১৫
বাঘের অনুপস্থিতিতে শিকারি বাঘের গুহায় গিয়ে যেমন রোমাঞ্চিত বোধ করে কলরবের অনুপস্থিতিতে তার বাথরুমে গোসল করাটাও নিহিনের কাছে প্রায় সমান রোমাঞ্চকর। গোসল করতে ঢোকার সময় কল্প কোত্থেকে একটা টাওয়াল এনে দিলো। নিহিন বলল,
“বাথরুমে তো টাওয়াল আছে দেখলাম।”
“ওটা তো পাপ্পার। এটা কারোর না, তুমি এটা নাও।”
কল্পর দেওয়া টাওয়াল আর কলরবের একটু আগে গোসল করে যাওয়া ভেজা টাওয়াল দুটোই এখন পাশাপাশি রাখা। কলরবের টাওয়ালটাই উঠিয়ে নিল নিহিন। আবার ভাবলো, পরপুরুষের টাওয়াল ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে, মাথাটা কি একদমই গেল! পরক্ষণেই আবার ভাবলো, ধুর কী হবে এত কিছু ভেবে, যা ভালো লাগছে তাই ভাল। ভালো লাগায় কোনো পাপ নেই।
টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতেই কেমন একটা পুরুষ পুরুষ গন্ধ পেল। অদ্ভুত অচেনা এক ভালোলাগায় ভরে গেল নিহিন।
গোসল করে বের হতেই কল্প দৌড়ে এলো। ওকে দেখেই নিহিনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, নিহিনকে হাসতে দেখে কল্পও হাসল। চুল মুছতে মুছতে নিহিন ভাবল, একটু কাজল লাগালে হয়, কলরবের ভালো লাগবে। ব্যাগ থেকে কাজল বের করতে গিয়েই কল্পর জন্য আনা চকলেটগুলো চোখে পড়ল। বের করে কল্পকে দিতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল। বলল,
“আমার জন্য? ইয়ে!”
আয়নার সামনে গিয়ে এক চোখে কাজল লাগাতেই দেখতে পেল পাশে বসে দেখছে কল্প। দেখতে দেখতে একদম বাঁকা হয়ে পড়েই যাচ্ছিল। নিহিন ওর এ অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। কল্পও দাঁত বের করে হাসল। নিহিন জিজ্ঞেস করল,
“হাসছ কেন?”
“তুমি হাসছ তাই। তুমি সাজছো তাই না?”
“হ্যাঁ তো।”
“আচ্ছা এটা কী লাগাচ্ছ চোখে?”
“এটা কাজল।”
“ও এটাকেই কাজল বলে?”
“হুম।”
“এটা লাগালে ব্যথা লাগে না?”
“না তো!”
“আচ্ছা তাহলে লাগাও।”
কাজল লাগিয়ে খাটের উপর ওঠে বসল নিহিন। কল্প আরো কাছে নিহিনের একদম সামনে এসে বলল,
“তুমি একদম আমার মায়ের মতো দেখতে।”
নিহিন প্রথমে কিছু বলতে পারল না। এরপর মুখটা স্বাভাবিক রেখে বলল, “হ্যাঁ অনেকটা মিল আছে।”
ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল নিহিন। তারপর কল্প কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে? মা কখনো ধরেনি। জানো স্কুল ছুটির পর সবাই দৌড়ে গিয়ে ওদের মাকে জড়িয়ে ধরে, আর আমি দাদাভাইয়ের সাথে বাসায় চলে আসি, আমার মন খারাপ দেখে দাদাভাই আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চায়। চকলেট আইসক্রিম কিনে দিতে চায়, আমার তখন ওসব কিছু ভালো লাগে না।”
চোখ ছলছল করছে কল্পর। নিহিন ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আর নিহিনের কান্না দেখে কল্পও কেঁদে ফেলল। মা ও সন্তান দুজনে দুজনার পরিপূরক। এইটুকু একটা বাচ্চা এত কষ্ট নিয়ে এত হাসি মুখে থাকে কী করে বুঝে পেল না নিহিন। ইচ্ছে করছে এই যে ধরেছে, এভাবেই ধরে থাকুক। নিহিন কান্না থামাতে পারছে না…কী অদ্ভুত ব্যাপার, এত কষ্ট কেন হচ্ছে এ বাচ্চাটার জন্য। কল্প তো আসলে ওর কেউ না।
শওকত সাহেব ও কলরব বেল না বাজিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকল ফ্ল্যাটে। নিজের রুমে ঢুকে এ দৃশ্য দেখে হতবাক কলরব। নিহিন কল্প দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু কেন? কলরবকে দেখে নিহিন দেওয়ালে টাঙানো নিজের ছবিটার দিকে তাকাল। নিহিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে কলরবও তাকাল।
১৬
সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলো নিহিন। কল্প ওর ছোট্ট হাতে যখন খাওয়া শুরু করল, বড্ড মায়া হলো নিহিনের।
“কল্প আমি খাইয়ে দেই তোমাকে? খাবে আমার হাতে?”
“সত্যি আমাকে খাইয়ে দেবে?”
আনন্দে নেচে উঠল কল্পর চোখমুখ। কলরব বলল,
“এই না না, ও একা নিজ হাতে খায় আরো অনেক আগে থেকে।”
“তাই বলে আমি একবেলা ওকে খাইয়ে দিতে পারব না?”
কল্প আর শওকত সাহেব চুপ করে আছে, কলরব নিহিনকে বলল, “দরকার নেই, তুমি খাও তো। আজ তুমি খাইয়ে দেবে, কাল কে থেকে তো আবার ওর নিজ হাতেই খেতে হবে, তাই অভ্যাস নষ্ট করার দরকার নেই।”
“এটা কেমন কথা বলছ তুমি? বাচ্চা মানুষ তো।”
এবার শওকত সাহেব বললেন,
“একবেলা খাইয়ে দিক না। ও তো আর তোর আমার হাত ছাড়া কারো হাতে খায়নি কখনো।”
“না বাবা, আজ খাইয়ে দিলে পরে আবার আবদার করবে। কয়দিন নিহিন খাইয়ে দিতে পারবে বলো?”
কল্প বলে উঠল,
“আমি আর কখনো আবদার করবো না পাপ্পা, আই প্রমিস!”
কলরব কিছু বলার আগেই নিহিন বলল,
“ও তো আজও আবদার করেনি, আমিই তো চাইলাম। অযথা শাসন করছো কেন? আমি ওকে খাইয়ে দেবোই। তোমার কোনো কথা আমি শুনছি না।”
কলরব মনে মনে বলল, “কেন যে না করছি তা তোমারা কেউ বুঝলে না। এ বাচ্চাটাকে আমি মা দিতে পারব না, শুধু শুধু একদিন ওকে মায়ের জাত চিনিয়ে লাভ কী! পরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে যখন বালিশ ভেজাবে, তোমরা কেউ তো টের পাবে না।”
কিন্তু নিহিনের এ কথায় খুশি হলো শওকত সাহেব, সবসময় শুধু শাসন তার ভালো লাগে না। নিহিন খাইয়ে দিতে গেল। কল্প বলল,
“মিষ্টি আন্টি থাক আমি একাই খেয়ে নিচ্ছি। দেখো আমি কী সুন্দর করে খাই, একটুও প্লেটের বাইরে পড়বে না। নিহিন তাকালো কলরবের দিকে। বাবার পারমিশন ছাড়া ছেলে খাবে না সেটা বুঝে গেছে নিহিন।” কলরব হেসে বলল,
“আচ্ছা খাও, কিন্তু এরপর আন্টিকে বিরক্ত করা চলবে না।”
কল্পর মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল। তারপর হা করল, নিহিন খাইয়ে দিলো।
কলরবের বাবা বলল,
“মা এত সুন্দর রান্না বহুদিন খাইনি। আর ভর্তাগুলো তো অসাধারণ, দেখতেও কী চমৎকার হয়েছে। আজকালকার মেয়েরা এত যত্ন করে রান্না করতে পারে জানা ছিল না। তোমার আন্টি চলে যাবার পর এত ভালো রান্না কখনো খাইনি।”
কলরব বলল,
“বাবা ওর রান্না কিন্তু মায়ের মতো না।”
“একেক জনের রান্না একেক রকম হয় সেটাই স্বাভাবিক। রান্না ভালো হয়েছে এটাই বড় কথা।”
কল্প খেতে খেতে বলল,
“আমি এত মজা জীবনে খাইনি। আমি তোমাকে আর মিষ্টি আন্টি ডাকবো না।”
কলরব বলল,
“তাহলে কি রাঁধুনি আন্টি ডাকবি?”
কল্প নিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাঁধুনি কী?”
নিহিন হেসে বলল,
“কুক।”
তারপর কল্প কলরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কখনোই না, আমি ওকে মিষ্টি বলে ডাকব। আন্টি বলব না। আন্টিরা তো পচা হয়, শুধু গাল ধরে টানে। মিষ্টি তো ভালো।”
কল্পর এ কথায় সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠল।
কলরব বলল,
“কিন্তু ইলিশ পোলাওটা আগের বারের মত অত ভালো লাগছে না।”
কথাটা বলেই কলরব নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করা ভঙিতে আবার খাওয়া শুরু করল। কলরব কী মিন করছে তা নিহিনের বুঝতে বাকি রইল না। শওকত সাহেব বললেন,
“এর থেকে মজা আবার হয় কীভাবে। মা তুমি ভেবো না, পোলাও টাও খুব মজা হয়েছে। কলরব হয়তো কোনো কারণে ভাব নিচ্ছে।”
নিহিন বলল,
“না আংকেল আমি ভাবছি না। ওর কাছে কেমন লাগল তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আপনার আর কল্পর কাছে ভালো লাগলেই আমি খুশি।”
কলরব হেসে ফেলল। শওকত সাহেব জিজ্ঞেস করল ‘হাসছিস কেন?’
“এমনি বাবা।”
নিহিনের গা জ্বলছে, এ ছেলেটা নিশ্চিত কোনো দুষ্টুমির কথা ভেবে হাসছে।
১৭
লাঞ্চের পরপরই বেড়িয়ে পড়ল ওরা। কলরব ড্রাইভ করছে, পাশের সিটে নিহিন। কলরব বলল,
“আসার সময় কল্প কী বলছিল তোমার কানে কানে?”
নিহিনের মনে পড়ল, কল্প কানে কানে বলছিল, “মিষ্টি, তুমি আবার আসবে আর আমাকে আবার খাইয়ে দেবে। এ কথা পাপ্পাকে বোলো না কিন্তু, ঠিক আছে?” নিহিন আদর করে বলেছিল, ঠিক আছে। কলরবকে বলল না কল্প কী বলেছে, বলল
“সেটাও তোমার জানা লাগবে?”
“তুমি না বলতে চাইলে বোলো না। কল্পকে জিজ্ঞেস করলেই পাওয়া যাবে।”
“সব কথাই তোমার জানা লাগবে কেন, শুনি?”
“কৌতূহল।”
“এত কৌতূহল ভালো না।”
“ও, আচ্ছা তুমি কি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে পারবে?”
“বাসায় বলে এসেছি বিকালে ফিরবো।
“ও।”
“কেন?”
“না, মানে তোমার সময় থাকলে একটু আশুলিয়ার দিকে যেতাম। নদীর হাওয়া গায়ে লাগাতে।”
“ঠিক আছে দাঁড়াও, আমি বাসায় একটা কল করে জানিয়ে দেই যে ফিরতে দেরি হবে।”
“আচ্ছা।”
কল করতে গিয়ে নিহিন দেখল ফোন খুঁজে পাচ্ছে না। পরে মনে পড়ল রান্না করার সময় ফোন বেজেছিল, তখন ফোন নিয়ে গিয়েছিল রান্নাঘরে, এরপর আর আনতে মনে নেই হয়তো। ওখানেই রয়ে গেছে। কলরব গাড়ি ঘুরালো। বলল,
“এখন মাত্র সাড়ে তিনটা বাজে। বাসা থেকে ফোনটা নিয়ে তারপর ওদিক দিয়ে আশুলিয়া চলে যাই। তোমাকে ৭ টার মধ্যে বাসায় পৌঁছে দিলে হবে?”
“দেরি হবে জানালে ৯/১০ টা বাজলেও সমস্যা নেই। একটা কিছু বলে দিলেই হবে।”
বাসায় গিয়ে বেল বাজালো কলরব। পরপর তিনবার বাজাবার পরেও দরজা না খোলায় অবাক হয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, ভেতরে ঢুকে আরও অবাক হলো। বাসায় কেউ নেই। ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে কলরব বাবাকে কল করল, নিহিন পাশেই দাঁড়িয়ে।
“হ্যালো…”
“হ্যাঁ কলরব বল।”
“বাবা তোমরা কোথায়?”
“কল্প বোর হচ্ছিল তাই নিয়ে একটু বেড়িয়েছিলাম, এই লেকের ধারে হাঁটছিলাম। এখন তোর বড় চাচার বাসায়।”
“অতদূর গেলে কীভাবে?”
“তোর চাচার সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়, ওর গাড়িতে এলাম।”
“পারোও তোমরা, আমাকে জানাবে না?”
“তুই তো বললি নিহিনের সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে ওকে বাসায় দিয়ে তারপর ফিরবি। তাই ভাবলাম এখন ডিস্টার্ব না করি। সন্ধ্যায় ফোন করে বলতাম এসে নিয়ে যেতে।”
“বাবা মজা নিও না তো।”
“রাগ করছিস কেন? তোর আসতে আসতে রাত হবে, আমরা কি ততক্ষণ বোর হব?”
“বাবা তোমাদেরকে কেউ যেতে না করেছে? বলে যাবে তো।”
“ওইযে বললাম ডিস্টার্ব করতে চাইনি।”
“ধুর তুমি না! মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না তুমি আমার বাবা।”
শওকত সাহেব, হাসতে লাগাল। কলরব বলল,
“রাখলাম।”
ফোন কাটতেই নিহিন বলল,
“কী হয়েছে? এত মেজাজ দেখালে?”
“আর বোলো না, বাবা না বলে কল্পকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিল। আমাকে বললে তো আমি পৌঁছে দিয়ে তারপর তোমাকে দিতে যেতে পারতাম।”
“কোথায় গেছে?”
‘বড় চাচার বাসায়।”
“তো এত রাগ করার কী আছে?”
“তুমি জানো না, কল্প মারাত্মক দুষ্টু। বাবাকে দশবার কিনে বিশবার বেচে দিলেও সে টের পাবে না। বাইরে গেলে ওর দুষ্টুমি আরও বেড়ে যায়, ১ বছর আগে ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল, তারপর থেকে আমি খুব টেনশানে থাকি। বাবা এখন আর ওকে সামলাতে পারে না।”
“কী এক্সিডেন্ট?”
“রাস্তা পার হতে গিয়ে বাবার হাত ছেড়ে দৌড় দিয়েছিল। হঠাৎ একটা বাইক এসে পড়ল। কল্পর গায়ে ধাক্কা লাগল, বাইকটা তো পড়ল, কল্পর গায়ের ওপরেই পড়ল।”
ভয়ার্ত কণ্ঠে নিহিনের মুখ দিয়ে বের হয়ে এল,
“ইস! এইটুকু বাচ্চা।”
“এখানেই শেষ না, এ দৃশ্য দেখে বাবা স্ট্রোক করল।”
“ওমা!”
আঁতকে উঠল নিহিন। কলরব বলল,
“একসাথে দুজন হসপিটালে। কল্পর একটা হাত আর একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। সারতে অনেক সময় লেগেছিল, বাবার অবস্থাও খারাপ ছিল। বোঝে আমার অবস্থাটা। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে দুমাস ছুটি নিয়ে এদের সেবা করেছি।”
“দুমাস!”
“হ্যাঁ, বাবা সুস্থ হয়ে গিয়েছিল, কল্পর মোটামুটিভাবে সারতে দুমাস লেগেছিল। তারপর থেকে খুব ভয়ে থাকি। ওদের একা একা বাইরে যেতে দেই না।”
“দিও না, যা শোনালে! ভাবলেই বুকটা কেঁপে ওঠে।”
“যাই হোক, ফোনটা নিয়ে চলো বের হই। সোয়া চারটা বেজে গেছে।”
“ও হ্যাঁ।”
রান্নাঘরে গিয়ে দেখল সেখানে ফোনটা নেই। বের হয়ে এসে দেখল কলরব ড্রইং রুমে নেই। ওর রুমে যায়নি তো?
নিহিন ফোন আনতে যাওয়ার পর কলরব দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, হঠাৎ চোখটা জ্বলে উঠল, চোখে কি কিছু গেল? তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে চোখে পানি দিলো। তারপর বারান্দায় গিয়ে টাওয়ালে মুখ মুছতেই মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেল, মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণ বলে মনে হচ্ছে। মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণ ওর টাওয়ালে! তখন খেয়াল হলো নিহিন গোসল করেছে ওর বাথরুমে। কিন্তু কল্প যে বলল ওকে এক্সট্রা আরেকটা টাওয়াল দিয়েছে। তখনই পাশে আরেকটা টাওয়াল চোখে পড়ল। দুইটাই কেন ব্যবহার করবে? তার মানে কি ইচ্ছে করে ওর টাওয়াল ব্যবহার করে এটা ভিজিয়ে রেখেছে, কল্প দিয়েছে বলে? পাগলিটা ওর প্রতি এখনো দুর্বল তা বুঝতো কিন্তু এ অবস্থা সেটা ভাবতেও পারেনি। মুখে হাসি ফুটে উঠল। খুব ভালো লাগছে, এতটা ভালো ও কাছে থাকতেই শুধু লাগত। টাওয়ালটা ধরেই এসব ভাবছিল কলরব। এমন সময় বারান্দার দরজায় শব্দ হলো।
“আমার ফোনটা পাওয়া যাচ্ছে না, একটা কল দেবে?”
টাওয়ালটা আবার মেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই নিহিন বলল, “একি! তোমার চোখ এত লাল কেন?”
“কিছু ঢুকেছিল।”
“কি?”
“জানি না, চোখ ধুয়ে ফেলেছি, এখন আর সমস্যা নেই। কী যেন বলছিলে?”
“ফোন রান্নাঘরে নেই। অন্যকোথাও রেখেছি বোধহয়। একটা কল দাও।”
কলরব কল করতেই ফোন বেজে উঠল ওর ঘরে। ঘরে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই চোখ পড়ল দেওয়ালে ছবিটার দিকে, তাকাতেই মনে পড়ল, তখন বাবা আর কল্প থাকায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি নিহিন। সুযোগ পেয়ে আর তাই হাতছাড়া করল না। বলল,
“আমার ছবি তোমার ঘরের দেয়ালে টাঙানোর মানে কী?”
“এটা তো আমার বউয়ের ছবি। তোমার ছবি হবে কেন? খবরদার নজর দেবে না।”
দুষ্টুমির হাসি হাসল কলরব। নিহিনির বুকে ধাক্কা লাগল ‘বউ’ শব্দটা। প্রথম দিন একটু রয়েসয়ে কথা বলেছে, আজ আর কিছু মানছেই না, একদম নিজের চরিত্রে ফিরে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“দেখো আমি সিরিয়াস, আমার ছবি কেন লাগিয়েছ? আর কোথায় পেয়েছ এই ছবিটা?”
“তোমার ছোটভাই এলাকার স্টুডিওতে ছবি ওয়াশ করতে দিয়েছিল। ও বের হওয়ার সময় রাস্তা থেকে ওকে দেখেছি, দেখে মনে হলো এমন তো হতে পারে যে তোমার ছবিও থাকতে পারে, কারণ তার কিছুদিন আগেই তোমার বোনের বিয়ে ছিল। বিয়েতে অনেক ছবি তুলেছো সেটা বলেছিলে।”
“স্টুডিওতে গিয়ে চাইতেই দিয়ে দিলো? বাহ তাহলে তো…”
নিহিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলরব বলল,
“না সেরকমভাবে চাইলে কেউ দেয় নাকি? সে স্টুডিওতে কাজ করত আমাদের বাসার দারোয়ানের ছেলে, ওই ছেলেটার সাথে আমার তো খুব খাতির ছিল, ওকে বলতেই ম্যানেজ করে দিলো। তাছাড়া আমাদের ব্যাপারটা ও আগে থেকেই জানত। তা নাহলে এতটা সহজ হতো না।”
“এভাবে না নিয়ে আমার কাছে চাইলে কি দিতাম না?”
“এটা তোমার বাবার সাথে ডিল হওয়ার দুই তিনদিন পরের ঘটনা, তখনও বাসা পালটাইনি। তোমার বাবা তোমার সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছে, তোমার ছবি দেখতে তো নিষেধ করেনি।”
বলেই হাসল কলরব।
“নিষেধ করলেই শুনতে হবে কেন?”
“সেকথা বলে আর কী হবে। ভেবেছিলাম তোমার বাবা কথা রাখবে। বাদ দাও এসব কথা।”
“আচ্ছা দিলাম বাদ, এবার এটা বলো দেওয়ালে কেন লাগিয়েছ ছবিটা? আবার কল্প বলছে এটা ওর মায়ের ছবি। এসবের মানে কী?”
কলরব জিজ্ঞেস করল,
“রাগ করেছ?”
নিহিননের গলার স্বর নরম হলো। বলল,
“রাগ করিনি। কিন্তু বাচ্চাটাকে মিথ্যের ওপরে রাখছো কেন?” কলরব এবার সিরিয়াস হলো। বিছানার একপাশে বসে নিহিনের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“দেখো, কল্প যখন একটু বড় হয়েছে, মা কী বুঝতে শিখেছে তখন থেকে ওর মাকে দেখতে চাইত। আমি কোত্থেকে দেখাব বলো? আর আমার কাছে তোমার এই ছবিটা ছিল, আমি ওকে এটা দেখিয়ে বলেছিলাম এটাই ওর মা। কখনো ভাবিনি তোমার সাথে আবার দেখা হবে, আমি জানতাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই তোমার ছবি দেখিয়ে কল্পকে ঠাণ্ডা করেছি। আর কাকে দেখাতাম বলো তো? তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে মনেপ্রাণে তোমাকেই নিজের বউ বলে জেনেছি। অন্য কাউকে এ জায়গায় বসাতে পারব না, সেরকম কোনো সিনেমার ডায়লগ আমি দেবো না। কিন্তু এটা ঠিক, তোমাকে ভুলতে পারছিলাম না। সে অবস্থায় যদি বিয়ে করতাম তাহলে সে মেয়েটাকে কষ্ট দেয়া হতো। ভালোবাসতে পারতাম না, নিজেকে কখনো দিতে পারতাম না। তাই অনেকভাবে চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলতে, নতুন সম্পর্কেও জড়িয়েছি, প্রেম হয়েছিল কিন্তু ভালোবাসা হয়নি। তার মুখের দিকে তাকালে আমি তোমাকে দেখতে পেতাম, তাকে ডাকতে গিয়ে তোমার নাম ধরে ডেকে ফেলতাম। এরকম আরো অনেক কিছু। কোনো অনুভূতিই আসত না। কীভাবে আসবে বলো? চারটা বছর অপেক্ষা করেছি, ভাবতে পার কতটা সময়? কীভাবে কেটেছে সেই দিনগুলো? সারাজীবন কোনোমতে টেনেটুনে পাশ করা আমি কিনা সেকেন্ড ইয়ার থেকে ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট হয়ে উঠলাম। কেন? শুধু একজনকে পাওয়ার লোভে। তখন মাথায় শুধু ওই একটা চিন্তাই ছিল। নিহিনের বাবা বলেছে যোগ্য হতে, আমাকে যোগ্য হতে হবে, এমন যোগ্য যে আমাকে ফিরিয়ে দিতে না পারে। যখনই তার জন্য মন খারাপ করত, ভাবতাম সেও তো দূরে থাকলেও অপেক্ষা করছে আমার জন্যই, তাহলে আর দূরে কই? আমার চিন্তাই তো করছে। এভাবেই দূরে থাকাটায় অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমার। সঙ্গী ছিল এক বুক স্বপ্ন। দুজন মিলে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্ন। ভালো চাকরি হয়েছে নিজের ফ্ল্যাট, গাড়ি সব করেছি নিজের টাকায়, স্বপ্নের সংসারটাও সাজিয়েছি ঠিক যেমনটি সে চেয়েছিল। নীল দেওয়াল, সিলিঙে অসংখ্য তারা, বেড রুমের একটা দেওয়াল জুড়ে আয়না, বারান্দায় বেলি ফুলের গাছ সবই করেছি, সবই আছে, শুধু সে নেই।
কথাগুলো বলে কলরব কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, নিহিনও একটা কথাও বলল না। তারপর আবার শুরু করল কলরব,
“অন্য একটা মেয়েকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না। তাই অন্য কোনো মেয়ে না, কল্পকে নিয়ে আসলাম আমার জীবনে। আমার জীবনের সব না পাওয়াকে পূরণ করে দিয়েছিল ও। ওকে আমি এডপ্ট করেছি ওর জন্মের দুই ঘণ্টা পর। সেদিন থেকে ও আমার ছেলে। তোমার বাবা ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে খুব ডিপ্রেশনে ছিলাম, ও আসার পর জীবনটাই অন্যরকম হয়ে গেছে। ও এখন আমার সবথেকে প্রিয়জন। আর কল্পও ঠিক তাই, আমার প্রত্যেকটা কথা ওর কাছে বাণী। আমাকে ভয় পায় বলেই না, ভালোবাসে প্রচণ্ড তাই। সেই ছেলেটা যদি তার মাকে একটু দেখতে চায় তাহলে তখন কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক তা চিন্তা করা আমার পক্ষে কি সম্ভব তুমি বলো?”
কলরব কথাগুলো বলে যখন নিহিনের দিকে উত্তরের জন্য তাকাল তখন দেখল নিহিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। বুকটা কেঁপে উঠল 1 সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল,
“এই কাঁদছো কেন?”
নিহিন কিছু বলল না। কলরব নিহিনের মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই পাগলি, কী হচ্ছে এসব? তুমি কাঁদলে আমার ভালো লাগে? থামো বলছি।”
নিহিন ধুম করে ঝাঁপিয়ে পড়ল কলরবের বুকে, কান্নার বেগ আরোও বাড়লো। কলরব প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কোনোমতে টাল সামলালো। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইল, এত বছরের জ্বলন্ত আগুনে যেন পানি পড়ল। কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা হাতে জড়িয়ে ধরল নিহিনকে। আর কোনো কথা বলতে পারল না, ওর সারা শরীর কাঁপছে।
১৮
কতক্ষণ যে কেটে গেল এভাবে তা কেউ জানে না। আস্তে আস্তে নিহিনের কান্নার গতি কমল। কিন্তু কলরবকে ছাড়ল না, বুকে মাথা রাখা অবস্থাতেই বলল,
“তুমি এত কষ্ট করেছ আর আমাকে একবার জানতেও দাওনি!”
কলরব নিহিনকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
“হুম, কিন্তু তোমার কান্না দেখে তো মনে হচ্ছে কষ্টগুলো তুমি করেছ।”
“আমি! আমি তো তোমাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি খুব রেগে ছিলাম তোমার ওপর।”
একথার পর কলরব দুহাতে নিহিনের মুখটা তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“জানি তো, কারণ আমি যোগাযোগ করার কোনো উপায় রাখিনি। আর তুমি জানতে না কেন আমি এমনটা করেছিলাম। তাই আমাকে তুমি ভুলতে পেরেছিলে। আমি কী করে ভুলবো বলো? তোমার সাথে ঝগড়াঝাটি দূরের কথা কোনো খারাপ স্মৃতিও ছিল না। আমি জানি, একবার যদি তোমাকে জানানো হতো সত্যিটা, তাহলে তুমি অবশ্যই অপেক্ষা করতে।”
একথা শুনে নিহিনের কান্নাটা আবার বাড়ল। কলরব বলল,
“আমাকে দেখো, আমি কি কাঁদছি? যা ঘটেছে আমাদের জীবনে তার শিকার তো আমরা দুজনেই তাই না? আচ্ছা, তোমরা মেয়েরা এত কাঁদতে পার কীভাবে?”
ছিটকে সরে গেল নিহিন, তারপর কলরবের বুকে হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ধমকের সুরে বলল,
“কী বললে?”
কলরব হেসে বলল,
“ম্যাম, কথাটা বললাম বলেই কান্নাটা থামল আপনার। এতক্ষণ আদর করে বলেছি, তখন আপনার কান্না থামেনি তাই রাগিয়ে দিলাম। যার হাসি এত সুন্দর সে কাঁদলে কি ভালো লাগে?”
নিহিন লজ্জা পেয়ে বলল,
“তুমি একটা পাজির হাড্ডি।”
“হুম, জানি।”
নিহিন এখন আর তাকাচ্ছেই না কলরবের দিকে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মুখটা। মিষ্টি হাসি ঠোঁটে, চোখ দুটো ভেজা। সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে। ওকে আবার জড়িয়ে ধরে ভালোবাসায় পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে কলরবের। ও জানে নিহিন এখন বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু কাজটা ঠিক হবে না, তাই এখনি বেড়িয়ে যেতে হবে। আবেগকে অত পাত্তা দিতে নেই!
সন্ধ্যা পার হয়ে যাওয়ায় ওদের আর আশুলিয়া যাওয়া হলো না। নিহিন বাসায় না এসে তিথির বাসায় গেল। কলরব ওকে তিথির বাসায়ই পৌঁছে দিলো। বাসায় ঢুকেই নিহিন তিথিকে জড়িয়ে ধরল। তিথি দুষ্টুমি করে বলল,
“কি খুব হয়েছে নাকি আজ? এত্ত খুশি?”
“যাহ! বাজে কথা বলিস না। বলছি সব, বলার জন্যই তো আসা। এত সব ঘটনা ঘটেছে যে তোকে বলতে না পারলে পেট ফেটে মারা যাব।”
“সেকি! আচ্ছা তোর মুখটা লাল কেন রে? চুমুটুমু খেয়েছিস নাকি?”
“ছি ছি তোর মুখে কি কিছু আটকায় না?”
তিথি হেসে উঠল, খুব মজা পাচ্ছে ও। তারপর বলল,
“থাকবি আজকে?”
“না বাসায় বলে আসিনি। শুধু বিকেলে ফোন করে বলেছি যেতে দেরি হবে।”
“এখন বলে দে।”
“না রে কাল সকালে ক্লাস আছে, দেরি হলেও যেতে হবে।”
“আচ্ছা তাহলে তাড়াতাড়ি বল তোদের প্রেমলীলার কথা।”
“ছি ছি ভালো কথা মুখ দিয়ে বেরোয় না?
“না।”
হেসে বলল তিথি। তারপর নিহিন ওকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা বলল। সব শুনে তিথির প্রথম কথা ছিল,
“দোস্ত, ছোটবেলা থেকে তোর চোখে মুখে এত খুশি আমি এর আগে কোনোদিন দেখিনি। তুইও যে আমাদের মতো খুশির বিষয়কে এভাবে প্রকাশ করতে পারিস তা আজ জানলাম। তুই যতক্ষণ কল্পর কথা বলছিলি তোর মধ্যে আমি একজন মাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।”
একথার পর নিহিন চিন্তিত হলো। বলল,
“সবই বুঝলাম, কিন্তু আমি একটু বেশি ভেবে ফেলছি বোধহয়। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সেটা ঠিক কিন্তু আমি তার জন্য বেশি আবেগে ভেসে যাচ্ছি। আমার অতীতটাকেও ভুলে যাচ্ছি।”
“উফ, তুই ওসব নিয়ে পড়ে আছিস? আজাইরা। আর কলরব ভাইয়া তো সব জানেই। তাছাড়া সাব্বির সেদিন কী বলেছিল মনে নেই? কলরব ভাইয়া যদি আরেকটা সুযোগ পায় তাহলে যেকোনো মূল্যে কেড়ে নেবে তোকে।”
“ওটা সাব্বিরের নিজস্ব ধারণা। আর কলরব শুধু বিয়ের কথা জানে। আর কিছুই জানে না।”
১৯
“বাবা আসব?”
শওকত সাহেবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল কলরব। উনি বিছনায় শুয়ে ছিলেন। না উঠেই বললেন,
“আয়, এত রাতে? কিছু হয়েছে?”
বাবার পাশে বিছানায় বসে বলল,
“না বাবা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“নিহিন সম্পর্কিত?”
কলরব হাসল। বলল,
“হ্যাঁ”
শোয়া থেকে ওঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন শওকত সাহেব। তারপর জিজ্ঞেসে করলেন,
“কল্প ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ, এতক্ষণ ওর ঘুমানোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ “আচ্ছা, বল কী বলবি।”
“ওই একটু আলোচনা। কী করব না করব।”
“তুই যা ভালো মনে করিস কর, আমি আছি তোর পাশে।”
“তা তো আমি জানি বাবা। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত তা বুঝতে পারছি না।”
“প্রপোজ করেছিস?”
“না।”
“মানে? তাহলে কি করলি সারাদিন?”
“কথা বলেছি, তাছাড়া প্রপোজ করার কিছু নাই। ও খুব ভালোভাবে জানে আমি ওকে এখনো ভালোবাসি।”
“তোকে তো রোমান্টিক ভেবেছিলাম রে। এখন তো দেখছি তুই একটা মাকাল। বিয়ে করতে চাস, না বললে কী ও এসে বলবে ওগো আমাকে বিয়ে করো?”
কলরব হেসে বলল,
“তুমি বিয়ের প্রপোজালের কথা বলছো? সেটা তো করবই। আজই করে দিতে পারতাম কিন্তু একটু স্পেশালভাবে করতে চাচ্ছি। যেন সারাজীবন এ দিনটা ও মনে রাখে। ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই’ বা ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব’ সেটা তো সবাই বলে। আমার কি উচিত না একটু আলাদা হওয়া?”
বাবা কলরবের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
“এই না হলে আমার ছেলে।”
হাসল কলরব।
এরপর কলরবকে একটু চিন্তিত দেখাল। বলল,
“কিন্তু বাবা, কয়েকটা সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলতেই এসেছি।”
“হ্যাঁ, বলে ফেল।”
“প্রথম সমস্যা নিহিনের বাবা, আমাকে উনি কখনোই পছন্দ করতেন না। যদি উনি রাজি না হয়, নিহিন কখনো ফ্যামিলির বিরুদ্ধে গিয়ে একা একা আমাকে বিয়ে করবে না। ও ওরকম মেয়েই না।”
“মানবে ইনশাআল্লাহ, সে যদি অনুতপ্ত না হতো তাহলে এত বছর বাদে নিহিনকে সব বলে দিতো?”
“কী জানি।”
“আর আমি তো যাবই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, আমাকে নিশ্চই ফেরাবে না, যেখানে তুই এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছিস নিহিনের জন্য। আবার নিহিনও তো তোকে ভালোবাসে। দেখিস মেনে নেবে।”
“শুধু এটুকু পর্যন্ত হলে কি এত ভাবতাম বাবা? কল্প আছে তো। এক ছেলের বাপের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কেন?”
“কিন্তু কল্পর ব্যাপারে সত্যিটা বলে দিলেই তো ওরা বুঝবে।”
“সে নাহয় বুঝলো। কিন্তু বাবা যদি ওরা আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয় তাহলে তো জানবে যে কল্প আমার নিজের ছেলে।”
“সেটাতো সবাইকে সেরকম জানানো হয়েছে তাই। কারণ আমরা চাই না কল্প কখনো সত্যিটা জানুক।”
“তাও যদি বিশ্বাস না করে?”
“বেশি ভাবছিস রে বাবা। এত ভাবার দরকার নেই।”
“আরো সমস্যা আছে বাবা। কল্প ওর মায়ের ব্যাপারে কী পরিমাণ পজেসিভ তা তো জানো। আমি এখন বিয়ে করলে তো ও স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে।”
“আরে না। নিহিনের সাথে তো কল্পর খুব ভাব হয়ে গেছে। জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, আবার ওর হাতে ভাত খেল। আদরের নাম দিয়ে দিল ‘মিষ্টি’।”
“কিন্তু বাবা সেটা ও করেছে ওর মায়ের মত দেখতে বলে। আমি বিয়ে করলে একটা অন্য ব্যাপার হবে। আমি তো চিনি কল্পকে।”
“তা অবশ্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওকে বোঝাতে হবে আগেই, ওর অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।”
“আমি অবশ্য একটা প্ল্যান ভেবেছি।”
“কী প্ল্যান?”
“যেহেতু কল্প ওর মায়ের সাথে খুব মিল পেয়েছে নিহিনের। সেক্ষেত্রে ওকে বললেই হয় নিহিনই ওর মা। এক কথায় বিশ্বাস করে নেবে, তখন অবশ্য ও জিজ্ঞেস করবে তাহলে ওর মা আমাদের সাথে থাকে না কেন?”
“তখন বলবি যে ওর নানাভাই তোর ওপর রাগ করে নিয়ে গিয়েছিল।”
“হ্যাঁ, তারপর যখন জিজ্ঞেস করবে কেন রাগ করেছিল তখন কী বলব? তাছাড়া তারপর তো ও নিহিনের বাবাকে অপছন্দ করবে “তাতে তোর সমস্যা কী? ভিলেনদের ওরকম একটু হয়।”
“বাবা, তুমি যে কী বলো!”
হেসে ফেলল কলরব, সঙ্গে শওকত সাহেবও হাসল। এরপর কলরব বলল,
“একটা প্লাস পয়েন্ট কী জানো বাবা? একবার যদি কল্পকে বলি নিহিনই ওর মা, তাহলে ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে হলে যা করতে হয় কল্প মেনে নেবে। মায়ের প্রতি ওর অনেক দুর্বলতা। রাতে রাতে কাঁদে মায়ের জন্য। তুমি তো জানো না।”
“আর দিনের বেলা যে কতবার, কতভাবে মায়ের কথা মনে করে কাঁদে তাও তুমি জানো না।”
“ওটা তোমার ডিপার্টমেন্ট বাবা।”
“হ্যাঁ তাতো বলবিই।”
একটু থেমে কলরব আবার বলল,
“কিন্তু এগুলোর জন্য নিহিনের মত আছে কি না তাও জানতে হবে। পরের ছেলেকে নিজের ছেলের মতো পালতে হবে, এটা যদি ও না পারে কিংবা পারলেও যদি না চায়, তাহলে বিয়ের চিন্তাটাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো আমি।”
“কচু ভালোবেসেছিস, আর কচু চিনেছিস। তোদের ১০ টা বাচ্চা হলেও নিহিন সবচেয়ে বেশি আদর করবে কল্পকে।”
“একদিনেই বুঝলে কী করে?”
“তোর মতো মাকাল না আমি, ওকে দেখে ওর সাথে কথা বলেই বুঝেছি ও কেমন মেয়ে।”
“তবু বাবা, কল্পকে অবহেলা করলে তো আমি মানতে পারব না। জানি নিহিন ওরকম না, তারপরেও একদিন আদর করে খাইয়ে দেওয়া আর সারাজীবন ছেলের মতো পালা এক কথা না।”
“তুই এত ভাবছিস কেন?”
“কারণ বাবা দুজনের একজনও কষ্ট পেলে সহ্য করতে পারব না।”
শওকত সাহেব কলরবের পিঠে হাত রেখে বললেন,
“আমার ছেলেকে তো আমি চিনি। সব দিক সামলে নেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছে। তার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।”
“হুম কিন্তু বাবা সমস্যা আরো আছে, যা আমি তোমাকে বলতে পারব না বাবা।”
“আমাকে বলতে পারবে না এমন কোনো কথা আমার ছেলের থাকতেই পারে না।”
“না মানে…”
“আরে আমার ছেলে দেখি লজ্জা পাচ্ছে, ঘটনা কী? বল তো, আমি তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাই না?”
“আসলে বাবা, কল্প তো আমাকে ছাড়া ঘুমায় না, তো নিহিন আসলে ব্যাপারটা…”
“ও এই কথা!”
হো হো করে হেসে উঠল বাবা। কলরব বলল,
“জানতাম মজা নেবে তুমি। ধুর, এজন্যই বলতে চাইনি।”
“না না মজা নিচ্ছি না। তুই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিস। কল্প তোদের প্রাইভেসি নষ্ট করবেই, সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারেও কোনো প্ল্যান করতে হবে। এমন হতে পারে আমার কাছে থাকবে কল্প।”
“ঘোড়ার ডিম বুচ্ছো তুমি, প্রাইভেসির কথা বলিনি। বলেছি নিহিনের জন্য আমি যদি কল্পকে দূরে সরিয়ে দেই তখন ওর মনে হতে পারে যে মা না থাকতেই ভালো ছিল, ও ওর বাবাকে পুরোপুরি পেত।”
না, কল্প নিহিনকে পেয়ে তোকে ভুলে যাবে। “না বাবা, কল্প মানতে পারবে না বোধহয়।”
“তাহলে কী করতে চাচ্ছিস?”
“দেখি, আগে নিহিনকে বিয়ের প্রপোজাল তো দেই। তারপর রাজি হলে ওর সাথে ডিরেক্ট কথা বলব ব্যাপারটা নিয়ে। বিয়ের পর ঝামেলায় পড়ার থেকে আগে কথা বলে নেয়া ভালো।”
“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছিস।”
“বাবা এতকিছুর পরেও আরো একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে।”
“আবার কী?”
“জানোই তো নিহিনকে কতটা ভালোবাসি। যদি নিহিনকে পেয়ে আমি কল্পর ঠিকভাবে যত্ন নিতে না পারি?”
“পারবি, তোর ওপর বিশ্বাস আছে আমার। তাছাড়া তুই কল্পর টেক কেয়ার করার সুযোগই পাবি না। নিহিনই সব করবে দেখিস তুই, কী গোছালো মেয়ে।”
“জানি না বাবা, যেদিন নিহিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম কল্পর খুব মন খারাপ হয়েছিল, আসার সময় একটা কথাও বলেনি, অথচ নিহিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমি ওর এসব খেয়ালই করিনি।”
“এতদিন পর প্রথম দেখা করতে গিয়েছিলি তো, সেজন্য। তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাই যেন হয় বাবা।”