তেইল্যা চোরা – ৯

মুক্ত পৃথিবীতে আরো দুটি প্রাণির মধ্যে সখ্যতা হয়ে গেছে। একজন সদ্য বিধবা আরেকজন স্বজনহীন মাঝি। তাদের বুক ভরা মমতা, চোখ ভরা আকুতি কিন্তু মুখে কোনো ভাষা নেই। রোশনীর জট পাকিয়ে যাওয়া পাটের আঁশের মতো চুলগুলো সেই সখ্যতার জোরে তেলের ছোঁয়া পাচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতে দাগ হয়ে যাওয়া গালে চার আনায় কেনা সুগন্ধি পাউডারের ছোঁয়া লাগছে। চুলে বাঁধার জন্য ফিতা কিনে দিয়েছে নসু মাঝি, রোশনী ভান করে নিতে চায়নি। নসু জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে, অবশ্য জোর না করলেও চলতো। বিধবা নারী সেই ফিতা চুলে লাগিয়ে সাঁজতে পারে না, কিন্তু গভীর রাতে আমেনা ঘুমিয়ে গেলে, ফিতাগুলো চুলে বাঁধে, পুকুরের শান্ত জলে গিয়ে নিজেকে দেখতে চায়, অন্ধকার রাত্রিতে শুধু তার ছায়া দেখা যায়। আজকাল অকারণেই হাসে সে, কারণ ছাড়াই কাঁদে। সেদিন নৌকায় উঠার সময় নসু, হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। রোশনী ধরতে পারেনি, ভেতর থেকে কে যেন বাধা দিচ্ছিলো। নৌকায় বসে কাঁদছিল রোশনী। নসু মাঝি কষ্ট পেলো, রোশনীকে কষ্ট দিয়েছে বলে। হাত বাড়ানো তার স্পর্ধা হয়েছে, মনে মনে নিজেকে গালি দিলো নসু। রোশনী মাথা তুলে নসুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার হাত ধইরো না মাঝি, আমি অভাগী। তোমার সর্বনাশ হইবো।’

‘আমার সর্বনাশের আর কিছু বাকি নাই, সব সর্বনাশ আগেই হইছে।’

ঠিক তখনি নদীর পার ঘেসে খুব করুণ এক দৃশ্যের অবতারনা ঘটলো। খালি গায়ে লুঙ্গি পরা একটি লোক কলাপাতায় মুড়িয়ে একটি ছোটো লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পেছনে একটি মেয়ে, তার কোলে আরেকটি লাশ। মেয়েটি লাশের ভার বহন করতে পারছে না, মাঝেমধ্যেই থেমে শ্বাস টানছে। মাঝি লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নেমে গেল। মজিদকে নৌকায় বসিয়ে রোশনীও নেমে গেল। মেয়েটির হাত থেকে ছোটো লাশটি নিতে চাইলো নসু। মেয়েটি আঁতকে উঠে বলল, ‘ধইরো না, কলেরার মরা।’

মাঝি একটু থমকে গেল, তারপর একরকম জোর করেই লাশটি কোলে নিলো। দুই বছরের বাচ্চা, গায়ে কাফনের কাপড় জোটেনি, মায়ের পুরনো শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সামনের লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। দুই ছেলে এক বিছানায় মারা গেছে তার, কেউ এগিয়ে আসেনি, কলেরার মরা ছুঁয়ে মরবে নাকি? স্বামী-স্ত্রী মিলে কবর দিতে যাচ্ছিলো তাদের মানিকগুলো। মৃত্যুভয়হীন দুটি মানুষ অবাক করে দিয়ে তাদের সঙ্গী হলো। মেয়েটি লাশটি নসু মাঝির কোলে দিয়ে কোলছাড়া হলো, এতক্ষণে সে শোক করার অবসর পেলো। রোশনীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে চলল, তার কোলের সন্তানগুলোকে মাটি চাপা দিতে।

ফেরার সময় নসু একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ পরেও তার ভেজা চোখ শুকায়নি। রোশনী নীরবতা ভঙ্গ করলো, ‘তোমার বাপ- মার কতা মনে হইছে?’

‘কলেরায় মরছে গো কুটুম, সবাইরে লইয়া গেছে কলেরায়, আমারে রাইখ্যা গেছে। যেই কলেরারে সবাই ডরায়, আমি হেই কলেরারে ডরাই না। আমি এহন কোনো কিছুরে ডরাই না।’

বুকটা হু হু করে উঠলো রোশনীর। নৌকার কাছে এসে নসু লাফ দিয়ে উঠে পড়ল, রোশনী হাত বাড়িয়ে দিলো। নসু নিজের হৃদকম্পন নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘না গো কুটুম, আমি মরা ধইরা আসছি।’

‘আমিও তো মরাই মাঝি।’

‘তোমার কলেরা হইবো, ডরাও না?’

‘আমিও আর কিছুরে ডরাই না মাঝি।’

*

রোশনীর গঞ্জে যাওয়া নিয়ে মাতব্বর শ্রেণি নাখোশ ছিলেন, তবে পুকুরঘাটের নারী সমাজ খুব উদ্বেলিত হলো। তাদের গল্পের অভাব হয় না এখন। রোশনীর সাথে সাথে আমেনাকে জড়িয়ে কতরকম ডালপালা যুক্ত গল্প যে তারা রচনা করতো। নসু মাঝি আর রোশনীর নাম ঘৃণাভরে অথচ উচ্ছাসের সাথে উচ্চারিত হতো পুকুরঘাটে। মুখরা হুরমতি সারাদিন গলার রগ ফুলিয়ে তালপাতার বেড়ার ওপাশ থেকে আমেনাকে এসব গল্পগুজব গালি সহযোগে জানাতে কোনোরকম আলস্য করতো না। আমেনা বরাবরের মতোই নীরবে শুনে যেতো। আজ যেন হুরমতির গলাটা একটু প্রসন্ন, ভোরবেলা আমেনার রসুই ঘরের ধোয়া দেখেই বলল, ‘খাইয়া ল মাগী, খাইয়া ল, আর বেশিদিন নাই, মাতব্বররা সালিশ বসাইবো, গঞ্জে গিয়া বেশ্যাগিরী ছুটাইবো। মোল্লা বাড়ি থেইক্যা বেশ্যাগো বিদায় করবো মাতব্বরেরা। তহন যাইস দুই মাগী নসু ভাতারের লগে।’

আমেনার মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে গেল। সালিশ বসলে যে তাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে, সেটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। এই গ্রামে স্বামীহীনাদের কোনো আশ্রয় নেই। সারাদিন মনের ভেতর শিকারি বাঘের মতো চিন্তাটা তাকে হানা করলো।

মনের বাঘটি রাতেও তাকে ঘুমাতে দিচ্ছিলো না, অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। রোশনী বলে উঠলো, ‘কী গো ঘুমাও নাই?’

‘না গো ভাবী ঘুম আসে না। তুমি ঘুমাও না ক্যান?’

‘একটা খবর শুনছি, খারাপ খবর।’

আমেনার মনে চিন্তাগুলো ঝড় তুলে ফেলল মুহূর্তে, রোশনীও কী জেনে গেছে সালিশের খবর? আমেনা বুকের ঝড়টা মুখে না এনে নির্লিপ্তভাবে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী খবর?’

‘দেশে নাকি যুদ্ধ হইবো।’

আমেনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, সালিশের চেয়ে যুদ্ধ ভালো। সে বলল, ‘যুদ্ধ হইলে হোক, আমগো কী?’

আমেনা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, রোশনী ঘুমাতে পারলো না, তার মনে হচ্ছে কোনো একটা ভয়ংকর বিপদ আসছে।

মানুষগুলো কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। উত্তরের ক্ষেত থেকে ডাক দিলে যার গলার আওয়াজ দক্ষিণের ক্ষেতে পাওয়া যেতো, সেই লোকও এখন ফিসফিস করে কথা বলে। গ্রামের মাতব্বরেরা গ্রামের ডাঙ্গর মেয়েদেরে ত্রুটি খুঁজতে কিংবা ছোকরা ছেলের বেয়াদবীর শাস্তি দিতে বের হয় না। ভয়ে সংকোচে ফ্যাকাসে হয়ে ঘরে বসে হুকো টানে। রোশনীর মাছ ধরার চাঁই, ডুলা, চাটাই পড়ে থাকে, কেউ কিনতে আসে না। রোশনী গঞ্জে অনেক অপরিচিত মানুষ ঘুরতে দেখে, শহর থেকে এসেছে তারা, সবার মুখে দিশেহারা ভাব। লোকগুলোর চেহারা দেখলেই ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঢাকায় নাকি গুলি চলেছে, অনেক মানুষ মরে রাস্তায় পড়ে আছে। গুলির কথা শুনে অনেকদিন বাদে বাবুল মিয়ার কথা মনে পড়ল রোশনীর। চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *