তোমার মনে অন্য কারোর বাস
জিনিয়া, আমার বাড়িতে কিন্তু বিয়ের দেখাশোনা শুরু হবে, এখনো তোমার মতামত জানালে না! রেকর্ডিং রুমে সাউন্ড সেট করার মাঝখানেই উদগ্রীব হয়ে বললো রিতেশ৷
জিনিয়া ওর কালার করা চুলটা ঘাড়ের কাছে ব্যাকক্লিপে আটকে আড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো, আর ইউ ক্রেজি রিতেশ? বিয়ে?
বিয়ে করবো আমি?
আরে এখনো মফঃস্বলের দিকের কল শো গুলোতে আমি স্টেজে উঠলেই পুরুষদের মধ্যে একটা মারাত্মক উন্মাদনা দেখি৷ সেটা শুধুমাত্র আমার গানের জন্য নয়, ওই মাদকতাটা বোধহয় আমাকে তাদের প্রেমিকা হিসাবেও কল্পনা করে৷ কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠলো রিতেশের৷ জিনিয়া নাকি একজন সংগীত শিল্পী! এই ধরনের নিম্ন রুচির মানুষকে রিতেশ যে কি করে ভালোবাসলো কে জানে! জিনিয়া কি তবে ঠিকই বলে, শুধুই ওর মিষ্টি গলার টানে নয়,ওর ওই আকর্ষণীয় শরীরের টানেই রিতেশ বারবার ছুটে যায় জিনিয়ার ধর্মতলার ফ্ল্যাটে৷ না, শুধু শরীরের টানেই নয় জিনিয়ার ওই হঠাৎ গেয়ে ওঠা গানের কলি, ওর গলার সুরের টানেই রিতেশ ভালোবেসেছিলো ওকে৷ যদিও জীবনের ফার্স্ট প্লে ব্যাকে ফিমেল সিঙ্গার ছিলো জিনিয়া৷ ভয়ে যখন বুক শুকিয়ে কাঠ,তখনই জিনিয়া ওর রিনরিনে গলায় বলেছিলো, ডোন্ট ওরি… আমি আছি,ম্যানেজ করে নেব৷
সত্যিই জিনিয়া পাশে ছিলো৷ সত্যি বলতে কি রিতেশ দত্ত আর জিনিয়া মুখার্জীর ডুয়েট অ্যালবামের বাজার যেমন হাই, তেমনি টলিউডের অল্পবয়সি নায়ক-নায়িকার লিপেও ওরা এখন পারফেক্ট৷ দুজনের কেরিয়ার তরতর করে এগুনোর সাথে সাথেই ব্যক্তিগত সম্পর্কও এগুচ্ছিলো৷ ফিল্মি ম্যাগাজিনে প্রায়ই স্প্যানিশ গিটার হাতে রিতেশকে পোজ দিতে দেখা যায়, অবশ্যই তার পাশে থাকে জিনিয়া৷ একটা ফিল্মি ম্যাগে তো গসিপ কলমে লিখেই দিয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি গায়ক রিতেশ আর গায়িকা জিনিয়াকে আপনারা হানিমুন এনজয় করতে দেখবেন৷
জিনিয়া পত্রিকাটা দেখে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছিলো৷ সেদিন থেকেই রিতেশের মনে সংশয় তৈরি হয়েছিলো, জিনিয়া কি আদৌ ওকে ভালোবাসে? যতবারই জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করেছে ততবারই ও এড়িয়ে গেছে৷
এমনকী ওর নির্জন ফ্ল্যাটে শরীরী খেলায় উন্মত্ত হতে হতেও ওর ভিজে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রিতেশ জানতে চেয়েছে, কবে মিসেস রিতেশ দত্ত হবে জিনিয়া?
রিতেশের শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে জিনিয়া বলেছে, নট মিসেস রিতেশ দত্ত, প্লিজ কল মি অনলি জিনিয়া৷
ইদানীং রিতেশের বাড়িতে বাবা মা দুজনেই উঠে পড়ে লেগেছে ছেলের বিয়ে দিতে৷ দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকেই এই উদ্যোগ৷ দিদির সাথে রিতেশের বয়েসের পার্থক্য মাত্র তিনবছর৷ কিন্তু রিতেশের ওপর রিতিকার প্রভাব খুব বেশি৷ ছোটো থেকেই রিতিকার প্রায় প্রতিটি কথা শুনতে শুনতে রিতিকা কবে যেন রিতেশের দিদি নয় মায়ের স্থান নিয়ে নিয়েছে৷ এখনো দিদিই রিতেশকে বলছে, দেখ ভাই, তুই যদি জিনিয়াকে বিয়ে করতে চাস সেটাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই৷ জিনিয়ার সাথে ফাইনাল কথা বলে আমাদের জানাস৷ আমি ওর অভিভাবকের সাথে কথা বলে নেব৷
এদিকে গত তিনদিন ধরে জিজ্ঞেস করেও সঠিক উত্তর পায়নি রিতেশ৷ তবে কি জিনিয়ার অন্য কারোর সাথে কোনো রিলেশন তৈরি হয়েছে, তাই বিয়ের কথায় ক্রমাগত এড়িয়ে যাচ্ছে রিতেশকে!
বার তিনেক ভুল সুর দিয়ে ফেললো লিরিকে৷ মিউজিক ডিরেকটর বললেন, তুমি কি ডিস্টার্বড আছো রিতেশ?
জিনিয়াকেও তিন তিনবার গাইতে হলো রিতেশের ভুলের জন্য৷ নিখুঁত গাইছে জিনিয়া৷ অথচ রিতেশের যেন কিছুতেই পারফেক্ট হচ্ছে না৷ মনের মধ্যে একটা কথারই অনুরণন চলছে, সরি রিতেশ, আমি বিয়ে করে সংসার করার জন্য জন্মাই নি৷
রিতেশ বলেছিলো, ডাল ভাত রাঁধা সংসার তো আমি করতে বলিনি জিনিয়া! তোমার কেরিয়ার, তোমার গান সব আগের মতোই থাকবে৷ শুধু দু-জনে একসাথে থাকা সামাজিক ভাবে৷
আলতো হেসে জিনিয়া বলেছিলো, ম্যারেড চিহ্নটাই যথেষ্ট জিনিয়া মুখার্জীর ক্রেজ টা নষ্ট করার জন্য৷
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন ডিরেক্টর সমীর গুপ্তা৷
রিতেশ… পারফেক্ট হচ্ছে না৷
বার তিনেক পর, মনের সাথে যুদ্ধ করে সুরটা সঠিক লাগলো ও৷ যদিও অন্যদিনের থেকে অনেকটাই খারাপ৷ তবুও চালিয়ে নেবেন ডিরেক্টার৷
অন্যমনস্ক রিতেশ গাড়ির বেল্ট না লাগিয়েই স্টার্ট দিলো গাড়িতে৷ ট্রাফিক পুলিশ ধরেও ছিলো, নেহাত স্টার ,পরিচিত নাম তাই আজকের মতো ছাড়া পেলো৷
রাতেই দিদির ফোন এলো৷
কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়েই রিতিকাকে বলে দিলো রিতেশ, জিনিয়া আমার ফ্রেন্ড, সহ গায়িকা৷ হঠাৎ ওকে বিয়ের কথা বলছিস কেন?
দিদির গলায় দ্বন্দ্বের সুর৷ তুই ঠিক বলছিস ভাই, তুই আমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করবি? নিশ্চিত থাক ভাই, আমি তোর মনের মতো মেয়েই জোগাড় করে আনবো৷ যে তোর গানকে সম্মান করবে৷
নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো রিতেশ৷ বারংবার কানের কাছে পরিচিত কণ্ঠস্বর… সরি রিতেশ, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ প্রথম দেখা থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত ভালোলাগা, খুনসুটি, সুরের মূর্ছনা যেন চোখের সামনে দিয়ে ক্রমশ বেরঙিন হয়ে উঠছে৷ জিনিয়ার সাথে কাটানো সব রামধনু রাঙা সময়গুলো হঠাৎ করেই ধূসর আকাশের মলিনতা নিয়ে হাজির হচ্ছে রিতেশের সামনে৷
হয় দিদির কথায় রাজি হতে হবে, নয় জিনিয়ার কাছ থেকে অপমানিত হয়েও ওর সাথে ছন্নছাড়া জীবন কাটাতে হবে রিতেশকে৷ এত সাফল্য পাওয়ার পর রিতেশের ইদানীং মনে হচ্ছে জীবনটা যেন লক্ষ্যহীন হয়ে যাচ্ছে রিতেশের৷ দিনের শেষে একটা নিরবিচ্ছিন্ন অবসর, একজন একান্ত সঙ্গী… এগুলোর বড্ড প্রয়োজন জীবনে৷ শুধু সাকসেস আর কেরিয়ারে উন্নতি দিয়ে জীবন চালানো সম্ভব নয়৷ জিনিয়া কোনোদিনই রিতেশকে বিয়ে করবে না সেটা আজ ওর কথায় পরিষ্কার৷
মনখারাপি বাতাসটা চবিবশ ঘন্টা রিতেশের চারিদিকে ঘুরছে৷
ততদিনে কানাঘুষোয় ম্যাগাজিনের চমকদার খবর হয়ে উঠেছে, রিতেশ আর জিনিয়ার ব্রেকআপ এর ঘটনাটা৷ ওরা শুধুমাত্র প্রফেশনাল ব্যাপারেই এক সাথে গাইবে৷ মুখরোচক খবরের খোরাকে জিনিয়ার অবশ্য খারাপ লাগা তৈরি হয়নি৷ বরং রিতেশকে পরিষ্কার বলেছে, এই নেগেটিভ প্রচারেও ওর ক্রেজ বাড়বে বৈ কমবে না৷
মনমরা রিতেশের উদাস মনের খবরটা হয়তো দিদির কাছে মা-ই পাঠিয়েছিল৷ তাই দিদি ফোনে নির্দেশ দিল, দুদিনের জন্য আমার বাড়ি থেকে ঘুরে যা৷ দুই ভাইবোনে মিলে বিন্দাস মস্তি করবো৷
দিদির ডাকে সাড়া দেবে না অতটাও বড়ো সড়ো ব্যক্তিত্ব কখনোই নিজেকে ভাবে না রিতেশ৷ তাই দিদির নির্দেশে নিজের ব্যস্ত সিডিউল থেকেও তিনদিন বের করে চলে গেল শিলিগুড়ি৷ জিজু চাকরি সূত্রে এখন শিলিগুড়িতেই আছে৷ তাই রিতিকাও স্বামী অশোকের কাছে শিলিগুড়ির সরকারি বাংলোতেই জমিয়ে সংসার পেতেছে৷ রিতেশকে পেয়ে যেন হাতে স্বর্গের চাঁদ পেলো দিদি৷ সেই স্কুল বেলার মতোই রাগী চোখে বললো, কি চেহারা করেছিস নিজের! ওই মেয়ের জন্য আমার এত সুন্দর ভাইয়ের চোখের নীচের কালি পড়েছে? এভাবে ভাইকে দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না রিতিকার৷ তার সেই খুনসুটি করা,অভিমানী ভাইটা যেন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ৷ বড্ড নিশ্চুপ৷ নিভে আসা আলোয় ছাদে গিয়ে এক মনে গান গাইছিল রিতেশ৷ গলায় এক অদ্ভুত নীরবতা,গভীর বেদনা৷
অটোগ্রাফ প্লিজ… কোনো নিউজ পেপারে তো খবর বেরোয়নি যে সিঙ্গার রিতেশ দত্ত আমাদের শিলিগুড়িতে আসছেন৷ ময়ূরপঙ্খী রঙের সালোয়ার পরা মেয়েটা উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে৷ যেন সামনে স্বয়ং ঈশ্বরকে দেখেছে৷ চমকে উঠেছে রিতেশ৷ দিদির ছাদে এই মেয়েটা কি করছে ?
রিতেশের চোখের কৌতুহল নিবারণ করতেই বলে উঠলো, আমি রিতিকা বউদির পাশের বাড়িতেই থাকি৷ ওই যে আমাদের বাড়ি৷ ছাদ থেকে দেখলাম,আপনি গান গাইছেন৷ আর নিজেকে বশে রাখতে না পেরে চলে এলাম৷ চায়ের ট্রে হাতে পিছন থেকে দিদি ডেকে উঠলো, ওমা সায়নী… তুই! তুই চিনিস রিতেশকে?
সায়নী বলে মেয়েটি একমুখ হেসে বললো, চিনবো না মানে! আমাদের ইউনিভার্সিটির সকলেই ওনার পাগলের মতো ফ্যান ছিলাম৷
রিতেশ বললো, ছিলেন! মানে এখন আর নেই?
সায়নী জিভ কেটে বললো, ধুর, তাই বললাম বুঝি? এখনো আছি, সারাজীবন থাকবো৷
দিদি মুচকি মুচকি হাসছে দেখেই অস্বস্তি হচ্ছে রিতেশের৷ সায়নীর কোনো লজ্জার বালাই নেই৷ সে তখন তার হাতের ছোট্ট ডায়রী আর পেনটা ধরে আছে রিতেশের সামনে৷ সায়নীর কথা বলার মধ্যে এক অদ্ভুত সরলতা৷
চোখে তখনও পছন্দের গায়ককে দেখার অপরিসীম বিস্ময়৷ বহুবার বহু প্রোগ্রামে গিয়ে এরকম অনেক ফ্যানের সম্মুখীন হয়েছে রিতেশ, তাই নতুন কিছু নয়৷
তবে আলটপকা সায়নী যে কথাটা বলে বসলো তার জন্য বোধহয় রিতিকাও প্রস্তুত ছিলো না৷ রিতেশ তো নয়ই৷
রিতেশ স্যার, আর যাই করুন ওই শাকচুন্নি টাইপের মহিলাটাকে বিয়ে করবেন না৷ প্রথম দিন জিনিয়া মুখার্জীর সাথে আপনাকে দেখে আমরা সবাই বলেছিলাম,ইস! রিতেশ স্যারের চয়েসটা ভালো না৷
দেখতে ভালো হলেই কি আর ভালো মনের মানুষ হয়! ওই জিনিয়া ম্যাডাম কিন্তু আপনার প্রতি জেলাস৷
রিতেশ চমকে তাকিয়েছিলো অপরিচিত মেয়েটার দিকে! কি আশ্চর্য বিশ্লেষণ ক্ষমতা মেয়েটার৷ একটা স্টেজ শো দেখে বুঝতে পেরে গেলো আসল ঘটনাটা৷ এটা রিতেশও অনেকবার ফিল করেছে, বারবার নিজের মনকে শাসন করে বলেছে, ছি! ভালোবাসাকে সন্দেহ করছো?
জিনিয়া রিতেশকে ভালোবাসে, ও কেন ওকে হিংসা করবে! তবুও জিনিয়ার কয়েকটা ব্যবহারে হিংসাটা এতটাই প্রকট হয়েছে, যে কষ্টে মুচড়ে উঠেছে রিতেশ৷
সায়নীর কথাটা শুনেই চুপ করে গেছে রিতেশ৷ একজন ফ্যানের কাছ থেকেও শুনতে হলো জিনিয়ার নামে৷ জিনিয়া ওদের ভালোবাসা, সম্পর্ককে অস্বীকার করলেও… রিতেশ ওর নামে নিন্দা করতে পারবে না কারোর কাছে৷
রিতিকা মেয়েলি কৌতুহলে বলে উঠলো, এই সায়নী কি করে বুঝলি?
সায়নী গল্প বলার ঢঙে বললো, আরে আমাদের মিলন সংঘের পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যখন রিতেশ স্যার আর জিনিয়া ম্যাম এসেছিলো তখনই খেয়াল করেছিলাম, মাউথপিসে মুখে একটা কথা বলার পরেই জিনিয়া ম্যাম রিতেশ স্যারের সাথে মাইক চেঞ্জ করলেন৷
রিতেশ স্যারের মাইকের সাউন্ডটা অনেক বেটার ছিলো৷
তুমিই বলো, রিতিকা বউদি, ভালোবাসলে কেউ পারতো এটা করতে! বরং খারাপটা নিজে নিয়ে ভালোটা ভালোবাসার মানুষকে দিতো৷
এতক্ষনে হাসি পেয়ে গেল রিতেশের! মেয়েটা যেভাবে ভালোবাসার সরলীকরণ করলো, জিনিয়া শুনলে হেসেই লুটিয়ে পড়তো৷ বলতো, ক্যারিয়ারের আগে সিলি লাভ কখনোই আসতে পারে না৷
দিদিটার আর আক্কেল জ্ঞান হবে না কোনোদিন৷
সায়নীকে জিজ্ঞেস করলো, জিনিয়ার জায়গায় তুই থাকলে কি করতিস?
সায়নী বললো,আমি রিতেশ স্যারকে আগলে রাখতাম৷
বলতেই দিদি বললো, রিতেশ-এর সারাজীবনের দায়িত্ব যদি তুই পাস কি করবি?
শেষ বিকেলের আলোয় সায়নীর মুখে অস্তগামী সূর্য একমুঠো লালচে লজ্জা ছড়িয়ে দিলো৷
বকবক করা মেয়েটাও নিমেষে চুপ করে গেলো!
হাসি পাচ্ছিলো রিতেশের৷ এই মেয়ে আবার লজ্জাও পায়!
ছাদ থেকে দুরদুর করে নেমে গেলো সায়নী৷
রিতেশ দিদির দিকে তাকিয়ে বললো, তুই কি চবিবশ ঘন্টা ঘটকালি করে যাবি?
কেন, মেয়েটাকে তোর পছন্দ হয়নি?
এই মুহূর্তে পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কিছুই ভাবে নি রিতেশ৷
জিনিয়া আর ওর কাটানো টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো বারবার ফিরে আসছে, আড়াল করে দাঁড়াচ্ছে দৃষ্টিপথ৷
ভাবনা শক্তিকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে৷ ওর এতদিনের সাধনা গানও যেন জিনিয়ার মতোই রিতেশকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে৷
দিদি আলতো করে মাথায় হাত রেখে বললো, ভাই… বল না, সায়নীর মতো সহজ সরল একটা মেয়েকে তুই জীবনসঙ্গিনী হিসাবে চাস কিনা! যে তোকে প্রতিযোগী ভাববে না, বরং আগলে রাখবে৷
রিতেশের ভাবনা শক্তি আপাতত অচল৷ মিডিয়া, ম্যাগাজিনের গসিপ, জিনিয়ার বিদ্রুপ… রিতেশের অবশ মন পারছে না এতকিছু একসাথে সামলাতে৷
তুই আমাকে আমার থেকেও ভালো চিনিস দিদি৷ তুই যা ভালো মনে করিস কর৷
রিতেশকে আর কিছুই বলতে হয়নি৷
সায়নীর বাবা মায়ের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে বিয়ের শপিং সব একা হাতেই সামলাচ্ছে রিতিকা৷
শুধু সায়নীকে বিশ্বাস করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো, যে সিঙ্গার রিতেশ দত্তর সাথেই সায়নীর বিয়েটা হচ্ছে ৷
সায়নী শুনেই বলেছিলো, চিমটি কেটে দেখো তো আমাকে, আমি ঠিক শুনছি কিনা! মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যেই সায়নী আর রিতেশের এনগেজমেন্টের ছবি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বেরিয়ে গেলো৷
সায়নী নিতান্তই ঘরোয়া মেয়ে৷ মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট৷ সে তুলনায় রিতেশ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, সাথে প্লে ব্যাক সিঙ্গার হওয়ায় ফিসফিসটা একটু বেশিই সরব হয়ে উঠলো৷
রিতেশ দত্তর মত হ্যান্ডসাম গায়ক শেষে একটা ঘরোয়া মেয়েকে বিয়ে করেছে! কানে কানে এটাও চললো যে, জিনিয়া মুখার্জির কাছ থেকে ল্যাং খেয়েই এই চট জলদি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে রিতেশ৷
ম্যাগাজিনগুলো যে সায়নীর চোখে পড়েনি তা নয়, কিন্তু স্টারদের সম্পর্কে এমন অনেক গসিপ বাজারে চলে, ভেবেই এড়িয়ে গেছে ও৷ এছাড়া রিতিকা বউদিও বলেছে ওরা নাকি শুধুই কো সিঙ্গার৷
তাছাড়া প্রিয় সিঙ্গারের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সায়নীর চোখের সামনে তখন রামধনুর রঙের খেলা৷
রিতেশ একটু গম্ভীর স্বভাবের আর সায়নী প্রাণচঞ্চল৷ তাই ফোনে যেটুকু কথা হয়েছে তাতে রিতেশের হ্যাঁ হুঁ এর জবাবে সায়নীর মহাভারত শেষ হয়েছে৷ একদিন রিতেশ বলেছিলো, সায়নী একটু দম নিয়ে, জল খেয়ে আবার শুরু করো, না হলে হাঁপিয়ে যাবে৷
সায়নী খিলখিল করে হেসে বলেছিলো, আমার অভ্যাস আছে, চিন্তা করো না৷
সায়নীর এই অনবরত বকমবকম করার ফলেই হোক অথবা দুঃখ ক্ষণস্থায়ীই হোক… এই প্রথম রেকর্ডিং রুমে ঢুকে জিনিয়াকে দেখেও না দেখার অভিনয়টা করতে পারলো রিতেশ৷
বরং জিনিয়াই আগবাড়িয়ে এগিয়ে এসে ওর এনগেজমেন্টের জন্য অভিনন্দন জানালো৷ সাথে এটাও বললো, এই ভালো হলো রিতেশ, তোমার বাবা মাকে শান্ত করার জন্য এমনই একটা ঘরোয়া মেয়ের দরকার ছিলো৷ আমি তো বলেইছি, ভালো আমি তোমাকেই বাসি, শুধু বিয়েটাতেই আপত্তি ছিল৷
বিয়ের পরেও আমার ফ্ল্যাটের দরজা তোমার জন্য খোলা থাকবে৷
হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করলো রিতেশের৷ আচমকাই সায়নীর মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে৷
মহানন্দার ক্ষীণ জলের ধারার সামনে দাঁড়িয়ে আগত সন্ধ্যের কনে দেখা আলোয় দেখা সায়নীর সরল মুখটা যেন ব্যঙ্গ করে বললো, সুরের সাধকের ভিতরের রূপটা ঢেকে রাখো রিতেশ৷
কথা না বলেই বিক্ষিপ্ত মন নিয়েও রেকর্ডিংটা শেষ করলো ও৷
ফেরার পথেও জিনিয়ার চোখের ইশারায় নিজেকে বড্ড অবাঞ্ছিত লাগছিলো৷
বারবার মনে হচ্ছিল জিনিয়ার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মিথ্যে হয়ে যাক৷ কোনো একটা বিশেষ উপায়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে রিতেশ ভুলে যাক পুরোনো সব কথা৷
বিয়ের আর মাত্র দিনপনেরো বাকি৷ এখনো রিতেশের মনের দোলাচল মিটেছে না৷ সায়নীর মতো সাধারণ মেয়েকে কি ও আদৌ কোনোদিন ভালবাসতে পারবে! নাকি চোরাবালির অন্ধকার ক্রমশ গ্রাস করে নেবে ওদের বিবাহিত জীবন৷
দিদি বলেছিলো, সায়নী নাকি গান গায়৷ খারাপ নয়, বেশ ভালোই গায়৷ যদিও রিতেশ এখনো শোনেনি৷ তবে দিদির ওই খারাপ নয় কথাটা শুনেই বুঝেছিল, সায়নী ওই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গান জানি বলা টাইপের পাবলিক৷
মা বলেছিলো, সবাইকে যে ভালো গাইতেই হবে তা তো নয়, গান ভালোবাসে যখন তখন তোর সমস্যা কি রে খোকা?
বাড়ির সকলেই বোধহয় জিনিয়া নামক কেরিয়ার সচেতন গায়িকাকে ঠিক বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছিলো না৷ এখন ঘরোয়া বউ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে৷ কিন্তু রিতেশের মনে জিনিয়া একটা অন্য অনুভূতি৷ জিনিয়া যখন খালি গলায় বেহাগের তানকারী করে তখন যে বিহ্বলতা কাটতেই চায় না রিতেশের৷ জিনিয়ার জন্য একটা আলাদা সম্মান তোলা আছে রিতেশের মনে৷ সায়নীকে সেই অর্থে ভালোবাসতেই পারবে না রিতেশ৷ জীবনসঙ্গী হলেই যে মনের নির্দিষ্ট আসনটা দখল করতে পারবে এমন ভাবাটাও তো অর্থহীন৷
মোটামুটি টলিউডের প্রায় সব ভি. আই. পি.-রাই নিমন্ত্রিত হয়েছে৷ মিডিয়া কভারেজ হবে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা৷ সায়নীর পোশাকটাও রীতিমতো ফ্যাশন ডিজাইনার দ্বারা প্রস্তুত৷ এত কথা বলা সায়নীও আজ একটু ঘাবড়ে গেছে৷
শিলিগুড়ি থেকে ওরা কলকাতায় চলে এসেছে বিয়ের চারদিন আগেই৷
একটাই রিসেপশনে পার্টি রাখা হয়েছে রিতেশ আর সায়নীর বিয়ের৷ বিয়ের আসরে কোনো জাঁকজমকের কমতি নেই৷ শুধু রিতেশের মুখের বিষণ্ণতাটা নিখুঁত মেকআপ বা শেরওয়ানির ঝলমলানিতেও কমানো গেল না৷
আলতো করে কেউ বললো, জিনিয়া মুখার্জী এসেছেন৷ গোটা হলে একটা সরগরম আওয়াজ৷ জিনিয়া জানে ঠিক কখন আর কোথায় কীভাবে নিজের দিকে ক্যামেরার ফোকাস নিয়ে নিতে হবে৷ প্লেব্যাক না করে অভিনয় করলেও জিনিয়া বেশ নাম করতো৷
প্রতিটা পদক্ষেপ মাপা, মুখের কৃত্রিম হাসিটা পর্যন্ত নিখুঁত৷
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে জিনিয়া৷ রিতেশের দমটা বন্ধ হয়ে যাবে যেন,জিনিয়া আর রিতেশের দূরত্ব এখন মাত্র চার পা৷ না, রিতেশের দিকে না এগিয়ে জিনিয়া সোজা চলে গেল সায়নীর চেয়ারের কাছে৷
সায়নীকে তখন ঘিরে রয়েছে ওর বন্ধুবান্ধবেরা৷ তার মাঝেই জিনিয়া ব্যাগ থেকে গয়নার ছোট্ট বক্সটা বের করে সায়নীর হাতে দিয়ে বললো, একদিন রিতেশই এই আংটিটা পরিয়ে দিয়েছিলো আমাকে, আমি আজ তোমাকে দিয়ে দিলাম৷
চমকে উঠেছে রিতেশ৷ জিনিয়ার হাতে সেই আংটিটা, যেটা জিনিয়ার গত বছরের বার্থ ডেতে রিতেশ গিফট করেছিলো৷ আজ ওর বিয়ের দিন জিনিয়া যে এভাবে প্রতিশোধ তুলবে ভুলেও ভাবেনি রিতেশ৷ জিনিয়ার এই রাগের একটাই কারণ জিনিয়া লিভ ইনে বিশ্বাসী হলেও বিয়েতে নয়৷
সায়নী মুচকি হেসে বললো, আপনার বন্ধু আপনাকে গিফট করেছে, আপনি কেন সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা না রেখে তার দেওয়া গিফটটা আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন সেটাই বুঝলাম না৷
আমার উপহারটা ডিউ থাক ম্যাডাম,আমি অন্যকে দেওয়া জিনিস গ্রহণ করি না৷
জিনিয়া মুচকি হেসে বললো, তাহলে তো রিতেশকেও বিয়ে করা উচিত নয় তোমার৷ রহস্যের হাসি জিনিয়ার মুখে, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রিতেশ৷
সায়নী বললো, মেয়েদেরও যেমন বিয়ের পরে মেয়েবেলার পরিচয়টা মুছে যায়, তেমনি ব্যাচেলার ছেলেও বিয়ের পরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায়৷ আমি বিবাহিত রিতেশকে ভালোবাসবো, তার অতীতকে নয়৷
ছবি দেখে মেয়েটাকে যতটা সাদাসিধে মনে হয়েছিল সেটা যে নয় তা বুঝে গেছে জিনিয়া৷ সায়নীর কথায় রীতিমতো অপমানিত বোধ করছিলো ও৷ এমনিতেই ওর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে রিতেশের এই হটকারীর মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসাটাকেই ঠিক সহ্য করতে পারছে না জিনিয়া৷ তারপর আবার রিতেশের নতুন বউ-এর লম্বা চওড়া কথা!
ফুলশয্যার রাতেই রিতেশের অন্যমনস্ক মুখটার দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো, সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা না করলেও পারতে৷ আমি না হয় আমার পছন্দের সিঙ্গারকে জীবনসঙ্গী পেয়েছি ভেবে কাটিয়ে দেব, কিন্তু তুমি?
সায়নীর সেই উৎফুল্লতা আর নেই, চোখে মুখে একটা না বলা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি৷ রিতেশের খারাপ লাগছে, আবার সায়নীকে আঁকড়ে ধরতেও পারছে না নিজেকে উজাড় করে! অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা ঘিরে রয়েছে জুঁই ফুল আর গোলাপ দিয়ে সাজানো ফুলশয্যার বিছানাটাকে৷
আজ বকবক মেয়েটাও চুপ৷
শুধু একবারই বললো, তার মানে ম্যাগাজিনের গসিপ মিথ্যে হয় না!
জিনিয়া মুখার্জী আর রিতেশ দত্ত তারমানে শুধু বন্ধু নয়!
রিতেশ চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো৷ রক্ত গোলাপগুলো পাঁপড়ি মেলে বিদ্রুপ করলো ফুলশয্যা নামক স্বপ্নের রাতটাকে৷
রিতেশের বাবা মা তো সায়নী বলতে অজ্ঞান৷ রিতিকাও যেন দু-হাতে আগলে রেখেছে সায়নীকে৷ সত্যি বলতে কি রিতেশ ওর বাবাকে অনেকদিন পরে এত এত কথা বলতে দেখলো, হাসতে দেখলো… সেটা শুধুমাত্র সায়নীর জন্যই৷
রেকর্ডিং-এ যাওয়ার আগে রিতেশের প্রয়োজনীয় জিনিস সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে সায়নী৷ কর্তব্যের কোনো ঘাটতি নেই, শুধু সেই আগের মতো হাসিটা আর নেই ওর মুখে৷ ওর এই চুপ হয়ে যাওয়াতেই রিতেশ আরও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে৷ মেয়েটার মুখের প্রতিটা নিষ্পাপ রেখা যেন আঙুল তুলে রিতেশকে বলে, তুমি ঠকিয়েছ আমাকে! তোমার গানে পাগল ছিলাম বলেই সুযোগ নিয়েছো৷
সত্যিই কি তাই! সায়নীকে বিয়ের আগে কি একবারও মনে হয়নি রিতেশের যে, দেখুক জিনিয়া, আমি ওকে ছেড়েও বাঁচতে পারি৷
হঠাৎই সোমবার রেকর্ডিং ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি ফিরে এলো রিতেশ৷ দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পেল, কেউ একটা গান গাইছে, ওর ঘর থেকেই ভেসে আসছে আওয়াজটা৷ গলার স্বরে মাদকতা না থাকলেও সুর জ্ঞান প্রখর৷ সায়নী গাইছে, মা বলছে, তুই তো খোকার কাছে শিখতে পারিস৷
সায়নী উদাস মুখে বললো, তোমার খোকার সময় কোথায় সময় নষ্ট করার!
সায়নীর গলায় ভেজা কান্নার সুর৷
ঘরে ঢুকতেই মা বললো, খোকা তুই তো কোনোদিন আমাদের গান শোনাস না, সবই যন্ত্রের মাধ্যমে শুনতে হয়৷ সায়নী…
মেয়েটা যেন কয়েক মাসেই রিতেশের বাবা মাকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে৷ বিরক্ত হয়েই রিতেশ বললো, আগে গানটা শিখুক, তারপর গাইবে…
হারমোনিয়াম বাজালেই গান হয় না৷
সায়নী আলতো করে বললো, আমি তো জিনিয়া মুখার্জী হতে চাইনি৷
আজই জিনিয়ার সাথে কাটিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ৷ নিজেরাই গানে গানে একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছিলো জিনিয়ার ফ্ল্যাটের অন্ধকার ড্রয়িংরুমে৷ জিনিয়া রিতেশকে বিয়ে করেনি ঠিকই, কিন্তু কেউ জিনিয়াকে অপমান করলেই রিতেশের বুকে এসে বিঁধে যায়৷ জিনিয়া আজই বলছিলো, তোমার বউকে পেয়ে কি আমাকে ভুলে গেলে?
রিতেশ বুঝিয়ে বলেছে জিনিয়াকে, সায়নী ওর নামে মাত্র বউ৷ সকলের সামনে একটা মুখোশ মাত্র৷
রিতেশ রাগী চোখে বললো, যে কেউ চেষ্টা করলেই জিনিয়া মুখার্জী হতে পারে না সায়নী৷
ইদানীং সায়নীকে দেখলেই কেমন অসহ্য লাগছে৷ কেন যে মরতে বিয়েটা করতে গিয়েছিলো! তার থেকে জিনিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে লিভ ইন করলেই বেটার হত৷ এত সাধারণ একটা মেয়ে রিতেশ দত্তর বউ হতে পারেনা৷ ইদানীং রিতেশ-এর নিজের লেখা কথা, ওরই সুর আর গলায় গাওয়া গানগুলো মারাত্মক ভাইরাল হচ্ছে৷ জিনিয়া বললো, মার্কেটে তো এখন একটাই নাম…
পরিচালকদের সব গাড়িই তো এখন রিতেশ দত্তর বাড়ির দিকে ছুটছে৷
যদিও নন্দন বলে ছেলেটাও কম্পিটিশনে আছে৷ অদ্ভুত লিরিক্স তৈরি করে ছেলেটা৷ ওর গানের কথাগুলোর জন্যই রিতেশ নাম্বার ওয়ানে পৌঁছাতে পারছে না৷
‘মেঘের বাড়ি’ ছবিতে সব থেকে পপুলার গানটা নন্দনের গাওয়া৷
‘তোমার মনের ঘরে অন্য কারোর বাস৷ বর্তমানে থেকেও আমি রইলাম পরবাস৷’
গানটার জন্য সম্ভবত নন্দন জাতীয় পুরস্কার পাবে৷ মনমরা হয়ে বসেছিলো রিতেশ৷ জিনিয়া বললো, নন্দন তো আগেও গাইতো, কই এত ভালো লিরিক্স তো ছিলো না৷
আজকের পার্টিতে নন্দনেরও আসার কথা আছে৷
এই মুভিতে জিনিয়া, রিতেশ আর নন্দনের একসাথে একটা গানের সিকোয়েন্স আছে৷
নন্দনের সাথে সেভাবে সামনা সামনি পরিচয় নেই রিতেশের৷
একেবারেই নতুন ও ইন্ডাস্ট্রিতে৷ একবছরেই বেশ নাম করে ফেলেছে৷
নন্দনের পরনে সাদা কালো পাঞ্জাবি৷ মুখে বেশ একটা অহংকারী ব্যক্তিত্ব৷ রিতেশ আর জিনিয়াকে বললো বটে আপনাদের থেকেই শিখছি৷ কিন্তু চোখে মুখে অহংকার পরিষ্কার৷
সামনেই ও জাতীয় পুরস্কার পেতে চলেছে সেই ভাবটাও বেশ পরিষ্কার৷ আরে নমিনেশন পাওয়া মানেই পুরস্কার পাওয়া নয়, গাম্বাট সেটাও জানে না, বললো জিনিয়া৷
আপসেট রিতেশ বাড়ি ফিরেও ক্লান্ত মুখে বললো, সায়নী সম্ভবত নন্দন পাবে এবারের পুরস্কারটা৷ অন্তত খবর তাই বলছে৷
সায়নী বেশ হেসেই বললো, তার মানে জিনিয়া মুখার্জী আর রিতেশ দত্তর থেকেও বেশি ভালো কেউ গাইতে পারে?
রাগের মাথায় সায়নীর গালে একটা থাপ্পড়ই মেরে বসলো রিতেশ৷
সায়নী বললো, বাহ! তোমার শুধু গলা নয়, হাতেও বেশ ছন্দ আছে তো৷
আমি কি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সায়নী?
তুমি তো জানতে আমি জিনিয়াকে ভালোবাসি৷
কথাটা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো রিতেশ৷
না, জানতাম না… বিয়ের রাতে জানলাম৷ তার আগে পর্যন্ত তুমি আর তোমার দিদি মিলে বুঝিয়েছিলে, এগুলো জাস্ট গসিপ৷ স্টারদের নিয়ে রটনা৷
বিয়ের পরে যখন তোমার শার্ট-এ লিপস্টিকের দাগ আর লেডিস পারফিউমের গন্ধ পেয়েছি তখন বুঝেছি ওগুলো গসিপ নয়৷
আপাতত আমি এসব জেনেও কেন তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না জানো? কারণ নিজেকে আর মুখরোচক খবর করতে চাইছি না বলে!
সায়নী চলে গেল রান্না ঘরে৷
হাত না তুলেও থাপ্পড় মেরে গেলো রিতেশের গালে৷
জিনিয়া শুনে বললো, দেখো রিতেশ এসব হলো জেলাস মেয়ে৷ নিজেদের কোনো ক্ষমতা নেই, যোগ্যতা নেই তোমার ওয়াইফ হবার, তাই হিংসা করছে৷
তবুও তো ন্যাশনাল আওয়ার্ড প্রোগ্রামেতে আমার বাবা-মা জোর করে আমার সাথে সায়নীকে পাঠিয়ে দিচ্ছে গো৷ রিতেশের মুখেও বিরক্তি৷
জিনিয়া চিমটি কেটেই বললো, ভালো তো, তবুও তো রিতেশ দত্তর বউ হয়ে একবারের জন্যও সিরিফোর্ট অডিটোরিয়ামে পা রাখতে পারবে ওই হিংসুটে টাইপ মেয়েটা৷ নিজের তো কোনো যোগ্যতা নেই তোমাদের হেঁসেল ঠেলা ছাড়া৷
সত্যিই রিতেশের যে কি ভীমরতি ধরেছিলো, যে ওই সাধারণ মেয়েটাকে বিয়ে করে বসলো!
জিনিয়া, তুমি কার সাথে যাবে?
একমুখ হেসে জিনিয়া বললো, আমি মিউজিক ডিরেক্টার প্রতাপ রায়ের সাথে যাচ্ছি৷ মার্কেটে খবর আছে জিনিয়া মুখার্জীর নতুন প্রেমিক নাকি এই প্রতাপ রায়৷ বড়ো ঘাটেই নৌকা বেঁধেছে জিনিয়া৷
রিতেশ জিজ্ঞেস করলেই জিনিয়া বলেছে, কেন রিতেশ বিয়ে তো তুমিও করেছো৷ ঘরে বউ রেখে তুমিও তো আসছো আমার ফ্ল্যাটে৷ তাহলে আমি কার সাথে মিশেছি তা নিয়ে তোমার এত আগ্রহ কেন!
সপাটে যেন কেউ একটা চড় মারলো রিতেশের গালে৷
দামি গাড়ি, অফুরন্ত টাকার আড়ালেও রিতেশ ভীষন অসুখী৷ অসুখী, কারণ সে জিনিয়ার মতো মেয়েকে ভালোবাসে! যে ভালোবাসার অর্থই বোঝেনা৷ এখন যেমন মিউজিক ডিরেক্টার প্রতাপ রায়কে ব্যবহার করছে সিঁড়ি হিসাবে৷
সিরিফোর্ট অডিটোরিয়াম আজ তারকা খচিত৷ ন্যাশনাল আওয়ার্ড দেওয়ার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে৷
রিতেশের পাশের সিটটাতেই বসে আছে সায়নী৷ অন্য সময় হলে রিতেশের সাথে কোনো পার্টিতেই আসতে চায় না৷কলকাতার মধ্যেই বেরোতে চায় না সায়নী৷ আজ হয়তো নন্দনের কাছে রিতেশের পরাজয়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে চাইছে সায়নী৷ গত এক বছরের রিতেশের কাছ থেকে প্রাপ্ত সব অপমানগুলোর মলম পড়বে রিতেশের হাত থেকে ন্যাশনাল আওয়ার্ডটা বেরিয়ে গেলো বলে৷ শুধু সায়নী কেন, জিনিয়াও চায় না পুরস্কারটা রিতেশ পাক!
জিনিয়া এখন প্রতাপ রায়ের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই হলে প্রবেশ করলো৷ আড়চোখে একবার তাকালো রিতেশের দিকে…
সায়নীই আগ বাড়িয়ে বললো, আমি কি সামনের চেয়ারে যাবো, জিনিয়া মুখার্জী কি তোমার পাশে বসবে?
অপমানে শরীরটা নীল হয়ে যাচ্ছে রিতেশের৷ সেই সময়েই ঘোষক সুললিত কন্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘মেঘের বাড়ি’ মুভির লিরিক্স-এর জন্য ন্যাশনাল আওয়ার্ড পাচ্ছেন, সায়নী সেন৷
গায়ক নন্দনের গলায় যে গানগুলো আপনারা শুনেছেন সেগুলোর রচয়িতা সায়নী সেন৷ অপরিচিত আর সম্পূর্ণ নতুন নাম সায়নী সেন৷
রিতেশকে চমকে দিয়েই সায়নী উঠে গেলো মঞ্চে৷ পাশেই আরেকজন ন্যাশনাল আওয়ার্ড পাওয়া গায়ক নন্দন দাঁড়িয়ে আছে৷
দত্ত নয়, সেন সারনেম ব্যবহার করেছে সায়নী! রিতেশের পরিচয়টা কি মুছে দিতে চাইছে! তাই আগের সারনেম? এখনো ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে রিতেশ৷ মেঘের বাড়ির মুভির পোস্টারে লিরিকিস্ট-এর নামটাই তো দেখা হয়নি৷ ভেবেছিলো নন্দনই হয়তো করেছে৷ নন্দন তো এখন বেশ কিছু গান নিজেই লিখে সুর দিয়েছে… তাই আর খেয়াল করা হয়নি৷
সায়নীর হাতে মাইক, বলতে শুরু করেছে ও৷
কি লিখেছি জানি না, কাটাকুটি করতে করতেই কয়েকটা গানের লাইন বেরিয়ে এসেছিলো আমার কলমে৷ ‘মেঘের বাড়ির’ পরিচালক তার মুভির জন্য লিরিক্স চেয়ে এড দিয়েছিলেন৷ শুধু খেলার ছলেই নিজের লেখা ওই হাবিজাবি শব্দগুচ্ছদের বন্দি করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম৷ হাজার হাজার গানের ভিড়ে আমার কথাগুলো যে সিলেক্ট হবে, সেটাও কল্পনা করিনি৷ ভাবতেও পারিনি তারপর ‘মেঘের বাড়ির’ সব কটা লিরিক আমাকে লিখতে হবে৷ তবে সব থেকে প্রিয় ছিল, ‘তোমার মনে অন্য কারোর বাস,বর্তমানে থেকেও আমি রইলাম পরবাস’…
আমি নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, আমাদের শরৎ বাবুর সাধারণ মেয়ের মতো কোনো উচচাকাঙ্ক্ষাও ছিলো না সেলিব্রিটি হবার৷ সেলিব্রিটিদের দূর থেকে ভালোবেসেছি চিরকাল৷ তবুও আজ জাতীয় পুরস্কার পেয়ে আপ্লুত৷ এখনো স্বপ্ন স্বপ্ন সত্যি মনে হচ্ছে এই পুরস্কারটাকে৷
নন্দন হাসি মুখে মাইক ধরেই বললো, শুধু লিরিক্সের জোরেই গানটা হিট৷ গায়কির জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত গায়কও লিরিকিস্টকেই ক্রেডিট দিতে চাইছে৷
থমথমে করছে রিতেশের ঘরের পরিবেশ৷ সায়নীর ডায়রির পাতায় অসংখ্য গান লেখা৷ তার মধ্যে বেশ কিছু অলরেডি নন্দন গেয়েছে৷
রিতেশের বাবা, মা, এমনকী দিদিও জানতো সায়নী গান লেখে৷ শুধু রিতেশই ছিল অন্ধকারে৷
পরিচিতরা ক্রমাগত ফোনে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাচ্ছে রিতেশকে৷ এমন গুনের স্ত্রী পেয়েছে বলেই হয়তো৷ এমনকী জিনিয়াও বললো, তোমার বউ তো ছুপা রুস্তম৷ তবে তোমার সারনেম ব্যবহারে কি আপত্তি আছে তোমার বউ-এর?
কাল রাতেই সায়নীকে জিজ্ঞেস করেছিলো রিতেশ, সায়নী কেন দত্ত ইউজ করেনি, সেন কেন? সায়নী ভারী গলায় বলেছিলো, দত্ত হলাম কবে?
ক্ষমা চাইবে কি সায়নীর কাছে? আদৌ কি হয় ওর অপরাধের ক্ষমা!
সায়নীর সম্মুখীন হতেই লজ্জা করছিলো রিতেশের৷ তবুও রাতের অন্ধকারে একই বিছানায় শুয়ে আলতো করেই ডাকলো রিতেশ৷ একবারও বললে না আমাকে? কেন সায়নী?
অভিমানী গলাটা যেন বিদ্রুপ করলো রিতেশকেই! সায়নী ধীরে ধীরে বললো, অনেক রাত হলো, ঘুমিয়ে পড়ো৷ কাল তোমার রেকর্ডিং আছে!
রিতেশ বললো, হোক রাত৷ ফুলশয্যার রাতেও তো আমরা ঘুমিয়েছিলাম আজ না হয় একসাথে ভোর দেখলাম৷
মৃদু হেসে সায়নী বললো, এখনো তোমার গা থেকে জিনিয়া মুখার্জীর পারফিউমের গন্ধ আসছে রিতেশ৷ তোমার গায়ে খুঁজলে হয়তো এখনো দু চারটে লাভ বাইট পাওয়া যাবে জিনিয়ার৷ আমি আজও তোমার গানের ফ্যান৷ কিন্তু মানুষ রিতেশকে আমার বড্ড ঘেন্না৷
প্লিজ রিতেশ, আমাদের সম্পর্কটা চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকতে দাও,গসিপ বানিও না৷ বিয়ের রাতের আমাকে নিয়ে আড়ালের হাসি ঠাট্টা আজও ভুলিনি৷ আমাকে থাকতে দাও সাধারণ মেয়ে হয়ে৷ নিতান্ত সাধারণ হয়েই বাঁচতে চাই আমি৷ সাধারণ মেয়েদের এত সস্তা ভেবো না রিতেশ, আত্মসম্মান শব্দটা আমিও জানি৷
নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজটাও যেন আজ ব্যঙ্গ করে উঠলো রিতেশকে৷ দূরে কোথাও গান বেজে উঠলো…
তোমার মনে অন্য কারোর বাস,
বর্তমানে থেকেও আমি রইলাম পরবাস…