পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

তৃতীয় পর্ব- কত শত যোনিচক্রস্মৃতি

তৃতীয় পর্ব- কত শত যোনিচক্রস্মৃতি

গোটা জগৎটাই কেমন যেন অলীক বলে বোধ হচ্ছে। আজন্মলালিত যে জ্ঞান, যে চেতনা, যে সত্যমিথ্যা শিক্ষায় নিজেকে বড়ো করে তোলা, সব কেমন কাচের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে দ্রুত। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে অজস্র শব্দের বিনবিনুনি। সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী বারবার জানতে চাইছে, “কী হয়েছে? চাকরিতে কিছু সমস্যা?” বলতে পারছে না। শুধু যে অস্তিত্বটুকু নিজের বলে জানত, এক অন্যরকম হাওয়া এসে তাকে বয়েনিয়ে যাচ্ছে। কোথায়? সে জানে না। এ যদি সত্যি হয়, তবে সব সত্যি। রূপকথার মতো, ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মতো, ফেলে আসা গল্পরা কোন এক জাদুবলে প্রাণ পেয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়ে যেন চিৎকার করে নিজেদের জানান দিচ্ছে। সে বুঝতেও পারেনি এত কিছু ঘটতে পারে।

চার বিঘে জমির উপরে বিরাট এক বাড়ি। কলকাতা শহরে এমন বাড়ি আগে দেখেনি সে। ম্যাকিনটশ বার্নের নকশা গায়ে। সামনে বড়ো বড়ো ডোরিক খাম আর পোর্টিকো। যেন গ্রিক স্থাপত্যের কোনও অট্টালিকা। খিলান দেওয়া সিঁড়ি একতলা থেকে উঠেছে দোতলায়। মেঝেতে রংবেরং-এর কাচ। দেওয়ালে সাহেবদের আঁকা বড়ো বড়ো অয়েলপেন্ট। গলায় স্টেথোস্কোপ, গোলগাল মুখের মানুষটি ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্ত। চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। মুখে মৃদুমৃদু হাসি। কাঠের ফ্রেমে বসানো পিতলের তকমা ধুলোয় ভরা। সেই খুলো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে শিল্পীর নাম খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেছিল সে। জড়ানো অক্ষরে লেখা এল জি বার্টন। আর্কাইভের লোকেরা একদিকে দলিল দস্তাবেজ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে, অন্যদিকে নামানো হচ্ছে দামিদামি সব জিনিসপত্র, পিতল আর রুপার বাসন। এগুলো সব যাবে নিলামে। এতে ওর আগ্রহ নেই বিশেষ। দলিলগুলো বহু পুরাতন। কিছু কিছু প্রায় কলকাতা নগরের পত্তনের সময়কার। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখাই ওর কাজ। ধৈর্য ধরে বসে বসে আলাদা করতে হয় পাট্টাপত্র, ইজারা, দানপত্র, ফারখতিপত্র আর ডিক্রিগুলোকে। এগুলোই ভবিষ্যতে ইতিহাস লিখতে কাজে আসবে। এদের ভাষা অদ্ভুত ফারসি আর বাংলা মেশানো। কাজের খাতিরে এই ভাষার সঙ্গে পরিচিত সে। সহজেই আলাদা করে দিতে পারে এক দলিল থেকে অন্য দলিলকে। সাধে কি স্টেট আর্কাইভিস্ট তার উপরে এত ভরসা করেন! দলিলগুলো আলাদা আলাদা করে রাখতে গিয়ে একটা কাগজে চোখ পড়ে গেল তার। কোনও দলিল নয়। চিঠি। তারিখ অপেক্ষাকৃত আধুনিক। চিঠির প্রেরকের নাম দেখেই একটু থমকে গেল। এই প্রিয়নাথ কি সেই প্রিয়নাথ, যিনি ‘দারোগার দপ্তর’ নামে এক ধারাবাহিক সিরিজ লিখতেন? আগ্রহভরেই চিঠিটা পড়তে লাগল। চিঠিতে লেখা-

মান্যবরেষু ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্ত সমীপে,

মহাশয়,

বহুকাল আমাদিগের কোন যোগাযোগ নাই। আজি হইতে পনেরো বৎসর পূর্বে যে ভয়ানক ঘটনাবলী আমাদিগকে এক বিন্দুতে আনিয়াছিল, সে কারণও বিগত হইয়াছে। নদীতে জোয়ার আসিলে নূতন পলি, পুরাতনকে ঢাকিয়া দেয়। তেমনই গত কয়েক বৎসরে দেশের পরিস্থিতি যা হইয়াছে বা হইতেছে, তাহাতে মহারাণীর জুবিলির পূর্বে ম্যাসন হলে কি হইয়াছিল, তাহা মনে রাখিবার ইচ্ছা বা সুযোগ কাহারও নাই। এখন পত্রপত্রিকায় মোহনবাগান ক্লাবের শিল্ড বিজয় কিংবা ভারতবর্ষের রাজধানী আদৌ দিল্লী শহরে স্থানান্তরিত হইবে কি না, ইত্যাদি লইয়া বচসা চলিতেছে।

কিন্তু যে দায়িত্ব আমাতে অর্পিত হইয়াছিল, আমি পুরাণের দানব অ্যাটলাসের ন্যায় তাহা নিত্য বহন করিয়া চলিতেছি। ভূত হইতে প্রস্তুত সেই অদ্ভুত বড়ি অগ্নিনিরয়, যাহা প্রকৃতপ্রস্তাবে আপনার আবিষ্কার, তাহা এক্ষণে আমার হেপাজতে রহিয়াছে। শুনিয়াছি অগ্নিনিরয়ের জঠরে আবদ্ধ থাকাকালীন ভূতের কীর্তি কখনই নাশ বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। ফলে এই দ্রব্য বহুযুগ বাদেও আপনার সক্রিয়তা দেখাইতে সক্ষম হইবে। আমি চাকুরি হইতে অবসর লইয়াছি। বহুমূত্র রোগ আর হৃদযন্ত্রের নানা অসুখে নিয়ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া থাকি। আজ প্রভাতে কেন জানি না মনে হইল এই ধরাধামে আমি আর বেশিদিন নাই। ফলে এই বৃদ্ধের অন্তিম ইচ্ছা, এই বড়ি তাহার আবিষ্কারকের নিকট ফিরিয়া থাক। তাহাতে সর্বার্থেই সকলের মঙ্গল হইবে।

এই চিঠির সহিত একটি পাণ্ডুলিপি পাঠাইলাম। সেই অভিশপ্ত দিনগুলিতে যাহা ঘটিয়াছিল, যাহা আমার জ্ঞানবুদ্ধি মতে সতা, সবই উহাতে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। এ পাণ্ডুলিপি এখনই প্রকাশের যোগ্য নহে। আপনি ইহা গোপনে আপনার কুক্ষিগত করিয়া রাখিলে বাধিত হইব। সঠিক সময় আসিলে মহাকাল নিজেই ইহাকে লোকচক্ষুর সম্মুখে আনিবে ইহাই আমার বিশ্বাস। সঙ্গে কাঠের বাক্সটিতে আপনার আবিষ্কৃত অগ্নিনিরয় রহিয়াছে। আমি নিশ্চিত উহাকে আপনি ব্যবহার করিবেন না। সযত্নে লুক্কায়িত রাখিবেন। কিন্তু যদি কোনদিন পুনরায় অগ্নিনিরয় বা ভূত প্রস্তুতের প্রয়োজন পড়ে, ক্লাইভ স্ট্রিটের গোয়েন্দা তারিণীচরণ রায়ের নিকট সেই প্রস্তুতপ্রণালী রহিয়াছে। কিন্তু আপনার দায়িত্ব তাহাকে খুঁজিয়া লওয়া। সম্প্রতি সে কলিকাতা ও গোয়েন্দাগিরি, উভয়ই ত্যাগ করিয়াছে। পরমেশ্বরের কৃপায় আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

ইতি-

শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়।

পুনঃ- আপনার এককালে সহযোগী ল্যানসন ওরফে লখন এক্ষণে চন্দননগরের বড়বাজারের সন্নিকটে সপরিবারে স্থিত হইয়াছে। উহার নূতন নাম ম্যানুয়েল ডিব্যাসি।

গোটা চিঠিটা ও একবার পড়ল, দুবার পড়ল, বারবার পড়ল। বিশেষ করে শেষ লাইনটা। ওর গোটা ছেলেবেলা চলে এল ওর সামনে। একবার পাশের বাড়ির পটুদের দুর্গাঠাকুর ছুঁয়ে ফেলেছিল। পল্টুর বাবা ওকে বেধড়ক মারেন। কেউ প্রতিবাদ করেনি। ওর সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেত না কেউ। আড়ালে ফিসফিস করে বলত ট্যাঁশ, বেজন্মা। ওর কোনও বন্ধু নেই। কোনও বন্ধু ছিল না। উচ্চমাধ্যমিকের পরে ও বুঝল এবার সময় এসেছে। এ দেশে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে না থাকলে অশেষ দুঃখ। সে ধর্মই হোক, বা রাজনীতি কিংবা যৌনতা। অন্যরকম মানেই খারাপ। একঘরে। বিদ্রূপ। কোর্টে এফিডেভিট করে নাম আর পদবি বদলে নিল। বদলে নিল এই দেশের সংখ্যাগুরুদের মতো। কলেজে তাই নাম বললে কেউ থমকে যেত না। বিস্মিত হত না। তেরছা দৃষ্টিতে তাকাত না।

বাক্সটা দলিলগুলোর সঙ্গেই ছিল। কাঠের বাক্স। তাতে ধাতুর লাইনিং। কোনও চাবির ছিদ্র নেই। খোলার মতো কোনও ঘাট নেই। এই বাক্স পাশাপাশি খুলতে হয়। ও জানে। এককালে এই বাক্সের রহস্য সবার অজ্ঞাত ছিল। ধনীরা গোপন কিছু রাখতে এই ধরনের বাক্স ব্যবহার করতেন। হাতে পেলেও খোলা যাবে না। ভাঙতে গেলে ভিতরে পাতলা কাচের লাইনিংয়ের মধ্যে তীব্র অ্যাসিড ভিতরে থাকা সমস্ত কিছু নষ্ট করে দেবে। কিন্তু এখন এই বাক্সের কৌশল জন্মদিনে বাড়ি বাড়ি ম্যাজিক দেখানো ম্যাজিশিয়ানরাও জানেন।

“আচ্ছা, তোমরা এবার একটু ব্রেক নাও। সকাল থেকে একভাবে কাজ করছ তো”, ও বাকিদের বলল। কথাটা মিথ্যে নয়। কয়েকশো বছরের পুরোনো দলিল ধুলো ঘেঁটে বার করা, তাদের নম্বর বসানো, অ্যাকুইজিশান ডকেট করা, সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, প্রায় পাঁপড়ের মতো ভঙ্গুর কাগজগুলো যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখা। প্যাশন না থাকলে এ জিনিস চরম বিরক্তিকর। সহকারীদের বেশি অনুরোধ করতে হল না। তারা পত্রপাঠ “আধা ঘন্টার মধ্যেই আসছি স্যার” বলে বিদায় নিল। তন্ময় নামে একটা ছেলে নতুন এসেছে। সে-ই ডকেটিং করছিল।

“তুমি যাবে না?”

“হ্যাঁ স্যার, যাচ্ছি। একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট জাতীয় লেখা পেয়েছি। বেশ মোটা। আলাদা আলাদা কাগজে হাতে লেখা। দড়িদিয়ে বাঁধা। এটার ডকেট করছিলাম।”

“করে ফেলেছ?”

“হ্যাঁ স্যার, অ্যাকুইজিশানে ঢুকিয়ে দিয়েছি।”

.

ইশশ! কেন আর খানিক আগে ওর চোখে এটা পড়ল না। এ জিনিষ সরকারি আর্কাইভে ঢোকা মানে আবার একশো বছরের স্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া। যা করার তাকেই করতে হবে। এতকাল মাস্টার বারবার যে কথা বলে এসেছেন, যে কথাকে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিল গল্পকথা ভেবে, আদতে সে আছে। আছে ওই পাণ্ডুলিপির পাতায়, এই চিঠিতে, ওই বাক্সে। শীতের দুপুরে সোনালি রোদ জড়িয়ে রয়েছে গোটা দত্তবাড়িতে। যা করার দ্রুত করতে হবে। কাঁধের ঝোলাব্যাগে বাক্স আর চিঠিটা ঢুকিয়ে নিল প্রথমে। এবার পরের কাজ। ইনভেনটরির হিসেব লেখার জন্য আজকেই বেশ কয়েক রিম সাদা পাতা কেনা হয়েছিল। প্রয়োজনের অনেক বেশি। পাণ্ডুলিপিটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একদিকের টেবিলে। শেষ পাতাটা দেখা যাচ্ছে শুধু। তাতে লেখা-

হৃদয়ের এক অনাবিল তাড়নায় এই সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করিলাম। জানি না, উচিতকার্য হইল কি না। তবে যিনি ইহা পাঠ করিবেন, তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই, ভূত আমার আয়ত্তে বিশ্রামে রহিয়াছে, কিন্তু ধ্বংস হয় নাই। আমি ইহাকে ধ্বংসের সপক্ষে ছিলাম, কিন্তু সাইগারসনের পীড়াপীড়িতে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সর্ববৃহৎ প্রমাণকে নিজ হাতে নষ্ট করিতে পারি নাই। ভূতের মুণ্ড তারিণীর নিকট, ধড় আমার দখলে। এমন ব্যবস্থা করিয়া সাইগারসন দেশে ফিরিয়াছিলেন। ধড়মুণ্ড একত্র হইলে পুনরায় ভূত জাগিবে। কোন দুষ্কৃতকারীর হস্তে তাহা পতিত হইলে তো মহা সর্বনাশ। ভবিষ্যতে যদি সেই তৃত জাগ্রত হয়, তবে যে ভয়ানক কাণ্ড ঘটিবে তা ভাবিতেই শোণিত শুখাইয়া আসে…

.

দড়ি খুলে পড়তে শুরু করল সে। যত পড়ছে, মনে হচ্ছে এক অজানা সত্য যেন সদ্য জেগে ওঠা দানবের মতো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির পিছন দিক থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা ফিরে আসছে। এসে গেলেই সর্বনাশ। প্রথমেই ও গোটা পাণ্ডুলিপিটা ব্যাগে পুরে নিল। প্রথম পাতাটা বাসে। সেই জায়গায় সাজিয়ে দিল নতুন সাদা পাতা। এমনভাবে বেঁধে দিল যে দেখলে কারও সন্দেহ হবে না।

তন্ময় এসে দেখল তাদের কাজের জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে তাদের ইনচার্জ। কোনও সাড়া নেই। কাঁধের ভারী ব্যাগটা ধুলায় লুটাচ্ছে। চোখেমুখে জলের ছিটা দিতে কোনওমতে উঠে আবার পড়ে গেল সে। খালি পেটে এতক্ষণ কাজে মাথা ঘুরে গেছে বোধহয়। তন্ময় একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা চন্দননগরে পৌঁছে দিতে বলল তাকে। এক অর্থে ভালোই হল। গাড়িতে বসে পাণ্ডুলিপির অনেকটা পড়া হয়ে গেল। এবার খোঁজের পালা।

খোঁজ করতে বেশ কিছুদিন কাটল। ধরা দিয়েও যেন ধরা যাচ্ছে না। সব কিছু পারদের মতো পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, একদিন আনন্দবাজারে ক্লাসিফায়েড কলামে একটা বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠল সে। তাতে লেখা, “প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রে প্রাইভেট আই অ্যান্ড কোং। প্রো: তুর্বসুরায়। ৩৫ ক্লাইভ স্ট্রিট, কলকাতা।”

ওর ঠোঁটে মৃধু একটা হাসি ফুটে উঠল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *