বারো
তীরে বসে আপন মনে এ দৃশ্যটা কল্পনা করছিলাম। এমন সময় জর্জ মন্তব্য করল যে বিশ্রাম নেয়ার পরে ধোয়ামোছার কাজে একটুখানি সাহায্য করতে হয়তো আমার আপত্তি থাকবে না। এভাবে গৌরবময় অতীত থেকে ফিরিয়ে আনা হলো আমাকে দুঃখ আর পাপে ভরা এ গদ্যময় বর্তমানে। নৌকায় গিয়ে এক টুকরো কাঠ আর এক গোছা ঘাস দিয়ে কড়াইটা পরিষ্কার করে জর্জের ভেজা শার্টটা দিয়ে পালিশ করে ফেললাম ওটাকে।
ম্যাগনা কার্টা দ্বীপে গেলাম আমরা। দেখলাম একটা কটেজের সামনে দাঁড়ানো পাথরটা। লোকে বলে ওই পাথরটার ওপরেই নাকি ম্যাগনা কার্টা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যদিও আসলে ওখানেই, নাকি কেউ যেমন বলে, রুনিমিডের অপর তীরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে বিষয়ে আমি নিজে কোন মন্তব্য করতে রাজি নই। তবে আমি ওটা দ্বীপে স্বাক্ষরিত হয়েছিল—এ জনপ্রিয় তত্ত্বকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতি। আমি যদি ওই সময়ের কোন ব্যারন হতাম তাহলে নিশ্চয়ই রাজা জনের মত ধূর্ত মক্কেলকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমার সাথীদেরকে জোর দিয়ে বলতাম। দ্বীপে চালাকি বা ধোঁকা দেয়ার সুযোগ সম্ভাবনা ছিল কম।
পিকনিক পয়েন্টের কাছে এ্যাঙ্কারওয়াইক হাউসের প্রাঙ্গণে এক প্রাচীন মঠের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ওখানেই নাকি অষ্টম হেনরী এ্যানি বোলেইনের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতেন এবং তাঁর সাথে মিলিত হতেন। কেণ্ট-এর হেভার দুর্গে এবং সেণ্ট এলবান্স-এর কাছে কোন এক জায়গাতেও নাকি তিনি এ্যানি বোলেইনের সাথে দেখা করতেন। এ দুই অসাবধান তরুণ-তরুণী কোন্ কোন্ জায়গায় একত্র হয়ে প্রেমকূজন করছেন না সেটা খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে উঠেছিল তখনকার ইংল্যাণ্ডবাসীদের পক্ষে।
এরকম কোন বাড়িতে কি আপনি কখনও ছিলেন যেখানে একজোড়া প্রেমিক—প্রেমিকা প্রেমকূজনে রত? ব্যাপারটা সত্যি বড় দুঃসহ। আপনি ভাবলেন, ড্রয়িংরুমে গিয়ে একটু বসবেন। চললেন সেখানে। দরজাটা খুলতেই একটা শব্দ এল আপনার কানে। হঠাৎ যেন কারও মনে পড়ে গেছে কোন কথা। ভেতরে পা দিতেই দেখলেন যে এমিলি জানালার কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে রাস্তার ওপাশে কি যেন একটা দেখছে এবং আপনার বন্ধু জন এডওয়ার্ড কামরার অপর প্রান্তে বসে সারা মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে অন্য লোকের আত্মীয়স্বজনের ছবি দেখছে। দরজার মুখে থেমে আপনি বলেন, ‘আহা, আমি জানতাম না যে এখানে কেউ আছে।
‘ওহো, জানতেন না?” হিমেল কণ্ঠে বলে এমিলি, যার অর্থ—সে বিশ্বাস করে না আপনার কথা।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আপনি বলেন, ‘খুব অন্ধকার এখানটায়, বাতি জ্বালছ না কেন?’
জন এডওয়ার্ড বলে ওঠে, ‘আহ্ হা, তাই তো।’
এমিলি বলে যে বিকেলে বাতি জ্বালানো বাবা পছন্দ করেন না।
আপনি ওদেরকে দু’একটি খবর বলেন। আইরিশ প্রশ্নে আপনার মতামত জানান। কিন্তু এসবে ওদের আগ্রহ দেখা যায় না। সব প্রসঙ্গে ওরা শুধু বলে, “হ্যাঁ’! ‘তাই নাকি?’ ‘হ্যাঁ’ ইত্যাদি। এ রীতিতে মিনিট দশেক আলাপের পর দরজা খুলে আপনি বেরিয়ে যান এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেন যে আপনার স্পর্শ ছাড়াই দরজাটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। আধঘণ্টা পরে আপনি ভাবেন যে সঙ্গীত-কক্ষে গিয়ে বসে বসে পাইপ টানবেন। গিয়ে দেখেন যে ওখানকার একমাত্র চেয়ারটি দখল করে আছে এমিলি। জন এডওয়ার্ড, কাপড় চোপড়ের ভাষাকে বিশ্বাস করা গেলে, স্পষ্টত বসেছিল মেঝের ওপর। কোন কথা বলে না ওরা, তবে এমন দৃষ্টিতে তাকায় আপনার দিকে—যে দৃষ্টি সভ্যসমাজে যতটা বলা সম্ভব সবই বলে দেয়। তখন চট করে বেরিয়ে গিয়ে আপনি পেছনে দরজাটা ভেজিয়ে দেন।
এখন বাড়িটার যে কোন কামরায় নাক গলাতে ভয় হয় আপনার। তাই. সিঁড়িতে কিছুক্ষণ ওঠানামা করে আপনি চলে যান নিজের শোবার ঘরে। বসে থাকেন বিছানায়। কিছু সময় বসে থাকার পর ওটাও আর ভাল লাগে না। কাজেই হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে আপনি চলে যান বাগানে। বাগানের পথে হেঁটে হেঁটে সামার-হাউস পার হয়ে যাবার সময় ভেতরে তাকাতেই দেখেন ওই দুই বোকা তরুণ-তরুণী জড়াজড়ি করে বসে আছে এক কোণে। ওরা দেখতে পায় আপনাকে এবং স্পষ্টত ধারণা করে যে আপনার নিজস্ব কোন বদ মতলবে ওদের পিছু নিয়েছেন আপনি।
‘এসবের জন্য একটা বিশেষ কামরা বেছে নেয় না কেন ওরা যাতে মানুষ সে কামরা থেকে দূরে থাকতে পারে?’ বিড়বিড় করে বলতে বলতে দ্রুতপায়ে হলঘরে ফিরে গিয়ে ছাতা হাতে বাইরে চলে যান আপনি।
বোকা ছেলে অষ্টম হেনরীর সাথে তাঁর ছোট্ট এ্যানির পূর্বরাগ চলার সময়ও নিশ্চয় অনেকটা এরকম কাণ্ডই ঘটেছিল। উইণ্ডসর আর রেইসবারি এলাকায় তাঁদের প্রণয়লীলা চলাকালে বাকিংহ্যামশায়ারের লোকেরা হয়তোবা আচমকা তাঁদের সামনে পড়ে যেয়ে বলে উঠত, ‘ওহো, আপনারা আছেন এখানে! লজ্জায় রাঙা হয়ে হেনরী বলতেন হ্যাঁ, এইমাত্র এক লোকের সাথে দেখা করতে এসেছেন তিনি। আর, এ্যানি বলে উঠতেন, ‘খুব খুশি হলাম আপনাকে দেখে! বেশ মজার ব্যাপার, তাই না? এইমাত্র মি. হেনরীর সাথে গলির মধ্যে আমার দেখা হয়ে গেল। উনিও একই পথে যাচ্ছেন।’
ওই লোকগুলো তখন চলে যেত ওখান থেকে এবং নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, ‘এ প্রণয়লীলা আর প্রেমকূজন যদ্দিন চলবে ততদিন অন্যত্র সরে থাকা উচিত আমাদের। আমরা কেণ্ট-এ চলে যাব।’
কেণ্ট-এই চলে যেত তারা। ওখানে পৌঁছার পর প্রথম যে দৃশ্যটা তাদের চোখে পড়ত তা হচ্ছে হেভার দুর্গের চারপাশে হেনরী আর এ্যানির প্রণয়লীলা।
‘আরে ধুত্তোরি!’ বলে উঠত তারা, ‘চলো, সরে পড়ি। এ আর সহ্য হচ্ছে না আমার। চলো, সেন্ট আলবান্স-এ যাই আমরা। বেশ চমৎকার নির্জন জায়গা ওটা।’
সেণ্ট আলবান্স-এ গিয়েও সেই একই দৃশ্য দেখত তারা—মঠের দেয়ালের নিচে ঘন চুম্বনরত ওই হতচ্ছাড়া প্রেমিক যুগল!
তখন এ লোকগুলো গিয়ে জলদস্যু হয়ে যেত এবং বিয়েটা হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দস্যুবৃত্তি করে বেড়াত।
পিকনিক পয়েন্ট থেকে ওল্ড উইণ্ডসর লক পর্যন্ত নদীটা বড় মনোরম। তীর ধরে চলে গেছে ছায়াময় পথ। পথের ধারে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর ছোট ছোট বাড়ি। পথটা গেছে ‘কুইসলি সরাই’ পর্যন্ত। নদীপথের সরাইগুলো যেমন হয়, এটাও তেমনি একটা ছবির মত সুন্দর সরাই। হ্যারিস বলে এখানে খুব ভাল এল্ (যবের মদ) পাওয়া যায় এবং এসব ব্যাপারে হ্যারিসের কথায় আস্থা রাখা যেতে পারে। ওল্ড উইওসর এমনিতেই বিখ্যাত। এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরের একটা প্রাসাদ ছিল এখানে। এখানেই আর্ল গডউইন সে যুগের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন রাজ-ভ্রাতার মৃত্যুর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে। এক টুকরা রুটি ভেঙে নিয়ে আর্ল গডউইন বলেছিলেন, ‘আমি যদি দোষী হই তাহলে এ রুটি খাওয়ার সময় গলায় আটকে যেন মরি।’
এ বলেই রুটিখণ্ডটি মুখে পুরে গিলে ফেলেন এবং ওটা গলায় আটকে গিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটায়।
ওল্ড উইণ্ডসর থেকে বোভেনি পর্যন্ত নদীতে দেখার মত কিছুই নাই। জর্জ আর আমি গুণ টেনে হোম পার্ক পার হয়ে এগিয়ে গেলাম। ডাচেট ছেড়ে যাবার সময় জর্জ আমাকে জিজ্ঞেস করল নদীতে আমাদের প্রথম ট্রিপের কথা আমার মনে আছে কিনা—সেই যেবার ডাচেটে রাত দশটায় নেমে আমরা ঘুমাবার জায়গা খুঁজছিলাম?
বললাম, মনে আছে। ওটা ভুলতে অনেক সময় লাগবে।
দিনটা ছিল আগস্টের ব্যাঙ্ক হলিডের আগের শনিবার। আমরা ছিলাম ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত। আমরা এই একই তিনজন। ডাচেটে পৌঁছে ঝুড়ি, দুটো ব্যাগ, কম্বল, কোট এবং এরকম আরও জিনিসপত্র নিয়ে আমরা যাত্রা করি আশ্রয়ের সন্ধানে। একটা ছোট্ট সুন্দর হোটেল পার হয়ে যাই আমরা। হোটেলটার বারান্দা ক্লেমাটিস এবং অন্যান্য লতায় ছাওয়া। কিন্তু ধারে-কাছে কোন হানিসাকল (সুগন্ধি ফুলযুক্ত লতা) নাই। যে কারণেই হোক, আমার মনটা গোঁ ধরে বসে হানিসাকল—এর জন্য। বলি, ‘উঁহু, এ হোটেলে ঢুকো না! চলো, আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখি হানিসাকল-এ ঢাকা কোন হোটেল মেলে কিনা।’
কাজেই হাঁটতে থাকি আমরা আরেকটা হোটেলের খোঁজে। পাই একটা, এবং এটাও খুব সুন্দর। এর ওপর একপাশ ঘেঁষে হানিসাকল আছে। কিন্তু ওখানে সামনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একটা লোকের চেহারা-সুরত হ্যারিসের পছন্দ হয় না। সে বলে, লোকটাকে মোটেই ভাল মনে হয় না। আর, ওর বুটজোড়াও বেজায় বদখত। কাজেই আরও এগিয়ে যেতে থাকি আমরা। অনেকটা পথ পার হয়ে যাই, কোন হোটেল সামনে পড়ে না। তখন এক লোকের দেখা পেয়ে তাকে বলি আমাদেরকে কয়েকটা হোটেলের রাস্তা দেখিয়ে দিতে।
লোকটা বলে, ‘আরে আপনারা তো হোটেলগুলো পেছনে ফেলে চলে আসছেন। আপনাদেরকে এখন উল্টো দিকে ফিরে যেতে হবে। তাহলেই স্ট্যাগ—এ পৌঁছে যাবেন।’
আমরা বলি, ‘ওখানে আমরা গিয়েছিলাম। পছন্দ হয়নি। ওটার ছাদে হানিসাকল নাই।
সে বলে, ‘তাহলে ওটার ঠিক উল্টো দিকে আছে ম্যানর-হাউস। ওখানে চেষ্টা করে দেখেছেন?’
জবাবে হ্যারিস বলে যে আমরা ওখানে যেতে চাই না। ওখানে একটা লোক আছে, তার চেহারা আমাদের পছন্দ হয়নি। তার চুলের রঙ এবং বুটজোড়াও হ্যারিসের পছন্দ হয়নি।
‘সেক্ষেত্রে আপনারা কি করবেন বুঝতে পারছি না আমি। সত্যিই বলছি, কারণ, এ তল্লাটে হোটেল মাত্র ওই দুটোই,’ বলে আমাদের সংবাদদাতা।
‘আর কোন হোটেলই নাই?’
‘না, জবাব দেয় লোকটি।
‘তাহলে আমরা করব কি?’ চেঁচিয়ে ওঠে হ্যারিস।
তখন জর্জ মুখ খোলে। সে বলে যে হ্যারিস আর আমার ইচ্ছা হলে নিজেদের জন্য একটা হোটেল বানিয়ে নিতে এবং কিছু মানুষ তৈরি করিয়ে ওতে রেখে দিতে পারি। নিজের ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে সে স্ট্যাগ হোটেলে ফিরে যাবে।
মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরা কোন বিষয়েই তাঁদের আদর্শ বাস্তবায়িত করতে পারেন না। তাই হ্যারিস আর আমি সকল জাগতিক বাসনার শূন্যগর্ভর্তা নিয়ে হা-হুতাশ করতে করতে জর্জকে অনুসরণ করি।
লটবহরসহ স্ট্যাগ-এ পৌঁছে হলঘরে নামিয়ে রাখি সেগুলো।
বাড়িওয়ালা এসে বলেন, ‘গুড ইভনিং, ভদ্রমহোদয়রা।’
‘ওহ গুড ইভনিং,’ বলে জর্জ, দয়া করে তিনটা বিছানার ব্যবস্থা করুন আমাদের জন্য।’
‘খুবই দুঃখিত, স্যার, আমাদের পক্ষে বোধ হয় সম্ভব হবে না।’ জবাব দেন বাড়িওয়ালা।
জর্জ বলে, ‘ঠিক আছে, চিন্তার কিচ্ছু নাই, দুটো হলেই চলবে। আমরা এক বিছানায় দু’জন শুতে পারব। কি বলো, পারব না?’ জানতে চায় সে হ্যারিস আর আমার দিকে ফিরে।
হ্যারিস জবাব দেয়, ‘আলবৎ পারব।’ সে মনে করে খুব সহজেই জর্জ আর আমি এক বিছানায় শুতে পারব।
বাড়িওয়ালা আবারও বলল, ‘খুবই দুঃখিত, স্যার। সত্যি গোটা বাড়িতে একটা বিছানাও খালি নেই। আসলে ইতোমধ্যেই আমরা এক বিছানায় দু’জন, এমনকি তিনজনকেও জায়গা দিয়েছি।’
একথা শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই আমরা।
কিন্তু হ্যারিস হলো পুরানো মুসাফির। সে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। ফুল্লহাসি হেসে সে বলে, ‘ঠিক আছে ভাই, ঠিক আছে, উপায় যখন নাই তখন আমরা কষ্ট করেই থাকব। বিলিয়ার্ড কামরায় কোনরকমে একটা ব্যবস্থা করে দিন আমাদের জন্য।’
‘অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। বিলিয়ার্ড টেবিলে এরিমধ্যে তিন ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন। কফি-রুমে শুয়েছেন দু’জন। আজ রাতে আপনাদেরকে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়।’
জিনিসপত্র তুলে নিয়ে আমরা চলে যাই ম্যানর-হাউসে। আমি বলি, এখানে আগেরটার চেয়ে আমার ভাল লাগা উচিত। হ্যারিস মন্তব্য করে, ‘হ্যাঁ—ঠিকই এখানেই ভাল হবে।’ লাল-চুলো লোকটার দিকে তাকানোর দরকার নাই আমাদের। তাছাড়া, চুল লাল হবার ব্যাপারে বেচারা লোকটার কোন দোষ নাই।
বিষয়টা সম্পর্কে হ্যারিসের এ বক্তব্যটা ছিল বেশ সহৃদয়তা ও বিবেচনাপূর্ণ।
ম্যানর-হাউসের লোকগুলো শুনতেই চায় না আমাদের কথা। বাড়িওয়ালী দোরগোড়ার সিঁড়িতে আমাদের সাথে দেখা করে এ বলে সম্ভাষণ জানান যে আমরা হলাম গত দেড়-ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া চতুর্দশতম পার্টি। আস্তাবল, বিলিয়ার্ড কামরা, কিংবা কয়লাগুদাম সম্পর্কে আমাদের ভীরু জিজ্ঞাসার উত্তরে অবজ্ঞার হাসি হেসে তিনি জানান যে ওসব জায়গা অনেক আগেই ভরাট হয়ে গেছে।
গোটা গ্রামের মধ্যে আমরা রাতের জন্য আশ্রয় পেতে পারি এ রকম কোন জায়গা তাঁর জানা আছে কি?
জবাবে তিনি বলেন যে কষ্ট সহ্য করতে আপত্তি না থাকলে আমরা আধ মাইল দূরে ইটন রোডে যে ছোট্ট বিয়ারের দোকানটি আছে ওখানে যেতে পারি, তবে আমরা যেন মনে রাখি যে ওখানে যাবার সুপারিশ তিনি করছেন না।
আর বেশি কিছু শোনার অপেক্ষা না করে ঝুড়ি, ব্যাগ, কোট, কম্বল, পোলা—পুঁটলি তুলে নিয়ে আমরা ছুটে যাই। দূরত্বটা আধ মাইলের জায়গায় মনে হয় এক মাইল। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে ঢুকি ‘বারটিতে।
বিয়ারশপের লোকগুলো বেজায় রূঢ়। আমাদের দিকে তাকিয়ে ওরা শুধু দাঁত বের করে হাসে। ওখানে গোটা বাড়িটাতে বিছানা মাত্র তিনটা এবং ইতোমধ্যেই ওখানে ঘুমাচ্ছেন সাতজন লোক, আর দুটি বিবাহিত দম্পতি। তবে ওখানে চাকরদের কামরায় এক দয়ালু বজরামাঝি ছিল। তার মনে হয় যে আমরা স্ট্যাগ হোটেলের পাশের মুদী দোকানটিতে চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমরা ফিরে যাই সেখানে।
মুদীদোকানও ভর্তি। ওখানে আমাদের দেখা হয় এক বুড়ীর সঙ্গে। বুড়ী দয়া করে আমাদেরকে নিয়ে চলে সিকি মাইল দূরে তার এক মহিলা বন্ধুর কাছে, যিনি মাঝেমধ্যে ভদ্রলোকদের কাছে কামরা ভাড়া দেন।
বুড়ীটি হাঁটে বড় মন্থর গতিতে। ফলে বিশ মিনিট লেগে যায় তার বান্ধবীর বাড়ি যেতে। তবে তার পিঠে কত রকমের ব্যথা আছে তার সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে সে গোটা পথটা জমিয়ে রাখে।
মহিলাবন্ধুর কামরাগুলো ভাড়া হয়ে গেছে। সেখান থেকে আমাদেরকে বলা হয় ২৭ নম্বরে যেতে। ২৭ নম্বরেও জায়গা নাই। ওরা আমাদেরকে বলে ৩২ নম্বরে যেতে। ওখানে গিয়ে দেখি ৩২ নম্বরও ভর্তি।
ফিরে যাই আমরা মহাসড়কে। বড় ঝুড়িটার ওপর বসে পড়ে হ্যারিস বলে, সে আর এক পাও নড়বে না। জায়গাটা বেশ নিরালা মনে হচ্ছে তার কাছে। সে চায় যে ওখানেই তার মরণ হোক। জর্জ আর আমাকে সে অনুরোধ করে তার হয়ে তার মাকে বিদায় চুম্বন দিতে, আত্মীয়দের বলতে যে সে ওদেরকে মাফ করে দিয়েছে এবং সুখে মৃত্যুবরণ করেছে।
সেই মুহূর্তে একটা রাচ্চাছেলের ছদ্মবেশে সেখানে এক দেবদূতের আবির্ভাব হয় (দেবদূতের পক্ষে ধারণাযোগ্য এর চেয়ে কার্যকর কোন ছদ্মবেশের কথা আমার মাথায় আসে না)। তার এক হাতে একটা বিয়ারের ‘ক্যান’–অন্য হাতে দড়ির আগায় বাঁধা কি একটা জিনিস। সামনে কোন চ্যাপ্টা পাথর পড়লে জিনিসটাকে সে নামিয়ে দেয় এবং পাথরটা পার হলে তুলে নেয়। এতে এক অদ্ভুত ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। শব্দটা দুঃখের ও যন্ত্রণার।
এ স্বর্গীয় দূতকে (পরে আবিষ্কার করি যে ঠিকই সে তাই) আমরা জিজ্ঞেস করি—সে এমন কোন নিরালা বাড়ির কথা জানে কিনা যেখানে বাসিন্দা কম এবং তারা অক্ষম (বৃদ্ধা মহিলা আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভদ্রলোক হলেই ভাল), এবং তারা ভয় দেখালে সহজেই তিনজন মরিয়া হয়ে ওঠা যুবককে ওই রাতের জন্য নিজেদের বিছানা ছেড়ে দেবে। এরকম বাড়ির কথা জানা না থাকলে সে আমাদেরকে একটা খালি শুয়োরের খোঁয়াড়, কিংবা পরিত্যক্ত চুনের ভাটি, অথবা ওই ধরনের কিছুর কথা বলতে পারে কিনা তা ও জিজ্ঞেস করি। সে বলে ওরকম জায়গা—অন্তত এখন পাওয়া যাবে এমন জায়গার কথা তার জানা নাই। তবে আমরা চাইলে তার সাথে যেতে পারি। তার মায়ের বাড়তি কামরা একটা আছে এবং তিনি আমাদেরকে রাতের জন্য জায়গা দিতে পারেন।
সেখানে সেই চাঁদের আলোতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটির গলা জড়িয়ে ধরি এবং তাকে আশীর্বাদ করতে থাকি। ওই দৃশ্যটা বড়ই সুন্দর হত যদি না আমাদের আবেগের আতিশয্য ও ধাক্কা সামলাতে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে বাচ্চাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ত এবং আমরা সুদ্ধ হুমড়ি খেয়ে তার ওপর পড়ে যেতাম। খুশিতে বিভোর হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে হ্যারিস। জ্ঞান ফিরে পাবার জন্য ওকে বাচ্চাটার বিয়ার ক্যান ছিনিয়ে নিয়ে ওটার অর্ধেকটা খালি করে ফেলতে হয়। তারপর সে মারে এক দৌড়। ফলে লটবহরের বোঝা বইতে হয় জর্জ আর আমাকে।
বাচ্চাটা আর তার মা থাকে চার কামরার একটা কুটিরে। বড় ভাল মানুষ। আমাদেরকে গরম বেকন খেতে দেয়। আমরা সবটুকু—পাঁচ পাউণ্ড-খেয়ে ফেলি। এরপরে খাই জ্যাম টার্ট, আর দু’পট চা। তারপর যাই শুতে। কামরায় বিছানা ছিল দুটি। একটি ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ট্রাল বেড (ভাঁজ করে রাখা যায় এরকম খাট)। জর্জ আর আমি শুই এটাতে। অন্যটা বাচ্চা ছেলেটার খাট। ওটাতে হ্যারিস একাই শোয়। সকালে আমরা দেখি যে তার নাঙ্গা পা দুটো বেরিয়ে আছে খাটের বাইরে টানটান হয়ে। গোসল করার সময় জর্জ আর আমি তার পা দুটোকে তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করি।
যাকগে, এবার ফিরে যাই আমাদের বর্তমান ট্রিপের কথায়। উত্তেজনাকর কিছুই আর ঘটল না। গুণ টেনে মাঙ্কি দ্বীপের কিছু দূরে গিয়ে আমরা থামলাম এবং লাঞ্চটা সেরে নিলাম। কোল্ড-বীফ খেতে খেতে আমাদের খেয়াল হলো যে শর্ষে আনতে ভুলে গেছি। তখন আমি অনুভব করলাম যে শর্ষে আমার চাই-ই। শর্ষে খাওয়ার এত প্রবল ইচ্ছা আমার জীবনে এর আগে বা পরে আর কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনিতে শর্ষের ধারও ধারি না আমি। খুব কুচিৎ ওটা খাই। কিন্তু ওই সময় ওটার জন্য দুনিয়াটা দিয়ে দিতাম।
এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে ক’টা দুনিয়া থাকতে পারে আমার জানা নাই, তবে ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তটিতে কেউ যদি আমাকে এক চামচ শর্ষে এনে দিত তাহলে সবগুলো দুনিয়াই আমার কাছ থেকে সে নিয়ে নিতে পারত। আমি যখন কোন জিনিস চাই এবং পাই না তখন ওরকম বেপরোয়া হয়ে উঠি।
হ্যারিস বলল যে শর্ষের বিনিময়ে সে-ও দুনিয়া বিলিয়ে দেবে। ওই সময় এক টিন শর্ষে নিয়ে কেউ ওখানে চলে এলে খুবই লাভ হত তার। দুনিয়াগুলোর মালিক হয়ে সে বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে নিশ্চিন্তে কাটাতে পারত।
কিন্তু তা তো হবার নয়! অসঙ্কোচে বলছি, শর্ষেটা হাতে আসার পর আমি আর হ্যারিস দু’জনেই জবান থেকে সরে যাবার চেষ্টা করতাম। লোকে উত্তেজনার মুহূর্তে এসব অবিবেচনা প্রসূত প্রস্তাব দিয়ে বসে। পরে অবশ্য বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গেলে দেখতে পায় যে তারা যা দিতে চাচ্ছে সেটার মূল্য প্রার্থিত বস্তুর মূল্যের চাইতে অনেক অনেক বেশি।
শর্ষের অভাবে নৌকায় বিষাদের ছায়া নেমে এল। নীরবে বীফ খেলাম আমরা। অস্তিত্বটা শূন্যগর্ভ ও আকর্ষণহীন মনে হলো। শৈশবের সুখের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম আমরা। তবে অ্যাপল-টার্ট খাওয়ার সময় এবং জর্জ যখন ঝুড়ির তলা হাতড়ে আনারসের একটা টিন বের করে গড়িয়ে নৌকার মাঝখানে নিয়ে গেল তখন আমরা কিছুটা খুশি হয়ে উঠলাম। আমরা অনুভব করলাম যে জীবনটা যতই যা হোক, উপভোগ করার মত।
তিনজনই আমরা আনারসের ভক্ত। টিনের ওপরকার ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে আমরা ভেতরের রসের কথা ভাবলাম, হাসলাম একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। হ্যারিস একটা চামচ নিয়ে তৈরি হয়ে গেল।
টিনটা খোলার জন্য ছুরি খুঁজতে লাগলাম। ঝুড়ির সবকিছু বের করে তন্ন তন্ন করে দেখলাম। ব্যাগগুলোর জিনিসপত্র সব ঘাঁটলাম। নৌকার তলায় লাগানো বোর্ডগুলো টেনে টেনে তুলে ফেললাম। সব মালপত্র তীরে নিয়ে গিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে দেখলাম। টিন খোলার ছুরি পাওয়া গেল না।
হ্যারিস পকেট-ছুরি দিয়ে ওটা খুলতে গিয়ে ছুরিটা ভাঙল এবং বিশ্রীভাবে নিজের হাত কেটে ফেলল। জর্জ চেষ্টা করল ওটাকে কাঁচি দিয়ে খুলতে। কাঁচিটা ওপর দিকে লাফিয়ে উঠে তার চোখ খুলে ফেলার উপক্রম করল। ওরা দু’জন নিজেদের ক্ষতস্থান ব্যাণ্ডেজ করা নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় আমি চেষ্টা করলাম আঁকড়ার সূঁচালো ফলা দিয়ে টিনটাকে ছেঁদা করতে। আঁকড়াটা হাত ফস্কে ঝাঁকি মেরে আমাকে ফেলে দিল নৌকা আর তীরের মাঝখানে, দু’ফুট কাদাপানির মধ্যে। টিনটা অক্ষত অবস্থায় গড়াতে গড়াতে গিয়ে একটা চায়ের পেয়ালা ভেঙে ফেলল।
এবার খেপে গেলাম আমরা। টিনটাকে তীরে নিয়ে গেলাম। মাঠ থেকে এক বড় ধারাল পাথর কুড়িয়ে আনল হ্যারিস। আমি নৌকা থেকে মাস্তুলটা উঠিয়ে আনলাম। জর্জ টিনটাকে ধরে রাখল, হ্যারিস পাথরের ধারাল দিকটা চেপে ধরল টিনের মাথায়, আমি মাস্তুলটা যথাসম্ভব উপরে তুলে সর্বশক্তি দিয়ে মারলাম এক বাড়ি।
জর্জের স্ট্র-হ্যাটটিই সেদিন তার প্রাণটা বাঁচিয়েছিল। ওই হ্যাটটি (ওটার যেটুকু অবশিষ্ট আছে) সে রেখে দিয়েছে। শীতের সন্ধ্যায় ছেলে-ছোকরারা যখন পাইপ ধরিয়ে বসে নিজ নিজ জীবনের বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার গল্প ফাঁদে, তখন জর্জ ওটা নামিয়ে এনে দেখায় ওদেরকে। তারপর শুরু হয় সেই চমকপ্রদ কাহিনী নতুন করে বলা। প্রতিবারই সে ওতে বাড়তি কিছু বিবরণ যোগ করে দেয়।
হ্যারিসের গায়েও সামান্য আঘাত লাগে।
এ ঘটনার পর আমি মাস্তুল দিয়ে টিনটাকে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকি পিটিয়ে পিটিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লে দায়িত্বটা নিয়ে নেয় হ্যারিস।
পিটিয়ে পিটিয়ে ওটাকে আমরা চ্যাপ্টা করে ফেলি, চৌকোনা করি, জ্যামিতির পরিচিত সব রকম আকার দান করি, কিন্তু ফাটাতে বা ছিদ্র করতে পারি না। এরপর ওটাকে নিয়ে পড়ে জর্জ। তার পিটুনিতে টিনটা এমন এক অদ্ভুত, ভৌতিক, অপার্থিব, বর্বর ও বিকট রূপ নেয় যে অবশেষে ভয় পেয়ে সে মাস্তুলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তখন তিনজন মিলে আমরা ওটাকে ঘিরে বসি। দেখতে থাকি জিনিসটাকে।
টিনের ঢাকনার দিকটা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত এমনভাবে চুপসে ভেতর দিকে ঢুকে গেছে যে দেখে মনে হলো ওটা যেন আমাদের দিকে চেয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছে। ওই হাসিটা ভীষণ রাগিয়ে দেয় আমাদেরকে। হ্যারিস খপ্ করে ওটাকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নদীর মাঝখানে। ডোবার সময় আমরা ওটাকে গাল দিতে থাকি।
নৌকায় উঠে সটকে পড়ি আমরা জায়গাটা থেকে। মেইডেনহেড পৌঁছার আগে আর কোথাও থামি না।
মেইডেনহেড বড্ড বেশি চালিয়াতির জায়গা। মোটেই আনন্দজনক নয়। এটা হলো নদীপথের যত বাবু আর ওদের অতিরিক্ত পোশাকধারী মহিলা সঙ্গীদের প্রিয় আস্তানা। এটা হলো সেই জাঁকজমক দেখানো হোটেলগুলোর শহর, যেখানে ফুলবাবু আর ব্যালে নর্তকীরা আনাগোনা করে। এ হচ্ছে সেই ডাইনীর রান্নাঘর—যেখান থেকে নদীর ওই দানবগুলো—স্টীম-লঞ্চগুলো বের হয়ে আসে। লণ্ডন জার্নাল পত্রিকার ডিউক সাহেব ওখানে সব সময় একটা ‘ছোট্ট জায়গা’ রাখেন এবং তিনখণ্ড উপন্যাসের নায়িকাটি অন্যের স্বামীকে নিয়ে ফূর্তি করতে বেরুলে সেখানে নিয়ে ডিনার খান।
মেইডেনহেড পার হবার পরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা আর ঘটেনি। হাল ধরে বসেছিলাম আমি। পালে বেশ হাওয়া লেগেছিল। গোটা নদী প্রায় ফাঁকা। কেবল দূরে মাঝ-নদীতে নোঙর করা একটা জেলে ডিঙ্গি। কাছে যেতে দেখলাম তিন গোমড়ামুখো বুড়ো মাছ ধরছে। চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুতোর দিকে। আর, রক্তিম সূর্যাস্তের অতীন্দ্রিয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে নদীর পানি, আগুন-রাঙা হয়ে উঠেছে দু’পাড়ের উঁচু বনভূমি, আকাশের পুঞ্জীভূত মেঘরাশি পরিণত হয়েছে এক অপরূপ সোনালী শোভায়। এ এক গভীর মুগ্ধতা, উচ্ছ্বসিত আশা আর আকাঙ্ক্ষার মুহূর্ত। গাঢ় রক্তবর্ণ আকাশের পটভূমিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে ছোট্ট পালটি, আমাদের চারদিকে ঘনায়মান গোধূলি পৃথিবীটাকে ঢেকে দিচ্ছে রঙধনুর ছায়ার আবরণে।
আমাদের পেছনে ধীর পায়ে নেমে আসছে রাতের আঁধার। আমরা যেন কোন্ প্রাচীন কিংবদন্তীর নাইট, পাল-তোলা নৌকায় চেপে কোন অতীন্দ্রিয় হ্রদ পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছি অজানা এক গোধূলির রাজ্যে, সূর্যাস্তের মহান ভূমিতে।
না, গোধূলির রাজ্যে আমরা যাইনি। আমরা হুস্ করে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছি ওই ডিঙ্গিটাকে—যেখানে তিন বুড়ো বসে বসে মাছ ধরছিল। আমাদের পালের বাধার জন্য দেখতে না পাওয়ায় প্রথমে বুঝতে পারিনি কি হয়েছে। তবে সান্ধ্য বাতাসে উত্থিত ভাষার প্রকৃতি থেকে বুঝতে পারি যে মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর কাছাকাছি পৌঁছেছি এবং তারা বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট।
হ্যারিস পালটা নামাল। তখন আমরা দেখলাম কি কাণ্ড ঘটেছে। আমাদের নৌকার ধাক্কায় তিন বুড়ো তাদের চেয়ার থেকে ছিটকে একসাথে স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে গেছে নৌকার তলায়। এখন তারা ধীরে ধীরে, অতি কষ্টে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে পরস্পরের দেহ থেকে। গায়ে লেপ্টে যাওয়া মাছগুলোকে তুলে ফেলছে এবং এসব কাজ করতে করতে গালি দিচ্ছে আমাদেরকে। আর সে কি গালি! সাধারণ ভাসাভাসা ধরনের গালি নয়—দীর্ঘ, সুরচিত, অর্থবহ গালি—আমাদের গত জীবন, ভবিষ্যৎ জীবন, আমাদের সকল আত্মীয়স্বজন ও আমাদের সাথে সম্পর্কিত সব কিছুকে জড়িয়ে তৈরি সুন্দর শক্ত গালি।
হ্যারিস ওদেরকে বলল যে সারাদিন একটানা বসে বসে মাছ ধরার পর এই একটুখানি উত্তেজনাকর ঘটনার জন্য ওদের তো কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। হ্যারিস আরও বলল যে ওদের মত বয়স্ক মানুষকে মেজাজ হারিয়ে অমন গালাগাল দিতে দেখে সে আহত ও দুঃখিত হয়েছে।
কিন্তু কোন ফল হলো না ওসব কথায়।
জর্জ বলল, এর পর থেকে সে হাল ধরবে। আমার মত মানুষের মন নৌকার হাল ধরে নষ্ট হবে এটা সে আশা করে না। এর চাইতে তুচ্ছ সাধারণ লোকদেরই নৌকার তত্ত্বাবধান করা ভাল। তা নাহলে আমরা সবাই ডুবে মরব। এই বলে হাল ধরে সে আমাদেরকে মার্লোতে নিয়ে গেল।
মার্লো পৌঁছে পুলের নিচে নৌকা রেখে রাতের জন্য আমরা ‘ক্রাউন’ হোটেলে আশ্রয় নিলাম।