তেইল্যা চোরা – ৮

রাত্রিবেলা হঠাৎ করে মেঘ গর্জনের মতো একটা ভয়াবহ শব্দ হলো। পুরো জেলখানা কেঁপে উঠলো, তারপরেই একটা বিকট চিৎকার, সেই সাথে কোরাসে আবার সেই শব্দ এবং আবার কয়েকটা চিৎকার। তারপর ঢংঢং করে ঘণ্টা বাজলো, ইউসুফ মুন্সি চোখ বড়ো বড়ো করে উৎকণ্ঠায় বলে উঠলো, ‘পাগলা ঘণ্টা।’

সেই ঘণ্টায় মধ্যরাত্রে জেলখানার দেয়ালের ইটগুলোও যেন জেগে উঠলো। আলো জ্বলে রাত্রির গভীরতাকে কমিয়ে দিলো। বন্দুকওয়ালা গার্ডরা সবাইকে লাইন করে বের করে আনলো মাঠে। মাঠের মধ্যখানে, একসাথে সাতটা দেহ পড়ে আছে। তাদের গায়ে কালচে রক্ত, দূর থেকে দেখেই বলে দেয়া যায়, দেহগুলোতে প্রাণ নেই। দুই একটা লাশের চেহারা দেখা যায়, ফজর আলী তাদের চিনে, কতবার দেখা হয়েছে, সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে অথবা কচু ক্ষেতে। ভীত গলায় সে ইউসুফ মুন্সিকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হয়েছে?’

ইউসুফ মুন্সি কিছু বলতে পারলো না, তার পেছনে থাকা সুজন মাস্টার বলল, ‘পলাইতে চাইছিল।’

জেলারসাহেব এসেছেন। তার চোখ মুখ বেশ উৎফুল্ল, ঘুম ভাঙার বিরক্তি নেই, সম্ভবত তিনি ঘুমান নাই, সামনে এসে বললেন, ‘এরা জেল পালানোর প্ল্যান করছিল, আমি জানতাম। এরা চাবি বানিয়েছে, আমি দেখেছি। কিন্তু কিছু বলিনি। আমি চেয়েছি তারা পালাক, আমি এদের মুক্তি দিতে চেয়েছি। আজ তারা মুক্ত। এদের প্রত্যেকের শরীরে তেরোটা করে বুলেট আছে, এতো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আমি কৃপণ নই। এখানে যারা আছো, তাদের মধ্যে কেউ যদি আমার জেলখানা থেকে পালাতে চাও, আমি বাধা দিবো না। কিন্তু ধরা খেও না, আমি ধরতে পারলে, আবার এই জেলখানায় ফিরিয়ে আনবো, তখন তোমার বুকেও তেরোটা বুলেট থাকবে, একটাও কম না।’ আর একটা কথাও বললেন না, হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। এরকম ঘটনার পর, কয়েদিদের উলোট পালট করা হয়। ইউসুফ মুন্সির সুনামের কারণে তাদের সেলে তেমন পরিবর্তন হলো না, সেখানে শুধু নতুন একজন যুক্ত হলো, পাগলা প্রফেসর।

পাগলা প্রফেসরের আগমনে ইউসুফ মুন্সি নারাজ, সেই সুবাধে ফজরও নারাজ। তারা নিজেরা একসাথে খায়, একসাথে কাজ করে, এক কম্বলে দুইজন শোয় কিন্তু প্রফেসর তাদের থেকে আলাদা, একা একা থাকেন, কীসব বইপত্র পড়েন, আর একটা কম্বলে তিনি একাই থাকেন। ইউসুফ মুন্সি যখন নামাজ পড়ায়, প্রফেসর ছাড়া সবাই কাতার করে দাঁড়িয়ে যায়। বেনামাজী প্রফেসরের উপর ইউসুফ মুন্সির ক্ষোভটা তাতে আরো বেড়ে যায়।

বাচ্চু মিয়ার বোন দেখা করতে এসেছিল তার সাথে, খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো চিড়ার মোয়া দিয়ে গেছে। সেলে আসতেই সবাই ঘিরে ধরলো, সে সবাইকে একটা করে মোয়া দিলো, শুধু প্রফেসর বাদে। ইউসুফ মুন্সি বেশ শব্দ করে মোয়া খাচ্ছে, স্বাভাবিকের চেয়ে গলা উঁচু করে বলল, ‘খুব সোয়াদ হইছে রে বাচ্চু। বহুতদিন বাদে এমন কিছু খাইলাম।’

যাকে উদ্দেশ্য করে গলা উঁচু করে বলা সেইজন যেন এই দুনিয়ায় নাই, সে কী একটা মোটা বইয়ের দিকে ঘণ্টাখানেক হলো তাকিয়ে আছে। ফজর বুঝলো, কেন যেন মায়া হলো এই পাগলা প্রফেসরের জন্য। হাতের মোয়াটি আর খেতে পারলো না সে, পকেটে পুরে রেখে দিলো।

গভীর রাতে ফজর কম্বল সরিয়ে উঠলো, সবাই ঘুমাচ্ছে, সুজন মাস্টার প্রবল বেগে নাক ডাকছে। শুধু একটি মানুষ জেগে আছে, প্রফেসর। বাহিরের ল্যাম্প পোস্টের খানিকটা আলো ঢুকছে এই সেলে, সেই আলোতেই বই খুলে বসেছেন তিনি। ফজর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে অর্ধেকটা মোয়া বের করে প্রফেসরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। প্রফেসর অবাক হলো, কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্য। আবার চোখ নামালেন বইয়ের দিকে। ফজর মোয়াটা ধরে রেখেই বলল, ‘খুব সোয়াদ, আপনে আসতে চাবাইয়া খাইয়া ফেলেন, কেউ দেখবো না, কাউরে কওন লাগবো না।’

প্রফেসর বিরক্তি সহকারে তাকালেম। তারপর বললেন, ‘যাও ঘুমাও গিয়ে, আমাকে ডিস্টার্ব করো না।’

এই প্রথম প্রফেসরের মুখে কথা শুনলো ফজর, শুদ্ধ কথা শুনে অভ্যাস নেই ফজরের, তাই কিছু বুঝতে পারলো না। ফজর ভয়ে ভয়ে হাতটা বাড়িয়েই রাখলো। প্রফেসর এবার চোখ পাকিয়ে একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘আমাকে একা থাকতে দাও, বুঝো না কি বলি?’

ফজর মুখের ভাষা কতটুকু বুঝেছে কে জানে, কিন্তু চোখের ভাষা ঠিক বুঝতে পারলো, অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে মোয়াটা পকেটে ভরে রাখলো। প্রফেসরের মনে হলো, এতো কঠিনভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি, এই প্রথম জেলে কেউ তাকে কিছু সেধেছে। শুতে যাচ্ছিলো ফজর, প্রফেসর তাকে ডেকে বললেন, ‘দাও দেখি কেমন খেতে চিড়ার মোয়া।’

ফজর হাসিমুখে মোয়া বের করে দিয়ে বলল, ‘হাদলে ছাগল খায় না, ভোতার লাগল পায় না।’ বলেই সে বুঝলো, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। প্রফেসর ভ্রু কুচকে তাকালেন, ‘ফজর সাথে সাথে বলল, ভুলে মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেছে।

প্রফেসর হেসে ফেললেন, ফজর আলীর মনের সব ভয় যেন কেটে গেল। প্রফেসর একটু খেয়ে বাকিটা আবার ফজর আলীর হাতে তুলে দিলেন। ফজর আলী মুহূর্ত দেরি না করে কামড় বসিয়ে দিলো। প্রফেসরকে সে শব্দ করে চাবাতে মানা করেছে, কিন্তু সে নিজেই বেশ শব্দ করে মোয়া খাচ্ছে। প্রফেসর কিছুক্ষণ মোয়া খাওয়া দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’

‘ফজর আলী।’

‘এখানে কেন? চুরি করেছো?”

‘না চুরি না কইরাই আইছি, তয় আগে চুরি করতাম। আইচ্ছা আপনেরে সবাই পাগলা পফেসর কয় ক্যান?’

‘পৃথিবীর সবাই কারো না কারো কাছে পাগল। আইনস্টাইন, নিউটনকেও কিছু লোক পাগল ভাবতো। তুমি মধ্যরাতে জোর করে আমাকে মোয়া খাইয়েছো এটা আমার কাছে পাগলামী, কিন্তু তোমার কাছে স্বাভাবিক। আমরা যার কথা, আচরণ বুঝতে পারি না, তাকেই পাগল বলি। আমার কথা বুঝেছো?”

‘জে না।’

‘তাহলে আমি তোমার কাছে পাগলই রইলাম।’

‘আপনেরে এমনে দেখলে পাগল মনে অয় না, খালি বাইরে গিয়া যহন সুরা পড়েন তহন পাগল পাগল লাগে।’

‘ওটা সুরা নয়, কবিতা পড়ি।’

‘কবিতা পইড়া কী হইবো, সোয়াব পাইবেন?’

‘সে তুমি বুঝবে না, ফজর।’

‘আপনের নাম কী?’

‘আমার এখন নাম নেই, নম্বর আছে; নাম মুছে দিয়েছি অনেক আগে।’

‘আপনে কী কইরা আইছেন?’

‘খুন করেছি, খুন।’

‘আপনারে দেইখা মনে হয় না আপনে খুন করছেন।’

‘তুমি খুব সরল মানুষ ফজর। সরল মানুষের চিন্তা হয় সরল এবং বিশুদ্ধ।’

‘কারে খুন করছেন?

প্রফেসরের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। রাত্রীর গভীর কালো ভর করলো তার মুখে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘যাও ঘুমাতে যাও।’

জগতে কত ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। জেলখানার সেই ছোট্ট সেলেও যেন অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। গ্রামের অশিক্ষিত সিঁধেল চোরের সাথে সখ্যতা হয়ে গেছে বিদেশ থেকে পিএইচডি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের। তাদের পৃথিবী ভিন্ন, তাদের ভাষা ভিন্ন তবুও প্রকৃতি তাদের এক জায়গায় এনে জড়ো করলো। তাদের সবকিছু বিপরীত হলেও মিল আছে, সবার কাছের মানুষজন তাদের সাথে দেখা করতে আসে, কিন্তু এই দুজনের কেউ আসে না। একা একা যখন দুজন বসে থাকে তখন প্রফেসর ফজর আলীকে সান্ত্বনা দেন। মাঝেমধ্যে কবিতা শুনিয়ে মন শান্ত করার চেষ্টা করেন। কবিতা শুনে ফজর আলীর মনে সন্দেহটা আরো প্রবল হয়, এই লোক নিশ্চিত পাগল। একদিন বলেই বসলো, ‘এই হাবিজাবি কেডা লেখছে।’

‘জীবনানন্দ দাশ।’

‘পাগল আছিল মনে হয়।’

‘হা হা হা! তা হয়তো ছিল একটু, চাঁপা খুব ভালোবাসতো জীবনানন্দের কবিতা। জোছনা রাতে বাগানে বসে আমি কবিতা পড়তাম, সে শুনতো।’

‘চাঁপা কে?’

প্রফেসরের বুকটা ধক করে উঠলো, আনমনে বললেন, ‘চাঁপা আমার বউ।’

‘উনি কই? আপনের লগে দেখা করতে আসে না?’

প্রফেসরের গলাটা ধরে এলো, বুকটা ভেতরে কে যেন মুচড়ে দিচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘সে আর আসবে না রে, আর কখনো আসবে না।’

‘ক্যান?’

প্রফেসরের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, শীতের উঠানের মতো। চোখদুটিতে শুকিয়ে যাওয়া কুয়ার শূন্যতা। হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘কারণ, আমি তাকে খুন করেছি।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *