এমন ঘোর বর্ষায় বেড়াতে যাওয়া! বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যে শুনছে আঁতকে উঠছে৷
কিন্তু রমিত আর দীপকের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই৷ তাদের মতে, অনেক চেষ্টায় যখন দুজনে একসঙ্গে ছুটি পেয়েছে তখন যাবেই৷ ওসব বর্ষা, বৃষ্টি কোনও ব্যাপারই নয়৷ দেখার যদি চোখ থাকে আর মনে যদি ফুর্তি থাকে, তাহলে সব কোনও ঋতুতেই প্রকৃতিদেবীর দাক্ষিণ্যে ঘাটতি পড়ে না৷
দীপক আর রণিত এক কথায় অভিন্নহৃদয় বন্ধু৷ ভবানীপুরে মুক্তদলের কাছে এক পাড়ায় পাশাপাশি গলিতে বাড়ি৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, খেলাধুলো সব একসঙ্গে৷ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রণিত এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরিতে ঢুকেছে৷ দীপক গবেষণা করছে৷ তার আবার একটু-আধটু লেখা-লিখিরও অভ্যাস আছে৷ তবে অন্য সব কাজের ফাঁকে বছরে অন্তত বার দুয়েক রুকস্যাক ঘাড়ে নিয়ে দুই বন্ধুর একসঙ্গে বেরিয়ে পড়াটাও অনেকদিনের অভ্যাস৷ কিন্তু গত একবছর ধরে কিছুতেই আর সুযোগ হচ্ছিল না৷ রণিতের নতুন চাকরি৷ ছুটি পাওয়া মুশকিল৷ দীপকের বাড়িতে নানা ঝামেলা চলছিল৷ তাই এতদিন পরে যখন দুজনের সময় মিলেছে, তখন আর দেরি নয়৷ পরপর কয়েকবার পাহাড় হয়েছে৷ এবার তাই সমুদ্র৷ বর্ষায় গোয়া৷
তবে দীপক আর রণিতের বেড়াতে যাওয়াটা ঠিক আম-টুরিস্টের মতো হয় না৷ প্রথমে তারা কোনও একটা পরিচিত নাম-ডাকওলা টুরিস্ট স্পটে যায় ঠিকই৷ কিন্তু তারপর সেখানে থেকেই খোঁজ করে আশপাশের কোনও অজানা সুন্দরীর৷ এমনি করে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে ওরা সন্ধান পেয়েছিল চটকপুরের৷ শিলং গিয়ে আসলে বেশি সময় কাটিয়েছিল বড়াপানিতে৷
এবারের বেড়ানোটাও যে আলাদা কিছু হবে না, সেটা ঠিক হয়ে গেছিল আগেই৷ মাণ্ডবী নদীর ধারে গোয়ার রাজধানী প্যানজিম বা পানাজিতে হোটেল বুক করা আছে৷ প্রথম দিন গিয়ে ওঠা হল সেখানেই৷ সেদিনটা পানাজি ঘুরে দেখার পাশাপাশি নতুন জায়গার খোঁজও চলল৷ শেষ পর্যন্ত হোটেলের মালিকই দিলেন সন্ধান৷ কুলু নদীর মোহনায় তেরাখোল দুর্গ৷ পানাজি থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের পথ৷ ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিও চমৎকার৷ মাঝে মাঝে দু-একটা ছোট নদী বার্জে চড়ে পেরোতে হয়৷ তবে মুশকিল একটাই৷ পর্তুগিজদের তৈরি তেরাখোল দুর্গ এখন একটা বেশ দামি হোটেল৷ আর ওই হোটেল ছাড়া ওখানে থাকার আর কোনও জায়গা নেই৷ তবে বর্ষাকালে টুরিস্ট কম৷ তাই ঘর পাওয়া যেতেই পারে৷ থাকতে পেলে পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র মিলিয়ে তেরাখোল একেবারে জমজমাট৷ না হলে অবশ্য তিনঘণ্টার রাস্তা উজিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে পানাজিতে৷
শুনে তো দুই বন্ধুর আর তর সইছে না৷ গোয়াতে মোটরবাইক ভাড়া পাওয়া যায়৷ চালাতে পারে দুজনেই৷ রাস্তাও ভালো৷ তাই পরের দিনই হোটেলের মালিকের কাছ থেকে সব খোঁজখবর নিয়ে ব্যাগ কাঁধে সকাল সকাল বাইকে চড়ে বেরিয়ে পড়ল দুজনে৷ দুপুরের আগেই পৌঁছেও গেল৷
গোয়া আর মহারাষ্ট্রের সীমানার খুব কাছেই তেরাখোল৷ কুলু নামের একটা ছোট্ট নদী এখানে এসে আরবসাগরে মিশেছে৷ সেই মোহনার ধার থেকেই উঠে গেছে পাহাড়৷ আর তারই মাথায় তেরাখোল দুর্গ৷ আরব সাগরের ঢেউ যেন প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে পাহাড়টাকে৷ কিন্তু প্রতিবারই পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে যাচ্ছে অজস্র সাদা ফেনায়৷ আর পাহাড়ের মাথায় ঠিক যেন রাজার মুকুটের মতোই বসে আছে দুর্গটা৷ কুলু নদী পেরোনোর সময় বার্জের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দূর থেকে দুর্গটাকে দেখে ভারী পছন্দ হয়ে গেল দীপক আর রণিত দুজনেরই৷
ভাগ্যদেবী সহায়৷ হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে জানা গেল, একটিমাত্র ঘর খালি আছে৷ তবে সেটা সমুদ্রমুখো নয়৷ পিছন দিকে, মানে জঙ্গলমুখো৷ তাই-ই সই৷ চটপট সই-সাবুদ সেরে জিনিসপত্র নিয়ে দুই বন্ধু চলল ঘরের দিকে৷
হোটেলের ভিতরটা বেশ অন্যরকম৷ দুর্গের স্বাভাবিক গঠন যথাসম্ভব না বদলে ব্যবস্থা হয়েছে অতিথিদের থাকার৷ তাই সরু সরু গলি পথ, বাঁক, খাড়া সিঁড়ি সবই আছে৷ আবার ঘরের ভিতরে সম্পূর্ণ আধুনিক ব্যবস্থা৷ ঘরও অপছন্দের কিছু নয়৷ সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না ঠিকই৷ কিন্তু জানলা খুললেই চোখে পড়ে দুর্গের প্রাচীর৷ তার পিছনে নিবিড়, সবুজ জঙ্গল৷ ঘোর বর্ষা সব গাছ-লতা-পাতা ফনফনিয়ে বেড়ে চারপাশটাকে যেন বেড় দিয়ে ধরেছে৷ ঘর দেখাতে এসেছিল যে ছেলেটি সে অবশ্য বলল, জঙ্গল দেখে যতটা ঘন মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়৷ আর হিংস্র জন্তু-জানোয়ারও মোটেই নেই৷ ওপাশে মারাঠিদের গ্রাম আছে৷ সেখানকার মানুষজন এই জঙ্গলের পথ দিয়েই যাতায়াত করে৷
হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু আসার সময়ই দেখা গেছিল সমুদ্রের মাথায় ক্রমশ ঘন হচ্ছে কালো মেঘের দলবল৷ এক কাপ চা খেতে না খেতেই নামল মুষলধারে বৃষ্টি৷ একটাবেলা পুরো মাটি৷ বিকেলে বৃষ্টি থামলে বেরোল দুজনে৷ পায়ে হেঁটে একটু চারপাশটা দেখে আসার ইচ্ছা৷ পাহাড়ী পথে বাঁক নিয়ে কিছুটা নামতেই দেখে পাথরের ওপর বসে আছে এক বুড়ো৷ পরনে ঢোলা প্যান্ট আর তাপ্পি মারা জামা৷ মাথায় টুপি৷ তাদের দেখেই বেশ পরিষ্কার ইংরাজিতে বলল, আমাকে যদি দশটা টাকা দাও, তাহলে আমি তোমাদের একটা সুন্দর গোয়ান কবিতা শোনাতে পারি৷
আমরা কবিতা শুনতে ভালোবাসি না৷ গম্ভীর গলায় বলল রণিত, ঠিক আছে৷ দশ টাকা দিলে আমি তোমাদের একটা সুন্দর গোয়ান গানও শোনাতে পারি৷
আমাদের গান শুনতে এখন ইচ্ছে করছে না৷ নির্লিপ্ত গলায় ফের বলল রণিত৷
কিন্তু বুড়ো ছাড়ার পাত্রই নয়৷ ফের বলল, নো প্রবলেম৷ কুড়ি টাকা দিলে আমি তোমাদের এই ফোর্টের গল্পটা শোনাতে পারি৷ সেটা কিন্তু এখানকার খুব কম লোকই জানে৷ আমি ছোটবেলায় আমার ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি৷ সহজে কাউকে শেয়ার করি না৷ তবে তোমাদের দেখে ভালো লোক মনে হচ্ছে৷ তাই বলতেই পারি৷ তবে কুড়ি টাকা লাগবে কিন্তু….
রণিত খেঁকিয়ে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দীপকের ততক্ষণে মজা লেগে গেছে৷ তাই বন্ধুকে থামিয়ে বলল, ঠিক আছে, রাজি৷ কুড়ি টাকা দেবো৷ গল্পও শুনবো৷ কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তো আর গল্প শোনা যাবে না৷
এখানে বলব কেন৷ আমরা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসব৷ ঢেউ এসে তোমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে যাবে৷ আর পাহাড়ের ওপর দুর্গের পিছনে একটু একটু করে সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখতে দেখতে আমার গল্প শুনবে৷ সব কিছু উপভোগ করার জন্য একটা অ্যামবিয়েন্স লাগে বুঝলে ইয়ংম্যান৷ সেটা না হলে মজাটা পুরো হয় না৷ তবে সমুদ্রের ধারে যাওয়ার সময় নিচের ঝুপড়িতে বলে যেও৷ ওরা আমাদের তিনজনের জন্য চা পাঠিয়ে দেবে৷ ওটা অ্যানির দোকান৷ ও বাড়িতে খুব ভালো বিস্কুটও বানায়৷
বুড়ো মহা চালাক৷ মনে মনে ভাবল দীপক৷ শুধু যে কুড়ি টাকা নেবে তা নয়, আমাদের ঘাড় ভেঙে চা-বিস্কুটও খাবে৷ রণিত তো গজগজ করছে, শুধু শুধু কুড়িটা টাকা গচ্চা…
আরে ছাড় না৷ কুড়ি টাকাই তো৷ এইসব লোকাল লোকজনের কাছে অনেকরকম গল্পের স্টক থাকে৷ শুনেই দেখি বুড়ো কী বলে৷ আর এখন তো সন্ধে হয়ে আসছে৷ এমনিতেও আজ আর বিশেষ কোথাও যাওয়া যাবে না৷
চা-এর অর্ডার দিয়ে সমুদ্রের ধারে বালিতে গিয়ে বসে তিনজনে৷ মাথা থেকে টুপিটা খুলে পাশে রেখে বুড়ো বলতে শুরু করে, সে অনেক বছর আগের কথা৷ গোয়াতে তখন পোর্তুগিজদের রাজত্ব৷ এই দুর্গের কেল্লাদারও ছিলেন এক পোর্তুগিজ, নাম রোবার্তো গঞ্জালেস৷ কেল্লাদারের চেহারাটি যেমন বিশাল মানুষটিও তেমনি নিষ্ঠুর৷ দুর্গের চাকর-বাকর, সেপাই-শান্ত্রী সবাই তাকে যমের মতো ভয় করত৷ কথায় কথায় চড়, থাপ্পড় থেকে শুরু করে চাবুক চালাতেও তার কোনও দ্বিধা ছিল না৷ কেল্লাদারের অত্যাচারের হাত থেকে আশপাশের গ্রামের মানুষজনও রেহাই পেত না৷ লোকজন নিয়ে গিয়ে গ্রাম লুঠ করা ছিল রোবার্তোর কাছে একটা খুব আমোদের বিষয়৷
কেল্লার অন্য মানুষজন কিন্তু রোবার্তোর এরকম অত্যাচার মোটেই পছন্দ করত না৷ কিন্তু তাদের কিছু করার সাহস ছিল না৷ এদের মধ্যেই ছিলেন দমিনিক লোবো৷ ফর্সা ছিপছিপে ছোটখাটো মানুষ৷ পেশায় চিকিৎসক৷ নানারকম গাছ-গাছড়া থেকে ওষুধ তৈরি করতেন৷ শুধু কেল্লার লোকজনের নয়, অসুস্থ হয়ে যে তাঁর কাছে আসত, তারই তিনি চিকিৎসা করতেন৷ ব্যাপারটা কেল্লাদারের ভালো লাগত না মোটেই৷ কিন্তু সেসময় তো যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত৷ তাই কেল্লায় একজন চিকিৎসক থাকা খুব জরুরি ছিল৷ অপছন্দ হলেও তাই রোবার্তো সহ্য করতেন দমিনিককে৷
দমিনিক তাঁর কাজের প্রয়োজনেই মাঝে মাঝে জঙ্গল পেরিয়ে আশ- পাশের মারাঠি গ্রামগুলোয় চলে যেতেন৷ বিশেষ করে পাশেই কুণ্ডা গ্রামে থাকতেন এক বৃদ্ধ কবিরাজ৷ তাঁর সঙ্গে দমিনিকের বেশ ভাব হয়ে গেছিল৷ নিয়মিত যাতায়াতের ফলে দমিনিক এই অঞ্চলের মানুষের ভাষাও অনেকটাই বুঝতে আর বলতে পারতেন৷ সেই কুণ্ডা গ্রামেরই ছেলে ছিল শিবা৷ তার সঙ্গেও দমিনিকের খুব ভাব হয়েছিল৷ দুজনে প্রায় সমবয়সী৷ শিবা দমিনিককে লাঠি খেলা শিখিয়েছিল৷ দমিনিক তাকে তরোয়াল চালাতে শিখিয়েছিলেন৷ শিবার বোন কুঙ্কু আবার দমিনিকের জন্য চমৎকার একখানা পাগড়িও বানিয়ে দিয়েছিল৷ সেই পাগড়ি পরে দমিনিক যেদিন কেল্লায় ফিরলেন সেদিন রোবার্তো মনে মনে দারুণ চটেছিলেন৷ এদেশি লোকজনের সঙ্গে এরকম মেলামেশা রোবার্তো একদমই পছন্দ করতেন না৷ বিশেষ করে শিবা তো ছিল তাঁর দু-চক্ষের বিষ৷
তখন থেকেই সুযোগ খুঁজছিল রোবার্তো৷ একদিন দমিনিক শহরে গেছেন, ফিরতে রাত হবে৷ বেশি দেরী হলে নাও ফিরতে পারেন৷ সেই সুযোগে দলবল নিয়ে রোবার্তো গিয়ে হানা দিল কুণ্ডা গ্রামে৷ তাদের লুঠপাট চালাতে দেখে তেড়ে এল শিবা৷ রোবার্তোর সঙ্গীরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি৷ তাই খুব সহজেই তারা শিবাকে বন্দি করে নিয়ে এল কেল্লায়৷ রোবার্তো জানিয়ে দিল, পরদিন সকালে ফাঁসি হবে শিবার৷ সন্ধ্যায় কেল্লায় ফিরে সবকথা শুনে চমকে উঠল দমিনিক৷ শিবাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রোবার্তোকে অনুনয়-বিনয়ও করলো৷ কিন্তু লাভ হল না কিছুই৷ রোবার্তো সাফ জানিয়ে দিল শিবা তার লোকেদের ওপর হামলা করেছে, তাই তাকে সে ফাঁসি দেবেই৷
রাত বাড়ছে৷ কেল্লায় নিজের ঘরে বসে ছটফট করছে দমিনিক৷ কী করে বন্ধুকে বাঁচাবে সে….
বুড়ো গল্প বলে চমৎকার৷ দীপক আর রণিত গল্পে এমন ডুবে গেছিল যে খেয়ালই করেনি, হাতির পালের মতো একটা মেঘের দল সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে এসে ঠিক তাদের মাথার ওপর দোল খাচ্ছে৷ বুড়ো কিন্তু ঠিক দেখেছে৷ তাই টুক করে টুপিটা মাথায় চাপিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হোটেলে ফেরো৷ জোর বৃষ্টি আসছে৷ এক্ষুনি ভিজে চুপ্পুড় হয়ে যাবে৷
কিন্তু গল্পের শেষটা শোনা হল না যে….
অবাক হয়ে বলল রণিত৷ বুড়ো ততক্ষণে দ্রুত পা চালিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেছে৷ রণিতের কথা শুনে থেমে গিয়ে কীরকম একটু অদ্ভুত হেসে বলল, তাতে কী আছে৷ তোমরাও তো দুই বন্ধু আজ রাতে ওই কেল্লায় থাকবে৷ গল্পের শেষটা নিজেদের মতো করে ভাবো না৷ তারপর কাল না হয় দেখব আমার গল্পের সঙ্গে তোমাদের গল্প মেলে কীনা৷
কথাগুলো শেষ করেই রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল বুড়ো৷ আর তাকে দেখাই গেল না৷ প্রায় ছুটতে ছুটতে হোটেলে ফিরল দীপক আর রণিত৷ ফিরতে না ফিরতেই বৃষ্টিও নামল মুষলধারে৷ আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা থাকায় দিনের আলোও ফুরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি৷ এদিকে অন্ধকার একটু গাঢ় হওয়ার পরই কারেন্ট চলে গেল৷ হোটেলের অবশ্য নিজস্ব জেনারেটর আছে৷ সেটি চালু হতে সব না হলেও কিছু কিছু আলো জ্বলে উঠল আবার৷ তবে তাতে পুরোন কেল্লার অন্ধকার পুরোটা কাটল না৷ একটু পরে রিসেপশন থেকে ফোন করে দীপকদের বলল যে এরকম বৃষ্টি বাদলা হলে যদি কারেন্ট চলে যায়, তাহলে সাধারণত সারা রাতে আর ফেরে না৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে গোটা রাত তো আর জেনারেটর চালানো সম্ভব নয়৷ তাই সবাইকে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হবে, যাতে সব কাজ হয়ে গেলে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া যায়৷
হোটেলের ডাইনিং হলে সব অতিথিদের ডিনার সারা হয়ে গেল রাত দশটার মধ্যেই৷ চমৎকার গোয়ানিজ পদের ডিনার৷ দীপক আর রণিত তো খেয়ে মহা খুশি৷ ঘরে ফিরে জুত করে বসে গল্প করতে করতেই জেনারেটর বন্ধ হয়ে গিয়ে গোটা হোটেল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল৷ বেয়ারারা অবশ্য কয়েকটা মোমবাতি দিয়ে গেছিল৷ কিন্তু সেগুলো না জ্বেলেই বসে গল্প করছিল দুজনে৷ ঘর অন্ধকার৷ মস্ত খোলা জানলার ওপাশে আরও ঘুটঘুটে অন্ধকার জঙ্গল৷ তবে গরম নেই মোটেই৷ বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় বরং একটা বেশ শীত শীত ভাব৷ হঠাৎ দীপক বলে উঠল, দ্যাখ রণিত, চারপাশটা দেখে মনে হচ্ছে না যে আমরা সেই রোবার্তো আর দমিনিকের সময়েই ফিরে গেছি৷
যা বলেছিস৷ মনে হচ্ছে যেন ওই জঙ্গলের ওপাশেই কুণ্ডা গ্রাম৷ কুপি জ্বলছে৷ বর্ষার মধ্যে দরজার আগল টেনে দিয়ে শিবা আর কুঙ্কু শোয়ার আয়োজন করছে৷
কিন্তু দীপক, আমার কিন্তু বুড়োর কথাবার্তা একটু অদ্ভুত লাগছিল৷ বুড়ো যেন সবটা বলছে না৷ কেমন যেন একটা রহস্যের ভাব৷ যেন কিছু কথা চেপে রাখছে৷
আরে ওসব হল টাকা নেওয়ার কৌশল৷ কাল দেখবি আবার গল্পের শেষটা বলার জন্য টাকা চাইবে৷ ওরকম ঢের দেখেছি আমি৷ তবে টাকা যখন দিতেই হবে, তখন আমি আর কষ্ট করে গল্পের শেষটা ভাবতে রাজি নই৷ তার থেকে চল, শুয়ে পড়ি৷ কাল ভোর ভোর উঠে বেরোব৷
রাত তখন কটা জানা নেই, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপকের৷ সময় দেখার জন্য অভ্যাসমত বালিশের পাশে রাখা মোবাইল হাতড়াতে গিয়ে দেখে মোবাইল নেই৷ মোবাইল খুঁজতে গিয়ে ঘুমের ঘোরটা কেটে যায় দীপকের৷ কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে চমকে উঠে বসে সে৷ একী, ঘরটা এমন অন্যরকম হয়ে গেল কী করে! দুটো খাটের বদলে এখন একটা খাট৷ ঝালর লাগানো মশারি৷ রণিত কোথায় গেল? তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে যায় দীপক৷ এক ছিপছিপে চেহারার পর্তুগিজ যুবকের উদ্বিগ্ন মুখ৷ পরনে ফ্রিল দেওয়া জামা আর পাতলুন৷ নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সেই যুবক৷ দুর্গের সংকীর্ণ গলিপথ ধরে এগোয়৷ একটা ঘর থেকে প্রবল নাক ডাকার আওয়াজ আসছে৷ হালকা হাতে সেই ঘরের দরজায় চাপ দিতেই দরজা খুলে যায়৷ ভিতরে খাটে শুয়ে কেউ একজন ঘুমোচ্ছে৷ তার ঘরঘর নাক ডাকার আওয়াজই শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকে৷ চোখে দেখতে না পেলেও কেল্লাদার রোবার্তোকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না দীপকের৷
একটু অপেক্ষা করে সেই যুবক৷ তারপর বিড়াল পায়ে এগিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো আংটা থেকে একটা বড় চাবি বার করে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাবধানে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়৷ চাবিটা হাতে নিয়ে এগোয় সামনের দিকে৷ বেশ কয়েকটা বাঁক পেরিয়ে একদিকে নিচে নামার সিঁড়ি৷ অন্ধকারেই অনায়াসে সিঁড়ি বেয়ে নেমে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ায় সে৷ চাবি দিয়ে খুলে ফেলে দরজায় লাগানো মস্ত তালা৷ দরজা খুলে যেতেই লাফিয়ে ওঠে রণিত, দমিনিক, তুমি কী করে এলে?
চুপ কথা বোলো না৷ বৃষ্টির রাত৷ রক্ষীরা সব আকণ্ঠ পানভোজন করে অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ এই সুযোগে তোমাকে পিছনের দরজা দিয়ে বার করে দেব৷
কিন্তু দুর্গ প্রাকারে প্রহরী থাকবে তো?
দেখতে পাবে না৷ এই প্রবল বৃষ্টিতে তারাও নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে ঢুকেছে৷
কিন্তু দমিনিক, তোমার কী হবে? রোবার্তো ঠিক বুঝতে পারবে, তুমিই আমাকে ছেড়ে দিয়েছো৷ ওরা তোমাকে বন্দি করে রাখবে৷ তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে চলো৷
তা হয় না শিবা৷ এরা আমার জাতভাই৷ আমাকে এদের সঙ্গেই থাকতে হবে৷ কিন্তু তুমি তাড়তাড়ি করো৷ প্রহরীরা জেগে গেলে তোমাকে আর বাঁচাতে পারব না৷
শিবা একটু ভাবল, তারপর বলল, তুমি শুধু ভোর হওয়া পর্যন্ত সাবধানে থেকো৷ সূর্যের আলো ফুটলেই আমি গ্রামের ছেলেদের নিয়ে আসব তোমাকে উদ্ধার করতে৷ কেল্লাদারকে কেউ পছন্দ করে না৷ রোবার্তো আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেলে সবাই তোমাকেই কেল্লাদার মানবে৷
দুজনে নিঃশব্দে উঠে এল ওপরে৷ খুব সাবধানে পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে দমিনিক শিবাকে নিয়ে এল দুর্গের পিছনদিকে যে খিড়কির দরজা আছে সেখানে৷ এই দরজায় তালা দেওয়া থাকে না৷ কিন্তু বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে দুজনেই৷ দরজা খুলতে গিয়ে দমিনিকের হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল লোহার খিল৷ মুহূর্তে জেগে গেল রক্ষীরা৷ ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছেন দমিনিক৷ শিবাকে ঠেলে দরজার বাইরে বার করে দিয়ে বলল, পালাও শিবা পালাও৷ আমার ভাবনা ভেবো না….
বিদ্যুৎগতিতে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল শিবা৷ রক্ষীরা ছুটে এসে ধরে ফেলল দমিনিককে৷ এদিকে চীৎকার, চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে রোবার্তোরও৷ কিন্তু তিনি তো ঘর থেকে বেরোতে পারছেন না৷ রক্ষীরা এসে উদ্ধার করল তাঁকেও৷ তখন মাথায় আগুন জ্বলছে রোবার্তোর৷
কেন ছেড়ে দিয়েছ তুমি বন্দিকে?
রোবার্তোর ক্রুর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে দমিনিক বলল, ও আমার বন্ধু৷ তুমি ওকে অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছিলে৷ সেজন্যই ছেড়ে দিয়েছি৷
কেল্লাদারের আদেশ অমান্য করেছ তুমি৷ এর শাস্তি মৃত্যু৷ কাল সকালেই ফাঁসি দেওয়া হবে তোমাকে৷
দমিনিককে বেঁধে রাখার আদেশ দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল রোবার্তো৷
ফাঁসিকাঠ তৈরি৷ তার পাশেই হাত-পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে দমিনিককে৷ পূবের আকাশ একটু ফর্সা হয়েছে৷ লালচে আভা দেখা যাচ্ছে দিগন্তে৷ দমিনিক বুঝতে পারছে, এই তার জীবনের শেষ সূর্যোদয় দেখা৷ আলো ফুটলেই রোবার্তোর হুকুম পালন করবে রক্ষীরা৷
হঠাৎ বাইরে কীসের গণ্ডগোল? শোনা যাচ্ছে বহু মানুষের একসঙ্গে চীৎকারের শব্দ৷ কেল্লার ফটক কারা যেন ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে৷ রক্ষীরা দৌড়াদৌড়ি করছে কেন? প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল কেল্লার দরজা৷ পিলপিল করে ছুটে আসছে অসংখ্য মানুষ….
ধড়মড় করে নিজের বিছানায় উঠে বসল দীপক৷ সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ৷ মেঘ কেটে গেছে৷ নরম রোদে ভেসে যাচ্ছে ঘর৷ জানলার বাইরে বৃষ্টি ভেজা ঝকঝকে সবুজ বন৷ পাশের খাটে বসে কীরকম যেন অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রণিত৷
তুই কি কোনও স্বপ্ন দেখলি?
বসে যাওয়া গলায় জানতে চায় দীপক৷ কেমন যেন অনিশ্চিতের মতো একটু সময় চুপ করে থাকে রণিত৷ তারপর মাথা নেড়ে বলে, দেখেছি৷ দমিনিক আর শিবার স্বপ্ন….
বেলা বেড়েছে৷ আজই পানাজিতে ফিরে যাবে ঠিক করে ফেলেছে দীপক আর রণিত৷ হোটেলের বিল মেটাতে গেলে ম্যানেজার বললেন, আজকের দিনটা থেকে গেলে পারতেন৷ আজ এখানে গ্রামে একটা খুব চমৎকার উৎসব হয়৷ আমরা হোটেলের বোর্ডারদের জন্য একটা স্পেশাল প্রোগ্রাম রাখি৷ সবাই মিলে ওখানে যাই, নাচ-গান দেখি, তারপর রাতে ফিরে পোর্টিকোতে ডিনার৷ গ্রামের ভোজসভায় যা রান্না হয়, তারই একটা থাকে স্পেশাল ডিশ৷ থাকতে পারতেন, ভালো লাগত৷
উৎসবটা কীসের? কোনও পুজো নাকি?
না না৷ এটা একেবারে অন্যরকম৷ ওরা বলে বন্ধুত্বের উৎসব৷ গ্রামের ছেলে শিবার সঙ্গে পোর্তুগিজ ডাক্তার দমিনিকের বন্ধুত্ব হয়েছিল৷ শিবাকে বন্দি করেছিল কেল্লাদার৷ তাকে বাঁচায় দমিনিক৷ কিন্তু সেই অপরাধে দমিনিককে যখন ফাঁসিতে ঝোলাতে যাচ্ছে কেল্লাদার, তখন শিবা দলবল নিয়ে তেরাখোল দুর্গ আক্রমণ করে৷ ভীষণ যুদ্ধ হয়৷ যুদ্ধে দমিনিক আর শিবা দুজনেই মারা গেছিল৷ আজকের দিনেই নাকি হয়েছিল সেই যুদ্ধ৷ তাই এই দিনটাকে ওরা বলে বন্ধুত্বের দিন৷
আমাদের জরুরি কাজ আছে পানাজিতে৷ আজকে ফিরতেই হবে৷ আপনি প্লিজ বিলটা সেটল করে দিন৷
দীপকের গম্ভীর গলা শুনে আর কথা না বাড়িয়ে বিল তৈরিতে মন দেয় ম্যানেজার৷ একটু পরেই টাকা-পয়সা সব চুকিয়ে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে মোটরসাইকেলে ওঠে দুই বন্ধু৷ কেল্লার গেট দিয়ে বেরিয়ে একটু এগোলেই বাঁক নিয়েছে রাস্তা৷ সেখানেই পাথরের ওপর বসে আছে টুপি মাথায় বুড়ো৷ তার দিকে একবারও না তাকিয়ে স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে যায় দীপক৷ মাথার টুপিটা খুলে পাশে রেখে, বুড়ো শুধু একটু অদ্ভুত হাসে৷
—