ত্রিরত্নের নৌবিহার – ১৬

ষোলো

বেলা প্রায় এগারোটায় আমরা রীডিং-এর কাছাকাছি পৌঁছলাম। নদী এখানটায় নোংরা এবং নিরানন্দময়। রীডিং এলাকায় লোকে বেশিক্ষণ থাকে না। শহরটা অবশ্য এক বিখ্যাত প্রাচীন জায়গা। রাজা এথেলরেডের সেই বিস্মৃত-প্ৰায় দিনে ডেনরা তাদের যুদ্ধজাহাজগুলোকে কেনেটে নোঙর করে রীডিং থেকে গোটা ওয়েসেক্স ভূমিকে তছনছ করতে শুরু করে এবং এখানেই এথেলরেড আর তাঁর ভাই আলফ্রেড লড়াই করে তাদেরকে পরাজিত করেন। এথেলরেড করেন প্রার্থনা, আলফ্রেড করেন লড়াই।

পরবর্তীকালে লণ্ডনে পরিস্থিতি যখন অসন্তোষজনক হয়ে উঠত তখন রীডিংকে মনে হয় একটা হাতের কাছের পালানোর জায়গা বলে গণ্য করা হত। ওয়েস্টমিনিস্টারে প্লেগ দেখা দিলেই পার্লামেন্ট ছুটে চলে যেত রীডিং-এ। ১৬২৫ সালে আইন-আদালত ও পার্লামেন্টকে অনুসরণ করে, এবং কোর্টগুলো সব রীডিং-এ বসতে থাকে। আইনজীবী আর পার্লামেন্টের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য লণ্ডনে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু প্লেগ দেখা দেয়ার নিশ্চয় দরকার ছিল।

পার্লামেন্টের যুদ্ধের সময় এসেক্স-এর আর্ল রীডিং অবরোধ করেন। এর সিকি শতক পরে ওরেঞ্জ এর যুবরাজ এখানে রাজা জেমস্-এর বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

প্রথম হেনরি এখানে তাঁর নির্মিত বেনেডিক্টাইন মঠে সমাহিত রয়েছেন। মঠটির ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়। ওই মঠেই মহান জন অব গণ্ট-এর সাথে লেডি ব্লাঁকির বিয়ে হয়।

সকালে ঠিক হয়েছিল যে আমি দাঁড় টেনে রীডিং পার করে তিন মাইল পর্যন্ত নৌকা নিয়ে যাব। এখন তো আমরা রীডিং-এর দশ মাইল উজানে পৌঁছে গেছি। নিঃসন্দেহে এখন আবার দাঁড় টানার পালা ওদের। তবে জর্জ বা হ্যারিস কাউকেই আমি বিষয়টা বোঝাতে পারলাম না। সুতরাং আর তর্ক না করে দাঁড় দুটো তুলে নিলাম। মিনিট খানেক দাঁড় টানতে না টানতেই জর্জ দেখল যে পানিতে কালোমত কি একটা যেন ভাসছে। আমরা এগিয়ে গেলাম জিনিসটার দিকে। কাছে যেতে জর্জ ঝুঁকে পড়ে ধরে ফেলল জিনিসটাকে এবং তার পরেই চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে গেল। মুখটা তার হয়ে গেল রক্তশূন্য।

ওটা ছিল এক স্ত্রীলোকের লাশ। পানির ওপর হালকাভাবে ভেসে ছিল। মুখটা মিষ্টি এবং শান্ত। সুন্দর নয়। দেখতে অতি অকাল-পক্ক, খুব পাতলা, টানটান। ক্লেশ এবং দারিদ্র্যের ছাপমারা হলেও মুখটা ছিল কোমল এবং কমনীয়। সেই মুখে এমন একটা প্রশান্তির ভাব ছিল যেমনটা শেষ যন্ত্রণা ছেড়ে গেলে কোন রুগ্ন ব্যক্তির মুখে ফুটে ওঠে।

থানা-কোর্টে ঘুরে বেড়ানোর কোন আকাঙ্ক্ষা আমাদের ছিল না। আমাদের ভাগ্যক্রমে তীরে দাঁড়ানো কয়েকজন লোকও লাশটি দেখতে পেয়েছিল। ওরা এখন আমাদের হাত থেকে লাশটির ভার নিল।

আমরা পরে স্ত্রী লোকটির কাহিনী শুনি। অবশ্যই সেটা সেই পুরানো, অতি পুরানো অশ্লীল বিয়োগান্ত কাহিনী। সে ভালবেসে প্রতারিত হয়েছিল—কিংবা নিজেই নিজেকে প্রতারিত করেছিল—যা আমরাও কেউ কেউ মাঝেমধ্যে করি। তার পরিবার এবং বন্ধুরা স্বভাবতই এতে দারুণ আঘাত পায় এবং ক্রুদ্ধ হয়। তারা ওর জন্য নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।

লজ্জার জাঁতাকল ঘাড়ে নিয়ে দুনিয়ার সাথে একাকী যুঝতে গিয়ে সে কাহিল থেকে কাহিলতর হয়ে পড়তে থাকে। দৈনিক বারো ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সপ্তাহে সে বারো শিলিং পেত। ওটা দিয়ে কিছুদিন সে তার নিজের এবং বাচ্চাটার ভরণপোষণ চালায়। ছয় শিলিং দিতে হত বাচ্চাটার জন্য। বাকিটা দিয়ে সে নিজের দেহ আর আত্মাকে একত্রে ধরে রাখত।

কিন্তু সপ্তাহে ছয় শিলিং দিয়ে দেহ ও আত্মাকে খুব দৃঢ়ভাবে একত্রে ধরে রাখা যায় না। ওদের মধ্যেকার বাঁধুনিটা যখন এরকম ক্ষীণ হয় তখন ওরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চায়। একদিন, আমার মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকার বেদনা এবং ভোঁতা একঘেয়েমি অন্যদিনের চাইতে পরিষ্কারভাবে তার চোখের সামনে এক অশরীরী প্রেতমূর্তির মত দাঁড়িয়ে তাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। সে ভয় পেয়ে যায়। শেষবারের মত সে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-জনের কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু বিপথগামী বর্জিতজনের সেই আবেদনটি তাঁদের মান—সম্মানের হিমায়িত দেয়ালে চিড় ধরাতে ব্যর্থ হয়। তখন সে যায় তার বাচ্চাকে দেখতে। ক্লান্ত বিমর্ষভাবে এবং কোন রকমের বিশেষ আবেগের প্রকাশ না ঘটিয়ে বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খায় সে। এক পেনি দামের একটি চকলেটের প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল সে শিশুটির জন্য—সেটা গুঁজে দেয় ওর হাতে। তারপর সে চলে যায় বাচ্চাটিকে ছেড়ে। এবার শেষ যে ক’টি শিলিং তার কাছে ছিল সেগুলো দিয়ে একটা টিকেট নিয়ে সে চলে আসে গোরিং-এ।

গোরিং-এর বনভূমি এবং উজ্জ্বল সবুজ মাঠ প্রান্তরের সাথেই বোধ হয় জড়িত ছিল তার জীবনের তিক্ততম ভাবনাগুলো। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে, যে ছোরাটি ওদেরকে আঘাত হানে ওটাকেই তারা বুকে জড়িয়ে ধরে। হয়তো সেই তিক্ততার মধ্যে ওখানকার বড় বড় গাছগুলোর নুয়ে পড়া শাখা-প্রশাখার ঘন ছায়াতলে যাপিত মধুর মুহূর্তগুলোর সোনালী স্মৃতিও মিশে ছিল।

সারাদিন সে ঘুরে বেড়ায় নদীর ধারে বনে বনে। তারপর নেমে আসে সন্ধ্যা, ধূসর গোধূলি তার কালো চাদরখানি মেলে ধরে পানির ওপর। তখন সে তার দু’বাহু মেলে দেয় নদীর দিকে-যে নদী তার দুঃখ আর আনন্দের সাক্ষী। এবং নদী তাকে গ্রহণ করে কোমল বাহু বাড়িয়ে, তার ক্লান্ত মাথাটিকে শুইয়ে দেয় আপন বুকে, ধুয়ে দেয় তার সকল ব্যথা-বেদনা।

এমনি করে সে পাপ করে সব কিছুতে—পাপ করে জীবনে এবং মৃত্যুতে। খোদা তাকে সাহায্য করুন! সাহায্য করুন অন্য সব পাপীকে, যদি আরও কেউ থাকে।

নদীর বাঁ তীরে গোরিং এবং ডান তীরে স্ট্রীটলি উভয়ই দিন কতক থাকার জন্য চমৎকার জায়গা। আমরা চেয়েছিলাম ওই দিনই ওয়েলিংফোর্ড পর্যন্ত এগিয়ে যেতে। কিন্তু এখানে নদীর মিষ্টি হাসি মুখ আমাদেরকে কিছুক্ষণ থেকে যেতে প্রলুব্ধ করল। ব্রিজের কাছে নৌকা রেখে আমরা স্ট্রীটলিতে গিয়ে ‘বুল’ হোটেলে লাঞ্চ করলাম। মন্টমোরেন্সি দারুণ খুশি হলো এতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *