এগারো
পরদিন সকাল ছ’টায় জেগে উঠে দেখি জর্জও জেগেছে। দু’জনেই পাশ ফিরে শুয়ে আবার চেষ্টা করলাম ঘুমাতে, কিন্তু পারলাম না।
বৈঠার গুঁতো মেরে হ্যারিসকে জাগাবার চেষ্টা করলাম। তৃতীয় গুঁতোয় কাজ হলো। পাশ ফিরে সে বলল যে এখনি উঠে তার ফিতেওয়ালা বুট পরে নেবে। আমরা অবশ্য আঁকড়ার ঘা মেরে ওকে বুঝিয়ে দিলাম সে কোথায় আছে। হঠাৎ উঠে বসল সে। এতে মণ্টমোরেন্সিটা ছিটকে গিয়ে পড়ল নৌকার এক পাশে। বেচারা বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিল হ্যারিসের বুকের ঠিক মাঝখানটায় শুয়ে।
ক্যানভাস গুটিয়ে চারজনে নৌকার শেষ প্রান্তে গিয়ে মাথা বের করলাম। নিচে পানির দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলাম শীতে। রাতের বেলা ভেবেছিলাম ভোরে উঠে শাল কম্বল ছুঁড়ে ফেলব, ক্যানভাস খুলে উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ব নদীর বুকে এবং অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটব মনের সুখে। এখন সকাল হতেই কেন জানি না, কাজটা আর তেমন আকর্ষণীয় মনে হলো না। পানিটা যেন স্যাঁতসেঁতে এবং বেজায় রকম ঠাণ্ডা। বাতাসটাও মনে হলো বেশ হাড়-কাঁপানো।
‘কে নামবে আগে?’ জিজ্ঞেস করল হ্যারিস।
আগে নামার জন্য কারও তেমন তাড়াহুড়া দেখা গেল না। জর্জ নৌকার ভেতর দিকে চলে গিয়ে মোজা পরে বুঝিয়ে দিল যে সে নামবে না। মণ্টমোরেন্সি এক অনিচ্ছাকৃত ‘ঘেউ’ শব্দ দ্বারা তার মনোভাব প্রকাশ করল। সে যেন বলতে চাইল যে পানিতে নামার কথা ভাবলেই তার আতঙ্ক হয়। পানি থেকে উঠে আসতে কষ্ট হবে—একথা বলে হ্যারিস গিয়ে তার পাজামা গোছাতে লাগল।
আমার ইচ্ছা হচ্ছিল না পুরাপুরি হার মানতে, যদিও পানিতে নামাটা আমার ভাল লাগে না। পানির নিচে সূঁচালো খুঁটা, কাঁটা, কিংবা আগাছা থাকতে পারে। আপসমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঠিক করলাম যে নদীর ধারে নেমে গায়ে পানি ছিটিয়ে আসব। তোয়ালে নিয়ে চলে গেলাম। কাছেই তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা গাছ। উঠলাম সেই গাছের একটা ডালে। ডালটা নিচু হয়ে পানির ভেতরে নেমে গেছে।
খুব শীত লাগছিল। কনকনে হাওয়া যেন ছুরির ফলার মত বিধে যাচ্ছিল গায়ে। ভাবলাম, পানি ছিটাব না শেষ পর্যন্ত, ফিরে গিয়ে পোশাক পরে ফেলব। কিন্তু যেই না ফিরতে গেলাম — অমনি ডালটা খসে গেল, তোয়ালেসহ ঝপাস্ করে আমি পড়ে গেলাম পানিতে। কি ঘটেছে বুঝে ওঠার আগেই তলিয়ে গেলাম এবং গ্যালন খানেক পানি গিলে স্রোতের টানে চলে গেলাম মাঝনদীতে। ভেসে উঠে মুখ দিয়ে পানি ছিটাতে ছিটাতে নৌকার দিকে সাঁতরে আসার সময় শুনলাম হ্যারিস বলছে, ‘হা ঈশ্বর, আমাদের “জে” দেখছি পানিতে নেমেছে। আমি ভাবিনি যে তার সাহস হবে। তুমি ভেবেছিলে কি?’
‘কেমন লাগছে রে?’ জিজ্ঞেস করল জর্জ। মুখ থেকে পানি ছিটিয়ে জবাব দিলাম, ‘চমৎকার লাগছে! তোমরা আহাম্মক, তাই নামোনি। চেষ্টা করে দেখো না কেন? শুধু একটুখানি শক্ত হওয়া দরকার।’
কিন্তু এসব বলে ওদেরকে আমি টলাতে পারলাম না।
পানি থেকে উঠে পোশাক পরার সময় এক মজার কাণ্ড ঘটল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে তাড়াতাড়ি শার্ট পরতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় ওটাকে ফেলে দিলাম পানিতে। এতে দারুণ খেপে গেলাম আমি, বিশেষত জর্জ হো-হো করে হেসে ওঠায়। বুঝলাম না অত হাসির কি হয়েছে। জর্জকে বললামও সেকথা। শুনে জর্জ আরও জোরে জোরে হাসতে লাগল। অত হাসতে আমি আর কাউকে দেখিনি। শেষে তার ওপর আমার মেজাজটা একদম বিগড়ে গেল। তাকে বুঝিয়ে দিলাম সে ঘরত্বের নৌবিহার কেমন বদ্ধ পাগল, উন্মাদ এবং অর্বাচীন। কিন্তু এতে সে আরও জোরে হো-হো করে হাসতে লাগল। আর তখনি, অর্থাৎ যেই মাত্র শার্টটাকে আমি তুলতে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে, লক্ষ করলাম যে ওটা আমার নয় মোটেই— ওটা হলো জর্জের শার্ট। এতক্ষণে ব্যাপারটার হাস্যকর দিকটি প্রথমবারের মত আমার নজরে পড়ল এবং পড়া মাত্রই আমি হাসতে আরম্ভ করলাম। অট্টহাসি হাসতে হাসতে জর্জের ভেজা শার্টের দিকে এবং জর্জের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাতে তাকাতে ক্রমেই বেশি বেশি মজা পেতে লাগলাম। আমি এত হাসলাম যে শেষ পর্যন্ত শার্টটা আমার হাত থেকে আবার পড়ে গেল পানিতে।
হাসির দমকের ফাঁকে ফাঁকে জর্জ বলল, ‘তুমি কি…হো-হো…তুমি কি…হো—হো হো…শার্টটা তুলবে না?’
আমি এত বেশি হাসছিলাম যে কতক্ষণ পর্যন্ত জবাবই দিতে পারলাম না। শেষে দম নিতে নিতে গলা ঝাঁকিয়ে কোনরকমে বলে ফেললাম, ‘ওটা আমার শার্ট নয়, তোমার!’
কোন মানুষের হাসিমুখ মুহূর্তে বদলে গিয়ে অমন কঠোর হয়ে উঠতে জীবনে এর আগে আর কখনও দেখিনি।
লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘কি বললি, ওরে মূর্খ! ওরে গাধা! সাবধানে কাজ করতে পারিস না? কাপড় পরতে হলে তীরে গিয়ে পরিসনি কেন? নৌকায় ওঠার উপযুক্ত নস্ তুই। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি আমি। দে, আঁকড়াটা দে আমাকে।’
আমি ব্যাপারটার হাস্যকর দিকটার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে তা দেখতে পেল না। একেক সময় আমাদের জর্জটার রসবোধ এমন ভোঁতা হয়ে যায় যে কৌতুক তার চোখে পড়ে না।
হ্যারিস প্রস্তাব করল যে ব্রেকফাস্টে আমরা ডিমের ওমলেট খাব। ওমলেট সে নিজেই বানাবে। তার বয়ান শুনে মনে হলো ওমলেট বানাতে সে সিদ্ধহস্ত। পিকনিকে ও প্রমোদ তরীতে বেড়াতে গিয়ে প্রায়ই নাকি সে ওমলেট বানিয়েছে। ওমলেটের জন্য সে বিখ্যাত। এসব কথাবার্তা থেকে আমরা বুঝলাম যে তার হাতের ওমলেট একবার যারা খেয়েছে তাদের মুখে পরে অন্য খাবার রোচেনি। হ্যারিসের ওমলেট না পেয়ে হা-পিত্যেস করতে করতে বেচারারা মরে গেছে।
শুনতে শুনতে জিভে পানি এসে গেল আমাদের। আমরা উনুনটা, কড়াইটা এবং ঝুড়ির ভেতর যে ক’টা ডিম চাপ লেগে ভেঙে অন্য জিনিসপত্রে লেপ্টে না গিয়ে তখনও অক্ষত অবস্থায় ছিল সেগুলো ওর হাতে তুলে দিয়ে অনুরোধ করলাম সে যেন কাজটা শুরু করে।
ডিম ভাঙতে, ঠিক ভাঙতে নয়—ভেঙে কড়াইয়ের মধ্যে ফেলতে, ওর পাজামার ওপর পড়া থেকে এবং শার্টের আস্তিন বেয়ে ওঠা থেকে ওগুলোকে বিরত রাখতে, কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হলো ওকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় আধা ডজন ডিম ভেঙে কড়াইতে ফেলল সে এবং উনুনের পাশে উবু হয়ে বসে ফেটাতে লাগল ওগুলোকে।
জর্জ আর আমার বিচারে মনে হলো কাজটা বড্ড হয়রানিকর। যতবার সে কড়াইটার কাছে গেল ততবারই তার হাত পুড়ল, হাতের জিনিস নিচে ফেলে দিয়ে সে নাচতে লাগল উনুনটার চারপাশে, আঙুল ছড়িয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গাল দিতে থাকল সব কিছুকে। সত্যি, জর্জ আর আমি যতবার তাকালাম ওর দিকে, ততবারই দেখলাম যে ওই ক্রিয়াটিই সে করে চলেছে। আমরা প্রথমদিকে ভাবলাম যে ওটা হয়তো ওমলেট পাক-প্রণালীরই একটা প্রয়োজনীয় অংশ।
ওমলেট কি জিনিস আমরা জানতাম না। কল্পনা করলাম, ওটা নিশ্চয় রেড—ইণ্ডিয়ান কিংবা সাণ্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জের ধরনের কোন খাবার, যেটা সঠিকভাবে রান্না করতে হলে নৃত্য ও মন্ত্রপাঠের প্রয়োজন হয়। মণ্টমোরেন্সি গিয়ে নাকটা বাড়াল কড়াইয়ের ওপর। ফুটন্ত চর্বির ছিটা লেগে ফোস্কা পড়ে গেল তার নাকে। সে-ও নেচে নেচে গাল দিতে আরম্ভ করল। সব কিছু মিলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল আমার দেখা সবচেয়ে মজাদার ও উত্তেজনাকর দৃশ্য। এটা শেষ হয়ে যাবার পর জর্জ আর আমি দু’জনই রীতিমত দুঃখ বোধ করলাম।
রন্ধন কর্মের ফলটা হ্যারিসের প্রত্যাশা অনুযায়ী হলো না। খাওয়ার উপযোগী বস্তু কিছুই চোখে পড়ল না আমাদের। ছ’টা ডিম ফেলা হয়েছিল কড়াইটার মধ্যে, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এল চামচখানেক পোড়া অরুচিকর ধরনের একটা পিণ্ড।
হ্যারিস বলল যে সব দোষ ওই কড়াইটার। সে মনে করে, একটা মাছ রান্নার হাঁড়ি আর গ্যাসের উনুন থাকলে কাজটা আরও ভালভাবে হতে পারত। আমরা ঠিক করলাম যে গেরস্থালীর এ দুটো প্রয়োজনীয় জিনিস যোগাড় করতে না পারা পর্যন্ত ওমলেট বানানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকব।
ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে সূর্যের তেজ বাড়ল এবং বাতাস পড়ে গেল। সকালটা হয়ে উঠল মন-মাতানো। এমন কিছু নজরে পড়ল না যা উনিশ শতককে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। রোদে প্লাবিত নদীর দিকে তাকিয়ে আমরা প্রায় কল্পনা করে ফেললাম যে আমাদের এবং ১২১৫ সালের সেই চিরবিখ্যাত জুনের সকালটির মধ্যেকার শত শত বছরের ব্যবধান অপসৃত হয়েছে এবং আমরা—ঘরে-বোনা কাপড় পরা ইংরেজ সাধারণ মধ্যশ্রেণীর সন্তানরা কোমরে ছোরা গুঁজে অপেক্ষা করছি ইতিহাসের সেই বিখ্যাত পাতাটি কিভাবে লেখা হচ্ছে তা দেখার জন্য। প্রায় চারশো বছরেরও বেশি কাল পরে ইতিহাসের ওই পাতাটির মর্ম সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেন জনৈক অলিভার ক্রমওয়েল। ভদ্রলোক গভীরভাবে ওটি অধ্যয়ন করেছিলেন
গ্রীষ্মের সেই রৌদ্রস্নাত সকালটা। উজ্জ্বল, কোমল, নিথর। কিন্তু বাতাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আসন্ন আলোড়নের শিহরণ। রাজা জন রাত কাটিয়েছেন ডানক্রফ্ট হলে। আগের দিন ছোট্ট স্টেইনেস শহরটা সারাক্ষণ ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হয়েছে সশস্ত্র লোকদের অস্ত্রের ঝনঝনা, অমসৃণ পাথুরে সড়কে বিশাল বিশাল আকারের অশ্বের খুরের শব্দ, ক্যাপ্টেনদের হাঁকডাক এবং দাড়ীওয়ালা তীরন্দাজ, বল্লম বর্শাধারী বিদেশী সৈন্যদের অভদ্র হাসিঠাট্টা আর অশ্লীল গালাগালির আওয়াজে।
ঝলমলে পোশাকে সজ্জিত নাইট আর স্কোয়ারের দল ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এসে পৌঁছেছেন। তাঁদের সারাদেহ ভ্রমণের ক্লেদ আর ধুলায় আবৃত। ভীত সন্ত্রস্ত শহরবাসীরা সারাটা সন্ধ্যাকাল তাড়াতাড়ি দুয়ার খুলে অশিষ্ট সৈন্যদেরকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে। কারণ, তাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং দু’টোই হওয়া চাই সব চাইতে সেরা। নতুবা সেই ঘর আর ঘরের মালিকদের কপালে রয়েছে চরম দুর্ভোগ, যেহেতু এসব ঝঞ্চা-ক্ষুব্ধ দিনে তরবারিই হলো বিচারক, জুরী, ফরিয়াদী এবং জল্লাদ। তরবারি ইচ্ছা করলে কারও কাছ থেকে কিছু নিয়ে তাকে প্রাণে না মেরে রেহাই দিলেও দিতে পারে।
বাজার এলাকায় ব্যারনদের সৈন্যরা শিবিরে শিবিরে আগুনের চারদিকে বসে খাচ্ছে দাচ্ছে, মদ গিলছে ঢকঢক করে, হৈ-হল্লা করে মাতলামির গান গাইছে। রাত গভীর হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তারা জুয়াখেলা আর ঝগড়াঝাঁটিতে মত্ত হচ্ছে। জ্বলন্ত আগুনের আভা অদ্ভুত ছায়া ফেলছে তাদের স্তূপীকৃত অস্ত্রশস্ত্র আর কুৎসিত চেহারার ওপর। নগরের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে চারপাশে ভিড় করে অবাক বিস্ময়ে দেখছে তাদেরকে। নাদুস-নুদুস দেহাতী যুবতীরা হেসে হেসে ঘনিয়ে এসে দেহাতী যুবাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ও উদ্ধত-স্বভাব সৈন্যদের সাথে শুঁড়িখানার ঠাট্টা-বিদ্রূপ বিনিময় করছে। অনাদৃত গ্রাম্য যুবারা পেছনে দাঁড়িয়ে মুখে শূন্য হাসি মেখে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। চারদিকের মাঠের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন বড় বড় লর্ডরা তাঁদের সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। তাদের দূরবর্তী শিবিরগুলোতে জ্বলছে মিটিমিটি আলোর শিখা। ওঁৎ পাতা নেকড়ের মত শহরের উপকণ্ঠে নড়াচড়া করছে মিথ্যাবাদী জনের ফরাসী ভাড়াটে সৈন্যরা।
প্রতিটি অন্ধকার রাস্তায় টহল দিচ্ছে সশস্ত্র পাহারাদার, উঁচু জায়গাগুলোতে মিটমিট করে জ্বলছে পাহারাদারদের বাতি। এমনি করে কেটে যায় রাতটা। টেম্স-এর এ সুন্দর উপত্যকা জুড়ে নেমে আসে সেই মহা-প্রভাত—যা নির্ধারিত করে দেয় পরবর্তী বহু যুগ-যুগান্তের মানুষের ভাগ্যকে।
আমরা যেখানে আছি ঠিক তার ওপরটাতেই সেই ধূসর প্রভাতের শুরু থেকে চলছে মহা শোরগোল, শোনা যাচ্ছে বহু মজুরের কোলাহল। গতকাল আনা বিরাট সামিয়ানাটা ওঠানো হচ্ছে। ছুতোর মিস্ত্রীরা সারি সারি আসন পেতে পেরেক ঠুকে দিচ্ছে। লণ্ডন থেকে নানা রঙের ঝালর-পর্দা, সিল্ক আর সোনারূপা খচিত কাপড় নিয়ে এসেছে এপ্রেনটিসরা।
এখন দেখ! দেখ! স্টেইনেস থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে নদীর ধার ঘেঁষে, ওই পথ ধরে গম্ভীর স্বরে কথা বলতে বলতে এবং হাসাহাসি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে জনা দশ-বারো দীর্ঘদেহী টাঙ্গিধারী লোক। এরা হলো ব্যারনদের অনুচর। নদীর তীর বরাবর এগিয়ে এসে আমাদের থেকে শ’খানেক গজ দূরে থেমে নিজ নিজ হাতিয়ারে ভর দিয়ে অপেক্ষা করছে তারা।
এমনি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অস্ত্রধারী মানুষের নতুন নতুন দল আসছে ওই পথে কুচকাওয়াজ করে। তাদের শিরস্ত্রাণ আর বুকের বর্ম থেকে বিচ্ছুরিত প্রভাত সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূরে। ঝকমকে আবরণে সাজানো অসংখ্য ঘোড়ায় যেন ভরে গেছে গোটা পথটা। ওদের মিলিত চিঁহি—ধ্বনিতে পূর্ণ হয়ে গেছে দশদিক। ঘোড়সওয়ারেরা হাঁকডাক করতে করতে ছুটাছুটি করছে এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপের কাছে। গরম হাওয়ায় অলসভাবে আন্দোলিত হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট পতাকা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো সৈন্যরা মাঝেমধ্যে চঞ্চল হয়ে দু’পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে কোন শ্রেষ্ঠ ব্যারনের জন্য। তিনি তাঁর দেহরক্ষী স্কোয়ারদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠে এগিয়ে গিয়ে অবস্থান নিচ্ছেন নিজের ভূমিদাস ও প্রজাদের সামনে।
আর ওখানটার ঠিক বিপরীত দিকে, কুপারের পাহাড়ের ঢালুতে জড়ো হয়েছে বিস্মিত গ্রামের মানুষ, কৌতূহলী শহরবাসী। ওরা স্টেইনেস থেকে ছুটে এসেছে এখানে। ওরা কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না এত গোলমাল কিসের জন্য। তবে যে মহা ঘটনাটা ওরা দেখতে এসেছে তার সম্পর্কে ওদের প্রত্যেকেরই একটা আলাদা ভাষ্য রয়েছে। কেউ কেউ বলে যে এদিনের ঘটনায় মানুষের অনেক উপকার হবে। কিন্তু বুড়োরা মাথা নাড়ে, কারণ এরকম গালগল্প তারা আগেও শুনেছে।
স্টেইনেস থেকে গোটা নদীটা ছেয়ে গেছে অসংখ্য নৌকা আর চামড়ায় তৈরি ছোট্ট ডিঙ্গিতে। এসব ডিঙ্গি এখন আর কেউ পছন্দ করে না, কেবল গরীবরাই ব্যবহার করে। নৌকা আর ডিঙ্গিগুলো যতটা সাহস হয়েছে ততখানি এগিয়ে ভিড় করেছে ঢাকনি-দেয়া প্রকাণ্ড বজরাগুলোর কাছাকাছি। এগুলো প্রস্তুত হয়ে আছে রাজা জনকে সেই স্থানটিতে নিয়ে যাবার জন্য যেখানে ম্যাগনা কার্টার চূড়ান্ত দলিলটা অপেক্ষা করছে তাঁর সই-এর জন্য।
বেলা দুপুর হয়ে গেছে। বহু ঘণ্টা যাবৎ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছি আমরা এবং আর সব লোক। গুজব রটেছে যে পিচ্ছিল জন আবার সটকে পড়েছেন ব্যারনদের কব্জা থেকে, ভাড়াটে সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে গেছেন ডানক্রফ্ট হল থেকে এবং শিগগিরই তিনি প্রজাদের মুক্তিসনদে সই করার বদলে অন্য কাজে হাত দেবেন।
না, তা হতে পারেনি। এবার তিনি ধরা পড়েছেন লৌহমুঠিতে। নানা ছল—চাতুরি করলেন তিনি ছাড়া পাবার জন্য, কিন্তু বৃথা গেল সবই। রাস্তায় দূরে দেখা গেল একটা ছোট্ট ধুলোর মেঘ। ক্রমে ক্রমেই সেটা কাছে এগিয়ে আসতে ও বড় হয়ে উঠতে লাগল। অনেক ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠল। অবশেষে সমবেত সশস্ত্র লোকদের বিক্ষিপ্ত দলগুলোর মাঝখান দিয়ে ঠেলে ঢুকে পড়ল বর্ণাঢ্য পোশাকধারী অশ্বারোহী লর্ড আর নাইটদের এক দীপ্ত মিছিল। ব্যারনদের প্রজা আর অনুচররা সামনে, পেছনে, দু’পাশে ঘিরে নিয়ে চলল সেই মিছিলকে। মাঝখানে ঘোড়ায় চড়ে চললেন রাজা জন।
বজরাগুলো যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে উপস্থিত হলেন তিনি। বড় বড় ব্যারনরা নিজ নিজ সৈন্যদের অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে এলেন তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য। হাসিমুখে তিনি সম্ভাষণ জানালেন তাঁদেরকে, হাসলেন, মধুমাখা কুশল বাক্য বললেন। ভাবখানা এমন, যেন তাঁর সম্মানে আয়োজিত কোন ভোজের উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি এসেছেন। কিন্তু ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার জন্য উঁচু হয়েই তিনি চকিতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন মিছিলের পেছনে দাঁড়ানো তাঁর ভাড়াটে ফরাসী সৈন্য এবং চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে চেপে রাখা ব্যারনদের কঠোরমূর্তি অনুচরদের দিকে।
খুবই দেরি হয়ে গেছে কি? পাশের নিশ্চিন্ত অশ্বারোহীটার প্রতি আচম্বিতে একটা আঘাত, ফরাসী সেনাদের উদ্দেশ্যে একটা আদেশ, সামনে দাঁড়ানো অপ্রস্তুত যোদ্ধাদের ওপর একটা বেপরোয়া হামলা হলেই এসব বিদ্রোহী ব্যারনকে তাঁর বিরোধিতা করার জন্য পস্তাতে হতে পারে। যদি একজন রিচার্ড থাকতেন ওখানে! তাহলে মুক্তির পেয়ালা ইংল্যাণ্ডের ওষ্ঠ থেকে ভূতলে নিক্ষিপ্ত হত, স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ পিছিয়ে যেত শত শত বছরের জন্য।
কিন্তু ইংরেজ যোদ্ধাদের কঠোর মুখগুলো দেখে দমে গেল রাজা জনের হৃদয়, তাঁর হাত দুটো ঢলে পড়ল ঘোড়ার লাগামের ওপর। ঘোড়া থেকে নেমে সবচেয়ে সামনের বজরাটিতে আসন গ্রহণ করলেন তিনি। তাঁর পেছনে দৃঢ় মুষ্টিতে তরবারির হাতল চেপে ধরে বজরায় উঠে পড়ল ব্যারনরা। হুকুম দেয়া হলো বজরা ছাড়ার।
ভারি ঝকমকে পাটাতনের বজরাগুলো ধীর গতিতে যাত্রা করল রুনিমিডের তীর ছেড়ে। ধীরে ধীরে খরস্রোত কেটে তারা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এক সময় মৃদু আওয়াজ তুলে থেমে গেল সেই ছোট্ট দ্বীপটার গা ঘেঁষে—যার নাম আজকের দিন থেকে হয়ে যাবে ম্যাগনা কার্টা দ্বীপ। তীরে উঠলেন রাজা জন। শ্বাস বন্ধ করে আমরা প্রতীক্ষায় রইলাম নীরবে। একটু পরেই এক প্রচণ্ড উল্লাস ধ্বনিতে ফেটে পড়ল আকাশ-বাতাস। আমরা জানলাম যে ইংল্যাণ্ডের মুক্তি—মন্দিরের এক মহান ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে।