ত্রিরত্নের নৌবিহার – ১০

দশ

হ্যারিস আর আমি ভাবতে লাগলাম যে বেল-উয়্যার লকটিকেও একইভাবে তুলে দেয়া হয়েছে। জর্জ গুণ টেনে আমাদেরকে স্টেইনেস পর্যন্ত নিয়ে গেছিল। সেখানে আমরা তার হাত থেকে দায়িত্ব নিই। আমাদের মনে হলো যেন পঞ্চাশ টনী বোঝা টেনে নিয়ে চলেছি এবং চল্লিশ মাইল হাঁটছি। সাড়ে সাতটায় গুণ টানা বন্ধ করে সবাই উঠে পড়লাম নৌকায়। দাঁড় বেয়ে বাঁ তীরে গিয়ে নৌকা বাঁধার একটা জায়গা খুঁজতে লাগলাম।

প্রথমে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ম্যাগনা কার্টা দ্বীপ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। নদীর এ অংশটা বড় মনোরম। নদী এখানে এক চোখ জুড়ানো সবুজ উপত্যকার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। আমাদের ইচ্ছা ছিল ওখানে কোন ছবির মত ছোট্ট খাঁড়িতে রাত কাটানোর। কিন্তু দিনের শুরুতে ছবির মত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রতি যতটা আকর্ষণ ছিল এখন তেমনটি আর অনুভব করলাম না। ওই রাতের জন্য কোন কয়লাবাহী বজরা আর গ্যাস কারখানার মাঝখানে এক চিলতে পানিতে একটুখানি আশ্রয় পেলেই আমরা বর্তে যেতাম। আমরা তখন প্রাকৃতিক দৃশ্য চাচ্ছিলাম না, আমরা চাচ্ছিলাম রাতের খাওয়াটা সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে।  তবে ‘পিকনিক পয়েন্ট’ পর্যন্ত এগিয়ে একটা প্রকাণ্ড এম্ গাছের নিচে এক চমৎকার কোণে আমরা থামলাম এবং ছড়ানো শেকড়ের সাথে নৌকাটি বাঁধলাম তারপর ভাবলাম, খাওয়াটা সেরে নেব (সময় বাঁচানোর জন্য চা পর্যন্ত আমরা খাইনি)। কিন্তু জর্জ বলল, না। আঁধার পুরোপুরি ঘন হয়ে আসার আগে এবং কি করছি সেটা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছে ওই সময়ের মধ্যেই ক্যানভাসটা খাটিয়ে ফেলা ভাল হবে। এর পরে সব কাজ হয়ে গেলে সহজ হালকা মন নিয়ে আমরা খেতে বসতে পারব।

কিন্তু ওই ক্যানভাসটা খাটাতে কি পরিমাণ ঝক্কি পোয়াতে হবে সেটা আমরা কেউই ভাবিনি। কল্পনার দৃষ্টিতে কত সহজই না দেখাচ্ছিল কাজটাকে। ধনুকের মত বাঁকানো পাঁচটা বড় আকারের লোহার পর নৌকার ওপর উপুড় করে বসিয়ে দিয়ে তার ওপর ক্যানভাসটা বিছিয়ে বেঁধে দিলেই হলো। মাত্র মিনিট দশেকের কাজ। এভাবে কাজটাকে আমরা খাটো করে দেখলাম।

তারপর পতরগুলোকে সকেটের মধ্যে বসাতে শুরু করলাম। কাজটা যে বিপজ্জনক হতে পারে তা মনেই হবে না। কিন্তু আজ অতীতের দিকে তাকিয়ে আমি একথা ভেবে আশ্চর্য হই যে গল্পটা বলার জন্য আমাদের কেউ এখনও বেঁচে আছে। ওগুলো তো পতর নয়—ছিল দানব। প্রথমে ওরা সকেটে ঢুকতেই চাইল না। ওগুলোর ওপর চড়ে আমাদেরকে লাফাতে হলো, ঝাঁপাতে হলো, লাথি মারতে হলো, নৌকার আঁকড়া দিয়ে ওগুলোকে পিটাতে হলো হাতুড়ি মারার কায়দায়। এত কাণ্ড করে ঢোকানোর পর দেখা গেল—যেটা যে সকেটে ঢোকানো হয়েছে সেটা ওই সকেটের পতর নয় তখন সবগুলোকে আবার সকেট থেকে বের করে নেয়া দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু বেরিয়ে ওরা আসবে না। দু’জনে মিলে পাঁচ মিনিট ধরে টানাটানি করার পর হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ওরা আমাদেরকে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করল। ওগুলোর মাঝখানে কব্জা লাগানো ছিল। আমাদের দৃষ্টি যখন অন্য দিকে, সে মুহূর্তে কব্জাগুলো খামচে দিল আমাদের দেহের কোমল জায়গাগুলোতে। আর, আমরা যখন পতরের এক দিকটা ধরে ধস্তাধস্তি করে ওটাকে কাজ করতে রাজি করানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, ঠিক ওই মুহূর্তে ওটার অপর দিকটা কাপুরুষের মত পেছন দিক থেকে এসে আমাদের মাথায় ঘা বসিয়ে দিতে লাগল।

শেষ পর্যন্ত আমরা সকেটে বসালাম ওগুলোকে। এবার বাকি রইল কেবল ক্যানভাসটা বিছিয়ে ঢেকে দেয়া। জর্জ ক্যানভাসের এক দিকটা খুলে বেঁধে দিল নৌকার গলুইয়ের সঙ্গে। হ্যারিস একপাশে দাঁড়িয়ে রইল ওটাকে গড়িয়ে খুলতে খুলতে আমার কাছে এগিয়ে দেয়ার জন্য। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম হ্যারিসের হাত থেকে ওটা নেয়ার জন্য নৌকার পেছন দিকে। বেশ সময় লেগে গেল ওটা আমার কাছে আসতে। জর্জ তাঁর কাজটুকু ঠিকই করল, কিন্তু হ্যারিসের জন্য কাজটা ছিল নতুন। সে গোলমাল বাধিয়ে বসল।

কিভাবে যে সে তা করতে পারল জানি না, সে নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারল না, তবে কোন না কোন রহস্যজনক পদ্ধতিতে দশ মিনিটের অতি মানবীয় প্রয়াসের পরে নিজেকে সে সম্পূর্ণভাবে ক্যানভাসের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। ক্যানভাসের পরতে পরতে এমন শক্ত করে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভাঁজ হয়ে যায় যে তার বেরিয়ে আসার আর উপায় থাকে না। মুক্তির জন্য সে অবশ্য উন্মত্তের মত লড়তে থাকে—কারণ মুক্তি প্রত্যেক ইংরেজ সন্তানের জন্মগত অধিকার, এবং তা করতে গিয়ে (এটা আমি পরে জেনেছি) সে ধাক্কা দিয়ে জর্জকে ফেলে দেয়। তখন হ্যারিসকে গাল দিতে দিতে জর্জও লড়তে থাকে এবং নিজেকে জড়িয়ে ও মুড়িয়ে ফেলে ক্যানভাসে।

ওই সময় আমি ব্যাপারটার কিছুই জানতাম না। আমি নিজে কাজটা বুঝতেও পারিনি। আমাকে বলা হয়েছিল যেখানে ছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ক্যানভাসটা গড়াতে গড়াতে আমার কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করতে। তাই আমি আর মণ্টমোরেন্সি সুশীল সুবোধ বালকের মত ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম যে ক্যানভাসটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খাচ্ছে, অতি মাত্রায় লাফাচ্ছে এদিক ওদিক। কিন্তু আমরা মনে করলাম ওটা হয়তো ওই কাজের পদ্ধতিরই অংশ। সুতরাং ওতে কোনরকম হস্তক্ষেপ করলাম না।

ক্যানভাসের তলা থেকে দম আটকানো স্বরে কিছু কথাবার্তা শুনে আমরা অনুমান করলাম যে কাজটা ওদের জন্য খুব কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে। আমরা ঠিক করলাম, ওটা একটু সহজতর হয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করব এবং তার পরে হস্তক্ষেপ করব।

অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমেই বেশি রকম তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নৌকার একপাশে ক্যানভাসের ভেতর থেকে মোচড় দিতে দিতে জর্জের মাথা বেরিয়ে এল। মাথাটা বলল, ‘এ্যাই অকম্মা ধেড়েটা, একটু সাহায্য করতে পারছ না আমাদেরকে? খড়-ঠাসা মমির মত ওখানে দাঁড়িয়ে দেখছ আমরা দুটো মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি, বুদ্ধু হাঁদা কোথাকার!’

কারও সাহায্যের আবেদন আমি কখনও উপেক্ষা করতে পারি না। গিয়ে ওদেরকে মুক্ত করলাম ক্যানভাসের ভেতর থেকে। এবং কাজটা করলাম একেবারে ঠিক সময়ে, কারণ দম আটকে হ্যারিসের মুখটা ততক্ষণে কালো হয়ে গিয়েছিল।

এরপর প্রায় আধঘণ্টা যাবৎ কঠোর পরিশ্রম করে ক্যানভাসটা লাগিয়ে আমরা খাবার-টাবার বের করলাম। কেটলিটা গলুইয়ের কাছে উনুনে চাপিয়ে ওটার দিকে না দেখার ভান করে চলে গেলাম নৌকার পেছন দিকে। বের করতে লাগলাম অন্য সব জিনিসপত্র। নদীপথে কেটলি গরম করার এটাই হচ্ছে একমাত্র পন্থা। কেটলিটা যদি লক্ষ করে যে আপনারা ওর মধ্যে পানি ফোটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, তাহলে মোটেই গরম হবে না সে। আপনাকে দূরে সরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া শুরু করতে হবে। এমন ভান করতে হবে যেন চা আপনি মোটেই খাবেন না। কেটলির দিকে ফিরেও তাকাবেন না। এরকম করলে শিগগিরই শুনবেন টগবগ করে ফুটছে পানি, চা হবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে পানিটা।

আরেকটা চমৎকার বুদ্ধি আছে। আপনাদের যদি তাড়া থাকে খুব, তাহলে পরস্পর জোরে জোরে বলাবলি করতে থাকুন যে চা-এর দরকার নেই, চা আপনারা খাবেন না। কেটলির কাছে চলে যান, যাতে সে শুনতে পায়। তারপর চেঁচিয়ে বলুন—আমি চা খেতে চাই না, তোমার চা-এর ইচ্ছা আছে, জর্জ?’ জবাবে জর্জ বলুক— ‘আরে না, না, চা আমি এক্কেবারে পছন্দ করি না। চা-র বদলে আমরা লেমোনেড খাব। চা অত্যন্ত বদহজমী জিনিস।’ সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন, কেটলির পানি ভসভস করে ফুটে উপচে পড়ে উনুনসুদ্ধ নিবিয়ে দিয়েছে।

আমরা এ নির্দোষ ছলনাটা করলাম। ফল হলো এই যে সবকিছু ঠিকঠাক করার পর দেখা গেল চা-ও তৈরি। তখন লণ্ঠন জ্বেলে আমরা বসে পড়লাম খেতে।

ওই খাওয়াটা সত্যি দরকার ছিল আমাদের। পুরো সাড়ে পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে নৌকার আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত কাঁটাচামচ বাসনপেয়ালার টুংটাং আর চার সেট পেষণ দন্তের একটানা পেষণের আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছুই শোনা গেল না। সাড়ে পঁয়ত্রিশ মিনিট পর ডান পা গুটিয়ে বাঁ পা-টা সামনে মেলে দিয়ে হ্যারিস বলে উঠল, ‘আহ্!’

তার পাঁচ মিনিট পর জর্জও ‘আহ্!” বলে খালি প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলল তীরে। . তিন মিনিট পর মণ্টমোরেন্সি এ যাত্রায় এই প্রথমবারের মত তৃপ্তির লক্ষণ দেখাল এবং কাত হয়ে শুয়ে পাগুলো মেলে ছড়িয়ে দিল। সবশেষে আমি ‘আহ্!’ বলে মাথাটা পেছনে হেলাতে গিয়েই ঢু খেলাম একটা পতরের সাথে, তবে এতে কিছু মনে করিনি আমি—এমনকি একটা গাল পর্যন্ত দিইনি

ভরপেট খাওয়ার পর কি ভালই না লাগে। মনটা সন্তুষ্ট হয়ে যায় নিজের ওপর, গোটা দুনিয়ার ওপর। যারা ভরপেট খেয়ে দেখেছে তারা বলে যে বিবেক পরিষ্কার থাকলে বেশ সুখ ও তৃপ্তি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু একই রকম সুখ ও তৃপ্তি দেয় ভরা পেট এবং তা দেয় অনেক সস্তায় ও সহজে। প্রচুর পরিমাণে সহজপাচ্য খাবার খেলে মনটা বড় উদার ও ক্ষমাশীল, মহৎ ও দয়ালু হয়ে ওঠে

আমাদের চিন্তাশক্তির ওপর পরিপাকযন্ত্রের এ আধিপত্যটা বড্ড অদ্ভুত। পাকস্থলী না চাইলে আমরা কাজকর্ম করতে পারি না, চিন্তাও করতে পারি না। আমাদের আবেগ-অনুভূতি এর নির্দেশের অধীন। ডিম-বেকন খাওয়ার পর পাকস্থলী হুকুম দেয়, ‘কাজ করো!’ বীফস্টেক-পোর্টার খাওয়ার পর বলে, ‘ঘুমাও!’ এক কাপ চা (প্রতি কাপে দু’চামচ পাতা এবং তিন মিনিটের বেশি যেন সেদ্ধ না করা হয়) খাওয়ার পর পেট মস্তিষ্ককে বলে, ‘এখন উঠে পড়ো, নিজের শক্তির পরিচয় দাও। বাকপটু হও, হৃদয়ের গভীরতা ও কোমলতা প্রদর্শন করো। প্রকৃতি ও জীবনের প্রতি স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকাও। কল্পনার সাদা ডানা বিস্তার করে ঈশ্বর-সদৃশ তেজে উড়ে যাও নিচেকার পৃথিবীর ঘূর্ণিপাকের ঊর্ধ্বে—জ্বলন্ত তারকালোকের সুদীর্ঘ অলিগলি পার হয়ে অনন্তের সিংহদ্বারে।’

গরম মাফিন পিঠা খাওয়ার পর পেট বলে, ‘মাঠের পশুরা মগজহীন ও উদাসীন। কোনরূপ কল্পনা, আশা, ভয়, ভালবাসা, কিংবা জীবনের বিন্দুমাত্র আলোর চিহ্ন পর্যন্ত নাই ওদের মধ্যে। তুমি ওদের মত হাবাগোবা অনুভূতিহীন হয়ে যাও।’ আর প্রচুর মাত্রায় ব্র্যাণ্ডি পানের পর বলে, “এবার এসো, হাসো—খেলো-ডিগবাজি খাও—যাতে তোমাদের ইয়ার-বন্ধুরা হাসতে পারে। বোকার মত বক্‌বক্ করো, বিড়বিড় করো অর্থহীন অস্পষ্ট আওয়াজে। দেখাও যে হুঁশজ্ঞান আর ইচ্ছাশক্তি লোপ পেলে মানুষ আধা-ইঞ্চি অ্যালকোহলের মধ্যে পাশাপাশি পড়ে থাকা বেড়ালছানার মত কি অসহায় নির্বোধ বস্তুতে পরিণত হয়।

আমরা আমাদের পেটের অতি হীন নিকৃষ্ট গোলাম ছাড়া আর কিছুই নই। নৈতিকতা আর ন্যায় পরায়ণতার দিকে হাত বাড়িয়ে লাভ নেই বন্ধুরা, নিজেদের পেটকে সতর্ক পাহারায় রাখো, যত্ন ও বিবেচনার সাথে তাকে আহার যোগাও। তাহলে বিনা প্রয়াসেই পুণ্য ও তৃপ্তি এসে আসন গাড়বে তোমার হৃদয়ে এবং তুমি হবে একজন উত্তম নাগরিক, প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা—একজন মহৎ ও পবিত্রপ্রাণ মানুষ।

আমাদের নৈশ আহারের আগে হ্যারিস, জর্জ আর আমি ছিলাম ঝগড়াটে, খিখিটে ও বদমেজাজী। খাওয়ার পরে আমরা একসঙ্গে বসে হাসলাম একে অন্যের দিকে চেয়ে। কুকুরটার দিকে তাকিয়েও হাসলাম। আমরা ভালবাসলাম পরস্পরকে, ভালবাসলাম সবাইকে। হ্যারিস উঠে পায়চারি করতে গিয়ে জর্জের পায়ের কড়াটি মাড়িয়ে দিল। ঘটনাটা যদি খাওয়ার আগে ঘটত তাহলে জর্জ ইহ এবং পরলোকে হ্যারিসের ভাগ্য সম্পর্কে এমন সব ইচ্ছা ও কামনা ব্যক্ত করত যা শুনলে যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিই শিউরে উঠতেন।

এখন ও শুধু বলল, ‘সাবধানে দোস্ত, সাবধানে।’

খাওয়ার আগে হলে জবাবে হ্যারিস তার চরম অপ্রীতিকর সুরে বলত যে জর্জ যেখানটায় বসেছে তার দশ গজের মধ্যে কাউকে চলাফেরা করতে হলে সে বেচারা জর্জের পায়ের কোন না কোন অংশ না মাড়িয়ে পারবে না। হ্যারিস ইঙ্গিতে আরও বলত যে ওরকম লম্বা পা নিয়ে জর্জের কোনক্রমেই উচিত হয়নি এরকম সাধারণ আকারের একটা নৌকায় আসা। জর্জকে সে উপদেশ দিত ওর পা দুটো যেন নৌকার পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। কিন্তু এখন ওসবের পরিবর্তে হ্যারিস বলল, ‘ওহো, আমি দুঃখিত, বন্ধু, ব্যথা পাওনি তো?’

জর্জ জবাব দিল, ‘মোটেই না।’ সে আরও বলল যে দোষটা তার নিজের। হ্যারিস বলল -না, দোষ তার।

ওদের কথাবার্তা শুনে বড় ভাল লাগল আমার।

নিজ নিজ পাইপ ধরিয়ে নীরব রাতের দিকে তাকিয়ে আলাপে মগ্ন হলাম আমরা।

জর্জ বলল, আমরা কেন এভাবে থাকতে পারি না সব সময় পাপ আর প্রলোভনের দুনিয়া থেকে দূরে? কেন আমরা পারি না মাতলামিমুক্ত শান্তিপূর্ণ ও সৎকর্মময় জীবন যাপন করতে? আমি বললাম যে ওই রকম জীবন যাপনের আকাঙ্ক্ষা আমার মনেও জাগে। আমরা আলোচনা করলাম চারজনে মিলে কোন ছোট্ট, সুন্দর ব্যবস্থাযুক্ত মরু-দ্বীপে গিয়ে বনের মধ্যে বসবাস করতে পারি কি না।

হ্যারিস বলল, সে যতটা শুনেছে, মরু-দ্বীপের ব্যাপারে বিপদ হলো এই যে ওগুলো বড্ড স্যাঁতসেঁতে। কিন্তু জর্জ বলল যে না, ঠিকমত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করলে স্যাঁতসেঁতে ভাবটা আর থাকে না।

এরপর আমরা আলোচনা শুরু করলাম ড্রেন সম্পর্কে। এ আলোচনার সময় জর্জের মনে পড়ে গেল ওর বাবার জীবনের এক মজার ঘটনা। অন্য এক লোকের সঙ্গে ওর বাবা ওয়েলস্ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এক রাতে তাঁরা আশ্রয় নেন ছোট্ট এক সরাইতে। সেখানে আরও কিছু লোক ছিল। ওই লোকগুলোর সাথে মিলে তাঁরা সন্ধ্যাটা কাটালেন।

খুব আমোদেই কেটেছিল সময়টা। ফুৰ্তি-আনন্দ চলেছিল গভীর রাত পর্যন্ত। শু’তে যাবার সময় (জর্জের বাবা যখন নবীন যুবক এটা তখনকার কাহিনী) তাঁরা দু’জনও ছিলেন কিছুটা নেশাগ্রস্ত। তাঁদের (জর্জের বাবা ও তাঁর বন্ধুর) শোবার কথা ছিল একই কামরায়, তবে আলাদা আলাদা বিছানায়। মোমবাতি হাতে উঠে গেলেন তাঁরা ওপরতলায়। কামরায় ঢোকার সময় মোমবাতিটা কাৎ হয়ে দেয়ালে লেগে নিভে যায়। ফলে তাঁদেরকে অন্ধকারে কাপড়-জামা ছেড়ে হাতড়ে হাতড়ে বিছানায় উঠতে হয়। বিছানায় তাঁরা উঠলেন এবং ভাবলেন যে ভিন্ন ভিন্ন বিছানাতেই উঠেছেন। আসলে ভিন্ন বিছানার বদলে দু’জনে দুই বিপরীত দিক থেকে একই বিছানাতে উঠেছেন। বালিশের ওপর একজনের মাথার পাশে উঠে গেল অন্য জনের পা।

কিছুক্ষণ কাটল নীরবতার মধ্যে। তারপর জর্জের বাবা ডাক দিলেন, ‘এ্যাই জো, শুনছ?’

খাটের বিপরীত প্রান্ত থেকে জবাব দিল জো, ‘কি ব্যাপার, টম?’

‘আরে ভাই আমার বিছানায় অন্য লোক শুয়ে আছে। এই তো, আমার বালিশের ওপর তার পা দুটো,’ বললেন জর্জের বাবা।

‘এ যে বড় অদ্ভুত কাণ্ড টম, আমার বিছানাতেও কে একজন শুয়ে আছে, জবাব দিলেন জো।

‘কি করবে লোকটাকে নিয়ে?’ প্রশ্ন করলেন জর্জের বাবা।

‘ছুঁড়ে ফেলে দেব নিচে,’ জবাব দিলেন জো।

‘আমিও তাই করব,’ নির্ভীকভাবে বললেন জর্জের বাবা।

এক সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর ধপাস ধপাস করে দুটো ভারি বস্তুর পতন হলো মেঝের ওপর। তারপর শোনা গেল একটা বিষণ্ন স্বর, ‘ওহে, টম।’

“হ্যাঁ, বলো!’

‘অবস্থা কি তোমার?’

‘সত্যি করে বলতে গেলে আমার লোকটাই তো ছুঁড়ে ফেলে দিল আমাকে।’

‘আরে, আমারটাও তাই করেছে। এ সরাইটা তেমন ভাল বলে মনে হচ্ছে না। কি বলো তুমি?’

হ্যারিস জানতে চাইল সরাইটার নাম কি

‘দ্য পিগ অ্যাণ্ড হুইসল, কেন?’

‘ওহ্ না, একই সরাই নয় তাহলে,’ বলল হ্যারিস।

‘মানে? কি বলতে চাও তুমি?’ জিজ্ঞেস করল জর্জ।

বিড়বিড় করে হ্যারিস বলল, ‘খুব অদ্ভুত ব্যাপার, তবে এক গ্রাম্য সরাইতে আমার বাবারও একবার ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি তাঁকে প্রায়ই কাহিনীটা বলতে শুনেছি। তাই ভেবেছিলাম সরাইটা একই হতে পারে।’

সেদিন রাত দশটায় শুয়ে পড়লাম আমরা। মনে করেছিলাম ক্লান্তির দরুন ঘুমটা ভালই হবে। কিন্তু হলো না। আমার নিয়ম হচ্ছে এই যে কাপড়-চোপড় ছেড়ে বালিশে মাথা রাখব, তারপর কেউ একজন দরজা ধাক্কা দিয়ে বলবে যে সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। কিন্তু আজ রাতে দেখা গেল সব কিছুই যেন আমার বিপক্ষে: গোটা ব্যাপারটার নতুনত্ব, নৌকার কাঠিন্য, ঠাসাঠাসি অবস্থা আমি শুয়েছিলাম এক আসনের নিচে পা, অন্য আসনের নিচে মাথা রেখে), নৌকার তলায় পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এবং গাছপালার শাখায় শাখায় বাতাসের শোঁ শোঁ অস্থির করে রাখল আমাকে, আমার ঘুমের ব্যাঘাত করল।

ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়েছিলাম। তারপর নৌকার একটি অংশ আমার মেরুদণ্ডে খোঁচা দিতে থাকে। এ অংশটা যেন রাতের মধ্যেই গজিয়েছিল, কেননা আমাদের যাত্রার সময় এটা ছিল না এবং সকালে এটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এরি মধ্যে আমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছি এবং স্বপ্ন দেখেছি যে একটা স্বর্ণমুদ্রা গিলে ফেলেছি। স্বর্ণমুদ্রাটি বের করার জন্য তুরপুণ দিয়ে ছিদ্র করা হচ্ছে আমার পিঠে। আমি এ কাজটাকে ওদের নিষ্ঠুরতা মনে করে বললাম যে মুদ্রাটি ধার হিসাবে আমাকে দিক ওরা, মাস শেষে আমি শোধ করে দেব। কিন্তু আমার কথা গ্রাহ্য না করে ওরা বলল যে ওটা তক্ষুণি বের করে নেয়া অনেক ভাল হবে, কারণ তা না হলে অনেক সুদ জমে যাবে। এতে আমি খুবই রেগে গেলাম ওদের ওপর এবং ওদেরকে আমি কি ভাবি সেকথা বলে দিলাম। তখন ওরা এমন তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে তুরপুণটাকে মোচড় দিল যার ফলে আমি জেগে উঠলাম।

নৌকার ভেতর বদ্ধ দম আটকানো পরিবেশে মাথা ধরে গেল আমার। ভাবলাম, রাতের মুক্ত ঠাণ্ডা হাওয়ায় হেঁটে বেড়াব কিছুক্ষণ। হাতের কাছে কাপড়—জামা যা পেলাম—কিছু আমার নিজের, কিছু জর্জ ও হ্যারিসের পরে নিয়ে ক্যানভাসের তলা থেকে বেরিয়ে তীরে উঠে গেলাম।

চমৎকার রাত। চাঁদ ডুবে গেছে। নীরব পৃথিবীটাকে ফেলে গেছে তারাদের পাহারায়। সেই নিশ্ছিদ্র নীরবতায় মনে হলো আমরা পৃথিবীর সন্তানরা যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন তারারা যেন আলাপ করছে তার সাথে, ওদের বোনের সাথে। আলোচনা করছে অসীম রহস্যময় বিষয়গুলো নিয়ে অতি গম্ভীর ও গভীর স্বরে, যার শব্দ মানুষের শিশুসুলভ শ্রবণযন্ত্রে প্রবেশ করে না।

আমাদেরকে অভিভূত করে এ অজানা তারারা। কি শীতল, স্বচ্ছ ওরা! আমরা হলাম সেই শিশুদের মত—যারা খুদে খুদে পা ফেলে নিজেদের অজান্তে ঢুকে পড়েছে ঈশ্বরের কোন স্বল্প আলোকিত মন্দিরে। ওদেরকে শেখানো হয়েছে ঈশ্বরের উপাসনা করতে, অথচ ওরা জানে না তাঁকে। মন্দিরের প্রতিধ্বনিপূর্ণ বিশাল গম্বুজের তলায় ছায়াময় আলোতে দাঁড়িয়ে অর্ধেক আশা অর্ধেক ভীতি নিয়ে ওরা তাকাচ্ছে ওপর দিকে, সেখানে কোন ভয়ঙ্কর ভৌতিক মূর্তি দেখবে বলে।

তবু রাতকে কত আরাম আর শক্তিতে পূর্ণ বলে মনে হয়। রাত এলে আমাদের ক্ষুদ্র দুঃখ-বেদনা সব লজ্জায় পালিয়ে যায়। দিন কাটে বিরক্তি আর চুশ্চিন্তায়। দিনের বেলা আমাদের হৃদয় থাকে অসৎ ও তিক্ত ভাবনায় ভরা, দুনিয়াটাকে মনে হয় আমাদের প্রতি বিরূপ ও কঠোর। তারপর রাত আসে কোন মহিয়সী স্নেহবতী মায়ের মত। আলতোভাবে হাতটা ছোঁয়ায় আমাদের জ্বরতপ্ত কপালে। আমাদের অশ্রুভেজা ছোট্ট মুখটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে হাসে স্নিগ্ধ হাসি। কথা যদিও বলে না সে, তবু আমরা জানি কি সে বলতে পারে। আমাদের তপ্ত গাল সে চেপে ধরে আপন বুকে, আর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায় আমাদের সকল ব্যথা বেদনা। একেক সময় গভীর ও প্রকৃত দুঃখ-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমরা নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি তার সামনে। কারণ, একমাত্র গোঙানি ছাড়া আর কোন ভাষা থাকে না সে বেদনা প্রকাশের। রাতের হৃদয়টা ভরে যায় আমাদের প্রতি করুণায়। সে দূর করতে পারে না আমাদের ব্যথা। তাই আমাদের হাত সে তুলে নেয় আপন হাতের মধ্যে। নিচেকার ক্ষুদ্র পৃথিবীটা তখন আরও ক্ষুদ্র হয়ে যায়, সরে যায় অনেক অনেক দূরে। রাতের কালো ডানায় চেপে মুহূর্তের জন্য আমরা উপনীত হই তার চাইতেও প্রবল এক উপস্থিতির মধ্যে। সেই মহান উপস্থিতির আশ্চর্য আলোতে সকল মানবের জীবন খোলা বইয়ের মত পড়ে থাকে আমাদের সামনে। আমরা জানতে পারি যে দুঃখ আর বেদনা ঈশ্বরের দূত ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুঃখ-বেদনার কাঁটার মুকুট যারা পরেছে শুধু তারাই তাকাতে পারে সেই আশ্চর্য আলোর দিকে। ফিরে এসে ওই বিষয়ের, যে রহস্য তারা জেনেছে তার সম্পর্কে মুখ খুলতে বা কিছু বলতে না-ও পারে ওরা।

তিন সুদর্শন নাইট একদা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন কোন্ এক অচিন দেশে। তাঁদের পথটা গেছে এক গহন বনের পাশ দিয়ে। ঘন ঝোপঝাড় আর শক্ত কাঁটালতায় বনটা ছিল ভরা। পথ ভুল করে সেখানে ঢুকলে কাঁটার ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হত মানুষের দেহ। ওই বনের গাছপালার পাতাও ছিল অতি কালো এবং পুরু, যার ফলে সূর্যের এক কণা আলোও গাছের শাখা-প্রশাখার ছাউনি ভেদ করে নিচের জমাটবাঁধা ছমছমে আঁধারকে হালকা করতে পারত না।

সেই অন্ধকার বনের পথে যেতে যেতে তিন নাইটের একজন সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভুলপথে চলে গেলেন অনেক দূরে। তিনি আর ফিরলেন না। তাঁর দুই সাথী অনেক দুঃখ পেলেন। কেউ মরে গেলে লোকে যেরকম শোক প্রকাশ করে সেভাবে হারানো সাথীর জন্য শোক করতে করতে তাঁরা এগিয়ে গেলেন গন্তব্যের দিকে।

অবশেষে তাঁরা পৌঁছলেন তাঁদের অভীষ্ট দুর্গে। এবং অনেকদিন সেখানে কাটালেন আমোদ-ফূর্তিতে। এক রাতে খুশি মনে বড় হলঘরের জ্বলন্ত কাঠের গুঁড়ির পাশে আরামে বসে মদ পান করছিলেন তাঁরা। এমন সময় তাঁদের হারানো সাথীটি এসে সম্ভাষণ জানালেন তাঁদেরকে। নাইটটির গায়ে ভিখারীর শতছিন্ন মলিন পোশাক, তাঁর সুন্দর দেহের সর্বত্র অসংখ্য ক্ষত, কিন্তু মুখে গভীর আনন্দের উজ্জ্বল দীপ্তি।

তাঁর কি হয়েছিল তা জানার জন্য দুই নাইট খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন তাঁদের ফিরে পাওয়া সাথীকে। তিনিও বর্ণনা করলেন কিভাবে বনের মধ্যে পথ হারিয়ে অনেক দিন অনেক রাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং শেষে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন মৃত্যুর অপেক্ষায়।

তারপর যখন তিনি একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন সে মুহূর্তে বুনো অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক অনিন্দ্য সুন্দরী কুমারী, হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যায় মানুষের অজ্ঞাত নানা ঘোরাল পথে। যেতে যেতে এক উজ্জ্বল আলোর প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অন্ধকার সেই বনভূমি। ছোট্ট প্রদীপের আলোর সাথে যেমন সূর্যের আলোর তুলনা হয় না—তেমনি দিনের আলোর সঙ্গেও তুলনা চলে না এ আলোর। সেই আশ্চর্য আলোতে আমাদের পথভ্রষ্ট নাইটটি স্বপ্নের মত একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পান। মূর্তিটিকে তাঁর এমন জমকালো ও সুন্দর মনে হয় যে নিজের রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর কথাও তিনি ভুলে যান। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন একজন মোহাচ্ছন্ন মানুষের মত, যার আনন্দ সাগরের ন্যায় গভীর এবং সেই গভীরতার পরিমাণ কোন মানুষের জানা নাই।

ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যায়। নাইটটি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ধন্যবাদ জানান সেই সন্ত পুরুষটিকে—যাঁর অনুগ্রহে গহন বনে পথ হারিয়ে তিনি ছায়ামূর্তির দর্শন পেয়েছেন।

অন্ধকার সেই বনটির নাম দুঃখ। কিন্তু ওখানে নাইটটির দেখা মূর্তিটা কে বা কার, সেকথা আমরা নাইবা বললাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *