তৃতীয় অধ্যায় – মধ্যবর্তী পুলিশ
ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাস একটি দুঃখজনক ইতিহাস। সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তীকালে শের’শা বাদশা আকবর ছত্রপতি শিবাজী জন্মগ্রহণ না কবলে অবস্থা আরও শোচনীয় হতো। ভারতের মধ্যযুগীয় সংগঠন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য আজও সংগৃহীত হয় নি। এ-বিষয়ে বরং বাংলার পুলিশী সংস্থা সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। মৌর্য রাজাদের ও গুপ্ত রাজাদের পতনের পর ভারতের অন্ধকার যুগ শুরু হয়।
পরবর্তীকালে প্রাচীন ভারতের পুলিশী সংস্থা ও বিচারের কার্যাদির কিছুটা অদল-বদল হয়েছিল। সেই সময় শক-তূণ প্রভৃতি বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ভারতীয় শাসকদের ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। সেজন্য প্রশাসনিক বিষয়ের মতো সাংস্কৃতিক বিষয়েও অধোগতি দেখা যায়। গুপ্ত-সম্রাটরা এবং অন্য কয়েকজন ভারতের পূর্ব-গৌরব সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করলেও তাঁদের সাম্রাজ্যও পরবর্তীকালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতীয়দের প্রধান দোষ এই যে বহিঃশত্রুকে পরাজিত করার পর তাদের পশ্চাদধাবন করে নিজ-দেশের পুনরাক্রমণের ঘাঁটিগুলি বিধ্বস্ত না-করা। সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে তারা নিজবলে লড়লেও কখনও সমবেতভাবে তাদেরকে রোখার চিন্তা করেন নি।
[শক-হূণদের বিতাডনে ভারতীয় নৃপতিরা পূর্বাকালে একবার মাত্র একত্রিত হয়েছিল। পরবর্তী নৃপতিরা পূর্বপুরুষদের এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন নি। মৌর্য-সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মতো মধ্যে-মধ্যে সীমান্তের ওপরে পররাজ্যগুলি [ভীতি প্রদর্শনার্থে] তাঁরা আক্রমণ করতেন না। এটিও ভারতীয় নৃপতিদের পতনের অন্যতম কারণ ছিল।]
বড়ো-বড়ো সাম্রাজ্যের পতন হওয়ায় বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব হতো না। ছোট ছোট রাজ্যের পক্ষে বিরাট বাহিনী পোষণ ও ব্যয়বহুল আধুনিক অস্ত্র রক্ষণ ও সম্ভব হতো না। সর্বোপরি এ-সম্পর্কে মানসিক ও অন্যান্য প্রস্তুতিরও অভাব ছিল। অহিংসবাদ, অতি-ধর্মাচরণ এবং ন্যায়বোধও এজন্য দায়ী কিনা তা-ও এ-বিষয়ে বিবেচ্য।
সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভাব হিন্দু-নৃপতিরা সংযত করতো। মুসলমানদের আক্রমণে হিন্দু-নৃপতিদের পতনে সমাজ অত্যন্ত ব্রাহ্মণ-নির্ভর হয়। এই পরিণতি ভারতীয় সমাজের পক্ষে শুভ হয় নি। যে কোনো কারণেই হোক, ব্রাহ্মণদের উপর আরঙজেব পর্যন্ত জিজিয়া-কর আরোপ করেন নি। ‘দিল্লিশ্বরো-বা জগদীশ্বরো-বা’ মন্ত্রটি সেকালে ব্রাহ্মণরাই সৃষ্টি করেছিল। তবে ব্রাহ্মণদেরই এক অংশ এই দুর্বিপাক থেকে ভারতকে রক্ষা করেছিল। শিবাজীর গুরু ও মন্ত্রীরা এবং পেশোয়াররা ও ব্রাহ্মণ ছিলেন। [ব্রাহ্মণদের সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ করার অর্থ বুঝা যায় না।]
বিদেশী শাসনের প্রথমদিকে কেবল ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতি ধ্বংস অব্যাহত থাকে। কিন্তু সেই দুর্যোগে সামন্ত হিন্দু-বাজাবা তাদের পুলিশ ও সেনাদলের সাহায্যে প্ৰজাদের জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষা করেছিলেন। এইজন্য সাধারণ প্রজাবা কোনোদিনই বিদেশী শাসকদের স্বীকার করেন নি। বাজা বলতে তাবা স্ব স্ব স্থানীয় উপরাজাদেরই জানতো ও বুঝতো।
ব্রিটিশদের অধিকারের প্রথম দিকেও তাদের মনোবৃত্তি এই-রকম থাকায় চতুর ব্রিটিশ তাদের তোয়াজ করে তাদেরই মাধ্যমে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করতেন। এজন্য তাঁরা এই দেশীয় রাজাদের সকলকে এবং অধিকাংশ জমিনদারদের স্ব-স্ব পদে অধিষ্ঠিত রেখেছিলেন।
পাঠান-শাসকরা দিল্লি প্রভৃতি রাজধানীগুলিতে ঘাঁটি স্থাপন করলেও স্বাধীন ও অর্ধ-স্বাধীন রাজাদের বা জমিনদারদের আভ্যন্তরীণ শাসন, বিচার ও পুলিশী কাজে হস্তক্ষেপ করেন নি। এই বিশাল দেশে ও-রকম কোনও কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাবা আত্মরক্ষার্থে এজন্য বড়ো-বড়ো দুর্গনগরী তৈরি করেছিলেন। খাজনা কিংবা কব বা উপঢৌকন না-পাঠালে এঁরা মধ্যে-মধ্যে দুর্গগুলি হতে অভিযান পাঠাতেন। ওই-সব দুর্গগুলিতে সেজন্য সর্বদা সুসজ্জিত বেতনভুক বিদেশী সৈন্যদলকে রক্ষা করা হতো।
পাঠান-শাসকরা তাদের রাজধানীতে এবং সেনানিবাসগুলিতে সেনাবাহিনীর দ্বারা শান্তিরক্ষা করতেন। সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ভূভাগে শাসন, বিচার ও পুলিশী কাজ হিন্দু-উপরাজারা পূর্বের মতো সমাধা করতেন। এই সকল উপরাজারা বহুগুণে উন্নত পূর্বতন পুলিশী-ব্যবস্থা উত্তরাধিকারী-সূত্রে পেয়েছিলেন।
পাঠানরা মোগলদের মতো ভারতীয় পুলিশ প্রথা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। একমাত্র সম্রাট আলাউদ্দীন তাঁর রাজধানী ও সেনানিবাস সমূহে তৎকালীন ভারতে মৌর্য রাজাদের অনুকরণে প্রথম আরোপক সংস্থা তথা এনফোর্সমেন্ট বিভাগ স্থাপন করেছিলেন।
বহু পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলিকাতায় ব্রিটিশরা সম-অর্থে এনফোর্সমেন্ট-পুলিশ স্থাপন করেছিলেন। তৎকালে দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্য হলে ওইগুলির জন্য নূতন প্রণীত নিয়ন্ত্রিত আইন আরোপণের জন্য পুলিশেতে ওই নূতন বিভাগ সৃষ্ট হয়েছিল। আজও পর্যন্ত এই আরোপক বিভাগ এদেশের পুলিশেতে আছে।
সম্রাট অশোক [প্রিয়দর্শী অশোক] বাজার-সমূহের নিয়ন্ত্রণে প্রথম আরোপ-সংস্থা তৈরি করেন। সম্ভবত গুপ্ত-সম্রাটরাও তার অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দীন খিলিজী [১২১৬-১৩১৬] মধ্যযুগীয় ভারতে ওঁদের মতো প্রথম আরোপক-সংস্থা তথা এনফোর্সমেন্ট-পুলিশের স্রষ্টা। বাজারের লেনদেন ও দর-নিয়ন্ত্রণে শাহান-ই-মুণ্ডি [শাহান=তত্ত্বাবধায়ক। মুণ্ডি=বাজার] নামে এক রাজ কর্মচারীর অধীনে ওই আরোপক-সংস্থা ছিল। ক্রেতাকে ঠকালে কিংবা সপ্তাহে একদিন বাজার বন্ধ না-রাখলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। ওজনে কম দিলে ব্যাপারীর দেহ হতে সমপরিমাণ মাংস কেটে নেওয়া হতো। শাহান-ই-মুণ্ডির কাছারি বাজারগুলির মধ্যে এক স্থানে থাকতো। ছুটির দিন তথা সাপ্তাহিক বন্ধের দিন সেটি হরতাল রঙে রঞ্জিত করা হতো। তাই আজও বাজার বন্ধ করা হলে তাকে ‘হরতাল’ বলা হয়। এ থেকেই বর্তমান কালের রাজনৈতিক হরতালের সৃষ্টি। ছাড়পত্র তথা পারমিট ব্যতীত ব্যাপারীদের কৃষকদের নিকট হতে শস্য ক্রয় করা নিষিদ্ধ ছিল। মজুত বিরোধী আইনে ধনী ব্যক্তি ও ওমরাহরাও অধিক দ্রব্য বাজার হতে কিনতে পারতেন না। [বি. দ্র.] বিদেশী আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের শক্তিশালী স্ব স্ব সাম্রাজ্যগুলি ভেঙে পড়েছিল। কেন্দ্র শক্তিহীন ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন প্রধান’ পারস্পরিক কলহরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূঁইয়ার রাজ্যে সমগ্র ভারত বিভক্ত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো ওদের ভৌগোলিক সুবিধা নেই। ওরা অনেকে বেতনভুক বিরাট সেনাবাহিনী পোষণে অক্ষম। পূর্বের মতো উন্নত অস্ত্র আবিষ্কার ও রক্ষণের এবং সৈন্যদের প্রশিক্ষণের ও রসদ সরবরাহের মতো সক্ষম কোনও কেন্দ্রীয় শক্তি তখন ভারতের ছিল না। ফলে ভাবতের এখানে-ওখানে বহু ভূমি বিদেশী কবলিত হয়েছিল। ভূঁইয়া উপরাজাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ভারতে কোথাও হলো না। বরং বিদেশীদের তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে স্বাধীন কিংবা অর্ধস্বাধীন রইলো। এতে স্বভাবতই ভারতে সংস্কৃতি-রক্ষার ভার গ্রামীণ ভূ ইয়ার উপরাজাদের উপরই পড়লো। এই দায়িত্ব তাঁরা উত্তমরূপেই পালন করেছিলেন। [এঁদেরকে এখন সামন্ততান্ত্রিক তথা বুর্জোয়া বলা নিরর্থক।] আভ্যন্তরীণ পুলিশ এবং বিচার ও শাসন-ব্যবস্থায় এঁরা বিদেশীদের হস্তক্ষেপ করতে দেন নি। বার্ষিক কর দেওয়ার অতিরিক্ত বিদেশীরা দাবী করলে তাঁরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই রাজ-করও তারা সকল সময় তাদেরকে দিতেন না।
বাংলাদেশে রাজা গণেশের নেতৃত্বে বাঙালী ভূঁইয়ারা পাঠানদের প্রথমে হঠায়। সম্ভবত সেই সাহসে বলীয়ান হয়ে ভারতের অন্যত্রও ভূঁইয়া-রাজারা বিদ্রোহ করে পাঠানদের পর্যুদস্ত করে। এইভাবে বহু স্থান তারা পুনরায় সম্পূর্ণ স্বাধীনও করেছিল। পাঠানদের এই বিপাকের সুযোগে মোগলরা এদেশ আক্রমণ করে দিল্লি অধিকার করে সাম্রাজ্য বিস্তার করলো।
প্রথমদিকে বাঙালী ভূঁইয়ারা গৌড়ের দুর্বল পাঠান শক্তির সঙ্গে একযোগে মোগলদের সার্থকভাবে প্রতিরোধ করেছিল। বাঙালী ভূঁইয়ারা [পাঠানদের শেষ অবস্থায়] তখন কার্যত স্বাধীন। গৌড়ে কোনও বিদেশী-শক্তি রাখা না-রাখা তখন তাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন। তবে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি থাকায় তাঁরা কাউকে নৃপতি-পদে মনোনয়নে অক্ষম ছিলেন। অবশ্য তারা নতুন বিদেশী মোগলদের বিরুদ্ধে প্রথম দিকে একতাবদ্ধ হয়েছিলেন।
উপরোক্ত কারণে মোগল সম্রাট বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে পাঠানদের বদলে বাঙালীদের উপর ক্রোধ প্রকাশ করে লিখেছিলেন: ‘আমি বাঙালীদের দেখে নেবো। তাদের আমি উচিত-শিক্ষা দেবো।’ মোগলদের পক্ষে নদীবহুল বাংলার কর্দমাক্ত পথ-ঘাট ও জলা-জমিতে যুদ্ধ করা কঠিন ছিল। বাবর তাঁর পুস্তকে রাজপুতদের তাচ্ছিল্য করলেও এ-কথা স্বীকার করেছিলেন যে বাঙালীরা ভালোই যুদ্ধ করে। [এই সময় বাংলাদেশে একজন মাত্র হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত মুসলিম ভূঁইয়ার ছিল। অন্য দিকে—বিহারে জন্ম সূত্রে বাঙালী বা বেহারী শেরশা নামে অন্য এক ভূ ইয়ারও ছিল। তবে এঁর পিতা জনৈক বিদেশাগত পাঠান ছিলেন।]
এই কালে উভয়-সম্প্রদায়ের উপরাজারা পরস্পর-বিদ্বেষী হওয়ার কারণ দেখেন নি। ধর্মে ভিন্ন হলেও তাঁরা জাতিতে নিজেদের হিন্দু ভাবতেন। তখনও তাঁরা হিন্দু-জাতিরই একটি উপজাতি বাঙালী ছিলেন।
সেইকালে মোগল কর্তৃক অন্য পাঠানদের আগমন-পথ সম্পূর্ণ বন্ধ। তাঁরা স্বদেশের পাঠানদের সঙ্গে কোনও বিশেষ সম্পর্ক না-রেখে বঙ্গবাসী হয়েছিলেন। সেজন্য পাঠান-সুলতানদের পক্ষে বাঙালী ভূঁইয়াদের সাহায্য অপরিহার্য ছিল। তৎকালে বঙ্গদেশ বলতে বঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড বোঝাতো।
[বি. দ্র.] শেরশাহের পিতা ভাগ্যান্বেষী বিদেশী পাঠান হলেও শেরশাহ নিজে বাঙালী ভাবাপন্ন ছিলেন। এঁরা বিহারের একজন ভূঁইয়ার উপরাজা ছিলেন। ওইকালে বিহারের মগধী ও মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার পার্থক্য ছিল সামান্য। তৎকালে মগধ-গৌড়ের সংস্কৃতিও ছিল অভিন্ন। শেরশাহকে নিজেদের নেতারূপে গ্রহণ করে বৃহৎ বাংলার ভূঁইয়া-রাজারা গৌড়ের অকর্মণ্য সুলতানদের হটিয়ে গৌড় দখল করতে সাহায্য করেছিলেন। এই গৌড়-মহানগরী হতে বেরিয়ে শেরশাহ হুমায়ুনকে বিতাড়িত করে দিল্লী অধিকার করেছিলেন। চিরাচরিত প্রথামত বাঙালী ভূইয়ারা তাঁকে সৈন্যদল-সহ সাহায্য করে থাকবেন। কারণ হুমায়ুনকে বিতাড়িত করার মতো পর্যাপ্ত পাঠান-সৈন্য বিহার ও বাংলায় নিশ্চয় ছিল না। তাদের সংখ্যা তখন পূর্বভারতে স্বভাবতই অতি নগণ্য। এই থেকে তৎকালীন বৃহৎ বঙ্গের সামন্তদের শক্তিমত্তা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।
[লৌহ-আকর পর্যাপ্ত থাকায় পূর্বভারতের এই ভূভাগে অস্ত্রশস্ত্র তৈরির সুবিধা ছিল। এজন্য পূর্বভারতেই মোর্য ও পাল সাম্রাজের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির উত্থান হয়েছিল। বিদেশী আক্রমণ রুখতে ব্যস্ত থাকতে না-হলে এদেশে য়ুরোপের পূর্বে শিল্প-বিপ্লব শুরু হতো। এ-কারণে সর্ববিষয়ে প্রারম্ভ চমৎকারভাবে হলেও তা সম্পূর্ণ হতে পারে নি। ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সম্পর্কেও তা সমভাবে প্রযোজ্য।]
[এখানে উল্লেখ্য এই-যে বাবর বিহার দখল করলেও বঙ্গদেশ অধিকার করতে পারে নি। প্রতিরোধে দৃঢ়শক্তি বাঙালীদের উপর বিষোদ্গার করে তাঁকে বিহার হতে ফিরে যেতে হয়েছিল।]
শেরশাহের মৃত্যু হলে হুমায়ুন ফিরে এসে বাংলাদেশ বাদে উত্তর ভারতের অন্যত্র আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পুত্র সম্রাট আকবর ভারতের বহু প্রদেশ জয় করলেও বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন নি। জাহাঙ্গীরের পক্ষেও বাংলার ভূঁইয়া-রাজাদের সম্পূর্ণ বশীভূত করা সম্ভব হয় নি। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই-যে সাজাহান সর্বপ্রথম বাংলার ভূঁইয়া-রাজাদের নিকট নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। সমস্যাসংকুল বাংলাদেশে-তৎকালেও মোগল সুবাদাররা বহাল হতে প্রায়ই অনিচ্ছুক হয়েছেন। বলা বাহুল্য নাতি-উষ্ণ বাংলাদেশ তখন নিশ্চয় স্বাস্থ্যপ্রদই ছিল।
সম্রাট আকবর দিল্লিতে একটি সুগঠিত পুলিশ সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। রাজা টোডরমল শাসনের ও রাজস্ব-ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করায় ওই দুটির মধ্যে প্রাচীন ভারতের রীতি-নীতির বহু সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
[শেরশাহের সময়েও বাংলার ভূঁইয়া-রাজারা পূর্ব কালের মতো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে ও অপহৃত দ্রব্য উদ্ধার করতে না-পারলে অভিযোগকারীদের ক্ষতিপূরণ করে দিতেন। অর্ধেক সম্পত্তি উদ্ধার করে বাকিটা উদ্ধার করা সম্ভব না-হলে তাঁরা স্বেচ্ছায় তার ক্ষতিপূরণ করতেন।]
শেরশাহ উত্তর ভারতের সম্রাট হলে তিনি প্রাচীন বাংলার পুলিশের ওই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারতের অন্যত্র স্থানীয় জায়গীরদারদের ও সামন্ত রাজাদের পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পাঠানরা বিদায় নিলে তাদের স্থলে মোগলরা দিল্লিতে এসে ঘাঁটি করলো। ওই দিল্লিকে কেন্দ্র করেই তারা ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। কিন্তু সমগ্র দেশের প্রশাসন ব্যাপারে তারা পাঠানদের মতো হিন্দু সামন্তদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। পাঠানদের কোনও সুগঠিত পুলিশ ছিল না। তাঁরা তাঁদের রাজধানীতে ও ফৌজা ঘাঁটিগুলিতে সৈন্য দ্বারা শাস্তি রক্ষা করতেন।
সর্বপ্রথম সম্রাট আকবর তাঁর মন্ত্রী টোডর মলের সাহায্যে ভারতের প্রাচীন পুলিশের অনুকরণে প্রাচীর বেষ্টিত দিল্লীনগরীর মধ্যে একপ্রকার পুলিশী সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পাঠানদের মতো মোগলরাও অন্যত্র সামন্ত রাজাদের বিচার পুলিশ ও শাসন-ব্যবস্থার একটুকুও হস্তক্ষেপ করেন নি। তৎকালীন দিল্লির পুলিশকেই মোগল-পুলিশ বলা হয়।
মোগল পুলিশ
সুগঠিত মোগল-পুলিশ ব্যবস্থা কেবল রাজধানী দিল্লি নগরীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেনানিবাসগুলিতে এবং উল্লেখ্য ঘাঁটিগুলিতে ফৌজদারদের অধীনে ফৌজী-পুলিশ ছিল। সেখানে মূলত সেনাবাহিনী দ্বারাই শান্তি রক্ষা করা হতে। জায়গীরদারগণ এবং উপরাজগণ স্ব স্ব জমিদারীতে ও রাজ্যে নিজস্ব পুলিশ, শাসন ও বিচার-ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।
মোগলরা ভারতের জায়গীরদারদের অধীনে গ্রামীণ পুলিশ সম্বন্ধে সম্পর্কহীন হলেও রাজধানীতে তাদের সুগঠিত নগর পুলিশ ছিল। সম্ভবত সংস্কৃত-সুপণ্ডিত ও শাস্ত্রবিদ্ আকবরের মন্ত্রী রাজা টোডরমল রাজস্ব-ব্যবস্থার সঙ্গে তার আরও উন্নতি করেন। এজন্য প্রাচীন ভারতের নগর-পুলিশের প্রভাব ও কার্যাদি তাতে সুস্পষ্ট। রাজস্ব-আদায়ের সঙ্গে ওই যুগে পুলিশের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ ছিল। পূর্বে কলিকাতা-পুলিশও ওই দু-কাজ একসঙ্গে করতো। আরব ও মিশর দেশের রক্ষীদের সঙ্গে মোগলদের দিল্লী-পুলিশের মিল কম। সেখানে ওইকালে কোনও প্রকার সুগঠিত পৃথক পুলিশ-দল ছিল না।
প্রাচীন ভারতের পুলিশের মতো মোগল-পুলিশও জনগণের আয়-ব্যয়ের উপর নজর রাখতো। তারা শহরে নবাগত ব্যক্তিদের এবং কৃত্রিম বাটখারা, দাঁড়িপাল্লা ও ওজনাদির সংবাদ নিতো। তবে প্রাচীন ভারতের মতো অপরাধ-নির্ণয়ের জন্য তাদের বেতনভুক সুগঠিত গোয়েন্দা তথা গুপ্তচর-বিভাগ ছিল না। তাহলেও পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তারা স্থানীয় প্রাচীনকালীন হিন্দু খোঁজী-সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করতো। এই বিষয়েও উভয় পুলিশের মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। [ভারতীয় খোঁজী-সম্প্রদায় সম্বন্ধে পরে বলা হবে।]
সিরিয়া ও মিশরে অবশ্য প্রাচীনকালে মামুলী চর-নিয়োগ প্রথা ছিল। [BOGHAZ Kol এবং Tel-el amavna শিলালিপি দ্র.] কিন্তু এদেরকে ঠিক পুলিশ-পর্যায়ভুক্ত করা যায় না।
মোগল আমলে দিল্লির পুলিশ-সংগঠন একজন কোতোয়ালের অধীন ছিল। দোষী ব্যক্তিদের তিনি গ্রেপ্তার করে হাজতে রাখতেন। তিনিই তাদের বিচারের জন্য কাজীর নিকট আনতেন। বিচাবে যা দণ্ড হতো তা কার্যকর করার ভারও তাঁর উপর। এ ছাড়া তাঁকে সরকারী প্রচারকের কাজও করতে হতো। শহরের মাঝখানে একটি চবুতরা তথা প্ল্যাটফর্ম স্থাপিত ছিল। এই চবুতরায় বাদশাহের ফরমান ও হুকুমত আদি সাধারণের জ্ঞাপনার্থে টাঙানো থাকতো। বিদ্রোহীদের ছিন্নমুণ্ডও এখানে প্রদর্শনীরূপে রক্ষিত হতো।
কোতোয়ালকে আকবরের হুকুম মতো করণিকদের সাহায্যে একটি নথি তৈরি করতে হতো। তাতে দিল্লি শহরের বাড়িগুলির সংখ্যা ও তার বাসিন্দাদের সংখ্যা, নামধাম ও পেশা প্রাচীন ভারতীয় রক্ষীদের মতো লিপিবদ্ধ করতে হতো। শহরের বাজারী, সৈন্য, শিল্পী ও দরবেশদের হিসাবও তাদের রাখতে হতো।
[এই পদ্ধতিকে বর্তমান পুলিশদের ডায়েরি তথা স্মারক-লিপি লেখা এবং বিবিধ নথিপত্র তথা রেজিস্টার রক্ষার সঙ্গে তুলনা করা চলে।]
এই কোতোয়াল সমগ্র দিল্লি শহরকে কয়েকটি মহল্লায় ভাগ করতেন। প্রত্যেক মহল্লার অধিবাসীদের মধ্য হতে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে মহল্লা-সর্দার নিযুক্ত করে তার উপর ওই মহল্লা-সম্পর্কে কিছু কর্তব্যের ভার অর্পিত হতো। কোতোয়াল নিযুক্ত স্থানীয় গুপ্তচররা দিনে বা রাত্রে সংঘটিত উল্লেখ্য ঘটনা নথিভুক্ত করতো। নবাগত ব্যক্তি ও অতিথিরা তাঁদের আগমন বার্তা জানাতে বাধ্য হতেন। কোতোয়াল-নিযুক্ত ব্যক্তিরা মহল্লার হালালখোর তথা স্ক্যাভেনজারদের নিকট হতে অপরাধসম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ করতো। [মৌর্য পুলিশের সহিত উহার সাদৃশ্য সুস্পষ্ট]
[অধুনা কলিকাতা নগরের মুসলিম-বস্তিগুলিতেও প্রতি মহল্লায় উপরোক্ত ঐতিহ্য-মতো গভর্নমেন্টের সঙ্গে সংশ্রবহীন স্বতঃস্ফূর্ত-নির্বাচিত মহল্লা-সর্দার আছে। এইসব মহল্লা-সর্দারদের মুসলিম জনগণের উপর প্রচুর প্রভাব রয়েছে। কলিকাতা-পুলিশ প্রায়ই তদন্ত ও অন্য কাজে এদের সাহায্য নেন এবং তা পান। এই জনগণ সকলেই বহির্বাংলা হতে আগত মুসলিম।]
কিন্তু অপরাধ-নির্ণয় ও অপহৃত দ্রব্য উদ্ধারে প্রাচীন বংশগত হিন্দু খোঁজী-সম্প্রদায়ের উপর মোগলরা নির্ভরশীল ছিল [স্যার যদুনাথের প্রবন্ধ দ্র.]। মৌর্যদের ভ্রাম্যমাণ-গুপ্তচরদের বংশধররূপে এরা নিজেদের দাবী করে। গুরুগাঁও-এর ইংরাজ-ম্যাজিস্ট্রেট লরেন্স সাহেব [ব্রিটিশদের সময়ে] বহু দুরূহ মামলা এদের সাহায্যে কিনারা করেছিলেন [‘লাইফ জন লরেন্স’ প্র.]। বড় বড় দাঙ্গা-হাঙ্গামা দমন ও শাস্তি-রক্ষার কাজ মোগল-যুগে শহরে সশস্ত্র সৈন্যরা করতো।
মোগল-চবুতরার পথ দিয়ে কসাইবা বাজারে গেলে কিছু মাংস সেখানে ভেট দিতে হতো। ১৬৮০ খ্রী. এই প্রথা বে-আইনী আওয়াব সাব্যস্ত হওয়ায় রহিত হয়। পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের এক থানায় মৎস্য দপ্তরী নেওয়ার জন্য থানাদার দণ্ডিত হন। কোতোয়ালী চবুতবায় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতেরও ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু প্রাচীন ভারতে প্রকাশে অপরাধীকে বেত্রাঘাত কিংবা কারো ছিন্নমুণ্ড প্রদর্শন-করা নিষিদ্ধ ছিল। যা-কিছু দণ্ড তা কারাগারের মধ্যে নিরালা মশানে তথা বধ্যভূমিতে সমাধা হতো। ‘উনি দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা’ বাংলার এই প্রাচীন প্রবাদ-বচনে অন্য দণ্ডের সঙ্গে মুণ্ডচ্ছেদও বোঝানো হয়েছে।
[বি দ্র.] ভারতীয় কোটাল-পদ হতেই সম্ভবত কোতোয়াল-পদটির উৎপত্তি। প্রাচীন কাহিনীতে কোটাল-পুত্র মন্ত্রী-পুত্র রাজ-পুত্রের নাম একসঙ্গে উল্লিখিত। কোটাল যে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি তা ইহা প্রমাণ করে। মোগল-পুলিশের উপর প্রাচীন ভারতীয় রক্ষী-সংগঠনের প্রভাব সুস্পষ্ট। রাজা টোডরমল দিল্লির নগর-পুলিশের উন্নতি করেন। কারণ রাজস্ব-ব্যবস্থার সঙ্গে পুলিশ-সংগঠনের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ। দিল্লি নগরের কোতোয়ালরা দাঁড়ি-পাল্লা-বাটখারা ওজনাদি পরীক্ষা করতেন। তাঁরা পণ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্ব গতিও রোধ করতেন। কিন্তু এই কাজ পরে মুস্তফি নামে কর্মীদের উপর ন্যস্ত হয়। এই মুস্তাফিদের উপর মুসলিম ধর্ম-বিরোধী কাজু নিবারণের ও ভার ছিল।
[অশোক ও অন্যান্য মৌর্য-সম্রাটদের নগর-রক্ষীরাও ওজন বাটখারা ও দাঁড়িপাল্লা সম্বন্ধে সতর্ক থাকতেন। তদুপরি তাঁরা নাগরিকদের নৈতিক মান অক্ষুণ্ণ রাখতেও সচেষ্ট ছিলেন। তবে ধর্মমতগুলি সম্বন্ধে উদার-নীতি থাকায় তাঁরা তাতে হস্তক্ষেপ করেন নি। তাঁরাও মোগলদের মতো নাগরিকদের আয়-ব্যয়ের উপর লক্ষ্য রেখে ছেন। তাছাড়া,বেশ্যাপল্লী গুলিতে ও সেনানিবাসে তাদের পৃথক পৃথক পুলিশ ছিল।] [বি. দ্র.] মোগল অধিকারের পূর্বে পাঠান-সম্রাট শেরশাহ ভারতের কয়েক স্থানে গ্রামীণ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। অপরাধ-নিরোধ এবং অপরাধ নির্ণয়ে ব্যর্থ গ্রাম-প্রধানকে তিনি দণ্ডের ব্যবস্থা করেন। তবে এই ব্যবস্থা সাময়িকভাবে দিল্লির চতুষ্পার্শের গ্রামগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি বাংলাদেশের প্রথা মতো ভারতের অন্যত্রও চুরির ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা জমিদার-শাসকদের উপর আরোপ করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা ওই সব স্থানে মাত্র সাময়িকভাবে প্রতিপালিত হয়েছিল। শেরশাহ সুবা-বাংলার [বঙ্গ, বিহার ও ছোটনাগপুর] সুসংগঠিত জমিনদারী পুলিশ-ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হন নি।
শেরশাহ বাংলার রাজধানী গৌড় মহানগরী হতে যাত্রা করে হুমায়ুনকে ভারত হতে বিতাড়িত করেন। প্রচলিত প্রথা মতো বাঙালী ভূঁইয়া-রাজারা স্বসৈন্যে নিশ্চয়ই ওই যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। বাংলার ভূঁইয়ারা রাজা গণেশকে সাহায্য করার মতো গৌড়ের সুলতানকে বিতাড়িত করে শহর দখল করার ব্যাপারে তাঁকেও সাহায্য করেছিলেন। কারণ ওই সময় ভূঁইয়া রাজাদের নিকট গৌড়ের তৎকালীন সুলতান কয়েকটি কারণে বিরাগভাজন হয়েছিলেন।]
বর্তমান ভারতের পুলিশ-সংগঠনে প্রাচীন ভারতের প্রশাসন-সংক্রান্ত প্রভাব কতটুকু তা ইতিহাসের গবেষক-ছাত্রদের গবেষণার বিষয়। তবে এই-যে পরবর্তী কালের বাংলার জমিদারী-পুলিশের প্রভাব তাদের উপর সুস্পষ্ট ছিল।
বাংলার প্রশাসন, বিচারকার্য এবং পুলিশী-ব্যবস্থা বুঝতে হলে প্রাচীন ভারতীয় এবং মোগল-পুলিশ সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন আছে। তাই এই দুই যুগের পুলিশ সম্বন্ধে এইখানে আলোচনা করা হলো।
উপরে পাঠান ও মোগল-পুলিশ সম্বন্ধে বলা হলো। ওই সময় ওরা ভারতের গ্রামীণ-পুলিশে হস্তক্ষেপ করে নি। গ্রামীণ-পুলিশ পূর্বের মতো সামন্তরাজাদের অধীন ছিল। পাঠান ও মোগলরা ফৌজী ক্যাম্পে ও রাজধানীতে রক্ষীদল রেখেছিল। তবে ওই-গুলি ফৌজী-পুলিশের সহিত তুলনীয়। পাঠানরা মূলতঃ সৈন্যদ্বারা তাদের ঘাঁটিগুলিতে শান্তিরক্ষা করতো। মোগলরা মাত্র রাজধানী দিল্লিতে একটি পুলিশ-দল তৈরি করে। সেই দল-গঠনেও প্রাচীন ভারতীয় পুলিশের প্রভাব সুস্পষ্ট। এবার বাংলার পুলিশ সম্বন্ধে বিস্তারিত বলবো। কিন্তু তৎপূর্বে বাঙালী উপজাতি সম্বন্ধে বুঝতে হবে। বাংলার ইতিহাস বলতে বাঙালীর ইতিহাস বোঝায়। পুর্বতন বাঙালীদের সঙ্গে অধুনাতন বাঙালীর প্রভেদ রয়েছে। এই পুস্তকে আমি প্রাচীন বাঙালীদের সম্বন্ধে অধিক বলেছি। তাঁদের স্বভাব-চরিত্র বর্তমান বাঙালীদের মতো ছিল না। তুলনার জন্য বর্তমান বাঙালীদের চরিত্র নিম্নে উদ্ধৃত হলো। এখানে বর্তমান বাঙালীদের সংশোধনযোগ্য জাতীয় ত্রুটি সম্বন্ধে আলোচনা করবো। কোনও জাতির বা উপজাতির উত্থান-পতন জাতীয় চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন হলে জাতীয় ইতিহাসেরও পরিবর্তন হয়। সেই অবস্থায় পশ্চাদপদরা অগ্রগামীদের চাইতে আরও বেশী এগোয়। তাই প্রত্যেক জাতির ও উপজাতির পূর্বাপর জাতীয় ইতিহাস অবশ্য পঠিতব্য। তবেই তাদের পূর্বেকার ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করার সুযোগ হবে। তাতে ফলাফল বুঝে সময়ে সাবধান হওয়া যায়। কারণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারে বারে ঘটেছে। জাতীয় চরিত্রে অদল-বদলের ইতিহাসও প্রয়োজনীয় ইতিহাস।
কেউ কেউ বলেন বাঙালীরা আর্য-অনার্য-দ্রাবিড়ের সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতি। এজন সর্বভারতীয় বোধ ও প্রীতি বাঙালীদের রক্তে প্রবাহিত। বাঙালীর [হিন্দু মুসলিম খ্রীস্টান বৌদ্ধ] দেহাকৃতি, ব্লাড গ্রুপিং নৃতাত্ত্বিক তথ্য এ বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই তথ্য হিন্দু-মুসলিমের দ্বিজাতি-তত্ত্ব স্বীকার করে না। এরা কখনও [ভূঁইয়ারাও] এক নেতার অধীনে একতাবদ্ধ হয় নি। বরং পারস্পরিক বিদ্বেষ ও আত্মধ্বংসী রাজনীতির মধ্যে নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখে সহজে অন্যের শিকাবে পরিণত হয়েছে। কারো কারো মতে, এরা ঘর-জ্বালানে পর-ভুলানে হলেও বারে বারে নিজেদের ক্ষতি করে সমগ্র ভারতের উপকার করেছে। এরা একেবারে ভাবপ্রবণ, দুঃখবিলাসী ও আদর্শবাদী। এদের প্রথম আন্দোলনে এরা রাজধানী হারায় ও প্রদেশের উল্লেখযোগ্য অংশ বেহাত হয়। দ্বিতীয় আন্দোলনের ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারায় ওরা নিজদেশে পরবাসী হয়েছে। তৃতীয় আন্দোলনে ওদের প্রদেশ খান খান হয়ে তিনখান হয়ে যায়। চতুর্থ আন্দোলন করলে ফল কি হবে সেটা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। কিন্তু প্রতিবারই এরা নিজেরা পিছিয়ে সমগ্র ভারতকে এগিয়ে দিয়েছে। এজন্য কারো নিকট হতে কখন ও সাধুবাদ না পেলেও এরা আত্মস্বার্থ ভুলে সকলের জন্য ভেবেছে ও প্রাণপণ করেছে। এত বড় স্বার্থত্যাগী ও আত্মভোলা জাতি পৃথিবীতে বিরল। এদের মুষল-পর্বের দিন এখনও বিলম্বিত। এখনও নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও হানাহানি করে এরা আকণ্ঠ বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে আছে। এই অহেতুক রাজনীতি-সর্বস্ব বাঙালীরা আজ আর কোথাও চাকরি পায় না। তাদের চাষের জমিতে অন্যেরা ফ্যাক্টারি তৈরি করেছে। এদের অর্থহীন রাজনীতি ও অন্তর্বিরোধের সুযোগে অন্যেরা প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ উন্নত। এরা এই যুগে নিজভূমে প্রায় পরবাসী। অথচ সামান্য প্রতিকার বা প্রতিবাদ করতেও এদের অসীম লজ্জা।
এই উপজাতি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরই দুয়ারে চাকরির প্রত্যাশায় বৃথা ঘোরাঘুরি করে। যে সকল ইংরাজ-বণিকেরা একমাত্র তাদেরই চাকরি দিত, ওদেরকে তাড়িয়ে এরা অন্যদের সুবিধা করে দিয়েছে। এরা নিজেরাই নিজেদের অন্যতম শত্রু। অথচ কিছুকাল পূর্বেও এরা ইংরাজদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবসা করেছে।
[বাঙালী নির্মাণশিল্পীরা পূর্বে সমুদ্রগামী যুদ্ধ-জাহাজ ও বাণিজ্য জাহাজ তৈরি করতো। বাঙালী কর্মকারদের দ্বারা অস্ত্রশস্ত্রের মতো উৎকৃষ্ট কামান ও বন্দুক তৈরিরও ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে।]
এটি স্বীকৃত সত্য যে পূর্বকালে নৌবাণিজ্যে বাঙালীরা অদ্বিতীয় ছিল। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সুদূর বন্দরে বাণিজ্য-তরীসহ বাঙালীদের দেখা যেত। প্রমাণ স্বরূপ —আজও ব্রত-উদ্যাপনে বাঙালী কন্যারা সেই দিনের স্মৃতি বহন করে। তাদের পূর্বসূরীরা সমুদ্রগামী পতিপুত্রের নিরাপত্তা-কামনায় পুষ্কবিণী ও নদীতে প্রদীপ-সহ ক্ষুদ্ৰ ভেলা ভাসাতো। তাদের উত্তরপুরুষের কন্যাদের ব্রতানুষ্ঠানে এই প্রথা আজও রয়েছে।
[বাণিজ্য ও শিল্পের উপর জাতীয় উন্নতি নির্ভরশীল। বহির্বাণিজ্যের জন্য বাঙালীর মন প্রথম সংস্কারমুক্ত হয়। এজন্য পূর্বতন বাঙালীদের ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্বন্ধে বলবো। জাতীয় চরিত্রের ও ইতিহাসের সহিত ওইগুলির সম্পর্ক আছে।] নৌশিল্পের মতো বাঙালীদের বস্ত্র-শিল্পেরও খ্যাতি ছিল। সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম ঢাকাই মসলিন রোম-সম্রাটদেরও ব্যবহার্য ছিল। কিন্তু বাঙালীদের নৌশিল্প উত্তরকালে ব্রিটিশরা দারোগাদের সাহায্যে ধ্বংস করলেও তাঁতিদের আঙুল কাটার কাহিনী অলীক। ঐ গণ-গল্প ইংরাজদের প্রতি বাঙালীদের রাজনৈতিক ঘৃণা হতে উদ্ভূত।
ইংল্যাণ্ডের মতো পরাধীন ভারতে শিল্প-বিপ্লব সম্ভব হয় নি। ইংল্যাণ্ডের যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে বাঙালী তাঁতীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। কলিকাতার লাহা-পরিবার ইংল্যাণ্ডের লাট-মার্কা বস্ত্রের সর্বভারতীয় এজেন্ট হলেন। তাঁরা ওই ব্যবসায়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছিলেন। পরে, বিড়লারা ওই ব্যবসায়ে তাঁদের বেনিয়ান হন। লাহা-পরিবার ব্যবসা ছেড়ে অধিক সম্মানের প্রত্যাশায় জমিদারী কিনে জমিদার হলেন। ফলে বিড়লা-হাউস তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো। বাণিজ্য-লক্ষী বাঙালীদের ত্যাগ করে ক্ষেত্রীদের নিকট ও ক্ষেত্রীদের ত্যাগ করে মারোয়াড়ীদের নিকট চলে যায়। এখন আবার তাদের নিকট হতে ভাটিয়াদের কাছে চলে যাচ্ছে। জমিদার হওয়ার লোভ, আয়েসী জীবন ও ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রহানি তার কারণ। বস্তুতপক্ষে বর্ধমান বা নাটোর-রাজের পাশে বিড়লারাও আসন পেতো না। বাঙালী ব্যবসায়ীরা নাম-মাত্র মহারাজা হতে চাইলেন। রাজনীতি ও চাকরি-সম্বল বাঙালীদের পূর্বস্থানে ফেরার চেষ্টা কম। তাই এখন তাদের একমাত্র বুলি : ‘সব কিছু জাতীয়করণ করো।’ এ ভিন্ন তাদের আজ বাঁচবার অন্য কোনোও উপায়ও বোধহয় নেই।
হিন্দু-বাঙালীদের পূর্বকালে জাহাজী বাণিজ্য ও কলোনী স্থাপন সুবিদিত। ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দেও ফস্টার সাহেব হীরাট নগরে একশ’ জন এবং ভার্সিস নগরে একশ’ দশজন হিন্দু-বণিক দেখেছেন। বাজমশীদ, আস্ত্রারণ, ভেজদ, কাম্পিয়ন ও পারস্য সাগরকূলেও বহু হিন্দু-বণিক সপরিবারে বাস করতো। কলিকাতা শহরে বসাক ও শেঠ পরিবার ও অন্যরা প্রাচীন ব্যবসায়ী। সপ্তগ্রাম ও চুঁচড়ার সুবর্ণ বণিকরাও তখন সক্রিয়। পরে এরা সকলে কলিকাতায় ইংরাজদের সঙ্গে ব্যবসা ভাগাভাগি করে। ১৮৫১ খ্রী. বণিক-সভা প্রতিষ্ঠাকালেও তাতে বহু বাঙালী ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হতে হটলেও ব্যবসা-ক্ষেত্রে তারা তখনও হটে নি। অর্থাৎ অর্থ নৈতিক ক্ষেত্রে তারা তখনও পরাধীন নয়। কিন্তু সরকার-অনুগৃহীত বিটিশ-উৎপাদকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মুচি, মাঝি প্রভৃতি দেশীয কারিগররা হেরে চাষের মাঠে ভিড় জমালো। বাঙালী ধীরে ধীরে ব্যবসায়-ক্ষেত্র হতেও বিদায় নিলো। পুস্তকের এই অংশে প্রসঙ্গ ক্রমে বাঙালীকে আমি তাদের পূর্ব-কৃতিত্ব স্মরণ করালাম। তাদের আমি বলতে চাই যে ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেদের চিনুন ও পূর্ব পুরুষদের স্মরণ করুন।
[বি. দ্র.] পূর্বতন বাংলাদেশে বাঙালীদের বিভিন্ন শ্রেণীগুলির মধ্যে অর্থ নৈতিক অসমতা যৎসামান্য ছিল। শাসক যাজক বণিক ও শিক্ষক প্রভৃতি ব্যক্তিগত বৃত্তিধারী ওদের প্রতিটি শ্রেণীতে ছিল। সেইকালে বাঙালী ব্রাহ্মণ ও কায়স্থাদি উচ্চশ্রেণীরা পরভূক জীবন [প্যারাসাইট লাইফ] যাপন না করে অন্যদের মতো কৃষিকার্য করতো। কিছুকাল পূর্বেও বাঙালী ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ প্রভৃতিরা লাঙল না ধরলেও কোদাল কোপাতে জমি নিড়োতে ও বেড়া বাঁধতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না। অন্যদের দ্বারা উৎপাদিত শস্যের ভাগ না নিয়ে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করেছেন। কিন্তু ব্রিটিশরা ইংরাজি শিক্ষা দিয়ে এঁদেরকে মধ্যবিত্ত করে মূল সমাজ হতে দূরে সরায়।
বিহার প্রভৃতি স্থানে আজও ব্রাহ্মণ ও ছত্রী আদিরা তথাকথিত অচ্ছ্যুৎদের সহিত পাশাপাশি ক্ষেত্রে হলকর্ষণ করে। একই পরিবারের এক ভাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যভাই লাঙল চষে বা ভঁইস চরায়। ওই সব অঞ্চলে অর্থনৈতিক অসমতা না থাকায় ঈর্ষাও নেই।
উপরোক্ত সামাজিক কারণে বিহার ও বাংলার সাহিত্যও বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। কোনও পথহারা ভূইয়ার পুত্র বা রাজপুত্র কৃষক-গৃহে আশ্রয় নিলে বিবাহের জন্য তার রুষক-কন্যার সহিত প্রণয় সম্ভৰ। কিন্তু বাংলাদেশে ঐ পথহারা ব্রাহ্মণ-পুত্রকে গৃহস্বামী বলবে : তোমাকে আমাদের অন্ন কি করে খাওয়াবো? জাত-সাপের কোনও ছোট বড় নেই। গৃহস্বামী তখন তাকে গ্রামের এক ব্রাহ্মণ-বাড়িতে নিয়ে যাবে এবং সেই বাড়ির কন্যার সহিত প্রণয়ের পর গল্পটি শেষ হবে।
প্রাচীন বাংলায় জাতিভেদ থাকলেও এইরূপ অর্থ নৈতিক অসমতা কোনও দিনই ছিল না। উচ্চ নিম্ন শ্রেণীভেদে গোলায় ধান ও পুকুরে মাছ থাকতো। প্রণম্য ব্রাহ্মণরাও অন্য শ্রেণীদের মতো মাটির ঘরে বসবাস করেছে। অপরদিকে উভয় শ্রেণীর অবস্থাপন্নদের ও সমুদ্রগামী বণিকদের অট্টলিকা ছিল। সকল শ্রেণীর লোকই দেশের শাসককুলে ছিল।
[পরে ব্রিটিশ-শাসনে সমাজের বুদ্ধিজীবীরা দ্রুত ইংরাজি শিক্ষা করে পৃথক সমাজের সৃষ্টি করে। বুদ্ধিজীবীদের এইভাবে পৃথক করে ব্রিটিশরা লড়াকু জনগণকে বিভ্রান্ত করে।]
পূর্বে ব্রিটিশরা বাঙালী কন্টাকটার দ্বারা স্বর্ণ রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা তৈরি করতো। জমিদার-শাসকরা অর্থনৈতিক কারণে— সম্রাট ও বাদশাহের তৈরি মুদ্রাদির উপর নির্ভরশীল ছিল। ওই সব ধাতুতে খাদ না থাকায় তার সমমূল্যের জন্য মুদ্রা জাল করা অলাভজনক ছিল। বহু পরে ইংরাজ গভর্নমেন্ট নিজস্ব ট্যাঁকশাল স্থাপন করে খাদ-মিশ্রিত মুদ্রা তৈরি করতে থাকেন।
উপরে অধুনা-দৃষ্ট বাঙালীদের সম্বন্ধে অধিক বলা হয়েছে। এবার পূর্বতন বাঙালীদের সম্বন্ধে বিস্তারিত বলবো।
পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে বৃহৎ বাংলার বিচার, পুলিশ ও শাসন সম্পর্কিত ইতিহাস খ্রী. পূ. কাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমি বিবৃত করবো। এটাকে প্রাচীন কাল, মধ্যবর্তী কাল ও বর্তমান কাল—এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি। তাতে কার্যকরণ-সহ বাংলার প্রকৃত জাতীয় ইতিহাসও উদ্ধার করা হয়েছে।
আশা করা যায় যে অন্য গবেষকদের দ্বারা এই বাংলায় পুলিশের ইতিহাসের আদর্শে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিচার ও পুলিশের পৃথক পৃথক ইতিহাস রচিত হবে।