আরামের চেয়ারটা। তারপর পাইপ ধরিয়ে নিঃশব্দে ধূমপান করতে থাকে। তরুণদের কিছুক্ষণ সে আত্মজাহির করার সুযোগ দেয়। তারপর কোন ক্ষণিক বিরতিকালে মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে সে মন্তব্য করে:
‘জানো, মঙ্গলবার বিকেলে আমি কিছু মাছ ধরেছি, তবে সে কথা কাউকে বলে কোন লাভ নেই।’
‘কেন, কেন?’ প্রশ্ন করে সবাই।
‘কারণ, বললে কেউ বিশ্বাস করবে বলে আমি আশা করি না, শান্তভাবে জবাব দেয় বুড়োটি কণ্ঠে বিন্দুমাত্র তিক্ততার সুর না মিশিয়ে। তারপর পাইপে আবার তামাক ভরতে ভরতে বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করে তার জন্য ঠাণ্ডা স্কচ-থ্রী আনতে
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে যায় সবাই। তার উক্তি খণ্ডন করার প্রয়োজনীয় সাহস কেউ অনুভব করে না। সুতরাং কারও উৎসাহদান ছাড়াই তাকে বলে যেতে হয়।
‘না,’ বলে যায় সে চিন্তামগ্নভাবে, ‘একথা অন্য কেউ বললে আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এটা খাঁটি সত্য। গোটা বিকাল ধরে আমি বসে ছিলাম ওখানে। ডজন কয়েক ডেস আর গুটিকয় জ্যাক ছাড়া বলতে গেলে কিছুই ধরতে পারিনি। ব্যর্থ প্রয়াস ভেবে প্রায় উঠেই যাচ্ছি এমন সময় সুতোয় একটা জোর টান অনুভব করলাম। ভাবলাম আরেকটা ছোট মাছ হবে হয়তো। হেঁচড়া টানে তুলতে গেলাম ওটাকে। কিন্তু ছিপ নাড়তে পারলাম না। মাছটা তুলতে আমার আধঘণ্টা সময় লাগল—হ্যাঁ স্যার, পুরো আধঘণ্টা! এবং প্রত্যেক মুহূর্তে আমি ভেবেছি—এই বুঝি ছিঁড়ে গেল সুতোটা! শেষ পর্যন্ত ওটাকে কব্জা করলাম। কি মাছ ওটা বলো তো? স্টার্জন! চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের স্টার্জন! সুতোর টানে এসে পড়ল। হ্যাঁ, তোমরা আশ্চর্য হতে পারো – বাড়িওলা, দয়া করে আরেকটা স্কচ দাও তো আমাকে।
তারপর সে বলে যায় যেসব লোক দৃশ্যটা দেখেছে তারাও কেমন বিস্মিত হয়েছিল সে কাহিনী, বাড়ি ফেরার পর তার বউ কি বলেছে এবং জো বিউগল্স্ কি মন্তব্য করেছে সে কথা।
নদীর কাছের এক হোটেল মালিককে আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানকার মৎস্যশিকারীরা তাকে যেসব গালগল্প বলে সেগুলো শুনতে শুনতে একেক সময় তার খারাপ লাগে কিনা। সে বলে, ‘আরে না স্যার, এখন লাগে না। প্রথম প্রথম কিছুটা খারাপ লাগত, কিন্তু এখন খোদার রহমতে আমি আর আমার বউ সারাদিন ওগুলো শুনি। এটা অভ্যাসের ব্যাপার, বুঝলেন তো, অভ্যাসের ব্যাপার।’
আমি একসময় এক তরুণকে জানতাম। সে ছিল অত্যন্ত বিবেকবান ছেলে। সে কৃত্রিম টোপ নিয়ে মাছ ধরা শুরু করার পর স্থির করে যে ধৃত মাছের পরিমাণ শতকরা পঁচিশ ভাগের বেশি বাড়িয়ে বলবে না কখনও।
সে বলে, ‘চল্লিশটা মাছ পেলে আমি লোককে বলব পঞ্চাশটা পেয়েছি। এর চাইতে বেশি মিথ্যা আমি বলব না, যেহেতু মিথ্যা বলাটা পাপ।
কিন্তু তার শতকরা পঁচিশের পরিকল্পনাটা মোটেই কার্যকর হয়নি। সে ওটা প্রয়োগ করতে পারেনি কখনও। দিনে তার ধরা মাছের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল তিন। তিনের সঙ্গে শতকরা পঁচিশ ভাগ যোগ করা যায় না—অন্তত মাছের ক্ষেত্রে।
সুতরাং সে তার পার্সেন্টেজ তেত্রিশ এবং এক-তৃতীয়াংশ করে দেয়। কিন্তু মাত্র একটা বা দুটো মাছ ধরলে এটাও হয়ে দাঁড়ায় অসুবিধাজনক। কাজেই ব্যাপারটাকে সহজ করে নেয়ার উদ্দেশ্যে সে ধৃত মাছের পরিমাণটাকে দ্বিগুণ করে নিতে মনকে তৈরি করে।
কয়েকমাস সে এই সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ চালায় এবং তারপর এটা আর ভাল লাগে না। সে যে কেবল দ্বিগুণ করে বলছে তা কেউ বিশ্বাস করে না।. সুতরাং সে এর থেকে কোন ফয়দাই পায় না, অথচ তার এই সংযমের জন্য সে অন্য মৎস্যশিকারীদের মধ্যে বেকায়দায় পড়ে যায়। সে যখন তিনটি মাছ পেয়ে বলে যে ছ’টি পেয়েছে, তখন তার পরিচিত আরেক লোক আসলে মাত্র একটি মাছ পেয়ে বলে বেড়ায় যে দুই ডজন পেয়েছে। এতে সে রীতিমত ঈর্ষা বোধ করতে থাকে।
কাজেই শেষ পর্যন্ত সে নিজের সাথে একটা চূড়ান্ত বন্দোবস্ত করে নেয় এবং অতঃপর নিষ্ঠার সঙ্গে তা অনুসরণ করে যায়। বন্দোবস্তটা হলো, ধৃত প্রতিটি মাছকে দশটা মাছ হিসাবে গোনা। তার ব্যবস্থায় দশটার কম মাছ ধরা সম্ভব নয়। দশটাই হচ্ছে নতুন ব্যবস্থার ভিত্তি। যদি ঘটনাক্রমে কেবল একটা মাছই ধরে, সে বলে দেয় বিশটা ধরেছে, দুইটা ধরলে বলে তিরিশটা ধরেছে, তিনটা ধরলে বলে চল্লিশটা ধরেছে।
পরিকল্পনাটি সরল এবং সহজ। ইদানীং শোনা যায় যে মৎস্য শিকারী সমাজের প্রায় সবাই এটা ব্যবহার করছে। টেম্স মৎস্যশিকারী সমিতির কর্মকর্তারা দু’বছর আগে সত্যি এটা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু প্রস্তাবটি কয়েকজন প্রবীণ সদস্যের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তারা বলে যে সংখ্যাটা যদি একে দশ না হয়ে বিশ হয়, অর্থাৎ একটা মাছকে যদি বিশটা মাছ বলে গোনা হয় তাহলে প্রস্তাবটা বিবেচনা করা যেতে পারে।
নদীর ধারে একটা বিকাল কাটাবার সময় যদি তোমার থাকে, তাহলে আমি তোমাকে বলব কোন ছোট্ট গ্রামীণ পানশালায় গিয়ে বসতে। সেখানে তুমি নির্ঘাত দু’একজন বুড়ো ছিপওয়ালাকে দেখবে বসে বসে তাড়ি খাচ্ছে। তারা আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে এত মেছোগল্প শুনিয়ে দেবে যাতে অন্তত মাসখানেকের জন্য তোমার হজমশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
জর্জ আর আমি—হ্যারিসের কি হয়েছে জানি না, বিকেল নামতেই সে গিয়ে শেভ করে আসে, পুরা চল্লিশটা মিনিট ধরে জুতো সাফ পালিশ করে, তারপর থেকে তাকে আমরা আর দেখিনি, সুতরাং জর্জ আর আমি—এবং কুকুরটা ওয়েলিংফোর্ড চলে যাই বেড়াতে। এটা হচ্ছে দ্বিতীয় বিকেলের কথা। বেড়ানোর শেষে ফেরার পথে আমরা বিশ্রাম এবং অন্য কাজের জন্য নদীর ধারের একটা ছোট্ট পানশালায় যাই। আমরা গিয়ে বসি পার্লারে। এক বুড়ো ওখানে বসে বসে লম্বা মাটির পাইপে তামাক টানছিল। স্বাভাবিকভাবেই আলাপ শুরু হয় আমাদের মধ্যে।
বুড়োটি আমাদেরকে বলল যে বড় ভাল দিন গেছে আজ এবং আমরা তাকে বললাম যে কালকের দিনটা ছিল চমৎকার। তারপর আমরা সবাই একে অন্যকে বললাম যে আমরা মনে করি আগামী দিনটা হবে চমৎকার। জর্জ বলল যে এবারকার ফসল বেশ ভালই হবে দেখা যাচ্ছে।
তারপর কিভাবে যেন প্রকাশ হয়ে পড়ল যে আমরা বাইরের লোক এবং পরদিন সকালেই চলে যাচ্ছি ওই এলাকা ছেড়ে।
তারপর আলাপে ছেদ পড়ল কিছুক্ষণের জন্য। এই ফাঁকে কামরাটার চারদিকে নজর বুলাতে লাগলাম। আমাদের দৃষ্টি ঠেকে গেল চিমনির তাকের ওপর রাখা একটা ধুলোয় আচ্ছন্ন পুরানো কাচের বাক্সে। বাক্সটার ভেতরে রয়েছে একটা ট্রাউট মাছ। ওই ট্রাউটটা আমাকে যেন মুগ্ধ করে ফেলল। বস্তুত প্রথম দৃষ্টিতে ওটাকে আমি কড় ভেবেছিলাম।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বুড়োটি বলে উঠল, ‘আহ চমৎকার মাছ ওটা, তাই না?’
‘বেশ বিরল ধরনের,’ বললাম আমি বিড়বিড় করে। জর্জ বুড়োটিকে জিজ্ঞেস করল মাছটার ওজন কত হবে বলে সে মনে করে।
উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের কোট খুলতে খুলতে বলল আমাদের বুড়ো বন্ধুটি, ‘আঠারো পাউণ্ড ছয় আউন্স। ছ’বছর আগে, আগামী মাসের তিন তারিখে ছ’বছর পূর্ণ হবে, আমি ওটা ধরেছি। একটা পোনা মাছের টোপ দিয়ে ওটাকে আমি ধরি ব্রিজের ঠিক নিচে। লোকে আমাকে বলেছিল যে নদীতে মাছটা আছে। আমি তাদেরকে বলেছিলাম যে ব্যাটাকে ধরব এবং ধরেছিও। আজকাল এদিকে ওই সাইজের বেশি মাছ দেখা যায় না। শুভরাত্রি, সাহেবরা, শুভরাত্রি।’
চলে গেল লোকটা আমাদেরকে একা রেখে।
এরপর মাছটা থেকে আমরা চোখ সরাতে পারিনি। সত্যি, দারুণ মাছ ছিল ওটা।
আমরা তখনও চেয়ে আছি ওটার দিকে—এমন সময় স্থানীয় মোটবাহক একপট বিয়ার হাতে এসে দাঁড়াল কামরাটার দরজায়। সে-ও তাকিয়ে রইল মাছটার দিকে।
তার দিকে ফিরে জর্জ বলল, ‘মস্ত বড় ট্রাউট ওটা।’
‘আহ! আপনি তা বলতে পারেন, স্যার,’ জবাব দিল লোকটি। বিয়ারে একটা চুমুক দিয়ে সে আবার বলল, ‘ওই মাছটা যখন ধরা হয় তখন বোধ হয় আপনি এখানে ছিলেন না, স্যার?’
‘না,’ বললাম আমরা। এই এলাকায় আমরা নতুন।’
‘আহ!’ বলল মুটেটা, ‘তাহলে অবশ্য আপনারা কি করে জানবেন। প্রায় বছর পাঁচেক হলো আমি ওই মাছটা ধরেছি।’
‘ওহো! তুমিই তাহলে ধরেছিলে মাছটা?’ বললাম আমি
‘হ্যাঁ, স্যার,’ জবাব দিল বুড়ো লোকটি। ‘আমি ওটাকে ধরেছিলাম এক শুক্রবার বিকেলে — তখনকার লিস্টওয়েজ লকের ঠিক নিচে এবং এখানে উল্লেখ করার মত বস্তু হচ্ছে এই যে একটা কৃত্রিম টোপ দিয়ে ওটাকে ধরেছিলাম আমি। গিয়েছিলাম পাইক ধরতে। ট্রাউটের কথা চিন্তাও করিনি। যখন ওটা গিলে বসল আমার টোপ তখন আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। তা বুঝলেন কিনা, ছাব্বিশ পাউণ্ড ওজন ছিল মাছটার। শুভরাত্রি, ভদ্রলোকেরা, শুভরাত্রি।
মিনিট পাঁচেক পরে তৃতীয় ব্যক্তি এসে হাজির হলো। সে বলল কিভাবে একদিন সকালে ব্লীক মাছের টোপ দিয়ে ওটাকে সে বড়শিতে গেঁথেছিল। বর্ণনা শেষ হতেই চলে গেল লোকটা। এবার একজন ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখো মাঝ বয়সী লোক এসে জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসলেন।
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শেষে নবাগতের দিকে ফিরে জর্জ বলল, ‘মাফ করবেন। আশা করি, এখানটায় সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও আমরা যে স্বাধীনতাটা নিচ্ছি তাতে কিচ্ছু মনে করবেন না। আপনি কেমন করে ওই ট্রাউটটা ধরেছিলেন সেটা বললে আমার এই বন্ধুটি এবং আমি নিজে অত্যন্ত বাধিত হতাম।’
‘কি কাণ্ড, কে আপনাদেরকে বলেছে যে আমি ওটা ধরেছি!’ আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন তিনি
আমরা জানালাম যে কেউ বলেনি, তবে যেভাবেই হোক আমাদের মন যেন বলে দিল যে তিনিই কাজটা করেছেন।
‘আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য তো?’ হাসতে হাসতে জবাব দিলেন গোমড়ামুখো লোকটি, ‘কারণ প্রকৃত তথ্য হচ্ছে এই যে আপনারা ঠিকই আন্দাজ করেছেন। ওটা আমিই ধরেছি। কিন্তু আপনারা কেমন করে সেটা অনুমান করলেন? সত্যি এটা বড় অদ্ভুত ব্যাপার।’
তারপর তিনি আমাদেরকে বলে গেলেন কিভাবে মাছটা তুলতে তাঁর আধঘণ্টা লেগে যায় এবং কেমন করে ওটা তাঁর ছিপ ভেঙে ফেলে। তিনি বললেন বাড়ি ফিরে যত্নের সঙ্গে ওটার ওজন নিন। ওজন দাঁড়ায় কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চৌত্রিশ পাউণ্ড।
তিনি উঠে চলে যাবার পর এল বাড়িঅলা। তার ট্রাউটটি সম্পর্কে যেসব কাহিনী শুনেছি সেগুলো বললাম। সে খুবই মজা পেল। সবাই মিলে আমরা হাসলাম প্রাণখুলে।
‘ভাবুন দেখি একবার, জিম বেট্স, জো মাগস, মি. জোনস্ আর বুড়ো বিলি ম্যাণ্ডার্স সবাই কিনা আপনাদেরকে বলল যে ওটা তারাই ধরেছে। হা! হা! হা! বেশ-বেশ, ভাল।’ বুড়ো সৎ মানুষটি প্রাণখুলে হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ, তারা নিজেরা ধরলে আমার পার্লারে রাখার জন্য আমাকে দিত বৈ কি, তারা সেই ধরনের লোক বটে! হা! হা! হা!’
তখন সে মাছটার সঠিক ইতিহাস বলল আমাদেরকে। দেখা গেল যে মাছটা সে নিজেই ধরেছে, বহু বছর আগে, যখন সে খুবই ছোট ছিল। কোন রকম কৌশল বা দক্ষতার দ্বারা নয়, মাছটা সে ধরেছিল সেই দুয়ে ভাগ্যের গুণে যে সবসময় ভর করে সেই ছেলেটির ওপর যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে গাছের একটা ভাঙা শাখার মাথায় একটুখানি সুতো বেঁধে কোন সূর্যস্নাত বিকেলে চলে যায় বড়শি বাইতে।
সে আমাদেরকে বলল যে ট্রাউটটি বাড়িতে আনায় পিটুনি খাওয়া থেকে সে বেঁচে যায়। তার স্কুলের মাস্টার পর্যন্ত বলেছিলেন যে মাছটার মূল্য ত্রৈরাশিক অঙ্কের নিয়ম শেখা আর অঙ্ক কষার যোগফলের সমান।
এই পর্যায়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেল কামরা থেকে। জর্জ আর আমি আবার মাছটার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম।
সত্যি এক আশ্চর্যজনক মাছ ছিল ওটা। আমরা যত তাকাই ততই বিস্ময় আমাদের বৃদ্ধি পায়।
মাছটা জর্জকে এতই উত্তেজিত করে তোলে যে আরও ভাল করে দেখার জন্য সে একটা চেয়ারের পিঠে উঠে দাঁড়ায়। এতে চেয়ারটা যায় পিছলে এবং জর্জ পতন থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পাগলের মত আঁকড়ে ধরে ট্রাউটের বাক্সটি। ধড়াস করে ওটা পড়ে যায় নিচে, ওটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জর্জ আর চেয়ারটি।
আতঙ্কে ছুটে গিয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মাছটাকে ভেঙে ফেলোনি তো?’
সাবধানে উঠতে উঠতে চারদিকে তাকিয়ে জর্জ বলল, ‘আশা করি ভাঙেনি।’
কিন্তু ভেঙে সে ফেলেছে। হাজার টুকরা হয়ে ছড়িয়ে আছে ট্রাউটটি। আমি বলি হাজার টুকরা—তবে টুকরার সংখ্যা মাত্র নয় শতও হতে পারে। আমি ওগুলো গুণতে যাইনি।
একটা ঠাসা (Stuffed) ট্রাউট ভেঙে ওরকম ছোট ছোট টুকরা হয়ে যাবে এটা অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য ব্যাপার বলে মনে হলো আমাদের।
হ্যাঁ, ঠাসা ট্রাউট হলে ব্যাপারটা অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্যই হত বটে, কিন্তু ওটা ঠাসা ছিল না।
ওই ট্রাউটটি ছিল প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে বানানো।