১৩
সুজনের প্রলাপে ফজরের হুশ এলো। হাত বাড়িয়ে সুজনের কপালে হাত দিয়েই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। জ্বরটা আবার ফিরে এসেছে। তার পাশে ইউসুফ আর বাচ্চু মরার মতো পড়ে রয়েছে। গতরাতে কত মাইল দৌড়েছে, কত দেশ পেরিয়েছে কেউ বলতে পারে না। এই নীরব তল্লাটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে শুয়ে পড়েছিল চারজনই। ঘুমিয়েছিল কিংবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ফজর চোখ খুলে দেখলো, আলো ফুটেছে কিন্তু পাখি ডাকছে না। ভোরের আলোতে তাদের রাত্রী নিবাসের স্থানটি সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝলো, তারা একটি বাগানে আছে। বাগানে মেহগনী গাছ ভর্তি। বাগান পেরিয়ে একটা ঘর দেখলো, ছন দিয়ে ছাওয়া কুঁড়েঘর কিন্তু কোনো জনমানব কিংবা জনমানবের লক্ষণ চোখে পড়ল না।
ইউসুফ আর ফজর সুজনকে টেনে সেই কুঁড়েঘরটাতে নিয়ে এলো। একটি চাঁটাই পাতাই ছিল ঘরে, চাঁটাইয়ে শুইয়ে দিলো তাকে। বাচ্চু এসব কর্মযজ্ঞে যোগ দিলো না, সেও সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়েই অনুযোগের সুরে বলল, ‘ভুখ লাগি হ্যায়।’
ইউসুফ আর ফজরের পেটও সে অনুযোগে সাড়া দিলো। ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো, রান্না করার কোনো সামগ্রীই এখানে নেই। কয়েকটা লুঙ্গি কুর্তা ঝুলে আছে। এই ঘরটা হয়তো রাতে বাগান পাহারা দেয়ার জন্যই বানানো হয়েছে। এমনকি খাওয়ার জন্য পানিও নেই, একটি কলসি নির্লজ্জভাবে এক কোণায় উল্টে আছে। তারা মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো, ফজর বলল, “আমি গিয়া দেখি, কোনো খাওন পাওন যায় নাকি?’
বাচ্চু আসন্ন ভোজনের অপেক্ষায় চোখ মুদে বলল, ‘আচ্ছা বাত।’
ইউসুফ মুন্সি ফজরকে থামিয়ে বলল, ‘এইখান থেইকা লুঙ্গি কোর্তা পইরা যা। সাবধানে যাইস। কেউ জিগাইলে কবি, মুসাফির।’
ফজর ইউসুফ মুন্সির উপদেশ খুব ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে সন্তর্পণে এগুতে লাগলো গ্রামের দিকে। নিজের মুসাফির পরিচয় দেয়ার মতো কাউকে পাচ্ছে না সে। একটা মাঠ পেরুলো, মাঠে দাড়িয়া বান্ধা খেলার জন্য দাগ কাটা আছে, কিন্তু কোনো খেলোয়াড় নজরে এলো না। হাঁটতে হাঁটতে খালের পাড়ে চলে এলো। সুদূরে দৃষ্টি দিয়ে অবাক হয়ে গেল সে, অন্ধকার কালো নির্জীব এক গ্রাম দেখা যাচ্ছে। যেন গ্রাম নয়, গভীর নদীর কালো পানিতে গ্রামের ছায়া।
ফজর হাঁটতে হাঁটতে পোড়া ঘরগুলি দেখছিল, কিছু কিছু ঘরের সামনে তুলসী গাছের বেদী এখনো অক্ষত আছে। এই কয়েকটা তুলসী গাছ ছাড়া গ্রামে জীবন্ত কিছু চোখে পড়ল না। এগুতে এগুতে পঁচা বোটকা একটা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারলো। ফজর বুঝলো না গন্ধটাকে এড়াতে গিয়ে আরো কাছে চলে যাচ্ছে সে। বুকটা তড়াস করে উঠলো তার, জামরুল গাছের নিচে ঠেস দিয়ে আছে একটি উলঙ্গ মহিলা। তার পরনে শুধু চুলের সিঁথিতে দেয়া লাল সিঁদুর ছাড়া আর কিছুই নেই। কয়েকটি মাছি মহিলাটির নাকের সামনে ভনভন করছে, আরো কয়েকটি মাছি বুকের স্তনহীন ক্ষতে। দুদিন পুরনো এই লাশ থেকেই গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফজর চিৎকার করে ছুটে চলেছে, লাশটি থেকে যতদূর যাওয়া যায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই মহিলাটির ছবি ভেসে উঠছে, হাজার মাইল দৌড়েও মনের ভেতর থেকে এই বিভীষিকা থেকে দূরে যেতে পারবে না সে।
ছুটতে ছুটতে কিছু একটার সাথে তার পা ধাক্কা খেয়েছে, সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। মাথা তুলে দেখলো, নির্জীব একটা আট-নয় বছরের ছেলে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটির বুকে কালচে রক্ত। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলো, এক লাশ থেকে ছুটে পালিয়ে সে লাশের মিছিলে এসে পৌঁছেছে। চারদিকে লাশ আর লাশ। তাজা লাশ, গলা লাশ। কোনো লাশের চোখ খোলা, কোনো লাশের চোখই নেই। শিশু লাশ, বুড়ো লাশ, নারী লাশ, পুরুষ লাশ, সবাই একসাথে শুয়ে আছে। আবার ছুটতে লাগলো ফজর। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে ছুটছে সে, কিন্তু লাশের সে মিছিল পার হতে পারছে না।
দরজায় বিধ্বস্ত ফজরকে দেখে ইউসুফ আর বাচ্চু দুজনেই চমকে উঠলো, সুজনের জ্ঞান থাকলে সেও চমকে উঠতো। ফজর শীতল গলায় বলল, ‘খাওন নাই, লাশ আছে।’
কিছু কথায় আর বাকিটা হাতের ইঙ্গিতে ফজর তার বিভীষিকার বর্ণনা করলো। ইউসুফ মুন্সির মনে কোনো সন্দেহই রইলো না, এই জুলুম মুক্তিদের কাজ। সে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ‘হিন্দুগুলানের কইলজা দেখছো? মুক্তি হইয়া মুসলমান মারে।’
ফজর বাধা দিয়ে বলল, ‘সব তো মনে হয় হিন্দু লাশই দেখলাম হুজুর।’
‘তুমি ঘোরে কী দেখতে কী দেকছো কে জানে! আর হিন্দু দুয়েকটা মরলে ভালোই!’
বাচ্চু অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো, শোয়া থেকে উঠে বলল, ‘ইসব আলাপের গুষ্ঠী কিলাতা হো, ইধার সে চলেন যাইগা। ভুখ লাগা হ্যায়।’
ফজর বলল, ‘সুজন মাস্টারের জ্বর কমলে যামুনে, এহন তো হে উইঠ্যা খাড়াইতেই পারবো না।’
বাচ্চু সুজনের দিকে খুব বিরক্ত হয়ে তাকালো, ‘ইসকে লিয়ে হাম কিউ মরে? আমার ভুখে জান বাহির হোতা হ্যায়। কেউ না গেলে, আমি একলা যায়েংগে।’
ইউসুফ বাচ্চুর মূল সুর এড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই ভুলভাল উর্দু কতা ক্যান কও। বাঙালি হইয়া ক্যান তুমি পাঞ্জাবী সাজতে যাও? হয় এক্কেরে উর্দুতে কতা কও নাইলে বাংলায় কও। নাইলে চুপ কইরা থাইকো।’
কেউ যেন বাচ্চুর পরিধেয় কেড়ে নিলো, বাচ্চু যেন জনসম্মুক্ষে উলঙ্গ হয়ে গেল, সে ভাবতো তার উর্দু দক্ষতায় সবাই বিমোহিত এবং তার প্রতি সবার মনে একটা সম্ভ্রমের সিংহাসন হয়ে গেছে। এভাবে সিংহাসন বিচ্যুত হয়ে নগ্ন হয়ে যাওয়াতে সে যতটা না লজ্জা পেলো তার চেয়ে বেশি ক্ষুদ্ধ হলো। সে ইউসুফ মুন্সির দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিলো, চোখ দিয়ে যদি সত্যই আগুন বের হতো এতক্ষণে সে আগুনে ইউসুফ মুন্সি ভষ্ম হয়ে যেতো। ইউসুফ মুন্সি বহাল তবিয়তে বসে আছে, ফজরও ইউসুফ মুন্সির কোনো প্রতিবাদ করেনি। বাচ্চু আর কিছু বলল না, হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বের হয়ে যাওয়ার সময় অভিশাপ দিয়ে গেল, ‘মরো তোম বাঙালি লোক।’
ফজরের ধারণা ছিল বাচ্চু ফিরে আসবে কিছুক্ষণ পর কিন্তু বাচ্চু ফিরলো না। ইউসুফ মুন্সি কোথা থেকে কাঁচা এক কাঁদি কলা নিয়ে এলো। আগুন জ্বালিয়ে সেগুলো পুড়ে খেলো দুজনে। সুজনকেও খাওয়ালো, কিন্তু সুজন খুব বেশিক্ষণ তা পেটে রাখতে পারলো না, বমি করে দিলো। জ্বর বাড়ছেই তার। কপালে হাত রাখলে হাত পুড়ে যায় অবস্থা। ফজর কাপড় ভিজিয়ে পানি পট্টি দিলো কপালে, কিন্তু কোনো লাভ হলো না, জ্বর কমে না।
রাতে ফজর বসে বসে কীভাবে বলরামপুর যাবে সে চিন্তাই করছে। ইউসুফও হয়তো বাড়ি ফেরার কথা চিন্তা করছে। সুজনের গলার শব্দে দুজনেরই ধ্যান ভঙ্গ হলো। ফজর সুজনের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কমেনি। সুজন বলল, ‘কেমন ঝম ঝমাইয়া বিষ্টি নামছে।’
ফজর বৃষ্টির কোনো আলামত দেখলো না। সুজনের চোখগুলো কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে।
সুজন ফজরের দিকে তাকিয়ে কাতর ভরা গলায় বলল, ‘আমি মইরা যামু, তাই না ফজর ভাই?’
‘না মরবা ক্যান, তুমি আমার লগে আমার বাইত যাইবা। আমেনার হাতের শাপলা ছালুন খাওয়ামু তোমারে, তহন বুজবা বেহেশতী খানা কী জিনিস!’
‘না ভাই, আমি মুক্তি হমু।’
‘তুমি মুক্তি হোওনের লাইগা এতো ফাড়াফাড়ি লাগাইছো ক্যান?’
‘ভাই আমি দেখছি। আমদানি ঘরে যহন মুক্তিগো গুল্লি করে, তাগো চোউখ বাইন্ধা দেয়। গুলি চলনের আগে তারা শইল্যার সব শক্তি দিয়া একটা কতা কয়। হুইন্যা পশম খাড়াইয়্যা যায়।’
‘কী কয়?’
‘জয় বাংলা। তুমি দেহো নাই ভাই, মরণের পরেও তাগো মুহে কেমুন মায়া লাইগা থাহে। মনে অয় যেন, মার কোলে মরছে। আমিও মার কোলে মরবার চাই গো ভাই। মার কতা ভুইল্যা গেছি, মায়রে মনে করবার চাই। আমি মুক্তি হমু ভাই।’
ফজর সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘আইচ্ছা হইবা। এহন ঘুমাও বাই।’
‘না ভাই তুমি আমারে কও, ভালা কইরা কও, আমি মুক্তি হমু। তোমার পোলার কসম দিয়া কও, আমি মুক্তি হমু।’
ফজর মাথা নিচু করে রইলো, তা দেখে সুজন যেন আরো ক্ষেপে গেল। বলল, ‘কও বাই কও, তাইলে একটু শান্তি লাগবো আমার।
ফজর বলল, ‘আইচ্ছা, তুমি মুক্তি হইবা। তোমার নাম হইবো মুক্তি সুজন।’
সুজনের মুখে প্রশান্তির আভা দেখা গেল। সে ঘুমিয়ে পড়ল।
ইউসুফ মুন্সি বিরক্ত হয়ে ফজরকে বলল, ‘যেই কতা রাকতে পারবা না হেই কতা দিলা ক্যান?’
ফজর মাথা নিচু করে বলল, ‘জানি না হুজুর।’
শেষ রাতে সুজনের জ্বর একেবারে সেরে গেল। সে উঠে বসলো, ঠেলে ঠেলে ফজর আর ইউসুফ কে উঠালো। হাসিমুখে বলল, “খুব ভালা লাগতাছে এহন। সকাল সকাল বাইর হইয়া যামু আমরা। নালিন্দাবাড়িত মুক্তিগো ক্যাম্প আছে, হেদিকে গিয়া নাম লেখামু।’
ইউসুফ মুন্সির খুব বিরক্ত লাগছে এসব শুনতে। সে বিরক্ত হয়ে শুধু বলল, ‘জয় বাংলা তোমার মাতা খাইছে।’
ফজর হাসিমুখে বলল, ‘ঠিক আছে, বেইন্যারটা বেইন্যা দেহন যাইবো। অহন একটু ঘুমাও, শইলডা ভাঁজে পরুক।’
সুজন শুয়ে পড়ল। ভোর হওয়ার আগেই সুজনের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর এলো। এলোমেলো বকছে সে, শুধু ‘মা মা’ করছে। ফজর আলী কপালে হাত দিয়ে ভয় পেয়ে গেল। পানিপট্টি দিলো আবার। সুজন এরমধ্যে দুবার বমি করেছে, পেটে কিছু নেই তার, তবুও বমি হয়েছে। মাকে ডাকতে ডাকতে সূর্য উঠার আগেই মারা গেল সুজন। সকাল আর দেখা হলো না তার।
ইউসুফ মুন্সি সুজনের জানাজা পড়ালো, তার পেছনে ফজর। ফজর আবার কোদাল হাতে নিলো, আবার কবর খুড়লো সে। সুজনকে শুইয়ে দিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টিতে পথে ঘাটে মাঠে সবখানে প্যাঁচপ্যাচে কাদা জমেছে। কাদাপথ মাড়িয়ে তারা হেঁটে চলেছে, পথের বুকে পদচিহ্ন এঁকে তারা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু জেলখানায় যাওয়ার আগে তারা যে পৃথিবী রেখে গিয়েছিল এটা সেই পৃথিবী নয়। মাঠ থেকে কেউ হাঁক ছেড়ে ডাকছে না, গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের কান্না আর মায়েদের শাসন শোনা যাচ্ছে না। রাস্তায় বৃদ্ধরা অকারণ কৌতূহল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছে না, ‘কেডা গো তোমরা? কোন বাড়ির কুটুম?’
সবকিছু কেমন যেন অসম্ভব নীরব আর নিস্তব্ধ। রাস্তায় দুই একটি মানুষ যদিওবা দেখেছে কেউ ভয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। রতননগর পৌঁছালো তারা, অনেক নাম শুনেছে এই গ্রামের। জেলার সবচেয়ে বড়ো হাট বসে রতননগর গঞ্জে। হাটের দিন নাকি বড়ো বড়ো মানুষরাও হারিয়ে যায় এই গঞ্জে। হাটেরদিন ছাড়াও প্রতিদিন ভিড় লেগেই থাকে। স্টিমার ঘাট আছে একটা গঞ্জের পাশেই। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন পণ্য আসে। সুন্দরবনের বাঘের চামড়াও নাকি আসে এই গঞ্জে। জমিদার জোয়ারদারেরা শখের বসে কিনে নিয়ে যায়। গঞ্জের পাশেই পৌষ মাসে যাত্রাপালার দল আসে আর মাঘ মাসে আসে সার্কাস দল। অথচ এখন কে বলবে এটাই সে রতননগর গঞ্জ, আজ আবার হাটবার। দুই একটি কুকুর এদিক সেদিক ঘুরছে, তাদের আচরণে কোনো আলস্য নেই, কেমন ভীত একটা ভাব। মানুষজন চোখে পড়ছে না। সব মানুষ গেল কোথায়? গঞ্জের ঢুকার রাস্তায় একজন মানুষ দেখা গেল। মানুষ না বলে ময়লার আখড়া আর উকুনের কারখানা বলাই ভালো। চুল দাড়ি জট পাকানো লোকটির দাড়িতে ভালো করে লক্ষ্য করলে খালি চোখেই দুই একটি উঁকুন দেখা যায়। লোকটির গায়ের গন্ধে টের পাওয়া যায়, ইহজীবনে পানির স্পর্শ পায়নি তার শরীর। ইউসুফ মুন্সি লোকটা থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বলল, ‘মানুষজন সব কই? আইজ হাটবার না?’
পাগল লোকটি ইউসুফের দিকে তাকিয়ে চক্ষু পাকিয়ে বলল, ‘বেবাক মানুষ ঘুমায়। তোর বন্দুক কই?’
‘বন্দুক নাই, বন্দুক থাকবো ক্যান?’
‘বন্দুক না থাকলে শুইয়া থাক, ঘুমাইয়া যা।’
‘কী আবোল তাবোল কতা!’
‘মুসলমানি হইছে তোর?’
ইউসুফ মুন্সি আর কথা বাড়ালো না, লোকটির কথাবার্তা বিপদজনক দিকে মোড় নিচ্ছে। হন হন করে হেটে গঞ্জ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা। লোকটি চেঁচিয়ে পেছন থেকে বলছে, ‘শব্দ করিছ না, মাইনষে ঘুমায়। আস্তে আস্তে যাইছ। মনা কাডা না থাকলে মুচির থেইক্যা কাইট্যা লইয়া আয়।’
গঞ্জ পার হতেই বিকট এক দৃশ্যের সামনে উপস্থিত হলো তারা। খালের পাড়ে খেজুর গাছের নিচে গুড়ের দোকানের মতো মাছির মেলা বসেছে। উৎকট গন্ধ ভেসে আসছে সেখান থেকে। কিছু কুকুর আনন্দে ঘেউ ঘেউ করছে। আট দশটা মানুষকে চালের বস্তার মতো স্তুপ করে রাখা হয়েছে। একটা কুকুর গভীর অধ্যাবসায়ের সাথে এক বৃদ্ধের হাত কামড়াচ্ছে। হাতটা প্রায় টেনে ছিড়ে ফেলেছিল, কিন্তু জীবিত মানুষদের উপস্থিতিতে কর্ম সম্পন্ন করতে পারলো না। একটু দূরে গিয়ে জিহ্বা ঝুলিয়ে পা গুটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। ইউসুফ মুন্সির পেটে পাঁক দিলো, হাত পা অবশ হয়ে গেল। পেটে হাত রেখে হড়হড় করে বমি করতে লাগলো সে। কিন্তু ফজর চমকালো একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার লাশ দেখে। মুখ থুবড়ে পরে আছে লাশটা, ফজরের বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। হাতদিয়ে উল্টালো লাশটি। মুহূর্তেই পেছনে সরে গেল। নাক ঠোঁট কিছুই নেই, নরম মাংস কুকুরেরা আগেই সাবাড় করেছে। ইউসুফ মুন্সি উদাস দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লাশটির দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত ঘষে স্বগোক্তি করলো, ‘শালা মুক্তির বাচ্চারা।’
ফজর আলী উপরে তাকিয়ে আছে, সম্ভবত আকাশ দেখছে। তুষ ঢালার পর চুলার আগুন যেমন বহুগুণে বেড়ে উঠে, তারপর আবার ধিকিধিকি জ্বলে, ফজরের বুকেও তেমন একটা আগুন সর্বদাই জীবন্ত। লাশটা দেখে তার বুকের আগুনটা যেন উসকে উঠলো। সুজন মৃত্যুর আগে বৃষ্টির শব্দ শুনেছিল, হয়তো তার বুকেও এমন একটা আগুন ছিল, তার আগুন নিভে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। ফজর আলী আকাশে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির অপেক্ষায়।
*
বলরামপুরের পাশের গ্রাম নিশিকান্দিতে ইউসুফ মুন্সির বাড়ি। আড়াইদিন হেঁটে ইউসুফ মুন্সি আর ফজর নিশিকান্দি গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁছালো। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে ইউসুফ মুন্সির। তার মেয়েটা বাজানকে দেখে কেমন খুশি হবে, ছেলেটা নিশ্চয়ই লাফ দিয়ে কোলে উঠবে, আর তার বউ ফাতেমা সে কি আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দেবে। তার বাবা ঝাঁপসা চোখে তাকে দেখে নিশ্চয়ই চিনতে ভুল করবে না। মা তো জড়িয়ে ধরেই বিলাপ করবে। মসজিদের পেছনে হিজল বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কে যেন ইউসুফ কে ডাকলো। ইউসুফ গলা শুনেই বুঝলো তার বৃদ্ধা মায়ের গলা। হিজল বনের ভেতর থেকে মায়ের গলা শুনে অবাক হয়ে গেল সে। দিনের বেলাতেও এই বনে কেউ যায় না, এইখানে খারাপ জ্বীনদের বসবাস। কিন্তু মায়ের ডাককে অগ্রাহ্য করতেও পারছে না সে। ভেতর থেকে অনেকগুলো গুমোট ফিসফাস শব্দ ভেসে আসছে। ইউসুফ মুন্সি সুরা ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তার মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইউসুফ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, গ্রামের অনেক মানুষ এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। ভয়াল দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে, প্রচণ্ড বিপদে কেউ কেউ অভ্যাসমতো ঘুমিয়ে আছে। মরলে ঘুমের মধ্যেই মরতে চায় তারা। ইউসুফের বৃদ্ধা মায়ের পাশে তার নয় বছরের ছেলেটিও আছে। সে তার ‘বাজান’ কে দেখে অবাক হয়েছে কিন্তু খুশি হয়েছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। বৃদ্ধা পুত্রদর্শনে আবেগ তাড়িত হয়ে কাঁদতে বসে গেল। কান্নাটা একটু জোর পেতেই সবাই মৃদু ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। ইউসুফ তার মা কে বলল, ‘কী হইছে মা, বেবাক মানুষ এই জ্বীনের আস্তানায় ক্যান?’
‘বাবাগো জানোয়ারের দল আইসা সব জ্বালাইয়া দিছে। আশ (হাঁস)-মুরগার লাহান মানু মারতাছে।’
ইউসুফের চোখে এক রাশ রক্ত এসে ভর করলো, বলল, ‘মুক্তিরা এইহানেও আইয়া পড়ছে?’
ইউসুফ মুন্সির মা পুত্রের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল, কথার সুরটা ধরতে পেরে বলল, ‘মুক্তিরা না রে বাজান, পাকি জানোয়ারেরা সব জ্বালাইছে। মুক্তিরা তো সব আমাগো পোলাপান।’
ইউসুফ কথাগুলো হজম করতে পারলো না, মাথার উপরে আকাশটা যেন খান খান করে ভেঙ্গে গেল। মায়ের কথাগুলো নিজের মনেই দুয়েকবার আওড়ে নিলো, ভুল শোনেনি তো? নিজেই নিজেকে বারবার অবিশ্বাসের সুরে বলতে লাগলো, ‘পাকিস্তানিরা মুসলমানের গেরামে আগুন দিছে? মুসলমান মারছে?’
হঠাৎ তার মন চঞ্চল হয়ে উঠলো, বলল, “মা, ফাতেমা কই? আর আমার মাইয়া জুলেখা কই? আব্বারে দেহি না কেন?’
‘তোর বাপেরে মাইরা লাইছেরে পুত।’
ইউসুফ মুন্সির নিঃশ্বাস আটকে এলো, কিন্তু শোক করার অবকাশ নেই, মাকে আবার বলল, ‘ফাতেমা আর জুলেখা কই?’
বৃদ্ধা কেঁদে উঠলো, “তোর বউ আর মাইয়ারে ক্যাম্পে ধইরা নিয়া গেছে পাঞ্জাবীরা।’
বৃদ্ধা জুলেখার পরিধেয় শাড়িটি গুটলি করে বুকে নিয়ে রেখেছিল, সেটা ইউসুফের দিকে এগিয়ে দিলো। এই শাড়িটিই পরে ছিল জুলেখা, এখনো তার গায়ের গন্ধ লেগে আছে তাতে। পাঞ্জাবীদের শাড়ির প্রয়োজন নেই। খুলে রেখে গেছে।
ফজর চেয়ে দেখলো ইউসুফ মুন্সির চেহারাটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। মুন্সির এই চেহারা ফজর আগে কোনোদিন দেখেনি। হিংস ভয়ানক একটা চেহারা, চোখ মুখ ফেটে যেন রক্ত ঝরে পড়বে। মুন্সির মুসলমানী বিশ্বাসের সাথে এতবড়ো প্রতারণা সে সইতে পারছে না। হাতের পেশীগুলো ফুলিয়ে, হিজল গাছের ভাঙা একটা ডাল হাতে নিলো ইউসুফ মুন্সি। পাগলের মতো গুল্ম, ডালপালা ভাঙ্গতে লাগলো, যেন একটা ঝড় সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। ডালপালার উপর প্রলয় শেষ হতেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়ল। মেয়ের পরিধেয় শাড়িটি হাত বাড়িয়ে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে গেল। পেছনে সবাই ‘হায় হায়’ করে উঠলো। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ফেরানোর চেষ্টা করলো। কেউ কেউ বৃদ্ধাকে চুপ করার জন্য ধমক দিলো। কেউ কেউ বলে উঠলো, ‘আটকাও মুন্সিরে আটকাও।’ কিন্তু আটকানোর লক্ষণ কারো মধ্যে দেখা গেল না। ফজর আকস্মিক এসব ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে ছিল। সম্বিৎ ফেরা মাত্রই সে ছুটলো ইউসুফ মুন্সির পেছনে।
নালিন্দাবাড়ি গ্রামের সীমানায় প্রকাণ্ড তেতুল গাছের নীচে এসে ফজর ধপ করে বসে পড়ল। ইউসুফ মুন্সির উন্মাদ পা জোড়ার কাছে পরাজিত হয়েছে সে। ইউসুফ মুন্সি মাঠ পেরিয়ে ঘন সবুজ বৃক্ষের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। বৃক্ষ রাশির উপরে লম্বা বাঁশের মাথায় সাদা সবুজ পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। সেখানেই পাকিস্তানি আর্মিরা ক্যাম্প করেছে। ফজর আলী হাঁপাতে লাগলো, মাঠ পেরুলো না, সে ঘুরে চলল বলরামপুরের দিকে। দেশে সবাই বিপদে আছে, প্রাণ নিয়ে পথে পথে ঘুরছে। আমেনা আর মজিদ না জানি কেমন আছে?