১৫
সেদিন রাতে কালীগাঙ্গের পাড় ধরে হাঁটছে ফজর আর ইউসুফ। তিন দিন ধরে এই দুপায়ের উপর কম অত্যাচার হয়নি। কখনো হেঁটেছে, কখনো কাটা ভরা জঙ্গলে দৌড়েছে। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, কিন্তু থামতে পারছে না তারা। লুঙ্গি কাছা মেরে মাথায় গামছে বেঁধে নিয়েছে। শপথ নিয়েছে মনে, একটা পাঞ্জাবী না মেরে মরবে না।
‘কেডা? কেডা যায়?’
একটা লোক এগিয়ে এলো, কালো শরীরটা রাতের আঁধারের সাথে যেন দ্রবীভূত হয়ে গেছে, তাই লোকটাকে তারা দেখেনি। কাছে আসতেই লোকটাকে চিনলো ফজর আলী। নসু মাঝি। কিন্তু অন্ধকারে ফজর আলীকে চিনেনি নসু, কতো মানুষকে পার করে নসু সবার চেহারার সাথে নাম মনে করতে পারে না, ফজরের মুখে পেঁচিয়ে উঠা এবড়ো থেবড়ো দাড়ির কারণেও হয়তো চিনতে পারেনি। ফজর নিজের পরিচয় দিলো না, দেয়ার মতো তেমন কোনো পরিচয়ও তার ছিল না। তার বর্তমান পরিচয় জেলা পালানো আসামী, অতীত পরিচয় তেইল্যা চোরা। কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, এবং ভীষণ মর্যাদাহীন। ফজর আলী মুখটা খানিক ঢেকে বলল, ‘আমরা নালিন্দাবাড়ি যামু।’
নসু বলল, ‘বডার পার হইবেন? আসেন আমার নাও আছে। আমি মানুষ পার করি।’
ইউসুফ মুন্সি উশখুশ করে বলল, ‘পয়সা নাই আমাগো কাছে।’
‘আরে কী কন, এই বিপদের সময় পয়সা নিমু নাকি? শইলডা জইলা যায় যহন কাউরে পার করতে পারি না। আপনাগো পার করতে পারলে আমার ভালা লাগবো।’
নদীর ছলছল শব্দ ছাড়া আর তেমন কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না, দূরে হঠাৎ হঠাৎ একটা শিয়াল আনন্দে ডেকে উঠছে, কবর খুড়ে লাশ বের করে খেতে হয় না আর তাদের। মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, মানুষ এখন ফিসফাস করে কথা বলে, তারা নীরবে কাঁদতে শিখে গেছে।
নৌকা কালীগাঙের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে, নসুর বৈঠা একটা অপরূপ ছন্দ তৈরি করেছে নদীর তালে। ফজর বসে আছে, তার ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটি এলিয়ে পড়তে চাইছে। ইউসুফ মুন্সি নৌকার মাঝ বরাবর শুয়ে পড়ল। আকাশের তারাগুলো দুলছে মনে হচ্ছে। একসময় ঝাঁপসা হয়ে এলো তারাগুলো। মুন্সি ঘুমিয়ে পড়েছে। ফজর ঘুমায়নি, গত কয়েক বছরের জীবনটা এই অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা দিলো তার চোখের সামনে। নিজেকে আজ নিজেই চিনতে পারছে না সে। একসময়ের ভীত অসহায় ফজর মরে গেছে, এখন যে নৌকার গলুইয়ে বসে আছে সে ফজর নয় সে অন্য কেউ। তার কোনো আপনজন নেই, কিন্তু জ্বালা আছে। তার কোনো ভয় নেই কিন্তু ক্ৰোধ আছে।
‘ভাই, ও ভাই।’
নিজের চিন্তায় অচেতন হয়ে গিয়েছিল ফজর। নসুর ডাকে চেতনা ফিরলো, নসু তাকে ডাকছে ফিসফিস করে।
‘কী হইছে? আইয়া পড়ছি?’
নসু একটা বৈঠা ফজরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হাত লাগান একটু তয় আওয়াজ যেন না হয়। পাঞ্জাবীরা মনে হয় রাইতেও পাহারা বসাইছে। তাড়াতাড়ি পার হইতে হইবো এই জায়গাডা।’
ফজর নৌকার গলুইয়ে বসে বৈঠা বসিয়ে দিলো নদীর বুকে। অনভিজ্ঞ হাতে বৈঠা চালাচ্ছে সে, নদীর সাথে তাল মেলাতে পারছে না। দূরে কোথাও মানুষের শব্দ পাওয়া গেল। বুক শুকিয়ে গেল দুজনের। নৌকার গতি আরো বাড়ালো কিন্তু সময়ের গতি যেন কমে গেল। মানুষের গলা ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ আলো পড়ল তাদের উপর, একটা পাঞ্জাবী গলা ভেসে এলো, ‘কৌন যাতা হ্যায়?’
নসু এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ফজরকে বলল, ‘ভাই জান দিয়া টানেন।
মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেল, যন্ত্রের মতো দাড় বাইছে দুজন। আলোটা এখনো সরেনি তাদের উপর থেকে। সাথে সাথেই একটা বন্দুক আর্তনাদ করে গুলি ছুড়লো। ইউসুফ মুন্সি ধরফর করে উঠে বসলো, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চারপাশে দেখছে। নসুর পেশী ফুলে উঠেছে, নৌকা কলকল করে ছুটে চলেছে। ফজর সর্বশক্তি দিয়ে বৈঠা চালাচ্ছে। তার আর কোনো হুঁশ নেই, পরপর কয়েকটা গুলি চলল। আলোটা এখন আর তাদের উপর নেই, কিন্তু গুলি থামেনি এখনো। ফজর চোখ বন্ধ করে দাড় টানছে। বুকের ধরফরানি যেন বন্দুকের শব্দকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। পানির ছটায় পুরো ভিজে গেছে ফজর। হৃতপিন্ডটা যেন মুখের কাছে চলে এসেছে, কতক্ষণ এভাবে দাড় বেয়েছে বলতে পারবে না ফজর। এক মিনিটও হতে পারে আবার এক ঘণ্টা হলেও অবাক হবে না। গুলির শব্দ থেমে গিয়েছে। ফজর হা করে দম নিচ্ছে। পেছনে ফিরতে ফিরতে নসুকে বলল, ‘আজরাইলের হাত থেইক্যা বাঁইচা গেলাম।’
কিন্তু কই নসু? সে তো একা। ফজর চমকে উঠলো। ডিঙ্গির পেছনে গিয়ে জরিপ করলো, ইউসুফ মুন্সি এখনো বিমূঢ় হয়ে বসে আছে মাঝে। নসুর চিহ্নমাত্র নেই। দূরে নদীতে পাঞ্জাবীরা আলো ফেলে রেখেছে, সেখানে কালোমতোন একটা জিনিস ভাসছে। কালো শরীরের নসু, কালী গাঙের বুকেই সারাজীবন কাটিয়েছে, আজ সেই কালী গাঙেই তার সমাধি হলো।
রাতের গভীরতা মাপার মতো বিবেচনা ফজরের নেই এখন। নদীর ধারেই একটা গ্রামে এসে পৌঁছালো তারা, নদীতে পুজার লাল জবা ফুল আর ধুপের গন্ধে আন্দাজ করে নিলো, এটাই নালিন্দাবাড়ি গ্রাম। এই এলাকায় নদীর পাড়ে হিন্দু গ্রাম বলতে এই একটাই। ফজর নৌকা ঘাটে ভিড়ালো, আরো কিছু ডিঙ্গি বাঁধা আছে এখানে। গ্রামটা এখনো ঘুমায়নি, তবে ঝিমাচ্ছে। টিম টিম করে জ্বলা কিছু আলো চোখে পড়ছে। নিশি জাগা কিছু বাচ্চারা অভ্যাসমতো কাঁদছে। ফজর তার ভেজা শরীরটা টানতে টানতে নিয়ে চলল সেই আলোর দিকে সাথে ইউসুফ মুন্সি। একটা ঘুমন্ত বাড়ি পেরুতেই আলোর সন্ধান পেলো। উঠানের কোণে হারিকেন জ্বলছে, তার নিচে কিছু মানুষ গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে। হারিকেনের আলোটা চোখে সয়ে এলে, ফজরের ভুল ভাঙ্গলো, পুরো উঠান জুড়ে শখানেক মানুষ রয়েছে। কেউ কেউ জেগে রয়েছে, কেউ আবার নাক টেনে চুপিসারে কাঁদছে, বাকিরা কোনোমতে চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়েছে। কেউই আগন্তুকের আগমনে বিচলিত হলো না। ফজর চোখ দুটো বুলিয়ে নিচ্ছে সবার উপর, পাঁচ বছরের বাচ্চা দেখলেই বুকটা কেঁপে উঠছে তার, অন্ধকারে সবাইকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। একজন বৃদ্ধ তাদের দেখে মুখ ভ্যাংচালো। অন্যদিকে তাকিয়ে স্বগোক্তি করলো, ‘বেবাক মানুষ আইছে, নৌকাত জায়গা পাইতাম না। সব ভাগতাছে দেশ ছাইড়া। এতো মানুষ ক্যামনে থাকবো, কী খাইবো?’
কথাগুলো যে তাদের উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে তা বুঝতে ইউসুফ আর ফজরের বেগ পেতে হলো না। এসব মানুষ সব রিফিউজি ক্যাম্পে যাবার অপেক্ষায় আছে। প্রতিদিন নৌকা আসে। নৌকায় প্রায়শই স্থান সংকুলান হয় না। এখানের হিন্দু বাড়ির মানুষগুলো উঠানে তাদের জায়গা করে দিয়েছে। ভাত না পারলেও চাল ভাজা খেতে দিচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি শুধু ফজর আর ইউসুফের উপর বিরক্ত নয়, সে দুনিয়ার যাবতীয় সকল প্রাণির উপর বিরক্ত। মশা কামড় দিলে চেঁচিয়ে উঠে, গরম লাগলে ধমকে উঠে, কাকে ধমকায় সে-ই ভালো জানে। আশেপাশের লোকজনের তো কাছে ঘেষার বালাই নেই, তার চোখে চোখ রাখলেই দুটো কথা শুনিয়ে দেয়। ফজর আলী আর ইউসুফ মুন্সি উঠানের এক কোণে আশ্রয় নিলো 1
বাড়ির কর্তা এলো চালভাজা বিতরণ করতে। নতুন অতিথি দেখেই বলল, ‘আপনেরা বডার পার হইবেন?’
‘না, আমরা মুক্তি ক্যাম্পে যামু।’
খালি গায়ের পৈতা পরা লোকটির চোখে সম্ভ্রম ফুটে উঠলো। তাদের হাতে মুঠো মুঠো চালভাজা গুঁজে দিলো, একটু বেশিই দিলো বলল, ‘আইজকা রাইতটা এইখানে থাকেন। কাইল সকালে আমি রাস্তা চিনাইয়া দিমু।’
লোকটি সবাইকে এক মুঠো করে চাল ভাজা দিলো। বুড়ো লোকটির আবার অভিযোগ শুরু করলো। চালভাজার কাঠিন্য নিয়ে তার সমস্যা হচ্ছে। এই খাবার গরু ছাগলের মুখেও নাকি রুচবে না বলে নিতান্ত অনিচ্ছায় চাবাতে লাগলো। কেউ কিছু বলছে না, সবার মুখ ব্যস্ত। ফজর পাশের ঝিমাতে থাকা লোকটাকে বলল, ‘এই বুড়া মিয়া কি কোনো জমিদার নাকি?’
পাশের লোকটি হেসে বলল, ‘আরে না, ওর নাম নেকু ফকির। ভিক্ষা কইরা খায়, তয় জমিদারের থেইকা কমও না।’
যুদ্ধের সময় দুনিয়াটা অদ্ভুত হয়ে যায়। জমিদাররা সব ভিক্ষুক হয়ে গেছে, ভিক্ষুকরা সব জমিদারি ভান ধরেছে। ইঁদুররা সব রাজাকার হয়ে পিঠে রাইফেল নিয়ে সিংহ হয়ে গেছে। তাদের বুক আছে সে বুকে সাহস নেই। তাদের জিহ্বা আছে, সে জিহ্বায় লোভের লালা ঝরে পড়ে। একজন সিঁদ কাটা চোরও মুক্তিযোদ্ধা হবে, কেন হবে? প্রতিশোধ কিংবা ঘৃণার জন্য অথবা নতুন পরিচয়ের জন্য। রাইফেল ছাড়াও সে যোদ্ধা, তার বুকে আগুন আছে।
সকালটা আবার কোলাহলে শুরু হলো। নদীতে নৌকা ভিড়েছে। মানুষজন হুড়মুড় করে উঠছে নৌকায়। দেখলে মনে হবে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে পালাতে চাইছে। দেশ ত্যাগে তাদের আগ্রহ নেই কিন্তু তবুও পালাচ্ছে, মৃত্যুর ভয়ে। অনেকেই নৌকায় উঠে কেঁদে ফেলেছে, আবার কি ফিরে আসতে পারবে বাপ দাদার ভিটায়? এই মায়া ভরা মাটিতে?
সব কান্না ছাঁপিয়ে একটা কান্না ফজরের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো এই কান্না তার অতিপরিচিত। মাস্টারপুত্রের বেতের আঘাতে মজিদ ঠিক এভাবেই কেঁদেছিল। ফজরের দৃষ্টি চঞ্চল ফিঙ্গের মতো ঘুরতে থাকলো। কে কাঁদছে এভাবে? বাচ্চাটাকে একবার বুকে ভরে নেবে। মজিদের জন্য জমিয়ে রাখা সব আদর উজার করে দেবে। শব্দটাকে অনুসরণ করতে করতে নৌকার কাছে চলে এলো ফজর।
মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা প্রমাণ করে দেয় মানুষের কল্পনা অসীম নয়। ফজর যা কখনো কল্পনা করেনি, তাই ঘটলো। এই মুহূর্তে ফজরের মনের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নৌকায় ক্রন্দনরত মুখটি যে তার মজিদের। যার চেহারাটা, যার মুখাবয়বটা মনে করার জন্য কত নিদ্রাহীন রজনী ছটফট করে, চোখের জল ফেলে কাটিয়েছে সে মজিদ তার মায়ের কোলে বসে কাঁদছে। আমেনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, নিশ্চিতভাবেই সে তার চোখকে বিশ্বাস করছে না। এই অদ্ভুত মিলন প্রকৃতি তাদের জন্য ঠিক করে রেখেছিল। ফজরও নিজের চোখকে সন্দহ করছে, বিশেষ করে যখন দেখলো আমেনা হুরমতির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। মজিদ তার বাজানের দাড়ি সমৃদ্ধ চেহারাটা চিনতে পারেনি প্রথমে, যখন চিনেছে তখন তার কান্না বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের কোল ছেড়ে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাজানের কোলে ঝাপিয়ে পড়ল মজিদ। ফজর নিজের গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে মজিদকে জড়িয়ে ধরেছে। একটুর জন্যও ছাড়ছে না, এখনো তার মনে সন্দেহ হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। মজিদকে ছেড়ে দিলেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে।
হুরমতি চোখে জল এলো, রোশনী আঁচলে চোখ মুছলো। তরিকত মোল্লাও মুখ ফিরিয়ে চোখের জল লুকালো। কিন্তু আমেনার চোখ এখনো মরুভূমি। ফজরকে সে ক্ষমা করতে পারেনি। ছেলের গায়ে শপথ করেছিল। ছেলের অনিষ্টের চিন্তা না করে সে শপথ ভেঙ্গেছিল। ফজর মজিদকে জড়িয়ে রেখেই চোখ মেলে আমেনার দিকে তাকালো। আমেনা একটু চমকে উঠলো, এই দৃষ্টি তো সে আগে দেখেনি। কেমন খাঁটি আর পবিত্র সে চোখ। একেবারে কোনো বাধা ছাড়া বুকের ভেতরে গিয়ে অভিমান, অভিযোগের সব জাল ছিন্ন করে দেয়। ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা করে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না আমেনা, অভিমান সরে যেতেই লজ্জা ভর করে। ফজর কাছে এগিয়ে আসে, বলে, ‘আমি তো ভাবছিলাম…।’
আটকে যায় সে আর বলতে পারে না। হুরমতির মায়াময় চেহারাটা দেখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাথে আরো একটি মেয়ে। কে এই মেয়ে? অনেক কিছুই জানে না ফজর। জানতেও চায় না,
কিন্তু তরিকত মোল্লা উৎসাহ নিয়ে সব বলল।
***
কলিম বেপারীর পাঠানো দুটি রাজাকার খুব আনন্দ নিয়ে আমেনা আর রোশনীকে নিয়ে টানাটানি করছিল। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝা গেল না, আমেনা শুধু একটা রক্তের ধারা ছুটতে দেখলো। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা, চিকন লোকটি একটি আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। হুরমতি দাঁড়িয়ে আছে পেছনে তার হাতে রক্তাক্ত দা। তার মুখে অপরিসীম হিংস্রতা। পেটমোটা লোকটি ভীত শুকরের মতো অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হুরমতির রুদ্র মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে যত সাহস ছিল, সবই পিঠের রাইফেলের জোরে। কিন্তু হুরমতিকে দেখে সেই রাইফেলের কথাই যেন ভুলে গেল। রোশনীর হাত ছেড়ে নিজের প্রাণ নিয়ে পালালো সে। পেছন থেকে হুরমতি গালি বর্ষণ করছে, ‘গোলামের পুতেরা মাইয়া দেখলেই জিবলা বাইর হইয়া যায়? লেড় খাওয়া বলদেরা সাহস থাকলে আয়, কল্লাটা নামায়া দেই। ঐ পেটলাগানীর পুত ভাগস কই?’
গালিগুলো যদি আগেই ব্যবহার করতো হয়তো দায়ের প্রয়োজন পরতো না। আমেনা এবং রোশনী দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়ক। হুরমতির হিংস্র, কদর্য মুখটার পেছনে একটা মায়ের কোমল ছবি আছে, কিন্তু হুরমতি মা হতে পারেনি। হুরমতির ভয়েই তরিকত মোল্লা দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রাণ খোয়ানোর চেয়ে সন্তানহীন থাকাই উত্তম মনে করেছে সে। হুরমতি সারা দুনিয়াকে অভিশাপ দিয়ে বেড়ায় সে, আমেনাকে একটু বেশিই দেয়, আমেনার প্রতি হিংসাও তার কম নয়, আমেনা মা, সে নয়। আমেনা হুরমতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমারে বাঁচান নাই আমার পোলার মারে বাঁচাইছেন।’ বলেই হুরমতির পায়ে ঢলে পড়ল। পায়ে ধরে বলল, ‘আইজ থেইকা আমার পোলার দুইডা মা।’
আশ্চর্যজনকভাবে হুরমতির হিংস্র চেহারাটা মুহূর্তেই মুছে গেল। সেখানে ভর করলো মায়া ভরা এক মুখ। আমেনাকে ধরে উঠিয়ে স্বভাবমতো বলল, ‘ধুর মাগী, আর ঢং করিস না।’
হুরমতির গালিতে আমেনা আর বিচলিত হলো না, এই গালিতে কতো মায়া ভরা আছে সে এখন জানে। তরিকত মোল্লা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়াল করেনি। রাজাকারের পোশাক পরা একটা রক্তাক্ত লাশ উঠানে পড়ে আছে, ঘাওয়ালা একটা কুকুর লাশটাকে ঘুরে ঘুরে শুঁকছে। হুরমতি দাওয়ায় আমেনা আর রোশনীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা রক্তমাখা দা। তরিকত মোল্লার অজ্ঞান হওয়ার দশা। তরিকত মোল্লাও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এই খবর ক্যাম্পে পৌঁছালে কী হবে খুব ভালো করে জানা আছে তার। সে কাছে গিয়ে বলল, ‘এইডা কী করলা বউ, আমরার মরণের ব্যবস্থা করলা?’
হুরমতি চেঁচিয়ে বলল, “তুমি কেমুন পুরুষ গো, দুইডা মাইয়ারে ধইরা নিয়া যাইতাছে আর তুমি ঘরে শুইয়া ঘুমের ভান ধইরা পইরা আছিলা। ভিত্রে ভিত্রে যে তুমি হিজড়া হেইডা তো আগে জানি নাই।’
হুরমতির সাথে বিতণ্ডাতে যাওয়াই উচিত হয় নাই তরিকত মোল্লার, কথার ঘায়ে সে হাজার সৈন্য কুপোকাত করতে পারে, তরিকত তো সাধারণ মোল্লা মানুষ। সে কথার সুর পরিবর্তন করে বলল, “এহন গাট্টি বোচকা যা পারো তাড়াতাড়ি বান্ধো, এইখানে আর থাকন যাইবো না। পালাইতে হইবো।’
হুরমতি বলল, ‘কই যামু?’
রোশনী বলল, ‘নসু মাঝি কইছিল, নাও দিয়া নালিন্দাবাড়ি নামাইয়া দিবো।
হুরমতি কোমর দোলা দিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘যদিও ধরে বাঘে, ভাতারের নামডাই আগে।
নসু মাঝি তাদের নামিয়ে দিয়ে গেছে। রোশনী বলেছিল তাদের সাথে যেতে, কিন্তু নসু রাজি হয়নি। সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কী কও কুটুম, আরো কত মানুরে পার করতে হইবো, আমি না থাকলে মাইনষে এই বিপদে গাঙ পার হইবো ক্যামনে।’
রোশনীর মন খারাপ হয় আবার খুব গর্বও হয়, মনে মনে ছড়া কাটে সে,
‘তুমি খুব ভালা গো মাঝি তুমি খুব ভালা।
এইবার আসলে তোমারে দিমু, ভালোবাসার মালা।’
***
মজিদ ফজরের কোলে বসে আছে। কাদা থেকে মজিদের ঘোড়াটি উদ্ধার করে দিয়েছে ফজর। তার কান্নার হেতুই ছিল এই ঘোড়া। নৌকায় উঠার সময় তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘোড়াতে আর তেমন আগ্ৰহ নেই তার, সে তার বাজানকে পেয়েছে। ইউসুফ মুন্সির খুব আনন্দ। নিজের কষ্ট ভুলে ফজরের সুখ দেখেই তার বুক আনন্দে ভরে গেছে। তরিকত মোল্লার সব কথা শোনার পর ফজর আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নসু মাঝি আসলেই ভালা লোক আছিল।’
ফজরের দীর্ঘশ্বাস আর অতীতকালে করা স্তুতিবাক্য শুনে রোশনী উৎকন্ঠ হয়ে বলল, ‘কই? মাঝি কই?’
‘আওনের সময় মিলিটারিরা গুল্লি চালাইছিল আমাগো উপ্রে। নসু গুলি খাইয়া গাঙে ডুবছে।’
সাথে সাথে রোশনী হাঁটু ভেঙ্গে বসে গেল, দিনের চকচকে আলোতে অন্ধকার নেমে এলো তার চোখের সামনে। মূর্ছা যাওয়ার আগে বলল, ‘আমি বড়ো আভাগী, কপাল পোড়া।’
নৌকায় লোকজন নিজেদের আসন দখল করছে। ফজর আমেনাকে তাগিদ দিলো। রোশনীকে ধরাধরি করে নৌকায় উঠানো হলো। আমেনা উঠলো, ফজর মজিদকে কোলে তুলে উঠিয়ে দিলো। ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘তেইল্যা চোরা না? জেল থেইক্যা কবে আইলো?’
আমেনার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ফজর দাঁড়িয়ে রইলো। আমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আসো, নাও ছাইড়া দিবো।’
‘আমি যামু না বউ, তোমারা যাও। মজিদরে দেইখা রাইখো। যুদ্ধ শেষ হইলে ফিরা আইসো। আমি না থাকলেও মজিদরে লেখাপড়া করাইও। পফেসর বানাইও। কদম গাছ দুইডা কোন সুমায় কাইটো না।
আমেনা অবাক চোখে চেয়ে রইলো ফজরের দিকে। বলল, ‘কই যাইবা তুমি?”
‘আমি মুক্তিক্যাম্পে যামু, আমার যুদ্ধ শেষ অয় নাই।’
ভেতর থেকে অনেকগুলো সভ্রমের দৃষ্টি ফজরের দিকে তাকালো। ‘তেইল্যা চোরা’ বলা লোকটি লজ্জায় মিইয়ে গেল। তার সাহস নেই যুদ্ধ করার তাই সাহসী বীরের সামনে লজ্জায় মাথা নত করাই কর্তব্য মনে করলো। ফজর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, আমেনার দুই গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এসেছে। এই প্রথম আমেনাকে কাঁদতে দেখলো সে। আমেনার বুকে হাজারটা কথা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তার কাঠিন্যের মুখোশ চোখের জলে গলে গলে পড়ছে। আমেনা বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল, ‘এই যুদ্ধ কি শেষ অইবো?’
‘অইবো বউ, আমরা শেষ করুম। মজিদ নিজের ভিটায় থাকবো। বুক ফুলাইয়া হাঁটবো। তারে কেউ চোরের পোলা কইবো না, মুক্তির পোলা কইবো।’ বলতে বলতেই সুখস্বপ্নে ফজরের চোখ ভিজে উঠে।
নৌকা ছেড়ে দিয়েছে, আমেনা এখনো অশ্রুসজল চোখে ফজরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাকে কাঁদতে দেখে মজিদও কাঁদতে থাকলো, এই দৃশ্য তার কাছে নতুন। হুরমতি মজিদকে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘আরে ব্যাটা তুই কান্দিস না, তুই মুক্তিযোদ্ধার পোলা।’
রোশনী স্থির চোখে তাকিয়ে আছে, তার চোখে এক ফোঁটা জলও নেই। তার সব কান্না শুকিয়েছে। পাশে বসেই আমেনা পাড়ের দিকে তাকিয়ে শুধু কেঁদেই চলেছে, তার অনেক বছরের কান্না জমা আছে। প্রকৃতি সাম্যবস্থার নীতিতে চলে, একজন কাঁদার ক্ষমতা হারালো আরেকজন ফিরে পেলো
নৌকাটা মোহনায় আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত ফজর তাকিয়ে ছিল। ফজর আর ইউসুফ মুন্সি হেঁটে চলল নালিন্দাবাড়ি মুক্তিক্যাম্পের দিকে। ফজরের আরেকটা প্রতিজ্ঞা পূরণ করা বাকি। নিজের ছেলের কসম কেটে যে প্রতিজ্ঞা সে সুজনের কাছে করেছিল।
*
নালিন্দাবাড়ি মুক্তিক্যাম্পের কমান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফজর পাশে ইউসুফ মুন্সি। কমান্ডার সিগারেটে ফুঁ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করছেন। বললেন, ‘মুক্তি হইতে হলে জানের মায়া ছাড়তে হবে। পারবে?’
ফজর দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘পারুম স্যার। মাথায় কাফন বানছি।’
‘এইখানে খাবার দাবারের গ্যারান্টি নাই, ঘুমানোর জন্য সুন্দর বিছানা নেই। মাঠে-জঙ্গলে ঘুমাতে হবে। কোনো আরাম আয়েশের ব্যবস্থা নাই।’
‘আরাম-আয়েশের দরকার নাই স্যার, আরাম-আয়েশ মাড়ি দিয়া আইছি। খালি কয়ডা পাঞ্জাবী মারতে পারলেই অহন আরাম হইবো।’
কমান্ডারের মুখে হাসি ফুটলো, বলল, ‘কী নাম তোমার?’
ফজর উপরের দিকে একবার তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো, ‘সুজন।’
পাশে দাঁড়ানো ইউসুফ মুন্সি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো ফজরের অটল মুখটার দিকে। নিজের নাম বিসর্জন দিয়ে সুজনের কাছে তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করলো ফজর।
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। নালিন্দাবাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের বাহিরে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টিতে ভিজছে ফজর। বহু প্রতীক্ষার বৃষ্টি, বুকের আগুন নেভানো বৃষ্টি। বলরামপুরে মেঠোপথ থেকে যে দুটি কদম গাছ দেখে ফজরের বাড়ি চেনা যায় সে দুটি কদম গাছও ভিজছে। আজ তাদের বিষণ্ণ লাগছে না।
***