তেইল্যা চোরা – ১

বলরামপুর গ্রামে মোল্লা বাড়ির অর্ধেকটা জুড়ে ফজর আলীর বাস। তার বাপ-দাদার জন্ম এখানে নয়। বছর চল্লিশেক আগে ফজর আলীর বাবা কসর আলী নিজ গ্রাম বালিয়াকান্দি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। নিজ গ্রামে তার পদবী লোকে ঠিক সানন্দে গ্রহণ করতে পারেনি। কালো অন্ধকারের মতো দেহ আর তার পেশা এই দুয়ে মিলে তার পদবী হয়েছিল ‘কাইল্যা চোরা’। অধিক ব্যবহারের কারণে পরে তা তার আসল নামকে গ্রাস করে, ‘কসর আলী’ বিলুপ্ত হয়।

গায়ের রঙের কারণেই হোক আর চতুরতার কারণেই হোক নিজ পেশায় ‘কাইল্যা চোরা’ ছিল দিগ্বিজয়ী। গ্রাম গ্রামান্তরে তার সুনাম কিংবা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। আশেপাশের দশগ্রাম এক নামে ‘কাইল্যা চোরা’-কে চিনত। গ্রামের মাতব্বর দিনরাত লোক খাইয়েও এত নাম করতে পারেনি, তার হিংসা হতেই পারে। কয়েকটা তালুকের মালিক সে, ব্রিটিশসাহেবদের সাথে উঠাবসা অথচ মানুষকে গ্রামের নাম বললে তারা কিছুক্ষণ চিন্তা করে জিজ্ঞাসা করে, “ও কাইল্যা চোরার গ্রাম”।

কাইল্যা চোরাকে মাথা মুড়িয়ে আলকাতরা মেখে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে নিজের এবং গ্রামের সম্মান রক্ষা করলেন তিনি ।

নিজ গ্রাম ছেড়ে ‘কাইল্যা চোরা’ বলরামপুরে চলে আসে। অভাবে পড়া হাসমত মোল্লার ‘ছাড়া বাড়ির’ অর্ধেকটা কিনে নিয়ে বসত শুরু করে। নিজের নাম ফিরে পায় সে। কিন্তু বেশিদিন নিজ নামে স্থায়ী হতে পারেনি। তার সুনাম, তার পদবী তাকে অনুসরণ করে এই বলরামপুরেও চলে এসেছিল। কিন্তু তাকে তাড়ানোর মতো তালুকদার বলরামপুরে ছিল না।

হিন্দুস্তান-পাকিস্তান আলাদা হলো, সাদাসাহেবরা দেশ ছাড়লো কিন্তু কসর আলী নিজের পেশা ছাড়লো না। নিজ পেশাতে বহাল থেকেই তিন মেয়ের বিয়ে দিলো। পাত্র ভালো পেয়েছিল, মর্যাদায় তার থেকে উচ্চ, ডাকাত। ফজর আলী তখনও মাঠে ময়দানে খেলা করে বেড়ায়। গাছে ঢিল মারে, পুকুরের পানি ঘোলা করে। বয়স তার খুব একটা বেশি হয়নি, কৈশোরের মাঝামাঝি। কসর আলী ভাবল, তিন মেয়ের ব্যবস্থা হলো, ছেলের একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারলে তার সুখমৃত্যু হবে না। ছেলেকে নিজের বিদ্যা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারতো সে, তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে অর্থসম্পত্তি এবং বুদ্ধি বিবেচনা সমস্তই লোপ পেয়েছিল। ফজরের মা দাওয়ায় বসে কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে বলল, ‘আমার পোলাডারে চোর বানাইও না।’

কসর আলী সিঁদ কাটা শাবলটাকে ধার দিতে দিতে বলল, ‘চোরের পোলা চোর হইবো, জজ ব্যারিস্টার হইত না। আমি মইরা গেলে পোলায় কী কইরা খাইবো, চোরের পোলারে কাম দিবো কেডা? জমি জিরাত থাকলে চাষবাস কইরা খাইতো, মাইয়া বিয়া দিতে তো সবই গেল ঐ ডাকাইতের ব্যাটাগো পেটে।’

এসব যুক্তিতেও চোরপত্নীর মন বুঝে না। সে কেঁদেই যায়, কসর আলী শাবল ধার করায় মন দেয়। নারীর অশ্রু আর চুলার ছাই তার কাছে একই বস্তু।

কসর আলীর দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনো ধরা পড়েনি সে, সিঁদ কেটেছে নিঃশব্দে, আত্মবিশ্বাস বরাবরই তার তুঙ্গে। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে যখন সিঁদ কাটছে, কেন যেন হাতটা বারবার কেঁপে উঠছিল, আজ তো সে আফিমও খায়নি। মাটি খুঁড়তে গিয়ে হঠাৎ টিনে আঘাত করলো কসর, ভেতর থেকে খেঁকিয়ে উঠলো কয়েকটা পুরুষ কন্ঠ। জীবনে এই প্রথম ভয়ে পেট মুচড়ে উঠলো কাইল্যা চোরার। শাবল ফেলে দৌড়ে পালানোর আগেই ধরা খেলো, ফজর কোনোরকমে পালিয়েছে।

কাইল্যা চোরার হাতেনাতে ধরা খাওয়ার খবরটা আগুনের মতো রটে গেল। হাতে শান দিয়ে আশেপাশের গেরাম থেকে লোকজন এলো। যাদের দ্রব্য সামগ্রী চুরি গিয়েছিল তারা এসেছে কিল-ঘুষিতে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিল-ঘুষি দানে কেউ কার্পণ্য করেনি। দুপুর নাগাদ ফজর আর তার মা সেখানে পৌঁছালো। ফিসফাস শব্দে সবাই মা ছেলেকে ‘চোরের বউ’

‘চোরের পুত’ সম্ভাষণ করে অভ্যর্থনা জানানো হলো। কসরের দেহে তখন অল্প একটু প্রাণ অবশিষ্ট আছে। যারা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে তারা ফজর আর তার মাকে দেখে আবার উৎসাহ ফিরে পেলো। আরো এক দফা কাইল্যা চোরার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা এবার লাভ তুলে নিলো। লাভক্ষতির হিসাবের মধ্যেই কোনো এক সময় কাইল্যা চোরের প্রাণ বেরিয়ে গেল।

মোল্লা মৌলভীরা কাইল্যা চোরার জানাজা পড়িয়ে জনগণের বিরাগ আয় করতে চান না। ঘরের পাশে তালপাতার বেড়ার ওপাড়েই মোল্লা বাড়ি, স্বয়ং হাসমত মোল্লা উপস্থিত সেখানে কিন্তু বেড়ার এপাড়ে এসে সদ্য প্রয়াত চোরের জানাজা পড়ানোর সাহস তার হলো না। ফজর আলী বাল্যকালে শেখা যত সুরা সব পড়ে নিজের বাবাকে টেনে কবরে নামালো। নীরবে কাঁদছে তার মা, বিলাপ করার মতো বিলাসিতা এই মৃত্যুতে নেই, প্রতিবেশীরা এসে সান্ত্বনা দেবে না, কেঁদে কেঁদে মূর্ছা গেলে মাথায় তেল পানি মাখবে না। কসর আলী চিৎকার করে পৃথিবীতে এসেছিল আর কাইল্যা চোরা নীরবে প্রস্থান করলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *