তেইল্যা চোরা – ২

রাত খুব বেশি হয়নি, কিন্তু অমাবস্যা হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে অনেক রাত। আকাশ ফুঁড়ে ফুঁড়ে তারা জ্বলছে। ঝিঁঝিঁরা অবিরত ডেকে রাতটাকে করে দিয়েছে আরো গভীর। ফজর দাওয়ায় বসে গায়ে সরিষার তেল মাখছে। ফজরের ছেলে মজিদ ঘুমাচ্ছে, কিন্তু আমেনার চোখে ঘুম নেই, সে আজ ঘুমাতে পারবে না। এরকম অনেক রাত সে জেগে কাটিয়েছে, বিয়ের আগে তার বাবার জন্য আর বিয়ের পর স্বামীর জন্য।

আমেনা বিছানা ছেড়ে স্বামীর পাশে এসে বসে। ফজর তেল মাখতে মাখতেই বলে, ‘কিছু কইবা?’

আমেনা চুপ করে বসে মাথা নাড়ে। কিছু বলে না সে, বলতে পারে না। ফজর ঠিক জানে আমেনা কী বলতে চায়। তেল মাখতে মাখতেই পূর্বপাশের কদম গাছ দুটির দিকে নজর গেল তার। কদম গাছ দুটির নিচেই তার বাবা এবং মায়ের কবর। কসর আলী মারা যাবার পর ফজরের মা তাকে আমেনার না বলা কথাগুলোই বলেছিল, ‘বাপ আমার, তুই যাইস না এই কামে। তোর বাপে করছে, দুনিয়ায় মানুষ গাইল্যাইছে, কবরে আরো আজাব ভোগ করতাছে। ক্ষেতে কামলা যা, মাডি কাট। আমি মাচাত লাউ লাগাইছি, কুমড়া লাগামু, আমাগো দুইজনের সংসার চইল্যা যাইবো। এই পাপের কাম করিস না বাপ, দোহাই লাগে।’

কিন্তু তাদের পাপের জীবন। মানুষ তাদের পাপ মনে করিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি। চোরের ছেলেকে কাজ দেয়ার মতো নির্বুদ্ধিতাও কেউ করেনি উল্টো ভূঁইয়াসাহেব কান মলে দিলেন, মিঞাসাহেব পিঠ চাবকে দিলেন। লাউয়ের মাচায় লাউ ধরে, ঘরে থেকে তা পঁচে যায়, কুমড়োগুলো ইঁদুরে খায় কিন্তু কেউ কিনে না। পেটে যখন জ্বালা শুরু হয়, তখন আর কবরের আজাবের কথা মনে থাকে না। ছেঁড়া কাপড়ে পর্দা করা যায় না। ভাঙা ঘরে শুয়ে পুণ্যের চিন্তা আসে না।

ভূঁইয়া-মিঞারা শুনলে অবাক হবে, রেগে যাবে। গলা খেঁকিয়ে বলবে, ‘আমি বলেছি চুরি করতে?’ কিন্তু দায়টা তাদেরই। কসর আলী চোরের জন্ম দেয়নি, দিয়েছে এই ভূঁইয়া-মিঞাদের মতো ভদ্র মানুষেরা। একদিন রাতে ফজর বেরিয়ে গেল। সারারাত তার মা নির্ঘুম কাটালো। ফজর সকালে ফিরে এলো। হাতে নতুন পাটের শাড়ি, মাথায় বাঁশের ওড়া থেকে বড়ো মাছের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, সাথে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী উঁকিঝুকি মারছে। খাদ্য-বস্ত্রের উৎস সম্পর্কে ফজরের মা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, সেই ক্ষমতা তার ছিল না। ফজরের বউ আমেনা ও এখন কিছু জিজ্ঞাসা করে না।

ফজরের গা’টা ঘুটঘুটে অন্ধকারেও চকচক করছে। লুঙ্গিটা কাছা মেরে পায়েও তেল লাগালো সে। একটা কাপড়ের ঝোলা আর শাবলটা হাতে নিয়ে বাড়ির পূর্বদিকে কদম গাছগুলো পার হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যাওয়ার আগে গাছ দুটিকে একবার দেখে নিলো, এই কদম গাছ দুটোকে খুব বিষণ্ন দেখায় সবসময়, এমনকি ফুল ফুটলেও।

***

বাড়িটা এক দফা জরিপ করে নিলো ফজর আলী। বেড়া দিয়ে ঘেরা দোচালা ঘর। তার পাশে গোয়াল ঘর আর রসুই ঘর। ঘরের পাশে গিয়ে কান পাতলো সে, ফিসফাস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কদম হোসেনের ঘর এটা, তার ছেলের বিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগে। নতুন বিয়ে করা ছেলেরা রাতে সহজে ঘুমাতে চায় না, কিশোরীদের মতো ফিসফিস করে কথা বলে বউয়ের সাথে। ফজর আলী মনে মনে বলল, ‘ঘুমা শালা ঘুমা, রং-রসের কতা কাইল কইস।’ কিন্তু কদম হোসেনের ছেলে ফজরের মনের কথা শুনলো না, সে তার বউয়ের মন বুঝতেই ব্যস্ত। ফজর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো। এই পেশায় ধৈৰ্য্যই সবচেয়ে বড়ো শক্তি। ফিসফাস করে কথা বললেও রাতের নীরবতার কারণে সবই শুনছে ফজর। কদমের ছেলে বলছে,

‘বিয়ার দিন এত কানছিলা কেন, আমারে পছন্দ হয় নাই?’

‘তোমার মতো দাঁতলা বেডারে কার পছন্দ হইবো?’

‘দাঁতের দেখছো কী! কামড় দিলে বুঝবা।’

‘হেই দুঃখেই তো কানছিলাম।’

বলেই ফিক ফিক করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে কদম হোসেনের ঘুম ভেঙ্গে গেল, সে বার কয়েক কৃত্রিম গলা খাঁকারি দিলো। ফিসফিসানিও বন্ধ হয়ে গেল।

ফজরের আমেনার কথা মনে হলো, বিয়ের দিন একটুও কাঁদেনি সে। সবাই ছিঃ ছিঃ করলো। বলল, ‘চোরের মাইয়্যার দিল বহুত পাষাণ।

আশ্চর্য হয়ে ফজর ভাবলো, সে কোনোদিন আমেনাকে কাঁদতে দেখেনি। তার চোখে সবসময়ই একটা বেদনা ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তা সে বুকের মধ্যেই জমিয়ে রাখে, চোখ ফেটে কোনোদিন বের হয় না সেগুলো। বিয়ের রাতে গম্ভীর মুখে গুটি মেরে শুয়ে ছিল আমেনা। নতুন বউয়ের স্বভাব সূলভ ভীতি তার চোখে ছিল না। ফজর তাকে ডাকতেই সে উঠে বসেছিল। ফজর কে হতবাক করে দিয়ে বলেছিল, ‘ডাকেন ক্যান, কাপড় খুলবেন?’

*

কদম হোসেন এবং তার ছেলে একযোগে নাকডাকা শুরু করলো। ফজরের কাছে নাক ডাকার শব্দের চেয়ে মধুর শব্দ আর কিছু নেই। শাবল দিয়ে মাটি খোঁড়া শুরু করলো সে। খুব বেশি সময় লাগেনি মাটি খুঁড়ে ঘরের মধ্যে সংযোগ করতে। ঘরের ভেতরের অন্ধকারের সাথে চোখগুলোকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিলো সে। বেড়ালের মতো পা ফেলে নতুন বরের যৌতুক সামগ্রী খুঁজতে লাগলো। পিতলের কলসি, সিলভারের জগ, পিকদানির মতো কিছু ধাতব সামগ্রী খুঁজে পেলো, এগুলো বহন করা ভীষণ মুশকিল। এসব নিম্নবিত্ত ঘরে এর অতিরিক্ত কিছু খুঁজেও পাওয়া যায় না। যাদের ঘরে সোনাদানা আছে তাদের ভিটে ইট দিয়ে পাঁকা করা, তাদের ঘরে সিঁদ কাটা যায় না। পুরো ঘর জুড়ে নগদ টাকার কোনো সন্ধান পেলো না সে। কদম হোসেন হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে, বাঁশের চৌকির একপ্রান্তে তার কঙ্কালসাড় রুগ্ন বউটি কোনোরকমে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। কদম হোসেন এই বউটির মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে, তাহলে আরেকটি জোয়ান মেয়ে দেখে বিয়ে করে কিছু নগদ অর্থের আমদানী করবে, সাথে জোয়ান শরীরকে ভালোই খাটিয়ে নিতে পারবে। এই বউয়ের সাথে আসা অর্থ অনেক আগেই শেষ, শরীরের শক্তিও ফুড়িয়ে এসেছে। তিন ডেকচি ধান সিদ্ধ করতেই হাঁপিয়ে উঠে। গতরের শক্তি কমার সাথে সাথে বউয়ের কদরও কমে গেছে। তিনবেলা খাবার দিয়ে এর আয়ু বৃদ্ধি করতে চায় না কদম, তাইতো বউটির এমন কঙ্কাল দশা।

ফজর আলী কদমের ঘরে তেমন কিছুই পেলো না, এসব ঘরে টাকা-পয়সা সাধারণত গোলায় রাখা হয়। ফজর গোলায় উঁকি দিয়ে দেখলো, ধান একেবারে তলানীতে। কিন্তু একটি ছোটো কাঠের বাক্স দেখা যাচ্ছে। ফজর আলী গোলায় নেমে বাক্সটি খুলে হাবিজাবি কিছু কাগজ পেলো, কিছু পিতলের চুড়ি ছিল, সেগুলোর তেমন দাম পাওয়া যাবে না। একেবারে শেষে কিছু মলিন টাকা পাওয়া গেল। অন্ধকারেও গুনে ফেলল ফজর, পনেরো টাকা বারো আনা। তাই নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কদমের পুত্র বধুর গলায় রূপার একটা হার চোখে পড়ল। নিজের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সন্তর্পনে হারটা গলা থেকে খুলে নিলো। বেশ ভারী আছে, দুই ভরি তো হবেই। কলিম বেপারীর কাছে এই হারের জন্য বারো টাকা দাম হাঁকবে, চিন্তা করলো ফজর। হারটি একটু কাছে থেকে দেখতেই বুঝলো, রূপার হার বটে তবে অনেক পুরনো। বিয়ের সময় মেয়ের মা নিশ্চয় বাক্স থেকে খুলে দিয়েছে। তার আগেও তার মা হয়তো তাকে দিয়েছে চোখের জলে ভিজিয়ে। কত নারীর চোখের জল আর মমতা আছে এই পুরনো হারে। চোরদের এসব ভাবলে হয় না, কিন্তু ফজর কিছুতেই হারটা নিয়ে তার ক্ষুদ্র সুড়ঙ্গ গলে বেরিয়ে যেতে পারলো না। সে হারটা আবার মেয়েটির গলায় দিতে গেল। খুলে নেয়া বিদ্যায় ফজর আলী যত শিক্ষিত, পরিয়ে দেয়াতে ততটাই মূর্খ। হার ফেরত দিতে গিয়ে নতুন বধুর ঘুমই গেল ভেঙ্গে।

সাক্ষাত যমকে কিংবা তেলাপোকা দেখেও কোনো মেয়ে এত জোরে চিৎকার দিতো না, যতটা ফজর আলীকে দেখে কদম হোসেনের ছেলের বউ দিলো। কদম হোসেনের ছেলে আর কিছু পারুক আর না পারুক, ঘুমাতে পারে। যেই চিৎকারে নদীর পাড়ে কবরস্থান থেকে দু- তিনটা মুর্দাও সম্ভবত জেগে উঠেছে, সে চিৎকারে তার ঘুমের বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটলো না। কিন্তু কদম হোসেনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজের পুত্রকে গালি দিয়েই সে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলো, তার ধারনা তার পুত্রই কোনো কাণ্ড করেছে। কিন্তু এ ঘরে এসে বধুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো তেলত্যালে একটা শরীর ঘরের মেঝেতে অর্ধেক গলে গিয়েছে। তড়িঘড়ি করে করে সে লাফ দিয়ে ফজর আলীর পা চেপে ধরে চেঁচাতে লাগলো। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা হলো না, ফজর আলী পিছলে বেরিয়ে গেল। কদম হোসেন তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘তেইল্যা চোরা, তেইল্যা চোরা।’

আশেপাশের মানুষজন চুলায় হাত ঢুকিয়ে হাতে ছাই মেখে এলো তেইল্যা চোরাকে ধরার জন্য। কিন্তু দৌড়ে পালানোতে তেইল্যা চোরা তার বাবা কাইল্যা চোরাকেও হার মানিয়েছিল। মুহূর্তেই সে গায়েব হয়ে গেল।

সকাল হতে হতেই কদম হোসেনের চুরি যাওয়া সম্পদের পরিমাণ বাড়তে লাগলো। পনেরো টাকা বারো আনা হয়ে গেল পঁচাত্তর টাকা। যেই রূপার হার পুত্রবধুর গলায় ছিল এবং এখনো আছে তা হয়ে গেল সোনার হার এবং তাও চুরি হলো। ডজন খানেক কাসার বাসন কোসন, এক হালি পিতলের কলস মিলিয়ে তার বিশাল সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে চুরি যাওয়া বস্তুর যে ফিরিস্তি সে দিচ্ছিলো তা শুনে জমিদার বাবুও মুখ লুকাবেন। কদম হোসেনের কঙ্কালসাড় বউ খুব কাজে এলো, শরীরে কিছু থাক না থাক তার গলার ধারেকাছেও কেউ নেই। স্বামীর বর্ণিত সম্পদের সাথে আরো কিছু যোগ করে গলা উঁচিয়ে মাটিতে আছড়ে আছড়ে বিলাপ করছিল সে। পুত্র হারানোর শোকেও কেউ এমন বিলাপ করতে পারে না।

***

আমেনা ধুলো উড়িয়ে উঠান ঝাড় দিচ্ছে। ফজরের সাড়ে চার বছরের ছেলে মজিদ হাঁস-মুরগীদের দৌড়িয়ে বাড়ি ছাড়া করে এখন ছোট্ট পেয়ারা গাছের ডাল ধরে ঝুলছে। ফজর আলী দাওয়ায় বসে আছে অপেক্ষায়। তেল আর কলঙ্ক সবই পুকুরের জলে ধুয়ে শেষ রাতেই বাড়ি ফিরেছিল সে। সারা রাত জেগে থাকার পর সকালে পান্তা খেয়ে শরীরে বেশ ঝিমুনি ধরে গেছে। কিন্তু এখন ঘুমানো যাবে না।

অতি কুৎসিত গালি দিতে দিতে মোল্লা বাড়ি কিংবা চোর বাড়িতে ঢুকলো কদম হোসেন। ফজর এতক্ষণ তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কদমের সাথে তার বৌ কামড়ানোর অভিপ্রায় রাখা দাঁতাল ছেলেটি, এবং আরো জনা পাঁচেক লোক এসেছে। উঠানে দাঁড়িয়ে ফজর আলীর দিকে তাকিয়ে কদম হোসেন বলল, ‘শালার পুত, আমার জিনিসপাতি সব বাইর কইরা দে, নাইলে লাখি দিয়া বিঁচি গাইলা দিমু।’

এরকম সকালের সাথে আমেনা পরিচিত, সে আপনমনে রান্নাঘরে চলে গেল চুলা ধরাতে। মজিদ একটু ভয় পেয়েছে, সে দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তার মায়ের আঁচলে লুকালো। ফজর খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কিয়ের কতা কন কদম ভাই? কিয়ের জিনিসপাতি?’

দাঁতাল ছেলেটি বলে উঠলো, ‘শালা তেইল্যা চোরা, ঢঙ করস? কাইলকা রাইতে আমাগো বাইত যাস নাই চুরি করতে?’

ফজর তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন না করে বলল, ‘কসম, আমি রাইতে বাইত আছিলাম।’

পেছনের লোকগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠলো, ‘তেইল্যা চোরার ঘরে ঢুইক্যা দেখো না, জিনিসপাতি পাও কিনা।

সমস্বরে বাকিরা সম্মতি জানালো, কিন্তু কদম হোসেনের সেরকম ইচ্ছা ছিল না। সে জানে তার পনেরো টাকা বারো আনা ছাড়া আর কিছুই চুরি হয়নি। কিন্তু পাশের লোকদের অতি উৎসাহে সে ঘর থেকে একবার ঘুরে এলো, পুরনো কলসি, আর কাপড় চোপড় উল্টিয়ে বেরিয়ে এলো। বাহিরে এসেই বলল, ‘চুরির জিনিস কেউ ঘরে রাখে নাকি? কই বেচসে কে জানে?’

একজন বলে উঠলো, ‘তার বউরে জিগাও।’

কদম হোসেন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ধুর মিয়ারা তোমরা কুনো কামের না, চোরের বউ কি হাচা কতা কইবো নাকি?’

ফজর আলীর দিকে তাকিয়ে আরো ভয়ানক কুৎসিত কয়েকটা গালিসহ হুমকি দিয়ে কদম হোসেন চলে গেল। ফজর আলী এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল।

কদম হোসেন ভুল বলেছিল, আমেনা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। যদি সত্য বলতে না পারে তবে চুপ করে থাকে তবে মিথ্যা বলে না। চোরের মেয়ে, চোরের বউ হিসেবে এই দোষটি তার ছিল। তবে একটি গুণও ছিল, সব গঞ্জনা, অপমান প্রতিবাদহীনভাবে গ্রহণ করতো।

গঞ্জনায় যদি পেট ভরতো তবে আমেনাকে কখনো অনাহারী থাকতে হতো না।

চুরির দ্রব্যাদি না পেয়ে কদম গজরাতে গজরাতে চলে গেল। কিন্তু গালির কোটা তখনও পূরণ হয়নি, মোল্লা বাড়ি থেকে ভৎসর্না শুরু হলো তারপরেই। হাসমত মোল্লার ছেলে তরিকত মোল্লার স্ত্রী হুরমতি, বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে যার গলায় তেজের পরিমাণও বাড়ছে। সকাল হতেই মৃত শ্বশুরকে অভিশাপ দিয়ে শুরু হয় তার দিন। শ্বশুরের অপরাধ চোরদের সাথে বসবাসে তাদের বাধ্য করছে। তারপর ফজর আলী এবং তার চৌদ্দগুষ্ঠিকে গালি দিয়ে গলা গরম করে। অন্তিম আঘাতটা দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে আমেনার উপর। নারীরা সর্বদা নারীদের দোষই খোঁজে, হুরমতিও সব অশান্তির জন্য আমেনাকেই দোষী সাব্যস্ত করে। গ্রামেগঞ্জে প্রতিবেশী নারীদের মধ্যে কথার যুদ্ধ বেশ প্রচলিত, তা রীতিমতো মহাভারতের যুদ্ধ ছাড়িয়ে যায়। একপাশ থেকে কথার সুতীক্ষ্ণ তীর ছোড়ে তো অপর পাশ থেকে গালির ধারালো বল্লম। মাঝেমধ্যে তা চুলোচুলিতে গিয়ে শেষ হয়। তবে এই ক্ষেত্রে দৃশ্যটা ব্যতিক্রম। হুরমতি একের পর এক ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়ে কিন্তু আমেনার নীরব কঠিন আবরণের ঢালে তা নিমিষেই নিস্ফল হয়ে যায়। পুকুরঘাটে পানি আনতে গেলে কত কটাক্ষবাণ ধেয়ে আসে তার দিকে, সে বিন্দুমাত্র আগ্ৰহ না দেখিয়ে কারো অনিষ্ট কামনা না করে কলসিতে পানি ভরে চলে আসে। পেছনে থেকে ভেসে আসে মুখ ভ্যাংচানো কিছু কথা, ‘চোরের বউয়ের দেমাগ দেখো না, লাজ শরম নাই, মুখ দেখায় কেমনে?

দুপুর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, সূর্যের তেজ কমে এসেছে কিন্তু হুরমতি অবিরাম বাণ ছুঁড়ে যাচ্ছে। আমেনা তার গাছের শুকনো ডাল চুরি করে রান্না করছে এই তার অভিযোগ। নিজের রান্না ঘরে ডাল ঘুটাতে ঘুটাতেই অভিশাপ দিয়ে বলল, ‘ও লো চুন্নি গলাত রক্ত উইঠ্যা মরবি, আমার গাছের ডাইল পুড়াইয়া যা রানছস সব যেন বিষ হইয়া যায়। বিষ খাইয়া বেবাক মর, আমার কইলজা জুড়াক।’

ফজর আলী চোখ ডলতে ডলতে বাহিরে এলো। আমেনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কিছু কইতে পারস না?’

আমেনা ভাতের হাড়ি উল্টিয়ে মাড় গালতে গালতে বলল, “কী কমু, এইসব আমার কপালে আছে, আল্লায় লিখ্যা দিছে। আমি চোরের মাইয়া, চোরের বউ এইসব আমারে শুনতেই হইবো।’

ফজর আলীর বুকে আমেনার এই নির্লিপ্ত ভঙ্গি শেলের মতো বিঁধে। মাঝেমধ্যে আমেনাকে বড়ো অকৃতজ্ঞ মনে হয় আবার কখনো কখনো নিজেকেই অপরাধী মনে হয় তার। মজিদ সকালের ঘটনার রেশ এখনো ভুলতে পারেনি। তার সামনেই তার বাবাকে সবাই বকে গেল অথচ তার বাবা কিছু বলল না। সে পাখির পেছনে দৌড়ানো এবং গাছে ঝুলাঝুলিতে ইস্তফা দিয়ে আপন মনে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাটিতে বেত্রাঘাত করছে। সব দোষ যেন এই মাটির।

ফজর আলী ছেলেকে ভুলানোর জন্য কাছে গিয়ে বলল, “কিরে টিয়া পাখির বাচ্চা ধরবি?’

অন্য সময় হলে মজিদ এই প্রস্তাবে লাফিয়ে বাবার কাঁধে গিয়ে উঠতো কিন্তু এখন কেন যেন টিয়া পাখির বাচ্চাও তার মনকে আকৃষ্ট করছে না। সে বেত্রাঘাত অব্যাহত রাখলো। ফজর আলী ছেলের নিরাসক্ত ভাব দেখে বলল, ‘বৈকালে তোরে রতনপুরের মেলাত লইয়া যামু, মাডির ঘোড়া কিন্যা দিমু।’

রতনপুরের মেলায় যাওয়ার প্রলোভনে মজিদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, মাটির শাস্তি স্থগিত রেখে উঠান জুড়ে লাফাতে লাগলো। তারপর বাবার গলায় ঝুলে বলল, ‘বাজান মায় যাইবো না?’

‘তোর মারে জিগা।’

মজিদকে কষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে হলো না, রান্নাঘর থেকে আমেনা গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমি যামু না, তোরা যা।’

ফজর সম্ভবত না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি তালপাতার ওপাড় থেকে হুরমতির গলা ভেসে এলো, ‘বাপ পুতে কই যায়? কার ঘরের সিঁদ কাটবো?’

ফজরের আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলো না, উত্তর যেন হুরমতিই দিয়ে দিলো। ‘চোরের বউদের ঘরে মুখ লুকিয়েই থাকতে হয়।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *