তৃতীয় পরিচ্ছেদ— নকল মনুষ্য
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জার্নাল থেকে
পুলিশ কর্মচারীগণকে কীরূপে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হয়, অজ্ঞাত বিষয়ে অনুসন্ধানে কীরূপে লিপ্ত হইতে হয়, অজ্ঞাতনামা অপরাধীকে কীরূপে ধৃত করিতে হয় তাহার আনুপূর্বিক বিবরণ আমি এ যাবৎ আমার ‘দারোগার দপ্তরে’ লিপিবদ্ধ করিয়াছি। এই লোকজগতে দিন দিন যত প্রকারের অপরাধের অবতারণা হইয়া থাকে, তাহার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে একটি অপরাধের সহিত অপরটির যে কোনও রূপ সাদৃশ্য আছে, তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু গভীর অনুসন্ধানে নানা অপরাধের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য থাকিলেও বেশ কিছু মিল নজরে আসে। গোয়েন্দাদের কর্ম সেই মিল খুঁজিয়া বাহির করা। এই সূর্যের তলায় নূতন কিছু ঘটে না, যাহা ঘটে তাহা পুরাতনের অনুবর্তন মাত্র, ইহাই আমাদিগকে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল। বহুলাংশে তাহা সঠিকও বটে। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ কর্মজীবনে এই একটিই মোকদ্দমা পাইয়াছি, যাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার মুহূর্তে যে বিষয় একবারের নিমিত্তও ভাবা যায় নাই, বা অনুসন্ধান করিতে করিতে যে সকল সামান্য বিষয়ের দিকে একবারের নিমিত্ত নয়ন আকৃষ্ট হয় নাই, সেই সকল সামান্য বিষয় অবলম্বন করিয়া মোকদ্দমার গূঢ় রহস্য বাহির হইয়া পড়িয়াছে। আমার জার্নালের এই অস্তিম অংশে আমি যাহা লিপিবদ্ধ করিতে যাইতেছি, তাহা যতই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব মনে হউক না কেন, ঈশ্বর শপথ, ইহার প্রতিটি শব্দ বর্ণে বর্ণে সত্য। যে ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জাল গোটা ইংরাজ শাসনের ভিত্তিমূল টলাইয়া দিতে প্রায় সক্ষম হইয়াছিল, আমি এক্ষণে তাহা পূর্বাপর বর্ণনা করিব। এই জার্নাল কেহ পাঠ করিবে বলিয়া আশা রাখি না, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে যদি এই পাণ্ডুলিপি ভবিষ্যতের কোনও পাঠকের হস্তে পতিত হয়, তাঁহাকে বলিব, হে পাঠক, যাহা লিপিবদ্ধ করিলাম, তাহা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানবুদ্ধির বাহিরে হইলেও সত্য, সম্পূর্ণ সত্য, সত্য বই কিছু নয়।
মেডিক্যাল কলেজে তারিণীর কেবিনে যে নাটকের উন্মোচন হইতেছিল, তাহার বিস্তারিত বর্ণনা পূর্বেই লিপিবদ্ধ করিয়াছি। সাইগারসন সাহেব বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার মুখপানে চাহিয়াছিলেন। শৈলর রচিত নাটকের শুরুর বিজ্ঞাপনেই বিপরীত সম্পাতিতে সে যাহা বলিতে চাহিয়াছে, তাহার তিলমাত্র যদি সত্য হয়, তবে এতবড় বিপদের সম্মুখীন ইংরাজ সরকার আজ পর্যন্ত হয় নাই। আমার জিহবা ভারী হইয়া উঠিয়াছিল, মুখে কথা জোগাইতে ছিল না। এতবড় একখানি খবর সাহেবকে কীভাবে বলিব, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না।
সাহেব আমায় পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “কিছু বলিতেছেন না কেন? কী লিখিত আছে উহাতে?”
আমি ক্ষীণ কম্পিত কণ্ঠে জানাইলাম, “সাহেব, কোন মুখে এই পাপ বাক্য উচ্চারণ করি? তবু আপনি জোর করিতেছেন, তাই বলি, ইহাতে লিখিত আছে, আগামী বৎসর মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি অনুষ্ঠানে তাঁহাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হইতেছে।”
ভাবিয়াছিলাম সাইগারসন সাহেব চটিয়া উঠিবেন, অথবা চমকাইবেন, অথবা এ সম্ভাবনাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। তিনি এই সমস্ত কিছুই করিলেন না, বরং তাঁহার ঘন ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হইয়া প্রায় মিশিয়া গেল। অতি ধীর পদক্ষেপে একখানি কেদারায় উপবেশন করিয়া হস্তের অঙ্গুলিসমূহ পরস্পরের সহিত স্পর্শ করাইয়া ঘাড় গুঁজিয়া তিনি কী যেন ভাবিতে লাগিলেন। মুখমণ্ডল গম্ভীর, যেন বর্ষণের পূর্বে অম্বুবাহী জলদ আসিয়া জমা হইয়াছে। কেবিনে উপস্থিত কেহ কিছু বলিতেছে না কিংবা বলা যায়, বলিবার সাহস জোগাইতেছে না। খানিক বাদে সাহেব নিজেই অতি ধীর কণ্ঠে কহিলেন, “সিউডোম্যান তবে সত্য!”
আমরা কেহই কিছু বুঝিতে পারিলাম না। তিনজনে অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলাম। সাহেবের ব্রায়াররুট পাইপখানি নিভিয়া গিয়াছিল। আবার তাহা জ্বালাইয়া সাহেব বলিতে শুরু করিলেন-
“হয়তো আপনাদের জ্ঞাত নাই, অদ্য অবধি আততায়ীরা মোট আটবার মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে হত্যার প্রচেষ্টা পাইয়াছে। প্রথমবার, ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে, মহারাণীর বিবাহের চতুর্থ মাসে, প্রিন্স এডওয়ার্ড ও মহারাণী বৈকালে বায়ু সেবনে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছিলেন। এডওয়ার্ড অক্সফোর্ড নাম্নী অষ্টাদশবর্ষীয় এক যুবক মহারাণীকে উদ্দেশ্য করিয়া বন্দুকের গুলি ক্ষেপণ করে। সে গুলি মহারাণীকে স্পর্শ করিতে পারে নাই। ইহার পরবর্তীতে জন ফ্রান্সিস, উইলিয়াম বিন, উইলিয়াম হ্যামিলটন সহ মোট সাতজন আটবার মহারাণীকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। অবশ্য প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়।”
-সাতজন ব্যক্তি আটবার প্রচেষ্টা করিল কেমন করিয়া?
অবাক হইয়া দেখিলাম অসুস্থ তারিণীর দুই চোখ জ্বলজ্বল করিতেছে। প্রশ্নটি সে-ই করিল।
সাহেব মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “জন ফ্রান্সিস ১৮৪২ সালের পরপর দুইদিন ২৯ শে ও ৩০ শে মে মহারাণীকে হত্যার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই বিফলকাম হয়। প্রথমদিন তাহার বন্দুক চলে নাই, দ্বিতীয়দিন আবার প্রচেষ্টা চালাইতে যাইবার পূর্বেই সে মহারাণীর প্রহরীদের হাতে ধৃত হয়। শেষ প্রচেষ্টা হয় ১৮৮২ সালে। ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কিন্তু এই আটটি প্রচেষ্টায় অদ্ভুত কিছু মিল লক্ষ করা গিয়াছিল, যাহাতে লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাগণ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোনকে সমস্ত ঘটনা এক গোপন চিঠিতে জানাইতে বাধ্য হন।”
“কী সেই মিল? জানিতে পারি কি?” আবার তারিণী।
“এখন আর লুকাইবার কিছুই অবশিষ্ট নাই। প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোনের সহিত মহারাণীর বিশেষ সুসম্পর্ক ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের গুপ্তচর বিভাগ তদন্ত করিয়া দেখিয়াছে, এই দীর্ঘ শাসনকালে যতবার মহারাণীর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে, তাহার কিয়মাসের মধ্যেই তাঁহাকে হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়। প্রতিবার হত্যার চেষ্টার পর ইংলন্ডে মহারাণীর জনপ্রিয়তা পুনরায় বৃদ্ধি পায়। ইহাতে প্রাথমিক সন্দেহ ছিল না, সন্দেহ দেখা দিল যখন গোয়েন্দারা তদন্ত করিয়া দেখিলেন প্রত্যেকটি প্রচেষ্টার মোডাস অপারেন্ডি বা হত্যা পদ্ধতি একই প্রকার এবং প্রতি ক্ষেত্রেই মহারাণী ক্ষমার দেবী হইয়া দোষীদের মৃত্যুদণ্ড মুকুব করিতেছেন”
“এক্ষণে সেই দোষীদের কি কারাবাস হইয়াছে?” আমি আর না থাকিতে পারিয়া প্রশ্ন করিলাম।
মৃদু হাস্য ফুটিয়া উঠিল সাইগারসনের ওষ্ঠে।
“ইহাদের প্রায় সকলকেই মানসিক রোগগ্রস্ত আখ্যা প্রদান করিয়া বেডলাম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁহার পরে তাঁহাদের কী হইল, অনেক চেষ্টা করিয়াও সে খোঁজ আমরা পাই নাই।”
“তবে জুবিলিতে….”
“জুবিলি লইয়া আমরা সকলেই খুব চিন্তিত। ১৮৮২ হইতে আজ অবধি চৌদ্দ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। মহারাণী বৃদ্ধা হইয়াছেন। রাজপরিবারে সিংহাসনের দখল লইয়া এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছে, যাহা ঠিক এই মুহূর্তে প্রকাশযোগ্য নহে। প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোনের শেষ সময়কাল হইতে প্রধানমন্ত্রী ও মহারাণীর সম্পর্ক ক্রমাগত নিম্নমুখী হইতে থাকে। মহারাণী প্রায়শই নানা ছলে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করিবার কৌশল খুঁজিতে থাকেন। আমাদের বিশ্বাস মহারাণীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত সেই সময়কালেই ঘটে।”
“গ্ল্যাডস্টোনের এই সময়কাল কবে হইতে কবে?” তারিণী এক্ষণে শায়িত অবস্থা হইতে উঠিয়া পা ঝুলাইয়া বসিয়াছে।
“১৮৯২ সনের ১৫ই আগস্ট হইতে ১৮৯৪ সনের ২রা মার্চ।”
কেবিনে উপস্থিত সকলে স্তব্ধবাক, চিত্রার্পিত নিঃস্পন্দ হইয়া রহিয়া গেলাম। এই সময়কাল আমাদের সকলের অতি পরিচিত। যে ভয়ানক, অলীক, বীভৎস নাট্যের ক্রীড়নক আমরা সকলে, তাহারও সূত্রপাত হইয়াছিল ওই কালসন্দর্ভেই, তাহা কি কেউ ভুলিতে পারে? ভোলা সম্ভব?
সাহেব যেন আমাদিগের হৃদয়ের কথা বুঝিয়াই বলিলেন, “তদন্তকালে যে সকল তথ্য আমাদিগের হাতে আসিয়াছে, তাহাতে আমরা নিশ্চিত, মহারাণীর রাজত্বকালের ষষ্ঠদশ বর্ষপূর্তি উৎসবকালেই তাঁহার উপরে অস্তিম আঘাত হানা হইবে। এ আঘাত এড়াইবার ক্ষমতা তাঁহার নাই। তবে তাহা কোন পথে, কীরূপে, কাহার বেশে আসিবে তা আজও আমাদিগের অজানা। আগামী বৎসর জুবিলি উপলক্ষ্যে মহারাণীর ভারতে আসিবার পরিকল্পনা। আমাদের ধারণা আঘাত তখনই আসিবে। গুপ্তঘাতকেরা খোদ ইংলন্ডে মহারাণীকে হত্যার সাহস আর দেখাইবে না। ইহার জন্যেই ভারতকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। ইংলন্ড অপেক্ষা ভারতে মহারাণীর বিরোধীর সংখ্যা প্রবল। দিকে দিকে ইংরাজ শাসন বিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দিতেছে। এইস্থলে তাই ষড়যন্ত্রকে বাস্তব রূপ দান অধিকতর সহজ।”
“মহারাণীকে এদেশে আসিতে বারণ করা কি নিতান্ত অসম্ভব?”
“উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া অসম্ভবই বটে। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তীকালে মহারাণী এই দেশের শাসনভার নিজ হস্তে লইবার পরই বিভিন্ন স্তর হইতে দাবি আসিতেছে, যে উপনিবেশ ব্রিটিশরাজের সর্বাপেক্ষা অধিক কর নিষ্কাশনের ক্ষেত্র, সেই উপনিবেশে কেন মহারাণী স্বয়ং যাইবেন না? মহারাণী ভিক্টোরিয়া আপন ভাবমূর্তি সচেতন। একবার যখন স্থির করিয়াছেন ভারতে আসিবেন, তাঁহাকে নিবারণ করে কার সাধ্য! আর আমাদের হস্তেও কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নাই। আছে শুধু এই অদ্ভুত সাংকেতিক নাটিকাটি আর আততায়ীর নাম।”
“আততায়ীর নাম?”
আমার প্রশ্নেই যে বিস্ময় লুকাইয়া ছিল তাহা বুঝিয়া সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলিলেন, “ঠিক নাম নয়। ছদ্মনাম। এই ঘৃণ্য কার্য যাঁহার উপর অর্পিত হইয়াছে, তাঁহার ছদ্মনাম সিউডোম্যান বা নকল মনুষ্য। কিন্তু তিনি কে বা তাঁহার পরিকল্পনা কী, সে বিষয়ে আমরা আজও গভীর তমসায় নিমগ্ন।”
“কিন্তু তাঁহার ছদ্মনামই বা জানা গেল কীরূপে? কে এই গুপ্তকথা ফাঁস করিল?”
“হিলি। আসল হিলি। যাহাকে আমারই পরামর্শে গুম করা হইয়াছিল।”