তোমার কালের স্বাদগন্ধ
আমি ভাবতাম—আমি এরকম বলব না কখনও। কখনও এই বুড়ো পিসেমশায়ের মতো বলব না যে, আমাদের কালে যা ছিল, তার বিন্দু-বিসর্গ নেই এখন। বিভিন্ন পুকুরের তাজা মাছ নিয়ে গর্বোক্তি, কিংবা আম-লিচুর ফলন, এমনকী শীত-গ্রীষ্মের সঠিক যাওয়া-আসাও যে তাঁদের কালের শৃঙ্খলার ওপর নির্ভর করেই চলত, এই অতীত-প্রজন্ম-নির্ভর গর্বোক্তিগুলি আমি করব না বলেই ঠিক করেছিলাম এই সেদিন পর্যন্তও। বিশেষত মূল্যবোধের যে ব্যাপারটা সব সময়ই প্রায় ঊর্ধ্বতন তৃতীয় প্রজন্মকে আহত করে, আমি সেখানেও ভেবেছিলাম যে, মূল্যবোধ তখন একভাবে ছিল এখন আর একভাবে রয়েছে, তাহলে মূল্যবোধ নেই বলছি কেন? এই রকম শতেক মহাকালের উপাদান যা আমাকে না আমারই মতো প্রায় বর্তমান-সহগামী মানুষকে এটাই ভাবতে সাহায্য করত যে, প্রজন্মের বিষমতাকে আমি কিছুতেই মনোমাঝে স্থান দেব না, সে আমারও যেন বর্তমান থেকে পতন ঘটছে—অনেক খারাপ যেমন আরও উদগ্র হয়ে উঠছে, তেমনই অনেক ভালোর প্রতিও আমি কি খানিক ঈর্ষ্যালু হয়ে উঠছি?
এই প্রজন্ম ভেদে কালপ্রাপ্তির কথাটা মহাভারতের মতো মহাকাব্যে এত দার্শনিকভাবে উঠেছে এবং দার্শনিকতাও এত কাব্যিক যে আজকেও সেটা সবচেয়ে আধুনিক কল্পনা। মহাভারতে সত্যবতীর কথা মনে থাকবে আপনাদের। তাঁর মতো এত ব্যর্থ এক জননী অন্যদিকে ততটাই অব্যর্থ এক জননী দ্বিতীয় নেই। তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয়—তিনি স্বয়ং মহাভারতের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাসের জননী। সেই কালে, যখন তিনি কৈশোরগন্ধী যৌবনা, সেই তখন যমুনায় নৌকো বেয়ে পরাশর মুনিকে পার করছিলেন। মাঝ-যমুনায় এসেই মুনি পরাশরের মধ্যে সেই বিস্ফোরণ ঘটল এবং ঘটল সেই পরম অভ্যুদয়। জন্ম হল দ্বৈপায়ন ব্যাসের—জয়তি পরাশরসূনুঃ সত্যবতী হৃদয় নন্দনো ব্যাসঃ।
কন্যা-অবস্থায় এককালীন পুত্রের জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও সত্যবতীর শরীর এবং মন এতটাই সরস এবং আধুনিক ছিল যে, হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু তাঁর প্রেমে পাগল হলেন, তাঁদের শর্তাধীন একটা বিয়ে হল এমনই যাতে যুবরাজ-প্রায় দেবব্রত ভীষ্মের প্রজন্মটাই স্তব্ধ হয়ে গেল, তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখার দীর্ঘতম আয়ু পেলেন—আমৃত্যু কর্মকর এক সাক্ষীর মতো। ওদিকে আশ্চর্যলক্ষণা সত্যবতী ভীষ্মের অনুরোধেই এবার কানীন পুত্র ব্যাসের কথা প্রকাশ করলেন এবং তাঁরই কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেই ভীষ্ম যেহেতু বিচিত্রবীর্যের দুই রানীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে চাইলেন না, অতএব ভীষ্মের ইচ্ছা মেনেই তিনি পুত্র ব্যাসকে দিয়ে কুরুবংশের তন্তু বিস্তার করলেন। জন্ম হল ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, এবং বিদুরের। অতঃপর যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবদের এবং দুর্যোধনাদি কৌরবদের।
বয়সে ছোট বলেই পুত্রসমান ভাই সত্যবতীর পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যকেও যেমন ভীষ্মই মানুষ করেছিলেন, তেমনই পৌত্র-সমান ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু-বিদুরকেও তিনিই মানুষ করেছিলেন। অবশেষে তারও পরের প্রজন্ম দুর্যোধন-যুধিষ্ঠিরদের জীবনও তিনি পূর্ণমাত্রায় দেখে গেলেন সাক্ষী চৈতন্যের মতো। পর পর একাধিক প্রজন্ম দেখার ধৈর্য লাভ করলেও প্রজন্ম-ভেদের রহস্যটা কিন্তু ব্যাসই প্রকট করে দিয়েছিলেন সত্যবতীর কাছে এবং সত্যি বলছি—এত ভালো করে বলাটা মহাকাব্যের এই বিশালবুদ্ধি কবির পক্ষেই সম্ভব।
ঋষি পরাশরের সঙ্গে মিলিত হয়ে কন্যাবস্থায় এক আর্ষ পুত্রের জন্ম দিয়েও সত্যবতী কিন্তু আর্ষ জীবন বেছে নেননি। তিনি ঋষির কাছে অক্ষত কুমারীত্বের বর চেয়েছিলেন। কৈবর্তের ঘর ছেড়ে তিনি রাজরানী হলেন, শান্তনুর পুত্রের জন্ম দিলেন আপন গর্ভে, কিন্তু অদ্ভুত তাঁর জীবনের পরিণতি। যে ভোগ বাসনা নিয়ে তিনি শান্তনুর ঘরে এসেছিলেন, যেভাবে স্বামী শান্তনুর মৃত্যুর পর নিজের হাতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন হস্তিনাপুরের রাজনীতি, তাতে আরও বহুদূর তাঁর সিদ্ধহস্ত প্রসারিত হতে পারত। কিন্তু তাঁর গর্ভজাত সন্তান দুজনেই মারা গেলেন। সত্যবতী কি তাতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন? হননি; তারপরেও বিচিত্রবীর্যের দুই রানীর গর্ভে যাতে সন্তান আসে সেই চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন তিনি। রাজনীতি এবং সূক্ষ্ম রাজনীতির বোধ এতটাই তাঁর করায়ত্ত ছিল যে, ভীষ্মের মতো এক ‘মেন্টর’-ও কিন্তু সত্যবতীর মত মেনে চলতেন সব সময়—সত্যবত্যা মতে স্থিতঃ।
আপন তপস্বী পুত্র ব্যাসের প্রেরণায় সত্যবতীর ইচ্ছাপূরণ করে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্ম হল বটে, কিন্তু পাণ্ডুও তো রাজ্য ত্যাগ করে চলে গেলেন শতশৃঙ্গ পর্বতে এবং সেটা যতখানি অন্তর্গত বৈরাগ্যবশত, তার চেয়ে অনেক বেশি জ্যেষ্ঠ এবং অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলোভ পুষ্ট করার জন্য। শেষে পাঁচ ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্ম দিয়ে পাণ্ডু তো মারাই গেলেন তাঁর অস্থায়ী পার্বত্য আবাসে। ধৃতরাষ্ট্র এবার পুরোপুরি রাজ্যে স্থলাভিষিক্ত। কেউ তাঁর রাজ্যাভিষেক করল না, কিন্তু তবু তিনি রাজা। ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলোভ তাঁর পুত্র দুর্যোধনের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেছে। তাঁর দুর্বিনীত আচরণের খবর তাঁর কানে এসে পৌঁছোচ্ছে। তবু সত্যবতী এই রাজসংসার চক্রে নাভিস্থানে বসে আছেন। এখন কেউ আর তাঁর অভিমত প্রার্থনা করে না। পিতামহ ভীষ্ম খানিক নির্দ্বন্দ্ব ভূমিকায়। তবু সত্যবতী মুখ ফুটে বলছেন না—তিনি বিরক্ত, তিনি রিক্ত।
ঠিক এই রকম একটি দিনে—যখন পাণ্ডুর শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ হয়ে গেল, সত্যবতী বসে আছেন শোকমূর্ছিত হয়ে, সেই সময় ব্যাস এলেন জননী সত্যবতীর কাছে। বড়ো আকস্মিকভাবেই তিনি বললেন—মা! তোমার সুখের দিন শেষ হয়ে গেছে মা। সামনে যে দিন আসছে, সে একেবারে ভয়ংকর সব দিন, মা! তুমি সেদিন সইতে পারবে না—অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ পর্য্যুপস্থিতদারুণাঃ। সামনে যেদিন আসছে, তাতে পাপের ওপরে পাপ জমতে থাকবে এই পৃথিবীতে। তোমার দেখা সেই পৃথিবীর যৌবন হারিয়ে গেছে, মা। এবার তুমি আমার সঙ্গে সেই বৈরাগ্য জগতে চলো, আর এখানে থাকা নয়—শ্বঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ পৃথিবী গতযৌবনা।
‘পৃথিবী গতযৌবনা’—পৃথিবী তাঁর যৌবন হারিয়েছে, ঠিক এইখানেই প্রজন্মবৃদ্ধের সমস্ত আর্তি, সমস্ত রহস্য দার্শনিক সরসতায় ধরা পড়ে। আসলে বিরাট, বিশদ কালাশ্রিতা পৃথিবী কী কখনও তার যৌবন হারায়? কখনও না, পৃথিবী তাঁর যৌবন না, আমরাই পৃথিবীকে হারাই, আমার যৌবন সন্নদ্ধা পৃথিবী আমার প্রৌঢ়তা, আমার বৃদ্ধতা, আমার জরা-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। তখনই আমরা বলতে থাকি—আমার কালে যা ছিল কত ভালো সব মানুষ কত ভালো সব স্বাদিষ্ট খাদ্য, কত ভালো সেই সব পরিবেশ! এখন যা চলছে, ঘোর কলি।
প্রজন্মগত বৃদ্ধ এই কথাটা বুঝতে পারে না যে, পৃথিবী কখনো তার যৌবন হারায় না। যারা এখনকার কালের যুবক-যুবতী, তাদের কাছে পৃথিবী তাদের মতোই যৌবনবতী, সর্বতোসাহিনী শৃঙ্গারিণীর মতো। কিন্তু প্রজন্ম-বৃদ্ধের যৌবন যেদিন অতিক্রান্ত হয়, সেদিন তার পৃথিবীও যৌবন হারায়। আমার জোশ জৌলুশ ভাস্করতার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীর দীপ্তি-কান্তি-সৌন্দর্যও ম্লান হতে থাকে ধীরে ধীরে। সন্তানের সঙ্গে পিতার বয়সের যে পার্থক্যটুকু থাকে, কালের এই অন্তরটুকুই একজনের কাছে বিবর্ণ জড়তা বয়ে আনে, অথচ অন্যতরের কাছে সেই কালই আশা, অভিসন্ধি আর আস্বাদনের চর্বণা সৃষ্টি করে।
এক প্রজন্মের পর অন্যতর প্রজন্মের সঙ্গে যে মতের মিল হয় না, সেখানে এই জগতের সতত প্রবহমানতাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। বয়স্ক পিতা-মাতা এবং বৃদ্ধতর পিতামহ-পিতামহীরা যদি এই প্রবহমান কালের মধ্যে ভেসে থাকতে না পারেন, তাহলে পূর্বোত্তর প্রজন্মের মধ্যে বিবাদ অবশ্যম্ভাবী। মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু ছিলেন বলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তিনি দেখেছেন, কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে তাঁকে আমরা অনেক উদাসীন দেখেছি। বিশেষত অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের বাড়বাড়ন্তের সময় থেকে। রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ-কালে পিতামহ ভীষ্ম বিদুরের অপমানটুকু বসে বসে দেখেছিলেন। দেখেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্ম দুর্যোধন পূর্বতন বিদুরকে বলছেন—নিজের সম্মানটা নিজে বাঁচান, কাকা! আমাদের ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামালেই ভালো থাকবেন—যশো রক্ষস্ব বিদুর সম্প্রণীতং/মা ব্যাপৃতঃ পরকার্যেষু ভূস্ত্বম।
ঠিক এই কথাটাই তো বৃদ্ধতর প্রজন্মের প্রতি পূর্বতনের শেষ কথা। দুর্যোধন বিদুরকে আরও বলেছিলেন—তুমি চিরকাল আমাদের উলটো কথা বলেছো, আমরা যেন সব বাচ্চা ছেলে, এইভাবে অপমান করো আমাদের। তাতে আমরা এটাই বুঝেছি যে, এতদিন আমরা একটা হিংস্র পশু কোলে নিয়ে বসে আছি। তোমার ব্যবহার ঠিক বেড়ালের মতো; যে বেড়াল পুষেছে, তার ঘরেই সে হিংসার কাজটা করে—মার্জারবৎ পোষকঞ্চেপহংসি। অতএব তুমি কথা বন্ধ করো, আমাকে কোনো শিক্ষে দিতে এসো না আর নিজেকেও কোনো আহা মরি ‘কর্তা’ বলে ভেবো না, আর কর্তা ভেবে আমাকে এসব খারাপ কথা বলারও চেষ্টা কোরো না—অহং কর্তেতি বিদুর মাবমংস্থা/ মা নো নিত্যং পরুযাণীহ বোচঃ।
ভীষ্ম পিতামহ বিদুরের এই অপমানটা দেখেছেন এবং বুঝেছেন—এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের আন্তরিক তফাত থাকলেও দুর্যোধনের মতো এতটা দুর্বিনীত প্রজন্ম ভীষ্ম দেখেননি। ফলত তিনি কিন্তু বিদুরের মতো উলটো কথায় তাঁর অপছন্দের কথাটা বলেননি। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি বুঝিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে মানিয়ে নিয়েছেন দুর্যোধনের সঙ্গে, আর ওই বস্ত্রহরণের সময় অধিকতর অপমানের ভয়ে দ্রৌপদীর উপযুক্ত প্রশ্নের উপযুক্ত জবাবটা তিনি এড়িয়ে গেছেন। ভীষ্মের মতো দীর্ঘায়ু হওয়ার সুবিধে এই যে, তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখতে পেয়েছেন এবং দেখতে পেয়েছেন যে দুর্যোধন যেমন একটা প্রজন্ম তেমনই যুধিষ্ঠিরও একটা প্রজন্ম। কালের গতিতে ভালোমন্দের চেহারা পালটায়।
সবচেয়ে জব্বর কথাটা বলেছেন কবি ভর্তৃহরি এবং পিতা-পুত্র-পিতামহের প্রজন্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সেই কথাটার সম্পর্ক এতটাই তটস্থ দার্শনিকের মতো যে, উত্তরোত্তর প্রজন্মের আচার-ব্যবহার এবং কথা অনেক সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। ভর্তৃহরি বলেছেন—আমরা যা কিছু ভোগ করেছি বলে ভাবছি, সেটাকে এমনও ভাবা যায় যে, আমাকে বা আমাদেরই ভোগ করে নেওয়া হয়েছে—ভোগা ন ভুক্তা বয়মেব ভুক্তাঃ। আর এই যে ভাবছি, সময় চলে গেল খারাপ সময় আসছে, সেটা এক্কেবারে ভুল। আসলে কাল হল সেই নিত্য পদার্থ যার আসা-যাওয়া নেই কোনো, ফলে সময় চলে গেল বলে যে হা-হুতাশ করি আমরা, ঘটনা ঠিক তার উলটো—সময় চলে না, আমরাই চলি। কাল যায় না, আমরাই যাই—কালো না যাতো বয়মেব যাতাঃ। তাই আমরা যে বলছি—আমাদের প্রজন্মে সব ভালো ছিল, এই প্রজন্মে সব খারাপ—সেটা দার্শনিক ভাবেই অসিদ্ধ। আসলে আমার ভালো পৃথিবী নিয়ে আমি চলে গেছি। তোমার ভালো পৃথিবী এসেছে তোমারই সঙ্গে যৌবনসরসা হয়ে।
আমি যে ভেবেছিলাম, চশমা নিয়েও আমি পা মেলাবো এই চলমান নতুন জীবনের সঙ্গে, অন্তত মনে মনে থাকব নতুন, মেনে নেব নতুনের ইস্তেহার। কিন্তু দেখলাম, সেটা হয় না। পা তো মেলাতে পারিই না, কেননা নব্য যুবকের দ্রুতপদী চরণ-চারণার তুলনায় আমার পদ-চারণা ধীর, অচঞ্চল এবং শারীরিক ব্যতিপাত যাতে না ঘটে, সেই কারণেই দৃঢ়। যদি বলি—ঠিক আছে শরীর চলুক তার আপন চালে, আমার মন চলুক এই শত শত তরুণ-তরুণীর মনোবাক্য-বুদ্ধি-অহংকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। দেখলাম, সে চলার মধ্যেও একটা ভালোর সঙ্গে আরেকটা ভালো মেলে না, প্রাচীন পঁচিশ বছর আগের ভালোর সঙ্গে এখনকার চলমান ভালোটা মিলছে না। আসলে ভালো-র সংজ্ঞাটা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের কারও হাতে নেই, সময় বা কালই বোধহয় সেই দার্শনিক অধিকারী যে সময় এবং সময়ান্তরের ভালোটাকে পর্যায়ক্রমে নির্ধারণ করে চলে। কিন্তু সে নির্ধারণ আমাদেরই চলার নির্ধারণ, আমাদেরই পর্যায়-কালের নির্ধারণ—সময় দাঁড়িয়ে আছে স্থির এক সাক্ষী-চৈতন্যেরা মতো—আখির ইয়ে ওয়ক্ত, কেয়া হ্যায়? কাঁহা সে আয়া, কিধার গয়া হ্যায়, ইয়ে কবসে কবতককা সিলসিলা হ্যায়? ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যায় আখির?
তার মানে, এই বুড়ো বয়সে বড়ো আধুনিকমনা হয়েও আমি কিন্তু সমস্যার কোনো সুমীমাংসা করতে পারি না। কেননা মহাকাশ কতগুলি চিরসত্য কোলে নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝখান দিয়ে আমার চোখে চশমা এসে জানান দেয়—সত্য বস্তুটাকে তুমি কিন্তু তোমার কালের চলমানতা দিয়ে বিচার করছো, অথচ তোমার কালের চলমানতা তোমার কালেই স্থির হয়ে গেছে। সেখানে জায়গা গিয়েছে অন্য এক চলমান স্থির। সেই কবি খুব ভালো লিখেছিলেন কথাটা। বলেছিলেন—
একটা চলতি গাড়ি থেকে আমি দেখছিলাম—অনন্ত বৃক্ষরাজি পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে, অথচ সব চেয়ে বড়ো সত্য তো এই যে সমস্ত গাছই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আমিই চলছি শুধু, চলতে চলতে ফুরোচ্ছি—
মগর হকিকতমে পেড় অপনি জগহ খড়ে হ্যায়,
সারি সদিয়াঁ কতার অন্দর কতার অপনি জগহ খড়ি হো,
ইসে ওয়ক্ত সাকিত হো ঔর হম হি গুজর রহে হো,…
…সফরমেঁ হম হ্যায় গুজরতে হাম হ্যায়।
জিসে সমঝতে হ্যায় হম গুজরতা হ্যায়, উয়ো থমা হুয়া হ্যায়,
আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যায়, কেয়া হ্যায় আখির।