চোদ্দ
লাঞ্চের পর বাতাস উঠল। সেই বাতাসে পাল তুলে তরতর করে আমরা চলে গেলাম ওয়ারগ্রেভ আর শিপলেক পার হয়ে। নদীর বাঁক ঘেঁষে গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলের নিদ্রালু রোদে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা ওয়ারগ্রেভ শহরটিকে দেখাচ্ছিল একটা মধুর পুরানো ছবির মত। দৃশ্যটা বহুদিন মনে রাখার উপযুক্ত।
শিপলেক হচ্ছে একটা সুন্দর গ্রাম। কিন্তু পাহাড়ের ওপরে হওয়াতে নদী থেকে চোখে পড়ে না। এখানকার গির্জায় টেনিসনের বিয়ে হয়েছিল।
সোনিং-এ পৌঁছে আমরা নৌকা থেকে নামলাম গ্রামটা একটু ঘুরে দেখার জন্য। পরীর দেশের মত সুন্দর জায়গা। এ যেন চুন-বালিতে গাঁথা বাড়িঘর নিয়ে তৈরি গ্রাম নয়, কোন রঙ্গমঞ্চের সাজানো গ্রাম। প্রতিটি বাড়িতে বসেছে গোলাপের মেলা।
প্রায় ঘণ্টাখানেক সোনিং-এ ঘোরার পর রীডিং পর্যন্ত যাবার সময় হবে না ভেবে আমরা ঠিক করলাম শিপলেকের একটা দ্বীপে ফিরে গিয়ে রাতটা ওখানেই কাটাব। দ্বীপে গিয়ে দেখা গেল কিছুটা বেলা তখনও রয়ে গেছে। জর্জ বলল, হাতে যখন যথেষ্ট সময় আছে তখন রাতের জন্য ভাল রান্নাবান্নার চমৎকার সুযোগ মিলবে। নদীপথে রান্নার ক্ষেত্রে কি করা সম্ভব তা আমাদেরকে দেখিয়ে দেবে সে। আমাদের উচিত তরি-তরকারি, মাংস এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুর যা যা অবশিষ্ট আছে সব দিয়ে আইরিশ স্ট্যু বানানো।
আইডিয়াটা মোহনীয় মনে হলো। লাকড়ি কুড়িয়ে এনে জর্জ আগুন জ্বালিয়ে দিল। হ্যারিস আর আমি বসে গেলাম ছুরি দিয়ে কেটে গোল-আলুর খোসা ইত্যাদি ছাড়াতে। আলুর খোসা ছাড়ানো যে এরকম একটা ঝামেলার কাজ তা আমার কখনও ভাবতে পারার কথা ছিল না। এ ধরনের যত কাজ করেছি তার মধ্যে এটাই দেখলাম সবচেয়ে কঠিন। আমরা শুরু করি খোশমেজাজে, বলা যায়—প্রায় খামখেয়ালী ভাব নিয়ে। কিন্তু প্রথম আলুটার খোসা ছাড়াতেই আমাদের ফূর্তির ভাবটা উবে গেল। যত ছাড়াই ততই যেন খোসা থেকে যায়। ছাড়াতে ছাড়াতে শেষে দেখা গেল যে আলুর—অন্তত আলু বলা যায় এমন কিছুর অস্তিত্বই আর নেই। জর্জ এসে দেখল, যা অবশিষ্ট আছে ওটা মটরশুঁটির মত একটা বস্তু। সে বলল, ‘উঁহু, এটা চলবে না। তোমরা আলুগুলোকে নষ্ট করছ। এভাবে নয়, খোসা চেঁচে তুলতে হবে।’
অতএব চেঁচে তুলতে লাগলাম আমরা। এ কাজটা ছুরি দিয়ে ছাড়ানোর চাইতেও কঠিন। আর, আলুগুলোর আকার-আকৃতিও এমন— কোথাও আঁবের মত ফুলে বেরিয়ে আছে, কোথাও বা ভেতরের দিকে চাপা গর্তের মত হয়ে আছে। একটানা পঁচিশ মিনিট কাজ করার পর আমরা মাত্র চারটা আলুর খোসা চেঁচে তুললাম। তারপর হাত গুটিয়ে বললাম যে সন্ধ্যার বাকি সময়টা লেগে যাবে আমাদের গা থেকে আলুর খোসা ছাড়াতে। মানুষকে লেজে-গোবরে অবস্থায় ফেলার জন্য আলুর খোসা তোলার মত জিনিস আর হয় না। হ্যারিস আর আমার শরীরের অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আলুর খোসায়। এতটা খোসা যে মাত্র চারটা আলু থেকে বেরুতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এতে দেখা গেল, যত্নের সাথে আর হিসাব করে কাজ করলে কি অসাধ্য সাধন করা যায়।
জর্জ বলল, ‘আইরিশ স্ট্যুতে মাত্র চারটা আলু—এটা হাস্যকর। কাজেই আরও দশ-বারোটা আলু ধুয়ে খোসা না ছাড়িয়েই ফেলে দিলাম হাঁড়ির মধ্যে। তার সঙ্গে দিলাম একটা বাঁধাকপি, সিকি বুশেলের অর্ধেক মটরশুঁটি। জর্জ সেগুলো নেড়েচেড়ে দিয়ে বলল যে হাঁড়িতে আরও বেশ কিছুটা জায়গা আছে মনে হচ্ছে তাই বড় ঝুড়ি দুটো টেনে এনে টুকরা-টাকরা নানা জিনিস এবং এটা-ওটার অবশিষ্ট অংশ খুঁজে নিয়ে ফেলে দিলাম হাঁড়িতে। অর্ধেকটা পর্ক পাই এবং কিছু পরিমাণ ঠাণ্ডা সেদ্ধ বেকন পড়ে ছিল ঝুড়ির তলায়। আমরা সেগুলোও মিশিয়ে দিলাম স্ট্যুর মধ্যে। জর্জ খুঁজে বের করল আধা টিন স্যামন মাছের ঝোল। ওটাও সে উপুড় করে ঢেলে দিল হাঁড়ির মধ্যে।
সে বলল যে এ-ই হচ্ছে আইরিশ স্টার সুবিধা — অনেক কিছুই সাফ করে ফেলা যায়। আমি হাতড়াতে হাতড়াতে ক’টা ডিম পেয়ে গেলাম। ওগুলো তখনও ফেটে যায়নি। ডিমগুলোও আমরা হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে দিলাম। জর্জ বলল, এতে ঝোলটা গাঢ় হবে।
আর কি কি জিনিস দেয়া হয়েছিল মনে পড়ছে না, তবে এটা জানি যে কিছুই অপচয় করা হয়নি। আমার স্মরণ আছে যে মণ্টমোরেন্সি আমাদের কার্যকলাপের প্রতি আগাগোড়া মহা আগ্রহ দেখাচ্ছিল। শেষ দিকে সে যেন কি একটা দৃঢ় সঙ্কল্প ও চিন্তা নিয়ে একদিকে চলে যায় এবং মিনিট কয়েক পরেই ফিরে আসে একটা পচা ইঁদুর মুখে করে। স্পষ্টতই সে চেয়েছিল আমাদের ডিনারে তার নিজস্ব অবদান হিসাবে ওটা উপহার দিতে। তবে, সে বিদ্রূপের মনোভাব নিয়ে অথবা সাহায্য করার সাধারণ আগ্রহ দ্বারা তাড়িত হয়ে এটা করেছিল তা আমি বলতে পারি না।
ইঁদুরটাকে হাঁড়ির মধ্যে ফেলা উচিত কি উচিত নয়—এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করলাম। হ্যারিস বলল, তার মতে ইঁদুরটা হাঁড়িতে দেয়াই ঠিক হবে, তাহলে সেটা অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে মিশে যাবে। সে বলল যে যত ছোট বা সামান্যই হোক, সব জিনিসই কাজে লাগে। কিন্তু জর্জ নজীরের প্রশ্ন তুলে বলল, আইরিশ স্ট্যুতে জলাভূমির ইঁদুর মেশানোর কথা সে আগে কখনও শোনেনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে সে যেতে চায় না, সে চায় নিরাপদ থাকতে।
হ্যারিস বলল, ‘নতুন কিছু পরীক্ষা না করলে কেমন করে জানবে জিনিসটা কেমন? তোমার মত লোকরাই দুনিয়ার প্রগতিতে বাধা দেয়। যে লোকটা জীবনে প্রথম জার্মান সসেজ খেয়ে দেখেছিল তার কথাটা একবার ভেবে দেখো তো?’
দারুণ জিনিস হয়েছিল ওই আইরিশ স্ট্যুটা। এমন স্বাদের খাবার আর কোনদিন বোধহয় খাইনি। ওটার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা খুব তাজা এবং ঝাঁঝালো। পুরানো একঘেয়ে খাবারে মুখের রুচি নষ্ট হয়ে যায়। এ ছিল এমন একটা খাবার যা স্বাদে এবং গন্ধে অভিনব, অতুলনীয়।
খাবারটা পুষ্টিকরও ছিল বটে। জর্জের ভাষায় এর মধ্যে ছিল ভাল ভাল উপাদান। মটরশুঁটি আর আলুগুলো আরেকটু নরম হলে ভাল হত। তবে আমাদের সবার দাঁতই ছিল শক্ত এবং মজবুত। কাজেই খেতে কোন অসুবিধাই হয়নি। আর, ঝোলটার কথা কি বলব—যেন একটা কবিতা। দুর্বল পেটের জন্য হয়তো একটুখানি গুরুপাক, তবে নিঃসন্দেহে পুষ্টিকর।
চা আর চেরী-টার্ট দিয়ে ভোজনপর্বটা শেষ করলাম আমরা। চা খাওয়ার সময় কেটলিটার সঙ্গে মণ্টমোরেন্সির লড়াই বেধে যায় এবং সেই লড়াইতে মণ্টমোরেন্সির লজ্জাস্কর পরাজয় ঘটে।
আমাদের গোটা যাত্রাকালটায় মন্টমোরেন্সি কেটলির প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহল দেখাতে থাকে। কেটলিতে পানি ফোটানোর সময় সে বিমূঢ়ভাবে বসে বসে ওটাকে লক্ষ করত এবং যখন-তখন গোঁ গোঁ করে ওটাকে খেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করত। কেটলি থেকে ফুটন্ত পানির ছিটা ও বাষ্প বেরুতে শুরু করলে সে ব্যাপারটাকে তার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ বলে গণ্য করত এবং কেটলির সঙ্গে লড়াই করতে চাইত। তবে সে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তেই কেউ না কেউ ছুটে গিয়ে তার শিকারটিকে তুলে নিয়ে যেত।
আজ সে ঠিক করেছিল যে কেউ এসে তুলে নেয়ার আগেই লড়াইটা সেরে ফেলবে। কেটলি থেকে পানি ফোটার প্রথম শব্দ শোনা মাত্রই গোঁ গোঁ আওয়াজ করে উঠে দাঁড়াল মন্টমোরেন্সি এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেল ওটার দিকে। কিন্তু ছোট্ট হলে কি হবে, কেটলিটারও সাহস ছিল পুরামাত্রায়। তাই বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে থু-থুর মত করে গরম পানি ছিটিয়ে দিল সে মণ্টমোরেন্সির দিকে।
‘কি! এত সাহস তোর!’ দাঁত বের করে গর্জে উঠল মন্টমোরেন্সি, আমি হলাম গিয়ে কঠোর পরিশ্রমী একজন গণ্যমান্য কুকুর। আমার সাথে বে-আদবী! তোকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। ওরে ব্যাটা হতচ্ছাড়া, লেম্বা-নেকো, নোংরা-মুখো পাঁজিটা, আয় দেখি!’
ছুটে গেল সে বেচারা কেটলিটার দিকে, কামড়ে ধরল কেটলির নলটা।
তখন সেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ হলো এক রক্ত-জমানো কেঁউ কেঁউ চিৎকারে। নৌকা থেকে ছুটে নেমে গেল মণ্টমোরেন্সি, ঘণ্টায় পঁয়ত্রিশ মাইল বেগে তিনবার চক্কর দিল দ্বীপটার চারদিকে এবং মাঝে মাঝে থেমে নরম কাদার মধ্যে নাকটা ডোবাতে লাগল।
সেদিন থেকে মন্টমোরেন্সি কেটলিটাকে লক্ষ করে ভয়, সন্দেহ আর ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টিতে। কেটলিটাকে দেখলেই লেজ গুটিয়ে গোঁ গোঁ করে পিছিয়ে যায় সে। ওটাকে উনুনে চাপানোর সঙ্গে সঙ্গেই নেমে যায় নৌকা থেকে এবং গোটা চা পর্বটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তীরে বসে থাকে।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর জর্জ তার ব্যাঞ্জোটা বের করে বাজাতে চাইল। কিন্তু হ্যারিস আপত্তি তুলে বলল যে তার মাথা ধরেছে, ওটা সে সহ্য করতে পারবে না। জর্জ ভাবল বাজনাটায় হ্যারিসের উপকারই হবে। সে বলল যে বাজনা প্রায় ক্ষেত্রেই স্নায়ুকে ঠাণ্ডা করে এবং মাথাব্যথা সারিয়ে দেয়। ব্যাঞ্জোর তারে দু’তিনটা টোকা মেরে হ্যারিসকে সে দেখাতে চাইল কেমন লাগে।
হ্যারিস বলল, এর চাইতে তার মাথাব্যথাই ভাল এবং ওটাই থাকুক।
আজ পর্যন্ত জর্জ ব্যাঞ্জো বাজাতে শেখেনি। তাকে চারদিক থেকে প্রবলভাবে বাধা দেয়া হয়েছে। আমরা নৌকায় থাকাকালে দুই কি তিনদিন সন্ধ্যায় চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু কখনও সফল হয়নি। হ্যারিসের ভাষাটা ছিল যে কোন লোকের মনোবল নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তার সাথে যোগ দিয়েছিল মণ্টমোরেন্সি।
জর্জ যখন বাজাত সেই পুরো সময়টা সে বসে বসে একটানা চিৎকার দিয়ে যেত।
মণ্টমোরেন্সিকে বুটজুতা ছুঁড়ে মেরে চেঁচিয়ে উঠত জর্জ, ‘আমি বাজাতে শুরু করলেই ব্যাটা ওরকম বিলাপ জুড়ে দেয় কেন?’
খপ্ করে বুটটা ধরে ফেলে পাল্টা জবাব দিত হ্যারিস, ‘ও বিলাপ শুরু করলে তুমি কেন ওভাবে বাড়াতে চাও? ওকে তুমি ঘাঁটিয়ো না। চিৎকার না করে পারে না ও। ওর সঙ্গীতের কান আছে, বুঝলে? তোমার বাজনাই ওকে চিৎকার দিতে বাধ্য করে।’
অতএব ব্যাঞ্জো অনুশীলনটা বাড়ি না পৌঁছা পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় জর্জ। কিন্তু বাড়িতেও বেশি সুযোগ পায়নি সে। মিসেস পি, ছুটে এসে বলতেন যে তিনি নিজে খুবই দুঃখিত, তিনি তার বাজনা শুনতে চান, তবে কিনা ওপরতলার গিন্নীটার অবস্থা বেশ নাজুক এবং ডাক্তার ভয় করছেন যে বাজনায় বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।
এরপর জর্জ গভীর রাতে পার্কে গিয়ে বাজাবার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টা সম্পর্কে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক রাতে পুলিশ পাহারাদার এসে পাকড়াও করে তাকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্পষ্ট প্রমাণিত হওয়ায় ছ’মাসের জন্য শান্তি বজায় রাখতে আইনত দায়বদ্ধ করা হয় তাকে।
এই ঘটনার পর ব্যাঞ্জো বাজানোর ব্যাপারে সে যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। শাস্তির ছ’মাস কেটে যাবার পর একবার-কি-দু’বার সে কাজটা আবার শুরু করার দুর্বল চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রতিবারই বাসিন্দাদের ওই রকম বিরূপতা এবং সহানুভূতিহীনতার সম্মুখীন হয়। কিছুদিন পরে পুরাপুরি হতাশ হয়ে ব্যাঞ্জোটা অনেক কম দামে বেচে দেয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়, ‘মালিকের আর জিনিসটার প্রয়োজন নাই।’ ব্যাঞ্জো ছেড়ে তাসের কৌশল শিখতে লেগে যায় সে।
বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা অবশ্যই একটা হতাশাজনক কাজ। আপনি মনে করবেন, সমাজের উচিত তার নিজের খাতিরে কোন লোককে একটা বাদ্য বাজানোর কায়দা-কৌশল আয়ত্ত করতে সর্বরকমে সহায়তা করা। কিন্তু সমাজ তা করে না।
আমি এক সময় এক তরুণকে জানতাম। সে ব্যাগ-পাইপ বাজানো শিখছিল। তাকে যে পরিমাণ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় তা জানলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আপনারা যাকে সক্রিয় উৎসাহদান বলতে পারেন সেটা নিজের পরিবারের কাছ থেকেও পায়নি বেচারা। তার বাপ তো গোড়া থেকেই ওটার বিরোধিতা করেন এবং বিষয়টা সম্পর্কে অত্যন্ত হৃদয়হীনের মত কথাবার্তা বলেন।
আমার ওই বন্ধু খুব ভোরে উঠত অনুশীলনের জন্য। কিন্তু নিজের দিদির বিরোধিতার দরুন পরিকল্পনাটি তাকে ত্যাগ করতে হয়। তার দিদিটি ছিলেন একটু ধর্মপরায়ণ। তিনি বলতেন যে দিনটা ওভাবে শুরু করা বড় বিশ্রী ব্যাপার বলে মনে হয় তাঁর।
অগত্যা রাত জেগে বসে থাকত সে এবং পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাজাত। কিন্তু এটাও চলল না, কারণ এতে বাড়ির বদনাম হয়ে গেল। গভীর রাতে ঘরমুখো মানুষেরা তাদের বাড়ির সামনে এসে থেমে যেত তার বাজনা শুনে এবং পরদিন সকালেই শহরময় রটিয়ে দিত যে আগের রাতে মি. জেফারসনের বাড়িতে একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। তারা বর্ণনা করত কিভাবে নিহত, ব্যক্তির আর্তচিৎকার, খুনীর পাশব গালাগাল, নিহত ব্যক্তির কাকুতি-মিনতি এবং মুমূর্ষু অবস্থায় তার গলার শেষ ঘড়ঘড় আওয়াজ পর্যন্ত তারা শুনতে পেয়েছে।
কাজেই, পরিবারের লোকেরা বাড়ির পেছনকার রান্নাঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে অনুশীলনের অনুমতি দেয় তাকে। কিন্তু এতসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাজনার কিছু কিছু আওয়াজ এখান থেকে বৈঠকখানা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে তার মাকে কাঁদিয়ে দিতে থাকে।
তার মা বলতেন যে বাজনাটা তাঁর দুর্ভাগা বাপের কথা (নিউগিনি উপকূলে সমুদ্রস্নানের সময় হাঙ্গরের পেটে যায় লোকটা) মনে পড়িয়ে দেয়। ছেলের বাজনার সঙ্গে ওই ঘটনার যোগাযোগটা কোথায় তা অবশ্য মহিলা বলতে পারতেন না।
এরপর ওরা বাড়ি থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে বাগানের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট ঘর বানিয়ে দেয় তার জন্য এবং তাকে বাধ্য করে বাজানোর ইচ্ছে হলে যন্ত্রটা নিয়ে ওখানে চলে যেতে। মাঝেমাঝে মেহমান আসতেন বাড়িতে। মেহমান ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না এবং বাড়ির লোকরাও ভুলে যেত তাঁকে বলে সাবধান করে দিতে। বেচারা মেহমান পায়চারি করতে করতে চলে যেতেন বাগানে এবং গিয়েই হঠাৎ কোন রকম পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়া, অথবা জিনিসটা কি তা না জেনে, পড়ে যেতেন ব্যাগ পাইপের বাজনার আওতায়। লোকটা যদি শক্ত মনের অধিকারী হতেন তাহলে শুধু মূর্ছাই যেতেন, কিন্তু গড়পড়তা বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন লোককে ওই বাজনাটা সাধারণত উন্মাদ করে দিত।
সৌখিন ব্যাগ-পাইপ বাদকদের প্রাথমিক প্রয়াসের মধ্যে যে বিষাদময় কিছু একটা আছে একথা স্বীকার করতেই হবে। ওই তরুণ বন্ধুটির বাজনা শুনতে শুনতে আমি নিজেই তা অনুভব করেছি। ব্যাগ-পাইপ বাজানোটা বড় কষ্টকর কাজ।
খাওয়ার পর থেকেই হ্যারিসের মেজাজটা বড় তিরিক্ষি হয়ে আছে। আমার মনে হলো এর মূলে রয়েছে ওই আইরিশ স্ট্য। গুরুপাক জিনিস খেতে সে অভ্যস্ত নয়। কাজেই তাকে নৌকায় রেখে জর্জ আর আমি চললাম হেনলিতে একটা চক্কর মেরে আসার জন্য। হ্যারিস বলল সে নৌকায় বসে বসে এক গ্লাস হুইস্কি খাবে, আর পাইপ টানবে এবং রাতের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখবে। আমরা ফিরে এসে হাঁক দিলেই দ্বীপ থেকে নৌকা বেয়ে গিয়ে আমাদেরকে তুলে আনবে।
যাত্রার সময় আমরা বললাম, ‘ঘুমিয়ে পড়ো না যেন, বুড়ো মিঞা।’
দ্বীপের দিকে নৌকা টানতে টানতে ঘোঁত ঘোঁত করে সে জবাব দিল, ‘এ’ স্ট্যটা যতক্ষণ পেটে আছে ততক্ষণ সেই ভয়টা তেমন নেই।’
হেনলি শহর তৈরি হচ্ছিল নৌকা বাইচের জন্য। হৈ-হল্লা শোরগোল চলছিল পুরোদমে। ওখানে বেশ কয়েকজন পরিচিত লোকের দেখা পেয়ে গেলাম আমরা। তাদের আনন্দময় সঙ্গ পেয়ে সময়টা আমাদের একটু তাড়াতাড়িই কাটল। ফলে, ফিরতি চার মাইলের হাঁটাপথে যাত্রা শুরু করতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল।
রাতটা ছিল বিষণ্ন, শীত শীত। বৃষ্টি পড়ছিল ঝিরঝির করে। অন্ধকার মেঠো পথে অতিকষ্টে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কথা বলছিলাম মৃদু স্বরে। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম ঠিক পথে যাচ্ছি, না ভুল পথে, সেটা নিয়ে। আমরা ভারতে আরম্ভ করলাম আমাদের আরামের নৌকাটির কথা, শক্ত করে আঁটা ক্যানভাসের আবরণ, ভেদ করে আসা উজ্জ্বল আলোর কথা, হ্যারিস আর মন্টথোরেন্সির কথা, হুইস্কির কথা। আফসোস হলো কেন নৌকায় থাকলাম না সেজন্য।
হাঁটতে হাঁটতে কল্পনার দৃষ্টিতে দেখলাম যে আমরা নৌকাতেই আছি এবং আমরা ক্লান্ত ও কিছুটা ক্ষুধার্ত। দেখলাম, অন্ধকারে ঢাকা নদীটাকে, আকারহীন অস্পষ্ট গাছপালা এবং সেই গাছপালার নিচে বিরাট একটা জোনাক পোকার মত ভাসমান আমাদের প্রিয় পরিচিত নৌকাটাকে। আমরা দেখতে পেলাম যে নৌকার মধ্যে খেতে বসেছি। মাংসের টুকরায় কামড় দিচ্ছি। রুটি এগিয়ে দিচ্ছি পরস্পরকে। শুনতে পাচ্ছি আমাদের ছুরি-কাঁটার ঠুংঠাং শব্দ, আমাদের হাসির আওয়াজ ক্যানভাসের খোলা পথে উপচে ছড়িয়ে পড়ছে রাতের অন্ধকারের বুকে। কল্পনার এই ছবিটাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম আমরা।
শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলাম গুণ-টানার পথটা। এতে খুবই খুশি হলাম আমরা। কারণ, এর আগ পর্যন্ত নদীর দিকে এগুচ্ছি, নাকি নদী থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। এ ধরনের অনিশ্চয়তা ক্লান্ত এবং নিদ্রাকাতর অবস্থায় মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। পৌনে বারোটা বাজতে আমরা শিপলেক পার হয়ে গেলাম। তখন চিন্তিতভাবে জর্জ বলল, ‘আচ্ছা, আমাদের নৌকাটা কোন্ দ্বীপে রয়েছে তা কি মনে আছে তোমার?’
আমিও চিন্তিত হলাম ওর প্রশ্নে। বললাম, ‘না তো! আমি জানি না। দ্বীপ কয়টা?’
‘মাত্র চারটা। সে জেগে থাকলে কোন অসুবিধা হবে না।’ জবাব দিল জর্জ। ‘যদি জেগে না থাকে?’ প্রশ্ন করলাম আমি। কিন্তু চিন্তাটাকে আমরা বাতিল করে দিলাম।
প্রথম দ্বীপটার কাছাকাছি গিয়ে হাঁক দিলাম আমরা। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অতএব চলে গেলাম দ্বিতীয় দ্বীপের সামনে। ওখানেও ডাকাডাকি করে কোন ফল হলো না।
‘ওহো, আমার মনে পড়েছে এখন। আমাদের নৌকাটা আছে তৃতীয় দ্বীপে,’ বলল জর্জ।
আশা ভরা মনে তৃতীয় দ্বীপের সামনে ছুটে গিয়ে হাঁক দিলাম। কোন জবাবই পেলাম না!
ব্যাপারটা তখন গুরুতর হয়ে উঠল। মাঝরাত পার হয়ে গেছে। শিপলেক এবং হেনলির হোটেলগুলোতে ঠাঁই পাওয়া যাবে না। ফিরে গিয়ে যে কটেজগুলোর দ্বারে দ্বারে ধাক্কা মেরে মাঝরাতে লোকের ঘুম ভাঙিয়ে জানতে চাইব ওরা ঘর ভাড়া দেবে কিনা—এটাও সম্ভব নয়। জর্জ বুদ্ধি দিল, হেনলিতে ফিরে গিয়ে কোন পুলিশের ওপর হামলা করতে। তাহলে থানা হাজতে রাতের আশ্রয় মিলবে। কিন্তু সেখানেও চিন্তার বিষয় আছে। ধরুন, পুলিশটা যদি শুধু পাল্টা কিল-ঘুসি দিয়েই আমাদেরকে ছেড়ে দেয় এবং হাজতে আটক রাখতে অস্বীকার করে, তাহলে!
আমরা তো গোটা রাতটা পুলিশের সঙ্গে মারামারি করে কাটাতে পারি না। তাছাড়া, বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করে ফেলে ছ’মাসের জন্য জেলে যাওয়ার ইচ্ছাও আমাদের নেই।
হতাশভাবে অন্ধকারে যেটাকে চতুর্থ দ্বীপ বলে মনে হচ্ছিল সেখানে গিয়েও আমরা চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন ফল হলো না। এদিকে বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বৃষ্টি থামবে না। অবাক বিস্ময়ে আমরা ভাবতে লাগলাম ওখানে নদীতে দ্বীপ মাত্র চারটা-না আরও বেশি, আমরা দ্বীপের কাছাকাছি আদৌ পৌঁছেছি কি পৌঁছিনি, যেখানে আমাদের পৌঁছার কথা তার এক মাইলের মধ্যেও আমরা গেছি কিনা, নাকি নদীর একেবারে ভুল অংশে গিয়ে হাজির হয়েছি, ইত্যাদি। অন্ধকারে সব কিছুকেই বড় অপরিচিত এবং অন্যরকম লাগছিল।
যখন সকল আশাই ছেড়ে দিয়েছি ঠিক সেই সময় আমাদের থেকে একটুখানি ভাঁটির দিকে নদীর অপর তীরে গাছপালার ভেতর একটা অদ্ভুত অলৌকিক আলোর ক্ষীণ কাঁপা কাঁপা শিখা আমার নজরে পড়ল। আলোটা এমনি ছায়াঘেরা এবং রহস্যময় ছিল যে মুহূর্তের জন্য আমি মনে করলাম ওটা ভূতের কাণ্ড। পরক্ষণেই মনে হলো যে ওটা আমাদের নৌকার আলো এবং মনে হওয়া মাত্রই এমন জোরে হাঁক দিলাম যে সেই হাঁকে ঘুমন্ত রাতের বিছানাসুদ্ধ কেঁপে উঠল
নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমরা মিনিট খানেক অপেক্ষা করে থাকলাম এবং তার পরেই—আহা! অন্ধকারের মধ্যে সে কি মধুরতম স্বর্গীয় সঙ্গীত! আমাদের কানে এল ঘেউ ঘেউ শব্দে মণ্টমোরেন্সির জবাব। এবার আমরা এমন জোরে পাল্টা চিৎকার দিলাম যা এফিসাসের ‘সেভেন পীপারের ঘুমও ভেঙে দিতে পারে (একজন ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে যতটা চিৎকারের দরকার হয় সাতজনকে জাগাতে তার চেয়ে বেশি চিৎকার লাগবে কেন তা আমি কখনও বুঝতে পারিনি)। আমাদের মনে হলো ঘণ্টাখানেক পরে, কিন্তু আসলে আমাদের চিৎকারের মিনিট পাঁচেক পরে দেখলাম যে অন্ধকারের বুকে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে একটা বাতিওয়ালা নৌকা এগিয়ে আসছে। শুনলাম, ঘুমজড়ানো কণ্ঠে হ্যারিস জিজ্ঞেস করছে আমরা কোথায় আছি।
হ্যারিসের ভাবসাব দুর্বোধ্য ও অদ্ভুত ঠেকল আমাদের কাছে। ওটা সাধারণ ক্লান্তিজনিত নয়—তার চেয়ে বেশি কোন কিছুর ফল। নৌকাটাকে সে ভিড়িয়ে দিল তীরের এমন একটা জায়গায় যেখান দিয়ে নৌকায় ওঠা আমাদের পক্ষে একদম অসম্ভব এবং নৌকা ভিড়বার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
অনেক হৈ-হল্লা চেঁচামেচি লাগল তাকে আবার জাগিয়ে তার মধ্যে কিছুটা চেতনার সঞ্চার করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হলাম এবং নিরাপদে নৌকায় উঠলাম।
নৌকায় উঠে আমরা হ্যারিসের চোখেমুখে একটা বিষণ্ণ ভাব লক্ষ করলাম। ওকে দেখে মনে হলো যেন খুব কষ্ট গেছে তার। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু ঘটেছে কিনা। সে বলল, রাজহাঁস!’
আমরা বোধ হয় কোন রাজহাঁসের বাসার কাছে নৌকা বেঁধেছিলাম। জর্জ আর আমি চলে যেতেই মাদী হাঁসটা বাসায় ফেরে এবং ব্যাপারটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে। হ্যারিস ওকে তাড়া করায় সে গিয়ে ওর পুরুষ হাঁসটাকে ডেকে আনে। হ্যারিস বলল যে হাঁস দুটোর সাথে তুমুল লড়াই বেধে যায় তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয় সাহস আর দক্ষতার। সে ওদেরকে হারিয়ে দেয়।
আধঘণ্টা পরে আরও আঠারোটি রাজহাঁসকে সাথে নিয়ে ওরা ফিরে আসে। হ্যারিসের বয়ান থেকে আমরা যতটুকু বুঝতে পারলাম সেই অনুযায়ী যুদ্ধটা খুব ভয়ঙ্করই হয়েছিল। রাজহাঁসেরা তাকে এবং মণ্টমোরেন্সিকে নৌকা থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করে। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে বীরের মত আত্মরক্ষা করে সে, হত্যা করে অনেকগুলোকে এবং নিহত হাঁসগুলো সাঁতরাতে সাঁতরাতে চলে যায় মৃত্যুবরণের জন্য।
জর্জ প্রশ্ন করল, ‘ক’টা রাজহাঁস ছিল বললে?’
‘বত্রিশটা,’ জবাব দিল হ্যারিস ঘুম জড়ানো স্বরে।
‘একটু আগেই না তুমি বললে যে আঠারোটা ছিল?’
‘না, আমি তা বলিনি। আমি বলেছি বারোটা। আমি গুণতে জানি না ভেবেছ?’ খেঁকিয়ে উঠল হ্যারিস।
এই রাজহাঁসগুলোর ব্যাপারে আসল তথ্যটা যে কি সেটা আমরা কোনদিন জানতে পারিনি। পরদিন সকালে আমরা এ সম্পর্কে হ্যারিসকে জেরা করি। সে ‘বলে, ‘কোন্ রাজহাঁস?’ তার কথায় মনে হলো যেন সে ভাবছে-জর্জ আর আমি স্বপ্ন দেখছি।
আহ্, কষ্টকর অভিজ্ঞতা আর ভয়ভীতির পরে নৌকার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে কি আনন্দই না পেলাম আমরা! প্রাণভরে খাওয়া-দাওয়া করলাম—জর্জ আর আমি। হুইস্কিটা খুঁজে পেলে একটুখানি ঢালতাম গলায়, কিন্তু পেলাম না। হ্যারিসকে প্রশ্ন করলাম ওটার কি হয়েছে সেই বিষয়ে। কিন্তু সে হুইস্কি’ শব্দটার মানে, এবং যে বিষয়টা নিয়ে আমরা বকবক করছি সেটার অর্থ মোটেও জানে বলেই মনে হলো না। মন্টমোরেন্সির ভাবসাবে মনে হলো তার যেন কিছু একটা জানা আছে, তবে সে মুখ খুলল না।
সে রাতে আমার ভাল ঘুম হলো। হ্যারিস বিঘ্ন না ঘটালে ঘুমটা আরও ভাল হতে পারত। আমার আবছা আবছা স্মরণ আছে যে অন্তত দশ-বারো বার আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছি হ্যারিসের পায়ের শব্দে। রাতভর হ্যারিকেন হাতে সে নৌকার মধ্যে তার কাপড়-চোপড় খুঁজে বেড়িয়েছে।
জর্জ আর আমি তার ট্রাউজারের ওপর শুয়ে আছি কিনা দেখার জন্য দু’বার সে আমাদেরকে উঠিয়েছে। দ্বিতীয় বারে জর্জ একদম খেপে গিয়েছিল। বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাত দুপুরে ট্রাউজার দিয়ে কি ঘণ্টাটা করবে তুমি, এ্যা? শুয়ে ঘুমাতে পারো না?’
এর পরে ঘুম ভাঙতে আমি দেখি, মোজা খুঁজে খুঁজে সে হয়রান। সবশেষে যে ব্যাপারটা আমার মনে পড়ছে তা হলো এই যে আমাকে একপাশ থেকে অন্য পাশে ফেরাতে ফেরাতে বিড়বিড় করে হ্যারিস বলছে তার ছাতাটা কোথায় গেল, পাচ্ছে না কেন ওটা? এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার!