তেইল্যা চোরা – ৫

উঠান ঝাঁট দিতে দিতেই রাজ্যের চিন্তা ভর করলো আমেনার মনে। পেয়ারা গাছে ডাসা ডাসা পেয়ারা ধরেছিল-আমেনা বাদুর, কাঠবিড়ালি থেকে বাঁচিয়ে পেয়ারাগুলো পেড়ে রেখেছে। মজিদ যখনই এসে বলে, ‘মা ভূখ লাগছে’–তখনি সে একটা একটা করে পেয়ারা বের করে দেয়। মজিদ এখন আর পেয়ারা খেতে চায় না; বলে, ‘ভাত খামু মা, আর গয়া খাইতে ভালা লাগে না।’ আজ তো পেয়ারাও শেষ, কী খাওয়াবে তাকে? ছেলেটা ক্ষুধা একেবারে সহ্য করতে পারে না। তখনি নজরে পড়ল তার অবশিষ্ট একমাত্র মুরগীটির দিকে। এটাও বেচে দিতে হবে,

ডিম পাড়া মুরগী বেচতে মায়া লাগে কিন্তু উপায় কী। কেউ ভালো দামও দিতে চায় না। ফজরের পরিচয় এখনো ভোগায় তাদের।

কাজীসাহেবের বউ তো সেদিন বলেই বসলো, ‘মুরগী তোর নাকি আবার চুরিধারী কইরা আনছস?’

‘না গো মা, আমার জামাই চোর, বাপে চোর কিন্তু এই জীবনে আমি চুরি করি নাই।’

‘তা ক্যামনে কই? ঠিক আছে, এক জোড়া দুই টাকা দিমু।’

‘কিন্তু মা, মুরগীর দাম তো আরো বেশি হয়।’

‘চোরের বউ থেইকা মুরগী কিনছি শুনলে কাজীসাবে এই মুরগীর মাংস ছুইবোও না। তবুও আমি দয়া কইরা রাখতাছি, এইদামে দিলে দে।’

এভাবে আর কয়দিন থাকতে পারবে সে এখানে। রাতেরবেলা ঘরের পাশে খুটখাট শব্দ হলেও ভয় লাগে। যে নারীর স্বামী জেলে সমাজে তার অনিষ্টের শেষ নেই। শকুনেরা ডানা ঝাঁপটায় চারপাশে। আমেনা ভাবলো, এই মুরগীটা বিক্রি করেই তার ভাইয়ের কাছে চলে যাবে। ভাই তাকে ফেলে দেবে না, দিতে চাইলেও পায়ে ধরে পড়ে থাকবে।

নিজের সামগ্রী বলতে তেমন কিছুই ছিল না আমেনার। মজিদের গুটি কয়েক জামাকাপড়, নাটাই, মুণ্ডুবিহীন ঘোড়া আর নিজের কিছু কাপড়চোপড় গুছাতেই পুটলিটা ভালোই বড়ো হয়ে গেল। অনেক পথ হাঁটতে হবে। গাছ কাটা একটা কচি লাউও সাথে নিয়ে নিলো। আঁচলে বেঁধে নিলো তার সবশেষ সম্বল দুই টাকা চার আনা। ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময় কেন যেন বুকটা কেঁপে উঠলো। একবার মনে হলো, ক্ষান্ত দেয়, এ ঘরেই পঁচে মরবে। কিন্তু মজিদের দিকে তাকিয়েই উঠান ছেড়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। ভাবলো হুরমতিকে বলে যাবে, কিন্তু এই বিদায়ের সময় নতুন করে গঞ্জনা শোনার এবং পুকুর পাড়ে মহিলাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না।

*

মজিদ অধীর হয়ে উঠলো, তার ছোটো দুটি পা আর হাঁটতে পারছে না। রোদটাও বাড়ছে। গ্রাম থেকে গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে তারা। গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার সময় রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে কোনো কোনো গৃহিনী নিজের কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে, ‘কোন গেরামের কুটুম্ব গো তোমরা, আহারে পোলাডা কাহিল হইয়া গেছে, পিড়ি পাইতা দেই, জল খাও।’

‘জল’ শব্দটা শুনেই আর অপেক্ষা করে না আমেনা। হিন্দুর বাড়ির পানিও খাবে না সে, ছোটোবেলা থেকেই চোর, মোল্লা, জমিদার, কেরানী কত দীক্ষাই পায়, সব দীক্ষা ভুলে যায়, কিন্তু ধর্মের গোড়ামীর দীক্ষা সহজে মুছে না। আমেনার বিধর্মী বিদ্বেষও তার নিজস্ব নয়, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।

গ্রামের হাড় জিরজিরে শিশুগুলো কুটুম্বের আশায় পথ চেয়ে থাকে, কুটুম্ব আসলে দুচারটে ভালো খাওয়া জুটে। আমেনা আর মজিদকে দেখেই অনেকে ছুটে আসে, কাছে এসে হতাশ হয়, না এটা তাদের কুটুম্ব নয়। যেই বাড়ির কুটুম্ব সেই বাড়ির লোকগুলোকে তাদের হিংসা হয়, আজ তারা পেট পুরে খাবে।

সূর্য যখন মাথার উপরে তখন তারা মোহাম্মদপুর পৌঁছালো, আমেনার ভাইয়ের গ্রাম। ভালোবেসে বাড়ি ছেড়ে বিয়ে করে এই গ্রামেই বসতি করেছিল সে। আমেনা আগে কখনো আসেনি। এক বাড়িতে গিয়ে ঘর লেপতে থাকা এক মহিলার কাছে জানতে চাইলো, “বাবুল মিয়ার বাড়ি কোনটা?’

‘কোন বাবুল মিয়া, ঘরজামাই বাবুইল্যা?’

আমেনা সম্মতিতে মাথা নাড়লো। মহিলার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল, ঘর লেপা বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি তার কে হও গো?”

‘আমি তার ভইন। আগে কোনোদিন আসি নাই, তাই চিনি না।’

মহিলা তখন মুখ কালো করে বলল, ‘তুমি জানো না?’

অজানা আশঙ্কায় আমেনার বুকটা ভারী হয়ে গেল। বলল, ‘কী?’

মহিলা হাত ধুয়ে বলল, ‘চলো।’

বাবুল মিয়ার বাড়িটি নারকেল পাতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেয়াল নিজের কর্মে ব্যর্থ। দেয়াল ভেদ করে রাস্তা থেকেই ঘরগুলোর জীর্ণদশা আর দরিদ্রতা স্পষ্ট বুঝা যায়। ভেতরে কিছু মোল্লা মৌলভী চাটাই পেতে বসে আছেন। তাদের মুখে দুপুরের রোদের মতো রাগের ছাপ।

একজন হাঁক ছেড়ে অন্দর মহলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘কই গো বাবুলের বউ? এমন অধর্ম তো আল্লায় মানবো না, বাবুলের লাইগা কি তোমার কোনো দয়া মায়া নাই?’ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু আগত অপরিচিতা দেখে একটু থমকে গেল। পাশের মহিলা কে একজন জিজ্ঞাসা করলো, ‘এটা কে গো বঁইচির মা?’

‘বাবুইল্যার ভইন, মেলা দূর থেইক্যা আইছে।’

মুরুব্বীরা খুশি হয়ে নড়েচড়ে বসেছেন, এবার একটা ব্যবস্থা হবে আশা করা যায়। আমেনা কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘরে ঢুকতেই দেখলো, একটি ছিন্ন বস্ত্রের মেয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে আছে, তার শরীরের কাঁপুনি দেখে বলা যায়, সে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমেনা কাছে গিয়ে মেয়েটির কাঁধে ধরলো। মেয়েটি উঠে তাকালো। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে, চোখেমুখে শুধু ধ্বংসস্তুপের ছাপ। শোক ছাপিয়ে ঘরে আসা অপরিচিত নারীর পরিচয় সম্পর্কে জানার কৌতূহলও তার চোখেমুখে ফুটে উঠার সুযোগ পেলো না। বইচির মা-ই পরিচয় দিলো, ‘তোমার ননদ, বাবুইল্যার ভইন।’

মেয়েটা যেন কান্না করার জন্য একটা কাঁধ পেলো। আমেনাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে লাগলো। এবার কান্নাটাকে শত চেষ্টা করেও শব্দহীন করতে পারলো না। আমেনা কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘ভাইজান কই?’

মেয়েটার কান্নার স্রোত যেন আরো বৃদ্ধি পেলো। বেড়ার ঘরের ছোটো জানালা দিয়ে বাড়ির পাশে নতুন খোঁড়া একটি কবরের দিকে তাকিয়ে আবার কাঁদতে লাগলো। আমেনা ফ্যালফ্যাল করে খেজুর পাতায় মোড়া নতুন কবরটির দিকে চেয়ে রইলো। বইচির মা-ও অকারণে কাঁদতে লাগলো, কিন্তু আমেনার চোখ চৈত্রের মাঠের মতো খটখটে শুকনো। সৃষ্টিকর্তা তাকে দুঃখ সহ্য করার শক্তি দিয়েছেন কিন্তু কান্না করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন।

দুরন্ত যুবক ছিল বাবুল, আশেপাশের গ্রামে যাত্রাপালার দল এলে, তাকে আর কোথাও পাওয়া যেতো না, সে থাকতো যাত্রার দলের সাথে। মাথায় নকল চুল লাগিয়ে, শাড়ি, চুড়ি পরে ছোটোখাটো অভিনয়ও করতো। কাবাডি খেলে হাত ভেঙ্গেছিল একবার, ভারী কাজ সে করতে পারতো না। তাই যাত্রায় নাম লেখালো। যাত্রার দলও তাকে সাথে নিয়ে নিলো। সেবার দলের সাথে চলে এলো মোহাম্মদপুর। এখানেই সে দেখা পেলো শ্যামল বর্ণের চমকানো বিদ্যুতের মতো মেয়ে রোশনীর। বজ্রাহত হলো বাবুল সেই বিদ্যুতে। গরীব ঘরের মেয়ের বাবা মেয়ের বিয়েতে আপত্তি করার দুঃসাহস দেখালেন না। কিন্তু আমেনার বাবা মেনে নিলেন না, মুখ কুচকে বললেন ‘ছিঃ ছিঃ আমার পোলায় চোর হইত ভালা হইত, কিন্তুক লাইন কইরা বিয়া করলো, ছিঃ।’

বাবুল ঘর বাঁধলো শ্বশুর বাড়িতে, লোকে ব্যঙ্গ করে বলতো, ‘ঘর জামাই বাবুইল্যা।’ ঘর জামাই বাবুইল্যা তখন যাত্রা দলের সুন্দরী মোহিনী। কত পুরুষ তার প্রেমে পড়েছিল, রোশনী হাসতো, কালেভদ্রে হিংসাও করতো। মন খারাপ হতো যখন মোল্লা মুরুব্বীরা তিরষ্কার করতো। যাত্রায় এবার বড়ো ডাক পড়ল চট্টগ্রামে, অধিকারী অসময়ে দল নিয়ে ছুটলেন চট্টগ্রাম। ভালোই চলছিল তাদের পালা। কিন্তু একদিন রাস্তায় মিছিল হলো, বাবুল সর্বদাই মিছিলের পাগল। ছোটোবেলায় ঈদের চাঁদ দেখা গেলে মিছিল করতো দলবল নিয়ে, বিয়েশাদিতে, খেলায় জিতলে কারণে অকারণে মিছিলে চলে যেতো। মিছিল দেখেই গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিলো, মিছিলে ভিড়ে গেল। তার গলার প্রখরতা দেখে দুই একজন তাকে সামনে ঠেলে দিলো। সে না বুঝেই চিৎকার করে উঠলো, ‘স্বায়ত্ব শাসন’ তার পেছনে শত গলা একসাথে বলে উঠলো, ‘দিতে হবে দিতে হবে।’ পেছনের গর্জন থামার আগেই, বন্দুকের গর্জন শোনা গেল। সামনে থাকা বাবুলের বুকেই বুঝি বিদ্ধ হলো প্রথম গুলিটি।

স্বামীর লাশ আনতেই রোশনীর সব জমানো অর্থ ফুরিয়েছে। হুজুর এসে বললেন, ‘বাবুইল্যা নাচ গান করতো, ছেলে হইয়া মাইয়া সাজতো, এলাকার পোলাপাইনের মনে কুচিন্তা ঢুকাইছে, তার দোযখ নিশ্চিত।’

রোশনী ভয় পেলো, কান্না থামিয়ে হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘উপায়?’

সমাধান দিলেন হুজুর, ‘কোরান খতম দিতে হইবো, তিনদিনের দিন মোল্লা মৌলভীগো দিয়া মিলাদ পড়াইতে হইব।’ কিন্তু একবারও দক্ষিণা কিংবা ভুঁড়িভোজের কথা বললেন না। রোশনী মাথা কাত করে দিয়েছিল শুধু, হুজুর মৌলভীরা সকাল থেকে ঢুলে ঢুলে মিলাদ পড়েছেন, মোনাজাতে উচ্চস্বরে দোয়া করেছেন, যেন বাবুলের পাপ মোচন করলেন। কিন্তু তারপরে বসেই রইলেন। উনাদের দক্ষিণার কথা তুলতেই রোশনী মুখ লুকালো। সেই থেকে হুজুররা একটু পর পর তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, আর রোশনী মাটিতে পড়ে ফুলেফুলে কাঁদছে, স্বামীর শোকে আর নিজের অসহায়ত্বে।

আমেনা নিজের সম্বল থেকে দুই টাকা দিয়ে হুজুরদের বিদায় করলো। হুজুররা খালি মুখে যেতে চাননি, তাই মুখভরে অভিশাপ দিয়ে গেছেন, রোশনীকে। অর্থের তুলনায় দোয়া একটু বেশিই করে ফেলেছিলেন, তাই অভিশাপ দিয়ে সমতা বিধান করলেন।

আমেনার বলরামপুরের দরিদ্রতা, অসহায়ত্ব মোহাম্মদপুরে এসেও ঘুচলো না বরং বাড়লো। কিন্তু নিজের ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কোথা থেকে যেন অসুড়ের শক্তি ভর করে তার মনে, যতবার হোঁচট খায় ততবার যেন আঘাত নেয়ার শক্তি বেড়ে যায়, সাহস বেড়ে যায় সংগ্রাম করার। এই সংগ্রাম সে নিজ গৃহে করবে, এখানে তার ভাইয়ের তাজা কবর আর আবর্জনার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। সকালে যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল সন্ধ্যায় বলরামপুরে সেই পরিচিত গৃহে এসেই তা শেষ হলো। সাথে যুক্ত হলো একটি অতিরিক্ত অনাহারী মুখ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *