১
আজ অনেকদিন পর পুরোনো ডায়েরিটা খুলে বসেছে নিহিন। অভিমানে যা খোলা হয়নি বহুদিন। কলরবের প্রত্যেকটা চাহনির কথা লেখা আছে এ ডায়েরিতে, আছে নিহিনের প্রত্যেকটা দীর্ঘশ্বাসের কথা। রাগ, অভিমান, অপমান ও দুঃখের জল গড়িয়ে পড়ছে নিহিনের চোখ থেকে। রাগটা আসলে কার ওপর করা উচিত? কলরবের ওপর নাকি বাবার ওপর? নাকি অদৃষ্টের ওপর? বুঝতেই পারছে না সে!
দিনগুলোর কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে নিহিনের। আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ক্লাস টেনে পড়ত তখন। কলরব পড়ত ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে। বয়সের ব্যাবধানটা নেহাত কম ছিল না। তবুও প্রতিটা বিকেল নিহিনকে দেখার জন্য দুটি চোখ উদগ্রীব হয়ে থাকত পাশের বাসার বারান্দায়। প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতো ও, কিন্তু আস্তে আস্তে ভালোলাগাটা কীভাবে যেন চলেই এলো। একটা সময় এলো যখন নিহিনও অপেক্ষা করত সে দুটি চোখে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য। বৃষ্টি এলেই নিহিন ছাদে যেত ভিজতে, তা দেখে কলরবও যেত তার বাসার ছাদে। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে নেমে আসত নিহিন। নূপুর পায়ে রিনিঝিনি চলার শব্দে কলরব টের পেত নিহিনের অস্তিত্ব। আর ওদিকে কলরবের গিটারের টুং টাং শব্দ যেন জানান দিত অপেক্ষমান দুটি চোখের হাহাকারের কথা।
কিন্তু কলরব এত ভীতুর ডিম ছিল যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শুধু দেখেই গেছে ওকে, কিছু বলার সাহস পায়নি। নিহিনেরই বা কী দায় পড়েছে যে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে! কিন্তু এসেছিল, সে দিনটিও একদিন এসেছিল যেদিন কলরব তার ভালোলাগার কথা জানিয়েছিল। নিহিনের জন্মদিনে গান গেয়ে নিহিনকে উইশ করেছিল কলরব। উপহার দিয়েছিল এক গাদা চকোলেট আর বেলি ফুলের মালা। সঙ্গে ছিল একটা বিশেষ উপহার.. চিকন একটা নূপুর যার একপাশে একটা হৃদয় আকৃতির সাদা পাথর। সেদিনই শুরু হয়েছিল দুজনের পথ এক হয়ে যাওয়ার।
নূপুরটা বের করল নিহিন, অনেক বছর পড়ে ছিল এ ড্রয়ারে। কালচে হয়ে গেছে, পায়ে পরল। প্রথমবার পরিয়ে দিয়েছিল কলরব। কী সাহসটাই না হয়েছিল ওর! ভাবলেই এখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাত বারোটার পর টয়লেটে যেতে ভয় পেত যে মেয়ে, সে মেয়ে কি না ছাদের চাবি চুরি করে রাত ১ টার সময় ছাদে গিয়েছিল কলরবের সাথে দেখা করতে! দুটো বাসা অনেক কাছাকাছি ছিল। ছাদের দেওয়াল টপকে এসে পড়েছিল কলরব।
তখন মোবাইল ছিল না নিহিনের। আর মোবাইলের প্রয়োজনও ছিল না অবশ্য। নিহিনের জানালা আর কলরবের বারান্দা তো ছিলই। রাতের পর রাত কেটেছে চোখে চোখ রেখে, হাজার কথার হাজার স্বপ্ন বুনে। মাঝখানে ছিল শুধু দুটো গ্রিলের বেড়ি। স্বপ্নের মত কেটেছিল সে তিনটি মাস
তারপর ঠিকই নিহিন একদিন ধরা পড়ে গেল বাসায়। আলতাফ সাহেব নিহিন কে বলেছিলেন, “যা হয়েছে ভুলে যাও। তুমি না জেনেই একটা ভুল করে ফেলেছ। ছেলেটা ভালো না, আমি খোঁজ নিয়েছি ওর ব্যাপারে আর কথাও হয়েছে ওর সাথে আমার।”
আলতাফ সাহেবের কাছে এর বেশি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর পায়নি সেদিন নিহিন। তাকে ঘর বদলে অন্য ঘরে দেয়া হলো। কলরবকে ফোন করে পেল, না সে, মোবাইল বন্ধ। কলরবের বারান্দার দরজাটাও বন্ধ থাকত, ১০/১৫ দিন পর নতুন ভাড়াটিয়া এসে খুলেছিল সেই দরজা। কলরবের আর কোনো খোঁজ পায়নি নিহিন। কেঁদে ভাসিয়েছিল অনেক রাত। অপেক্ষা করেছে অনেক দিন। তারপর অভিমানে, রাগে একসময় ভুলেও গিয়েছিল সবকিছু।
কিন্তু আজ আলতাফ সাহেব বললেন, কলরবকে তিনি সময় দিয়েছিলেন! বলেছিলেন, নিহিনের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না করে যদি ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তবেই কলরবের সাথে বিয়ে দেবেন নিহিনের! কিন্তু যদি কখনো কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাহলে তখনই সব শেষ। আর নিহিন যাতে যোগাযোগ করতে না পারে তাই ফোনের সিম, বাসা সবকিছু বদলে ফেলতে বলেছিলেন। এসব কথা আলতাফ সাহেব ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি ওকে। কলরব প্রত্যেকটি কথা মেনে নিয়েছিল, যোগাযোগ করেনি। ঠিকই ৪ বছর পর নিজেকে তৈরি করেই এসেছিল নিহিনকে বিয়ে করতে কিন্তু ততদিনে নিহিনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আসলে আলতাফ নিজেই একসময় কলরবকে দেওয়া কথা ভুলে গিয়েছিলেন, কারণ কলরব যে এতটাই সিরিয়াস তা তিনি ভাবতেই পারেননি। নিহিনের বিয়ে হয়েছে শুনে এরপর আর কোনো যোগাযোগ করেনি কলরব।
বিয়েটা হলেও সংসারটা ভেঙ্গে গিয়েছে নিহিনের…পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে এখন, ঘুরছে ফিরছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দ করছে, বেশ আছে। শুধু আবার বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না কিছুতেই, বলছে আরও পরে। তাই আলতাফ সাহেবের দুঃখের শেষ নেই। তাই হয়তো আজ সবটা বললেন তিনি। কিন্তু না বললেই বোধহয় ভালো হতো। খুব ভালো ছিল এতদিন, কারণ একটা রাগ ছিল কলরবের ওপর। এখন তো সে রাগটাও চলে গেল! এখন?
কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না নিহিন। আজ এতদিন পর আবার ডায়াল করল কলরবের সে নাম্বরটিতে, যদি পাওয়া যায়! এতদিনে নিশ্চয়ই বিয়ে করে সংসার করছে সে, তাতে কী! শুধু একবার কথা বলতে চায় ও, আর কিছু না। কিন্তু ওপাশ থেকে যথারীতি সুকণ্ঠী মেয়েটির কন্ঠস্বর ভেসে এলো, “আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।”
২
নিহিন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে কিছুদিন আগেই। ক্লাস শেষ করে ফ্যাকাল্টি রুমে ঢুকে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। রুমে এ মুহূর্তে ও একা। ইদানীং একা হওয়াকে রীতিমত ভয় পাচ্ছে নিহিন। আশপাশে কেউ থাকলে তার সাথে কথাবার্তা বলা যায়। কিন্তু একা থাকলেই ওই মানুষটার চিন্তা ভর করে মাথায়। যেকোনো মূল্যে কলরবকে খুঁজে বের করতেই হবে। শুধু একবার দেখা বা কথা হলেই চলবে। কিন্তু ওকে খুঁজে বের করার কোনো উপায় নিহিনের জানা নেই। অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারল না। ওর ডেস্কে একটা পাতাবাহার গাছ, সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ছোটোবেলা থেকেই পাতাবাহার খুব প্রিয় ওর। তাই কলরব ওর বারান্দায় বাঁশের চোঙে অনেক অনেক পাতাবাহার লাগিয়েছিল!
ফোনটা তুলে তিথিকে কল করল নিহিন, “হ্যালো.. তিথি?”
“হ্যাঁ নিহিন বল।
“তোর সাথে খুব জরুরি একটা কথা আছে।”
“বলে ফেল।”
“তুই কি এখন অফিসে?”
“না বের হয়ে গেছি, এখন রিকশায় বাসায় ফিরছি, কী হয়েছে বলবি তো!”
“তাহলে বাসায় যা, তারপর বলি।”
“আরে ব্যাটা প্রব্লেম নাই, তুই বল তো!”
“তোর কি কলরবের কথা মনে আছে?”
“কলরব? দাঁড়া, পরিচিত লাগছে নামটা কিন্তু মনে করতে পারছি না। কে জানি পোলাডা?”
“আমার একটাই বয়ফ্রেন্ড ছিল তিথি। পাশের বাসায় থাকত যে।”
“তুই ওই ভীতুর ডিমটার কথা আবার মনে করছিস? আংকেলের ঝাড়ি খাইয়া পালাই গেছিল যে!”
“আগে আমার কথা শোন…”
“না, আমি তোর কোনো কথাই শুনব না তার সম্পর্কে। সাহস থাকলে ঠিকই তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত কোনো না কোনোভাবে। তা না করে নিজের ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিল। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলি তুই। কিছু ভুলিনি আমি। যতদিন মনে থাকবে ততদিন আমি কোনো কথা শুনতে চাই না ওর ব্যাপারে।”
ফোন কেটে দিলো তিথি। নিহিন জানে এখন আবার ফোন দিয়ে লাভ নেই, কিছু শুনতে চাইবে না ও। তাই বাবা আর কলরবের মধ্যে কী কথা হয়েছিল তা লিখে একটা মেসেজ পাঠাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিথি কল করল।
“নিহিন, কী বলছিস তুই? এগুলো সব সত্যি?”
“হুম, বাবা নিজেই সব বললেন কালকে। “তুই কোথায়?”
“অফিসে।”
“তুই থাক, আমি রিকশা ঘুরিয়ে চলে আসছি।”
“না, তুই বাসায় যা। আমি তোর বাসায় আসছি। ক্লাস শেষ।”
“আচ্ছা, আয় তাহলে।”
নিহিন পৌঁছতে পৌঁছতে তিথি ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। কফি হাতে বারান্দায় বসলো দুই বান্ধবী। তিথি বলল,
“আংকেল এমনটা কেন করলেন?”
“সেটাই স্বাতাবিক না? তখন কত বাচ্চা ছিলাম। কত আর ১৫ বছর বয়স ছিল আমার। ওই বয়সের প্রেম কেউ মানে?”
“আচ্ছা না মানল, কিন্তু ওকে কথা দিলেন কেন যে ওর সাথেই তোকে বিয়ে দেবে?”
“বাবা প্রথমে ওকে বলেছিলেন ও যাতে আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ না করে, কারণ উনি এগুলো এলাউ করেন না। এটা শুনে নাকি কলরব বলেছিল ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর বাবা বলেছিলেন, তুমি এখনও স্টুডেন্ট, বিয়ে করবে কীভাবে? আর আমি আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো কী দেখে? তার চেয়ে এসব বাদ দিয়ে আগে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। তখন কলরব বলেছিল, ও প্রতিষ্ঠিত হয়েই আসবে বিয়ে করার জন্য। তবু ও আমাকেই বিয়ে করবে। তখন বাবা শর্ত দিয়েছিলেন যে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। করলে বাবা ওকে আর মানবেন না।”
“আর আংকেল এসব কথার কিছুই জানাননি তোকে, তাইতো?”
“হুম। আসলে ও গান গাইত যা বাবা পছন্দ করতেন না। পরাশুনাও করছিল বিবিএ, সাধারণ একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে। সবসময় বড় বড় চুল, মুখভর্তি দাড়ি। বাবার ওকে পছন্দ ছিল না। তুই তো জানিস বাবা কতটা ফরমাল!”
“হুম আর্মিম্যানদের নিয়ে এই এক সমস্যা। তাই বলে সে তোর সাথে কোন যোগাযোগ করবে না? করলে কি আর আংকেল টের পেতেন?”
“ও তো এমনই ছিলরে। খুব অনেস্ট।”
“এত অনেস্টি খালি বাংলা সিনেমায় মানায়, বাস্তবে না। রাগ লাগছে এসব শুনে, ধুত্তুরি।”
“আচ্ছা এসব কথা পরে হবে, আগে বল কীভাবে ওকে খুঁজে পাব?” একথা শুনে অবাক হলো তিথি।
“খুঁজে পাবি মানে? তুই কেন ওকে খুঁজবি? এমনিতেই তোর থেকে ৬ বছরের বড় ছিল, তার মানে ওর বয়স এখন ৩২। এতদিনে বিয়ে শাদি করে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে।”
“আরে সেসব কি আমি বুঝি না? আমি জাস্ট ওর সাথে একবার কথা বলতে চাই। নাহলে শান্তি পাব না, কাল থেকে খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি।”
“কিন্তু কেউ কি নেই যার মাধ্যমে ভাইয়াকে খুঁজে বের করা যায়?”
“না, এরকম কেউই নেই। বাবার কাছ থেকে জানতে পেরেছি যখন শেষবার ওর সাথে কথা হয়েছিল তখন ও ফিউচার ব্যাংকে চাকরি করত।”
“আরে আমাদের সাব্বিরই তো ফিউচার ব্যাংকে আছে। ওর হেল্প নেয়া যায়।”
“তাই তো! সাব্বির যে ফিউচার ব্যাংকে তা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু কলরব কোন ব্রাঞ্চে তা তো জানি না।”
“তাছাড়া সেটা তো আরও ৬ বছর আগের কথা। এখনও যে ভাইয়া ওখানেই আছে তার কী গ্যারান্টি?”
“তাহলে উপায়?”
“সাব্বিরের সাথে কথা বলে দেখ। ও যদি কোনো তথ্য দিতে নাও পারে তাতেও তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা তো করা যাক। তাছাড়া সাব্বিরও তো প্রায় ২/৩ বছর ধরে আছে ওখানে। আর ও যেই মিশুক ছেলে, দুনিয়ার মানুষের সাথে দোস্তি ওর।”
“হুম, আচ্ছা দাঁড়া কল করি ওকে।”
ওপাশে রিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাজতেই সাব্বিরের গলা পাওয়া গেল। “হ্যালো সুন্দরী!”
“সাব্বির, ফ্রি আছিস দোস্ত?”
“কেন? তোর কণ্ঠ এত সিরিয়াস কেন? কিছু হয়েছে?”
“কিছুক্ষণ কথা বলব।”
“বল, এখনও অফিসে কাজ করছি, কিন্তু সমস্যা নেই। তুই বলতে থাক।”
“তোর অফিসে কলরব নামে কেউ আছে?”
“না। কেন?”
“একজনকে খুঁজছি। ৬ বছর আগে তোদের ব্যাংকে চাকরি করত।”
“এই কি সেই কলরব, যার সাথে তোর স্কুল লাইফে অ্যাফেয়ার ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“এতদিন পর খুঁজছিস?”
“সে অনেক কথা, দেখা হলে বলব।”
“আচ্ছা সে কোন ব্রাঞ্চে? কোন ডিপার্টমেন্টে?”
“কিছুই জানি না।”
“তাহলে কীভাবে বলব? এটা তো অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা তাও চেষ্টা করব। কারণ ৬ বছর ধরে আছে এমন মানুষদের সাথে কথা বলে দেখি কিন্তু দোস্ত আমাদের ব্রাঞ্চ না হলে এত সহজে খবর পাব না আমি।’
“আচ্ছা, একটু দেখ দোস্ত।”
“ঠিক আছে।”
“রাখছি তাহলে।”
৩
নিহিনের বাসার ছাদে পায়চারি করছে তিথি। নিহিন ছাদের গ্রিলে হেলান দিয়ে বসে আছে। সাব্বির জানিয়েছে ওদের ব্রাঞ্চে কখনোই কলরর নামে কেউ ছিল না। কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ ভাবছিল আর কীভাবে খোঁজা যায় কলরবকে। হঠাৎ তিথি বলে উঠল,
“দোস্ত ফেসবুকে খুঁজেছিস?”
“অসংখ্যবার খুঁজেছি, পাইনি।”
“এটা কীভাবে সম্ভব? আজকালকার যুগে ফেসবুক কার না থাকে?”
“জানি না।”
“অন্য কোনো নাম আছে?”
“জানি না। এমনকি ওর পুরা নাম কী তাও জানি না আমি, শুধু কলরব লেখেই সার্চ দিয়েছিলাম।”
“উদ্ধার করছো আম্মা। প্রেম করছো আর নাম ধাম জানো না।”
নিহিন কিছু বলল না। মন খারাপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখটা। ওঠে গিয়ে তিথির সামনে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা ওর ইউনিভার্সিটিতে গেলে কেমন হয়? “গিয়ে?”
“গিয়ে সিনিয়র স্টুডেন্টদের জিজ্ঞেস করব।”
“আমার মনে হয় না এতে কোনো কাজ হবে।”
“যেতে তো সমস্যা নেই। গিয়েই দেখি একবার।”
“কবে যাবি?”
“কাল শনিবার, আমার তাড়াতাড়ি ছুটি। কাল যাওয়া যায়।’
তিথি নিহিনের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল,
“ঠিক আছে আমিও তাহলে যাব তোর সাথে।”
নিহিন গলা জড়িয়ে ধরল তিথির। আসলেই ছোটবেলার বন্ধুবান্ধবরা এমনই হয়, ঠিক বাবা মায়ের মতো। যেমন সবকিছু বুঝতে পারে তেমনই সবকিছুতেই সাথে থাকে। একলা ছেড়ে দিতে পারে না।
কলরবের ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। ৮ বছর আগে যে এখান থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে তার খোঁজ দেওয়া দূরের কথা নাম শুনে চিনলও না কেউ। তবে একটি ছেলের কাছ থেকে কিছুটা আশা পাওয়া গেল। ছেলেটার নাম সুপ্ত। সে বলল, তাদের ইউনিভারসিটির এক্স স্টুডেন্টদের একটা গ্রুপ আছে ফেসবুকে। যে গ্রুপের মডারেটর তার বড় ভাই। সে ভাইকে বলবে গ্রুপে একটু খোঁজ করার জন্য। নিহিন নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে সুপ্তর ফোন নাম্বারও নিয়ে এলো। নিহিন জানে না কলরবকে ও খুঁজে পাবে কি না। কিন্তু খুব দরকার ওকে নিহিনের। তা না হলে যে ভুল বোঝাবুঝিটা সারাজীবনই থেকে যাবে।
.
প্রায় এক সপ্তাহ পর…
আজ ইউনিভার্সিটিতে অনেক ঝামেলা ছিল, আজ যেন একটু বেশিই ক্লান্ত নিহিন। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল,
“হ্যালো।”
“হ্যালো, আপু আমি সুপ্ত বলছি। সেদিন আমাদের ভার্সিটিতে এসেছিলেন একজনকে খুঁজতে।”
“হ্যাঁ ভাইয়া তোমার নাম্বার আমি সেভ করে রেখেছিলাম। তুমি বলো।”
রীতিমতো ঘেমে গেছে নিহিন। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। সুপ্ত বলল,
“আপনি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সরি এত রাতে কল করার জন্য।”
“না না ভাইয়া, তুমি বলো।”
“আসলে আপু আমি ওইদিনই ভাইয়াকে বলেছিলাম। কলরব ভাইয়ার নাম শুনেই চিনতে পেরেছে ভাইয়া। আমার ভাই কলরব ভাইয়ার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিলেন। তাদের মধ্যে একসময় ভালো বন্ধুত্ব ছিল।”
নিহিনের বুকটা ধড়ফড় করছে। এত অস্থিরতা কেন?
“কলরবের কোনো ফোন নাম্বার কি আছে তোমার ভাইয়ার কাছে?”
“আপু ওই দিন ভাইয়া ফোনে অনেক খুঁজেছে। নাম্বার থাকার কথা কিন্তু পাচ্ছিল না। তাই আমিও আপনাকে আর কিছু জানাইনি। কারণ নেগেটিভ খবর শুনলে আপনার মন খারাপ হবে।”
নিহিনের ধড়ফড়ানি আরো বেড়ে গেছে। অসহ্য লাগছে। কিছু বলার মত শক্তি পাচ্ছে না। কোনরকমে বলল,
“ও।”
সুপ্ত আবার বলতে শুরু করল,
“তারপর আজ একটু আগে ভাইয়া পুরোনো একটা সিম অন করেছে কী কাজে, ওখানে কলরব ভাইয়ার একটা নাম্বার খুঁজে পেতেই আমাকে দিলো। ভাইয়া তখনই ফোন করতে চেয়েছিল কলরব ভাইয়াকে। আমি নিষেধ করলাম। আপনি কল করলে হয়তো চমকে যাবে কলরব ভাইয়া। ব্যাপারটা নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না!”
বলেই হাসলো ছেলেটি।
নিহিনের বুক কাঁপছে। একটা নাম্বার সে পেয়েছে। কিন্তু নাম্বারটা যদি কলরবের না হয়ে থাকে? কিংবা যদি নাম্বারটা বন্ধ থাকে? রাত ১২.৩৩ বাজে। এত রাতে কল করাটা কি ঠিক হবে? অনেক সাতপাঁচ ভেবে কল করেই ফেলল নিহিন। ওপাশে রিং হচ্ছে। একসময় রিং থেমে গেল। একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।
“হ্যালো।”
নিহিন বুঝল না এটা কি কলরব নাকি অন্য কেউ? কন্ঠটা কলরবের মতই আবার একটু মোটা, সেটা কি বয়সের কারণেই হয়েছে? এতক্ষণে ওপাশ থেকে বার কয়েক ভেসে এলো,
“হ্যালো.. হ্যালো.. কে বলছেন?”
নিহিন কোনরকমে বলল,
“হ্যালো।”
ওপাশে পুরুষ কণ্ঠটা এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল! পরক্ষণেই উৎকণ্ঠা,
“নিহিন!”
৪
হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো নিহিনের, গলার ভেতর কথা সব আটকে যাচ্ছে যেন। এতদিন পর একবার একটা হ্যালো শুনেই কণ্ঠ চিনে ফেলল কলরব! কোনরকমে বলল,
“হ্যাঁ”
“হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছ তুমি?”
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“আমিও ভালো আছি।”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
“আমার কণ্ঠ শুনে তাই মনে হচ্ছে? উলটো তোমার কণ্ঠটা ঘুমে জড়ানো।”
লজ্জা পেয়ে নিহিন বলল,
“আসলে এত রাতে ফোন করেছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“তুমি তো দেখি এখনো আগের মতই অকারণে লজ্জা পাও।”
একথায় নিহিন আরো লজ্জা পেল, মনে পড়ে গেল আগের কথা, তখন নিহিনের লজ্জা পাওয়াটা রীতিমতো উপভোগ করত কলরব। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর আবার কলরবই শুরু করল,
“ভাবিনি তোমার সাথে আবার কখনো কথা হবে। কিন্তু, আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলে?”
“ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।”
“ও, তা ম্যাডামের এ ইচ্ছাটা আরো আগে হলো না কেন?”
“কারণ সে জানতো আপনি পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে লাভ কী?”
“সেটাও ঠিক, তা আজ হঠাৎ কী মনে করে এই পালিয়ে যাওয়া মানুষটাকে খুঁজে বের করা হলো?”
“কারণ কিছুদিন আগেই আমি সত্যিটা জানতে পেরেছি।”
“কোন সত্যিটা?”
“১০ বছর আগে বাবা আর তোমার মধ্যে যা কথা হয়েছিল তা। ৬ বছর আগে যা কথা হয়েছিল তাও।”
“ও, কীভাবে জানলে?”
“বাবা নিজেই বলেছে।”
অবাক হলো কলরব।
“আংকেল নিজে বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী মনে করে?”
“জানি না।”
“ও”
আবারও দুজনই চুপ। কিছুক্ষণ পর নিহিন বলল, “তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করনি কেন?”
“কখন?”
“১০ বছর আগে, বাবার সাথে কথা হওয়ার পর। একবারের জন্য যোগাযোগ করনি, উলটো বারান্দার দরজাটাও খোলনি যে কয়দিন ছিলে ওই বাসায়।”
“হুম, ওই রকমই ডিল হয়েছিল তোমার বাবার সাথে।”
বলেই হেসে ফেলল কলরব। নিহিন বলল,
“ডিল! আমি সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।”
“আমিও সিরিয়াসলি বলছি। এক রকম ডিলই ছিল। তোমার বাবা আমাকে কোনো স্পেস না দিয়ে সরাসরি বলেছিল তোমাকে ভুলে যেতে, উনি প্রেমে বিশ্বাসী না। তখন আমিও তাকে বলেছিলাম, আমি প্রেম করব না, বিয়ে করব। ব্যস একগাদা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, বলেছিল সব মানতে পারলেই তোমাকে পাব। সে সব শর্তের মাঝে এটাও ছিল যে তোমার সাথে লুকিয়ে চুরিয়েও কোন যোগাযোগ করা যাবে না।
“কিন্তু একবার জানাতে পারতে যে বাবার সাথে তোমার এসব কথা হয়েছে এবং তুমি অপেক্ষা করবে।”
“তাতে তো শর্ত মানা হতো না। হয়তো তোমার বাবা জানতে পারত না, হয়তো পারত। কিন্তু আমি তো জানতাম, আল্লাহ তো জানত। শান্তি পেতাম না তাতে।”
“শর্ত মেনেই বা কী হয়েছে?”
কলরব হাসল।
“তোমার বাবা কি রিটায়ার করেছে?”
“হ্যাঁ, গতবছর।”
“এইবার বুঝলাম, কেন তোমাকে সব বলে দিয়েছে।”
“কেন?”
“ওই তো, আর্মি পোশাক যতদিন গায়ে থাকে ততদিন মানুষের মধ্যে মায়া-দয়া কাজ করে না।”
“তুমি আগের মতো দুষ্টুই রয়ে গেছ।”
একটু হেসে বলল নিহিন। কলরব বলল,
“আর তুমিও আগের মত লজ্জাবতী রয়ে গেছ। আচ্ছা এখনও কি আগের মত লাফালাফি কর ধুমধাম?”
“আমি কি চঞ্চল ছিলাম নাকি? লাফালাফি করে চঞ্চলরা।”
“এটাই একটা আজব ব্যাপার ছিল, তুমি কম কথা বলতে, লজ্জা পেতে, কখনো ধমক দাওনি, ঝগড়া করনি। কিন্তু হাঁটার বদলে দৌড়াতে, লাফাতে, উলটো চরিত্র। সোজাভাবে হাঁটতেই দেখিনি কখনো, তবে তোমাকে ওটাতেই মানাতো।”
কলরবের কথা শেষ হতেই একটা বাচ্চা ছেলের কন্ঠ পাওয়া গেল। বাচ্চাটা আহ্লাদি গলায় বলছিল, “পাপ্পা দেখ না, দাদাভাই বলছে আজকেও আমাকে ব্রাশ করতে হবে।”
কলরব নিহিনকে বলল,
“জাস্ট হোল্ড আ মিনিট।”
এরপর ওপাশে শুনতে পাওয়া গেল কলরব বাচ্চাটাকে বলছে, “প্রতিদিন ব্রাশ না করলে তোর মুখে গন্ধ হবে, দাঁতে পোকা ধরবে তারপর আফরা আর তোর পাশে বসবে না, দেখিস তুই।” বাচ্চাটা রেগে বলল, “পাপ্পা, শি ইজ মাই ফ্রেন্ড, আই টোল্ড ইউ বিফোর।”
“নিহিন, সরি।”
“ইটস ওকে, বাচ্চাটা কে?”
“ও কল্প, আমার ছেলে।”
বুকের ভিতরটা কুঁকড়ে গেল নিহিনের, পরক্ষণেই ভাবল এটাই তো স্বাভাবিক, মন খারাপ করার মত কোনো কারণই নেই। নিজেকে আরো স্বাভাবিক বোঝানোর জন্য নিহিন বলল,
“কত কিউট! কল্পর বয়স কত?”
“৫ বছর।”
“স্কুলে যায় বুঝি?”
“হুম, ওকে সাড়ে তিন বছর বয়সেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম।”
“কোন ক্লাসে পড়ছে এখন?”
“কেজি ওয়ান।”
“এইটুকুন একটা বাচ্চা এত রাত পর্যন্ত জেগে থকতে পারে?”
“না, ও ১০ টা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজকে জেগে আছে কারণ, একটু আগেই আমরা গ্রাম থেকে ফিরলাম।”
“ও তাহলে তো তুমি অনেক ক্লান্ত, ঘুমাও তাহলে।”
“হ্যাঁ, ঘুমাব। আসলে কাল সকালেই অফিস আছে, তা নাহলে আরো জেগে থাকা যেত।”
“কী চাকরি করছ?”
“ব্যাংকে।”
“ফিউচার ব্যাংক?”
“না, এখন এবিসি ব্যাংকে। দেড় দুই বছর আগে ছিলাম ফিউচারে।”
“ও।”
“তুমি? আর্মিতে?”
“ধ্যাত!”
হাসল কলরব। বলল, “তাহলে কী করছ?”
“ইউনিভারসিটিতে আগডুম বাগডুম পড়াই আর কী!”
“ওয়াও লেকচারার, গ্রেট। হাউ লাকি দে আর।”
“কাদের কথা বলছ?”
“তোমার ভার্সিটির ছেলে স্টুডেন্টগুলোর কথা বলছি।”
“তুমি আগের মতই মারাত্মক দুষ্টু আছ।”
“কই না তো।”
“ঘুমাও, তোমার না অফিস আছে?”
“হ্যাঁ, ঘুমাবো। রাখো তাহলে।”
“তুমি রাখো।”
“না তুমি রাখো।”
“একজন রাখলেই হয়।”
“লেডিস ফার্স্ট।”
“আচ্ছা রাখছি, গুড নাইট।”
“শোনো…”
“বল।”
“তোমার ফোন পেয়ে অনেক ভালো লাগল। আসলে অসম্ভব যখন সম্ভব হয় তখন বোধহয় এরকমই লাগে।”
নিহিনেরও কেমন যেন অদ্ভুত লাগতে লাগল!