ত্রিরত্নের নৌবিহার – ১৫

পনেরো

পরদিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙল দেরিতে। হ্যারিসের একান্ত ইচ্ছায় আমরা সাদামাঠা ধরনের ব্রেকফাস্ট করলাম। ব্রেকফাস্টের পর ধোয়ামোছা সেরে প্রায় দশটার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

একমত হয়েছিলাম যে আমরা এদিন সকালটায় গুণ না টেনে দাঁড় বাইব। হ্যারিস মনে করল সবচেয়ে ভাল হবে যদি জর্জ আর আমি দাঁড় বাই, আর সে হাল ধরে বসে। আইডিয়াটা মোটেই মেনে নিতে না পেরে আমি বললাম—হ্যারিস যদি বলত সে আর জর্জ কাজ করবে এবং আমাকে একটুখানি বিশ্রাম দেবে, তবেই সে প্রকৃত সদিচ্ছার পরিচয় দিতে পারত। আমার মনে হচ্ছিল এ যাত্রায় আমি ন্যায্য হিস্যার চেয়ে বেশি কাজ করে যাচ্ছি এবং এটা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছিল।

সব সময় আমার মনে হয় যতটা করা উচিত তার চাইতে বেশি কাজ আমি করছি। তার মানে অবশ্য এ নয় যে কাজ করতে আমার আপত্তি আছে। কাজ আমি পছন্দ করি, কাজ আমাকে মোহিত করে। কাজের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি বসে থাকতে পারি। কাজকে আমি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। কাজ শেষ করে ফেলার কথা ভাবতে গেলেই বুকটা আমার প্রায় ফেটে যেতে চায়।

খুব বেশি কাজ আমাকে গছানো যাবে না। কাজ জমানো আমার কাছে একটা প্রায় আবেগের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার স্টাডিটা কাজে একদম ভর্তি হয়ে আছে। ওখানে এক ইঞ্চি জায়গাও আর খালি নেই। শিগগিরই আমাকে কামরাটার সঙ্গে একটা নতুন অংশ যোগ করতে হবে।

কাজের যত্নও আমি নিই বৈ কি। আরে ভাই, আমার হাতে এমন সব কাজ রয়েছে, যার কোন কোনটা বছরের পর বছর ধরে আমার দখলে আছে এবং ওগুলোর ওপর একটা আঙুলের ছাপও পড়তে পারেনি আজ পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে আমি এসব কাজের লিস্টি বানাই, ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলি। আর কেউ তার কাজকে আমার চেয়ে বেশি সুরক্ষিত অবস্থায় রাখে না।

কিন্তু কাজ-পাগল লোক হলেও পক্ষপাতিত্ব আমি পছন্দ করি না। আমার যা ন্যায্য হিস্যা তার বেশি কাজ আমি চাই না।

কিন্তু না চাইলেও বেশি কাজ আমি পেয়ে যাই—অন্তত আমার সেরকমই মনে হয়, এবং এটাই আমার উদ্বেগের কারণ।

জর্জ বলে সে মনে করে না যে বিষয়টা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে। তার ধারণা ন্যায্য পাওনার চেয়ে বেশি কাজ পাচ্ছি বলে আমার যে ভয় সেটা শুধু আমার অতিসন্দিগ্ধ প্রকৃতিরই ফল। আসলে যে পরিমাণ কাজ আমার করা উচিত তার অর্ধেকের বেশি আমি করছি না। আমি মনে করি, জর্জ আমাকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই এসব বলে।

নৌকায় চলাচল কালে আমি লক্ষ করেছি যে ক্রুদের প্রত্যেকেরই বদ্ধমূল ধারণা থাকে—সে একাই সব কিছু করছে। হ্যারিসের ধারণা সে একা কাজ করে যাচ্ছে এবং জর্জ আর আমি তাকে ঠকিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে, হ্যারিস খাওয়া আর ঘুমানোর বেশি আর কিছু করছে এরকম কথাকে তো জর্জ হেসেই উড়িয়ে দিল। তার ঢালাই লোহার মত শক্ত অভিমত হলো—বলার মত সব কাজই করেছে সে, জর্জ স্বয়ং।

জর্জ বলে দিল, হ্যারিস আর আমার মত ফাঁকিবাজ কুঁড়ে লোক নিয়ে আর কোনদিন বাইরে বেরোয়নি সে।

তার এ মন্তব্যে বেশ মজা পেল হ্যারিস। আমার দিকে ফিরে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এইবার সেরেছে, বুড়ো জর্জটা কাজ নিয়ে কথা বলছে! আরে, আধ ঘণ্টা কাজ করলেই তো ব্যাটা অক্কা পাবে। বলো তো, জর্জকে তুমি কাজ করতে দেখেছ কোনদিন?’

এই বলে হাসতে লাগল হ্যারিস।

হ্যারিসের সাথে একমত হয়ে আমি বললাম যে না, কখনও দেখিনি—অন্তত এ যাত্রায় তো নয়ই।

প্রত্যুত্তরে জর্জ হ্যারিসকে বলল, ‘কাজ আমি করেছি, না তুমি করেছ, এ ব্যাপারে তোমার তো বেশি কিছু জানার কথা নয়, কারণ আমি নিশ্চিত যে অর্ধেকটা সময় তুমি ঘুমিয়েই কাটিয়েছ। খাওয়ার সময় ছাড়া অন্য কোন সময় হ্যারিসকে তুমি কখনও পুরোপুরি জেগে থাকা অবস্থায় দেখেছ?’ প্রশ্ন করল জর্জ আমাকে।

সত্যের খাতিরে আমি বাধ্য হলাম জর্জকে সমর্থন করতে। নৌকায় হ্যারিসকে শুরু থেকে কোন কাজেই পাওয়া যায়নি।

‘আরে রেখে দাও ওসব বোলচাল। অন্তত জেরোমটার চাইতে বেশি কাজ আমি করেছি,’ জবাব দিল হ্যারিস।

জর্জ বলল, ‘তা ঠিক, ওর চেয়ে কম তুমি কেমন করে করবে।’

হ্যারিস বলল, ‘জেরোমটা বোধ হয় ভাবে যে সে একজন প্যাসেঞ্জার।’

হ্যারিস একথা বলল আমার সম্পর্কে, যে আমি কিনা তাদেরকে এবং তাদের হতচ্ছাড়া নড়বড়ে নৌকাটাকে কিংস্টন থেকে গোটা পথটা নিয়ে এলাম, তাদের হয়ে সব কিছুর তদারক আর ব্যবস্থাপনা করলাম, তাদের যত্ন নিলাম, খেটে মরলাম। এই-ই হচ্ছে সে সবের প্রতিদান, তাদের কৃতজ্ঞতা। দুনিয়ায় রীতিটাই হলো এরকম।

উপস্থিত ঝগড়াটা আমরা মিটালাম এভাবে: হ্যারিস আর জর্জ দাঁড় বেয়ে রীডিং পার হয়ে যাবে। সেখান থেকে আমি গুণ টানব। প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে ইদানীং কোন আকর্ষণই খুঁজে পাই না আমি একটা সময় ছিল, অনেকদিন আগে, যখন কঠিন কাজের জন্য আমি শোরগোল তুলতাম। এখন আমি তরুণদেরকে সুযোগ দিতে চাই।

আমি লক্ষ করেছি যে জোর বাতাস আর কড়া স্রোতের বিপরীতে নৌকা বাইতে হলেই প্রবীণ নেয়েদের অনেকেই হাত গুটিয়ে ফেলে। একজন পরানো লোক যেভাবে নৌকার তলায় বিছানা পেতে লম্বা হয়ে শুয়ে গত বছর নৌকা বাইতে গিয়ে কিসব অবিশ্বাস্য কাজ করেছিল সে কাহিনী শুনিয়ে দাঁড়ীদেরকে উৎসাহ দিতে থাকে তা দেখলেই বোঝা যায় যে লোকটা প্রবীণ

যে দু’জন ঘামে ভেজা আনাড়ী ছোকরা গত আড়াই ঘণ্টা ধরে অতিকষ্টে উজানে নৌকা বেয়ে চলেছে তাদেরকে লক্ষ্য করে আরামে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে টেনে টেনে বলে, ‘এটাকে তোমরা কঠিন কাজ বলতে চাও? ইচ্ছে হলে অবশ্য বলতে পারো। তবে কি জানো, গত বছর জিম বাইফস্, জ্যাক আর আমি এক বিকেলের মধ্যে নৌকা বেয়ে মার্লো থেকে গোরিং পর্যন্ত চলে যাই—একবারও না থেমে। তোমার মনে আছে, জ্যাক?’

জ্যাক নামক লোকটা যত সব কোট-কম্বল কুড়িয়ে নৌকার মাথার দিকে বিছিয়ে গত দু’ঘণ্টা যাবৎ ঘুমোচ্ছিল। এরকম আচমকা প্রশ্নে আংশিকভাবে জেগে উঠে সে ব্যাপারটার যেটুকু তার মনে আছে তা বলে যায়। তার আরও মনে পড়ে যে গোটা পথটা তাদেরকে যেতে হয়েছিল দমকা হাওয়া ঠেলে।

‘প্রায় চৌত্রিশ মাইল, হ্যাঁ তাই মনে হয় আমার, এর কম ছিল না পথটা।’ বলতে বলতে প্রথম বক্তা নিজের মাথার নিচে গোঁজার জন্য আরেকটা গদি টেনে নেয়।

‘না হে, টম, বাড়িয়ে বোলো না। বড়জোর তেত্রিশ মাইল ছিল পথটা।’ মৃদু তিরস্কারের সুরে বলে জ্যাক।

এটুকু কথাবার্তা বলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে জ্যাক আর টম আবার ঢলে পড়ে ঘুমের কোলে। ওদিকে সেই সরল-মনা আনাড়ী ছোকরা দু’টো জ্যাক আর টমের মত অমন নামজাদা দাঁড়ীকে নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে যাবার সৌভাগ্যে নিজেদেরকে দারুণ গর্বিত মনে করে আগের চাইতেও জোরে জোরে দাঁড় টানতে থাকে।

আমি ছোটবেলায় বড়দের কাছ থেকে এসব গালগল্প শুনতাম, শুনে বিশ্বাস করতাম, গিলতাম এবং প্রতিটি শব্দ হজম করে আরও শুনতে চাইতাম। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে পুরানো দিনের সেই সরল বিশ্বাস নেই। গত মওসুমে একবার জর্জ, হ্যারিস আর আমি এক নতুন ছোকরাকে সাথে নিয়েছিলাম। আমরা তাকে নদীপথে আমাদের চমকপ্রদ সব কীর্তিকাহিনী শোনাই।

অতীতে বছরের পর বছর ধরে যেসব বাসি প্রচলিত মিথ্যা গালগল্প দিয়ে মাঝি-মাল্লারা কাজ চালিয়ে এসেছে সেগুলো তো তাকে শোনালামই, উপরন্তু সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিলাম আমাদের নিজেদের বানানো সাতটা সম্পূর্ণ নতুন গল্প। এদের মধ্যে একটা গল্প এমন ছিল, যা আসলেই ঘটতে পারত। গল্পটা প্রায় সত্য ঘটনা দিয়ে তৈরি। বছর কয়েক আগে ওই ঘটনাটি কিছুটা অন্যভাবে আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঘটেছিল। এটা এমন গল্প যা বিশ্বাস করলে একটা বাচ্চারও কোন ক্ষতি হবে না।

কিন্তু আমাদের তরুণ সাথীটি সব ক’টা গল্পকে উপহাস করে উড়িয়ে দেয়। সে দাবি করে, আমরা যেন তখনি গল্পে বর্ণিত কীর্তি-কাণ্ডগুলো করে দেখাই। সে জোর দিয়ে বলে যে ওই কাজগুলো আমরা করিনি।

গোটা সকালটা আমরা কাটালাম আমাদের নৌকা বাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে গালগল্প করে এবং দাঁড় টানার প্রথম প্রয়াসের স্মৃতি রোমন্থন করে।

আমার নৌকায় ওঠার পয়লা অভিজ্ঞতাটা বলি। আমরা ছিলাম পাঁচজন। প্রত্যেকে তিন পেনি করে চাঁদা দিয়ে রিজেন্ট পার্ক লেকে অদ্ভুত আকারের একটা নৌকা ভাড়া করে চড়ে বসি। শেষকালে চৌকিদারের ঘরে বসে থেকে আমাদেরকে জামা-কাপড় শুকাতে হয়।

এভাবে পানির স্বাদ পাবার পর আমি বেশ কিছুদিন শহরতলীর ইটখোলাগুলোতে ভেলায় চড়ে বেড়াই। ভেলায় চড়া যতটা কল্পনা করা যায় তার চেয়ে বেশি মজাদার এবং উত্তেজনাকর। বিশেষ করে সেই সময় যখন তুমি থাকো পুকুরের মাঝখানে, আর তিনি, মানে, যাঁর জিনিসপত্র দিয়ে ভেলাটা বানানো হয়েছে সেই মানুষটি, হঠাৎ মস্ত বড় একটা লাঠি নিয়ে হাজির হন পুকুরের পাড়ে।

ভদ্রলোককে দেখে প্রথম যে অনুভূতিটা তোমার মনে জাগে তা হলো এই যে তাঁকে সঙ্গ দানের কোন ইচ্ছাই তোমার নেই, কোনক্রমেই তুমি নিজেকে তাঁর সাথে আলাপের উপযুক্ত বলে ভাবতে পারছ না এবং অভদ্রতা না দেখিয়ে যদি পারা যায় তাহলে তুমি বরং তাঁর সাক্ষাৎ এড়িয়েই যাবে। সুতরাং তোমার লক্ষ্য হবে তিনি যে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার বিপরীত পাড়ে নেমে চুপচাপ এবং চটপট বাড়ি চলে যাওয়া। ওদিকে তাঁর মনোভাব কিন্তু দেখা যায় অন্যরকম। তোমার হাত ধরে আলাপ করতে বেজায় উদ্‌গ্রীব তিনি।

মনে হয় যে তিনি তোমার বাবাকে চেনেন এবং তোমার সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। কিন্তু এটা তোমাকে তাঁর প্রতি মোটেই আকৃষ্ট করে না। তিনি বলেন তাঁর তক্তা দিয়ে ভেলা বানানো তোমাকে শিখিয়ে দেবেন। কিন্তু তুমি যে ওই কাজটা ইতোমধ্যেই বেশ ভাল করেই শিখে ফেলেছ তা তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে ওরকম প্রস্তাব দেয়ার দরকার ছিল না বলেই মনে হয় তোমার, যদিও প্রস্তাবটা যে তিনি দয়া বশতই দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই ওটা গ্রহণ করে তাঁকে কষ্ট দেয়ার কোন ইচ্ছাই তোমার হয় না।

কিন্তু তোমার এ শীতল মনোভাব তাঁকে দমাতে পারে না। তোমার সাথে দেখা করার জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা, এবং তুমি যেখানেই নামো ঠিক সে জায়গাতেই তোমাকে সম্ভাষণ জানাবার জন্য যে উদ্যম নিয়ে তিনি পুকুরের এপাড়ে ওপাড়ে ছুটাছুটি করতে থাকেন সেটা, সত্যি রীতিমত তৃপ্তিদায়ক।

তিনি যদি মোটাসোটা হাঁফ-ধরা গোছের লোক হন তাহলে তাঁকে এড়ানো সহজ হয়, কিন্তু জোয়ান আর লম্বা ঠ্যাংওয়ালা লোক হলে মোলাকাতটি অনিবার্য হয়ে ওঠে। সাক্ষাৎকারটি অবশ্য সংক্ষিপ্তই হয়। কথাবার্তা যা বলার তিনিই বলেন। তোমার মন্তব্যগুলো হয় বেশিরভাগই ‘হ্যাঁ, হুঁ’ ধরনের এবং তাঁর হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে তুমি ছুটে পালাও।

প্রায় মাস তিনেক আমি মেতে ছিলাম ভেলায় চড়া নিয়ে। তারপর শিল্পের ওই শাখাটিতে যতটা দক্ষতা থাকা দরকার সেটা অর্জন করে ফেলায় আমি নৌকা চালানোর সিদ্ধান্ত নিই এবং লী-নদীর এক নৌ-চালক ক্লাবে যোগ দিই।

লী-নদীতে নৌকায় উঠলেই, বিশেষত শনিবার বিকেলে, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে নৌকা সামলানো, অথবা বজরার নিচে চাপা পড়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য তৎপর হতে হয়। চলন্ত গুণের দড়ির ধাক্কায় উল্টে গিয়ে নদীতে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য ত্বরিতে ও সুন্দর ভঙ্গিতে নৌকার তলায় বারে বারে শুয়ে পড়ার কায়দা শেখার প্রচুর সুযোগও এতে পাওয়া যায়।

কিন্তু এভাবে নৌকা বেয়ে কোন স্টাইল অর্জন করা যায় না। আমি স্টাইল, খুঁজে পাই টেমস্ নদীতে এসে। আমার নৌকা বাওয়ার স্টাইলটির এখন বেশ সুনাম। লোকে বলে যে ওটা বড় অদ্ভুত।

জর্জ ষোলো বছর বয়স হবার আগে পানির ধারেকাছেও যায়নি কোনদিন। ষোলো বছর পার হবার পর সে তার বয়সী আরও আটজনের সঙ্গে দলবেঁধে এক শনিবারে কিউ-তে যায়। ওদের মতলব ছিল একটা নৌকা ভাড়া করে রিচমণ্ড যাবে এবং ওখান থেকে ফিরে আসবে। জোসকিন্স নামে ওদের এক ঝাঁকড়াচুলের সাথী একবার কি দু’বার সার্পেনটাইন নদীতে নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিল। সে ওদেরকে বলেছিল যে নৌকা বাওয়া দারুণ মজার ব্যাপার!

ওরা যখন নদীর ঘাটে পৌঁছায় তখন জোর ভাঁটার টান শুরু হয়ে গেছে এবং বাতাসও বইছে প্রবল বেগে। কিন্তু এতে মোটেও চিন্তিত না হয়ে ওরা নৌকা বাছাই করতে থাকে।

ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলোর মধ্যে ছিল আট দাঁড়ের একটা মাস্তুলওয়ালা বাইচের নৌকা। ওটাই নজর কাড়ল ওদের। ওরা বলল ওটাই দেয়া হোক ওদেরকে। মাঝি গিয়েছিল অন্য কোথাও। নৌকায় ছিল শুধু তার ছেলেটি। সে বেচারা চেষ্টা করল ওদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করতে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াবার উপযোগী অন্য দু’তিনটা নৌকা দেখাল সে ওদেরকে। কিন্তু ওরা কানেই নিল না ছেলেটার কথা। ওই বাইচের নৌকাটাই ওদের চাই। ওদের ধারণা, ওই নৌকায় চাপলেই ওদেরকে ভাল দেখাবে।

অগত্যা ছেলেটি খুলে দিল নৌকা। গায়ের কোট খুলে ওরা তৈরি হলো আসনে বসার জন্য। ছেলেটি পরামর্শ দেয় যে জর্জ হোক চার নম্বর মাল্লা, কারণ তখনকার দিনেও যে কোন দলের মধ্যে জর্জকেই দেখাত সবচেয়ে বেশি ভারি এবং বলিষ্ঠ। জর্জ বলল চার নম্বর হওয়াতে সে খুশিই হয়েছে। জর্জকে তার উপযুক্ত জায়গায় বসিয়ে দিয়ে অন্যরাও বসে পড়ে যার যার আসনে। দুর্বলচিত্ত একটা ছেলেকে দেয়া হয় হাল ধরতে। জোসকিন্স তাকে হাল ধরার কায়দাকানুন সব বুঝিয়ে দিয়ে নিজে বসে যায় দাঁড় টানতে। সবাইকে সে বলে যে কাজটা খুবই সোজা: সে যা করবে সবাই যেন তা-ই করে যায়। সবাই জানায় যে ওরা তৈরি। কূলে—দাঁড়ানো মাঝির ছেলেটা তখন আঁকশি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে এগিয়ে দেয় স্রোতের মধ্যে।

এরপর কি ঘটে যায় তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে জর্জ অক্ষম। জর্জের তালগোল পাকানো স্মৃতিতে শুধু এটুকু আছে যে যাত্রার ঠিক পরক্ষণেই পাঁচ নম্বরের দাঁড়ের হাতল এক প্রচণ্ড আঘাত হানে ওর মাথার ঠিক পেছন দিকের গোলাকৃতি অংশটায়, সঙ্গে সঙ্গে যেন কি এক যাদুমন্ত্রে ওর নিচে থেকে বসার আসনটা যায় অদৃশ্য হয়ে এবং সে পড়ে থাকে নৌকার তলায় পাতা তক্তার ওপর। আরও একটি পরিস্থিতি ওর নজরে পড়ে। সে দেখে যে দু’নম্বর মাল্লাটি ওই একই মুহূর্তে শুয়ে পড়েছে নৌকার তলায় এবং পা দু’টো তার শূন্যে। স্পষ্টত সে মূর্ছিত।

কিউ ব্রিজের তলা দিয়ে ঘণ্টায় আট মাইল বেগে ওরা ছুটে যায় পাশাপাশি অবস্থায়। দাঁড় বাইছিল একমাত্র জোসকিন্স। জর্জ নিজের আসনটি উদ্ধার করে ওকে সাহায্যের চেষ্টা করে। কিন্তু তার দাঁড়টি পানিতে ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে দারুণভাবে বিস্মিত করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় নৌকার তলায় এবং তাকেও নিয়ে যেতে চায় টান মেরে।

ওদিকে হাল ধরেছিল যে ছেলেটি, সে হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে।

ওরা কিভাবে ফিরে এসেছিল সেটা এখনও জর্জের অজ্ঞাত। কিউ ব্রিজের ওপর তখন ভিড় জমে গেছে কৌতূহলী জনতার। বেশ মজা করে তারা দেখছিল তামাশাটা। চিৎকার করে একেক জন একেক রকম নির্দেশ দিচ্ছিল ওদেরকে। তিনবার ওরা নৌকাটাকে ব্রিজের খিলানের নিচ দিয়ে পার করে নিতে সক্ষম হয়, আর তিনবারই স্রোত ওদেরকে টেনে ফিরিয়ে আনে খিলানের নিচে। হালধরা ছেলেটা যতবার দেখে মাথার ওপর ব্রিজ, ততবারই নতুন করে কেঁদে ওঠে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

জর্জ বলল সেদিন বিকেলে সে ভাবতেই পারেনি যে নৌকা বাওয়া সত্যিকারভাবে আর কোনদিন তার ভাল লাগবে।

হ্যারিস নদীর চাইতে সাগরে নৌকা বাইতেই বেশি আগ্রহী। সে বলে যে ব্যায়াম হিসাবে ওটা তার বেশি পছন্দের। সাগরে নৌকা বাইতে আমার ভাল লাগে না।

মনে পড়ে, গত বছর গরমের দিনে ইস্টবোর্নে একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। বছর কয়েক আগে আমি বেশ কিছুদিন সাগরে নৌকা বেয়েছি। তাই ভেবেছিলাম এবারও কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু দেখলাম যে কৌশলটা পুরাপুরিই ভুলে গেছি। একটা দাঁড় যখন পানির গভীরে ডোবানো, অন্যটা তখন লাফিয়ে উঠতে লাগল শূন্যে। দুইটি দাঁড় একসাথে পানিতে ডুবিয়ে টান মারার জন্য প্রতিবারই আমাকে উঠে দাঁড়াতে হচ্ছিল। ফলে দৃশ্যটা দেখার জন্য ইতর—ভদ্র সকলের ভিড় জমে যায়। এরকম হাস্যকর ভঙ্গিতে আমাকে তাঁদের সামনে দিয়ে দাঁড় বেয়ে যেতে হয়। তীরের কাছাকাছি গিয়ে নৌকা রেখে এক বুড়ো নেয়ের সাহায্যে আমি ডাঙায় উঠি

কোন বুড়ো মাল্লার নৌকা বাওয়া দেখতে আমার ভাল লাগে, বিশেষ করে এমন একজনের—যাকে ঘণ্টার হিসাবে নৌকা বাওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছে। তার পদ্ধতির মধ্যে অতি চমৎকার রকমের শান্ত এবং নিশ্চল একটা কিছু প্রক্রিয়া থাকে। এ জিনিসটা সেই বিরক্তিকর তাড়াহুড়া আর তীব্র প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত—যা প্রতিদিনই ক্রমবর্ধমানভাবে উনিশ শতকীয় জীবনযাত্রার সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার জন্য শরীরটাকে খাটাতে সে মোটেও রাজি নয়। আর কোন নৌকা তাকে ধরে ফেললে বা পেছনে ফেলে চলে গেলে সে বিরক্ত হয় না। আসলে সে যেদিকে যাচ্ছে সেদিকের যাত্রী সব নৌকাই ওকে পেছনে ফেলে যায়। এরকম কাণ্ড ঘটলে অন্য যে কোন লোক ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হত। কিন্তু ভাড়া করা মাল্লা এসব গ্রাহ্যই করে না। তার মহৎ প্রশান্তি থেকে আমরা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে একটা চমৎকার শিক্ষা লাভ করতে পারি।

জর্জ বলল রুচি বদলের জন্য তার প্রায়ই ইচ্ছা হয় শালতি নৌকা চালাতে। শালতি চালানো এবং ওটা সামলানো অল্পদিনেই রপ্ত করা যায়। তবে মর্যাদা বজায় রেখে এবং ছলকে ওঠা পানিতে কাপড় জামা না ভিজিয়ে কাজটা করতে হলে দীর্ঘ অনুশীলনের দরকার হয়।

আমার পরিচিত একটা ছেলে শালতি চালাতে গিয়ে প্রথম দিনেই অত্যন্ত দুঃখজনক একটা দুর্ঘটনায় পড়ে যায়। সে এতই ভাল চালাচ্ছিল যে এতে তার মধ্যে একটা উদ্ধত ভাব জেগে ওঠে। শালতির এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে বেড়াতে থাকে সে। লগিটা এমন অবহেলার ভঙ্গিতে ঠেলতে থাকে—যা দেখতে সত্যি আকর্ষণীয়। নৌকার মাথায় গিয়ে লগিটা মাটিতে ঠেলে সে দৌড়ে যেতে থাকে অপর প্রান্তে, তারপর এক দৌড়ে আবার নৌকার মাথায়। ঠিক পাক্কা শালতিওয়ালার মত! আহ্! কি সুন্দরই না চালাচ্ছিল সে।

এবং সুন্দরভাবেই ব্যাপারটা চলত যদি না সে দুর্ভাগ্যক্রমে, চারদিককার দৃশ্য দেখার জন্য বাইরে তাকাতে গিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটিবার পা বাড়িয়ে শালতির একেবারে বাইরে চলে যেত। লগিটা দৃঢ়ভাবে পোঁতা ছিল কাদার মধ্যে। ওটাই সে আঁকড়ে ধরে রইল, আর শালতিটা চলে গেল ভাসতে ভাসতে। অবস্থানটা তার জন্য ছিল অমর্যাদাকর। তীর থেকে এক বেয়াদপ ছোকরা ওর পিছিয়ে পড়া সাথীকে ডাক দিয়ে বলে, “শিগগিরই আয়, লাঠির আগায় একটা বাঁদর বসে আছে। দেখবি তো ছুটে আয়।’

আমি যেতে পারছিলাম না তার সাহায্যে, কারণ দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা উপযুক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে একটা বাড়তি লগি নিয়ে আসিনি। শুধু বসে বসে দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। তার ভারে লগিটা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছিল কাদার ভেতর। ওই সময় তার চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল তা আমি কোনদিন ভুলব না। অনেক ভাবনা-চিন্তাই ছিল তার সেই অভিব্যক্তির মধ্যে।

আমি দেখলাম তার শরীরটা ধীরে ধীরে পানিতে নেমে গেল, দেখলাম হাত—পা ছুঁড়ে সাঁতরে ভিজে জবজবে হয়ে বিষণ্ন মুখে সে তীরে গিয়ে উঠল। তাকে এমন হাস্যকর দেখাচ্ছিল যে না হেসে আমি পারলাম না। হেসেই যাচ্ছিলাম কিছুক্ষণ ধরে। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলো যে অবস্থাটা যা দাঁড়িয়েছে সেটা ভাবতে গেলে আমার এতে হাসার মত কিছুই আসলে নেই। আমি তো রয়েছি তারই ভেসে যাওয়া শালতির মধ্যে, একলা এবং লগি ছাড়া। নদীর মাঝখান দিয়ে ভেসে চলেছি হয়তো কোন মাছধরা বাঁধের দিকে

নৌকার বাইরে পা বাড়িয়ে এভাবে সরে পড়ায় বন্ধুটির ওপর আমার ভীষণ রাগ হতে থাকে। ব্যাটা গেল তো গেল, যাবার আগে অন্তত লগিটা আমাকে দিয়ে যেতে পারত!

প্রায় সিকি মাইল ওভাবে ভেসে গেলাম। তারপর আমার নজরে পড়ে মাঝ—দরিয়ায় নোঙর করা একটা শালতিতে বসে দুই বুড়ো জেলে মাছ ধরছে। আমার নৌকা ওদের দিকে ছুটে যাচ্ছে দেখে ওরা চিৎকার করে আমাকে বলল সরে যেতে, ওদের ওপর গিয়ে না পড়তে।

পাল্টা চিৎকার দিয়ে আমি বললাম, ‘পারছি না।’

ওরা বলল, ‘তুমি তো চেষ্টাই করছ না।’

কাছাকাছি যাওয়ার পর ব্যাপারটা ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম। ওরা আমাকে ধরে ফেলে একটা লগি দিয়ে দিল। মাছ ধরার বাঁধটি ছিল ওখান থেকে মাত্র গজ পঞ্চাশেক ভাঁটিতে। ভাগ্যিস্ জেলে দু’জন ওখানে ছিল।

আমি যেদিন প্রথম শালতি নৌকা চালাতে যাই সেদিন আমার সঙ্গে আরও তিনজন ছিল। কথা ছিল, কাজটা কিভাবে করতে হয় সেটা ওরা আমাকে দেখিয়ে দেবে। আমরা সবাই একসাথে যেতে পারছিলাম না। তাই বলি যে আমি প্রথমে গিয়ে শালতিটা বের করব। তারপর ওরা আসা পর্যন্ত কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরব, প্র্যাকটিস করব।

কিন্তু কোন শালতি পেলাম না। সব ভাড়া হয়ে গেছে। অগত্যা তীরে বসে নদীর দৃশ্য দেখা আর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কিছু আমার করার ছিল না।

বসে আছি বেশিক্ষণ হয়নি, এমন সময় আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো একটা শালতি নৌকার মধ্যে একজন লোকের প্রতি। কিছুটা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম যে লোকটার জ্যাকেট আর টুপি হুবহু আমারি মত। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে শালতি চালানোর ব্যাপারে সে এক্কেবারে আনাড়ি। সে যা করছিল সেটা বড়ই মজার। সে লগি মারলে নৌকার কি হবে, বা ওটা কোন্ দিকে যাবে, তা বলার উপায় ছিল না। স্পষ্টত সে নিজেও তা জানত না। একেকবার সাঁ করে সে চলে গেল উজানে, একেকবার তীরবেগে ভাঁটির দিকে এবং মাঝে মাঝে শুধু ঘুরতে লাগল বনবন করে, ঘুরতে ঘুরতে চলে গেল লগির অন্য পাশে। এবং প্রতিবারের চেষ্টার ফল দেখেই মনে হলো সে সমানভাবে বিস্মিত ও বিরক্ত।

ওই সময় নদীর কাছাকাছি যারা ছিল তারা সবাই গভীর কৌতূহল নিয়ে দেখতে লাগল তাকে। তার লগির পরবর্তী ঠেলার ফল কি হবে সেটা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে বাজি ধরতে লাগল তারা।

যথাসময়ে আমার বন্ধুরা এসে হাজির হলো নদীর অপর তীরে। ওরাও দাঁড়িয়ে গিয়ে দেখতে লাগল তাকে। তার পেছনটা ওদের দিকে ফেরানো ছিল বলে ওরা শুধু জ্যাকেট আর টুপিই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে সঙ্গে সঙ্গে ওরা ধরে নেয় যে ওই লোকটা আমি–ওদের প্রিয় সাথী এবং তামাশাটা আমিই দেখাচ্ছি। ওদের তখন আনন্দের আর সীমা-পরিসীমা রইল না। নির্মমভাবে লোকটাকে টিটকারি দিতে লাগল ওরা।

আমি প্রথমে ওদের ভুল ধরতে না পেরে ভাবলাম, ‘কেমন অভদ্র ব্যবহার, বিশেষ করে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের সঙ্গে! কিন্তু ওদেরকে ডেকে আচ্ছা করে বকে দেয়ার আগেই ব্যাপারটার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এবং আমি তখন একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিলাম।

ওহো, কি মজাই না ওরা উপভোগ করল ওই ছেলেটাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে! পাঁচ-পাঁচটা মিনিট ধরে ওরা তার উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ল, তাকে উপহাস করল, ভেংচি দিল, বিদ্ধ করল তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ বাণে। যতসব বাসী কৌতুক ওরা নিক্ষেপ করল তার উদ্দেশ্যে, এমনকি নিজেরাও কয়েকটা নতুন কৌতুক বানিয়ে ছুঁড়ে মারল তাকে। আমাদের ঘরোয়া মহলে ব্যবহৃত হয় এমন সব পারিবারিক ঠাট্টা-বিদ্রূপ যেগুলো তার কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হবার কথা—সেগুলোও তার উদ্দেশে বর্ষণ করল ওরা। তারপর—ওদের বর্বর ঠাট্টা-বিদ্রূপ আর সহ্য করতে না পেরে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। ওরা দেখতে পেল তার মুখটি!

আমি দেখে খুশি হলাম যে বিলকুল বোকা বনে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় ভদ্রতাটুকুও ওদের মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে। ওরা বুঝিয়ে বলল যে তাকে ওরা নিজেদের পরিচিত একজন বলে মনে করেছিল। নিজেদের ব্যক্তিগত বন্ধু ছাড়া আর কাউকে ওরা ওইভাবে অপমান করতে পারে এটা সে মনে করবে না বলে, আশা প্রকাশ করল ওরা।

এভাবে কৈফিয়ত দেওয়াতে ব্যাপারটা অবশ্য ওখানেই মিটে যায়।

আমার মনে পড়ছে হ্যারিস একবার আমাকে তার এক স্নানের কাহিনী শুনিয়েছিল। সৈকতের কিনার ঘেঁষে সাঁতার কাটছিল সে। এমন সময় সে টের পায় যে পেছন থেকে কে যেন হঠাৎ তার ঘাড় ধরে জোর করে ডুবিয়ে ধরেছে পানিতে। ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু করে সে। তাকে ধরেছিল যে লোকটা সে মনে হয় হারকিউলিসের মত বলিষ্ঠ। ওই লোকের হাত থেকে ছাড়া পাবার সব চেষ্টাই বিফল হয়। অবশেষে হাত-পা ছোঁড়া, লাথিমারা সব বন্ধ করে হ্যারিস পরকালের দিকে মন ফেরাচ্ছে—এমন সময় লোকটা ছেড়ে দেয় তাকে।

পায়ে মাটি ঠেকতেই উঠে দাঁড়ায় হ্যারিস, চোখ মেলে খুঁজতে থাকে লোকটাকে—যে কিনা খুন করতে বসেছিল তাকে। হবু আততায়ী তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তখন হাসছিল প্রাণখুলে। কিন্তু যে মুহূর্তে হ্যারিসের মুখটি তার নজরে পড়ল অমনি চমকে উঠে পিছিয়ে গেল সে। বিবর্ণ হয়ে গেল তার চেহারা।

বিভ্রান্তভাবে তোতলাতে তোতলাতে লোকটা বলল, ‘আমি সত্যি ক্ষমা চাই আপনার কাছে, আপনাকে আমি আমার এক বন্ধু বলে মনে করেছিলাম।’

হ্যারিসের তখন মনে হয় যে তার ভাগ্য ভাল, তাই ভুল করে আত্মীয় বলে মনে করেনি। আত্মীয় মনে করলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ডুবিয়ে মেরে ফেলত।

পালের নৌকা চালাতে জ্ঞান এবং অভ্যাস দুটোই লাগে, যদিও ছেলেবেলায় আমি ওরকম মনে করতাম না। আমার ধারণা ছিল পালের নৌকা চালানো আপনা-আপনি শিখে ফেলা যায়। আরেকটা ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেও আমার মত ভাবত। এক ঝড়ো দিনে আমরা দু’জনে ঠিক করলাম যে কাজটাতে হাত লাগিয়ে দেখব। আমরা তখন থাকতাম ইয়ারমাউথে। মতলব করলাম ইয়ার নদীতে পাল তুলে নৌকা ভাসাব। পুলের কাছ থেকে একটা পালের নৌকা ভাড়া করে যাত্রাও করলাম দু’জনে।

ছাড়ার সময় নৌকাওয়ালা বলল, ‘আজকের দিনটা তেমন ভাল নয়, বাতাসের জোরটাও বড্ড বেশি। পালটা বরং কিছুটা গুটিয়ে নিন। বাঁকের কাছে পৌঁছলেই ধাঁ করে ঘুরিয়ে নৌকাকে বাতাসের দিকে সোজা করে দেবেন।’

আমরা বললাম—তাই করব। উল্লাসভরে তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিন্তু সে যা বলেছিল তার একটি বর্ণও মাথায় ঢোকেনি আমাদের। আমরা জানতাম না ওসব কাজ কিভাবে করতে হয়।

শহর থেকে যতদূর দৃষ্টি যায় আমরা দাঁড় বেয়ে এগুলাম। তারপর সামনে পড়ল এক বিস্তীর্ণ জলরাশি। তার ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়ের মত। আমরা বুঝলাম কাজ শুরু করার সময় হয়ে গেছে।

হেক্টর—ওটাই বোধ হয় ছিল ছেলেটার নাম—দাঁড় টানতে লাগল, আর আমি খুলতে লাগলাম পালটা। কাজটি বেশ জটিলই মনে হচ্ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত ওটা আমি করে ফেললাম। তারপর প্রশ্ন দেখা দিল পালের কোন দিকটা ওপরে থাকবে।

এক ধরনের সহজাত প্রেরণার দরুন আমরা অবশ্য সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিচের দিকটাই ওপরের দিক। তাই নিচের দিক ওপরে আর ওপরের দিক নিচে করে পালটা খাটাতে লেগে গেলাম। কিন্তু এভাবে চেষ্টা করে ওটাকে ওপরে তুলতেই অনেক সময় লেগে গেল আমাদের। এতে পালটার মনে বোধ হয় এরকম ধারণা জন্মাল যে আমরা লাশ দাফনের অভিনয় করছি এবং আমিই হচ্ছি লাশ, আর সে নিজে হচ্ছে কাফন।

যখন পালটা দেখল যে ব্যাপার আসলে তা নয় তখন তার খুঁটি দিয়ে কষে এক ঘা লাগিয়ে দিল আমার মাথায়। এরপর সে আর কিছুই করতে রাজি হলো না।

হেক্টর বলল, ‘ভিজিয়ে নে, নদীর পানিতে ফেলে ভিজিয়ে নে ওটাকে।’

সে আরও বলল যে জাহাজীরা খাটানোর আগে পালকে সব সময় ভিজিয়ে নেয়। সুতরাং আমিও ভিজালাম। কিন্তু এতে আগের চাইতে অবস্থার শুধু অবনতিই ঘটল। শুকনা পালে পা জড়িয়ে যাওয়া, মাথা পেঁচিয়ে যাওয়া মোটেও আনন্দের ব্যাপার নয়, কিন্তু যখন পালটা থাকে ছপ্‌ছপে ভিজা তখন ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় রীতিমত বিরক্তিকর।

দু’জনে মিলে আমরা শেষ পর্যন্ত জিনিসটাকে ওপরে ওঠালাম এবং খাটালামও, কিন্তু ঠিক উল্টো করে—অর্থাৎ ওপরের দিক নিচে আর নিচের দিক ওপরে করে নয়—অনেকটা পাশাপাশিভাবে। তারপর ওটাকে নৌকার দড়ি দিয়ে বাঁধলাম মাস্তুলের সঙ্গে।

নৌকাটা উল্টে যায়নি এটা আমি উল্লেখ করছি শুধুমাত্র একটা তথ্য হিসাবে। কেন উল্টে যায়নি তার কোন কারণ আমি দিতে পারব না। পরে আমি বিষয়টা বহুবার ভেবে দেখেছি কিন্তু কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।

নৌকাটা না উল্টাবার কারণ হয়তো এই ছিল যে দুনিয়ার সব জিনিসের মধ্যেই একটা সহজাত একগুঁয়েমি থাকে এবং নৌকাটারও ছিল। সেই একগুঁয়েমিই ওটাকে উল্টে যেতে দেয়নি। আমাদের কার্যকলাপ এক নজর দেখেই নৌকাটা হয়তো এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল যে আমরা প্রাভাতিক আত্মহত্যা অভিযানে বেরিয়েছি এবং তক্ষুণি সে আমাদের মতলব ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য কৃতসঙ্কল্প হয়।

নৌকা না উল্টানোর ব্যাপারে এটাই আমার একমাত্র ব্যাখ্যা।

মরণ আলিঙ্গনে নৌকার দু’পাশের কিনার জাপটে ধরে আমরা নিজেদেরকে কোনরকমে কেবল নৌকার ভেতরে রাখতে পারলাম, কিন্তু কাজটা বড় ক্লান্তিকর। হেক্টর বলল প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে জলদস্যু এবং অন্য জাহাজীরা বড় পালটা টেনে নামিয়ে ফেলে এবং আমাদেরও তা করা উচিত। কিন্তু আমি ছিলাম নৌকার মাথা বাতাসের দিকে সোজা করে রাখার পক্ষে।

আমার উপদেশ অনুসরণ করাটাই ছিল সবচেয়ে সোজা। তাই করলাম আমরা। নৌকার মাথার ভার নৌকার হাতে ছেড়ে দিয়ে দু’পাশের কিনার আঁকড়ে থাকার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলাম। নৌকা উজানের দিকে মাইলখানেক পর্যন্ত ছুটে গেল এমন এক প্রচণ্ড গতিতে, যে গতিতে আমি আর কোনদিন পাল তুলে যাইনি এবং যেতে চাইও না। তারপর হঠাৎ অলৌকিকভাবে দিক পরিবর্তন করে নৌকা ছুটে গেল নরম কাদাময় দীর্ঘ নিচু তীরের দিকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *