তেরোটার ঘণ্টা

তেরোটার ঘণ্টা

গাড়ি থেকে নেমে মস্ত গেটটার সামনে দাঁড়াল দেবল৷ গেট নয়, বলা উচিত সিংহ-দরজা৷ আক্ষরিক অর্থেই৷ কারণ গেটের বিশাল পিলারদুটোর ওপরে দুটো পাথরের সিংহ এখনও বসে আছে৷ একটার নাক ভাঙা৷ পা আর ল্যাজের বেশ খানিকটা অংশও খসে গেছে৷ অন্যটার মাথাটাই ভেঙে গেছে৷ তবু একসময় যে দুটো শ্বেতপাথরের কেশরওলা সিংহ থামের মাথায় জাঁকিয়ে বসে থাকত বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ গেটের অবস্থাও তথৈবচ৷ কালো আর সোনালি রঙ ছিল বোধহয়৷ আবছা মনে পড়ে দেবলের৷ সেসব উড়ে গেছে অনেককাল৷ মাথার দিকে সূচালো শিকগুলোও মরচেয় ঝুরঝুরে৷ বড় গেটটা সম্ভবত খোলাও হয় না বহুকাল৷ দেউড়ির পাশের ছোট গেট দিয়েই যাতায়াত চলে৷

গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা নুড়ি বেছানো পথ৷ অনেককাল আগে নিশ্চয় ফুলের কেয়ারি ছিল৷ এখন দুপাশে আগাছার জঙ্গল৷ বাগানের মাঝখানের ভাঙা ফোয়ারাটা থেকে দেবলও কখনও জল পড়তে দেখেনি৷ তবে ফোয়ারার মাঝখানে পরিটা আস্ত ছিল৷ এখন একটা মুণ্ডহীন ধড়ে ডানাদুটো লেগে আছে৷ মাঝখান থেকে কঙ্কালের হাতের মতো উঁকি মারছে জলের পাইপটা৷ দেখতে দেখতে দেবলের মনে হল গোটা চৌধুরী বাড়িটাই যেন ওরকম একটা মুণ্ডহীন কঙ্কালের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ বাড়ি না বলে অবশ্য প্রাসাদ বলাই ভালো৷ বিশাল বিশাল খিলান, চওড়া টানা বারান্দা, ঘোরানো সিঁড়ি, কোথাও শ্বেত পাথরের, কোথাও আবার দাবার ছকের মতো সাদা-কালো পাথর বসানো মেঝে, মস্ত উঁচু সিলিং থেকে ঝুলে থাকা ঝাড়লণ্ঠন, মেঝে জোড়া নরম পার্সিয়ান কার্পেট পাতা বাড়িটাকে নয়নপুর আর তার আশপাশের মানুষজন রাজবাড়ি বলেই চিনত৷ যদিও রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মোটেই রাজা ছিলেন না৷ তবে জমিদার ছিলেন৷ এই মৌজার অধিকাংশ জমি-জিরেতই ছিল তাঁর দখলে৷ দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং অত্যাচারী বলে পুরো পরগনাতেই কুখ্যাত ছিলেন তিনি৷ শুধু জমির ওপর নির্ভর করে পয়সা নয়৷ বংশানুক্রমিক জমিদারও ছিলেন না৷ ইংরেজদের সঙ্গে নুনের ব্যবসায় পয়সা করেছিলেন৷ সঙ্গে জাহাজঘাটার আরও দু-পাঁচটা ব্যবসাও ছিল৷ বিশেষ করে ঘড়ি মেরামতির কাজে বিশেষ নাম-ডাক ছিল তাঁর৷ সেসব থেকে পাওয়া টাকা আর সাহেবদের সঙ্গে দহরম-মহরমের সুবাদে জমিদারির পত্তন করতে অসুবিধা হয়নি৷ কলকাতায় বাড়ি ছিল৷ কিন্তু বয়স একটু বাড়ার পর ব্যবসার কাজ ছেলেদের হাতে তুলে দিয়ে নিজে চলে এসেছিলেন নয়নপুরে৷ জমিদারের যোগ্য নায়েব ছিলেন হরিহর পৈতুণ্ডি৷ দুজনে মিলে প্রজাদের গলায় গামছা দিয়ে খাজনার টাকা আদায় করতেন৷ সেই টাকায় জমিদারবাড়ির রমরমা বাড়ত৷ দোল-দুর্গোৎসবে মোচ্ছব হত৷ কলকাতা থেকে নাকি সাহেব-সুবোরাও আসতেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে৷

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়িটার ওপর আলগোছে চোখ বোলাচ্ছিল দেবল৷ এখন অবশ্য বাড়ির চেহারা দেখলে সেসব কথা কল্পনা করাও কঠিন৷ মস্ত কাঠামোটুকু শুধু টিকে আছে৷ তাছাড়া গোটা বাড়ির চেহারাটাই একটা দাঁত বের করা কঙ্কালের মতো৷ ইঁটের দেওয়াল বেয়ে ওঠা গাছের চারা রীতিমত ডালপালা মেলে দিয়েছে৷ দোতলার অনেকগুলো জানলারই খড়খড়ি ভেঙে ঝুলছে৷ পলেস্তারা খসে গেছে বহু জায়গাতে৷ শ্রীহীনভাবে বেরিয়ে থাকা ইঁটের ওপর পুরু শ্যাওলার আস্তরণ৷ একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো গোটা বাড়িটাই যেন অতীতের গন্ধ গায়ে মেখে মাটিতে মুখ গুঁজে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে৷ কথাটা ভেবেই নিজের মনে একটু হাসল দেবল৷ এই অপেক্ষাপর্বও শেষ হবে এবার৷ জমি-জিরেত অনেককাল গেছে৷ নয়নপুরের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে ছিল জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মানে দেবলের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার আমলের এই বাড়িটা৷ সেটাও এবার বিক্রি হয়ে যাবে৷ এদিকগুলো ইদানীং টুরিস্ট স্পট হিসাবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে৷ দেবলের সৌভাগ্য যে একজন শাঁসালো প্রোমোটারের নজর পড়েছে বাড়িটার দিকে৷ তিনি একটা রিসর্ট বানাতে চান এখানে৷ দরদাম করেনি দেবল৷ এই ভাঙাবাড়ির জন্য যা পাওয়া যায় তাই ভালো৷

প্রোমোটারের আসার কথা আজ বিকেলে৷ তার আগে একবার বাড়িটা ঘুরে দেখে নিতে হবে৷ আলাদা করে বিক্রি করার মতো জিনিসপত্র কিছু আছে কীনা৷ তাই আর দেরি না করে হর্ন বাজাল দেবল৷ বেশ কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে একজনকে আসতে দেখা গেল৷ কাছে আসতে চিনল দেবল৷ নগেনদা৷ বয়স অনেকটাই হয়েছে৷ তবে সামনে একটু ঝুঁকে পড়লেও চেহারাটা এখনও শক্তপোক্ত৷ মাথার চুল যদিও বিলকুল সাদা৷ আর চোখের সেই চনমনে, তীক্ষ্ণ চাউনিটাও নেই, কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি৷ চাবিটা হাতে নিয়ে গেটের কাছে এসে দেবলকে দেখে একটু যেন চমকে উঠল নগেনদা৷ দেবল যদিও গত কুড়ি বছরে নয়নপুরে আসেনি৷ কিন্তু নগেনদা মাঝে দু-একবার কলকাতা গেছে৷ তাই একেবারে না চেনার কথা নয়৷ তাছাড়া দেবলের আসার খবরও পেয়েছে৷ তাই নগেনদাকে চমকাতে দেখে একটু অবাক হয়ে দেবল বলল, কী হল নগেনদা, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না নাকি?

কথার উত্তর না দিয়ে মরচে ধরা তালাটা অতিকষ্টে খুলল নগেনদা৷ তারপর গেটের পাল্লাদুটো ধরে ঠেলা দিতে একটা বিকট কর্কশ আওয়াজ করে খুলে গেল সেদুটোও৷ পিলে কাঁপানো আওয়াজে চমকে গেছিল দেবল৷ নগেনদার মুখের ওপর দিয়েও একটা কালো ছায়া যেন খেলে গেল৷ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, তোমার না কাল আসার কথা ছিল? মানিকবাবুকে তো আমি বলেছিলাম, আজকের দিনটা বাদ দিতে৷ সে বলেনি তোমাকে?

দেবল ততক্ষণে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়েছে৷ তাই নগেনদার কথাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না৷ কিন্তু গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে পিছনের বুট থেকে তাকে স্যুটকেস নামাতে দেখে নগেনদা ফের বলে, আজ রাতে থাকবে ভাবছো নাকি?

এবার একটু বিরক্ত হয় দেবল৷

রাতে থাকবো না তো যাব কোথায়? মানিকবাবু তো আসবেন বিকেলবেলা৷ কথাবার্তা শেষ হতে সন্ধে হয়ে যাবে৷ তারপর ফিরব কেমন করে? তোমার সমস্যাটা কী বলো তো নগেনদা? রাঁধা-বাড়ার কিছু নেই বুঝি? টাকা দিচ্ছি, আনিয়ে নাও৷ আজকাল তো নয়নপুরে রোজই বাজার বসে৷ আসার পথে দেখলাম৷

স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে ঘরের ভিতরে যেতে আপনমনেই গজগজ করে নগেন, অমাবস্যার দিন….ভালো নয়৷ তাই বলেছিলাম আজ না আসতে….

অমাবস্যা-পূর্ণিমা তো প্রতিমাসেই হয়৷ তারসঙ্গে দিন ভালো-মন্দর কী সম্পর্ক বোঝে না দেবল৷ কিন্তু নগেনদা ততক্ষণে স্যুটকেস নিয়ে ভিতরে হাঁটা দিয়েছে৷ তাই গাড়িবারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে মস্ত বৈঠকখানাটায় একলা দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে দেবল৷ দাদু মারা যাওয়ার পর দেবল আর তার মা যখন পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে গেল, তখন তার বয়স বছর দশেক৷ দাদু মারা গেছিলেন বেশ অদ্ভূতভাবে৷ বৈশাখ মাস ছিল৷ রোজ বিকেলে হাঁটতে যেতেন দাদু৷ সেদিনও গেছিলেন৷ একটু পরেই কালবৈশাখী ঝড় উঠল৷ সঙ্গে বৃষ্টি আর ঘন ঘন বাজপড়া৷ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন বোধহয়৷ বাজে পোড়া শরীরটা কালো কাঠের মতো দেখতে হয়ে গেছিল৷ দেবল জানে লোকে মনে করে রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কুকর্মের অভিশাপ আছে তাদের বংশে৷ এই বংশের পুরুষদের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয় না৷ দাদু মারা গেছিলেন বজ্রপাতে৷ কারখানায় কাজ করার সময় মাথার ওপর ক্রেন ছিঁড়ে পড়ে দেবলের বাবা মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে ৷ তবে দেবল নিজে এসবে বিশ্বাস করে না৷ তার মতে দুর্ঘটনা যে কোনও সময় ঘটতে পারে৷ তার সঙ্গে অভিশাপের কোনও সম্পর্ক নেই৷

তবে রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নামটা মাথায় আসতে দেবলের মনে পড়ে এই বৈঠকখানা ঘরেই একটা মানুষপ্রমাণ ছবি ছিল রামেন্দ্রনারায়ণের৷ ঈগল পাখির মতো খাড়া নাক আর তীক্ষ্ণ-কুটিল চোখওলা লোকটার ছবিটা দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি হত ছোট্ট দেবলের৷ তাই এই ঘরটায় পারতপক্ষে একলা ঢুকত না সে৷ দরকারও তেমন হত না৷ কারণ এই ঘরে তখন দাদুর সঙ্গে দেখা করতে বাইরের লোকজনরা আসতেন৷ মায়ের সঙ্গে দেবল থাকত দোতলায়৷ কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হল দেবলের৷ যেন কেউ আড়াল থেকে তার দিকে নজর রাখছে৷ একটু অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল ছবিটা৷ রামেন্দ্রনারায়ণ যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তার দিকে৷ অয়েল পেইন্টিং৷ কিন্তু এতবছর পরেও চোখদুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে৷ ঘরের সব আসবাবপত্রই ধুলোয় মলিন৷ কিন্তু ছবিটায় যেন সময়ের ছাপ পড়েনি একটুও৷ গা-টা শিরশির করছিল দেবলের৷ তাই চোখ সরিয়ে নিয়ে এগোল সিঁড়ির দিকে৷ ঘর থেকে বেরিয়ে চওড়া বারান্দা৷ তার দুপাশ দিয়েই উঠেছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শুনতে পেল পুরোনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের ঢংঢং আওয়াজ৷ ঘড়িটা দাদুর আমল থেকে বৈঠকখানার কোণে রাখা থাকত৷ কিন্তু কখনও ঘণ্টা বাজতে শোনেনি দেবল৷ ঘড়িটা তার মানে নগেনদা ঠিক করিয়েছে৷ সেক্ষেত্রে এটার জন্যও আলাদা দাম পাওয়া যাবে৷ হাজার হোক এরকম একটা অ্যান্টিক ঘড়ি৷ কথাটা ভেবেই মনটা খুশি খুশি হয়ে গেছিল দেবলের৷ কিন্তু সিঁড়ির মুখে নগেনদাকে দেখে খুশিটা উপে গেল৷ নগেনদার মুখটা ফ্যাকাসে৷ দুহাতে বারান্দার রেলিংটা এত শক্ত করে ধরে আছে যে হাতের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে৷ দেবলকে দেখে ফিসফিস করে বলল, শুনলে, শুনতে পেয়েছো?

কী শুনব?

শুনতে পেলে না, ঘণ্টা বাজল?

হ্যাঁ শুনলাম তো৷ দাদুর গ্র্যান্ডফাদার ক্লক৷ আগে তো কোনওদিন শুনিনি৷ ঘড়িটা সারিয়েছো বুঝি?

বিড়বিড় করে মাথা নাড়ল নগেনদা, না, এত কাল বাজেনি৷ ঠিক আজকেই বাজল৷ আমি ঠিক বুঝেছি….আজই সেইদিন…..

আপন মনে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নগেনদা৷ বুড়োর মাথাটা যে একেবারেই গেছে বুঝতে অসুবিধা হল না দেবলের৷ বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলে কোথায় যে যাবে কে জানে? সারাটাজীবন তো এই চৌধুরীবাড়িতেই কেটে গেল৷ আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে কীনা জিজ্ঞাসা করতে হবে৷ নাহলে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে একটা ব্যবস্থাও করতে হবে৷ ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে মনটা ভালো হয়ে গেল দেবলের৷ এই ঘরটাতেই মায়ের সঙ্গে থাকত সে৷ পূব-দক্ষিণ খোলা আলোয় ভাসাভাসি ঘর৷ নগেনদা যতই অকর্মণ্য হয়ে পড়ুক, এই ঘরটাকে অন্তত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে৷ মেহগিনির পালঙ্কের ওপর ফর্সা চাদর পাতা৷ বালিশ-পাশবালিশ এমনকী একটা পাতলা কাঁথা পর্যন্ত পায়ের কাছে পরিপাটি করে গোছানো৷

দুপুরের খাওয়াও ভালোই হল৷ ভাত-ডাল-দুরকম ভাজা-মাছ৷ শেষপাতে পায়েসও ছিল৷ রান্না নাকি নগেনদা নিজেই করে৷ যদিও নিজের সেদ্ধভাত ছাড়া কিছু লাগে না৷ দেবল এসেছে বলেই বিশেষ আয়োজন৷ রান্নাও ভালো৷ তৃপ্তি করেই খাচ্ছিল দেবল৷ যদিও নগেনদার মুখটা ফ্যাকাসে মতো হয়েই ছিল৷ মাঝে মাঝেই যেন চমকে আশপাশটা সতর্কভাবে দেখে নিচ্ছিল৷

মানিকবাবু এলেন বিকেল পড়তেই৷ তখনও দিনের আলো রয়েছে ভালোমত৷ বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো দেবল৷ বাড়ির লাগোয়া বেশ কয়েক বিঘে জায়গা৷ সামনে ফুলের বাগান৷ পিছন দিকে ফলের গাছ অনেক৷ সবজির চাষও নাকি হত একসময়৷ একপাশে বিশাল পুকুর৷ বাঁধানো ঘাট এখন ফেটে চৌচির৷ ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে, খিড়কির গেটের কাছে একটা ছোট্ট চালাঘরের মতো৷ নগেনদা পিছন পিছন আসছিল৷ জিজ্ঞাসা করতে বলল, ওটা তো হাসেম ফকিরের মাজার৷ মনে নেই? তোমার দাদুর সময় থেকেই ছিল৷ দাদুর বন্ধু ছিলেন হাসেম ফকির৷ মাজারখানা তিনিই বানান৷ ফকির অনেককাল দেহ রেখেছেন৷ মাজারের পাশেই ওনাকেও মাটি দেওয়া হয়েছিল৷ পাড়ার লোকজন আসে৷ মোমবাতি জ্বালিয়ে যায়৷

কার্তিক মাস৷ দিন ছোট হতে শুরু করেছে৷ মানিকবাবু চলে যাওয়ার পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল৷ নয়নপুরে ইলেকট্রিসিটি আছে৷ কিন্তু ভোল্টেজের অবস্থা খুবই খারাপ৷ দেবলের ঘরের আলোটা জ্বলছে একেবারেই মিটমিট করে৷ টেলিভিশন নেই৷ ইন্টারনেটও থাকছে না বেশিরভাগ সময়৷ তাই ফেসবুক ঘেঁটে সময় কাটানোরও উপায় নেই৷ দেবল তাই ঠিক করেছিল, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে৷ এমনিতেই ভোরবেলা বেরোতে হবে বলে রাতে ভালো ঘুম হয়নি৷ তাই একটা লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেওয়াই ভালো৷ কালকের দিনটা পেরোলেই তো আবার সোমবার থেকে অফিসের কাজে জুতে যেতে হবে৷ নগেনদা আজ আসতে বারণ করেছিল ঠিকই কিন্তু দেবলের অফিস যে ছুটি দিতে রাজি নয় সেটা আর জানবে কী করে৷ যদিও নগেনদা কেন আসতে বারণ করেছিল, কেন হঠাৎ আজকের দিনটা ভালো নয় বলছিল বারবার, সেটা দেবলের মাথায় ঢোকেনি৷ রাতে খাওয়ার সময় কথাটা জিজ্ঞাসা করবে ভেবেও ভুলে গেছিল৷

রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা ঘরেই৷ ডিমের কষা, আলুর চোখা আর রুটি৷ খাটের পাশের ছোট টেবিলটায় খাবার গুছিয়ে দিয়েছিল নগেনদা৷ ভারী কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে, ঘরের কুঁজোটা ভর্তি আছে কীনা দেখে নিয়েছিল৷ তারপর বিছানাটা একটু ঝেড়েঝুড়ে দিয়ে, মশারি খাটিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ বলল, খাওয়া সেরে শুয়ে পোড়ো৷ বাসন-কোসন এখানেই থাক৷ সকালে আমি নিয়ে যাব৷ জানলা-দরজা বন্ধ করে শোবে কিন্তু৷ আর শোনো আমি ছাড়া অন্য কেউ ডাকলে সাড়া দিও না যেন৷

তুমি ছাড়া আর কে ডাকবে? আর কে এবাড়িতে আছে শুনি?

অত জানিনা বাপু৷ যা বললাম মনে রেখো৷ দিনটা খারাপ৷ আজ আসতে বারণ করেছিলাম৷ সেকথা তো শুনলে না৷ এখন বড় ঘড়িতে তেরোটার ঘণ্টা না পড়লেই বাঁচি৷

কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নগেনদা৷ আর এই তেরোটার ঘণ্টা, কথাটা শুনেই মাথার মধ্যে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল দেবলের৷ আশ্চর্য এই ঘটনাটা তো সে জানত৷ নগেনদাই বলেছিল একদিন৷ জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নিষ্ঠুরতার গল্প৷

পরপর দুবছর অজন্মা হয়েছিল নয়নপুরে৷ ক্ষেতের ফসল জ্বলে গেছে৷ মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে৷ সেই সুযোগে চড়া সুদে টাকা ধার দিয়েছিলেন জমিদার৷ প্রজারাও বাধ্য হয়েছিল নিতে৷ দুবছর পরে যখন ধান হল, তখন জমিদার জানিয়ে দিলেন সুদে আসলে সেই ধারের টাকা শোধ করতে হবে প্রজাদের৷ ফসল কেউ ঘরে তুলতে পারবে না৷ সব ফসল তুলে দিয়ে আসতে হবে জমিদারের গোলায়৷ প্রজারা রাজি নয়৷ তারা ঠিক করেছে গোপনে রাতের অন্ধকারে ফসল কেটে নিয়ে যাবে৷ তারপর দরকার হলে সবাই মিলে নিজেদের গোলা পাহারা দেবে৷ প্রজারা যে এরকম মতলব আঁটছে সেখবর পৌঁছে গেছিল জমিদারবাবুর কানেও৷ গরীব চাষীদের এতবড় দুঃসাহস তিনি কী করে মেনে নেবেন? তাই তাদের জব্দ করতে এক ভয়ানক পরিকল্পনা করলেন জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী৷ নিজের সব লাঠিয়ালকে চুপিচুপি ডেকে পাঠালেন জমিদার বাড়িতে৷ ঠিক হল রাতের অন্ধকারে তারা গিয়ে চাযীদের গোটা পাড়া ঘিরে ফেলবে৷ তাদের সঙ্গে থাকবে নায়েবমশাইও৷ জমিদারবাড়ির বিশাল গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক তখন প্রতি ঘণ্টায় ঢংঢং করে বেজে সময় বলত৷ বহুদূর থেকে শোনা যেত সেই ঘণ্টার আওয়াজ৷ অমাবস্যার রাতে পরিকল্পনা মতো লাঠিয়ালরা ঘিরে ফেলল চাষীদের পাড়া৷ ঘড়ি মেরামতিতে দক্ষ রামেন্দ্রনারায়ণ এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন যাতে ঠিক রাত বারোটায় ঘড়িতে তেরোটা ঘণ্টা পড়বে৷ আর এই তেরো নম্বর ঘণ্টার শব্দ শোনামাত্রই সব লাঠিয়ালরা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যাতে চাষীরা তৈরি হওয়ার কোনও সময় না পায় এমনকী পালিয়ে যেতেও না পারে৷ সবাইকে মেরে, বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে আসবে লাঠিয়ালরা৷ জোয়ান-মদ্দ-বুড়ো-বাচ্চা কাউকে রেয়াত করা হবে না৷

পরিকল্পনামাফিক কাজ হল৷ পুড়ে খাক হয়ে গেল চাষীদের পাড়া৷ অসংখ্য মানুষ মারা গেল৷ পুলিশ এসে জমিদারের বাড়িতে চা-জলখাবার খেয়ে চলে গেল৷ কোনও বিচার হল না৷ অপরাধীও ধরা পড়ল না৷ সবকিছুই আবার আগের মতো চলতে লাগল৷ কিন্তু সেই গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক বন্ধ হয়ে গেল৷ তাতে আর ঘণ্টাও পড়ে না, কাঁটাও নড়ে না৷

তার কিছুদিন বাদে একদিন জমিদারবাবু তাঁর ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেট দিয়ে বেরোচ্ছেন এমন সময় পথ আটকে দাঁড়াল এক পাগল বুড়ি৷ হাওয়ায় তাঁর পাকা চুল এলোমেলো উড়ছে৷ দু-চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে আগুন৷ জমিদারের মুখের সামনে আঙুল তুলে সে বলল, মনে করিস না তুই রেহাই পাবি৷ তারা সবাই আসবে৷ আবার আসবে৷ যেদিনে তাদের মেরেছিস সেইদিনেই ফিরে আসবে তারা৷ সেদিন তুইও রক্ষা পাবি না, তোর বংশের কেউ রক্ষা পাবে না….

গেটের পাহারাদাররা তক্ষুনি বুড়িকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল ঠিকই৷ কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরেই জ্বর আসে রামেন্দ্রনারায়ণের৷ জ্বরের ঘোরে সারাক্ষণ নাকি ভুল বকছিলেন৷ কোনও ওষুধ কাজ করেনি৷ সেই জ্বরেই তিনদিনের মাথায় মারা যান রামেন্দ্রনারায়ণ৷

গল্পটা নগেনদা বলেছিল দেবলকে৷ আর এটাও বলেছিল, সেই দিনটা নাকি ছিল কার্তিক মাসের অমাবস্যা৷ সে বছর নাকি কোনও একটা মাসে দুটো অমাবস্যা পড়েছিল৷ তাই কার্তিকের ওই দিনটি ছিল বছরের অষ্টম অমাবস্যা৷ নগেনদার কেমন একটা ধারণা ছিল, কার্তিক মাসে, অষ্টম অমাবস্যায় যদি বড় ঘড়িতে তেরোটার ঘণ্টা পড়ে, তাহলে সেই পুড়ে মরে যাওয়া চাষীদের প্রেতাত্মারা জেগে উঠে এই জমিদারবাড়িতে হানা দেবে প্রতিশোধ নিতে৷

মাসটা যে কার্তিক সেটা দেবল জানে৷ কিন্তু পূর্ণিমা-অমাবস্যা তো আর খেয়াল রাখা সম্ভব নয়৷ মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেবল দেখল ইন্টারনেট রয়েছে৷ গুগুল-এ সার্চ দিতেই বোঝা গেল রাতটা অমাবস্যার৷ আর শ্রাবণে দুটো অমাবস্যা পড়েছে৷ তাই বৈশাখ মাস থেকে ধরলে এটাও বছরের অষ্টম অমাবস্যা৷ সবটাই একজন অশিক্ষিত মানুষের মনগড়া গল্প, জানে দেবল৷ তবুও সবই কেমন যেন মিলে যাচ্ছে দেখে শিরদাঁড়ার কাছটা শিরশির করে উঠল একটু৷ মনটা ঘোরানোর জন্য মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল ইন্টারনেট চলে গেছে আবার৷ ঠান্ডা নেই তেমন৷ তবু জানলাগুলো বন্ধই করে দিল৷ ঠিক করল আলোটা নেভানোর দরকার নেই৷ এমনিতেই যেরকম নিভু নিভু আলো৷ ঘুমোতে অসুবিধা হবে না৷ কিন্তু মশারির ভিতর ঢুকে বালিশে মাথা রাখতেই দুবার দপদপ করে নিভে গেল আলোটা৷ মুহূর্তের মধ্যে জমাট বাঁধা কালো অন্ধকার যেন চারপাশ থেকে চেপে ধরল দেবলকে৷ সঙ্গে অদ্ভুত কানে তালা ধরা নৈঃশব্দ৷ একটা ঝিঁঝিঁর ডাকও কোথাও শোনা যাচ্ছে না৷ প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করে দেবল৷ একটু যেন ঝিমুনিও এসেছিল৷ কিন্তু হঠাৎ একটা প্রবল অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল৷ রাত কটা বোঝার জন্য অভ্যাসে বালিশের পাশে হাতড়ে দেখল, মোবাইল জ্বলছে না৷ অথচ চার্জ যে ছিল সে একটু আগেও দেখেছে৷ ঘর আগের মতই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার৷ কিন্তু দেবল স্পষ্ট বুঝতে পারছিল অতীতের পাতা উল্টে রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর জমিদার বাড়ি জেগে উঠেছে৷ গোপন ষড়যন্ত্রের ফিসফাস শোনা যাচ্ছে দেওয়ালের ওপারে৷ কারা যেন হেঁটে যাচ্ছে সতর্ক পায়ে৷ কথা বলছে চাপা গলায়৷ লাঠি-সড়কির ঠোকাঠুকির অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছে৷ ঠিক দেবলের ঘরের সামনে দিয়ে কে যেন খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল দরজার সামনে৷ নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছে দেবল৷ না, পায়ের আওয়াজ এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে৷ নীচের তলায় অনেক মানুষের অস্পষ্ট অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে৷ লোহার ওপর ঘষটানোর মৃদু আওয়াজ৷ সাবধানে সিংদরজা খুলে কারা যেন বেরিয়ে গেল৷ গোটা বাড়িটা দমবন্ধ করে কী এক সর্বনাশের জন্য অপেক্ষা করছে৷ কান খাড়া করে বিছানায় শুয়ে আছে দেবলও৷ হঠাৎ রাতের অন্ধকারের সব নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের ঘণ্টা বাজতে শুরু করল৷ ঢং ঢং ঢং৷ এক, দুই, তিন গুণছে দেবল৷ পাঁচ, ছয়, সাত…প্রতিটি ঘণ্টার শব্দ যেন চারপাশের পৃথিবীটাকে ঠেলে দিচ্ছে একটা অন্ধকার গহ্বরের দিকে৷ আট, নয়, দশ…ঘন্টার শব্দে জেগে উঠছে প্রেতলোকের প্রহরীরা৷ অবয়ব পাচ্ছে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া মানুষ৷ যে কোনও সময় খুলে যাবে মৃত্যুপুরীর দরজা৷ ঢং ঢং করে বারোটার ঘণ্টা বেজে থামল ঘড়ি৷ পর কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ৷ দমবন্ধ অপেক্ষা৷ তারপরেই আবার নড়ে উঠল পেন্ডুলাম৷ তেরোটার ঘণ্টা ঘোষণা করল অশনি সংকেত৷ একটা বিকট চিৎকার যেন ভেসে এল অন্ধকারের সমুদ্র থেকে৷ আতঙ্কে বিছানায় উঠে বসল দেবল৷ সব জানলা বন্ধ৷ কিন্তু তবু সে স্পষ্ট দেখতে পেল আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে ফেলছে অনেকগুলো বাড়িকে৷ দাউ দাউ করে জ্বলছে খড়ের চাল৷ প্রাণপণে ছুটে পালাতে গিয়ে ছিটকে পড়ছে মানুষ৷ আর্তনাদ করতে করতে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে৷ এসবই দেবলের জানা৷ কিন্তু একি একি! দেবলের দৃষ্টির সামনেই আর্তনাদ করতে করতে হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়াতে লাগল মানুষগুলো৷ তাদের গোটা গায়ে আগুন৷ একদল জ্বলন্ত মানুষ ছুটে আসছে৷ দেবল জানে, তারা ছুটে আসছে জমিদার বাড়ির দিকেই৷ বহু যুগ আগে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসছে মানুষগুলো৷ জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর ওপর প্রতিশোধ নেবে তারা৷ দেবলের শরীরেও বইছে সেই বংশেরই রক্ত৷ তাই রেহাই নেই তারও৷ এখনই পালাতে হবে তাকে৷ কিন্তু কোথায়? আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে দেবলের৷ মাথা কাজ করছে না৷ দরজায় ঠক ঠক শব্দ৷ নগেনদার গলা৷ দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে দেবল৷ আতঙ্কে দু-চোখ বিস্ফারিত নগেনদার, ওরা আসছে৷ এসে যাবে এক্ষুনি৷ পালাও তুমি৷ তোমাকে ছাড়বে না ওরা….

দেবলের হাত ধরে টানছে নগেনদা৷ ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নামে দুজনে৷ জ্বলন্ত মানুষগুলো পৌঁছে গেছে গেটের কাছে৷ গেট ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছি সবাই মিলে৷ যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে যাবে ঝুরঝুরে ফটক৷ দেবলকে সঙ্গে নিয়ে নগেনদা ছুটছে বাড়ির পিছনদিকে৷ গেট ভেঙে পড়ার শব্দ৷ স্রোতের মতো ঢুকে আসছে জ্বলন্ত মানুষের দল৷ দেবলকেও দেখতে পেয়ে গেছে তারা৷ ছুটে আসছে এদিকেই৷ পিছিয়ে গেছে নগেনদা৷ হাঁফিয়ে গেছে৷

পালাও পালাও, মাজারে যাও, হাসেম ফকিরের কাছে….

কোনওরকমে কথা কটা বলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল নগেনদা৷ পাগলের মতো ছুটছে দেবল৷ লোকগুলো কাছে এসে গেছে৷ যে কোনও সময় ধরে ফেলবে তাকে৷ তারার আলোয় মাজারের খড়ের চালাটা দেখতে পেয়ে প্রাণপণে ছুটে ভিতরে ঢুকে কোনওরকমে বেদিটা আঁকড়ে লুটিয়ে পড়ল দেবল৷ জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য শুধু দেখতে পেল দুহাত ওপরে তুলে, তার শরীরটাকে আড়াল করে এসে দাঁড়িয়েছেন এক ফকির৷ তাঁকে দেখে থমকে গেছে জ্বলন্ত মানুষের দলটা৷

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে নয়নপুরের জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি৷ বাড়ির সব আসবাব, রামেন্দ্রনারায়ণের ছবি, গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক সবই পুড়ে খাক হয়ে গেছে৷ শেষ মুহূর্তে পালাতে পেরেছিলেন বলে বেঁচে গেছেন দেবল চৌধুরী৷ তবে বাড়ির পুরোনো চাকর নগেন সূত্রধর পুড়ে মারা গেছেন৷

খবরটা স্থানীয় সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল৷ মানিকবাবু অবশ্য বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত বদলাননি৷ তবে জমিদারবাড়ি মেরামত করে হাভেলির ধাঁচে রিসর্ট বানানোর পরিকল্পনা তাঁকে বাদ দিতে হয়েছে৷ দেবল তাঁকে দিয়ে শুধু একটিই শর্ত দিয়েছে৷ মাজার আর তার চারপাশের এককাঠা জমি সে বেচবে না৷ সেখানে হাসেম ফকিরের কবরের পাশে রামেন্দ্রনারায়ণের অত্যাচারে মৃত নয়নপুরের চাষীদের স্মৃতিতে একটা সুন্দর শ্বেতপাথরের ফলকও সে লাগিয়ে দিয়েছে৷

সমাপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *