তেরো
মার্লো হচ্ছে আমার জানা মতে অতি সুন্দর একটি নদীকেন্দ্র। হৈ-চৈ পূৰ্ণ প্ৰাণবন্ত ছোট্ট শহর। সত্য বটে, সার্বিকভাবে দেখতে খুব সুন্দর নয়। তবে এখানে অনেক চমৎকার দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কালের বিধ্বস্ত সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকা এসব তোরণ আমাদের কল্পনাকে নিয়ে যায় অতীতের সেই দিনগুলোতে, যখন স্যাক্সন এ্যালগার ছিলেন মার্লো জমিদারির মালিক। পরে বিজয়ী উইলিয়াম এটা কেড়ে নিয়ে দান করেন রানী ম্যাটিল্ডাকে। তারপরে জমিদারিটা চলে যায় ওয়ারউইকের আর্লদের হাতে, কিংবা বিষয়জ্ঞানী লর্ড প্যাগেটের হাতে—যিনি পরপর চারজন রাজার উপদেষ্টা ছিলেন।
মার্লোতে সোমবার কিছু ভোরে উঠে ব্রেকফাস্টের আগেই আমরা সানে চলে যাই। ফেরার সময় মন্টমোরেন্সিটা নিজেকে আস্ত গর্দভ প্রমাণ করে বসে। মণ্টমোরেন্সি আর আমার মধ্যে যে একটি মাত্র বিষয়ে গুরুতর মতভেদ রয়েছে সেটা হলো বেড়াল। আমি বেড়াল পছন্দ করি, মণ্টমোরেন্সি করে না।
একটা বেড়ালের দেখা পেলে আমি ‘বেচারা পুষি’ বলে নিচু হয়ে ওটার মাথার পাশটাতে সুড়সুড়ি দিই। আর, বেড়ালটা ঢালাই লোহার মত শক্ত করে লেজটা খাড়া করে ফেলে। ধনুকের মত বাঁকিয়ে পিঠটা উঁচু করে তোলে। নাকটা ঘষতে থাকে আমার ট্রাউজারে। কিন্তু মন্টমোরেন্সির সাথে কোন বেড়ালের দেখা হলে গোটা রাস্তায় খবর হয়ে যায়। দশ সেকেণ্ডের মধ্যে দু’জনে যে পরিমাণ গালাগাল অপচয় করে তা দিয়ে, হিসাব করে খরচ করলে, সাধারণ একজন ভদ্রলোকের গোটা জিন্দিগীর কাজ চলে যাবে।
কুকুরটাকে আমি দোষ দিই না (আমি সাধারণত কেবল ওর মাথায় ঠোক্কর দিয়ে এবং ওকে ঢিল মেরেই সন্তুষ্ট থাকি), কারণ আমি মনে করি যে এটা ওর স্বভাব। ফক্স-টেরিয়াররা অন্য কুকুরের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি আদি পাপ নিয়ে জন্মায়। ফক্স-টেরিয়ারের স্বভাব গুণ্ডামিতে কোন লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের খৃষ্ট-অনুসারীদেরকে বছরের পর বছর ধরে ধৈর্যশীল প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।
মনে পড়ে একদিন আমি হে-মার্কেট স্টোরের লবিতে গিয়েছিলাম। আমার চারদিকে তখন কুকুর আর কুকুর। ওদের মালিকরা ভেতরে কেনাকাটা করছে, ওরা অপেক্ষা করছে মালিকদের জন্য। ওদের মধ্যে রয়েছে একটা ম্যাস্টিফ, একটা কি দুইটা কোলি, একটা সেন্ট বার্নার্ড, কয়েকটা রিট্রিভার আর নিউফাউণ্ডল্যাণ্ড, একটা বোরহাউণ্ড, একটা ফরাসী পুড়ল—যার মাথার চারদিকে প্রচুর লোম কিন্তু মাঝখানটায় চর্মরোগজনিত টাক, একটা বুলডগ, কয়েকটা লাউথার আর্কেড জাতীয় প্রাণী – আকারে প্রায় ইঁদুরের মত, এবং একজোড়া ইয়র্কশায়ার টাইক।
ওরা বসে আছে—শান্তশিষ্ট, ধৈর্যশীল এবং চিন্তামগ্ন। একটা ভাবগম্ভীর প্রশান্তি বিরাজ করছে লবির মধ্যে। একটা স্তব্ধতা আর সহিষ্ণুতার ভাব-ম্র বিষণ্নতার ভাব ছড়িয়ে আছে সেখানে।
এমন সময় সেখানে এসে ঢুকলেন এক তন্বী মহিলা একটা বিনয়ী চেহারার ছোট্ট ফক্স-টেরিয়ার নিয়ে। বুলডগ আর পুলটার মাঝখানে ওটাকে শেকলে বেঁধে রেখে তিনি চলে গেলেন। কুকুরটি বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখল মিনিট খানেক। চোখ তুলে সিলিং-এর দিকে চাইল। অভিব্যক্তি থেকে মনে হলো সে তার মায়ের কথা ভাবছে। তারপর যেন হাই তুলল। হাই তোলার পর সে তাকাল অন্য কুকুরদের দিকে। ওরা সব নীরব, গম্ভীর এবং মর্যাদাপূর্ণ।
সে তাকাল বুলডগটার দিকে। ওটা ডান পাশে স্বপ্নহীন নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তার বাঁ পাশে রয়েছে পুলটা, খাড়া এবং গর্বিত ভঙ্গিতে। সে তাকাল পুড়লটার দিকে। পরক্ষণেই কোনরকম হুঁশিয়ারি এবং সামান্যতম উস্কানি ছাড়াই সে কামড় বসিয়ে দিল পুলটার সামনের পায়ে। যন্ত্রণার কেউ কেঁউ চিৎকারে ভেঙে খানখান হয়ে গেল লবিটার শান্ত নীরবতা।
প্রথম পরীক্ষামূলক কর্মটার ফলাফল খুবই সন্তোষজনক মনে হওয়ায় সে পরিবেশটাকে প্রাণবন্ত করে তোলার সিদ্ধান্ত নিল। ঝাঁপিয়ে পড়ল পুড়লটার ওপর, প্রবলভাবে আক্রমণ করল একটা কোলিকে, কোলিটা জেগে উঠে ভীষণ চিৎকারে পাল্লা জুড়ে দিল পুড়লটার সাথে। ফক্সিটা তখন নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বুলডগটার কান কামড়ে ধরে ওটাকে টেনে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। বুলডগ হলো কিনা অদ্ভুতরকম পক্ষপাতহীন প্রাণী। সে নাগালের মধ্যে হলের দ্বারওয়ানসহ যাকেই পেল তারই ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এতে খুদে টেরিয়ারটি সুযোগ পেল অবাধে একটা সম-আগ্রহী ইয়র্কশায়ার টাইকের সাথে ঝগড়া চালিয়ে যাবার।
কুকুর-চরিত্র যাঁরা জানেন তাঁদেরকে একথা বলার দরকার নাই যে এসময়ের মধ্যে ওখানকার সবগুলো কুকুরের মধ্যে এমন তুমুল লড়াই বেধে গেছে যেন ওই লড়াইয়ের ফলাফলের ওপরই নির্ভর করছে ওদের ভিটামাটির ভবিষ্যৎ। বড় কুকুরগুলো নির্বিচারে লড়ছে পরস্পরের সাথে, ছোটগুলো লড়াই চালাচ্ছে নিজেদের মধ্যে এবং ফাঁক পেলেই কামড়ে দিচ্ছে বড়দের পা।
গোটা লবিটা জুড়ে বেধে গেল চরম বিশৃঙ্খলা। শোরগোল উঠল তুঙ্গে। হে—মার্কেটের বাইরে ভিড় জমে গেল জনতার। লোকে জিজ্ঞেস করতে লাগল ভেতরে গির্জা পরিচালক কমিটির সভা হচ্ছে কিনা, কিংবা কাউকে খুন করা হচ্ছে কিনা, এবং কেন খুন করা হচ্ছে। লাঠি-ডাণ্ডা দড়িদড়া নিয়ে ছুটে এল লোকজন, চেষ্টা করল লড়াইরত কুকুরগুলোকে ছাড়াতে, লোক পাঠানো হলো পুলিশ ডাকতে।
এ হট্টগোলের মধ্যে সেই মিষ্টি তরুণী মহিলাটি এসে ছোঁ মেরে বুকে তুলে নিলেন তাঁর ছোট মিষ্টি কুকুরটাকে (সে ইতোমধ্যেই টাইকটাকে অন্তত মাসখানেকের জন্য অচল করে দিয়েছে এবং এখন ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই করেনি, আসলে সে একটা নবজাত মেষশাবক), চুমো খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওকে খুন করে ফেলেছে কিনা, এবং কোন্ নচ্ছার বর্বর ধুমসো কুকুর ওকে কামড়েছে। কুকুরটি তাঁর বুকের সাথে লেপ্টে গিয়ে এমন দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাইল—যে দৃষ্টির ভাষা হচ্ছে, ‘ওহ্, তুমি এসেছ আমাকে এ জঘন্য জায়গাটা থেকে নিয়ে যেতে? আহ্, কি যে খুশি হয়েছি আমি!’
মহিলাটি বলেন যে মানী লোকদের কুকুরের সাথে অন্য কুকুরগুলোর মত বিরাট আকারের অসভ্য কুকুর রাখতে দেয়ার কোন অধিকার নাই স্টোরের লোকদের। তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে এ ব্যাপারে কাউকে ডেকে আনার।
ফক্স-টেরিয়ারের স্বভাবটা হলো এরকম। তাই, বেড়ালের সাথে ঝগড়া করার ঝোঁকটার জন্য মন্টমোরেন্সিকে আমি দোষ দিই না। তবে, সেদিনকার সকালে ওই ঝোঁকটাকে সে প্রশ্রয় না দিলেই খুশি হতাম।
আগেই বলেছি, স্নান করে ফিরছিলাম আমরা। হাইস্ট্রীটের আধাআধি জায়গায় হঠাৎ করে একটা বেড়াল কোন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে দুলকি চালে হেঁটে রাস্তা পার হতে গেল। বেড়ালটাকে দেখেই উল্লাসে চিৎকার করে উঠল মণ্টমোরেন্সি। এ হলো এক কঠিনহৃদয় যোদ্ধার চিৎকার-যে তার দুশমনকে হাতের মুঠোয় পেয়েছে। স্কচরা তাদের পাহাড়ের ওপরকার অবস্থান ছেড়ে সমতলে নেমে আসার পর ক্রমওয়েল হয়তো এধরনের চিৎকার দিয়েই ছুটে গিয়েছিলেন শিকারের দিকে।
মণ্টমোরেন্সির শিকারটা এক প্রকাণ্ড কালো হুলো বেড়াল। এত বড় এবং এমন বিদঘুটে চেহারার বেড়াল আমি কোনদিন দেখিনি। লেজের অর্ধেকটা, একটা কান এবং নাকের বেশ কিছুটা অংশ সে খুইয়েছে। লম্বা গাট্টাগোট্টা এ বেড়ালটার মধ্যে রয়েছে একটা প্রশান্তি এবং সন্তুষ্টির ভাব।
ঘণ্টায় বিশ মাইল বেগে মন্টমোরেন্সি ছুটে গেল বেচারা বেড়ালটার দিকে। কিন্তু বেড়ালটা তার চলার গতি বাড়াল না। মনে হলো সে যেন বুঝতে পারেনি যে তার জীবন বিপন্ন। ভাবী হত্যাকারী এক গজের মধ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত ধীর শান্ত ভাবে এগিয়ে গেল সে, তারপর বসে পড়ল রাস্তার মাঝখানটায় এবং নম্র জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে চাইল মন্টমোরেন্সির দিকে। সে দৃষ্টির ভাষা হচ্ছে, ‘হ্যাঁ, বলুন! আপনি কি আমাকেই চান?’
সাহসের ঘাটতি ছিল না মন্টমোরেন্সির, কিন্তু ওই বেড়ালটার চেহারার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা পরম সাহসী কুকুরের কলজেটাকেও জমিয়ে বরফ করে দিতে পারে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল মণ্টমোরেন্সি, ভাল করে তাকাল বেড়ালটার দিকে।
দু’জনের কেউ কিছু বলল না, তবে তাদের মধ্যে নিঃশব্দে এ রকম আলাপ হয়েছে বলে কল্পনা করা যায়:
বেড়ালটাগু ‘আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্য?’
মণ্টমোরেন্সি: ‘না—না, ধন্যবাদ।’
বেড়ালটা: ‘সত্যি, কিছুর দরকার থাকলে বলতে সঙ্কোচ করবেন না, বুঝলেন?
মণ্টমোরেন্সি: (পিছু হটতে হটতে) ‘আরে না-না, মোটেই না। আপনার ওসব নিয়ে ভাববার দরকার নাই। আমার-আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুল করেছি। ভেবেছিলাম আপনাকে চিনি। বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।’
বেড়ালটা: ‘না—না বিরক্ত হব কেন, মোটেই বিরক্ত হইনি। আপনার সাথে আলাপ করে বরং খুশিই হয়েছি। এবার বলুন তো, সত্যিই কি আপনি কিছু চান না?’
মণ্টমোরেন্সি: (পিছিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখে) ‘না—না, ধন্যবাদ, আপনার অশেষ অনুগ্রহ, গুড মর্নিং।’
বেড়ালটা: ‘গুড-মর্নিং।’
এবার বেড়ালটা উঠে চলতে লাগল আপন পথে, আর মণ্টমোরেন্সি লেজটাকে যত্নের সাথে পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে আমাদের কাছে ফিরে এসে সবার পেছনে একটা গুরুত্বহীন অবস্থান গ্রহণ করল।
আজও যদি আপনি মন্টমোরেন্সির কাছে গিয়ে ‘বেড়াল’ শব্দটা উচ্চারণ করেন তাহলে দেখবেন সে কুঁকড়ে গিয়ে করুণ দৃষ্টি তুলে আপনাকে বলতে চাইছে:
‘ওই কথাটা বলবেন না, প্লীজ।’
.
ব্রেকফাস্টের পর আমরা গেলাম বাজারে। নৌকায় তিন দিন চলার মত রসদপত্র কিনলাম। জর্জ বলল, আমাদের শাকসব্জী নেয়া উচিত, শাকসব্জী না খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ওগুলো রান্না করা যথেষ্ট সোজা এবং সে-ই তা করবে। কাজেই আমরা দশ পাউণ্ড গোল আলু, এক বুশেল মটরশুঁটি এবং কয়েকটা বাঁধাকপি নিলাম। হোটেল থেকে সংগ্রহ করলাম একটা বীফ-স্টেক পাই, কিছু গুজবেরি টার্ট এবং একটা ভেড়ার পা। শহরে ঘুরে ঘুরে কিনলাম ফলমূল, কেক রুটি-মাখন, জ্যাম, বেকন, ডিম এবং অন্যান্য জিনিস।
মার্লো থেকে আমাদের বিদায়টাকে আমি আমাদের অন্যতম প্রধান সাফল্য বলে গণ্য করি। আড়ম্বরময় না হলেও ওটা ছিল বেশ ভাবগম্ভীর এবং মর্যাদাপূর্ণ।
যে যে দোকানে আমরা গিয়েছি সবখানেই জেদ ধরেছি যে আমাদের কেনা জিনিসপত্র তক্ষুণি আমাদের সাথে পাঠাতে হবে। ‘জ্বি, স্যার, এখনি পাঠিয়ে দেব, আপনারা পৌঁছার আগেই আমাদের ছোঁড়াটা পৌঁছে যাবে স্যার,’ এবং তারপরে ঘাটে গিয়ে অযথা দাঁড়িয়ে থাকা, বার দু’য়েক ঝগড়া করার জন্য দোকান পর্যন্ত দৌড়ে যাওয়া, ওসব আমাদের সাথে চলবে না। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে ঝুড়িগুলো বাঁধাছাঁদা করিয়ে ছোঁড়াটাকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছি।
অনেক দোকানে গিয়েছি আমরা এবং প্রত্যেকটাতেই একই নীতি অনুসরণ করেছি। এর পরিণাম হলো এই যে কেনাকাটা শেষ হতে দেখা গেল ঝুড়িবাহী একটা বড় দল জুটে গেছে আমাদের পেছনে। হাই-স্ট্রীটের মাঝখান দিয়ে নদী পর্যন্ত আমাদের শেষ শোভাযাত্রাটি এমন এক জমকালো দৃশ্যের অবতারণা করেছিল যেমনটি মার্লোবাসীরা বহুদিন দেখেনি।
শোভাযাত্রাটির আকার ছিল এরকম:
একটা ছড়ি মুখে নিয়ে মন্টমোরেন্সি
দু’টো বদমাশ চেহারার খেঁকি কুকুর, মন্টমোরেন্সির বন্ধু।
কোট-কম্বলের বোঝা নিয়ে জর্জ, মুখে তার বেঁটে পাইপ।
হ্যারিস, একহাতে একটা ফুলে-ওঠা
গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ, অন্যহাতে লাইমজুসের
বোতল। এসব নিয়ে সে
চেষ্টা করছে সহজভাবে হাঁটতে।
ঝুড়ি নিয়ে সবজিওয়ালা আর রুটিওয়ালা ছোঁড়া।
বড় ঝুড়ি বহন করে হোটেলের চাকর।
ঝুড়ি হাতে ময়রার ছোঁড়া।
ঝুড়ি হাতে মুদীর ছোঁড়া
ব্যাগ বহন করে ছুটকা মজুর।
ছুটকা মজুরের প্রাণের সখা, হাত দুটো পকেটে গোঁজা,
মুখে বেঁটে মাটির পাইপ।
ঝুড়ি মাথায় ফলওয়ালার ছোঁড়া।
একটা ব্যাগ আর একজোড়া বুট নিয়ে আমি, ভাব
দেখাচ্ছি— যেন কি করছি জানি না।
ছ’টা বাচ্চা ছেলে এবং
চারটা বে ওয়ারিশ কুকুর।
আমরা ঘাটে পৌঁছার পর মাঝি বলল, ‘আসুন, আসুন, স্যার! আপনাদেরটা স্টীম-লঞ্চ, নাকি হাউস বোট?’
আমরা বললাম, আমাদেরটা ডবল দাঁড়ের হালকা নৌকা। এতে লোকটা আশ্চর্য হয়ে গেল।
হ্যাম্বলডন পৌঁছে আমরা দেখলাম আমাদের পানি ফুরিয়ে গেছে। সোরাইটা নিয়ে চলে গেলাম লক পাহারাদারের বাড়িতে কিছু পানি চেয়ে আনতে।
জর্জ ছিল আমাদের মুখপাত্র। মন-গলানো হাসি হেসে সে বলল, ‘দেখুন, সামান্য পানি দেবেন আমাদেরকে দয়া করে?
‘অবশ্যই।’ জবাব দিল বুড়ো লোকটি। ‘যতটা ইচ্ছা নাও, বাকিটা রেখে যাও।’
চারপাশে দেখে জর্জ বলল, ‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু কোথায়— পানিটা আপনি কোথায় রাখেন?’
নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিল বুড়ো, ‘ওটা সব সময় একই জায়গায় আছে বাপু, তোমার ঠিক পেছনটায়।’
জর্জ পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘কই দেখছি না তো!’
জর্জকে ঘুরিয়ে নদীর একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত দেখিয়ে বুড়ো মন্তব্য করল, ‘কেন, চোখ কোথায় তোমার? ওখানে দেখতে পাওয়ার মত যথেষ্ট পানিই আছে, তাই না?’
ব্যাপারটা মাথায় ঢোকার পর জর্জ বলল, ‘ওহ্-হো! কিন্তু আপনি তো জানেন, আমরা নদী পান করতে পারি না!’
বুড়ো জবাব দিল, ‘না। তবে তার কিছুটা পান করতে পারো। গত পনেরো বছর আমি তাই করে এসেছি।’
জর্জ বলল যে পনেরো বছর নদীর পানি খেয়ে তার চেহারাসুরত যা দাঁড়িয়েছে সেটা ওই বস্তুটার জন্য ভাল বিজ্ঞাপন বলে মনে হচ্ছে না। ওই বস্তুর বদলে সে বরং পাম্পের পানিই ব্যবহার করবে।
কিছুদূর এগিয়ে একটা কটেজ থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি। আমাকে বলতে হচ্ছে যে ওটাও ছিল নদীর পানি, কিন্তু আমরা সেটা জানতাম না এবং জানতাম না বলেই ওতে আমাদের কাজ চলে গেছে। চোখে না দেখে খেয়ে ফেললে পেট খারাপ করে না।
ওই মওসুমের শেষ দিকে আমরা একবার নদীর পানি খাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু চেষ্টাটি সফল হয়নি। আমরা ভাঁটির দিকে আসছিলাম। চা-পর্বের জন্য উইণ্ডসরের কাছে নদীর তীর ঘেঁষে নৌকা রাখি। আমাদের সোরাইটা ছিল খালি। ফলে সমস্যা দাঁড়াল এই যে আমাদেরকে হয় নদীর পানি দিয়ে চা বানাতে হবে, নতুবা চা খাওয়া বাদ দিতে হবে। হ্যারিস ছিল একটা চান্স নেয়ার পক্ষে। সে বলল পানিটা ফুটালেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। পানিতে যেসব জীবাণু আছে সেগুলো মরে যাবে পানি ফুটলে। অতএব টেম্স-এর বদ্ধজলার পানি কেটলিতে ভরে আমরা সেদ্ধ করলাম এবং সেটা ঠিকমত ফুটছে কিনা সেদিকে নজর রাখলাম।
চা আমরা তৈরি করেছিলাম এবং জুৎ করে বসেওছিলাম পানের জন্য। এমন সময় জর্জ তার পেয়ালাটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই মাঝপথে থেমে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওটা কি?’
‘কোনটা কি?’ জিজ্ঞেস করলাম হ্যারিস আর আমি।
‘কেন, ওটা!’ বলল জর্জ পশ্চিম দিকে চেয়ে।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হ্যারিস আর আমি দেখলাম মন্দাস্রোতে আমাদের দিকে ভেসে আসছে একটা কুকুর। আমি যত কুকুর দেখেছি তাদের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে নীরব আর শান্ত। এর চাইতে বেশি সন্তুষ্ট, শান্তমনা কুকুর আর দেখিনি আমি। স্বপ্নিল ভঙ্গিতে ভাসছিল কুকুরটি চিৎ হয়ে, পা চারটি সোজা ওপর দিকে তুলে। কুকুরটাকে বেশ স্বাস্থ্যবানই বলব আমি, তার বুকটাও ছিল বেশ সুগঠিত। আসতেই থাকল সে ধীর মর্যাদাপূর্ণভাবে। আমাদের নৌকার পাশাপাশি এসে থেমে গেল নল-খাগড়ার মধ্যে। ওখানে আস্তানা পাতল সন্ধ্যাটা কাটাবার জন্য।
জর্জ বলল, চায়ের দরকার নাই তার। পেয়ালা উপুড় করে চা-টা সে ঢেলে দিল পানিতে। হ্যারিসের তেষ্টা পায়নি, তাই সেও জর্জের অনুসরণ করল। আমি নিজেরটা অর্ধেক খেয়ে ফেলেছিলাম, তাই ভাবলাম, না খেলেই ভাল হত।
জর্জকে আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার টাইফয়েড হতে পারে কিনা এবং এ ব্যাপারে তার মত কি।
সে বলল, ‘আরে, না-না।’ তার মতে টাইফয়েড থেকে বেঁচে যাবার একটা ভাল চান্স আছে আমার। তবে যাই হোক, পক্ষকালের মধ্যেই আমার জেনে যাওয়া উচিত যে আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছি কি হইনি।
বদ্ধজলার ওপর দিয়ে শর্টকাট পথে আমরা রওনা দিলাম ওয়ারগ্রেভ-এর দিকে।
অর্ধেক পথ গিয়ে নৌকা থেকে নেমে আমরা লাঞ্চ করলাম। এই লাঞ্চ খেতে গিয়ে জর্জ আর আমি একটা বড় রকমের বিরক্তিকর ধাক্কা খাই।
ধাক্কা অবশ্য হ্যারিসও খেয়েছিল, তবে জর্জ আর আমারটার তুলনায় হ্যারিসেরটা অত কড়া হতে পেরেছিল বলে আমি মনে করি না।
দেখুন, ব্যাপারটা ঘটেছিল এরকম: পানির কিনার থেকে প্রায় গজ দশেক দূরে ঘাসের ওপর আরামে বসে আমরা সবেমাত্র খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছিলাম। হ্যারিস বীফ-স্টেক পাইটাকে দু’হাঁটুর মাঝখানে নিয়ে কেটে ভাগ করছিল, জর্জ আর আমি প্লেট ধরে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
‘চামচ আছে তোমাদের কাছে?’ বলল হ্যারিস, ঝোলটা বেড়ে দেয়ার জন্য একটা চামচ দরকার।
বড় ঝুড়িটা আমাদের পেছনেই ছিল। জর্জ আর আমি দু’জনেই পেছনে ঘুরে ওটার দিকে হাত বাড়ালাম। চামচটা বের করতে পাঁচ সেকেণ্ডও লাগেনি আমাদের। চামচ হাতে ফিরেই দেখি বীফ-স্টেক পাই সুদ্ধ হ্যারিস উধাও!
প্রশস্ত খোলা মাঠ। কয়েকশো গজের মধ্যে কোথাও কোন গাছপালা বা ঝোপঝাড় নাই। ও যে গড়িয়ে নদীতে পড়ে যাবে তা-ও সম্ভব নয়, কারণ নদীর দিকটাকে পেছনে রেখে আমরা বসে ছিলাম। নদীতে গড়িয়ে পড়তে হলে আমাদের গা বেয়ে উঠে তারপর পড়তে হত তাকে।
জর্জ আর আমি তাকাই চারদিকে, চেয়ে থাকি একে অন্যের দিকে।
‘ওকে কি ছোঁ মেরে স্বর্গে উঠিয়ে নেওয়া হলো?’ জিজ্ঞেস করি আমি।
‘তাহলে তো পাইটা নিয়ে যেত না ওরা,’ বলল জর্জ।
তার কথায় জোরালো যুক্তি আছে বলে মনে হলো, কাজেই স্বর্গ সংক্রান্ত তত্ত্বটা আমরা বাতিল করলাম।
‘আমার মনে হয় আসল ব্যাপার এই যে একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে,’ বলল জর্জ।
পরে গলায় একটুখানি বিষাদের সুর ঢেলে সে যোগ করল, ‘আমি যে ওই পাইটা কাটছিলাম না, এতেই রক্ষা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমরা চোখ ফেরালাম সেই জায়গাটার দিকে, যেখানে হ্যারিস আর পাইটাকে শেষবারের মত দেখা গেছে এ পৃথিবীতে। আমরা যা দেখলাম তাতে শিরায় শিরায় আমাদের রক্ত হিম হয়ে জমে গেল, খাড়া হয়ে গেল মাথার সব চুল।
আমরা সেখানে দেখলাম হ্যারিসের মাথাটা। আর কিছুই না, শুধু মাথাটা। লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে খাড়া উঁচু হয়ে আছে। মুখটা অত্যন্ত লাল এবং তাতে মহাঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধের অভিব্যক্তি।
জর্জই প্রথম সামলে উঠল। চিৎকার করে সে বলল, ‘কথা বলো! শিগগির বলো তুমি জীবিত না মৃত এবং তোমার বাকি অংশ কোথায়?’
‘ওহ্, মূর্খ গাধার মত কথা বোলো না। আমার বিশ্বাস, ইচ্ছা করেই তোমরা এটা করেছ।’ বলল হ্যারিসের মাথা।
‘কি করেছি আমরা?’ বিস্মিত চিৎকারে বললাম জর্জ আর আমি
‘কেন, জানো না তোমরা? আমাকে ওখানে বসিয়েছ তোমরাই। এটা হচ্ছে সস্তা নোংরা চালাকি! নাও এখন, পাইটা ধরো।’
আমাদের মনে হলো যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ময়লামিশ্রিত থেবড়ানো পাইটা এবং ওটার পেছনে গড়াগড়ি-খাওয়া, কাদামাখা, ভেজা অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে হ্যারিস।
না জেনে সে বসে গিয়েছিল একটা ছোট্ট খাদের একেবারে কিনারায়। লম্বা লম্বা ঘাসের জন্য খাদটা চোখে পড়েনি। এক সময় একটু পেছনে হেলতেই পাই—টাই নিয়ে হুস করে সে পড়ে যায় খাদের ভেতর।
পড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারার সময় সে যতটা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল জীবনে আর কোনদিন অমন আশ্চর্য হয়নি। বিন্দুমাত্র আন্দাজও করতে পারেনি যে কি ঘটে গেছে। প্রথমে সে ভেবেছিল কেয়ামত শুরু হয়েছে।
হ্যারিস আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করে যে জর্জ আর আমি আগে থেকে পরিকল্পনা করেই ঘটনাটা ঘটিয়েছি। অন্যায় সন্দেহ এমনি করে সবচেয়ে নির্দোষ ব্যক্তিটিরও পিছু নেয়। এ জন্যই কবি বলেছেন, ‘অপবাদ থেকে কে নিষ্কৃতি পায়?’ সত্যি, কে নিষ্কৃতি পায়?