তৃতীয় পর্ব— তিমির হননের গান
গতকাল ফিরেছি বেশ রাতে। আজ অফিসে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেল। অফিসে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এখন একলা কিছুক্ষণ ভাবতে হবে। কোনও ক্লায়েন্ট এসে পড়লে মুশকিল। তারিণী রায়ের সেই কাঠের চেয়ারে বসে একটা খাতা পেনসিল নিয়ে এ-ফোর কাগজে লিস্ট বানাতে থাকলাম। কী কী জেনেছি, আর কী জানিনি। আসলে সেইসব সাদা কাগজ পেয়ে আমার মতো ডিরেক্টর সাহেবও ঘাবড়ে গেছিলেন। আমাকে বারবার অনুরোধ করলেন ব্যাপারটা পাঁচকান না করতে। উনি নাকি তদন্ত কমিটি বসাবেন একটা। এটা এখন জলের মতো পরিষ্কার, দেবাশিসদা খুব সন্তর্পণে একটা একটা করে প্রিয়নাথের সেই ম্যানুস্ক্রিপ্ট চুরি করেছিলেন। কীভাবে? তা খোদায় মালুম। সঙ্গে ডায়রির পাতা। আমার মন বলছে এই ডায়রির পাতা তারিণীর। “তারিণীর ছেঁড়া খাতা।” কিন্তু দেবাশিসদার লেখা সেই চার লাইনের ছড়া অনুযায়ী সেই খাতার তো গণপতির ভূতের বাক্সে থাকার কথা।
এমন সময় ফোন। অফিসার মুখার্জি ফোন করেছেন।
—কী খবর মশাই? কিছু পেলেন?
—পেলাম বলতে আশাপ্রদ কিছু না। একটা কথাই জানতে পেরেছি, প্রিয়নাথের সেই পাণ্ডুলিপি আমাদের সরকারি আর্কাইভ থেকে চুরি করেছিলেন দেবাশিসদা। সঙ্গে তারিণীর ডায়রির পাতাও।
—কী করে জানলেন? আপনি গেছিলেন দেখা করতে?
—হ্যাঁ। শুনলাম পুলিশও গেছিল জেরা করতে।
—আমিই গেছিলাম তো। খুব একটা কিছু লাভ হয়নি। চুরির কথা আপনি জানলেন কীভাবে?
—সে অনেক গল্প। সাক্ষাতে বলা যাবে।
—আপনি এখন কোথায়?
—আমার অফিসে। ক্লাইভ স্ট্রিটে।
—বাহ। আমিও একটা কাজে লালবাজারে এসেছি। ফেরার পথে আপনার অফিসে যাব। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে আমায় লোকেশানটা পাঠিয়ে দিন।
—এক্ষুনি দিচ্ছি। আপনি কিছু জানলেন?
—এদিকে খুব চাপ ভাই। এক লোকাল নেতা খুন হয়েছে, সেই নিয়ে দুই রাত ঘুমোই না। আজ আবার লালবাজারে ডেকেছে।
—অটোপ্সি রিপোর্ট এসেছে?
—হ্যাঁ, নতুন কিছু নেই। সারা গায়ে আঘাত করে কষ্ট দিয়ে শেষে ছোরা দিয়ে খুন। তবে বিচিটা মরার আগেই কেটেছে।
—কিন্তু দেবাশিসদার… মানে ওটা ওই লাইব্রেরিতে কীভাবে এল, সেটা বুঝতে পারলেন?
—কেউ কিচ্ছু বলতে পারছে না। আমি সবাইকে জনে জনে জেরা করেছি। তবে আপনিও সাবধানে থাকুন ভাই। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই কেসে আপনাকে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। যাই হোক, আমি আসছি। সাক্ষাতে কথা হবে।”
অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, হোয়াটসঅ্যাপ করে আবার লিস্টে মন দিলাম। কিছু ক্লু এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে গোটাতে হবে। লিখতে থাকলাম—
১। দেবাশিস গুহ নিজের বাড়িতে খুন হলেন। খুনি (বা খুনিরা) অত্যাচার করল (কীসের জন্য?)
২। দেবাশিসদা কোনওমতে লুকিয়ে আমায় হোয়াটসঅ্যাপ করলেন (সময় পেলেন কখন?)
৩। ‘তুর্বসু জানে’ লিখে দেবাশিসদা আমায় ফাঁসালেন। কিন্তু আমি কী জানি?
৪। আমার ঘরে দালাল সেজে ঢুকে দেবাশিসদা লিখে এলেন তৈমুর ডিরেক্টরের কাছে আছে (কবে? জেঠিমাকে ফোন করতে হবে)
৫। আর্কাইভের ডিরেক্টর বললেন তাঁকে কিচ্ছু দেওয়া হয়নি…
ঠিক এইখানে একটা খটকা লাগল। ডিরেক্টরের চেম্বারে এটাই ছিল আমার শেষ প্রশ্ন। এটা করামাত্র ডিরেক্টর চটে গিয়ে বলেছিলেন, “আরে বাবা না বলেছি তো… ওঁর সঙ্গে এতটাও ঘনিষ্ঠতা ছিল না আমার।” এটা প্রথম প্রশ্নে কেউ বলে না। একসময়ই বলে, যখন একই প্রশ্ন তাকে দ্বিতীয়বার করা হয়। মানে আগে কেউ একই প্রশ্ন তাকে করেছিল। কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব! আমি ছাড়া তো দেবাশিসদার এই চিঠির কথা আর কেউ জানত না! নাকি জানত? সে কে? পকেটেই দেবাশিসদার চিঠিটা ছিল। এবার দেখেই বুঝলাম বিসমিল্লায় গলদ হয়েছে। এটা দেবাশিসদার লেখা চিঠি হতেও পারে, নাও হতে পারে। ছাপা চিঠি। যে কেউ লিখতে পারে। তলায় সইটা অবধি নেই। যেহেতু আমি ধরেই নিয়েছি এই বিষয়গুলো আমি আর দেবাশিসদা ছাড়া কেউ জানে না, তাই অন্য কেউ লিখতেই পারে না। কিন্তু এখন বেশ মনে হচ্ছে আর-একজন কেউ আছে, যে কিছুটা হলেও গোটা ব্যাপারটা জানে। দেবাশিসদার সেই চ্যালা? যে রাতে আসে? আমি কেন যেন নিশ্চিত ছিলাম ওটা আমি। কিন্তু যদি ওটা আমি না হয়ে অন্য কেউ হয়, আর দেবাশিসদা তাকে সব বলে থাকেন, তবে তো আরও একজন আছে যে সব জানে। কিন্তু সে কে?
মাথায় আসতেই জেঠিমাকে ফোন করলাম। ফোনে আবার রিংটোন, ‘ওম নমঃ শিবায়’। প্রায় অধৈর্য হয়ে ছেড়ে দেব, এমন সময় জেঠিমা ধরলেন।
—কে-এ-এ… হ্যালো… কে-এ-এ?
—জেঠিমা, আমি টাবু।
—ও টাবু? বল বাবা, কী ঠিক করলি? বাড়ির অংশটা বেচবি?
—সেজন্যেই ফোন করলাম জেঠিমা। সেই দালাল তোমায় কোনও নম্বর দিয়ে গেছিল? ফোন করব।
—সেসব তো কিছু দেয়নি, শুধু বলেছিল আবার আসবে।
—ও। তা এই দালাল দেখতে কেমন? নাম বলেছে?
—দেখতে তো ভালোই বাবা। ভদ্রলোকের ছেলের মতোই। লম্বা, দাড়িগোঁফ নেই। ছিলিম চেহারা। খুব সিগারেট খায়। নাম বলল সঞ্জয় দাস। তোর ঘর খুলে দিলাম। ঘুরে-টুরে দেখল। বলল পছন্দ হয়েছে।
—কবে এসেছিল মনে আছে?
—ওমা! সেটাই বলিনি তোকে? তুই যেদিন এলি, সেদিন সকালেই তো এসেছিল। আবার এলে কী বলব? তুই রাজি?
আমার মাথা ঘুরছিল। কোনওমতে হ্যাঁ হ্যাঁ করে রেখে দিলাম। আমি বুঝে গেছি ও দালাল আর আসবে না। আমি যেদিন চুঁচুড়া গেছি, সেদিন সকালবেলায় সে এসেছিল। মানে দেবাশিসদা ততক্ষণে মৃত। আর চেহারার যা বর্ণনা পেলাম, তাতে দেবাশিসদা হতেই পারেন না। তাহলে এ কে? দেবাশিসদার সেই চ্যালার প্রতি সন্দেহ বাড়ছে। লিস্টটা শেষ করি—
৬। দেবাশিসদা মারা যাবার পরের দিন সকালে আমার বাড়িতে গিয়ে কে চিঠি লিখে এল?
৭। অপর্ণা গুহকে নিয়মিত দেবাশিসদার বিষয়ে খোঁজ দিত কে? কোনও কাছের বন্ধু? কার কাছের? অবশ্যই এমন একজন, যে দেবাশিসদার কাছের। কারণ অপর্ণার কাছের লোক, কিন্তু দেবাশিসদাকে গভীরভাবে চেনে না, এমন লোকের কথা তিনি শুনবেনই বা কেন? আবার সেই চ্যালা উঁকি দিচ্ছে।
৮। দেবাশিসদার অণ্ডকোশ লাইব্রেরিতে গেল কীভাবে? এমন একজন নিয়ে গেছে, যে লাইব্রেরিকে হাতের তালুর মতো চেনে, অথবা তাকে কেউ সন্দেহ করবে না, কিংবা দুটোই।
৯। প্রিয়নাথের কাগজ বা তারিণীর ডায়রির কোথাও নিশ্চিতভাবে পো-র লেখা সেই দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধান আছে। সেটা তো আর আমার কাছে নেই। তাহলে আমাকে এর মধ্যে জড়ানোর মানে কী?
১০। যে কাগজ দেবাশিসদা চুরি করে এনেছিলেন, সেগুলো এখন কোথায়? (বাড়ি তো সিল করা)। দেবাশিসদার ওয়ারিশ কে?
আবার ফোনের কি-প্যাড ডায়াল করলাম।
—হ্যালো অপর্ণাদি, আমি তুর্বসু বলছি।
—আপনার লজ্জা করে না? আপনি কোন মুখে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?
—কেন দিদি, কী হল?
—কী হল? সেদিন এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এতদূর গেলাম, আপনাকে সব কথা খুলে বললাম, আর আপনি এটা জানালেন না যে, আপনিই সেই শয়তান যাকে দেবাশিস আমার আর সুতনুর পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে লাগিয়েছিল! আপনি আমাদের ইন্টিমেট অবস্থার ছবিও তুলেছেন।
—দিদি, আসলে ওটাই আমার প্রথম কেস…
—চুপ করুন। দিদি বলে ডাকতে লজ্জা করে না? আপনি আর ফোন করবেন না আমাকে।
বলে ফোন রেখে দিলেন অপর্ণা। কীভাবে উনি এত খবর জানছেন? একটা লোক আছে, যে ইন্দ্রজিতের মতো আড়ালে থেকে গোটা খেলাটাকে চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। এই খেলায় আমি কোনও এক চাল দেবার আগে সে আরও দুই চাল এগিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত, দেবাশিসদার খবর অপর্ণাকে দিত এই লোকটাই। উলটোটাও। দেবাশিসদা ভাবতেও পারেননি তাঁরই কাছের লোক তাঁর পিঠে ছুরি মারছে। মুশকিল হল অপর্ণা এর নাম বলবেন না। ফলে এ যে কে, তা বোঝা অসম্ভব।
ঠিক এমন সময় অপর্ণা দেবীর আলগোছে বলা একটা কথা মাথায় এল। তাঁদের বিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাণী রায়। দেবাশিসদার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু। কে এই বন্ধু? তাঁর নাম এই কেসে এখনও কেউ করেনি। আমিও দেবাশিসদার মুখে তাঁর কোনও বন্ধু আছে বলে শুনিনি। অফিসেও যা বুঝলাম, কোনও বন্ধু ছিল না। তাহলে এই বন্ধুটি কে? খুব যদি ভুল না হয়, এ-ই হয়তো দেবাশিসদার সেই চ্যালা। ডবল এজেন্ট। উত্তর দিতে পারেন অপর্ণা দেবী। ফোন করলাম। নাম্বার ব্লক। এখন উপায় একটাই।
অফিসে তালা মেরে চললাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। এখন মির্জা গালিব স্ট্রিট নাম হলেও লোকে আগের নামেই ডাকে। এই রাস্তাতেই বিখ্যাত লেখক থ্যাকারে সাহেব জন্মেছিলেন। রাস্তায় ঢুকতেই দেওয়ালে হলুদ রঙের বড়ো বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বাণী রায়। সঙ্গে ফোন নম্বর। নিচে ব্র্যাকেটে লেখা, কালম্যানের পাশে। কালম্যান এখানকার বিখ্যাত কোল্ড স্টোরেজ। কোল্ড কাটসের জন্য খুব জনপ্রিয়। দুধারে খাবার দোকানের গন্ধে ম-ম করছে। কালম্যান পেরিয়ে একটু দূরেই ঘুপচি অফিস। আলো কম। গিয়ে দেখলাম মোটা চশমা পরা এক অবিবাহিত (বিধবাও হতে পারে) বয়স্ক মহিলা গম্ভীর মুখে আনন্দবাজার পড়ছেন। আমাকে দেখে একটা ফর্ম এগিয়ে দিলেন।
—এটা ভরে আনবেন। আপনার নাম, পাত্রীর নাম, দুই কপি ফটো, আধার কার্ডের জেরক্স আর অরিজিনাল আর তিনজন সাক্ষী। দুরকম রেট আছে। নর্মাল দেড় হাজার, আর তৎকালে তিন।
—আমি বিয়ে করব বলে আসিনি।
—তবে?
—একটা কথা জানার ছিল।
—বলুন।
—২০১২-র মার্চে আপনার এখানে দুজন বিয়ে করেছিলেন। দেবাশিস গুহ আর অপর্ণা বসু।
—সে করতে পারে। কত লোকে কত বিয়ে করছে…
—আমার সেই বিয়ের সাক্ষীদের নাম চাই।
—অ। ডিভোর্স হচ্ছে বুঝি? আপনি কি গোয়েন্দা? প্রাইভেট ডিটেকটিভ?
বুঝলাম এই দাবি নিয়ে ওঁর কাছে অনেকেই আসে। হেসে মাথা নাড়ালাম।
—তার রেট আলাদা। পাঁচশো টাকা। ক্যাশে। আমি চেক নিই না।
—আজ্ঞে একটু কমসম…
—এক রেট।
উপায় নেই। রাজি হতেই হল। হাতে দরাদরির সময়ও নেই। অফিসার ফোন করছেন। নিশ্চয়ই ওঁর লালবাজারের কাজ হয়ে গেছে। ফোন ধরলাম।
“কোথায় আছেন মশাই?”
“একটু ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে এসেছি, একটা কাজে। আপনার হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, আমি তো যাচ্ছি আপনার অফিসে।”
“আসুন, আমি আসছি এখুনি।”
এদিকে মহিলা নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে একটা গোদরেজের আলমারি খুলে ধীরেসুস্থে খুঁজেপেতে একটা লাল মোটা খাতা বার করলেন। উপরে বড়ো করে ২০১২ লেখা।
—কোন মাস বললেন? মার্চ? তাই তো?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। নাম দেবাশিস গুহ।
—আগে পাঁচশো টাকা দিন। এটা আমার খাতার কপি।
দিলাম।
খাতা ঘুরিয়ে ধরলেন মহিলা। খাতায় ছবি আটকানো। দেবাশিসদা, আর অপর্ণার। পাসপোর্ট সাইজ। তাঁদের সই। নিচে তিনজন সাক্ষীর সই। প্রথম জন সুপর্ণা বসু, শিওর অপর্ণার মা। দ্বিতীয় জন দেবযানী দত্ত। এ অপর্ণার সেই বান্ধবী। আর তারপরেই দেবাশিসদার সেই বন্ধুর নাম ক্যাপিটালে লেখা। সঙ্গে সই। আমি প্রথমবার দেখে ভাবলাম ভুল দেখছি। আবার দেখলাম। খাতার পাতা একটু হলুদ হয়েছে, কিন্তু কালো কালিতে লেখা নাম জ্বলজ্বল করছে। এই নাম আমি চিনি। একটু আগেই এর সঙ্গে কথা হয়েছে। খাতায় লেখা, অমিতাভ মুখার্জি। ব্র্যাকেটে লেখা ও.সি., চন্দননগর পি এস।