১১
ভোরে এখনো পাখি ডাকে, কিন্তু সেই ডাকে থাকে বিষাদের সুর। সকালের সূর্য গায়ে মেখে হাল কাঁধে নিয়ে দল বেঁধে মাঠে যেতে দেখা যায় না চাষাদের। উঠানে দাদীকে ঘিরে ধরে ‘শুল্লুক’ কিংবা ‘কিছ্যা’ বলতে জ্বালায় না বাচ্চাদের দল। তাদের ঘরে পুরে রেখেছে গৃহিণীরা। দুপুরবেলা আর পুকুরঘাটে যায় না মহিলারা, রাতের বেলা যায় কলসি নিয়ে। বুড়ো রইসুদ্দিন গোয়ালঘরের সামনে বসে বিলাপ করে, তার ছেলে উজানে আছে, রাজাকাররা এসে গোয়ালের সব গরু আর সাথে ছেলের বৌকে ধরে নিয়ে গেছে। ছেলের বউয়ের জন্য আক্ষেপ নেই, কিন্তু গরুগুলোর জন্য বুক ফেঁটে যায় তার।
মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে বলরামপুর গ্রামের পাশের গ্রাম নিশিকান্দিতে। ভয়ে আশেপাশের সব গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে। যারা ছিল তারা ঘরে লুকিয়ে থাকে, অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। জোয়ার্দারসাহেব শান্তি কমিটি করেছেন, তার বাড়িতে প্রতিদিন বিরাট মচ্ছব হয়। গরু-খাসি জবাই হচ্ছে প্রতিদিন, মিলিটারির বড়ো অফিসাররা প্রতিদিন দাওয়াত কবুল করে যাচ্ছেন। কলিম ব্যাপারী রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হয়েছে, তাকে আড়ালে আবডালেও কেউ চোরের দোসর বলার সাহস পায় না এখন।
রোশনী আর গঞ্জে যায় না এখন, কিন্তু সকালে উঠেই সেই বাঁশ নিয়ে বসে থাকে, এটা সেটা বানায়। আমেনা চালের ভাড়ারে চোখ বুলিয়ে শঙ্কিত হয়, মনে মনে শুধু বলে, ‘কবে শেষ হইবো যুদ্ধ।’ নসু মাঝি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে চলে আসে, এটা সেটা দিয়ে যায়। আমেনা প্রতিবারই নসুকে বলে, ‘এইসবের দরকার নাই, আর কিছু আইনে না।
কিন্তু কোনোবারই আমেনার গলায় জোর থাকে না। বলরামপুর গ্রাম আর আগের সেই গ্রাম নেই, কিন্তু হুরমতির গলা সেই আগের মতোই আছে। নসু আসলেই সে ব্যঙ্গ করে চেঁচিয়ে বলে, ‘ভাতার আইছে? সালুন দিয়া ভাত দেও।’
নসু লজ্জায় অপমানে মাটির সাথে মিশে যায়, রোশনী রাগে দাঁতে দাঁত ঘষে। কিছু বলতে গেলেই আমেনা বাধা দেয় চোখের ইশারায়। হুরমতির স্বামী তরিকত মোল্লা রাজাকার বাহিনীর সদস্য, তার পাশের বাড়িতে থাকার কারণেই হয়তো এখনো পুরুষবিহীন এই বাড়িতে কারো নজর পড়েনি। কিন্তু কতদিন নজর বাঁচিয়ে থাকা যাবে? নসু আমেনার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভাবি এইখানে আর পইরা থাকার কি দরকার? সবাই চইল্যা যাইতাছে।’
‘কই যামু ভাই ঘর ছাইড়া?’
‘ঘর তো ঘরের জায়গাত থাকবো, আগে জানডা বাচান। মিলিটাররা নাকি মাইয়ালোকগুলারে ধইরা নিয়া যাইতাছে।’
রোশনী আর আমেনা দুজনেরই বুক কেঁপে উঠে। আমেন বলল, ‘বেবাকখানে মিলিটারি আইছে, যামু কই?’
নসু মাঝি গলা নামিয়ে বলল, ‘নালিন্দাবাড়ি থেইক্যা পত্যেকদিন বড়ারে বড়ো নাও যায়, আমি আপনাগো কালী গাঙ দিয়া নালিন্দাবাড়ি নামায়া দিয়া আসুম।’
গলার স্বর আরো নিচু করে নসু বলল, ‘ঐখানে মুক্তিরা কেম্প করছে। মিলিটারির সাহস নাই হেদিকে যাওনের।’
আমেনা শুধু ‘হু’ বলল। কেন যেনো এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা সে চিন্তা করতে পারে না। একদিন কিছু না ভেবে ভোরে বের হয়ে গিয়েছিল, ভাগ্য তাকে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরিয়ে এনেছে এই ঘরে। কিছু একটা বেঁধে রাখে আমেনাকে, সেটা কী ফজরের স্মৃতি নাকি অপেক্ষা? আমেনা জানে না।
*
দুই সপ্তাহে ইউসুফ মুন্সি আর বাচ্চু মিলে জেলখানার সব কাগজ আর গাছের ডালপালার টুকরা জোগাড় করে ফেলল। জেলখানার ভেতরটা ঝাড়ু দিয়েও এত পরিষ্কার করা যায়নি কোনোদিন, একেবারে তকতক করছে। পরিবেশ দেখে গার্ডরা খুশি, কিন্তু বাচ্চু আর ইউসুফ মুন্সির মুখ মলিন। ইতোমধ্যে তারা নিশ্চিত তারা পাগলের তালে নাচছে, নিজেদের বোকামীর জন্য দিনে শতবার নিজেদের অভিসম্পাত দেয়। সুজন একটু সুস্থ হয়ে উঠেছে, কিন্তু রাতেরবেলা জ্বরটা বেড়ে যায়। তখন সে তার বিস্মৃতপ্রায় মাকে দেখতে পায়, কথাও বলে। ফজর শুধু দিন গুনছে। তার আর তর সইছে না। পায়চারী করতে থাকা প্রফেসরের কাছে মাঝেমধ্যেই অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কবে?’
প্রফেসর ঢিল ছুঁড়ে উপরে, তারপর বলে, ‘সময় হলে।’
আজও পূর্বদিকের দেয়াল ঘেষে পায়চারী করছে প্রফেসর। ফজর দুটো ইটের টুকরা নিয়ে তার হাতে দিলো গোপনে। তারপর বলল, ‘হুজুরে কয় আপনে পাগল, আপনের কতায় নাচা ভুল হইছে।’
‘তোমারও কি তাই মনে হয়?”
ফজর মাথা নিচু করে রাখলো, তারপর বলল, ‘আর কতদিন এমনে চলবো? কবে যামু এইখান থেইক্যা?’
প্রফেসর কিছু বললেন না, একটুও বিচলিত হলেন না, চারদিকে তাকিয়ে উপরে ঢিল ছুড়লেন। দেয়ালে সাথে লাগানো ল্যাম্পপোস্টের বাতিটি আর্তনাদ করে ভেঙ্গে গেল। তিনি ফজরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘আজকেই।’
*
ইউসুফ মুন্সি তার পরিবারের কথা বলছে, একটি মেয়ে একটি ছেলে তার। মা-বাবা এখনো বেঁচে আছে। মেয়েটি নাকি তার খুব ন্যাওটা ছিল, এখন সারাদিন কাঁদে। খালি ‘বাজান বাজান’ করে। আঙুলের কড়া গুণে হিসাব করলো ইউসুফ, মেয়ের বয়স তেরো পার হয়ে গেছে, মেয়ের জন্য কী নিয়ে যাবে তাই নিয়ে পরামর্শ চলছে এখন। ফজর এসে বলল, ‘গঞ্জ থেইক্যা শাড়ি কিন্যা লইয়া যাইয়েন, কিন্তুক ট্যাকা কই?
ইউসুফ মুন্সি একটু চিন্তায় পড়ে গেল, তারপর তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ‘বারেকের দোকান থেইক্যা বাকি নিমু, পরে শোধ দিমু।’ শোধের কথা আসতেই ফজর বলল, ‘দেশে গিয়া কী কাম করবেন?’
‘দেশে ইসলামের লাইগ্যা যুদ্ধ হইতাছে, আমিও হেই যুদ্ধে সামিল হমু। রেজাকার হমু। ‘
বাচ্চু সাথে সাথে সম্মতি দিলো, বলল, “ঠিক বাত, হামভী পাকিস্তানি ভাইগো লগে থাকুঙ্গা।’
সুজন ফজরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কী করবা ফজর ভাই?’
ফজর শূন্য চোখে তাকিয়ে বলল, ‘জানি না কী করুম।’
ইউসুফ মুন্সি একটা স্নেহের ধমক দিয়ে বলল, ‘জানি না কী আবার? তুই আমার লগে থাকবি, তুইও রেজাকার হবি।’
ইউসুফ মুন্সিকে শ্রদ্ধা করে ফজর। সেও মনে মনে ভাবে, যে যাই বলুক ইউসুফ মুন্সির সাথেই থাকবে সে।
ইউসুফ মুন্সি সুজনের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী সুজন মাস্টর চুপ ক্যান? তুমি কই যাইবা?’
সুজন তার চোখ দুটো দেয়ালের দিকে বিছিয়ে বলল, “আমি মুক্তিফৌজে জয়েন দিমু, আমি মুক্তি হমু।’
ইউসুফ মুন্সি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করলো না, রাগত কন্ঠে বলল, ‘ইন্ডিয়ার দালালগুলান তোমার মগজধোলাই করছে, ভালা-মন্দ বুঝতাছো না তুমি। মুসলমানের বেটা হইয়া তুমি ক্যামনে মুক্তি হইতে চাও? পিঠের উপ্রে রাইফেলের বাটের বারি কি ভুইল্যা গেছো? এই দেশে কোনো মুক্তিগো রেহাই নাই। মরবা, মরবা।’
সুজন দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘মরলে মরছি, মরার আগে একটা হইলেও পাঞ্জাবী মাইরা মরমু।’
ইউসুফ মুন্সি শ্লেষোক্তি করলো, ‘কিলের শইলে কিল বিছারে, কিল না পাইলে উথাল পাথাল করে।’
*
রাতেরবেলা সবাই গোল হয়ে বসে আছে। চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যে শুধু প্রফেসর স্বভাবমতো বিকারশূন্য। ইউসুফ প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এহন?’
প্রফেসর তার বইটি বন্ধ করে একটু ঝুকে বাচ্চুকে বলল, ‘বিড়ি আছে? বিড়ি ধরাও।’
ইউসুফ মুন্সি হতবাক হয়ে বসে রইলো। সে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘এহন কি বিড়ি খাওনের সুমায়? এই তালা ভাইঙ্গা বাইর হমু ক্যামনে? কাগজ-টাগজ কি চাবাইতে আনাইছেন?’
প্রফেসর বলল, ‘বিড়ি ধরালেই তালা খুলে যাবে।’
ইউসুফ বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল, ‘কী আজগুবি কতা।’
বাচ্চু বিড়ি ধরালো, দুই টান দিয়ে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়লো। প্রফেসর হাত বাড়িয়ে বিড়ি চাইলো। ফজর খুব বিস্মিত হলো, প্রফেসরকে কখনো বিড়ি খেতে দেখেনি সে। প্রফেসর বিড়িটি হাতে নিয়ে কাগজের স্তূপে ফেলে দিলেন। কাগজের মধ্যে কোথায় যেন বিড়িটি হারিয়ে গেল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লাল আভা জানালো, বিড়ির জীবন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। লাল আভাটা কাগজ ফুড়ে লাল জিহ্বা বের করলো, আগুন জ্বলে উঠলো। শুকনো কাঠ পেয়ে আগুনের মাত্রা বাড়তে লাগলো। বাচ্চু চিৎকার করছে। প্রফেসর সবাইকে এক কোণে টেনে নিয়ে গেল, বলল, ‘যখন গার্ডরা তালা খুলে আগুন নেভাবে, তোমরা শুধু আমাকে অনুসরণ করবে।’
অন্ধকার ঘরটিতে আলোর ঢেউ খেলতে লাগলো। চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আলুথালু বেশে সদ্য ঘুম ত্যাগ করে আসা গার্ড হকচকিয়ে গেল আগুন দেখে। আগুনটা প্রায় ফজরদের ছুঁয়ে ফেলছে। গার্ড তাড়াতাড়ি চাবি ঢুকিয়ে গরাদ খুলে ফেলল। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো পাঁচজন। গার্ড আবার দৌড় দিলো, পাগলা ঘণ্টা বাজাতে অথবা আগুন নেভানোর জন্য সাহায্য আনতে, সে প্রায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। প্রফেসর দৌড়াতে শুরু করলো, তার পেছনে বাকিরা। তারা প্রাণপনে দৌড়ে পূর্ব দেয়াল ঘেষে দাঁড়ালো। অন্যসময় হলে তাদের স্পষ্ট দেখা যেতো কিন্তু এই দেয়ালের পাশের ল্যাম্পটি আজ দুপুরেই চূর্ণ হয়ে গেছে। অন্ধকারের ছায়ায় আশ্রয় নিলো তারা। ফজর হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এহন কী করুম?’
প্রফেসর গলা নিচু করে বলল, ‘দেয়ালে ঐপাশে মহিলা ওয়ার্ড, সেখানে কোনো কয়েদী নেই। কিছু সৈন্য থাকে। পাগলা ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে তারা মেইন গেইটের দিকে চলে যাবে। তখন মহিলা ওয়ার্ডের উত্তর দিকের দেয়াল পার করতে হবে, দেয়ালের পাশেই সুপারী গাছ আছে। দেয়ালের ঐ পাশেই জেলজীবনের সমাপ্তি। তবে সেখান থেকে জঙ্গলের পথ ধরে যতক্ষণ পারা যায় দৌড়াতে হবে। যুদ্ধের সময় জেলপালানো কয়েদীদের খোঁজার জন্য খুব বেশি ঝামেলা করবে না কেউ। এখন ভেতরে আর বাহিরে তেমন পার্থক্য নেই। একটা ছোটো কারাগার, আরেকটা বড়ো কারাগার।
ইউসুফ মুন্সি ভ্রু নাচিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘সবই বুজলাম, তয় এই উচা দেয়াল পার হমু ক্যামনে? এইখানে তো কলাগাছও নাই। ‘
প্রফেসর বলল, ‘দেয়াল খুব বেশি উঁচু না, বারো ফিট হবে। একজনের কাঁধে ভর দিয়ে পার হওয়া যাবে।
ফজর জিজ্ঞাসা করলো, ‘যে শেষে যাইবো হে কার কান্ধে খাড়াইবো?’
প্রফেসর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘যে শেষে থাকবে সে যাবে না।’
সুজন আঁতকে উঠলো, সে বলল, ‘না আমি থাকুম না।’
প্রফেসর হেসে বলল, ‘তোমার চিন্তা নেই, তুমি সবার আগে যাবে। আমিই যাবো না।’
সুজন স্বস্তি পেলো। বাচ্চু, ইউসুফ, আর ফজর হতবাক হয়ে গেল। ইউসুফ মুন্সির মনে এই প্রফেসরের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। কেউ কিছু বলল না, কেউ চায় না প্রফেসরের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসুক, শুধু ফজর একটু ব্যথিত হলো।
একদল গার্ড পানি, বালি নিয়ে দৌড়াতে লাগলো, এরমধ্যেই পাগলা ঘণ্টা বিকট শব্দে বেঁজে উঠেছে। শব্দহীন রাত্রীতে শব্দটা দানবের মতো শোনাচ্ছে। একে একে সুজন বাচ্চু ইউসুফ পার হয়ে গেছে, ফজরের কাঁধে পা রেখে। এখন ফজরের পালা। কিন্তু সে নড়তে পারছে না। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্যান স্যার? আপনে যদি না যাইবেন তাইলে এতকিছু ক্যান…?’
প্রফেসর কিছু বলতে পারলো না, বলার সাধ্যও নেই। এই জেলখানা থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা তার নেই, বাহিরের পৃথিবীতে সে খুনি, আর জেলখানায় সে পাগল। নিজের বউয়ের খুনী হওয়ার চেয়ে পাগল হয়ে থাকা ভালো। আরেকটি যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়, একটি সত্য যা সে ভুলতে চায়। যে সত্যকে ঢাকার জন্য সে নিজের বউকে খুন না করেও খুনী হয়েছে। সবাই জানে, তার বাবা ছেলের এই অপরাধ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু একমাত্র প্রফেসর এবং তার বাবাই জানে কে অপরাধী। প্রফেসর তার বাবাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মহান মানুষ ভাবতো, সেই বাবাই কিনা বিকৃত রুচির মানুষ। ছেলের বউকে ধর্ষণ করে গলা টিপে মারলো। প্রফেসর তা মানতে পারেনি, এক লহমায় শ্রদ্ধার আসন থেকে বাবাকে খসাতে পারেনি। ছেলে হিসেবে বাবাকে নিয়ে গর্ব করতো সে। খুনের দায় নিজে নিয়ে নিলো যাতে বাবার সম্মান বজায় থাকে, তাতে তারও সম্মান রক্ষা হলো। কিন্তু তার বাবা এই গ্লানি সহ্য করতে পারেনি, ল্যাবে তার মৃত দেহ পাওয়া গেল। সায়ানাইড খেয়েছে।
ফজর আলীর প্রতি প্রফেসরের একটা মায়া আছে, কারণ তারা দুজনেই নিকট আত্মীয়ের সম্মান মর্যাদার জন্য জেলে এসেছে। একজন খুন না করেও খুনী হয়েছে, একজন চুরি না করেও অপরাধী হয়েছে। একজন নিজের পরিচয় ত্যাগ করেছে পিতার জন্য আরেকজন পুত্রের জন্য। প্রফেসর ফজরের দিকে আদেশের সুরে বলল, ‘আমি বসছি, তুমি আমার কাঁধে দাঁড়াও।’
‘এত বড়ো বেয়াদ্দপী আমি ক্যামনে করি স্যার?”
প্রফেসর ধমক দিয়ে বললেন, ‘বেশি কথা বলো না, সময় কম। তাড়াতাড়ি করো।’
ফজর দ্রুত হাঁটু ভাঁজ করে প্রফেসরের পা ছুঁয়ে নিলো, মাথা নিচু করে বলল, ‘যেই হাত দিয়া আপনের পা ছুইছি, সেই হাতটা আমি আমার পোলার কপালে ছোঁয়ামু, সেও যাতে আপনের মতো মানুষ হইতে পারে।’
প্রফেসর তার আবেগ দমন করে আবার তাড়া দিলো, ফজর সাবধানে প্রফেসরের কাঁধে পা দিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। দেয়ালের ঐপাশে নামার আগে সে প্রফেসরের দিকে তাকালো, একই সাথে তার চোখে জল এবং প্রশস্ত হাসি দেখতে পেলো প্রফেসরের মুখে। পাগলা ঘণ্টা তখনো বেজে চলেছে, আসলেই উন্মাদের মতো বাজছে।
মহিলা ওয়ার্ডের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বড়ো রাস্তা পার হয়ে ঝোপঝাড়ে ভর্তি জঙ্গলে ঢুকলো তারা। অন্ধকারে উল্কার মতো ছুটে চলেছে চারটি মানুষ। কাটার ঝোপে চামড়া ছড়ে রক্ত ঝরছে, সাপ-খোপ সমৃদ্ধ জঙ্গলে সব ভয় মাড়িয়ে তারা বোধহীনভাবে দৌড়াচ্ছে শুধু। তাদের পেছনে তাড়া করা একঘেয়ে ঘণ্টার শব্দটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।