১০
মোটা উঁচু দেয়াল ভেদ করে মুক্ত পৃথিবীর অনেক খবরই পৌঁছায় না জেলখানায়। দেয়ালের ঐ পাশের খবরগুলো তাদের অজানাই থেকে যায়। কিন্তু যুদ্ধের খবরটা ঠিক পৌঁছে গেল জেলখানায়। ভেতরের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাওয়াতেই বুঝি ব্যাপারটা সবাই আন্দাজ করে নিলো। বাঙালি গার্ডের জায়গায় দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দি পরা বিশালদেহী সৈনিক। আগের মতো নিয়মিত গণনা করা হয় না। তাদের খাবারের প্লেট আগের মতো পূর্ণ হয় না, অর্ধেক খালি থেকে যায়। তিনবেলা নিয়মিত খাবারও জুটে না, হিন্দু কয়েদীদের আলাদা করে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলছে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে, কিন্তু এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করেনি। সুজন মাস্টার ছিল জেলখানার রেডিও, তার কাছে সব খবর পাওয়া যেতো। একদিন এসে বলল, ‘ঢাকায় গোলাগুলি হইছে, বহুত মানুষ মরছে। এইবার বাঙালিরা আর সইহ্য করতো না, দেখাইয়া দিবো।’
ইউসুফ মুন্সি শ্লেষমাখা কন্ঠে বলল, ‘কইথিকা পাও এইসব খবর? মানুষ মরে নাই, হিন্দু মরছে, ইন্ডিয়ার দালাল মরছে। এইডা মুসলমানগো দেশ, মুসলমানরা মুসলমানগো লগে যুদ্ধ করতো না। আমাগো যুদ্ধ একটাই ইসলাম রক্ষার যুদ্ধ।’
সুজন গ্রাহ্য না করে আবার বলল, ‘শেখসাহেবরে ধইরা নিয়া গেছে পশ্চিমে।’
বাচ্চু উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘ইয়ে আচ্ছা কাম হুয়া, বাঙালি ফকিন্নীর বাচ্চাগো খালি উসকাতা হায় ও।’
‘বাঙালি ফকিন্নীর বাচ্চা’ কথাটা শুনে নবাব পুত্র পাকিস্তানি বাচ্চুর দিকে সবাই সরু নজরে তাকালো, এমনকি ইউসুফ মুন্সিও।
***
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ঢাকার আগুন মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। মফস্বলের এই জেলখানাতেও তার ছোঁয়া লেগেছে। এখন আর কারো সাথে দেখা করতে স্বজনেরা আসে না। জেলের নতুন হাজতিরা যেই ঘরে থাকতো, সেটাকে বলা হতো আমদানী ঘর। আমদানী ঘর ততদিনে রপ্তানী ঘর হয়ে গেছে। ভেতরে তাকালে দেখা যেতো ভীত সন্ত্রস্ত একদল মানুষ, অধিকাংশ নগ্ন, তাদের দেহ রক্তাক্ত, তাদের কারো হাতে নখ নেই, সব নখ উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রতিদিনই সেখানে গুলির শব্দ পাওয়া যেতো, সেই ঘর থেকে কাউকে জীবন্ত বের হতে দেখেনি কেউ।
মাঝেমধ্যেই সকালে লাইন ধরে গোনার সময়, মোটা গোফওয়ালা গার্ডটি কিছু লোককে লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতো, তারাও আর ফিরে আসতো না। কানাঘুষা চলতো, কিন্তু কেউ উচ্চবাচ্য করতো না। গুঞ্জন উঠতো, সেই লোকগুলো নাকি মুক্তি ফৌজের পক্ষের লোক। তারা জেলখানায় বসে অন্য কয়েদীদের ইন্ডিয়ার দালাল বানাচ্ছিল।
সকাল বেলার গণনা হচ্ছে। পাঞ্জাবী অফিসার আজ নিজে কয়েদীদের দেখছেন। এই সময়টায় সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতো, কোনো কারণে কারো ডাক পড়লেই শেষ। লাইনের সামনে হেঁটে হেঁটে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই অফিসার প্রত্যেকের দিকে তাকাচ্ছে। তার জুতার মচ মচ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ হচ্ছে না। কেউ জোরে নিঃশ্বাসও ছাড়তে পারছে না, নিঃশ্বাস ছাড়লেই যেন সেটা নীরবতা ভঙ্গ করবে। পাঞ্জাবী অফিসার সুজনকে আঙুলের ইশারায় ডাকলো, তারপর সে আঙুল তুলল ফজর আলীর দিকে। ফজর আলীর মাথা ভন ভন করে ঘুরতে থাকলো, বুকটা ভেঙ্গেচুড়ে গেল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো, যেন পৃথিবীর সব বাতাস ফুরিয়ে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মজিদের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলো, আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সে মজিদের চেহারাটা মনে করতে পারলো না।
আমদানী ঘরের পেছনে তাদের দাঁড় করানো হলো, জায়গাটা ঝোপঝাড় দখল করে রেখেছে। ফজর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। একবার চিন্তা করলো, মাফ চাইবে, কিন্তু অপরাধ কী সেটাই জানে না, কীসের জন্য মাফ চাইবে? মাফ চেয়েও কি লাভ হবে? গুলির অপেক্ষা করতে লাগলো ফজর, হঠাৎ এক পাঞ্জাবীর গলা শোনা গেল, ‘খোদো!’ ফজর চোখ খুলে দেখলো, তাদের সামনে কোদাল। গর্ত করতে বলছে।
*
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। ইউসুফ মুন্সি নফল নামাজে বসে গেছে। সে সুজন আর ফজর আলীর জন্য দোয়া করছে। যতবার হাত তুলছে ততবার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে তার দাড়িগুলো ভিজে যাচ্ছিল। ফজর আলীকে আসলেই সে খুব ভালোবাসতো। বাচ্চু নির্বিকারভাবে বসে আছে, সে মনেপ্রাণে পাকিস্তানি হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত, পাকিস্তানিদের কাছে মৃত্যু ডালভাত ব্যাপার। প্রফেসর বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে, মুখ বইয়ে থাকলেও তিনি বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন।
সেলের লোহার দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল, সুজন আর ফজর ঢুকলো। ইউসুফ মুন্সি ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ বলে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দুই হাতে ফজরকে জড়িয়ে ধরলো, তার দাড়ি বেয়ে এখনো পানি ঝরছে। ফজর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, সুজন ধপ করে বসে পড়ল। প্রফেসরসাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, কাউকে কিছু না জিজ্ঞাসা করে আবার বইয়ে মুখ গুঁজলেন। বাচ্চু নাকের পশম টেনে ছিড়ছিল, সে তার কাজ অব্যাহত রেখে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ছোড় দিয়া কিউ? কিল ঘুষি খায়া?’
সুজন কিছু বলল না, ফজর বিড়বিড় করে বলল, ‘লাশ চাপা দিছি, অনেক, অনেক লাশ।’
*
নিত্যদিন ফজর আলীকে নতুন নতুন কবর খুঁড়তে হতো। লাশগুলোর হাতে একজন ধরতো আর পায়ে একজন, তারপর গর্তে ছুড়ে মারতো। হাতপা মুচড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকতো লাশগুলো। একটা গর্তে কয়েকটা লাশ। সুজন আমদানী ঘর থেকে ঝাড়ু দিয়ে নখ অথবা কাটা আঙুল জড়ো করতো, লাশগুলো ফেলার পর কোনো কোনোদিন এক ঝুড়ি নখ জমে যেতো। সেই নখগুলোও গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয় তারা। সুজন মাস্টার মাঝেমধ্যে রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায়। ফজরও কেমন যেন নির্জীব হয়ে গেছে। এখন লাশগুলোকে শুধু লাশ মনে হয় তার। এই সব শরীরে এক কালে প্রাণ ছিল, নখবিহীন এসব আঙুল প্রেমিকার গাল ছুয়েছে অথবা সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়েছে তা একবারও মাথায় আসে না ফজরের
আমদানি ঘরের পাশে বসে বিড়ি টানছিল ফজর। হঠাৎ মাথার উপরে জানালা দিয়ে কেউ একজন ডাকলো। কাতর গলায় বলল, “বিড়ি আছে?’
ফজর মুখ তুলে চাইলো জানালায়, একটা পরিচিত মুখ, দেখে খুশি হবে নাকি কষ্ট পাবে বুঝতে পারছে না সে। এই সেই নাদির গুন্ডা। সে উচ্ছাসে বলল, ‘ভাই আমারে চিনতে পারেন নাই? আমি আপনের সাথে হাজতে আছিলাম কিছুক্ষণ, আপনে আমারে এক প্যাকেট সিকেরেট দিছিলেন।’
নাদির গুন্ডা চিনতে পারলো। তার মুখেও উচ্ছ্বাস। সে বলল, ‘তোর সাজা হইছে? কয় বছর?’
ফজর একটা নতুন বিড়ি ধরিয়ে নাদিরের হাতে দিয়ে বলল, ‘সাড়ে পাঁচ বছর দিসে। আপনে এইহানে ক্যান?’
‘পাঞ্জাবী মারছি, কত্তবড়ো সাহস আমার এলাকার মানুষ মারতে আইছে। গ্যাদা গুন্ডা ধরাইয়া না দিলে আরো দশ বারোডা মারতে পারতাম। জেলখানায় আছস ভালা আছস, এই পাকিস্তানি শুয়োরগুলা মানুষ না, যেমনে পারতাছে মানুষ মারতাছে, জোয়ান মাইয়াগো ধইরা নিয়া নষ্ট করতাছে, বাচ্চাপোলাপান ও ছাড়তাছে না। জানোয়ারের দল। আমারে ঢাকার থেইকা ধইরা এইখানে আনছে, আইজকাইলের মধ্যেই মাইরা ফেলবো, যত তাড়াতাড়ি মারে তত ভালা।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘একটু পানি খাওয়াইতে পারবি?’
ফজর আলী দৌড়ে বের হয়ে গেল পানির সন্ধানে। একটা টিনের মগে পানি ভর্তি করে এসে দেখলো জানালাটা ফাঁকা। তারপর আর কোনোদিন সে নাদির গুন্ডাকে দেখেনি।
.
অন্ধকার ফজর আলীকে ঘুম পাড়াতে পারছে না। মেঝেতে উপুর হয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে সে, তার বুক ফেটে কান্না আসছে। প্রফেসর ফজরের পিঠে হাত রাখলো, জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হয়েছে ফজর?’
ফজর কুর্তার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘স্যার, আমি এইখানে থাকলে মইরা যামু।’
‘এখানের খাওয়াদাওয়া পরিশ্রম সব একসময় তোমার শরীর মানিয়ে নেবে।’
‘না স্যার, খাওনের কষ্ট সইহ্য করতে পারুম, আমগো জীবনে এর চেয়ে বেশি কষ্ট পাইয়া আইছি।’
‘তাহলে কী হয়েছে?’
‘আমার পোলাডার চেহারা ভুইল্যা গেছি স্যার, মনে করতে পারি না। আমি আমার মজিদের চেহারা মনে করতে পারি না।’
‘আমি জানি তোমার কেমন লাগছে। প্রিয়জনদের চেহারা বেশিদিন মনে রাখা যায় না, মন ভুলিয়ে দেয়, যাতে চোখ বার বার তাদের দেখে। সেজন্যই তারা প্রিয়জন।’
‘স্যার আমি এইখান থেইক্যা পলাইয়া যামু।’
‘সবাই আমাকে পাগলে বলে, কিন্তু এখন তুমি পাগলের মতো কথা বলছো। তেরোটা বুলেটের কথা মনে আছে?’
‘মরণের ভয় নাই, এইখানে পেত্যেকদিন মরি।’
‘হুট করে কোনো ভুল করো না।’
‘আপনে বুঝতাছেন না স্যার, আমার পরাণডা কেমন করতাছে।’ প্রফেসরের চোখ যেন জ্বলে উঠলো, বলল, ‘আমি বুঝবো না? তুমি আজ না হয় কাল এখান থেকে বেরুবে। তোমার ছেলেকে দেখবে, বউকে দেখবে। আমি এখান থেকে বের হলেও আমার প্রিয়জনদের দেখতে পারবো না। তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করি প্রতিদিন কিন্তু পারি না, কোনোদিন পারবোও না, কারণ তাকে আর কোনোদিন দেখবো না আমি।’
ফজর একটু লজ্জিত হলো, বলল, ‘স্যার আমার মনে হয় আপনে আপনার বউরে খুন করেন নাই।
‘তুমি বড়ো সরল লোক ফজর। আমি তোমাকে সাহায্য করবো পালাতে। তবে আমি যা বলবো সব মানতে হবে। যদি সব মানো তাহলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তুমি এই জেলের বাহিরে থাকবে।’
‘না স্যার এতো সুমায় নাই, নাদির ভাই কইছে, পাঞ্জাবীরা নাকি মাইয়াগো ধইরা ইজ্জত নষ্ট করতাছে, বাচ্চাগো বন্দুকের ছুড়ি দিয়া খুচাইয়া খুচাইয়া মারে। হাছা মিছা জানি না, আমারে তাড়াতাড়ি আমার আমেনা আর মজিদের কাছে যাইতে হইবো।’
‘ঠিক আছে এখন ঘুমাও, কাল এ ব্যাপারে কথা হবে।’
হঠাৎ বাচ্চু নড়েচড়ে উঠলো, সে চোখ ডলে উঠে বলল, ‘হাম ভী যায়েঙ্গে। নেহী তো জেলারকো সব কইয়া দিমু।’
*
বাচ্চুর ভাবভঙ্গীতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, সে ফজর আলীর সাথে আঠার মতো লেগে আছে। সে প্রফেসরকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, তাকে ছাড়াও পরিকল্পনা করতে পারে, সে হলে তাই করতো। রাতে শোয়ার সময় সে নিজের জায়গা ছেড়ে ফজরের পাশে এসে শুয়েছে। তার আচরণে ইউসুফ মুন্সি একটু অবাক হলো।
সুজন খবর নিয়ে এসেছে, সে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে উত্তেজনায়। একটু দম নিয়ে বলল, ‘মুক্তিফৌজ হইছে, পাকিস্তানিগো লগে তারা যুদ্ধ করতাছে, সবাই দলে দলে মুক্তিফৌজে নাম লেখাইতাছে।’
ইউসুফ মুন্সি মাথা দুলিয়ে বলল, ‘কই থেইক্যা ভুয়া খবর লইয়া আসো, সবাই নাম লেখাইতেছে না, হিন্দুরা মুক্তিফৌজ হইছে, লগে আছে ইন্ডিয়ার দালালেরা। দাড়ি কাইট্যা রাখছে মোছ নাম রাখছে মুক্তিফৌজ।
সুজন ইউসুফ মুন্সির কথাটা কানে তুলল না, সে বলল, ‘গ্রামেগঞ্জে শান্তি কমিটি হইতাছে, রাজাকার বাহিনী হইতাছে, তারা পাঞ্জাবীগো সব চিনায়া দিতাছে।’
ইউসুফ মুন্সি বেশ শব্দ করে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্, এইটা আসল খবর দিছো। বাঙালিরাও নামতাছে ইসলাম রক্ষার যুদ্ধে, মাশাল্লাহ। ইসশ আমি এহন জেলের বাইরে থাকলে আমিও রাজাকার হইতাম।’
বাচ্চু মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘হাম বাইর হোকারই রাজাকার বানুংগা, এক মাহিনা কা মামলাই তো।’
ইউসুফ মুন্সি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিন্তু তোর তো আরো দুই বছরের সাজা বাকি।
বাচ্চু একটু ভড়কে গেল, ভড়কে গিয়ে আবোলতাবোল কী যেন বলতে বলতে ফজরের পাশে গিয়ে চোখ নামিয়ে বসলো।
দুপুরের খাবারের আগেই ইউসুফ মুন্সি সব জেনে গেল। টিনের বাসনের পোকা আর কঙ্কর ভর্তি ভাত চাবাতে চাবাতে ইউসুফ মুন্সি ফজর আলীকে বলল, ‘তোর কি মাথা নষ্ট হইছে? তুই ঐ পাগলের কতায় নাচস? মরবি কইতাছি।’
ফজর আলী বাচ্চুর দিকে তাকালো, বাচ্চু আবার অপরাধীর ভঙ্গিতে চোখ নামালো। ফজর ইউসুফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেশে যুদ্ধ লাগছে, বউ পোলার কতা মনে হইলে কইলজাডা পুড়ায়। প্রফেসর সাবে আওলা মানুষ কিন্তুক হে গিয়ানী লোক, তার কতা হুনলে একটা ব্যবস্তা হইবো।’
‘যুদ্ধ লাগলে কী হইছে, আমরা মুসলমানের বেটা, আমাগো বউ পোলাগো কিচ্ছু হইবো না।’
মুখে এই কথা বললেও ইউসুফ মুন্সি মনে মনে নিশ্চিন্ত হতে পারে না, পাঞ্জাবীদের নিয়ে তার চিন্তা নাই, তারা পক্ষের লোক। তার চিন্তা হচ্ছে মুক্তিদের নিয়ে, তারা যদি কোনো ক্ষতি করে তার পরিবারের। এমনিতেও অনেকদিন কোনো খবর পাচ্ছে না। ফজর আলী বলল, ‘আমি আর থাকমু না, আমি পলামু। আপনে গেলে আমাগো লগে থাকতে পারেন। কিন্তু আর কাউরে কইয়েন না।’
জেলপালানো নিয়ে সবাই এতো উৎকণ্ঠায় ছিল যে, সুজনকে সারাদিন একবারও দেখা যায়নি, এটা কেউ লক্ষ্য করলো না। সন্ধ্যাবেলা শোয়ার সময় বুঝলো সবাই সুজন নেই। একজন আরেকজনের দিকে ভ্রু কপালে তুলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। বাচ্চু বলল, ‘শালে পলাইয়া গ্যায়া।’
বাচ্চুকে না বলে পালানোতে সে ক্ষুদ্ধ, মেঝেতে একদলা থুতু ফেলে সে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ করলো। ইউসুফ মুন্সি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ফজর অবাক হলো। প্রফেসর আগের মতোই বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। ফজর প্রফেসরের কাছে গিয়ে বলল, “কী চিন্তা করলেন?’
প্রফেসর বই থেকে মুখ বের করে বলল, ‘আমি চিন্তা করেছি কিন্তু কাউকে বলবো না। আমি যা যা বলবো তা করবে শুধু।’
ইউসুফ মুন্সি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘এইটা কেমুন কথা?’
প্রফেসর বলল, ‘কথা এটাই। পরিকল্পনা বলে বেড়ালে, তা সবার কানে ঘুরতে ঘুরতে জেলারের কানে যাবে।’
তারপর বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কানে কানে কথা বলার লোক তো আছেই।’
বাচ্চু আবার মুখ লুকালো, ইদানিং সে খুব লাজুক হয়ে যাচ্ছে। ইউসুফ মুন্সি একটু চিন্তা করে বলল, ‘আইচ্ছা ঠিক আছে, এহন কী করুম, হেইডা কন?’
‘অপেক্ষা করো, আর চাইলে ঘুমাতে পারো।’
ইউসুফ মুন্সি আর বাক্যব্যয় করলো না, আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল। ফজর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বসে সুজনের কথা চিন্তা করছে। বাচ্চু তার একদলা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, সেখানে দুটি মাছি ভন ভন করছে।
পরদিন আমদানি ঘরে আবার ডাক পড়ল ফজরের। আমদানি ঘরের বাহিরে একটা লাশ দেখলো ফজর আলী, মুখ থুবড়ে পরে আছে মাটিতে। কাছে যেতে হলো না, দূর থেকে দেখেই সুজনকে চিনে ফেলল ফজর। ফজর এগিয়ে গিয়ে দেখলো, না প্রাণ বাকি আছে, শ্বাস চলছে। ঠোঁট কেটে রক্ত লেগে আছে মুখে। সারা গা ফুলে গেছে। নিঃশ্বাসের গতি খুবই মৃদু। ঠোঁট ফাঁক করে একটা শব্দই বলল সুজন, “পানি”। তারপরই মূর্ছা গেল। সৈন্যটি বিরক্ত সহকারে বলল, ‘ইসিকো লে যাও, ছালে মুক্তি কো পানি পিলাতা হায়।’
পর পর তিন মগ পানি খেয়ে ফেলেছে সুজন। ভাত খেতে পারছে না, একবার চেষ্টা করেছিল, হড়বড় করে ভেতর থেকে সব বেরিয়ে গেছে। ইউসুফ মুন্সি সেই বমি পরিষ্কার করেছে। সারারাত বন্দুকের বাট দিয়ে পেটানো হয়েছে তাকে, পানি কিংবা খাওয়াদাওয়া কিছুই দেয়া হয়নি। এত মার খাওয়ার পর বেঁচে আছে বলেই আর মারেনি। তার অপরাধ আমদানি ঘরে এক আসামীকে পানি খেতে দিয়েছিল।
গায়ে এখন প্রচণ্ড জ্বর সুজনের। কম্বলের নিচে শুয়ে কাঁপছে। জ্বরে প্রলাপ বকছে, কী বলছে বুঝা যাচ্ছে না, শুধু কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে মাকে ডাকছে। জ্বরের ঘোরে সে ভুলে গেছে, বুক ফাটিয়ে চিৎকার করলেও তার মা আর শুনবে না।
সুজন ঘুমাচ্ছে অথবা জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ফজর বারবার সুজনের কপালে হাত দিয়ে দেখছে জ্বর কমছে কিনা। ইউসুফ মুন্সি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, বাচ্চু উশখুশ করছে। প্রফেসর বলল, ‘আমি চিন্তা করে রেখেছি।’
ইউসুফ জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী চিন্তা?’
‘সেটা তো বলবো না।’
‘আমরা কী করতাম?’
‘কাগজ আর কাঠের টুকরা কুড়াবে। যত পাও তত, আমার কাছে রাতেরবেলা জমা দেবে।’
‘কাগজ, কাডের টুকরা দিয়া কী হইবো?’
‘সেটা আমি বুঝবো, আর আমাকে প্রতিদিন দুটো করে পাথর কিংবা ইটের টুকরা জোগাড় করে দেবে।’
বাচ্চু বিড়বিড় করে বলল, ‘ইয়ে আদমি পাগল হ্যায়।’
ইউসুফ মুন্সি কিছু বলল না, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হলো, বাচ্চুর সাথে তার এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।
প্রফেসরসাহেব বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে বললেন, ‘যদি এখান থেকে বের হতে চাও তবে আমার কথা শুনো, আর যদি মরতে চাও, তবে নিজেরা জেল ভেঙ্গে পালাও।’
ফজর ইটের টুকরা খুঁজতে গিয়ে লক্ষ্য করলো, জেলখানায় এই জিনিসটা অতো সহজলভ্য নয়, অথচ সব দেয়ালই ইটের তৈরি শৌচাগারের গায়ের দেয়ালের কয়েকটা ইট নড়বড়ে। সেদিন ফজর শৌচাগারে গিয়ে বাচ্চুর চেয়েও বেশি সময় নিলো ফজর, বাহিরে রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। একটি ইট পেটের সাথে বেঁধে কুজো হয়ে বের হলো ফজর। তারদিকে তাকিয়ে একজন বলল, ‘তোরে কী কালকে ভাত বেশি দিছেনি?
ফজর কিছু না বলে আড়ালে চলে গেল, গোসলের চৌবাচ্চার পেছনে গিয়ে দেয়ালে ইট ভাঙ্গলো। ঘাস দিয়ে ঢেকে রেখে দুটো টুকরো পকেটে নিয়ে নিলো। প্রফেসরসাহেব, তার পায়চারী শুরু করেছেন, আর বিড়বিড় করছেন। ফজর গিয়ে আড়াল করে তার হাতে দুটো টুকরো তুলে দিলো। প্রফেসরসাহেব এবার স্থান বদলালেন, পূর্ব দিকের দেয়াল ধরে হাঁটছেন তিনি। সবাই যখন গোসলের হুড়াহুড়িতে ব্যস্ত তখন তিনি একটি ইটের টুকরা ছুড়ে মারলেন উপরে। সেটা দেয়ালের ঐ পাশে গিয়ে পড়ল। ফজর কিছুই ভেবে পেলো না, এতো কষ্ট করে সংগ্রহ করা ইটের টুকরা কি বাচ্চাদের মতো ছুড়াছুড়ি খেলার জন্য?
রাতে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বাচ্চু ঢুকলো, ইউসুফ মুন্সির পকেট ফুলে আছে। বাচ্চু তার পাজামার ভেতর ভরে দুটো চ্যালাকাঠ নিয়ে এসেছে। ঘুমন্ত সুজনের দিকে তাকিয়ে সাবধানে চ্যালাকাঠ দুটো এগিয়ে দিয়েই বলল, ‘রসুই থেইক্যা চুরি করছি।’
কাঠের টুকরা দুটো কম্বলে পেঁচিয়ে রাখা হলো। ইউসুফ মুন্সি পকেট থেকে বেশ কিছু পুরনো কাগজ বের করে দিলো। অধিকাংশই পুরনো খবরের কাগজের টুকরা। প্রফেসর কাগজগুলো ভাঁজ করতে লাগলেন, প্রত্যেকটা কাগজ তিনি পড়ে দেখছেন। ইউসুফ মুন্সি জিজ্ঞাসা করলো, ‘কাগজ কি পড়ার লাইগা আনাইছেন?’
‘এখানের সব বই পড়া শেষ, নতুন কিছু পেলে পড়তে ভালো লাগে।’
ইউসুফ মুন্সি আর কিছু বলতে পারলো না, সে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আগে গোপনে ছাড়তো, এখন আর গোপন করতে পারছে না। ফজর সুজনের পাশে শুয়েছে, সুজনের কপালে হাত রেখেই কখন ঘুমিয়ে গেছে বলতে পারে না। সুজনের গলা শুনে জেগে উঠলো। সুজন ডাকছে, ‘ফজর ভাই, ও ফজর ভাই।’
‘কী হইছে সুজন? পানির তিয়াস লাগছে?’
সুজন ফজরের হাত চেপে ধরে কাতর কন্ঠে বলল, ‘আমারে ফালাইয়া যাইও না ভাই, আমিও যামু তোমাগো লগে।’