১৪
ফজরের মনের আশংকা সত্য হলো, শূন্য বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। দরজার একটা কপাট ভেঙ্গে দুলছে। ফজরের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। ভয়ে ভয়ে ভেতরে গিয়ে তার পরিবারের সন্ধান করলো এবং হতাশ হলো। উঠান শুকনো পাতায় ভর্তি, আমেনার ঝাড়ুর ছোঁয়া পায়নি উঠান মজিদের সাম্প্রতিক কোনো দুষ্টুমির চিহ্নও খুঁজে পেলো না ফজর। তার নিজের বাড়িটি নিজের কাছেই অপরিচিত ঠেকছে। মোল্লা বাড়ি থেকে হুরমতির কোলাহল শোনা যাচ্ছে না, এই প্রথম মোল্লা বাড়িটি এতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে। হুরমতির অনুপস্থিতি নিয়ে কোনো সন্দেহ রইলো না ফজরের মনে। কাকে জিজ্ঞাসা করবে করবে আমেনার কথা, কোথায় আছে তারা? নিজের ভেতরে চুরমার করে দেয়া কী যেন একটা গলা ঠেলে বের হতে চাইছে। ফজর এলোমেলো পায়ে কদম গাছ দুটির নিচে গিয়ে বসে পড়ল। এই গাছ দুটির কাছে তার অনেক অভিযোগ, গাছগুলোও বিমর্ষ হয়ে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। হঠাত কান্নার শব্দ শুনে ফজর কদম গাছে থেকে সেদিকে নজর দিলো। বাড়ি থেকে নেমে গিয়ে অনুসন্ধান করে দেখলো, পাশের বাড়ির বুড়ি খালা পথে বসে পা ছড়িয়ে বিলাপ করছেন। তার সাদা চুল কোনোকালেই ঠিক গোছানো ছিল না কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই এলোমেলো। বিলাপ করতে করতে নিজের দুঃখের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছে, ‘মাইয়াডারে লাইগা কতো ভালা ভালা সম্বন্ধ আইছিল, পৌষ মাসে বিয়া দিমু ঠিক করছিলাম। অহন কেডা বিয়া করবো আমার মাইয়ারে, গোলামের পুতেরা আমার মাইয়াডারে নষ্ট করছে গো আল্লাহ। তাগো চৌদ্দ গুষ্ঠির কুষ্ঠ হইয়া মরবো।’ ফজরকে দেখে বিলাপে বিরতি দিয়ে খানিক চেয়ে রইলো। বলল, ‘অ কেডা রে, ফজর নাহি? জেল থুন ছাড়া পাইছস রে ফজর?’ তারপর আবার কেঁদে কেঁদে ফজরের কাছে নিজের দুঃখ বর্ণনা করলো।
ফজর অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘খালা মজিদ আর মজিদের মায় কই?’
‘বেবাক মাইয়াগো গোলামের পুতেরা ক্যাম্পে ধইরা লইয়া গ্যাছে। পুরুশ মানুষ পাইলে গুল্লি করতাছে। তুই জেল থেইক্যা ক্যান আইলি। এই দোজখের থেইক্যা জেলখানা মেলা ভালা।’
বৃদ্ধার কথাগুলো যেন ধারালো তরবারি হয়ে ফজরের বুকে গেঁথে গেল। দম আটকে গেল, বাতাস ফুরিয়ে গেল। মাথার ভেতর রক্তগুলো যেন পাগল হয়ে উঠেছে, ছলকে ছলকে বিদ্যুৎ হয়ে বজ্রপাত করছে। পাগুলো ছুটতে শুরু করলো, ফজর জানে না সে কোথায় ছুটছে। তবে তার পা জানে কোথায় যেতে হবে।
***
ক্ষমতা থাকলে প্রয়োগ করার জন্য মানুষ উশখুশ করে। পাকিস্তানি আর্মিরা কিংবা রাজাকাররা মানুষ মারার ক্ষমতা পেয়েছে কিন্তু মারার জন্য মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না, সব পালিয়েছে। বিনোদনের জন্য ক্যাম্পে আটকে রাখা পনেরো বিশটা মেয়েই ভরসা। বিনোদনের আকালে ভূগছে তারা। ফজর আলীকে পেয়ে সবার চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। কদম হোসেন ক্যাম্পের পাশ থেকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসা ফজর আলীকে ধরলো প্রথম। তারপর থেকে নিজ কৃতিত্বে তার বুক দু ইঞ্চি ফুঁলে গেছে। ফজরের পেছনে পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে যখন আনছিল সে তখন বাকি রাজাকারদের গর্ব করে বলছিল, ‘আমার চোউক ফাঁকি দিবো, এত্ত হস্তা না। বউ খুঁজতে আইছে ইউসুফ মুন্সির লাহান।’
ক্যাম্পের মাঝখানে জটলা হয়ে আছে। চেয়ার পেতে পাঞ্জাবীরা বসে আছে জটলা পাকিয়েছে। বাঙালি বন্দুকধারীরা দাঁড়িয়ে আছে, পাকিস্তানি প্রভুদের সামনে বসার চিন্তাও করতে পারে না তারা। রাজাকার কমান্ডার কলিম বেপারীও দাঁড়িয়ে আছে ঘাড় নুইয়ে। তার এই বিনীত রূপ কখনো দেখেনি ফজর আলী। ফজর আলীকে নিয়ে কদম হোসেন জটলায় প্রবেশ করলো। ইউসুফ মুন্সিকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তার মেয়ের শাড়ি দিয়ে, তার শরীরে কোনো বস্ত্রখণ্ড নেই। দুই পা এক সাথে চেপে ইউসুফ মুন্সি নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে। সবাই খুব মজা পাচ্ছে, বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়িওয়ালা একটা লোককে সচরাচর ন্যাংটো দেখা যায় না। উঁকি দিয়ে এক নজর দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে একেকজন। একজন রসিক তো, দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হুজুরের খেজুর দেহা যায়!’
ইউসুফ মুন্সি চোখ বন্ধ করে শুধু আল্লাহকে ডাকছে। বিনোদনে ফজর আলীর সংযুক্তিতে ক্যাম্পে উৎসবের ছটা ছড়িয়ে পড়ল। কদম হোসেন ফজরকে বেঁধে দিলো ইউসুফ মুন্সির সাথে। একজন এসে ফজরের মুখে দুটো লাথি বসিয়ে দিলো। ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। কদম হোসেন ফজরের লুঙ্গিতে টান দিতে গেলে একজন পাকিস্তানি ধমক দিয়ে উর্দুতে বলল, ‘সবর কা ফল মিঠা হোতা হ্যায়। ইসকা হিছাব কাল চুকায়েংগে।’
ইউসুফ মুন্সির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘আজ ইস জনাব সে খেলেংগে। যাও ইসকি বিবি আউর বেটী কো লে আও।
বিনোদন নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে, সবগুলো চোখ চকচক করে উঠলো। জেনানা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য একসাথে দুই তিনজন ছুটলো। সে ঘরের প্রতি আগ্রহ তাদের সর্বাধিক।
লালায়িত অনেকগুলো চোখের সামনে ফাতেমা আর তার মেয়ে জুলেখাকে হাজির করা হলো। এলোমেলো চুলগুলো বুকের উপর ছড়ানো। হাত দিয়ে নিজেদের উর্ধাঙ্গ ঢেকে রেখেছে তারা। কোমরে শুধু একটা গামছা জড়ানো। ইউসুফ মুন্সি তাকালো তার বউ আর মেয়ের দিকে। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠলো তার, এখনো আল্লাহকে ডাকছে সে। ফাতেমা আর জুলেখা ইউসুফ মুন্সিকে দেখেও নির্লিপ্ত রইলো, তাদের জীবনে দূর্যোগের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। নতুন কোনো বিপদে তাদের বুক কাঁপে না। তারা লাশ হয়ে গেছে। তাদের চোখের দিকে তাকালে যে কেউ বলে দিতে পারবে অনেক আগে তারা মারা গেছে। শীতল চোখগুলো যেন বরফ হয়ে গেছে।
মা আর মেয়ের অর্ধনগ্ন শরীরগুলোর ফাঁক ফোকর খুঁজে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো চোখ। ইউসুফ মুন্সি এখনো কাঁপছে। তার কাঁপুনি দেখে পাকিস্তানি অফিসারটি শুকরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে হেসে উঠলো পাশ থেকে কলিম বেপারী ব্যঙ্গ করে বলল, ‘মাইয়ার সামনে হুজুরের খেজুর দেহা যাইতাছে, কেউ ঢাইকা দেও।
অফিসারটি বাংলা পুরো বুঝে না, কিন্তু বেপারীর ইঙ্গিত ঠিক বুঝে গেল, তার মাথায় আরো শয়তানি খেলা করতে থাকলো। সে কলিম বেপারীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলবৎ।
বলেই ফাতেমা আর জুলেখার কোমর পেঁচিয়ে রাখা গামছা দুটো টান দিয়ে খুলে ফেলল। সে গামছা ছুঁড়ে ফেলল ইউসুফ মুন্সির দিকে। অকস্মাৎ এই ঘটনায় সবাই হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তেই অটহাস্যে ফেটে পড়ল। ইউসুফ মুন্সি চিৎকার করে উঠে, উপরের দিকে তােিয় বলল, ‘আল্লা রহম করো, আমারে মরণ দেও।’
অফিসারদের অভিসারের জন্য আলাদা একটি ঘর আছে। সেখানে ফাতেমা এবং জুলেখাকে নিয়ে যাওয়া হলো। আজ তাদের ভোগ করবে পাকিস্তানি অফিসারেরা। সবচেয়ে বড়ো অফিসারটি ঘোষণা দিলো, আগামীকাল সকালে মা-মেয়ের সামনেই ইউসুফ মুন্সিকে জবাই করা হবে। পাকিস্তানিটি রাত্রীকালীন সেবাগ্রহণের জন্য অভিসারঘরে চলে গেল। তার ভাগ্যকে ঈর্ষা করতে করতে সৈন্যরা এবং রাজাকারের দল জেনানা ক্যাম্পে সুযোগ খুঁজতে গেল। তবে সকলেই অপেক্ষা করতে লাগলো সকালের। নারীভোগের চেয়ে মানুষ জবাই কোনো অংশে কম উত্তেজনার নয়।
ইউসুফ মুন্সিকে যেখানে বাঁধা হয়েছে তার ঠিক পাশেই সেই অভিসার ঘর। একজন একজন করে অফিসার সেখানে ঢুকছে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে ভেতর থেকে, ফাতেমা অথবা জুলেখার। মুন্সি প্রতিটা চিৎকারে নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরছে। সকালের অপেক্ষা করছে সে। ফজর আলী অপেক্ষা করছে বৃষ্টির।
*
‘ইউসুফ ভাই, ইউসুফ ভাই!’
ফিসফিস গলায় কে যেন ডো ৬ঠলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দুই একটা শেয়াল আর ২-সুফ ফজর ছাড়া বোধহয় পুরে পৃথিবী ঘুমাচ্ছে। এখন কে ডাকছে? ফজর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। অন্ধকারে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে, ছায়াটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হাঁটু গেড়ে বসে শাড়ি দিয়ে বাঁধা ইউসুফের হাতের বাঁধন খুলছে। ইউসুফ মুন্সি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে?’
‘হাম বাচ্চু।’
ফজর আলীর বাঁধন খোলার পর তারা তিনজন উঠে দাঁড়ালো। বাচ্চুর গায়ে খাকী পোশাক। সে রাজাকার হয়েছে। সারাদিন সে ভীড়ের মধ্যে মিশে ছিল, সবই দেখেছে। ইউসুফ মুন্সি তাকে একবার অপমান করেছে কিন্তু তবুও সে মনে মনে মুন্সিকে শ্রদ্ধা করে। আজ যা ঘটেছে সে কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি, আবার সাহসে কুলায়নি কিছু করার। রাতের আঁধারেই এসেছে তাকে মুক্ত করতে। ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় উচ্চস্বরে কথা বলতে নিষেধ করলো বাচ্চু। ইউসুফের হাতে তখনো তার মেয়ের শাড়ি জড়িয়ে আছে। ইউসুফ মুন্সি বাচ্চুকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই বাচ্চু আরো একটি শাড়ি ইউসুফ মুন্সির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দুনো কো লইয়া ভাইগ্যা যান।’
ইউসুফ মুন্সি শাড়ি দুটি নিয়ে দুরু দুরু বুকে সেই ঘরের দরজা একটু ফাঁক করলো। ভেতরে এখনো ফাতেমা আর জুলেখা জেগে আছে। দরজা খুলতেই তারা নতুন আতঙ্কের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ইউসুফ মুন্সি ভেতরে না ঢুকে শাড়িগুলো ভেতরে ছুড়ে বলল, ‘পইরা বাইর হইয়া আসো।’
ফজর আলী বাচ্চুকে বলল, ‘আমার বউরে নাকি ধইরা আনছে, লগে আমার পোলাডাও আছিল। বাচ্চু ভাই তুমি কিছু করো।
বাচ্চু বিরক্ত হয়ে গেল, ‘বাঙালি কি খাসালত খারাপ, বইতে দিলে শুইতে চাতা হায়। নিজের জান লইয়া ভাগ যাও। বিবি কা চিন্তা বাদ দেও। ও তোমারা বিবি নেহী হায়। যুদ্ধের ছময় পাকিস্তানি আদমী কা বিবি হ্যায়।’
ফজর আলীর মাথায় কী যেন হলো, কোথা থেকে যে তার মধ্যে এক বুক সাহস চলে এলো সে জানে না। বাচ্চুর খাকী শার্টের কলারটা দুই হাতে জোরে চেঁপে ধরে বলল, ‘শালার ব্যাটা পাঞ্জাবীগো দালাল, গলা টিপ দিয়া জিবলা বাইর কইরা ফেলমু। তর পাঞ্জাবী বাপগো এহন ডাকতেও পারবি না। ডাকলেও মরবি। যা কইছি কর, আমার বউ পোলারে না লইয়া আমি যামু না।’
বাচ্চু বিস্ফোরিত নেত্রে ফজরের দিকে তাকিয়ে রইলো, এ কোন ফজর? এই ফজরের চোখের দিকে তাকালেই ভয় করে। বাচ্চুর কলার চেপে ধরাতে সে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কোনোমতে মাথা কাঁত করে সম্মতি জানালো সে, ফজর কলার ছাড়তেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো বাচ্চু। ফজরকে সাহায্য করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায়ও নেই, তেমন সমস্যাও নেই। আজ যার পাহারা দেয়ার কথা ছিল সে তাড়ি খেয়ে নাক ডাকছে। ফজরকে ইশারায় আসতে বলে হাঁটতে লাগলো। একটা দোচালা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আন্দার দেখো, তোমার বিবি ইধার আছে।
ভেতরে গুটিসুটি হয়ে অনেকগুলো মেয়ে ভয়ার্ত চোখে বসে আছে। তাদের চেহারা ভালো দেখা যায় না। বার কয়েক চোখ ঘুরিয়েও ফজর আমেনাকে খুঁজে পেলো না। নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমেনা নামে কেউ আছে এইহানে? লগে একটা বাচ্চাও আছিল পাঁচ বছরের।’
কিন্তু কোনো জবাব এলো না। ফজর আবার জিজ্ঞাসা করলো, কিন্তু কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো উত্তর পেলো না। বের হওয়ার আগে শুধু বলল, ‘আল্লায় তোমাগো দেকবো। একদিন সব শেষ হইবো।’
ফজর বাহিরে এসে বাচ্চুকে বলল, ‘এইহানে নাই।’
বাচ্চু মাথা নিচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে কয়েকটা উঁচু মাটির ঢিবি দেখিয়ে বলল, ‘তাইলে উধার আছে।’
ফজর আলী ভাবতেই পারছে না, আমেনা এই মাটির নিচে শুয়ে আছে। মজিদও কি শুয়ে আছে? মজিদের ছোটো ছোটো আঙুল কি পোকামাকড়ে কামড়ে খাচ্ছে। মজিদ মৃত্যুর সময় নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে, নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। পানি খেতে চেয়েছিল হয়তো। ফজরের পৃথিবীটা টলে উঠলো। জীবনে আমেনাকে সুখ দিতে পারেনি ফজর, মরণেও পারলো না। নিজেকেই দায়ী মনে হলো তার। ইচ্ছা করছে একটা ছুরি দিয়ে গলাটা দুভাগ করে ফেলে। কিন্তু পরমূহূর্তেই ভাবলো মরলে তার অপরাধের শাস্তি হবে না। বুকের ভেতর আগ্নেয়গিরি নিয়েই তাকে বাঁচতে হবে, জ্বলতে হবে সে আগুনে। মনের এক কোণে এখনো বৃষ্টির আশা করে সে। সব মিথ্যা হয়ে যাক। তার আমেনা, মজিদ ফিরে আসুক। তার নতুন জীবন হোক, তারা নতুন পরিচয় পাক। কেউ তাদের চোরের বউ, চোরের ছেলে বলে আর অবজ্ঞা করবে না, গঞ্জনা সহ্য করতে হবে না আর। একবার সে জ্বালা মেটানো বৃষ্টিটা আসুক।
ইউসুফ আলীর অস্ফুট চিৎকার শোনে সম্বিৎ ফিরলো ফজরের। বাচ্চু আগে আগে ছুটছে, কেউ জেগে গেলে তার নিজের জীবন বিপর্যয়ে পড়বে। ইউসুফ মুন্সি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। ফজর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হইছে?’
ইউসুফ মুন্সি মাথা তুলে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তারা বাইচা গেছে।’
ফজর আলী বুঝে উঠতে পারলো না, সে উঠে সেই ঘরের ফাঁক করা দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালো। দেখেই আঁতকে উঠলো। একটি শাড়ি নিচে অবহেলায় পড়ে আছে, আরেকটি শাড়ির দুই প্রান্তে দুটো নগ্ন লাশ ঝুলছে। একটি ফাতেমার আরেকটি জুলেখার। মরেছে তারা আরো আগে, আজ শুধু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো।
‘ইউসুফ ভাই চলেন।’ ফজর দৃঢ় গলায় বলল।
ইউসুফ মুন্সি শূন্যে চোখ মেলে বলল, ‘কই যামু, আমি এইখানেই মরুম।’
‘মরলে মরেন কিন্তু মরণের আগে কয়ডা পাঞ্জাবী মাইরা হের পরে মইরেন।’
ইউসুফ মুন্সি উদাস চোখে তাকিয়ে রইলো। ফজর যেন কেমন হয়ে গেছে, তার চোখেও আগের সেই নরম, অসহায় ভাবটা নেই। চোখে কী অসম্ভব তেজ, অন্ধকার রাত্রীতেও জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। তার ভেতরে এতো আগুন তো আগে ছিল না। ইউসুফ মুন্সি সে আগুন কিছুটা নিজের মধ্যে জ্বালিয়ে নিলো। তারপর বলল, ‘কই যাবি চল।’
‘নালিন্দাবাড়ি যামু।’
ইউসুফ মুন্সি বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুইও চল আমাগো লগে, তারা জানলে তোরেও মাইরা ফেলবো।’
বাচ্চুর শরীরে বাঙালি রক্ত কিন্তু মনে এখনো পাকিস্তানি মোহ প্রবাহিত হচ্ছে। সেই মোহেই মুন্সির প্রস্তাবকে তুচ্ছজ্ঞান করে হেসে বলল, ‘হামকো কিউ মারেংগে? হাম উনকা আপনা আদমী হ্যায়।’
ইউসুফ মুন্সি চোখে অসম্ভব মায়া নিয়ে বলল, ‘তুই জীবনেও পাকিস্তানি হইতে পারবি নারে। তোর মনে অহনো এট্টু হইলেও মায়া আছে। তোর ভিত্রে এহনো একটা বাঙালি আছে।’
***
ইউসুফ আলী অনেক ভুল কথা বলে কিন্তু বাচ্চুর ভবিষ্যত বাণী ঠিক হয়ে গিয়েছিল। গাছের নিচটা ফাঁকা দেখে সে খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিল, যখন দেখলো দুটো নারী ফাঁস দিয়ে মরেছে তখন হতাশাটা রাগে পরিণত হলো। উত্তেজনাময় সকালটা বিবর্ণ হয়ে গেল। বাচ্চু নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবে। অতি বুদ্ধির নমুনা দেখাতে গিয়েই সে ধরা খেলো। অতিরিক্ত একটা শাড়ির উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিতেই তার নাম উঠে এলো। এবং সকালের রং ফিরে এলো। বাচ্চুকে নগ্ন করে পেটানো হচ্ছে। হাত পায়ের হাড়ের পাশাপাশি তার আত্মবিশ্বাস এবং পাকিস্তানিদের প্রতি বিশ্বাস সব ভেঙ্গে গেল। পাঞ্জাবীদের তোষণ করা মনে বিষ জমলো। নিজের ভেতরের বাঙালিটা জেগে উঠলো ব্যথা পেলেই যে ‘মাগো’ বলে কেঁদে উঠে। মরার আগে শেষ যে বাক্যটি তার মুখ দিয়ে বের হয়েছিল তা হলো, ‘শালা পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চা’