৩
মজিদ আর হাঁটতে পারছে না, বাপের কাঁধে চড়ে বসেছে চুলে মুঠো করে ধরে। মেলা থেকে আসা মানুষগুলোর দিকে হা করে তাকিয়ে দেখছে সে। তাদের কারো হাতে কাগজের ফুল, বাঁশি। কেউ অবিরত বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে সে মেলা থেকে এসেছে। প্ৰায় প্রত্যেকটি মুখেই লাল-নীল জরি চকমক করছে। লাঠি বিস্কুট অথবা লেবেনচুশ চাবাতে চাবাতে বাচ্চারা কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরছে। রতনপুরে রায়সাহেবদের মাঠে পৌঁছেই মজিদের মুখের হাটার ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেলো। এতো লোক সে একসাথে দেখেনি আগে, এতো কোলাহল সে শুনেনি কখনো।
বাবার হাত শক্ত করে ধরে সে হাঁটছে মেলার মধ্যে, ময়রারা বড়ো বড়ো কড়াইয়ে জিলাপী ভাজছে, একলোক চিট মিঠাই বানাচ্ছে তার পাশেই। হাওয়াই মিঠাই, নারকেলের সন্দেশ, বাতাসা, কদমা আরো কত কী। মজিদের লালায়ত মুখ দেখে ফজর তাকে জিলাপী আর বাতাসা কিনে দিলো চার আনা দিয়ে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি মাটির ঘোড়াও কিনে দিলো। বাতাসা চুষতে চুষতে সে বেশ জটলা দেখলো এক জায়গায়। ভেতরে কী হচ্ছে দেখার উপায় নেই। ফজর তাকে কাঁধে তুলে নিলো। মজিদ অবাক হয়ে জীবনে এই প্রথমবারের মতো বানর দেখলো। একটা লোক ডুগডুগি বাজাচ্ছে আর বানরটি হেলে দুলে নাচছে। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে মজিদ বানর দেখতে লাগলো। আজ মজিদের বিস্মিত হওয়ার দিন, বায়োস্কোপ দেখলো, নাগর দোলায় চড়লো, সার্কাসে হাতি-ঘোড়া আর মানুষের খেলা দেখলো। মজিদের ছোট্ট বুকে এত সব অবাক করা ব্যাপার একসাথে জমা হচ্ছিল। তার মাঝেও বুকে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানে তার মায়ের জন্য আফসোস হচ্ছিল। মজিদের বেজার মুখ দেখে ফজর জিজ্ঞাসা করলো, ‘কীরে মন বেজার ক্যান, লেবেঞ্চুশ খাবি?’
মজিদ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘মায় তো বান্দর দেখলো না।’
‘সমইস্যা নাই, তোর মায় তো তোরে দেখে। চল তোর মার লাইগা কিছু কিইন্যা লইয়া যাই।’
এবার মজিদের মুখে হাসি ফুটলো। সে বলল, ‘মার লাইগা লেবেঞ্চুশ কিন্যা লইয়া যাই।’
ফজর হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘তোর মায় লেবঙ্কুশ খায় না, নিলে তোর পেটেই যাইবো। তোর মার লাইগা শাড়ি কিনমু, পুরান শাড়িডা পইরা থাকে।’
বাপ-বেটা খুশি মনে শাড়ির দোকানে গিয়ে খুব সুন্দর সবুজ একটা শাড়ি পছন্দ করলো। এক টাকা দুই আনা দামে দফারফা হলো। দাম দিতে কুর্তার পকেটে হাত দিয়ে ফজর বুঝলো, দুর্ভাগিনী আমেনার দুর্ভাগ্যমোচন হলো না, সার্কাস দেখার ফাঁকে কেউ ফজরের পকেট কেটে নিয়ে গেছে।
***
নগদ অর্থ চুরি গেছে, ঘরের চাল ভাড়ারের তলায় পৌঁছে গেছে, অমাবস্যা আসতে আরো সপ্তাহখানিক বাকি আছে। মজিদও এখন শুধু শাক দিয়ে ভাত খেতে চায় না। তাই ফজর গিয়েছিল কলিম বেপারীর কাছে। দিনেদুপুরে ফজরকে দেখে বেশ রুষ্ট হয়েছে কলিম, চুরির মালপত্রের হিসাব দিনের আলোতে করা যায় না।
কলিম ফজরকে শাসিয়ে বলল, ‘চোরের বেটা চোর তোরে না কইছি দিনের বেলা আমার কাছে আইবি না।’
ফজর মনে মনে বলল, ‘তুমি কত সাধু, চুরীর মাল পানির দামে কিন্যা শহরে বেইচ্যা ট্যাকা কামাইছো, চোররাই তোমারে বড়োলোক বানাইছে, তুমি হইছ বড়ো চোর।’ মুখে বিগলিত ভাব এনে বলল, ‘বেপারী সাব গোস্যা কইরেন না, বিপদে না পড়লে এই সময় আসতাম না। কিছু ট্যাকার দরকার আছিল।’
কলিম বেপারী দ্রুত চারপাশে নজর বুলিয়ে গলা নিচু করে বলল, ‘কী আনছস?’
‘কিছু আনি নাই। আগের মালের কিছু ট্যাকা পাইতাম, পরে দেবেন কইছিলেন।’
কলিম বেপারী গলা খাঁকারী দিয়ে উঠলো, ‘লাখি দেয়ার আগে ভাগ। ট্যাকা চাইতে আসছে উনি, মাল লইয়া আইতে পারলে আইছ, এহন ভাগ কইলাম। শালা চোরের জাত।’
*
রতনপুরের রায়সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চলার উপযুক্ত করে বলরামপুর বাজার পর্যন্ত একটা রাস্তা বানিয়েছিলেন। সেই রাস্তার একপাশে সুদূর দিগন্ত পর্যন্ত ফসলি জমি। সেখানে ধান, সরিষা চাষ হয়। বাতাসের দোলা খেয়ে হেলেদুলে উঠে সে ফসল। যাদের ঘামে এই ফসল হাসে তাদের বাস রাস্তার অপর পাশে। এই রাস্তা পার করে হাসিখুশি ফসলগুলো তাদের ঘরে আসে না, ফসলের ঠিকানা হয় রায়, জোয়ার্দারের গুদামে। তাদের ঘরে কদাচিৎ হাসি শোনা যায়, সেখানে ভর করে শুধু কান্না। বিভিন্ন ধরনের কান্না, ক্ষুদার কান্না, স্বামীর হাতে প্রহৃত হয়ে স্ত্রীর কান্না, স্বপ্নভঙ্গের কান্না, অসহায়ের কান্না। রায় বাবুর ঘোড়ার গাড়ির ধুলায় সে কান্না হারিয়ে যেতো, এখনো যায়। ফজর আলীর কানেও কান্না এলো। সে সাধারণত কান্না এড়িয়ে যায়, কিন্তু আজ এড়িয়ে যেতে পারলো না। মাস্টার বাড়ি থেকে যে কান্না ভেসে আসছে তা তার অতি পরিচিত। মজিদ কাঁদছে, বুকটা ধক করে উঠলো দৌড়ে মাস্টার বাড়ি ঢুকে দেখলো, উঠানের নারকেল গাছের সাথে মজিদকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাস্টার মশাইয়ের বেত দিয়ে তার চৌদ্দ বছরের কিশোর ছেলে সপাং সপাং করে মজিদের গায়ে আঘাত করছে। মজিদের কোমল চামড়ায় প্রতিটি আঘাত দাগ ফেলে গেছে। মজিদ চিৎকার করে তার মাকে ডাকছে। মজিদ তার বাজানকে দেখে চিৎকার থামিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফজর আলী তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে বাঁধন মুক্ত করলো। মজিদ তার বাবার বুকে সিটিয়ে গেল। শ্বাস টেনে টেনে এখনো কেঁপে উঠছে। মাস্টার মশাইয়ের ছেলে নিতাই মাটির দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে অভিযোগ করলো, ‘আমার ঘোড়া চুরি করছে।’
ফজর দেখলো গতকাল মেলা থেকে কিনে দেয়া ঘোড়াটি মাটিতে পড়ে আছে, পার্থক্য শুধু ঘোড়াটির মাথাটি অনুপস্থিত। মাথাটি দূরে অবহেলায় নিঃসঙ্গভাবে পড়ে আছে। ফজর আলী মাটি থেকে ধড়হীন ঘোড়াটি তুলে নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি মেলা থিক্যা কাইল কিন্যা দিছি, আমার পোলায় চুরি করে নাই।’
মাস্টারের গিন্নী এবার এগিয়ে এলো, মুখ ভ্যাঙচিয়ে বলল, ‘উঃ চোরের পোলায় সাধু, এই পোলারে যেন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি। আবার দেখলে বাপ-পোলা দুইজনরে বাইন্ধা পিটামু।’
ফজর আলী আর অযথা বাক্যব্যয় করলো না। মুণ্ডুবিহীন ঘোড়াটি মজিদের হাতে তুলে দিয়ে তাকে কোলে তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। মজিদ তার বাজানের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, তার বাজানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
আমেনা ফজরের সাথে একটা কথাও বলেনি। মজিদ কেঁদে কেঁদে সব বলল তার মায়ের কাছে। আমেনার মুখটা যেন আরো কঠিন হয়ে গেল। দাওয়ার নিচে দাঁড় করিয়ে কাঠের চামচ যেটাকে তারা ‘ডেউয়া’ বলে তার উল্টো পিঠে এক চিমটি লবণ রেখে মজিদকে খাওয়ালো তার ভয় তাড়ানোর জন্য। মজিদের ভয় তার মাকে দেখেই পালিয়েছে। তবুও আমেনা মজিদের বুকে ছিটিয়ে দিলো একদলা থুতু। থুতুগুলো যেন ফজরের মুখে গিয়ে পড়ল। নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো ফজর। আমেনার মনেও দাগ পড়ে গিয়েছিল, সেগুলো মজিদের গায়ে পড়া দাগের চেয়েও গাঢ়।
রাতে শুয়ে ফজরের চোখে ঘুম আসছিল না। মজিদ, আমেনা আর ফজরের মাঝখানে দেয়ালের মতো শুয়ে ছিল। একমাত্র দেয়ালটা ঘুমিয়ে ছিল দুইপাশের মানুষগুলোর চোখে ঘুম নেই। ফজর দেয়াল ডিঙ্গিয়ে আমেনাকে ডাকলো, ‘বউ!’
আমেনা জেগে ছিল কিন্তু চোখ মেলল না, ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো। ফজর আলী ঘুমন্ত বউকেই উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মজিদের কসম, আমি আর চুরি করমু না বউ।’
সাথে সাথে আমেনার চোখ খুলে গেল, কিন্তু মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তাকে দেখে বুঝা গেল না, সে ফজরের এই প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাস করেছে কি না।
রাতের আঁধারে স্ত্রী-পুত্রের সাথে শুয়ে করা প্রতিজ্ঞা দিনের আলোতে চালের ভাঁড়ার দেখে টলমল করে উঠলো ফজরের। কিন্তু হাত বাঁধা, মজিদের চেহারা আর আমেনার সেই নির্লিপ্ত চোখ মনে করে নিজেকে নিবৃত্ত করলো।
কাজের খোঁজে ফজর কতজনের কাছে গেল। কাজীসাহেব দাঁত খিঁচালেন, খাঁসাহেব মুখ ভ্যাঙচালেন, মির্জাসাহেব চোখ রাঙালেন, সরকারসাহেব লাঠি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। ক্লান্তি আর হতাশামাখা মুখ নিয়ে ফজর অবশেষে গেল জোয়ার্দারসাহেবের বাড়ি। জোয়ার্দারসাহেব এই বলরামপুরের রায়সাহেব। সম্পত্তির হিসাবে খাঁ- মির্জারা তার কাছে চুনোপুটি। এই অঞ্চলের অর্ধেক পুরুষ তার জমিতে কামলা খাটে। জোয়ার্দারসাহেবের সাথে সরাসরি দেখা করার উপায় নেই, তার নায়েব সব দেখাশুনা করে। ফজর নায়েবের কাছে গিয়ে নিজের আর্জি পেশ করলো। নায়েব ফজর আলীকে চিনত, চিনত বলেই বিপত্তি। নায়েব মশায় চোখ কুঁচকে বলল, ‘তোমারে কাম দিয়া কি বিপদে পড়বো নাকি?’
ফজর আলী হাতজোড় করে বলল, ‘আমি চুরি ছাইড়া দিছি, এই লাইগ্যাই তো কাম চাইতে আইছি।’
নায়েব মশাই ঠোঁট গোল করে পানের পিক ফেললেন, তারপর বললেন, ‘হেঃ কথায় আছে, কইলা ধুইলে মইলা যায় না। না বাপু অন্য কোথাও দেখো, এইখানে হইবে না।’
কিন্তু ভাগ্যদেবীর বোধহয় অন্য ইচ্ছা ছিল, জোয়ার্দারসাহেব সে সময় আহার শেষে হাঁটতে বের হয়েছেন। ফজরের আহাজারী তার কানে গেল। আজ জোয়ার্দারসাহেবের মন ভালো, তার ছোটো গিন্নী অভিমান ভেঙ্গে হাসিমুখে তার মুখে পান ঠেলে দিয়েছে। অভিমান ভাঙার পেছনে তার হাতের নতুন সোনার বালা জোড়ার বেশ ভূমিকা আছে। জোয়ার্দারসাহেব. এগিয়ে এসে বললেন, ‘কী ব্যাপার নায়েব, কী সমস্যা?’
নায়েব উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বলল, “কিছু না, এই ব্যাটা চোর আইছে কাম চাইতে। মানা করলাম, তাও যায় না।’
জোয়ার্দারসাহেব খুব বিষয়ী এবং বুদ্ধিমান লোক। অর্থসম্পত্তি তার যথেষ্ট আছে, কিন্তু তার ক্ষমতাও চাই। সামনের ইলেকশনে মুসলিম লীগের নমিনেশন চাইবেন। তার কাছে এখন সবাই ভোটার, সে চোরই হোক আর ডাকাতই হোক। তিনি এখন দয়া দেখানোর সুযোগ পেলে সহজে হাতছাড়া করেন না। হাতজোড় করা ফজর আলীর দিকে একদফা তাকিয়ে নায়েবকে বললেন, ‘রাইখা দেও।
‘কিন্তু হুজুর?’
‘যা বলছি তা করো।’ বলেই জোয়ার্দারসাহেব ছোটো বিবির দেয়া পান জাবর কাটতে কাটতে হাঁটতে লাগলেন। একটা ভোট বৃদ্ধিতে তার মন আরো ভালো হয়ে গেল।
*
গোড়ালি কাদা পানিতে ডুবিয়ে লাইন ধরে ধানের চারাগুলো ছপ ছপ করে পুঁতে দিচ্ছিল কামলারা। তাদের লাইনে তেইল্যা চোরাকে দেখে সবাই অবাক এবং ক্ষুদ্ধ হলো। কেউ কেউ নায়েব মশাইয়ের কাছে অভিযোগও এলো নিয়ে। কামলাদের মধ্যে কদম হোসেন সবচেয়ে বেশি রুষ্ট হলো। কিন্তু নায়েব মশাই বলে দিলেন, জোয়ার্দারসাহেবের হুকুম। সবাই কাজে ফিরে গেল কিন্তু মনে জ্বালাটা রয়ে গেল। কদম হোসেন গোড়ালি পানিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইজানেরা হগলের জিনিসপাতি সামলাইয়া রাইখো। এইখানে সবাই বালা মানুষ না।’
ফজর আলী কিছু বলল না, নীরবে ধানের চারা পুঁতে গেল। যোহরের আজানের সাথে সাথে কামলারা কাজ বন্ধ করে দিলো। একদল চলে গেল নামাজ পড়তে, আরেকদল গিয়ে উঠানের এক কোণে জটলা পাকিয়ে বসলো মধ্যাহ্ন ভোজনের অপেক্ষায়। ফজর আলী চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। দিনেরবেলা তাকে কখনো এত কাজ করতে হয়নি। মাটির সানকিতে মোটা চালের ভাত দেয়া হলো। নিমিষেই সানকি ছেঁচে সব ভাত খেয়ে ফেলল ফজর। ভাত শেষ করার পরই তার মজিদের কথা মনে হলো। তার অপুষ্ট, ক্লীষ্ট মুখখানা কল্পনা করতেই নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার। বাড়ির পাশেই কৃষ্ণচূড়াগাছ ডালাপালা মেলে আছে, তার ছায়ায় বসতেই ফজরের ঝিমুনি চলে আসলো। ঝিমুনিতেই একটা স্বপ্নও দেখে ফেলল সম্ভবত, সুখের কোনো স্বপ্ন।
হঠাৎ ভেতর বাড়ি থেকে গোলমালের শব্দ পাওয়া গেল। ভেতর বাড়ি থেকে সেটা বাড়ির উঠান পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। ফজর উঠানে আসলো ব্যাপারটা বুঝার জন্য। ভেতর থেকে জোয়ার্দারসাহেবের ছোটো গিন্নীর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তার অভিমানার্জিত হাতের বালাজোড়া পাচ্ছেন না।
উঠানের ভিড় থেকে হঠাৎ কদম হোসেন বলে উঠলো, ‘খাল কাইট্টা কুম্বুর আনছে জোয়ার্দার সাবে। এহন টের পাইলো তো।’
কদমের কথায় সবার যেন সম্বিত ফিরলো, অনেকগুলো সন্দেহের চোখ ফজরের দিকে ঘুরে গেল। আরেকজন বলে উঠলো, ‘এতক্ষণ তো দেখি নাই আমাগো লগে।’
সাথেই সাথেই আরেকজন বিজ্ঞ উত্তর দিলো, ‘চুরির মাল হাপিস করতে গেছিল।’
এভাবে নিজেদের প্রশ্ন উত্তরে তারা ফজরকে চোর সাব্যস্ত করলো। অবশ্য তার পূর্ব পরিচয় জানার পর সাব্যস্ত করার কিছু প্রয়োজন ছিল না। বালাজোড়া যে ফজরই নিয়েছে সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহই রইলো না। দোষী সনাক্ত হওয়ার পর চোরের পিঠের উপর জনগনের একটা অধিকার জন্মায়। কেউ নিজেদেরকে অধিকার বঞ্চিত করলো না। প্রথমেই ফজরকে পেছন দিক থেকে বেঁধে দিলো। তারপর বৃষ্টির মতো কিল ঘুষি তার সারা শরীরে বর্ষিত হতে লাগলো। ঘামে ভেজা কুর্তাটা ছিড়ে গেছে অনেক আগেই। লুঙ্গিটা কোনো রকমে কোমরে জড়িয়ে আছে। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরুচ্ছে, পিঠের দিকেও চামড়া কেটে গেছে, হাতের কয়েকটা আঙুল বুঝি ভেঙ্গেই গেছে। বাঙালি পুরুষ যখন বউ আর চোরকে শায়েস্তা করে তখন তার মনে কোনো মায়া থাকে না। ফজরের ভাগ্য খারাপ; জীবনে নানা দিকে পরাজিত বাঙালি পুরুষে ভরা ছিল সেই উঠান। তারা সুযোগ পেয়েছে, আজ তারা জিততে চায়, বীরপুরুষ হতে চায়, পরাজয়ের সব গ্লানি আজ মুছে ফেলতে চায়। ফজর একটু কথা বলার সুযোগ পেলেই বলে উঠছে, ‘আমি কিছু করি নাই। আমার পোলার কসম, আমি চুরি করি নাই।’
উঠানের মাঝখানে ফজর অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে। বীরপুরুষেরা নায়েব মশাইয়ের বাধায় নিজেদের কাজ স্থগিত রেখেছে। নায়েব মশাই সবাইকে বললেন, ‘কেউ কিছু করবা না, জোয়ার্দার সাব গঞ্জে গেছে। তিনি ফিরা আসলে বিচার হবে। এহন সবাই কামে যাও।’
এমন বিনোদনের হঠাৎ সমাপ্তি তার উপর তপ্ত রোদে মাঠে ঘাড় নুইয়ে কাজ করার ফরমান, উজ্জ্বল চোখমুখগুলোতে আঁধার নেমে এলো। কিন্তু উপায় নেই, মনে অতৃপ্তি নিয়ে সবাই মাঠে কাজ করতে গেল আর মনে মনে জোয়ার্দারসাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
কাঁঠালগাছের সাথে বাঁধা হয়েছে ফজরকে। এতক্ষণ মার খেয়েছে কিন্তু ব্যথা পায়নি, এখন ধীরেধীরে ব্যথাটা টের পাচ্ছে, সমস্ত শরীর জুড়ে ভোঁতা একটা ব্যথা। ফজর আলী ব্যথা থেকে মনোযোগ সরিয়ে মজিদ আর আমেনার কথা চিন্তা করতে লাগলো। আমেনা হয়তো ভাববে সে সত্যই আবার চুরি করেছে, নিজের ছেলের গায়ে হাত দিয়ে কসম কাটার পরেও চুরি করেছে। আমেনার কঠিন মুখটি চিন্তা করে ফজরের মনেও ব্যথা হতে লাগলো। সে ব্যথা শরীরের ব্যথার চেয়েও বহুগুণ বেশি।
বৈঠক ঘরের দাওয়ায় চেয়ারে বসে আছেন জোয়ার্দারসাহেব। পানের রসের কারণে কথা বলতে পারছেন না। চিলুমচি ধরে রেখেছে এক চাকর পানের পিকের আশায়। উঠানে ফজরকে মাটিতে বসানো হয়েছে, সবাই গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির মহিলারা চোর দেখার জন্য বৈঠক ঘরের জানালা ফাঁক করে উঁকিঝুকি করছে। একটা মানুষের ভাগ্য তার হাতে, নিজের ক্ষমতা চিন্তা করেই জোয়ার্দারসাহেবের মুখে প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ল। আজকের দিনটা বড়ো ভালো গেল। পানের পিক চিলুমচিতে ফেললেন, চাকরের অপেক্ষা শেষ হলো, সাথে কামলাদেরও। জোয়ার্দারসাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “আমি দয়ালু মানুষ। দয়া কইরা কাম দিছি। আমার ঘরেই কিনা এই কাম করলো, এই বেইমানরে কি করতাম?’
ভিড় থেকে কদম হোসেন এগিয়ে এসে বলল, ‘ক্ষমা দেবেন জোয়ার্দার সাব, এই তেইল্যা চোরায় আমার ঘরেও চুরি কইরা আমার সর্বনাশ করছে। আমি কইকি খেজুরের কাঁটা দিয়া তার চোখ গাইল্ল্যা দেই।’
কদম আগেই দুটি খেজুরের কাটা জোগাড় করে রেখেছে, চোখ গালার এমন সুযোগ সে আর কাউকে দিতে চায় না। এই প্রস্তাব বিপুল জনসমর্থন পেলো। জোয়ার্দারসাহেব মনে মনে ক্ষুণ্ন হলেন, এই ফকিন্নীর বাচ্চা নিজের ঘরের চুরির কথা বলে নিজেকে জোয়ার্দারের সাথে মিলাতে চাইছে, আবার বিচারের রায়ও দেয়। ধমকে বলে উঠলেন, ‘এই গাধাটারে কামে রাখছে কে? আইছে চোখ গালতে। চাবকাইয়া চামড়া তুইল্যা ফেলমু শালা ফকিন্নীর বাচ্চা।’
কদম হোসেন ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। তার রায়ে সমর্থনকারীরাও জোয়ার্দারসাহেবের সমর্থনে কদমকে চোখ রাঙ্গিয়ে দিলো। জোয়ার্দারসাহেব নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘চোখ গাললে তো তোমার ঘরেই আসবো ভিক্ষা চাইতে। আমি থানার বড়ো দারোগারে খবর দিছি, আইয়ুবসাহেবের আইনের দেশ, বিচারও হইবো আইন মতো।’
কামলাদের সমাবেশে গুঞ্জন উঠলো, ‘ঠিক ঠিক।’
বাঙালি কিছু পারুক আর না পারুক চাটুকারিতা ঠিক পারে। এই ‘ঠিক ঠিক’ গুঞ্জনেও সেই চাটুকারিতা ঝরে পড়ছিল, যদিও সবার হাত নিশপিশ করছিল, চোখ গালার দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলো।
দারোগাসাহেব চোর ধরতে এসেছেন নাকি ভুঁড়িভোজ করতে এসেছে বুঝা যাচ্ছে না। জোয়ার্দারসাহেবের পাশে বসে তিনি একের পর এক আম কনুই ভিজিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন। সাথে আসা দুইজন সিপাইয়ের অবস্থাও তদরূপ। তাদের দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন কিছু খায়নি। আমের বাটিটি আম শূন্য হলে জোয়ার্দারসাহেব চোরের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘দেখেন কী করা যায়।’
কিন্তু দারোগা সে আলাপের চৌকাঠ মাড়ালো না, হাতে লেগে থাকা রস চাটতে চাটতে বলল, ‘কতদিন বড়ো রুইয়ের মাথা খাই না, আপনার পুকুরে রুই আছে না?’
পুকুর থেকে রুই উঠলো, খাসি জবাই হলো। বেশ কিছু ফলফলাদি এবং সন্দেশ মিষ্টি খাওয়ার পর দারোগাসাহেবের চোরের কথা মনে হলো। জোয়ার্দারসাহেব মনে মনে ভাবলেন, ভাগ্যিস গোয়াল ঘরের দিকে নজর পড়েনি খাদকের। দারোগাসাহেব বললেন, ‘চোর আমি নিয়ে যাবো কিন্তু চুরি করেছে কী?”
‘আমার গিন্নীর হাতের বালা।’
‘গিন্নীর বালা চোরের হাতে, সর্বনাশ। চোর কি স্বীকার করেছে? বালা ফেরত দিয়েছে?’
‘স্বীকার করেছে কিনা জানি না, আমি তো জিজ্ঞাসাই করলাম না। আপনার জন্যই অপেক্ষা।’
‘জিজ্ঞাসা করে অবশ্য লাভও নেই, কথায় কাজ হবে না, লাঠির গুতা খেলে সব ফরফর করে বলে দেবে। বালাও বের হবে হারও বের হবে, চুরি করার স্বাদও মিটে যাবে।’
‘কিন্তু হার তো চুরি করে নাই!’
‘না করলেও বাহির করে দেবে। আমার সিপাই এমন প্যাদানি দেবে সব বের করে দেবে।’
এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে ছোটো গিন্নী ডাকলো জোয়ার্দারসাহেবকে। দারোগা মুখ ঘুরিয়ে সে ডাকের উৎস খুঁজতে লাগলেন, না পেয়ে হতাশ হলেন। জোয়ার্দারসাহেব ভেতরে চলে গেলেন। গিন্নী কি আবার অভিমান করেছে নাকি? গিন্নীকে দেখে তা মনে হলো না। জোয়ার্দারসাহেব কাছে যেতেই ঠোঁট উল্টিয়ে ফোঁপানো শুরু করলো। কাঁদার চেষ্টা করছে বোধহয়। জোয়ার্দারসাহেব বললেন, ‘ভনিতা বাদ দিয়ে বলো কী হয়েছে?’
গিন্নী কন্ঠে এক লিটার মধু ঢেলে বলল, ‘আপনে এত সখ কইরা বালাগুলান আমারে দিছেন, আমি গোসলের সময় যত্ন কইরা খুইলা পালঙ্গের উপর রাখছিলাম, আপনের ছোটো পোলায় সেই বালা খেলতে খেলতে পালঙ্গের নিচে নিয়ে ফালাইছে। আমি আইসা দেখি বালা নাই, এত সখ কইরা দিলেন, না দেইখা মাথা গরম হইছিল। এহন ঝাড়ু দিতে গিয়ে বালাগুলান খাটের নিচ থেক্যা পাইছি।’
জোয়ার্দারসাহেব দাঁতমুখ খিঁচে আছেন। মাঝেমধ্যেই নিজেকেই দুষেন তিনি। কোন কুলক্ষণে কম বয়সি মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। জোয়ার্দারসাহেবের মুখভঙ্গি দেখে ছোটো গিন্নী আবার কাঁদার চেষ্টা করলো। এবারের চেষ্টা সফল হয়েছে। জোয়ার্দার মাথা চুলকে গলা নামিয়ে বললেন, ‘হইছে আর ঢঙ করন লাগবো না। বালাগুলান মাইকশে তালা দিয়া রাখো। কাউরে কিছু কওনের দরকার নাই।’
‘কিন্তু তেইল্যা চোরার কী হইবো?’
‘সেইডা আমি দেখতাছি।
জোয়ার্দারসাহেব বাহিরে এসে দেখলেন, সিপাহী দুটি লাঠি হাতে প্রস্তুত হয়ে আছে। জোয়ার্দারসাহেবের অপেক্ষায় ছিল তারা। পুলিশের ভাষায় ‘গুতা’ বলতে যা বোঝায় তাই শুরু করবে। জোয়ার্দারসাহেব দারোগাকে বললেন, ‘আল্লায় দিলে আমার সহায় সম্পত্তি কম না, এক জোড়া বালা গেছে, যাক। আপনে এখন এরে নিয়ে যান। পরে কী করা লাগে আমি দেখুম।’
দারোগাসাহেব দ্বিরুক্তি করতে গেলেন, কিন্তু প্রবল বেগে একটি ঢেঁকুর আসলো, ঢেঁকুর তুলে মেনে নিলেন। জোয়ার্দারসাহেব মনে মনে ভালো ফন্দি আঁটলেন, এখন যদি জানাজানি হয় ফজর চুরি করেনি তবে দারোগা কিছু বলবে না কিন্তু মনে মনে ক্ষেপবে আর মানুষজন তাকেই ‘পাষাণ’ বলবে। পুলিশ ধরে নিয়ে যাক, তিনি গিয়ে মামলা উঠিয়ে ফজরকে ক্ষমা করে দেবেন। মুখে মুখে লোকজন বলবে “আহা জোয়ার্দারসাহবেরে শরীরে খালি দয়া আর মায়া, এমন ভালা মানুষ আর দেখা যায় না” আরেক খিলি পান মুখে দিয়ে জোয়ার্দারসাহেব আরামে চাবাতে লাগলেন।
পল্লীগ্রামে সন্ধ্যা বলতে কিছু নেই, সূর্য ডুবলেই সেখানে রাত। ঝিঁঝিঁপোকাগুলো অবিরাম ডেকে ডেকে রাতকে গভীর করে তুলে। ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাকাডাকির মধ্যেই নিতান্ত অনাড়ম্বরভাবে কোমড়ে দড়ি বেঁধে তেইল্যা চোরাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। দিনেরবেলা হলে বাচ্চাদের মিছিল থাকতো পেছনে, মহিলারা ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতো। পুরুষেরা দুই দণ্ড কোমর সোজা করে তাকিয়ে থাকতো। এখন তেমন কিছুই নেই। পথটা মোল্লা বাড়ির সামনে এসে বেঁকে গেছে। ফজরের বুকটা হু হু করে উঠলো, একবারও কি দেখবে না তার মজিদকে, আমেনা কি অভিমান করে আছে তার উপর। অভিমান নয়, বোধহয় ঘৃণাই করছে, নয়তো সারাদিনে কি সে খবর পায়নি? একবারও তো আসেনি দেখতে। মোল্লাবাড়ি পার হয়ে চলে যাচ্ছে তারা। ফজর বারবার পেছন ফিরে দেখছে। সেখানে তার মজিদ আছে, আমেনা আছে আর আছে দুটি বিষণ্ণ কদম গাছ।