তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো – ১০

১০

বাসা থেকে বেড়িয়ে নিহিন একটা রিকশা নিল। ১০ মিনিটের পথ। যেন শেষই হচ্ছে না। নিহিনের হাত পা কাঁপছে, রিকশা শক্ত করে ধরে রেখেছে, তবু মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। হাতের চামড়ার নিচে অদ্ভুত একটা শিরশিরানি হচ্ছে! হাতটা কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে। যেতে পারবে তো ঠিকমতো? কথা বলতে পারবে তো? নাকি প্রেস্টিজের বারোটা বাজিয়ে আসবে!

রেস্টুরেন্টে বসতেই কল্প বলল, “আন্টিটা এখনও আসেনি না?”

“না।”

“মেয়েরা অলওয়েজ লেট করে পাপ্পা।”

“আরে আমার মেয়ে বিশারদ রে!”

“বিশারদ কী পাপ্পা?”

“বিশারদ হচ্ছে স্পেশালিষ্ট।”

“ও, বাট পাপ্পা আই এম নট আ স্পেশালিস্ট! আমাদের স্কুলে এসেম্বলি শুরু হয়ে যাওয়ার পর যারা আসে তারা সবাই মেয়ে। ছেলেরা এসেম্বলির আগেই আসে সবাই, তাই বলেছি।”

“হুম, এমনও তো হতে পারে যে মেয়েরা লেট হয়ে গেলেও আসে বাট ছেলেরা লেট হলে আর আসে না। ঘুমিয়েই থাকে। সো তাদেরকে কীভাবে আইডেন্টিফাই করবি?”

এ প্রশ্নে চিন্তায় পড়ে গেল কল্প। কলরব বলল,

“এত চিন্তা করা লাগবে না। ৫ টায় আসার কথা, এখন পৌনে ৫ টা বাজে।”

“পোনে জানি কী?”

“পোনে না পৌনে।”

“একই কথা।”

“না, ভুল বাংলা আমি পছন্দ করি না, জানিস না?”

“উফ্ তুমি বলবে পোনে মানে কী?”

“মানে ৫ টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি।”

“আমরা এত্ত আগে এসেছি কেন?”

অবাক হয়ে বলল কল্প। কলরব বলল,

“ওই যে ছেলেরা আগে আসে তাই।”

“পাপ্পা, এসির মধ্যেও তুমি ঘামছ কেন?”

থতমত খেয়ে গেল, আসলেই একটু বেশিই ঘামছে। নিজের এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথেই তো দেখা করতে এসেছে, এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে? ধুর মান-ইজ্জত সব যাবে মনে হচ্ছে। কোনোমতে বলল,

“আজ অনেক গরম পড়েছে তাই ঘামছি।”

“কিন্তু আমি তো ঘামছি না।”

“বাপ একটু চুপ কর, তোর এত প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।”

কল্প কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে গেল ওদের টেবিলের দিকে খুব সুন্দর একটা মেয়েকে আসতে দেখে। কলরব কল্পর দৃষ্টিকে অনুসরণ করতেই নিহিনকে দেখতে পেল। কলরবের মনে হচ্ছিল সে হাওয়ায় ভাসছে। এত সুন্দর একটা মানুষ হয় কী করে? ইস ওকে যদি নিজের করে নেওয়া যেত সারাজীবননের জন্য! সেগুড়ে বালি! কোনোমতে কলরব বলল,

“অবশেষে ম্যাডামের দেখা পাওয়া গেল। বসো।”

নিহি প্ৰচণ্ড নার্ভাস। বসতে বসতে বলল,

“আমি কি অনেক দেরি করে ফেলেছি?”

“না আমরাই একটু আগে এসেছি, ওদিকটায় জাম থাকে, তাই আগেই বেড়িয়েছিলাম।”

এতক্ষণ কল্প নিহিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ বলে উঠল,

“তোমাকে আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু কোথায়?”

মনে করার চেষ্টা করতে লাগল কল্প। নিহিন কল্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তাই? কোথায় দেখা হয়েছে বলতো? আমারও তো মনে পড়ছে না।” কলরব অবাক হলো আর তার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে গেল। নিহিন অনেক বড় হয়েছে আর অনেক পরিবর্তন এসেছে, তবু কল্পর চেনা চেনা লাগছে, ধরে ফেলবে না তো? তাহলে বিপদের শেষ থাকবে না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল, আর কথা এড়ানোর জন্য বলল,

“আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দেই উনি আমার ছেলে কল্প। সুন্দরী মেয়েদের আবার ওনার খুব চেনা চেনা লাগে।”

নিহিন আর কল্প দুজনেই লজ্জা পেয়ে গেল।

হাফ ছেড়ে বাঁচল কলরব। কিন্তু ব্যাপারটা কল্প ভুলে না গেলে আবার একশো টা প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে দেবে।

খেতে খেতে অনেক গল্প হলো, অপ্রয়োজনীয় সব কথা। বেশির ভাগই কল্পকে নিয়ে, আর কল্প বলছে কলরবকে নিয়ে, আর নিহিন তৃপ্ত এক শ্রোতা। যা মনে আসছে তাই, তবু যেন অনেক না বলা কথা বলা হচ্ছে, অনেক প্রশান্তি। তারপর একসময় কল্প বলল,

“পাপ্পা আমি চাইল্ড জোনে গিয়ে খেলি?” কলরব বলল,

“আচ্ছা যা, সাবধানে।”

“ওকে পাপ্পা।”

কল্প চলে যাওয়ার পর নিহিন বলল,

“ও খুব লক্ষী না?”

“কী দেখে মনে হলো?”

“এই যে পারমিশন নিয়ে গেল। তুমি যেতে বলার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল।”

“হুম এটাকে যদি লক্ষ্মী বল, তাহলে ও লক্ষ্মী। বড়দের সাথে কখনো বেয়াদবি করে না। আর আমাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। কখনো মারি না কিন্তু ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করি।

“কী সাংঘাতিক বাবা তুমি!”

“এরকম না হলে ওর মতো দুষ্টু ছেলে দিনের মধ্যে দশবার আমাকে কিনতো আর বেচতো।”

নিহিনের চোখের সামনে চুল এসে পড়ছে বারবার। আর নিহিন হাত দিয়ে সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। কলরবের ইচ্ছে করছে নিহিনের হাতটা সরিয়ে নিজেই করুক এ কাজটা, কত করেছে একসময় যা এখন অসম্ভব। ইচ্ছের কথা বলতে না পেরে বলল,

“তোমার চুলগুলো কত বড় হয়ে গেছে। তোমাকে বড় চুলেই মানায়।”

“আমি বড় হয়েছি যে, তাই।”

বলেই আবার হেসে ফেলল নিহিন। কলরব এমন ড্যাবড্যাব করে

তাকিয়ে আছে যে নিহিন তাকাতেই পারছে না। কলরব বলল,

“তোমার হাসিটা আগের মতই সুন্দর আছে।”

“তোমার চোখে।”

“কখনোই না, আচ্ছা তোমার গালে এ তিলটা কি নতুন হয়েছে?”

“কই না তো, আগেও তো ছিল।”

“নাহ আমার স্পষ্ট মনে আছে তোমার গালে কোনো তিল ছিল না।”

“ও হ্যাঁ, হয়তো তখন ছিল না। তবে অনেকদিন আগেই এটা হয়েছে, ঠিক জানি না।”

“হুম, তুমি হাসলে তোমার গালে যে বাঁকা একটা ভাঁজ পড়ে সেটা আগেও বলেছি জানি না তোমার মনে আছে কি না, তিলটা ঠিক সেই ভাঁজের ওপরেই, অসাধারণ!”

নিহিন লজ্জা পেয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না, শুধু মিটিমিটি হাসল। কলরব বলল,

“তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, এই এত লজ্জা পাওয়াটা তার আরেকটা উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ইউক একটা বাচ্চা ছিলে। তখনও লজ্জা পেতে কিন্তু এত না।”

এবার একটু জোরেই হাসল নিহিন। বলল,

“হুম, আমি তো বড় হয়েছি, আর তোমার তো আমুল পরিবর্তন। যাকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছাড়া জীবনে দেখিনি, তাকে আজ ক্লিন শেভে দেখছি, অপরিচিত লাগছে।”

“সবই তোমার বাবার কৃপা।”

“আমার বাবা!”

অবাক হলো নিহিন, কলরব ওর দুষ্টু হাসিটা বজায় রেখেই বলল,

“অবশ্যই, আমি চেয়েছিলাম গায়ক হতে, পড়াশুনায় মন ছিল না কখনো। আর তোমার বাবা চেয়েছিল কর্পোরেট জামাই। তোমার বাবার ইচ্ছে রাখতে গিয়ে তার মেয়েকে পাবার লোভে সেই যে গান ছেড়ে পড়াশুনায় মন দিলাম, তখন থেকেই ক্যারিয়ারের প্রতি খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ব্যাংকে চাকরির একটা অফার পেলাম, ব্যস চোখ বন্ধ করে ঢুকে গেলাম, এমবিএর পর প্রোমোশন হলো। মনে হলো তোমার বাবার দৃষ্টিকোণ থেকে এবার বোধহয় যোগ্য হতে পেরেছি। তারপর তোমার বাবার সাথে দেখা করতে গেলাম, আমার কি কপাল দেখ, ততদিনে তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল!”

নিহিন অন্য দিকে তাকাল। কলরব বুঝল না ওর মন খারাপ হলো নাকি অপরাধবোধ? তবে এটা শিওর হলো বিয়ের ঘটনা সত্যি। বলল,

“আমি জানি তোমাকে যদি জানানো হতো সব কথা, তাহলে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে।”

“কিন্তু আমি অপেক্ষা করিনি।”

“আমি কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলাম তাই।”

নিহিন অন্যদিকে তাকিয়ে চুপ করেই রইল। কলরব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যই বলল,

“যাই হোক তোমার বাবার কৃপায় এ কর্পোরেট দুনিয়ায় আসা। ভালোই টাকা-পয়সা দিত ওরা, জানোতো পকেটে যথেষ্ট টাকা-পয়সা থাকলে নিজেকে রাজা রাজা মনে হয়। তোমাকে না পেয়ে দেবদাস অবশ্য হওয়া যেত কিন্তু অত সাহস নেই। তাই আর অন্যদিকে না গিয়ে এ ব্যাংকেই খাটতে লাগলাম। যার ফলশ্রুতিতে আবার প্রোমোশন হয়েছে, পকেট আরো ভারী হয়েছে, আরো শান্তি বেড়েছে তাই এখানেই লেগে আছি আজও। তাই ডেইলি শেভ করতে হয়, তবে আমার এই দাড়ি বিসর্জনের কারণে গাল ফুলানোর মত এখন আর কেউ নেই।”

নিহিনের মনে পড়ল, অনেকদিন পরও যদি কলরব শেভ করত তাহলেও নিহিন রাগ করত, তারপর গান শুনিয়ে রাগ ভাঙাতে হতো। সেজন্যই এ কথা বলল কলরব। তখন ব্যাপারগুলো অনেক স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে নিহিনের, ধুর এসব কথা কেন যে তুলতে গেল। নিহিনকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে এবার কলরব সিরিয়াস হলো,

“তবে আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে আমার জীবনের সব সাফল্যের দাবিদার তোমার বাবা। আমি মন থেকে ওনাকে শ্রদ্ধা করি। উনি সেদিন ওভাবে না বললে কখনো এতটা সিরিয়াস হতাম না ক্যারিয়ারের প্রতি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম, তারা কখনোই শাসন করেনি। যা মন চাইতো তাই করতাম, ওরকম থাকলে হয়তো আজও স্টুডেন্টই থেকে যেতাম কিংবা ভবঘুরে!”

এসব কথা শুনতে শুনতেই নিহিন হঠাৎ বলে উঠল,

“বিয়ে করোনি কেন এখনো?”

হেসে ফেলল কলরব। বলল,

“স্পাই টা কে বলো তো? খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার আমার মধ্যে মিউচুয়াল এমন কে আছে গোপন কথা পাচার করার মত! আর যদি থাকেই তবে আগে কোথায় ছিল?”

“স্পাইটা হলো সাব্বির।”

চমকে উঠল কলরব,

“সাব্বির মানে… সাব্বির রাহমান? ফিউচার ব্যাংকের?”

“হুম।”

“ওকে তুমি কীভাবে চেনো?”

“আমার খুব কাছের বন্ধু।

“বলো কী! ওর সাথে কালকেও একসাথে লাঞ্চ করেছি। কিছু বলল না আমাকে।”

“আমি নিষেধ করেছিলাম বলতে।”

“ওকে ধরতে হবে, ভাই আগে না বন্ধু আগে? আচ্ছা ভালো কথা, ও আবার আমার গোপন সব কথা ফাঁস করে দেয়নি তো?”

“করতেও পারে!”

মিটিমিটি হাসছে নিহিন। ও হাসলেই তিলটাতে চোখ আটকে যাচ্ছে, এই মেয়ে মনে হচ্ছে ব্রহ্মচারিত্ব ঘুচিয়ে দেবে এবার। কলরব মনোযোগ অন্য দিকে নেয়ার চেষ্টা করল। বলল,

“আমার বিয়ের কথা কল্পর সামনে ভুলেও বলতে যেও না। তাহলে তোমাকে দেখতেই পারবে না আর।”

“কেন?”

“আত্মীয়স্বজনরা আর বাবা যখন আমাকে বিয়ে করতে বলে তখন ও খুব রেগে যায়।”

“রেগে যায় কেন?”

“ওর মনের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ওর বাবা বিয়ে করলে এখনকার মত আর ভালোবাসবে না। নতুন মাকে ভালোবাসবে।”

“এগুলো তুমি ঢুকিয়েছো ওর মাথায় না?”

কলরব হেসে বলল,

“ছি ছি, আমি কেন ঢুকাব? আমি শুধু বলেছি আমি বিয়ে করলে ওর মা কষ্ট পাবে। ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ওর মা।”

চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল নিহিনের। বলল,

“তুমি সত্যি বড় বেশি সাংঘাতিক হয়ে গেছ। ছি, এইটুকুন বাচ্চার দুর্বলতার সুযোগ কেউ নেয়?”

আবার হাসল কলরব। বলল,

“তুমি বুঝবে না। যাই হোক, আমার কথা বাদ দাও, তোমার কথা বলো। বিয়ে তো হয়েছিল তাহলে সিংগেল কেন?”

“সংসার ভেঙে গিয়েছিল।”

“কীভাবে?”

“আমি বলতে পারব, তুমি সহ্য করতে পারবে না তার চেয়ে থাক, বাদ দাও এসব কথা।”

১১

বাসায় ফিরেই নিহিন দেখল মোহনা এসে বসে আছে। নিহিনকে দেখামাত্রই বলল,

“তোর সমস্যাটা কী বলতো?”

“কেন কী হয়েছে?”

“সেদিন ছেলেটার ছবি পাঠালাম, কিছুই জানালি না। ভালো বা খারাপ কিছু তো একটা জানায় মানুষ। এমনকি আমার একটা মেসেজের রিপ্লাই পর্যন্ত দিসনি। এতবার ফোন করলাম তাও ধরিসনি।”

“আপু প্লিজ, এরকম করো না। আমি সেদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম। আর আমার এসব ছেলে-ফেলে দেখতে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”

বলে নিহিন নিজের ঘরে ঢুকে গেল। মোহনা পিছনে পিছনে গেল।

“তা থাকবে কেন? যাই হোক, না থাকলে নাই, নিজের পছন্দ থাকলে সেটা অন্তত বল। বাবাকে এ বয়সেই আর কত টেনশন দিবি?”

“আমি কোথায় টেনশন দিচ্ছি?”

“মেয়েকে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত বাবার টেনশন যায়?”

“আরে ভাই বিয়ে করব না তাতো একবারও বলিনি। ইচ্ছে করলেই তো বিয়ে করে ফেলা যায় না। কাউকে পছন্দ না হলে কাকে বিয়ে করব? এখন তো আর সে বয়স নেই যে তোমরা একজনকে ধরে নিয়ে আসবে চোখ বুজে তাকে গ্রহণ করব।”

এ কথায় মিইয়ে গেল মোহনা, তবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। নিহিন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপু প্লিজ এ ব্যাপারটা নিয়ে আর একটা কথাও বলতে চাচ্ছি না।” আমার অনেক কাজ আছে। তুমি এখন যাও প্লিজ, দুলাভাই বসে আছে তোমার জন্য। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। পরে তোমাদের বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।”

আপু রাগ করে চলে গেল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়েই শুয়ে পড়ল নিহিন। ফ্রেশও হলো না। আজ কলরবের সাথে দেখা হয়েছে, এরচেয়ে বেশি

রিফ্রেশমেন্ট আর কী হতে পারে! কলরবের কথাগুলো বারবার মনে করে করে শুনছে, দেখা হওয়া থেকে শুরু করে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়া পর্যন্ত রিভাইস করছে ও, একবার নয় বারবার। আগের মতই কলরবই বেশি কথা বলেছে আর ও শুনেছে। এর মধ্যেও যে কি অনাবিল আনন্দ তা নিহিন কাউকে বোঝাতে পারবে না। খুব ভালো লাগছে, খুব। সময়টাকে আটকে দিতে ইচ্ছে করছে, এত ভালো সময় যদি আর কোনোদিন না আসে!

নিহিনকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যখন কলরব বাসায় ফিরছিল মনে হচ্ছিল অনেক কিছু পেল ও। এ পাঁচ ছয় ঘণ্টা নিহিন বসে ছিল ওর সামনে, আর ও মুগ্ধ চোখে দেখছিল। কত রাত নিহিন জানালার পাশে কাটিয়েছে কলরবের সামনে বসে, হাত ধরে কাটিয়েছে।

তখনও মুগ্ধ চোখে দেখত ও। কিন্তু সে পাওয়ার চেয়ে এ পাওয়া কেন বেশি বলে মনে হচ্ছে? বারবার কলরবের চোখের সামনে ভেসে উঠছে নিহিনের সে হাসিটা, সে তিলটা আর চোখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দেওয়াটা।

বাসায় ফিরতে রাত হওয়ায় এসেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে কল্প। তারও অনেক পরে কলরব শুতে এলো। বিছানায় শোয়ামাত্র কল্প পাশ ফিরে বলল,

“পাপ্পা…”

“ওরে দুষ্টুটা, এখনো ঘুমাসনি?”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“অবশ্যই বাবা।”

“আন্টিটার সাথে কি আমার ছোটবেলায় দেখা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ, এখনই তো তোর ছোটবেলা।”

হেসে বলল কলরব। কল্প খুব সিরিয়াস গলায় বলল,

“উফ আমি বলছি আগের ছোটবেলায়ও কি দেখা হয়েছিল?”

“না।”

“তাহলে এত চিনি কেন?”

“চিনি কেন না, চেনা চেনা লাগছে কেন হবে।”

“উফ বলো না পাপ্পা।”

কল্প আরো সিরিয়াস। কলরব বলল,

“জানি না বাবা, হয়তো তোদের স্কুলে ওর মতো কোনো মিস্ ছিল “উঁহু, অনেকটা মায়ের মতো দেখতে।”

কলরবের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই হলো।

“দূর পাগল তোর মায়ের মতো লাগবে কোত্থেকে? সবসময় মাকে মিস করিস তো তাই এরকম মনে হচ্ছে।”

হঠাৎ কলরবকে অবাক করে দিয়ে কল্প ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতেই বলছিল,

“আমার খুব মার কাছে যেতে ইচ্ছে করে পাপ্পা, মায়ের বুকে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। সবার মা আছে, শুধু আমার নেই।”

কলরব কল্পকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,

“কাঁদে না বাবা, তুই না আমার লক্ষ্মী ছেলে। তুই না সব বুঝিস? কাঁদে না, কাঁদলে মা কষ্ট পাবে তো।”

কল্পর কান্না আরো বাড়ল। কলরব কল্পকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইল। হঠাৎ খেয়াল হলো ফেরার পথে পুরো রাস্তা চুপ ছিল কল্প। নিহিনের কথা চিন্তা করতে করতে ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি কলরব। দূর, এই প্রথম ছেলেটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল, খেয়ালই করেনি কল্প কী করছিল, কী ভাবছিল। এমনটা কেন হলো? ও কি তাহলে ভুল করতে যাচ্ছে? সামনে আগানোর আগে ব্যাপারটা নিয়ে আরো ভালো করে ভাবতে হবে।

১২

শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল নিহিন। ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রিনের দিকে চাইতেই দেখলো কলরব ফোন করেছে। হাসি ফুটে উঠল মুখে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কল্পর গলা পাওয়া গেল,

“হ্যালো, মিষ্টি আন্টি আমি তোমার একটা সিক্রেট জেনে ফেলেছি।”

হঠাৎ করে কল্প ওকে মিষ্টি আন্টি কেন বলছে বুঝতে পারল না। বলল, “তাই? কী সিক্রেট জানতে পেরেছ?”

“পাপ্পা বলছে তুমি মজা করে রান্না করো। আমি তোমার কাছে রান্না খেতে চাই। জানো, আমাদের বাসায় কেউ মজা করে রান্না পারে না। কিন্তু আমার মজা রান্না খেতে খুব ভালো লাগে।”

নিহিন হেসে বলল,

“ঠিক আছে তুমি কী রান্না খেতে চাও বলো?”

“যা তুমি চাও।”

কল্পর এরকম অসংলগ্ন কথা শুনলেই নিহিনের মুখটা খুশির আলোয় ভরে যায়। নিহিন বলল,

“আচ্ছা, কবে খেতে চাও বলো?”

“পাপ্পাকে জিজ্ঞেস করো, টা টা মিষ্টি আন্টি।”

“ওকে টা টা।”

এরপর কলরবের গলা পাওয়া গেল,

“নিহিন, আমি আসলে কল্প আর বাবার সাথে খেতে বসে গল্প করতে করতে বলে ফেলেছি যে তুমি ভালো রাঁধতে পারো, সরি তোমাকে ভেজালে ফেলে দিলাম।”

“আরে ধুর, ভেজালের কী আছে। কিন্তু আমার রান্না কবে খেলে তুমি?”

“তুমি আমাকে চিকেন ফ্রাই, চিংড়ি মাছ, নুডলস, ইলিশ পোলাও আর আমের আচার খাইয়েছিলে। এবং সবগুলোই তোমার হাতের রান্না ছিল। সব ভুলে গেছ? ১০ বছর কি খুব বেশি সময়?”

“তুমি সেই ছোটবেলার কথা বলছো? আমি তো তখন কেবল শিখছিলাম, অত ভালো রাঁধতে পারতাম না।”

“আমার কাছে ওগুলো অমৃত ছিল ম্যাডাম। লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে আসতেন ছাদে, আর আমি ছাদের রেলিং টপকে যেতাম খেতে। আহ মনে হতো….”

“কী মনে হতো? বলেন…..”

“না থাক। বললে আবার আপনি লজ্জা পেয়ে যাবেন।

নিহিন সত্যিই লজ্জা পেয়ে গেল। কথা ঘুরিয়ে বলল,

“যাই হোক, কী খাবে বলো? আর কবে খাবে?”

“তুমি যেদিন খাওয়াবে।”

“তাহলে সামনের শুক্রবার।”

“ঠিক আছে, তবে আমার একটা আর্জি ছিল।”

“কী বলো।”

“রান্নাটা আমার বাসায় এসে করলে খুব ভালো হয়, নাহলে আমার বাবা বঞ্চিত হবে, এই আর কী! তোমাকে আমার বাসায় দাওয়াতের কথাই বলতে পারতাম কিন্তু তোমাকেই রান্না করতে হবে এসে, আমরাই বরং অতিথি হয়ে যাব। যত যাই হোক আমাদের বাসাটা তিন বাপ ব্যাটার একটা ব্যাচেলর বাসা।”

হাসল নিহিন। বলল,

“ঠিক আছে, আসব।”

“আমি বাজার করে রাখব। যা যা খেতে ইচ্ছে করবে তাই তাই আনব কিন্তু, অনেক কিছু রান্না করতে হবে।”

“আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা আর সকালে আসতে হবে, আমিই তোমাকে নিয়ে আসব গিয়ে।”

“কেন আমি বুঝি একা যেতে পারি না?”

“আমার দায়িত্বজ্ঞান এখনো আগের মতই আছে ম্যাডাম। সাথে আলগা অধিকার ফলানো স্বভাবটাও।”

হাসতে হাসতে কথাটা বলল কলরব। নিহিনও হেসে বলল,

“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

“তাছাড়া…”

কথাটা শেষ করল না কলরব, থেমে গেল। নিহিন বলল, “তাছাড়া কী?”

“আমি নিয়ে আসতে গেলে আসার পথের সময়টা বাড়তি পাশে পাব তোমাকে এ লোভটাও সামলাতে পারছি না তো।”

নিহিন লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেল, কী বলবে? আর কলরবের প্রচণ্ড ভালো লাগল কথাটা বলে। যত যাই হোক সে পুরুষ মানুষ। আর নিহিন যে ধরনের মেয়ে, তাতে কলরব নিজে না আগালে কিছু আগাবেনা। নিহিন এখনও চুপ করে আছে দেখে কলরব প্রসঙ্গ পালটে বলল,

“ভালো কথা, কল্প তোমাকে একটা বিশেষ নামে ডেকেছে আজ। খেয়াল করেছ?”

“ও হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করব করব ভেবে আবার ভুলে গেছি। ও হঠাৎ আমাকে মিষ্টি আন্টি বলল কেন?”

“দুটো কারণে। প্রথমত তুমি খুব মিষ্টি দেখতে। আর দ্বিতীয়ত, তুমি ওকে গাল ধরে আদর না করে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছ তাই।”

“ও।”

“আসলে ও গাল ধরাটা খুব অপছন্দ করে। অথচ ওকে দেখলেই সবাই গাল ধরে আদর করে। বিশেষ করে মেয়েরা আই মিন ওর আন্টি আর আপুরা। ও ছোট মানুষ তাই সবাই গাল ধরে আদর করে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? কিন্তু সে নিজেকে ছোট মানুষ মানতেই রাজি না। দেখেছ না সবসময় কী পার্ট নিয়ে থাকে?”

“ঠিকই আছে, গাল ধরবে কেন? বাচ্চাদের গাল ধরে আদর করাটা একদম পছন্দ না আমার।”

“হুম, সে জন্যই তোমাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। আর এর আগে ওকে কেউ এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেনি, তাই যখন তুমি এটা করেছ, হি ওয়াজ ফিলিং সামথিং ডিফ্রেন্ট। সেজন্য সরাসরি মিষ্টি আন্টি। যেখানে আন্টি গোষ্ঠীদের সে খুব একটা পছন্দ করে না।”

“তাহলে তো বলতে হচ্ছে আমি ভাগ্যবতী।”

“উহুঁ সে ভাগ্যবান যে এতদিনে তার মাথায় কোনো নরম হাতের স্পর্শ পড়েছে।”

১৩

আজও শাড়ি পরতে গিয়েও পরল না। তিথি বলেছিল আজ শাড়ি পরতে, যেহেতু কলরব খুব পছন্দ করে। কিন্তু নিহিন পারল না। কলরবের বাবার সাথে আজই প্রথম দেখা। শাড়ি পরে গেলে কেমন হয়ে যায় না ব্যাপারটা! আজও ভালো করে সাজল নিহিন। কল্পর জন্য অনেকগুলো চকোলেট কিনেছিল, সেগুলো ব্যাগে ভরে নিল। কলরবের সকাল ৮ টায় আসার কথা। রেডি হয়ে আচরানো চুল আবার আচরাচ্ছে নিহিন। এত যত্ন করে এর আগে কখনো কারো জন্য সাজেনি। আয়নার দিকে তাকিয়ে এসব আবোল-তাবোল ভাবছিল, তখনই ফোনটা এলো,

“নিহিন, আমি চলে এসেছি। তোমার কতদূর?”

“আমি রেডি হয়ে বসে আছি।”

“দেরি করে ফেললাম নাকি?”

“আরে না, কোথায় আছ বলো?”

“তোমাদের গলির মাথায়ই আছি, এলেই পেয়ে যাবে।”

“ওকে ওয়েট। জাস্ট ৫ মিনিটে আসছি।”

নিহিনকে দেখেই কলরব বলল,

“তুমি কি সত্যিই দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছ নাকি আমার চোখে সমস্যা?”

“তোমার চোখে সমস্যা।”

লজ্জা পেয়ে বলল নিহিন। কলরব বলল,

“তোমাকে লজ্জা পেলে আরও সুন্দর লাগে, সেটা জানো?”

“ধুর চলোতো, দেরি হয়ে যাচ্ছে এবার।”

কলরব বেল বাজালো, পিছনে নিহিন। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুললেন শওকত সাহেব। কলরবের পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা না করেই নিহিন সালাম দিল। শওকত সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

“এসো মা এসো।”

“কেমন আছেন আংকেল?”

“আছি মা, আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। তুমি ভালো আছ তো?”

“জি।”

ড্রইং রুমে বসলো ওরা। কলরব বলল,

“কল্প উঠেছে বাবা?”

“না, ঘুমাচ্ছে এখনো।”

“তোমরা গল্প করো, আমি ওকে উঠাচ্ছি।”

কল্পকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দাঁত ব্রাশ করিয়ে নিয়ে এলো কলরব। এসে দেখল বাবা কিছু একটা বলছে আর নিহিন মিটমিট করে হাসছে। কল্প এসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিহিনের দিকে। নিহিন কল্পকে কাছে টেনে বসালো। কল্পর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কেমন আছ কল্প?”

“ভালো আছি। মিষ্টি আন্টি জানো, তুমি আসবে বলে আমি আজ তাত্তারি ঘুম থেকে উঠেছি। দাদাভাই বলেছে আজকে আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করব।”

নিহিন হেসে কল্পকে আদর করে দিলো। শওকত সাহেব বললেন,

“মা, আমার দাদাভাই কিন্তু ওর বাবার মতো এত দুষ্টু হয়নি।

কলরব অবাক হওয়ার ভান করে প্রতিবাদ করল,

“মানে কী? আমি দুষ্টু! কী করেছি আমি?”

নিহিন হেসে বলল,

“এসব বলে আড়াল করতে পারবে না। আমি ইতোমধ্যে তোমার দুষ্টুমির কাহিনি একটা শুনে ফেলেছি।”

কলরব বলল,

“বাবা এটা ঠিক হচ্ছে না, এমনটা তো কথা ছিল না।

এমন সময় কল্প বলে উঠল,

“কোনটা দাদাভাই, অই যে পাপ্পা টিচারকে বলেছিল দাদুর মা অসুস্থ ওটা বলেছ?”

শওকত সাহেব বললেন,

“ওহো, ওটা তো ভুলেই গেছি।”

এরপর নিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“শোনো মা কী হয়েছে। ও বাসার বাইরে গলিতে খেলছিল। তো এমন সময় ওর টিচার এসেছে। সে এমন ফাঁকিবাজ, বলে কি না ওর নানু অসুস্থ, তাই ওর মা নানু বাড়িতে গেছে, বাসায় তালা তাই বাসায় ঢুকতে পারছে না বলে রাস্তায় খেলছে। তখন ওর টিচার জিজ্ঞেস করল ‘তুমি যাওনি?’ ও বলে ‘না আমি তো স্কুলে ছিলাম তাই মা আমাকে নিয়ে যেতে পারেনি। দেখছেন না আমি বন্ধুর জামাকাপড় পরে আছি।’ ওর মা কিন্তু বাসায়ই ছিল, পড়বে না বলে টিচারকে রাস্তা থেকেই এসব কথা বলে ভাগিয়েছে।”

নিহিন হাসতে হাসতে বলল,

“ওকে এত দুষ্টু বলে মনে হয়নি কিন্তু আগে।”

“আন্টি আমি কিন্তু টিচার আসলে প্রতিদিন পড়ি। মন না চাইলেও পড়ি। তাহলে বলো আমি পাপ্পার মতো এত দুষ্টু?”

কল্প উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করল নিহিনকে। নিহিন বলল,

“একদম না। তুমি তো লক্ষ্মী ছেলে।”

কল্প দাঁত বের করে হাসল। কলরব বলল,

“অনেক হয়েছে, এবার খেতে চলো। নাহলে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসাথে করতে হবে।”

কল্প বলল,

“না প্লিজ, দাদাভাই পাপ্পার আম চুরির গল্পটাও বলো না।”

কলরব বলল,

“আচ্ছা খেতে খেতে বোলো, খেতে চলো আগে।”

এরপর সবাই খেতে গেল, খেতে খেতে আরও অনেক গল্প হলো।

কলরবের ইচ্ছার রান্না হবে ইলিশ পোলাও, কল্পর ইচ্ছায় চিকেন ফ্রাই আর চিংড়ি মাছ ভুনা। যখন শওকত সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলো কী খাবেন উনি

“এতকিছু রান্না হচ্ছে, আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই মা, আমি এসবই খাবো।”

কলরব বলল,

“বাবা স্পেশাল কিছু খেতে চাইলে বলে দাও, ওর রান্নার হাত কিন্তু খুব ভালো। আর ও খুব নিরীহ, যা বলবে নির্বিকারে রাঁধবে। তাই এ সুযোগ হাতছাড়া করলে ভুল করবে। নিহিন বলল,

“আমি মোটেও নিরীহ না। আমার রান্না করতে ভালো লাগে। আংকেল আপনি বলুন তো কী খাবেন।”

শওকত সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,

“তুমি মা ভর্তা করতে পারো?”

“হ্যাঁ পারি। কী ভর্তা খাবেন বলুন?”

“তোমার যা সুবিধা হয়। বাসায় যা আছে তার মধ্যে যা হয় আর কি।”

“ঠিক আছে।”

নিহিন রান্নাঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে কলরব গেল। তার পিছনে পিছনে কল্প যাচ্ছিল। হঠাৎ করে কল্পকে খপ করে ধরে ফেললেন শওকত সাহেব।

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছ দাদাভাই?”

“কেন কিচেনে।”

“কিচেনে গিয়ে তুমি কী করবে?”

“পাপ্পা যে গেল।”

“তোমার আন্টিতো আমাদের বাসায় নতুন, কোনো কিছু খুঁজে পাবে না, তাই পাপ্পা সবকিছু দেখিয়ে দিতে গেছে। তুমি গিয়ে কী করবে?”

“ও। কিন্তু আমি গেলে কী হবে? একটু মিষ্টি আন্টিকে দেখতাম।”

“তুমি রান্নাঘরে গেলে কালো হয়ে যাবে। আর হাত পায়ে তেল পড়লে পুড়ে যাবে। তখন ব্যাথা পাবে। তার চেয়ে আন্টি রান্না শেষ করে যখন ঘরে আসবে তখন দেখো। এখন আমরা ডোরেমন দেখি, চলো।”

কল্পর চোখ মুখ চিকচিক করে উঠল।

“সত্যি দাদাভাই? ডোরেমন দেখতে পারব? পাপ্পা বকবে নাতো? ডোরেমন হিন্দি কথা বলে তাই পাপ্পা সমসময় ডোরেমন দেখলে বকে, মনে নেই?”

“পাপ্পা জানলে তো বকবে। আমরা তো জানতেই দেবো না। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব।”

“লুকিয়ে দেখতে পারব কীভাবে? পাপ্পা যদি দেখে ফেলে।”

“যতক্ষণ তোমার আন্টি রান্না করবে ততক্ষণ তো তোমার পাপ্পা আসতে পারবে না। আন্টিকে বলে দিতে হবে না কোথায় কী আছে?”

“কিন্তু দাদাভাই, ডোরেমন দেখলেই তো আমি হিন্দি বলে ফেলি। তখন তো ধরা খেয়ে যাবো। যদি পাপ্পা মারে?”

“আজ তো আন্টি আছে, আন্টির সামনে মারতে পারবে?”

“ইয়ে, কত্তদিন আমি ডোরেমন দেখি না, কী মজা কী মজা আজকে ডোরেমন দেখব।”

১৪

নিহিন পোলাও বসিয়ে দিয়েছে এক চুলায়। অন্য চুলায় ইলিশ মাছটা তৈরি করছে পোলাওতে দেয়ার জন্য। আর কলরব ক্যাবিনেটের ওপর বসে আছে পা ঝুলিয়ে। নিহিন বলল,

“তুমি শুধু শুধু আছ এখানে, যাও তো। এই গরমের মধ্যে তোমাকে থাকতে হবে না।”

“শীতের দিনে গরম কীসের?”

“ইশ, শীত কি এখনো এসেছে নাকি? দুনিয়ার গরম। এই দেখো ঘামছ।”

“এই গরমটা তো তোমারও লাগছে, তুমিও ঘামছ।”

“আরে বাবা, রান্নাটা তো আমিই করছি, তুমি না।”

“আজ তুমি রেঁধে দিচ্ছ? এরপর তো খেতে ইচ্ছে করলে নিজেকেই রাঁধতে হবে। আমাদের বুয়ার রান্না জঘন্য আর বউ-টউও নাই, তাই শিখছি।”

“আমি রেসিপি লিখে দেবো।”

“১০ বছর দেখিনি তোমাকে। আজ একটু দেখছি, দেখতে দাওনা। এমন করছো কেন?”

একথা বলেই কলরব খেয়াল করল নিহিনের গায়ে রোদ পড়ছে, নেমে দাঁড়াল নিহিনের পাশে। এমনভাবে দাঁড়াল যাতে আর রোদ না লাগে। লজ্জা পেয়ে নিজের অজান্তেই একটু সরে গেল নিহিন। কারণ, নিহিন বুঝতেই পারল না কেন কলরব নেমে দাঁড়াল। ভাগ্যিস কাজ করছে নাহলে মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়তে হতো। এবার কথা পালটালো,

“কী ভর্তা করব বলো তো?”

“তোমার যা মন চায়। আমরা বুভুক্ষ ব্যাচেলর পার্টি। যা রাঁধবে তাই খাবো।”

নিহিন হাসল। কলরব বলল,

“তোমার হাসিটা মারাত্মক। এত হেসো না প্লিজ।”

“ধুর তোমার যত আজেবাজে কথা।”

নিহিন এবার পোলাওয়ের মধ্যে ইলিশ মাছটা দেবে। পোলাওয়ের ঢাকনাটা সরাতে যাবে এমন সময় কলরব নিহিনের হাতটা ধরে ফেলল।

“পাগল হলে নাকি? খালি হাতে গরম ঢাকনা ধরছো?”

“ওহ, তাই তো! খেয়ালই করিনি।”

“কলরব ন্যাপকিন এগিয়ে দিলো আর হাতটাও ছেড়ে দিলো। একসময় কত ধরেছে এ হাত, কিন্তু এখন একজন দূরের মানুষের মতই দূরে থাকতে হচ্ছে, হয়তো হবেও।”

পোলাওটা হয়ে গেছে, নামিয়ে কল্পর চিংড়ি মাছ ভুনা করে ফেলল। টমেটো ভর্তা, বেগুন ভর্তা আর কালিজিরা ভর্তা রেডি করে ফেলল নিহিন। তারপর এক চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে আর এক চুলায় চিকেন ফ্রাইটা ভাজতে শুরু করল। কলরব জিজ্ঞেস করল,

“নিহিন, তোমার মনে আছে যেদিন তুমি আমাকে প্রথম তোমার হাতের ইলিশ পোলাও খাইয়েছিলে সেদিন কী হয়েছিল?”

নিহিনের মনে পড়ল….

সেদিন রাত প্রায় ১ টার দিকে কলরবকে জানালা দিয়ে নিহিন বলেছিল,

“তোমার জন্য আজকে একটা স্পেশাল জিনিস আছে।”

“কী? দাও।”

“আছে, একাটা জিনিস, খুব স্পেশাল। এখান দিয়ে দেওয়া যাবে না। খেতে হলে ছাদে আসতে হবে।”

“খাওয়ার জিনিস? কিন্তু এর আগে তো যা খাইয়েছো সব জানালা দিয়েই দিয়েছ। এমন কী জিনিস যে ছাদে গিয়েই খেতে হবে!”

“আছে, বললাম না খুব স্পেশাল!”

“চুমু খাওয়াবে? সিরিয়াসলি? যাক এত দিনে পারমিশন পাওয়া গেল।” অবাক হয়ে বলল কলরব। নিহিন তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। বলেছিল, “ছি ছি তুমি এমন কথা বলতে পারলে? আমি তো ইলিশ পোলাওয়ের কথা বলছিলাম। স্পেশাল বলেছি কারণ আমি এটা আজকেই শিখেছি, আর আজকেই প্রথম করলাম।”

“ওহ.. সরি সরি। আমি দুষ্টুমি করছিলাম বাবা, কান্নার কী আছে? আমি তো আগেই বলেছি, তুমি বড় হওয়ার আগে এসব কথা মুখেও আনবো না। আজকে একটু দুষ্টুমি করতে গিয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে, রিয়েলি সরি। এই দ্যাখো কান ধরেছি।”

নিহিনের অভিমান আরো বেড়েছিল। বলেছিল,

“তুমি ইলিশ মাছ পছন্দ করো বলে আমি এটা রান্না করা শিখেছি। আর তুমি পাত্তাই দিলে না?”

“কে বলেছে পাত্তা দেইনি, খুব দিয়েছি। তুমি দ্যাখো, আমি জাস্ট ২ মিনিটে তোমাদের ছাদে আসছি।”

তারপর কলরব নিহিনদের বাসার ছাদে এসেছিল। নিহিন বক্সটা খুলতেই কলরব বলেছিল,

“চামচ কই?”

“আনিনি, আমি খাইয়ে দেবো।”

কলরব হেসে বলেছিল,

“কী সৌভাগ্য।”

নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিল নিহিন। নিহিন কলরবের প্রশ্নের উত্তর দিলো।

“মনে থাকবে না কেন? আমি তোমাকে খাইয়ে দিয়েছিলাম।”

“সেটা তো ঠিক আছে, কিন্তু এটা বলতে এত লজ্জার কী আছে, তোমার দেখছি লজ্জা বাতিক খুব বেড়েছে।”

“মোটেও না। আমি লজ্জা পাচ্ছি না।”

“তাহলে তাকাও আমার দিকে।”

নিহিন তাকাল। কিন্তু কলরব যে কী দুষ্টু হাসি ঠোঁটে নিয়ে তাকিয়ে আছে, সে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা নিহিনের কর্ম নয়। চোখ ফিরিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো। চিকেন ফ্রাই হয়ে গেছে। চিকেনগুলো তেল থেকে উঠিয়ে নিতে নিতে বলল,

“তোমার দিকে তাকাতে গেলে আমার চিকেন ফ্রাই কয়লা হয়ে যাবে। খুব জ্বালাচ্ছ, যাও তো এখান থেকে।”

“জ্বালানোর তো কিছু দেখোইনি। ভাগ্যিস আমার বউ হওনি, হলে বুঝতে জ্বালা কাকে বলে।”

নিহিন মনে মনে বলল, ইশ যদি সৌভাগ্য হতো সে জ্বালায় জ্বলার! এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রাই প্যানটা নামাতে যাচ্ছিল নিহিন। আবার নিহিনের হাতটা ধরে ফেলল কলরব,

“আমার জ্বালায় জ্বলতে পারোনি বলেই কি গরম ফ্রাই প্যান ধরে হাত পুড়িয়ে জ্বলতে চাচ্ছ?”

এবার আতকে উঠল নিহিন। এই ফ্রাই প্যানাটা ধরলে খবর ছিল। কলরব আবার বলল,

“এভাবে রান্না-বান্না করো? এত বেখায়ালি! আমি না থাকলে তো দুবার হাত পুড়ত আজ।”

“একদম না। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়েই তো অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি না থাকলে আরো তাড়াতাড়ি এবং নির্ঝঞ্ঝাটভাবে রান্না শেষ হতো আমার।”

বলেই হাসল নিহিন। তারপর খেয়াল হলো বেহায়ার মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। চোখ সরিয়ে নিল নিহিন।

রান্না শেষ করে ড্রইং রুমে আসতেই কলরব দেখল কল্প দাদার সাথে খেলছে। শওকত সাহেব ওদের দেখেই বললেন,

“মা ফ্যানের নিচে বসো। ইশ কত কষ্ট হলো।”

“কষ্টের কিছু নেই আংকেল, বাসায়ও রান্না করি। বাবা পছন্দ করেন। তাই আমার অভ্যাস আছে, আর ভালোও লাগে।”

কল্প এসে নিহিনের পাশে বসলো। কলরব বলল,

“বাবা, তোমরা গল্প করো। আমি গোসলটা করে আসি। নামাজের সময় তো হয়ে গেছে।”

এমন সময় কল্প বলে উঠল,

“পাপ্পা, আমি আজকে নামাজ পড়তে যাব না।”

“কেন?”

“আজ মিষ্টি আন্টির সাথে থাকব, এভরি ফ্রাইডে তো যাই।”

“আচ্ছা থাকিস।”

শওকত সাহেব ও কলরব নামাজ পড়তে যাওয়ার পর নিহিন কল্পকে বলল,

“কল্প, তুমি কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবে বাবা?”

“হ্যাঁ পারব। কিন্তু তুমি কোথায় যাবে?”

“আমি গোসল করব তাহলে।”

কল্পর মুখে হাসি ফুটে উঠল,

“আচ্ছা, চলো আমি তোমাকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।”

এরপর কল্প নিহিনকে ওদের বেডরুমে নিয়ে গেল। রুমে ঢুকেই নিহিনের চোখ আটকে গেল কালো রঙের ফ্রেমে বাঁধাই করা দেওয়ালে টাঙানো বড় একটা ছবিতে। ১৫/১৬ বছর বয়সী একটা মেয়ের ছবি মাথার চুলগুলো দুটো ঝুঁটি করা। মাথাটা একপাশে হেলিয়ে দিয়ে হাসছে। অনেক চেঞ্জ এসেছে, তবু নিজেকে চিনতে কষ্ট হলো না নিহিনের। কিন্তু বুঝতে পারল না এ ছবিটা কলরব পেল কোত্থেকে? ও তো দেয়নি। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কল্প বলল,

“আমার মা। খুব সুন্দর না দেখতে?”

নিহিন কোনোরকমে বলল,

“হ্যাঁ অনেক সুন্দর। নাম কী তোমার মায়ের?”

“আমার মায়ের নাম পরি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *