তৃতীয় অধ্যায় – মহানবী মদীনায়

তৃতীয় অধ্যায় – মহানবী মদীনায়

মদীনার জীবনে ঐতিহাসিক দিন।
মহানবী মদীনায়।
নতুন সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন।
আনসারদের সামরিক শক্তি।
হিযরতের পর মদীনায় অমুসলিমদের অবস্থান।
নতুন ব্যবস্থার সমস্যাবলী।

.

অধিকাংশ মক্কী মুসলমানদের সঙ্গে মহানবীর মদীনায় আগমনের ফলে আনসাররা ইসলামের জন্য এমন একটা দূর্গ ও শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলেন যা তাদের চিরকালীন শত্রু কুরাইশদের জন্য একটি প্রচন্ড ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এর ফলে তারা তাদের মানসিক শান্তি ও আত্মপ্রসাদ হারিয়ে ফেলে। মদীনার নতুন শক্তির ভয়ে তারা সব সময়ই ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে।

নতুন সমাজ ব্যবস্থা

নবীজির সামনে প্রথম কাজ ছিল আল্লাহর অনুমোদিত পথে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

নতুন ব্যবস্থা গড়ার পথে প্রধান অন্তরায় গুলি ছিল নিম্নরূপ:

১. ইয়াথ্রিবের আল- আউস এবং আল-খাযরাজ গোত্রদু’টির মধ্যে বহুদিনের শত্রুতা যার ফলে তাদের মধ্যে বহুবার গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

২. মক্কায় জিনিসপত্র ফেলে বহু সংখ্যক মক্কী মুসলমানের মদীনায় আসার পর সমস্যা; তাদের চরম দারিদ্র এবং জীবনধারণের কোন ব্যবস্থা না থাকা।

৩. মহানবীর আগমনের আগে ইয়াথ্রিবে (মদীনায়) বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়ের আর্থ-রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব। শীঘ্রই এটা পরিস্কার হয়ে উঠে যে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং কুরাইশদের আসন্ন আগ্রাসন প্রতিহত করতে ইহুদীদেরকে তাঁদের দলে আনতে হবে।

নবীজির মসজিদ নির্মাণ

ইসলামের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন স্থাপনের লক্ষ্যে অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ পদক্ষেপ ছিল এমন একটা মসজিদ নির্মাণ করা যার লক্ষ্য হবে নতুন ধর্মমতের বৈশিষ্টগুলি তুলে ধরা। এর আরো একটি কাজ ছিল শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মুসলমানদেরকে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত করা এবং বৈঠক স্থল হিসেবে বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে একত্রিত করা যাতে তারা জাহিলিয়া যুগের সংস্কার ও বৈরিতা ভুলে পরস্পরের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পারে।

এজন্য নবীজি ঐ জায়গায় একটা মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন যেখানে তাঁর উট হাঁটু গেড়েছিল। নবীজির নির্দেশ পেয়ে. মুসলমানরা প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহ করলেন। তারা তালগাছ কাটলেন, ইট বানালেন এবং একশ’ হাত জায়গার উপর মসজিদ বানানোর কাজে লেগে গেলেন।

মসজিদটি নির্মাণের কাজে অন্যান্য সাহাবীদের সঙ্গে নবীজিও পিঠে করে ইট এবং মাটি বহন করেন। নবীজি তাদেরই একজন সবাই কাজে উৎসাহ পান। এটা দেখে কর্মীদের মধ্যে একজন বলে উঠেন: “ নবীজি যখন কাজ করছেন তখন আমরা যদি অলস হয়ে বসে থাকি তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য বড় একটা অন্যায় কাজ।”

নবীজির মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এটা দেখতে খুব সাধারণ লাগলো। এর দেয়ালগুলি নির্মিত হয়েছিল ইট এবং মাটি দিয়ে। ছাদটি তালগাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি ছিলো বলে সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি ভিতরে ঢুকতো। মেঝে ছিল বালি ও কাঁকরের। ছাদ ঠেকিয়ে রাখর জন্য মাঝখানে তালগাছের গুড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল।

মদীনায় নবীজির প্রথম ভাষণ

এই সাধারণ উপাসনালয়টি হলো মানবজাতির প্রথম আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল-গাজ্জালীর ভাষায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছিল মনুষ্যরুপী দেবদূত এবং অসভ্য অত্যাচারীদের জন্য এরা ছিলেন একটা উন্নত সভ্যতার দিশারী।

এই মসজিদেই নবীজি মুসলমানদের প্রতি তাঁর প্রথম ভাষণ দেন। আব্দুর রহমান বিন আউফের বরাত দিয়ে আল-বাইহাকি বলেছেন যে এই ভাষণে নবীজীর বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ:

“ভাইসকল, আপনারা নিজেদের জন্যই আপনাদের আগে কিছু (অর্থাৎ ভাল কাজ) পাঠান। আপনারা নিশ্চয়ই ভাল করেই জানেন যে প্ৰত্যেকেই আপনারা মরে যাবেন এবং যে পরিবারকে পিছনে ফেলে যাবেন তাদেরকে দেখার কেউ থাকবে না। এবং কেউ যখন তার প্রভুর কাছে ফিরে যায় তখন তাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং কেউ তখন তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না কিংবা প্রভুর কাছে তার হয়ে কথা বলার সাহস পাবে না। প্ৰভু তাকে জিজ্ঞেস করবেন :

আমি কি তোমার কাছে আমার দূত পাঠিয়েছিলাম না এবং পার্থিব সম্পদ আর শক্তি দিয়েছিলাম না? তোমার সঙ্গে তুমি কি নিয়ে এসেছ? সে তখন ডানে -বামে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না। এরপর সামনের দিকে তাকিয়ে সে দোযখ দেখতে পাবে। অতত্রব আপনাদের মধ্যে যিনিই আগুনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চান, এক টুকরো খেজুর দিয়ে হলেও তাকে তা করতে হবে। যার দেবার মত কিছুই নেই তিনি ভাল কথা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন, কারণ সব ভাল কাজের জন্য দশ থেকে সাত’শ গুণ সওয়াব দেওয়া হবে। আপনাদের উপর এবং আল্লাহর নবীর উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”

সৌভ্রাতৃত্ব সম্মেলন

মসজিদটিকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সভ্যতার কেন্দ্র (যেখানে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে কোন মধ্যস্ততা ছাড়াই সম্মিলিতভাবে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতেন) বানানোর পর মহানবী তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞায় মুসলমানদের বিভিন্ন দলের মধ্যে বিদ্যমান জাহিলিয়া যুগের যাবতীয় শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দিতা দূর করার কাজে মনোনিবেশ করলেন।

আমরা আগেই বলেছি ইয়াসরিবে তখন ছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ এবং গোত্রে গোত্রে মারামারি। এর যৌবনের ফুল শুকিয়ে গিয়েছিল, জনগণের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং আরব ভূখন্ডের এই এলাকায় ইহুদিদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার সুযোগ এসেছিল।

যে সুনির্দিষ্ঠ এবং বিচক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মহানবী আউস এবং খাযরাজ গোত্রের বৈরিতা দূর করেছিলেন সেটাই ছিল মদীনায় অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে তাদের মধ্যে এবং তাদের ও মুহাজিরিনদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। এই সম্মেলনে একজন মুহাজিরকে একজন আনসারির সঙ্গে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জুটি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

ইবনে ইসহাক বলেছেন, “আল্লাহ্ নবী আনসার ও মুহাজিরিনদের মধ্য থেকে আসা তাঁর সাহাবীদের মধ্যে একটা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি তাঁদেরকে বললেনঃ “তোমরা পরস্পরের ভাই হবে এবং তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক দু’জন লোক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে।”

একটি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আদর্শগত ব্যবস্থাপনায় নতুন সমাজের বিভিন্ন উপাদান সংযোজনের ক্ষেত্রে এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ফলপ্রসূ একটা ভূমিকা পালন করেছিল। এর চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কোন ঐক্যের বন্ধন কেউ কখনো কল্পনা করতে পারেননি।

এই ভ্রাতৃত্বের প্রক্রিয়ায় আনসাররা, বিশেষ করে তাঁদের নেতারা, খুব খুশী হয়েছিলেন, কারণ এতে করে ইয়াসরিবের জনগণের বহু শতাব্দীর লালিত শান্তি ও স্থিরতার আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

একইভাবে এই নব্য প্রতিষ্ঠিত ভ্রাতৃত্বের ফলে মুহাজিরিনরাও স্বস্তি পেয়েছিলেন। কারণ তাঁদের ভ্রাতৃপ্রতিম আনসারদের সাহায্য-সহযোগিতায় মক্কায় সহায়-সম্পত্তি ফেলে কিংবা সেখানকার মূর্তি পূজারীদের জবরদস্তিতে সম্পত্তি হারিয়ে মদীনায় আসার পর তারা যে চরম দারিদ্রের মধ্যে নিপতিত হয়েছিলেন তার বোঝা কিছুটা হালকা হয়েছিল।

আনসারদের উদার সাহায্যের প্রস্তাব

আনসাররা তাঁদের ভ্রাতৃপ্রতিম মুহাজিরিনদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। মুহাজিরিনদেরকে সাহায্য সহযোগিতার লক্ষ্যে তাঁদের নিজেদের সম্পত্তির একটা অংশ তাঁদেরকে দিতে চাইলেন।

মুহাজিরিনরাও একই রকম মহত্তের পরিচয় দিলেন। আনসারদের উদার প্রস্তাবের তাঁরা প্রশংসা করলেন বটে কিন্তু বিনীতভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সৎভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা ও চাষাবাদ করতে লাগলেন এবং এর জন্য যেটুকু সাহায্য ও সহানুভূতি দরকার শুধুমাত্র সেটুকুই তাঁরা আনসারদের কাছ থেকে গ্রহণ করলেন।

আল-বুখারী বর্ণনা করেছেন যে সা’দ বিন আর-রাবি[১] তাই ভাই আব্দুর রহমান বিন আউফকে[২] তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি দিতে চেয়েছিলেন।

[১. তাঁর জীবন ইতিহাসের জন্য আমাদের ওহুদের যুদ্ধ বইটি দেখুন।

২. পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে তাঁর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়েছে।]

সা’দ আব্দুর রহমানকে বললেন, “আনসারদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, সুতরাং আপনি আমার অর্ধেক সম্পত্তি নিতে পারেন। আমার স্ত্রীও দু’জন; সুতরাং দু’জনের মধ্যে যে বেশী সুন্দরী তাকেই আপনি আপনার জন্য নির্বাচন করুন; আমি তাকে তালাক দিয়ে দেব। নির্দিষ্ট সময়ের পরে আপনি তাঁকে বিয়ে করতে পারেন।” আবদুর রহমান জবাব দিলেন : “আল্লাহ আপনার সম্পদ বাড়িয়ে দিন এবং পরিবারের মঙ্গল করুন! আমার কিছুই প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু আমাকে বাজারের পথটা দেখিয়ে দিন।” তাঁকে বি, কাইনুকা বাজারের পথ দেখিয়ে দেয়া হলো। তিনি সেখান থেকে মাখন ও পনির নিয়ে ফিরলেন (তাঁর সেদিনের রোজগার থেকে)। তিনি ব্যবসা শুরু করলেন এবং পরে একদিন হলুদ রঙের পোশাক পরে নবীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এ সম্পর্কে নবীজি প্রশ্ন করলে তিনি তাঁকে বললেন যে তিনি বিয়ে করেছেন এবং বিয়েতে পাঁচ দিরহামের সোনা ব্যয় করেছেন।

নতুন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট সমূহ

এভাবে নবীজি সুন্দর ও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর নতুন একটা সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। এ ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট ছিল এতদিনের পরস্পর বিরুদ্ধ আউস ও খাযরাজ গোত্র দু’টির মধ্যে সুসম্পর্ক অতীতে এই দু’টি গোত্রের মধ্যে এমন সুসম্পর্ক আর কখনো দেখা যায়নি। এই সুসম্পর্ক তাদের মধ্যেকার অতীতের সমস্ত বৈরিতা দূর করে দেয়।

এই দুই গোত্রের মধ্যে নবীজির প্রতিষ্ঠিত ঐক্যের ফলে নতুন বাণী- প্রচারের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধসমূহের ক্ষেত্রে ইসলামের ব্যাপক উপকার হয়েছিল।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আনসারদের অবস্থান

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাহ্তানী গোত্র আউস এবং খাযরাজের অবস্থান হয়ে উঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহানবী মুহাম্মদের (সঃ) গৃহীত

পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত তারা মারাত্মক ঝগড়া-কলহে তাদের শক্তি অপচয় করতো। ইহুদিরা এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ ক’রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এই এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এজন্য তারা সব সময়ই উক্ত দুই গোত্রের বৈরিতায় ইন্ধন যোগাত।

কিন্তু ইসলাম এসে একটা সাধারণ আদর্শ দিয়ে এই দুই বিবাদমান গোত্রকে এক করে দেয় এবং নিজের প্রয়োজনেই তাদের সামরিক শক্তিকে সুসংবদ্ধ করতে শুরু করে।

প্রথম দিকে এটাই ছিল একমাত্র শক্তি যা ইসলামের বিস্তারে সাহায্য করে এবং এর ফলে সমগ্র আরব ভূখন্ডই অবশেষে এক আল্লাহ্ বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সেখানে শান্তি, ন্যায় বিচার ও স্থিরতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া এই শক্তির বলেই ইসলাম শেষ পর্যন্ত তার মারাত্মক শত্রু কুরাইশদের পরাভূত করতে সক্ষম হয়।

ইয়াসরিবের অমুসলিম জনগোষ্টী

নবীজি যখন নিশ্চিত হলেন যে নতুন ইসলামী প্রশাসনিক ব্যবস্থা একটা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মদীনার মুসলমানরা একটা আদর্শগত, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ঐক্য অর্জন করেছেন তখন তিনি নতুন মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নগরীর অমুসলিম জনগোষ্ঠী ইহুদিদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবলেন।

কিন্তু ইহুদিদের অন্তরে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র ছিল দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ এবং বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ক্রমান্বয়ে তা তাদের দ্বিতীয় প্রকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা আবার ষড়যন্ত্র শুরু করলো। শান্তিতে সুপ্রতিবেশীর মত বসবাসের পরিবর্তে তারা মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ আর কুৎসার বীজ ছড়িয়ে তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলো।

অন্যদিকে মুসলমানরা ইহুদিদের সঙ্গে তাঁদের চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। ইহুদিদের সঙ্গে তাঁদের আচরণ থেকেই তাঁদের উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসঘাতক প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার পরম ইচ্ছা প্রতীয়মান হয়।

কিন্তু চক্রান্তকারী ইহুদিরা তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে এবং দমন নিপীড়নের আশ্রয় নেয়। যে দ্রুত গতিতে ইসলাম একটা উদীয়মান শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছিল তা ইহুদিদের চরম মাথা ব্যাথার করণ হয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষ করে নবীজির প্রতি তাদের ঘৃণার কারণ ছিল এই যে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলি সত্যে পরিণত হচ্ছিল এবং এতে করে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছিল যে যার জন্য তারা এতদিন অপেক্ষা করছিল মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কারশি হলেন প্রকৃত পক্ষে সেই নবী। কিন্তু তাঁকে গ্রহণ না করে এবং তাঁর আগমনে খুশী না হয়ে তারা বরং নবীকে এবং তাঁর প্রচারিত আল্লাহর বাণীকে ঘৃণা করতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে দু’জন ইহুদি পন্ডিত হুয়াই বিন আখতাব, নবীজির স্ত্রী সাফিয়ার[১] (আল্লাহ্ তাঁর মঙ্গল করুন) বাবা এবং তার ভাই ইয়াসিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

[১. সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব বিন সা’না বিন থালাবা বিন উবায়েদ বিন কাব-এর গোত্র ছিল লাভি বিন ইয়াকুবের বি.নাদির এবং পরিবার ছিল মুসা নবীর ভাই আরন বিন ইমরানের পরিবার। তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল ইহুদি প্রধান সালাম বিন মুশকামের সঙ্গে এবং পরে খাইবার ইহুদিদের নেতা কানানা বিন আবি আল-হাকিকের সঙ্গে যিনি খাইবারের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। সাফিয়া তখন একজন মুসলমান সৈন্যের হাতে বন্দী হন। তখন নবীজি তাঁকে ডেকে পাঠান। সহি আল-বুখারি এবং মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে নবীজি তাকে মুক্তি দেন এবং বিয়ে করেন। যে মুসলমান সৈন্যটি সাফিয়া এবং তাঁর চাচাত বোনকে একসঙ্গে বন্দী করেছিলেন, তিনি তাদেরকে নিয়ে অন্য ইহুদিদের মৃতদেহের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মৃতদের দেখে চাচাত বোনটি চীৎকার করে কেঁদে উঠে এবং সাফিয়ার মুখে আঘাত করে এবং মাথায় ধুলো ছিটিয়ে দেয়। এই ঘটনা জানতে পেরে মহানবী মুসলমান সৈন্যটিকে মহিলা দু’জনকে মৃতদের কাছে নিয়ে কষ্ট দেওয়ার জন্য জব্দ করেন। ইবনে হাজর তাঁর আল-ইসাবা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে খাইবারের যুদ্ধের আগের দিন রাতে সাফিয়া চাঁদকে তাঁর কোলে পড়ে যেতে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই স্বপ্নের কথা তাঁর মাকে জানালে মা তাঁর মুখে এই বলে চড় মেরেছিলেন যে তিনি আরবদের রাজাকে (অর্থাৎ মহানবীকে) বিয়ে করতে চান। সাফিয়া একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও বিদূষী মহিলা ছিলেন। ইবনে আব্দুল বার বলেছেন যে একদিন সাফিয়ার একজন ক্রীতদাসী খলিফা ওমরের কাছে এসে বলেছিলেন যে সাফিয়া এখনো ইহুদিদের কর্মবিরতি দিবস শনিবারকে পছন্দ করেন এবং ইহুদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ওমর একজন দূত পাঠিয়ে সাফিয়াকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন যে আল্লাহ তাঁকে শুক্রবার (আল-জুম্মা) দেবার পর থেকে শনিবারের প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ নেই তবে ইহুদিদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন যে তারা তাঁর রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় বলেই তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এ একথা শুনে ওমর ইহুদিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নেন। সাফিয়া তাঁর দাসী মেয়েটিকে এরকম করার কারণ জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি জবাব দিয়েছিল, “শয়তানের প্ররোচনায় আমি এটা করেছিলাম।” একথা শুনে সাফিয়া তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আশাবুল হাদিস এর ভাষ্য অনুসারে সাফিয়া মোট দশটি ধর্ম বিশ্বাসকে হস্তান্তর করেছিলেন নবীজির কাছ থেকে। গন্ডগোলের সময় খলিফা ওসমান যখন গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন তখন সাফিয়া তাঁর জন্য খাবার ও পানি সরবরাহ করতেন। তিনি ওসমানকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিদ্রোহীদের রাজী করাতেও গিয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোহী নেতা আল-আশতার আল-নখীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সাফিয়াকে থামিয়ে তাঁর খচ্চরের গায়ে আঘাত করেছিলেন। এতে তিনি তাকে বলেছিলেন, “আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না; আমাকে ফিরে যেতে দিন।” তিনি ৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।]

ইবনু ইসহাক বলেছেন যে আব্দুল্লাহ্ বিন আবু বকর বিন মুহাম্মাদ বিন আমর বিন হাযম-এর ভাষ্য অনুসারে সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব বলেছিলেন “আমি আমার বাবা এবং চাচা ইয়াসিরের অত্যন্ত প্রিয় ছিলাম। আল্লাহর দূত মদীনায় আসলে আমার বাবা ও চাচা একদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। বিকেলে ফিরে আসলে আমি তাদেরকে বিষণ্ন ও ক্লান্ত অবস্থায় ধীরে ধীরে এবং নীরবে হাঁটতে দেখেছিলাম। আমি তখন অভ্যাসবশতঃ তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখ-ভারাক্রান্ত থাকার জন্য দু’জনের মধ্যে একজনও আমাকে দেখতে পেলেন না। তখন আমার চাচা ইয়াসিরকে বলতে শুনলাম :

“তিনিই কি সেই মানুষ?” (অর্থাৎ প্রতিশ্রুত নবী)

হ্যাঁ, তিনিই সেই মানুষ” বাবা বললেন।

“তুমি কি তাঁকে চিনেছিলে এবং তুমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?”

“হ্যা” বাবা বললেন।

“তাহলে তাঁর ব্যাপারে তুমি কি করতে চাচ্ছ?”

“আমি তাঁকে আজীবন প্রতিহত করবো”

একইভাবে আব্দুল্লাহ্ বিন সালামের[১]। (একজন ইহুদী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন) বরাত দিয়ে ইবনে ইসহাক বলেছেন যে একদিন তিনি আল্লাহর নবীর কাছে গিয়ে বলেন :

“হে আল্লাহর নবী, ইহুদিরা একটা কুৎসাপরায়ন জাতি। আমি চাচ্ছি আপনি আপনার একটা কক্ষে আমাকে লুকিয়ে রাখুন এবং আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাদেরকে না জানিয়ে আমার সম্বন্ধে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। এতে তাদের মধ্যে আমার অবস্থান সম্পর্কে তারা মুক্তভাবে বলতে পারবে। কারণ আমার নতুন ধর্ম গ্রহণের কথা জানতে পারলে তারা আমার নামে কুৎসা ও অপবাদ ছড়াতে শুরু করবে।” আব্দুল্লাহ্ বিন সালাম আরো বলেছেনঃ “এজন্য নবীজি আমাকে তাঁর একটা কক্ষে লুকিয়ে রাখলেন এবং তখন ইহুদি লোকেরা তাঁর কাছে আসলো। তারা নবীজির সঙ্গে কথা বললো এবং তাঁকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো।

[১. আব্দুল্লাহ বিন সালাম বিন আল-হারিস, আবু ইউসুফ ছিলেন ইউসুফ নবীর পরিবারের লোক; তিনি ছিলেন আন-নাওয়াফলের (আল-খাযরাজ গোত্রের) একজন মিত্র, যিনি প্রথমে খ্রীষ্টান ধর্ম এবং পরে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বি. কাইনুকা গোত্রের সদস্য এবং একজন ইহুদি ধর্মবিৎ। ধর্মমত হস্তান্তরকারীদের মতে আব্দুল্লাহ বিন সালাম বলেন : “মহানবী মদীনায় আসার পর আমি যখন তাঁর মুখের দিকে তাকালাম তখন আমি হতভম্ব হয়েছিলাম, কারণ ঐ মুখ কোন মিথ্যাবাদীর মুখ হতে পারে না।” মহানবী তাঁকে ঐ দশজনের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন যারা ছিলেন ভাগ্যবান এবং পরকালে বেহেশতে প্রবেশের ব্যাপারে নিশ্চিত। যাইদ বিন উমাইরের বরাত দিয়ে আল-বুখারীর বর্ণনা অনুসারে তিনি বলেছিলেন :

মুয়াদ বিন জাবাল যখন মৃত্যু শয্যায় তখন লোকজন এসে তার পরামর্শ চেয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন : “আবি দারদা, সালমান, ইবনু মাসুদ এবং আব্দুল্লাহ্ বিন সালামের (যিনি ইহুদি ছিলেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেছেন।) সঙ্গে জ্ঞান অন্বেষণ করুন।” তিনি আরো বলেন : “আমি আল্লাহর নবীকে বলতে শুনেছি যে তিনি হচ্ছেন দশজন বেহেস্তবাসীর একজন।” গন্ডগোলের সময় আব্দুল্লাহ বিন সালাম দূরে ছিলেন। তিনি কেনো পক্ষেই যোগ দেননি (জামালের যুদ্ধেও নয় কিংবা সিফ্ফিনের যুদ্ধেও নয়।) আল-বোগাই একটি বিশ্বস্ত সূত্রে তার আল-মুজাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে আব্দুল্লাহ্ বিন সালাম খলীফা ওমরকে আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন) এই বলে ইরাক গমন থেকে বিরত করতে চেষ্টা করেছিলেন : “আপনি আল্লাহর নবীর প্রচার বেদীকে আঁকড়ে ধরে থাকুন। আপনি এটি ছেড়ে গেলে আর কখনো এটি দেখতে পারবেন না।” চতুর্থ খলিফা আলী বিন আবি তালিব তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন : “তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে একজন ধার্মিক লোক। তিনি ৪৩ হিজরীতে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।]

অতঃপর নবীজি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন : “আপনাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ্ বিন সালাম কি ধরণের লোক?” তারা বললো : তিনি আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র; তিনি আমাদের ধর্মোপদেষ্টা এবং পন্ডিত।” আব্দুল্লাহ বিন সালাম বলেন, “তাদের কথা শেষ হলে আমি তাদের সামনে বেরিয়ে আসলাম এবং বললাম :

“হে ইহুদি ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের সামনে যা এসেছে (সত্য) তা গ্রহণ কর। আমি শপথ করে বলছি তিনি আল্লাহর নবী; তোমাদের গ্রন্থ তওরাতে নাম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট সহ তাঁর বর্ণনা রয়েছে। আামি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর দূত; তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে; আমি তাঁর নবুওতের সত্যতা স্বীকার করছি।”

একথা শুনে তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে নিন্দা করতে লাগল। আমি তখন নবীজিকে বললাম, “হে আল্লাহ্ নবী, আমি কি আপনাকে বলিনি যে এরা হচ্ছে কুৎসাপরায়ন, বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী এবং দুশ্চরিত্র?”

ষড়যন্ত্র এবং সংহতিনাশক চেষ্টা

মুসলমানদের প্রতি তাদের বদ্ধমূল শত্রুতা এবং হিংসার ফলে ইহুদিরা মহানবী এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অভিযান শুরু করলো।

প্রথমদিকে অবশ্য ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের কার্যাবলী গোলযোগ সৃষ্টির ‘মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এজন্য তারা জাহিলিয়ার পুরনো শত্রুতা এবং বিবাদ গুলিকে কাজে লাগাত। এ উদ্দেশ্যে মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদিরা ভন্ডদের সঙ্গে একটা যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলে। নতুন ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে পুরনো পৌত্তলিক জীবনধারায় ফিরে যাবার জন্য তারা মুসলমানদেরকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।

ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদি ষড়যন্ত্র

শাস বিন কায়েস ছিলেন একজন গোঁড়া ইহুদি এবং নাস্তিক। মুসলমানদের তিনি প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। একদিন মহানবীর একদল আল-আউস এবং আল-খাযরাজ গোত্রের সাহাবীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি দেখলেন যে তারা ভাইয়ের মত আন্তরিক ভাবে কথা বলছেন। অতীতের তিক্ত বৈরিতার পর তাদের মধ্যে এই ভালবাসা এবং মৈত্রী ছিল ইসলামের অবদান। কিন্তু এই দৃশ্যে শাস বিন কায়েস খুব বিচলিত হয়ে বলেছিলেনঃ

“বি’ কিলার প্রধানগণ তার দেশে একত্রিত হয়েছেন। এটা হতে পারেনা। তারা এক্যবদ্ধ থাকলে তাদের মধ্যে আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবো না।” তিনি ছিলেন একজন খাঁটি ইহুদি চরিত্র এবং ষড়যন্ত্র ও প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত। মুসলমানদের সঙ্গে বসেছিল এমন একজন ইহুদি যুবককে তিনি নির্দেশ দিলেন যে সে যেন মুসলমানদের সঙ্গে থেকে সুযোগ মত বুয়াথের যুদ্ধের কথা বলে এবং যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত তাদের কবিতাগুলি আবৃতি করে তাদের মধ্যেকার পুরনো শত্রুতা জাগিয়ে তোলে। বুয়াথের যুদ্ধ ছিল আউস এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে অনুষ্টিত জাহিলিয়া যুগের সবচেয়ে ভয়ানক গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে আউস গোত্রের জয় হয়েছিল এবং খাযরাজ গোত্র পরাজিত হয়েছিল।

ইহুদি যুবকটি তার নেতার নির্দেশ মতই কাজ করলো এবং মুসলমানদের বসে থাকার সময় একদিন বুয়াথের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে ইহুদি নেতাদের কু-মতলব চরিতার্থ করতে চেষ্টা করলো। আউস এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে একটা বিপজ্জনক বিবাদ সৃষ্টির জন্য উক্ত যুদ্ধের উল্লেখটাই যথেষ্ঠ ছিল।

এই দুই গোত্রের লোকেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অতীতের কার্যকলাপ নিয়ে নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লাগালো। এই পরিস্থিতিতে খাযরাজের একজন নেতা তার প্রতিপক্ষরকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন : “ আপনারা যুদ্ধ চাইলে তার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।” (তিনি ইসলাম- পূর্ব সময়ে তাদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটার পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দিলেন।) উভয় পক্ষেই উত্তেজনা চরমে উঠলো এবং আউসরা বললেন : আমরা রাজী আছি। আমরা আয- যাহিরায় (পোড়া পর্বতমালা, আল-হারা, মদীনার বাইরে অবস্থিত) আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হব। নেতারা যুদ্ধের ডাক দিলে উভয় পক্ষেই “অস্ত্র, অস্ত্র বলে চিৎকার শুরু হলো এবং উভয় পক্ষই নির্দ্ধারিত ময়দানের দিকে অগ্রসর হলো। তাদের শত্র ইহুদি এবং ভন্ডদের ইচ্ছ অনুসারে তারা আবারো একটা গৃহযুদ্ধের দুয়ারে গিয়ে পৌঁছলো।

যাই হোক, তাদের এই যুদ্ধের সংবাদ যথাসময়েই মহানবীর কানে গিয়ে পৌঁছলো এবং তিনিও তড়িৎ পদক্ষেপ নিলেন। কয়েকজন মুহাজিরিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন ষড়যন্ত্রকারী ইহুদিদের প্ররোচনায় মুসলমানদের আসন্ন যুদ্ধের অগ্নিকে দ্রুত নিভিয়ে ফেললেন।

ঘটনাস্থলে পৌঁছেই মহানবী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ “হে মুসলমানগণ! কি! আমি আপনাদের মধ্যে থাকতেই আপনারা জাহিলিয়া যুগের মত আবার যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন? আল্লাহ্ আপনাদেরকে ইসলামের পথে এনে জাহিলিয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে মহিমান্বিত করার পরেও?” এবং তিনি অবিশ্বাস (কুফর) থেকে মুক্ত করে আপনাদের অন্তরে ভালবাসা জাগিয়ে তোলার পরেও?”

একথা শুনে আউস এবং খাযরাজ উভয় গোত্রের লোকেরাই তাদের ভুল বুঝতে পারলেন এবং বুঝলেন যে তারা তাদের শত্রুদের হাতের পুতুল। তারা এটাও বুঝতে পারলেন যে সমস্ত ব্যাপারটাই শয়তানের কারসাজি এবং এটা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ইহুদি ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। তারা ভাইয়ের মত একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন এবং নবীজির সঙ্গে মদীনায় ফিরে গেলেন। এভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের নব- প্রতিষ্ঠিত ঐক্য ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ইহুদি ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।

এর পরেও ইহুদিরা (ভন্ডদের মিত্র হিসেবে) ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে থাকে এবং মহানবীর (সঃ) জন্য নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে।

তারা মহানবী এবং তাঁর শ্রোতৃমন্ডলীকে অদ্ভূৎ অদ্ভূৎ প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে চেষ্টা করতে লাগলো। ভন্ডরা ইসলামের ভান করে মুক্তভাবে মুসলমানদের সঙ্গে মিশতে থাকে এবং যুযোগ পেলেই মুসলমান সমাজে গুজব ছড়িয়ে তাদের ঐক্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে গোলযোগ সৃষ্টি করে।

ষড়যন্ত্রের উপযোগী-স্থান

মুসলমান সমাজের ঐক্য ধ্বংস করার লক্ষ্যে ভন্ডরা একটা কেন্দ্র পর্যন্ত গড়ে তুললো যেখানে তারা মুসলমানদের এবং মহানবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য মিলিত হতো। এটা ছিল একটা মসজিদ যা তারা প্রার্থনার জন্য জাঁকজমকভাবে নির্মাণ করেছিল। সবাই তাদেরকে মুসলমানদের একটা অংশ ভাবতো বলে কেউ তাদের আলাদা মসজিদ নির্মাণের বিরোধিতা করেনি।

মসজিদটি নির্মিত হওয়ার পরপরই মহানবী জানতে পারলেন যে ভন্ডরা কু-মতলবের কেন্দ্র হিসাবে ওটাকে ব্যবহার করছে। মহানবী তখন মুসলমান ও ইসলামের শত্রুদের আস্তানা হিসাবে ব্যবহৃত এই মসজিদটিকে ধ্বংস করার নির্দেশ জারী করলেন। যারা এই মসজিদটি তৈরি করেছিল সেই ভন্ডদের ব্যাপারে আল্লাহ নিম্নোক্ত ওহী নাযেল করেনঃ

আর যারা বিরোধিতা এবং অবিশ্বাসের মনোভাব নিয়ে একটা উপাসনালয় নির্বাচন করেছে, যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভেদ ছড়াতে চায় এবং যারা ইতিপূর্বে আল্লাহ্ এবং তাঁর নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারা

নিশ্চয়ই বলবেঃ “আমরা ভাল ছাড়া অন্যকিছু চাইনি। আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তারা সত্যি মিথ্যাবাদী।”[১]

তাদের হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে টুকরো টুকরো না হওয়া পর্যন্ত এই দালান অন্তরে সব সময় ভয়ের কারণ হয়ে থাকবে। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ এবং সব জানেন।”[২]

[১. আল কুরআন, ৯ : ১০৭

২. আল কুরআন, ৯: ১১১]

নবীজির মসজিদ থেকে ভন্ডরা বিতাড়িত

নবীজির নির্দেশে ভন্ডদের মিলন-কেন্দ্র (মসজিদ আল-দিরার) ভেঙ্গে দেওয়ার পরেও তাদের ইসলাম-বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। তারা মুসলমানদের উপহাস করতে থাকে এবং তাদের জন্য নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে।

“তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তাদের ঈর্ষাপূর্ণ দুরভিসন্ধিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এমনকি নবীজির মসজিদও তাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল না। তারা সেখানে এমনভাবে বসে তাদের কুকর্ম চালাতো যে মুসলমানদের জন্য সেখানে শান্তিতে জামাতের নামায পড়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।এমন অবস্থায় মহানবী তাদের জনসমক্ষে অপমান করে তাঁর মসজিদ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হলেন। তাদেরকে সংশোধন করার জন্য এবং তারা যাতে অন্যান্য সাধারণ মানুষকে (যাদের সঙ্গে তারা মসজিদের অভ্যন্তরে দৈনিক পাঁচবার মুক্তভাবে মিশত) কলুষিত করতে না পারে সেজন্যই মহনবী এই ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইবনু ইসহাক লিখেছেনঃ”এই ভন্ডগুলি মসজিদে আসত,মুসলমানদের কথা শুনতে এবং তারপর তাঁদের ধর্মবিশ্বাসকে উপহাস করত। একদিন নবীজি তাদেরকে মসজিদের ভিতর একসঙ্গে বসে নীচুস্বরে আলাপ করতে দেখলেন। তখনই নবীজির নির্দেশে তাদেরকে অপমান করে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হলো।”

মোট কথা, ইহুদি এবং ভন্ডরা মহানবীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি অব্যাহত রাখে এবং ইসলামের নতুন সংগঠনকে শুরুতেই বিনষ্ট করতে চেষ্টা করে কিন্তু আল্লাহ্ সব সময়ই তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেন। নবীজি এবং মুসলমানদের জন্য তারা একটা বড় সমস্যা হলেও, ইসলামের এই শত্রুরা সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে মুসলমানরা তাদের গতিবিধি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান এবং বিশেষকরে সামরিক ও রাজনৈতিক কোন ব্যাপারে তাদেরকে তাঁরা কখনো বিশ্বাস করেননি, কারণ তাঁরা জানতেন যে এরা ছিল আসলে ইসলামের শত্রুদের দ্বারা ব্যবহৃত দালাল বা গুপ্তচর।

নতুন মুসলমাদের জন্য এটি ছিল একটা অত্যন্ত ক্রান্তিকাল এবং তাদের জন্য ছিল চারদিক থেকেই বিপদ। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈরিতায় সমগ্র আরব ভূখন্ড তখন ফেটে পড়ছিল। কুরাইশরা তাদেরকে এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কারণ ইসলাম এবং ইসলামের নবীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কারণে বিরোধীরা বুঝতে পেরেছিল যে ইসলাম তাদের বহুদিনের পৌত্তলিক জীবনধারা সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করে দিতে চায়। স্বাভাবিক ভাবেই তারা ইসলাম এবং ইসলামের নবীর ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হয়।

মুসলমানদের জন্য এটি ছিল প্রকৃত পক্ষেই একটা সংকটময় অবস্থা। এতদসত্বেও মহানবী ইহুদি এবং তাদের ভন্ড মিত্রদের (ইসলামের সংগঠনে যাদের উপস্থিতি ছিল একটা সমস্যা সৃষ্টিকারী দুষ্ট ক্ষত) বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। মহানবী তাদেরকে উপেক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামের জোয়ারে ভেসে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের বৈরী কার্যকলাপের প্রতি চোখ বুজে থাকেন। ইহুদিরা এমন বিশ্বসাঘাতক হয়ে পড়ে যে তারা সমস্ত চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার ও সংকটময় মূহূর্তে তারা মুসলমানদের শত্রুদের পক্ষ অবলম্বন করে। এভাবে বি. কুরাইজারা তাদের জাতীয় কর্তব্য ভুলে এবং আল-আহযাবের যুদ্ধ অবরুদ্ধ মদীনার মুসলমানদের প্রতি তাদের ওয়াদা উপেক্ষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মহানবী তাদের সবাইকে হত্যা করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাদের স্ত্রী-পুত্রদের কে দাসত্বে বরণ করার নির্দেশ দেন। আমরা আমাদের পরবর্তী বই আল-আহযাবের যুদ্ধ -তে এ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *