তৃতীয় অধ্যায় – ব্যক্তিত্ব

তৃতীয় অধ্যায়

জোড়াসাঁকো থানায় প্রবেশ করে বুঝতে পারি যে সেখানে পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক-এক ইনচার্জের প্রমোশন এক-একরকম হয়। সত্যেন মুখার্জির মতো ছাঁদে, কর্মক্ষম ও সেই সঙ্গে সৎ অফিসার সে-যুগে দুর্লভ ছিল। কড়া ও সৎ ঊর্ধ্বতনদের আমারও পছন্দ। এঁদের কাছে ভালো কাজের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। ‘আমি কাঁচা খেয়ে ফেলবো। আজই একজনকে খাবো।’—ইনচার্জ-অফিসার সত্যেন মুখার্জি কজন নিম্নপদস্থ কর্মীর উদ্দেশে চেঁচাচ্ছিলেন, ‘পারেন তো ছুটি নিন কিংবা বদলি হয়ে যান, নইলে আপনাদের খতম করে দেব। রহমত মিয়ার জুয়া ও কোকেন ব্যবসা চলছে কী করে—য়্যা? আপনারা কিস্‌সু করেন না, কিস্‌সু দেখেন না।”

ইতিমধ্যে এক ধনীব্যক্তি মোটর থেকে নেমে, প্রদর্শনীর মতো আঙুলের হীরের আংটিগুলি উচিয়ে থানায় ঢুকলেন এবং সত্যেনবাবুকে বললেন, “আপনি এ-থানায় এসেছেন শুনে আলাপ করতে এলাম। হে হে। আপনাদের ওপরওয়ালাদের সঙ্গেও আমার খাতির আছে। আপনি নিশ্চয় আমার পরিচয় শুনে থাকবেন। আমি—’ সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি চেয়ার হতে লাফিয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘মশায়, আপনি তো একজন অ্যারিস্ট্রোকেট দালাল। নিম্নপদী ও নবাগত কর্মীদের নষ্ট করে চরিত্রহীন করাই তো আপনাদের কাজ। আপনি ফের এখানে এলে ফাটকে বন্ধ করে দেবো। এই দালাল-শ্রেণী আর বাস্তু-উকীলদের আমি থানায় ঢুকতে দিই না। ক্লিয়ার?’ [থানা প্র্যাকটিশ-করা কিছু উকীল ছিল।]

জোড়াসাঁকো এলাকার মতো দুর্ধর্ষ গুণ্ডা-অধ্যুষিত এলাকা অন্যত্র ছিল না। রাত্রে একটি বাড়িতে তল্লাসীর জন্য প্রবেশ করলাম। হঠাৎ সিঁড়ি থেকে শক্‌ পেয়ে সিপাহীরা নিচে গড়িয়ে পড়লো। ওরা যেখানে হাত দিয়েছে সেখানে হাইভোল্ট ইলেকট্রিক সংযুক্ত ছিল। এরপরই ডালকুত্তাদের আমাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হ’ল। সঙ্গে সঙ্গে ইষ্টক-বর্ষণ শুরু। ফলে আমাদের বহুজনকে হাসপাতালে যেতে হ’ল। পরে ওরা কৈফিয়তস্বরূপ বলে যে তারা আমাদের ডাকাত ভেবেছিল। জলের ঝারি করে ওরা কোকেন ড্রেনে ফেলেছে।

বাতাসী-বিবির ডেরাতে দুজন জোয়ান স্বামী কাম (Cum) রক্ষী ছিল। তাদের ঘরের দেওয়াল ঘুরিয়ে ওরা পালাতে পারতো। নিচে কোনও লোকজন নেই। একতলার ছাদ থেকে আঙটা টানলে দেওয়ালের চৌকো অংশসহ একটি মই নিচে নেমে আসে, অথচ মনে হবে ওই আঙটা কোনও কিছু টাঙাবার জন্য তৈরি করা হয়েছে। উপর হতে নারকেল মালা নেমে এলে কোকেন-খোর ব্যক্তি তাতে মূল্য রাখে। তারপর মালাটি উপরে উঠে গেলে মূল্য তুলে নিয়ে সেই পরিমাণ কোকেনের পুরিয়া নিচে নামে। মাঠকোটার দেওয়ালে ছোট ফুটো-মারফত কোকেন বিক্রি হয়। কে বা কারা বিক্রি করলো তা ওই বাড়িতে ঢুকে প্রমাণ করা যায় না। (সনাক্তির জন্য রঙ-ছোড়া পিচকারি ব্যবহার করতাম।) …জনৈক নেতা শয্যায় দেহ এলিয়ে পিস্তলের গুলিতে বাল্ব ভেঙে আলো নেবাতেন। মৎপ্রণীত ‘অধস্তন পৃথিবী,’ ‘খুনরাঙা রাতি’ ও ‘অন্ধকারের দেশে প্রভৃতি রচনায় এদের বিষয় হুবহু বলেছি। বস্তি-অঞ্চলে ধরে এনে গুম-করা ওদের সাধারণ ঘটনা।

কোনও এক গুণ্ডা-সর্দার উঠানে নিদ্রা যেতো। রৌদ্র উঠলে কেউ তার চোখে রুমাল চাপা দিতো। কিছু পরে চারজন তরুণী তাকে খাটিয়া-সুদ্ধ ঘরে তুলে নিয়ে যেতো। সেখানে সে খাটিয়ায় বসে গড়গড়া মুখে দিতো। তার পাঞ্জা দেখালে দলের লোকেরা তাকে মদত দিয়েছে।

একবার এক মুশ্লিম গুণ্ডাকে নাম জিজ্ঞাসা করা হলে সে বললে, তার নাম সেখ করীম; বাবার নাম সেখ আবদুল। কিন্তু ঠাকুরদার নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল, ‘ওকে! নাম ছোড় দিজিয়ে হুজুর। ও শালে হিন্দু থে।’…বন্ধু-কর্মী মহম্মদ মহসীন তা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল, ‘দেখ। এদের মধ্যে এজেন্ট-প্রপোগেটর কাজ করছে।’ হ্যালিডে পার্কে মুশ্লিম এবং গিরিশ পার্কে হিন্দু বক্তা সাম্প্রদায়িকতা প্রচারে রত। বন্ধু মহসীনের সাত-পুরুষের ভিটায় পাতকুয়া খুঁড়ে বহু দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়। বাড়ির লোকেরা মূর্তিগুলি লুকোবার চেষ্টা করলে সে বাধা দেয়। কলিকাতার প্রত্যেক পুলিশ-কর্মী অসাম্প্রদায়িক ছিল। কারণ, তারা নিজেদের হিন্দু বা মুশ্লিম না-ভেবে কেবল পুলিশ হিসাবেই ভেবেছে, যার কোনো জাত নেই।

তবে জোড়াসাঁকোর মতো সমস্যা-সংকুল থানা গোটা ভারতে আর ছিল কিনা সন্দেহ। জনৈক তরুণ মুশ্লিম দুহাত পেটে চেপে থানায় এসে বললে, ‘মেরি বুনাই দিল্লাগি করকে ছুরি মার দিয়া।’—জোর করে তার হাত পেটের উপর থেকে সরানো মাত্র নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়লো। থানা-সুদ্ধ লোক অপ্রস্তুত, হতভম্ব।…কোঁচড়ে ইট পুরে মাস্তানরা ‘আফ্রিকা স্পিক’ ফিলিম দেখছে। হঠাৎ বাঘের গর্জন শোনা মাত্র ‘মার শালে বাঘ’ বলে কোঁচড় শূন্য করে ইট ছুঁড়লো। তাতে বাঘ অবশ্য মরলো কেননা পর্দা শতচ্ছিন্ন। তাই সত্যেন মুখার্জির মতো ব্যক্তিকে এখানে বহাল করা হয়েছিল।

এই এলাকায় আমার প্রধান আকর্ষণ—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। ওই বাড়ির ঠাকুর-দালানে আমি ‘নটীর পূজা’ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখেছিলাম। এইখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ ঘটে। এই বাড়ির এক কক্ষে অবনীন্দ্রনাথ আমাকে ও হেমেন্দ্রকুমার রায়কে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ প্রভৃতি কয়েকটি লেখা পড়ে শুনিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্রাহ্মসমাজ শ্রমিক-সেবার পরিকল্পনা মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে একটি শ্রমিক-সমাজের সভাপতি হলে ইংরাজ-বণিক-সভার বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাঁর বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণও ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট পছন্দ করেন নি। ওঁরা রবীন্দ্রনাথের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখবার জন্য জোড়াসাঁকো থানার সারভেলেন্স-রেজিস্টারে তাঁর নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। এ সম্বন্ধে কোনও এক ইংরাজ-রাজপুরুষ নিম্নোক্ত রূপ একটি প্রতিবেদন লেখেন:

‘এই দীর্ঘকায় গৌরবর্ণের শ্মশ্রুযুক্ত ভদ্রলোককে হঠাৎ দেখলে যীশুখ্রীস্ট বলে ভ্রম হয়। এই একটিমাত্র কারণে তিনি বহু ইংরাজ-পণ্ডিতকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন। বহু য়ুরোপীয় ভদ্রলোক না-বুঝে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত করেন। তিনি স্বয়ং জমিদার হওয়া সত্ত্বেও প্রজা দরদী। ধনীপুত্র হয়েও তিনি বোলপুরে একটি ক্ষুদ্র বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।’.

একদিন এক জমাদার থানায় ফিরে এসে বড়োবাবুকে সংবাদ দিচ্ছিল: ৩ নং দাগী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে হাজির নেই। এই সময় জনৈক ভারতীয় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থানায় উপস্থিত ছিলেন এবং তা শুনে স্যার যদুনাথকে গল্পচ্ছলে বলেন। ঘটনাটি প্রকাশ পেলে ইনচার্জ অফিসারকে কৈফিয়ৎ দিতে হয় এবং তৎক্ষণাৎ কবিগুরুর নাম ওই তালিকা হতে বাদ দেওয়া হয়।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমেন্দ্রকুমার রায় ও কালিদাস নাগের মাধ্যমে আমার পরিচয়। ডঃ নাগের গ্রেটার ইণ্ডিয়া মুভমেন্টে আমি ছাত্রাবস্থায় যুক্ত ছিলাম। আমার পরিচয় দিতে সংকোচ হচ্ছিল। ডঃ নাগ তার কারণ বোঝাতে চাইলেন। গুরুদেব তখন বললেন, ‘মানুষের কাছে মানুষের পরিচয় দিতে লজ্জা হয় এমন কি ব্যাপার থাকতে পারে।’ আমি স্থানীয় পুলিশ-কর্মী শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘থানা তো কাছেই ছিল। পুলিশ একেবারে বাড়ির ভিতর! অতঃপর থানা-পুলিশে জড়িয়ে না পড়ি।’ তাঁর রসিকতা যাই হোক, উপস্থিত গুণীব্যক্তিদের জোড়া জোড়া চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হ’ল। আমি বিব্রতবোধ করে একটু একটু করে পিছিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করি।

তাঁকে কৈশোরে ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজ হল-এ প্রথম দেখি। ‘প্রবাসী’-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সভাপতি ছিলেন। রামানন্দবাবু বক্তৃতা-প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যৌবনে বহু কবিতা লিখেছি। অতি অল্প সময়ে ওই কবিতাগুলি প্ৰশংসা-লাভ করে। কিন্তু আমার কবিতার খাতাটি হারিয়ে গেছে।’—রবীন্দ্রনাথের ভাষণটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বক্তৃতা দিতে উঠে বললেন, ‘রামানন্দ-বাবুর কবিতাগুলি স্বল্পকালে প্রশংসিত হয়েছিল এবং স্বল্পকালেই লোকে তা ভুলে গেছে। এমন-কি খাতাটি পর্যন্ত তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমাকে কবিরূপে স্বীক্বতি পেতে চল্লিশ বৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাই স্বীকৃতি একটু দেরিতে আসাই ভালো। তাতে লেগে থাকা যায়, চর্চা করা যায়।’

রবীন্দ্রনাথ পুলিশের প্রতি স্নেহশীল ও সহানুভূতি ছিলেন। তাই ‘মুকুট’ নাটকে তিনি লিখে গিয়েছেন যে পুলিশ কারো পা জড়িয়ে ধরলে লোকে মনে করে জুতো-জোড়াটা সরাবার মতলবে আছে। পুলিশ-সম্পর্কে জনগণের অন্যায় সন্দেহ তাঁকে ব্যথিত করতো। অন্যদের মতো তাঁরও বহু অসুবিধা ছিল। তাই একটি পত্রে তিনি দুঃখ করে লিখেছিলেন: ‘আমার মধ্যে যেটুকু আগুন আছে তা দিয়ে সারাবাড়ি আলোকিত হয় না, ঘরের কোণে একটি প্রদীপ মাত্র জ্বালানো যায়।’তিনি শেষদিকে কথ্যভাষার পক্ষপাতী হন। সাধুভাষায় লেখা পুস্তক স্থায়িত্ব পাবে কিনা তাঁর সন্দেহ ছিল। ‘নৌকাডুবি’ সাধুভাষায় লেখা বলা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে ওটা ডুবলো।” একটি সভায় (E. N. Club) কবি জসীমউদ্দীন ও অন্যান্য মুশ্লিম কবি-সাহিত্যিকদের সভ্য করার জন্য ওঁকে বলতে শুনেছিলাম। শাস্তিনিকেতনে তরুণ চিত্রশিল্পীদের তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমপাতা এঁকে তলায় লেখো কাঠাল পাতা, তাহলে তা আমও নয় কাঁঠানও নয়, সে হবে তোমার মনের পাতা।’—তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্য অমৃত আস্বাদযুক্ত ছিল।

এক পত্রিকা-সম্পাদক তাঁর একটি কবিতা উদ্ধৃত করেন: ‘তোদের চক্ষু যত রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে। তোদের বাঁধন যত শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে।’

তৎকালীন পুলিশ ওই সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে। কিন্তু মূল লেখক রবীন্দ্রনাথকে তার জন্য তারা বিরক্ত করে নি। (অধুনা পুলিশ-ক্লাব লাইব্রেরিতে একটি রবীন্দ্র-শাখা আছে।) রবীন্দ্রনাথ উঠে যাওয়া পুরনো পত্রিকাগুলি পুনর্জীবিত করা পছন্দ করতেন না। তাঁর মতে ওদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। মানুষের মতো ওদেরও জীবনদান অসম্ভব। তাতে পূর্বভাবধারা পুনঃপ্রবাহিত হয় না।

[অবনীন্দ্রনাথ আমাদের বলেছিলেন যে শেষ জীবনে তাঁর আঁকা ছেড়ে লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের লেখা ছেড়ে আঁকার ইচ্ছা। তিনি আরও বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পরমায়ু তাঁর অপেক্ষা বেশি। কারণ, ওঁর মধ্যে মহর্ষির প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব রয়েছে।]

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের বহুবার বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য লেখেন আর আমরা তোমাদের জন্য লিখি। উনি যুগের চাইতে বহুদূর এগিয়ে আছেন বলে তাঁর সব লেখা তোমাদের বোধগম্য হয় না।’

বিঃ দ্রঃ—গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স-এর উত্তরাধিকারীদের মুখে শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের প্রথম পুস্তক তাঁরাই প্রকাশ করেন। তৎকালে লেখকদের সংখ্যা অতি নগণ্য ছিল। তাঁরা এক-একজন লেখকের প্রাপ্য অর্থ এক-এক রঙের কৌটোয় রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ পুস্তক-বিক্রির সংবাদ নিতে এলে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি রবীন্দ্রনাথ? ঠিক আছে। তাহলে হলদে কৌটো। একখানি পুস্তক বিক্রি হয়েছে। কমিশন বাদে তোমার প্রাপ্য দু-আনা।’ —রবীন্দ্রনাথ নাকি সবিনয়ে বলেছিলেন, ‘ক্রেতার নাম ও ঠিকানা যদি দেন তাহলে তাঁকে একদিন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতাম।’

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতাকালে আমি ডিউটিতে সেখানে ছিলাম। বক্তৃতার প্রারম্ভে বাংলাতেই তিনি বললেন, ‘খামাপ্রসাদের পিতা আশুতোষ স্নাতকোত্তর বিভাগে বাংলা ভাষা পাঠ্য করেন। এবার ভাইস-চ্যানসেলার হয়ে তিনি প্রথম বাংলা ভাষাকেই সমাবর্তনের আসরে টেনে ‘আনলেন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যানসেলার ইংরাজ লাটবাহাদুর তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করার প্রশ্নে তিনি বাংলা ভাষায় পণ্ডিত নন বলে আপত্তি উঠেছিল।’ কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার স্রষ্টারূপে তিনি স্বীকৃত হয়েছিলেন। (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার আমাদের বলেছিলেন, ‘রবিঠাকুরের সভায় গিয়ে লাভ হয় কী? উনি নিজেই কথা বলেন আর সবাই চুপ করে তা শোনে। কিন্তু আমার বৈঠকে সকলের সমান অধিকার।’ প্রকৃতপক্ষে অত বড়ো ব্যক্তিত্বের নিকট কোনো কথা বলা সম্ভব ছিল না।)

ঠাকুর-বাড়িগুলির মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অলংকৃত কাঠের সিঁড়িটি আমাকে মুগ্ধ করতো। উত্তরকালে ওই প্রাসাদের বিলুপ্তি আমাকে মর্মাহত করেছিল।

তদপূর্বে অবনীন্দ্রনাথের গৃহত্যাগকালে মর্মন্তদ স্বৰ্গত ভাষণটি কেউ জানে না। তিনি গৃহের প্রতিটি কক্ষের আসবাবাদি এবং উত্থানের প্রতিটি বৃক্ষের নিকট গলবস্ত্রে ও করজোড়ে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। —‘হে লতা! হে বৃক্ষ! তোমরা আমাকে বিদায় দাও। হে মৃত্তিকা! হে ইষ্টক! তোমরা আমাকে বিদায় দাও।’ উপস্থিত ব্যক্তিরা তা দেখে চোখের জল সংবরণ করতে পারেন নি।

ঠাকুর-বাড়ির দুটি চুরির মামলার কিনারা করায় খুশি হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে মিশনারিদের অপেক্ষা পুলিশের জনসেবার সুযোগ বেশি। আমি তাঁর এই বাণী স্মরণ রেখে এরূপ প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলাম।

এইকালে কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে পেশোয়ারীরা বাঙালীদের ফল-বিক্রয়ে বাধা দিতো। আমি ওখানে সিপাহী মোতায়েন করে বাঙালী তরুণদের দোকান বসিয়েছিলাম। মার্কেট-সুপারিনটেনডেও রঞ্জনবার এ-ব্যাপারে আমার সহায়ক হন। বাঙালী বেকার তরুণদের চা বিপণি ও হোটেলের অজস্র লাইসেন্স মঞ্জুর করি। রামবাগান বেশাপল্লীর নারীদের সুরক্ষণ ও তাদের শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলাম। জনৈক উৎপীড়ক অফিসারকে বড়বাজারে বদলি করে ওই এলাকার ভার আমাকে দেওয়া হয়। ওদের পুত্রকন্যাদের বিবাহ দিয়ে তাদের গৃহস্থ করার ব্যবস্থা আমি করেছিলাম। আমার কাজের স্বীক্বতিস্বরূপ নিম্নোক্ত গানটি বেশাপল্লীতে প্রায়ই গীত হ’ত। গায়িকা ইন্দুবালা এই গানটি প্রথম গেয়েছিলেন:

‘বড়োবাজারে অমুকবাবু
খাচ্ছে বসে মেওয়া।
পঞ্চ ঘোষালকে করলে রাজা
রামবাগানের বেওয়া।’

থানার প্রবীণ সিপাহী ও জমাদাররা ওইকালে কর্মদক্ষ ছিল। বহু তদন্তে অফিসারদের সাহায্য করে ওরা তাঁদের সুনাম এনে দিতো। জনৈক স্নেহপ্রবণ জমাদার নিজে আমাকে বলেছিল, ‘ছোটবাবু, কুছ কুছ ছোটউটি গাফিলি হামিলোককে লিয়ে করবেন। আপকো ভালাইকো বাস্তে ম্যায়লোক দলিল-খাট চুকেগা। নেহি তো ইসকো বাড়ে আপকো আপদ আসবে। আউর ইসমে বড়িয়া কৈফিয়ৎ দিতে হবে।কোনও তরুণ অফিসারকে নারীর প্রতি মনোযোগী বুঝলে তারা বাধা দিয়ে বলেছে: ‘উহু’। আপ বঢ়ি ঘরকি লেড়কা। ঘরমে আপকো বহু-বেটি আছে।’ …এদের নিকট পুলিশ লাইনের কতকগুলি পরিভাষা আমি রপ্ত করেছিলাম বেমন ফর্জেন্টি=উপর চালাক, হুদ্দো=এলাকা, মেরামতি=টাইট দেওয়া, খানেওয়ালা লড়নেওয়ালা ঝঞ্ঝাটিয়া রামধোলাই হ্যামধোলাই কোচোয়া ধোলাই। ফালতু আদমি, মোক্কা=কিল, হাফ উর্দি অর্থাৎ ধুতির উপর য়ুনিফর্মের কোট (জরুরি হালাতে ওই ব্যবস্থা), পেটি=বেল্ট, বে-পেটি, বে-উদি, রোঁদ অর্থাৎ রাউণ্ড ইত্যাদি।

[বহু কুসংস্কারও থানায় প্রচলিত ছিল। কারো হাত থেকে লাঠি বা হাতিয়ার মাটিতে পড়ে গেলে তার অর্থ—ঝামেলা বাড়বে। তখনই প্রতিষেধক হিসাবে ওতে জল ঢালা হ’ত। কারো সাসপেণ্ড বা বদলির পর নতুন অফিসার এলে তাঁর টেবিল অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতেন।]

শিব্রাম চক্কোরবর্তী নামে এক তরুণ লেখক এলাকার এক মেস বাড়িতে থাকতেন। স্বদেশী-ওয়ালা সন্দেহ করে তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখার হুকুম হ’ল। তাঁকে ফলো করে এক হোটেলে গেলাম ও একসঙ্গে কিছু খেলাম। পরে তিনিই একদিন আমাকে ফলো করে থানায় এলেন ও কিছু টাকা কর্জ চাইলেন। যাবার পূর্বে আপশোষ করে তিনি বললেন যে তাহলে পুলিশের পরই কাবুলিওয়ালার কাছে যেতে হয়। একদিন কাবুলিওয়ালা তাড়িত হয়ে তিনি থানায় আশ্রয় নিলেন। আমরা ওই কাবুলিওয়ালাকে চেপে ধরে হাজতে পুরলাম। ফলে ভারত-গভর্নমেন্ট ও আফগান-গভর্নমেন্টের মধ্যে পত্রালাপ শুরু হয়েছিল। কৈফিয়ৎ স্বরূপ আমি কাবুলিদের শতটাকায় শতটাকা সুদ ও তাজনিত অত্যাচারের ফিরিস্তি সহ প্রতিবেদন পাঠালাম। কিন্তু সুলেখক শিব্রামবাবু সাক্ষী দিতে চাইলেন না। তাঁর মতে ওরা জনগণের উপকারী বন্ধু। সেইদিন পুলিশ বিরূপ হলেও ওরা তাঁকে টাকা দিয়েছে। তাঁকে জবরদস্তি ডেপুটির কাছে হাজির করতে আদিষ্ট হলাম। কিন্তু ততদিনে তিনি নিখোঁজ হয়ে গেছেন।

এই উপলক্ষে কাবুলিদের উৎপাত সম্বন্ধে দেশব্যাপী তদন্ত চললো। গভর্নমেন্ট আফগান মানি লেণ্ডিং অ্যাক্‌ট পাশ করলেন। তার কয়েকটি ধারায় উল্লেখ আছে উৎপীড়ন করলে তা পুলিশ-গ্রাহ্য অপরাধ-গ্রাহ্য অপরাধ রূপে গণ্য হবে। উচ্চহারে সুদ গ্রহণও তার দ্বারা বন্ধ করা হয়।

গান্ধী-আরউইন প্যাক্‌ট ভেঙে গেলে কংগ্রেসকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছিল। সাব-ইনস্পেকটরদের ও তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের নিকট ছাপানো কমিটেণ্ট অর্ডারের বহু ফর্ম থাকতো। তাঁরা সন্দেহ হওয়া মাত্র যে কোনও ব্যক্তিকে হাকিমের নিকট উপস্থিত না-করে নিজেরাই তাতে সই করে জেলে পাঠাতে পারতেন। এত ক্ষমতা পুলিশকে আগে কখনও দেওয়া হয় নি। কিন্তু এই ক্ষমতা পাওয়া সত্ত্বেও আমরা কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে বেআইনী কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন বন্ধ করতে পারি নি। আমি বৃথা অপেক্ষা করে সিপাহীদের মধ্যাহ্নভোজের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ বাজারের মধ্য হতে খালি হাতে খদ্দর ও গান্ধী-টুপি পরা কংগ্রেসী প্রতিনিধিরা পথে নেমে সভা শুরু করে দিলেন। গান্ধী-টুপিগুলো পকেটে থাকায় আমি ওদের স্বরূপ বুঝতে পারি নি। ছুটে গিয়ে গ্রেপ্তার করার পূর্বেই সভাপতি মশাই তাঁর ভাষণের পুরোটাই পড়ে ফেলেছিলেন। ওঁরা নির্বিবাদে থানায় এসেছিলেন। ইংরাজ ডেপুটি সংবাদ পেয়ে থানায় এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এদের বডিলি ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে?’ আমি বিব্রত হয়ে মিথ্যা করে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’ নগ্ন-গাত্র সৌম্য-মূর্তি সভাপতি মশাই ডেপুটি-সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনি ঠিকই আমাকে চিনেছেন, আমি বর্ধমানের সেই নটি-বয়। ‘আমরা দেরি না-করে সবাইকে প্রিজন ভ্যানে পুরে লালবাজারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

নতুন আইনে সিমলা ব্যায়াম-সমিতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওরাই প্রথমে বারোয়ারির পরিবর্তে সর্বজনীন নামে দুর্গোৎসব করেন। ওদের সমিতিতে সর্ব-ধর্মের লোক-গ্রহণে আপত্তি ছিল না। অথচ ভর্তির সময় হনুমানজির পূজা দেবার নিয়ম ছিল। আমরা ওদের প্রদর্শনী-ক্ষেত্র থেকে ব্রিটিশ-বিরোধী পুতুল-সহ বারবেল ডাম্বেল ও আসবাবপত্র তুলে এনে থানার সমুখে রাখলাম। বহুকাল ধরে বৃষ্টিতে ভিজে ওগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল।

পরের দিন কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের দ্বিতলের একটি বিপণি হতে প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে আনার হুকুম হ’ল। কিন্তু সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি, অন্যদের সাথে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বসে রয়েছেন। মুন্সেফ চাকুরিতে মধ্যে মধ্যে ছেদ পড়লে তিনি ওখানে গিয়ে তাস খেলতেন ও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতেন। শ্রদ্ধাস্পদ অচিন্ত্য বাবুর জন্যই আমি কর্তব্য সাধন না করেই ওখান থেকে চলে এসেছিলাম।

কাজী নজরুল

প্রথম-রাত্রে রাউণ্ড পড়লে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হ’ত। তিনি প্রায়ই গ্রামোফোন কোম্পানী হতে হেঁটে অত রাত্রে বাড়ি ফিরতেন। চাদনি রাতে নয়া-রাস্তায় ফেলে রাখা বিরাট পাইপগুলোর উপর বসে কিছুক্ষণ উভয়ে গল্প করতাম। আমার এক সহকর্মী তাঁর কন্যার সংগীত-শিক্ষকরূপে কাজী সাহেবকে রাজী করাবার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। কাজী সাহেব রাজী হলেন। কিন্তু তাঁকে গোপনে পিছনের দরজা দিয়ে উপরে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি রাজী না-হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সর্বদা সদর রাস্তা দিয়ে হাঁটি। খিড়কির পথে আমার যাতায়াত নেই।’ (সর্বসমক্ষে ওঁকে উপরে নিয়ে গেলে বিপদ হ’ত।)

এক সপ্তাহ পরে স্পেশাল ব্রাঞ্চ হতে মেসেজ এলো: এলাকার একটি বাড়ি ভোররাত্রে তল্লাসী হবে। গোয়েন্দা পুলিশের রক্ষার্থে উর্দি-পরা পুলিশ যেন মজুত থাকে। গোয়েন্দা-কর্মীদের নির্দেশে কাজী নজরুলের বাড়িটি ঘেরাও করলাম। সুমুখের বাড়ির বারান্দা হতে জনৈকা বালিকাকে বলতে শুনলাম: ‘ও দিদি, শীথ বাজাও। অতিথি এসেছে।’ গোয়েন্দা-নেতা কাজী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি বিখ্যাত বিপ্লবী-কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ আমরা অবশ্য পরস্পরকে না-চেনার ভাব দেখিয়েছিলাম। প্রতিটি কক্ষের বাক্স ও শয্যা লণ্ডভণ্ড করে খোজা হ’ল। কিন্তু কোথাও একটি মাত্রও আপত্তিকর দ্রব্য বা পত্র পাওয়া গেল না।

হঠাৎ জনৈক অফিসার একটি তালাবন্ধ পুরনো বাক্সের ডানা খুলতে চাইলেন। কাজী সাহেব তৎক্ষণাৎ শশব্যস্তে সেদিকে ছুটে গিয়ে বললেন, ‘না-না-না।’ অফিসাররা তাতে সন্দিগ্ধ হয়ে ওই বাক্সটা ভেঙে উপুড় করলেন। কতকগুলি খেলনা, ছোট জামা ও অন্য দ্রব্য মেঝের উপর গড়িয়ে পড়লো। কাজী সাহেব তা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। তাঁর দুই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। আমরা সকলে অবাক। ‘অগ্নিবীণা‘র কবির চোখে আগুনের বদলে জল! ওইগুলি ছিল তাঁর মৃত-পুত্র বুলবুলের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি। তার মৃত্যুর পর এই প্রথম বাক্সটি খোলা হয়েছিল।

যামিনী রায়

এই উপলক্ষে অন্য একটি বিখ্যাত পুলিশী তল্লাসীর বিষয় উল্লেখ্য। পরবর্তীকালে আমি শ্বামপুকুর থানায় থাকার সময় সেটি ঘটেছিল। বাগবাজারে আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে এই রকম ভোররাত্রে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে আমি একটি বাড়ি ঘেরাও করি। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার স্বয়ং থানা-তল্লাসীতে উপস্থিত। সংবাদ: ওই বাড়িতে একজন মহাবিপ্লবী বাস করছেন। ভোররাত্রে নিচের

ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ওরা বুঝলেন যে খবর ঠিকই পাওয়া গেছে। সকলে পিস্তল উচিয়ে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকছিল, ইংরাজ ডেপুটি সাহেব বলে উঠলেন, ‘আরে তোমরা এ কোথায় এসেছো? এ যে একটা টেম্পেল (অর্থাৎ মন্দির।) ওপেন ইয়োর সু’স্ (জুতো খুলে প্রবেশ করো।’)

সমগ্র দেওয়ালে ও মেঝেতে অপূর্ব নকসা ও আলপনার কারুকাজ। বড়ো বড়ো জালা ও ঘটে এবং পিড়ির গায়ে লতাপাতা ফুল ও পাখি। বিচিত্র পদ্ধতিতে অংকিত দেবদেবীর মূর্তি ও ছবি থাকে থাকে সাজানো। তাদের টানা-টানা চোখ, গোল-গোল মুখ। আর রঙের কী জৌলুস! ডেপুটি কমিশনার ওই মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। পুরোহিত-মন্য ব্যক্তিটি অত ভোরে চাদর গায়ে নিবিষ্টচিত্তে ছবি আঁকছিলেন। প্রকৃত বিষয় প্রকাশ পেলে কমিশনার নিজেই বললেন, ‘একেই বলে বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টস।’

ডেপুটি সাহেব শিল্পরসিক ব্যক্তি। তিনি ওখান থেকে আর ফিরে আসতে চান না। অসংখ্য সুঅংকিত ছবি বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। শিল্পী বললেন যে, ‘একদিন মনে হ’ল ওগুলো ঠিক আঁকা হয় নিতাই বাইরে ফেলে দিয়েছি।’ কিন্তু আমাদের চোখে ওগুলো অপূর্ব লেগেছিল। ডেপুটি সাহেব অফিসে ফিরে তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছিলেন: ‘হি ইজ এ রেভোলিউনিস্ট। বাট নট ইন আর্মস, হি ইজ সো ইন আর্টস।’—এই শ্রদ্ধেয় শিল্পী যামিনী রায়। তখন থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাঁর আমি স্নেহধন্য ছিলাম।

[চারজন য়ুরোপীয় পণ্ডিত স্বাধীনতা-উত্তরকালে যামিনী রায়ের ঠিকানার খোঁজে কলিকাতা-কমিশনারের শরণাপন্ন হলে এক তরুণ দেশীয় ডেপুটি বলেছিলেন, ‘আমাদের সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল, যামিনী রায় কে? তিনি সিনেমা না থিয়েটারের আর্টিস্ট মনে করতে না-পেরে আমি শুধু লিখেছিলাম-আর্টিস্ট।’.. ডঃ বিনয় সরকারের নিকট শুনেছিলাম জনৈক পুলিশ-কর্মী তদন্তে এসে জানতে চেয়েছিলেন তিনি এ্যালাপ্যাথি না হোমিওপ্যাথি ডাক্তার?]

জোড়াসাঁকোয় প্রতিরাত্রে রাজনৈতিক তল্লাসী হচ্ছিল। কোনও এক প্রখ্যাত নেতা মাসিক প্রদেয় ৩০০ টাকা গুনে নিতে-নিতে এক দেশীয় অফিসারকে উদ্দেশ করে বলতে শুনেছিলাম: ‘দাদা-ভাই, একটু-একটু করে একপোজড হয়ে যাচ্ছি। আর দেরি না-করে কিছুদিন ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।’ পরদিন তাঁর বাড়ি তল্লাস করে, গদি ও বালিশ ছিঁড়ে, তাঁকে টেনে-হিচড়ে বার করে সর্বসমক্ষে আমরা গ্রেপ্তার করলাম। মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি, লাঙ্গবর্ষণ ও বন্দেমাতরম ধ্বনির মধ্যে তিনি প্রিজন্-ভ্যানে উঠেছিলেন।

একদিন জনৈক নিম্নপদস্থ গোয়েন্দা-কর্মী পন্নীর এক নেতা কর্তৃক প্রহৃত হলে থানায় নালিশ জানালেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কর্মীটিকে ট্যাক্‌টলেশ বলে প্রহারকারীকে গ্রেপ্তার করতে মানা করেছিলেন। উক্ত নেতা সন্দেহ এড়াতে সর্বসমক্ষে বাহাদুরি নিয়েছিলেন। উনি পুলিশের চররূপে দলের লোককে গ্রেপ্তারে সাহায্য করে অর্থোপার্জন করতেন।

এই-সব নিম্নপদস্থ গোয়েন্দা-কর্মীদের জনগণ চিনে এবং সহকর্মীরা না-চিনে পীড়ন করেছেন। ফুটে দাঁড়িয়ে জানলার দিকে তাকাতে দেখলে তাদেরকে মস্তান ভাবা হয়েছে। কেউ বা নজর এড়াতে মূত্রত্যাগের ছলে পরিপার্শ্বে বসলে টহলদারী সিপাহী তাকে রুলের ও তো দিয়ে থানায় এনেছে। পরদিন আদালতে জরিমানা দিলেও তাঁরা কিন্তু আত্মপরিচয় দেন নি। রোয়াকে উপবিষ্ট এক রুগ্ন বিপ্লবীর প্রতি নজর রেখে জনৈক গোয়েন্দা পানের দোকান থেকে পান ও চুন নিলেন তারপর কাশীর জর্দা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে স্থানত্যাগ করলেন। ওই বিপ্লবী ফেরার থাকাকালে এক তরুণ গোয়েন্দা বন্ধ সেজে তাঁর স্ত্রীর সহিত ভাব জমানোয় উনি ক্রুদ্ধ। এই সময় একজন প্রকৃত নাগরিক তাঁকে একটি রাস্তার হদিস জিজ্ঞাসা করলে উনি খিঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘হারামজাদা! কতদিন তোর চাকরি হ’ল?’ উভয়-পক্ষের গোপন-আহবে জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠিত কোনো-কোনো আশ্রমে প্রবীণ পুলিশ-কর্মী না-জেনে গীতার ব্যাখ্যা শুনতে গিয়েছেন। ভগিনীর বিবাহের অলংকার-সহ এক বিপ্লবী গ্রামের নিয়ালা পথে বাড়ি ফিরছেন। তার পিছু-পিছু অস্ত্রসহ ফ্রিগার্ড-রূপী গোয়েন্দাকে দেখে তিনি নিরাপত্তা বোধ করেছিলেন। বাড়ির নিকট এসে তিনি গোয়েন্দাটিকে সাদর নিমন্ত্রণ করে বলেছিলেন, ‘মশায়, এত রাত্রে কোথায় যাবেন? আসুন, ভোজন করে ঘুমিয়ে কাল সকালেই বরং যাবেন। আমাদের বাড়ি তো আপনার দেখাই রইলো।…তল্লাসীর জন্য বাড়ি ঘেরাও হলে কখনও-কখনও শিক্ষিত কুকুরের মুখে পিস্তলাদি গুঁজে নর্দমার বা গলির পথে বার করে দেওয়া হ’ত। তখন ওই কুকুর যথাকালে তাঁদের অন্য আড্ডায় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিতো। পুলিশ-কর্মীদের মতো নেতাদেরও সশস্ত্র গার্ড ছিল।

জোড়াসাঁকো থানায় বহাল থাকাকালে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ঘটনাটি করুণ হলেও তাদের কৃতিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি নি। সেই ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে নিয়ে উদ্ধৃত করা হ’ল।

এক বিপ্লবী কিশোরকে স্পেশাল ব্রাঞ্চ পুলিশ জোড়াসাঁকো থানার হাজত ঘরে পৃথক করে রেখেছিল। বহু অফিসার চেষ্টা করেও তার কাছ হতে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেন নি। তার সেই এককথা: রক্ত দিয়ে ভূর্জপত্রে প্রতিজ্ঞা লিপিবদ্ধ করে সে নিজেকে দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গ করেছে। তার জিহ্বা ছিড়ে নিলে বা চক্ষু তুলে নিলে কিংবা মস্তক চূর্ণ করলেও সে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। এক অভিজ্ঞ প্রৌঢ় অফিসার তার পিতৃবন্ধু রূপে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমি পুলিশ-কর্মী হলেও তোমার পিতৃবন্ধু। খবরদার, কারো কাছে কোনও স্বীকারোক্তি কোরো না। এমন-কি আমার কাছেও বেফাঁস কিছু বোলো না।’ পরদিন উনি তার পিতার সঙ্গে এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে দেখা করলেন। কিশোরটি বুঝতেও পারলো না যে ওইদিনই তার পিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। প্রত্যহই তিনি কাপড় বা মাথার তেল প্রভৃতি জিনিস এনে তাকে দিতেন। একদিন নিভৃতে ডেকে তিনি আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি আজ ফাইল দেখে অবাক। তোমাদের দলের বারোজনের মধ্যে তো ‘আটজন তো আমাদের লোক।’ বালকটি ‘অসম্ভব’ বলায় তিনি একটি নথি খুলে তাকে শোনাতে শুরু করেন: অমূখ তারিখে ভোর ছটার সময় তুমি অমুক দাদার তিনতলার ঘরে অর্গলবদ্ধ করে এই-এই দলনেতার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে। তোমাদের মধ্যে কথাবার্তা পাকা হলে তুমি পত্র ও অস্ত্র অমুক দাদার কাছে পৌঁছে দাও এবং তিনি এই-এই কথা তোমাকে বলেন। ঠিক কিনা?…এভাবে ভদ্রলোক তার প্রতিদিনের প্রতিটি মুভমেন্ট জানিয়ে দিলে সে কাঁপতে কাঁপতে দলের সমস্ত সংবাদ তাঁকে বলে দেয়। রাত্রিকালে অনুতাপ আসায় বালকটি কাপড়ের খুঁট গলায় আর লকআপের শিকে বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল।

কিছু কিশোরীও বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাড়িতে যখন তল্লাসী করা হয় তখন পুলিশ-কর্মী ও তার সাক্ষীদের দেহতল্লাসে সেই বাড়ির লোকেদের আইনী অধিকার আছে। একদিন ইংরাজ-ডেপুটির নেতৃত্বে গৃহে প্রবেশ করলে এক বালিকা আমাদের বললে, ‘পুরুষদের দেহ মেয়েরা তল্লাসে অক্ষম। অতএব মশাইরা, ওখানে সাতখানা গামছা আছে, পেণ্টুলন খুলে ওগুলো পরে ঘরে ঢুকুন।’ এইসব কথাবার্তার মধ্যে ওরা পিছনের দরজা দিয়ে মালপত্র পাচার করেছিল।

জনৈক ভদ্রলোক পুঁটলিতে বোমা বেঁধে হাওড়া স্টেশনে যাচ্ছেন খবর পেয়ে আমরা ওঁকে অনুসরণ করলাম। বাইরে থেকেই পুঁটলির ভিতরকার বোমার গোল-গোল আকার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ভদ্রলোক থামলে আমরা থামি এবং তিনি চলা শুরু করলে আমরাও চলতে থাকি। ওদিকে টেলিফোন-যোগে সশস্ত্র পুলিশকে পাঠাতে বলা হ’ল স্টেশনে। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে পুঁটলিটি সজোরে আছাড় দিলেন, ভয়ে আমরা পূর্বশিক্ষামতো স্পিলিন্টার এড়াতে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পড়লাম। পরে চোখ খুলে দেখি, না, আমরা কেহই আহত বা নিহত হই নি। ফুটি ও তরমুজের বড়ো-বড়ো কয়েকটা টুকরো শুধু চতুদিকে ছড়ানো। ওই ফলগুলি নষ্ট হওয়ায় ভদ্রলোক আমাদের কাছে মূল্যবাবদ দু-টাকা দাবি করেছিলেন।

অহেতুক ভীতি ও সন্দেহ অন্য ক্ষেত্রেও গোয়েন্দা-কর্মীদের বিব্রত করেছে। এঁরা কখনও এক পথ দিয়ে যাতায়াত করতেন না। মধ্যে-মধ্যে থমকে থেমে দাঁড়িয়ে পড়তেন। পিছনের পথিক সুমুখে এগোলে তবে তাঁরা চলা শুরু করতেন। আত্মীয়দের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হত না। একরাত্রে অন্ধকার ফুটপাতে চলতে-চলতে এক ভদ্রলোক থেমে দাঁড়িয়ে মুখে মোটা পাইপ গুঁজে অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছিলেন, তাই দেখে তাঁর গোয়েন্দা-শ্যালক পিস্তল উচিয়ে টিপ করেছিলেন। দেশলাইয়ের কাঠি ঠিক সময়ে জ্বলে উঠে মুখ আলোকিত না-করলে ভগিনীপতি হত্যার জন্য ওই ভদ্রলোক দায়ী হতেন।

[কিন্তু ওই মৃত্যুঞ্জয়ী সর্বত্যাগী তরুণ-দলের অধিকাংশই যৌবনের প্রগাঢ় ভাবধারা প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে পারেন নি। পরবর্তীকালে তাদের কেউ-কেউ সাধারণ ডাকাত ও প্রবঞ্চকের মতো হয়ে উঠেছিলেন। সর্বস্বত্যাগের ব্যর্থতা কারো মধ্যে উন্মাদনা এনেছিল। কেউ-কেউ পার্টির সম্পদ তছরুপ করে অন্য সদস্য দ্বারা নিহত হয়েছেন, কেউ-বা সেই অর্থদ্বারা ব্যবসা ফেঁদে ধনী হয়ে জীবন সার্থক করেছেন। অনেকেই অবস্থ আদর্শ-নিষ্ঠ হয়ে পরবর্তী জীবনে দারিদ্র্য বরণ করে নিয়েছেন সন্তুষ্টচিত্তে। এঁদের কার্যকলাপ গোপনে সমাধা হওয়ায় সেই স্বার্থ-ত্যাগ ও আদর্শনিষ্ঠার কোনও সংবাদই জনগণ বিশেষ জানতে পারেন নি।]

১৯৩৩ খ্রীঃ কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে ফেরারী বিপ্লবীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষকালে আমি উপস্থিত থাকলেও এই অসম-সংগ্রামে আমি কোনও অংশগ্রহণ করি নি। বিপ্লবীদের মরদেহ জোড়াসাঁকো এলাকার পুলিশ-মর্গে রক্ষিত হ’ত। গভীর রাত্রে আমি ওঁদের মরদেহ সেন্ট্রাল এভিনিউ ও বিডন স্ট্রীট ধরে নিমতলা ঘাটে পৌঁছে দিয়েছি। শবানুগামী তরুণদের পুলিশ-সম্পর্কিত উক্তিগুলি আমার কানে পৌঁছতো। এর আগে কোনও কটূক্তি আমার এতো ভালো লাগে নি।

কলকাতায় বহুকাল জুড়িগাড়ির প্রচলন ছিল। খপ খপ শব্দে এগুনো অশ্বদ্বয়ের সুমুখে একব্যক্তি ছুটতো ও চেঁচাতো: ‘তফাৎ যাও! তফাৎ যাও!’ এগুলির মধ্যে বনেদী বাড়ির একটি উল্লেখ্য ঐতিহ্য নিহিত ছিল।

কোনও এক বনেদী ধনীর বাড়িতে কেউ পায়ে হেটে এলে কোনও ঘণ্টাধ্বনি দ্বারা তাঁর উপস্থিতি ঘোষিত হ’ত না। এক ঘোড়ার গাড়িতে কেউ এলে পেটা-ঘড়িতে একটি মাত্র ঘণ্টা পড়তো। সেই সংকেতে বাড়ির কর্তামশাই অভ্যর্থনার জন্য কেবল প্রস্তুত হতেন। দুই ঘোড়ার গাড়ি হলে দুটি ঘণ্টা এবং কর্তামশাই সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে আসতেন। চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে কেউ এলে তিনটি ঘণ্টা এবং কর্তামশাই নিচে পর্যন্ত নামতেন।

কিছু ধনীব্যক্তির নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন শেষ সীমায় পৌঁছোয়। পূর্ব-পুরুষদের ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল পরিত্যক্ত। তাদের উপার্জিত-বিপুল ধনরাশি উত্তরপুরুষেরা পাল্লা দিয়ে নিঃশেষ করতে চাইছিলেন। কোনও পরিবারের রক্ষিতার সংখ্যানুযায়ী তাঁদের মর্যাদার বিচার করা হয়েছে। তবে মন্দের ভালো এই-যে রক্ষিতাদেরও তাঁরা বাড়ি ও অর্থ দিতেন, তাদের পুত্র-কন্যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। বিবাহিত স্ত্রীদের গর্ভজাত পুত্রগণ অপেক্ষা রক্ষিতাদের পুত্রেরা বহুগুণে সুশিক্ষিত ছিল। সেই-সব পুত্রদের মধ্যে বহুজনই নামী ও গুণীব্যক্তি হয়ে মূল সমাজে মিশে গিয়েছেন। বিধবা ও পরিত্যক্তদের আশ্রয় না-দিলে তারা বেশ্যা-সম্প্রদায়ভুক্ত হতে বাধ্য হ’ত। রক্ষিতা ও স্ত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ হলেও, এক বাড়ি হতে অন্য বাড়িতে তত্ত্বাদি ও উপহার পাঠানোর রীতি ছিল। এতে পুরুষদের মন সুস্থ ও আনন্দিত থাকায় তাঁরা যেমন, দীর্ঘজীবী ও দক্ষ কর্মী হয়েছেন তেমনি উদার-মনা স্ত্রীগণকেও বেশি করে সুখী করেছেন। এদের সন্তানদের মধ্যে সেই একনিষ্ঠতা ও সমদর্শিতা না-থাকায় বে-দরদী নারীদের দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। শুধু অর্থদ্বারা প্রেম ও শান্তি মেলে না। এঁদের ক্রমিক অধঃপতনের ইতিহাস ‘অপরাধ-বিজ্ঞানে’ যৌনজ অপরাধ শীর্ষক নিবন্ধে বিবৃত করেছি। পরবর্তীকালে এঁদের বৃহৎ বাড়িগুলিতে নওসেরা গ্যাঙ্গের আড্ডা হয়।

[একালে ভদ্রনারীদের অত্যন্ত সম্মান করা হ’ত। ট্রামে বা বাসে মহিলারা উঠলে তাঁদের না-বসা পর্যন্ত পুরুষ-যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। মহিলাদের জন্য আসন ছাড়তে ভদ্রজন মাত্রই ব্যগ্র হতেন।]

‘এই জোড়াসাঁকো থানা-বাড়িটিকে অভিশপ্ত মনে করা হ’ত। এখানে দুজন অফিসারের স্ত্রীবিয়োগ হবেই। জনপ্রবাদ: বহুপূর্বে এক দুঁদে ইনচার্জ এক দুর্ধর্ষ বিপুল-বপু গুণ্ডাকে সিড়ির নিচে পেড়ে ফেলে তার ভুঁড়ির উপর নাচতে শুরু করেন। তাতে যাবতীয় নাড়িভূড়ি গুহ্যপথে বার হলে তার মৃত্যু ঘটে। ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার বড়োবাবুকে খুনের মামলায় গ্রেপ্তার করতে এসে দেখেন যে তিনি কোয়ার্টারে হার্টফেল করে মারা গেছেন। তারপরও, গভীর রাত্রে সিঁড়ির নিচে উভয়ে মারামারি ও দাপাদাপি করে থাকে। ওই সিঁড়িটা অফিসার ও সিপাহীরা রাত্রিবেলা ব্যবহার করে না।

নয়া-রাস্তার মোড়ে এক জবরদস্ত জমাদারকে ঘোড়ায় গুঁতিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর পরও, ওই জমাদার রাত্রে কোনও সিপাহী ঘুমালে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। মৃত জমাদারের অদৃশ্য তদারকির ভয়ে কোনো সিপাহী ডিউটিতে ত্রুটি ঘটাতো না। অবশ্য এর প্রত্যেকটি ছিল ওদের অলীক কল্পনা মাত্র।

[পূর্বে এক দুঁদে অফিসার পুরাতন পাপীদের হাজত হতে বার করে দেহ মর্দন করাতেন। ঘুমের আমেজে তিনি চক্ষু মুদ্রিত করেছেন, সেই সুযোগে একজন আসামী পালালো। উনি কাগজে পত্রে তার মামলা ব্যারাকপুর কোর্টে ট্রান্সফার করে, অন্যজনকে পলায়নে প্রতিরোধ না-করার অপরাধে ঘুষি মারলেন। আচমকা ঘুষি খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়লো এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় মারা গেল। ইনচার্জবাবু তাতে না-ঘাবড়ে তাকে হাতকড়ি পরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে তদন্তে বেরুলেন। হাওড়ার পোল বন্ধ থাকায় তিনি তাকে নৌকাতেও তুলেছিলেন। পরে থানায় ফিরে তার লাফ দিয়ে ডুব সাঁতারে পালাবার একটা প্রতিবেদন পর্যন্ত লেখেন। কিন্তু ওই মৃত আসামী মাঝে মাঝে রাত্রে থানায় এসে বড়োবাবুকে খোঁজে। তাই সর্বদা প্রতি ঘরে দুটো করে লাইট জ্বালিয়ে রাখার রীতি।]

কোনও এক প্রৌঢ় পুলিশ-কর্মী কয়েদীদের ডেকে উপরে নিজেদের কোয়ার্টারে ঠাকুর-ঘরের সামনে এনে বলতেন, ‘ওই আমাদের লক্ষ্মী-মা আর ওই যে নারায়ণ, এঁদের দুজনকে স্পর্শ করে বলছি, তোরা স্বীকার করে জিনিসগুলো বার করলে তোদের মুক্তি দেবো।’ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই প্রতিবার তিনি করতেন। সেই-সব পাপ থানা-বাড়ির ইটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমা ছিল।

এইরূপ বহুবিধ প্রবাদ-যুক্ত থানা-বাড়ি থেকে মুক্ত হতে অফিসাররা ব্যস্ত হয়। তাঁদের স্ত্রীরা হিস্টিরিয়া-রোগে ভুগেছে। কারো কারো দুরারোগ্য রোগভোগ বা মৃত্যু ঘটেছে। বড়োবাবু সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি এ-সবে বিশ্বাস না করলেও সঙ্গে দুজন সিপাহীকে মোতায়েন রাখতেন। কিছুদিন পরে তাঁর স্ত্রী হঠাৎ রুগ্ন হয়ে থানার কোয়ার্টারেই দেহত্যাগ করলেন। তার একমাস পরে সেকেণ্ড অফিসার রহমন সাহেবের নব-পরিণীতা স্ত্রী জুবেদা বিবিও দেহরক্ষা করলেন।

[এরূপ অঘটন বন্ধের জন্য থানার মধ্যে মিলাদ শরীফ ও সত্যনারায়ণের পূজার রীতি ছিল। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা বন্ধ করা হয়।]

আমরা কোয়ার্টারগুলির অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার বিষয় বিবেচনা না করে শুধু প্রবাদগুলির উপরই বিশ্বাস স্থাপন করলাম। দুজনের স্ত্রী-বিয়োগের পরই থানা হতে যথারীতি বদলির হিড়িক পড়ে। এবারও সেই পঞ্চবার্ষিক ইতিহাসের পুনরুক্তি ঘটলো। বহু স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকো থানা ত্যাগ করে আমরা অন্যত্র বদলি হলাম। সত্যেন্দ্র মুখার্জি লালবাজারে গোয়েন্দা বিভাগে এবং আমি শ্যামপুকুর থানায় যোগ দিলাম।

সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি

তাঁর মতো সুদক্ষ পুলিশ-কর্মী শুধু ভারতে নয় পৃথিবীতে বিরল। শিকারীবিড়ালের মতো তিনি লহমায় অপরাধী চিনতেন। আমার সৌভাগ্য এই-যে আমার পুলিশী-শিক্ষা তাঁর নিকট পাই। ফলে, ইংলণ্ড ও মার্কিন দেশে প্রকাশিত পৃথিবীর উল্লেখ্য পুলিশী তদন্ত-পুস্তকে সাতটি ভারতীয় মামলার মধ্যে আমার তদন্ত-কৃত তিনটি মামলার স্থান পেয়েছে। তিনি অবসরগ্রহণ করলে তাঁর স্থলে আমি ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার (I.P.S.) হই।

রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি কোচোয়া-ধোলাই ও সত্যেন-মিক্সচারের প্রবর্তক। প্রথমটির দ্বারা শহরের গুণ্ডারা বিলুপ্ত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টির দ্বারা স্কুলগামিনী বালিকাদের পশ্চাৎ-অনুসরণকারী মস্তানগণ নিশ্চিন্ন হয়। তাঁর ভয়ে উৎকোচ গ্রহণকারী ও অন্যায়কারী ঊর্ধ্বতনরাও সংযত হতেন। (অশ্ব বিষ্ঠা + গোময় = সত্যেন-মিক্সচার।)

কলিকাতা পুলিশের মধ্যে বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তিনি এবং তাঁর সহকারীরূপে আমি প্রথম প্রতিবাদ করি। ইংরাজ অফিসার ও অ্যাংলো-সার্জেন্টদের ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশ ছিল না। পুলিশ-অ্যাম্বুলেন্সেও দেশীয়দের উপযুক্ত মর্যাদা নেই। ভারতীয় ও ইংরাজদের বাথরুম ও ল্যাভেটরি পর্যন্ত পৃথক। ওদের সুযোগ-সুবিধাও বহু বিষয়ে বেশি।

আমরা উভয়ে একত্রে এগুলির প্রতিকারে সতর্কতার সঙ্গে নামি। আমাদের প্রচেষ্টায় পৃথক পুলিশ-ক্লাব সৃষ্টি হ’ল। তার অনুসঙ্গ হিসাবে ফুটবল-ক্লাব এবং পুলিশ-লাইব্রেরিও স্থাপিত হ’ল। কলিকাতাবাসী প্রায় প্রতিজন লেখক এই লাইব্রেরিতে পুস্তক-দান করেন। লাইব্রেরিটি আমার প্রচেষ্টায় সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠেছিল। আমরা পৃথক অ্যাম্বুলেন্স-ডিভিসনও তৈরি করলাম। পরে আমি তার কোর-সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছিলাম। সত্যেন্দ্রবাবু বাহিরের মহিলাদের সাহায্যে কর্মীদের অভিনয়ের প্রবর্তক। আমি ‘কলিকাতা-পুলিশ জার্নাল’ প্রকাশ করে তার সম্পাদক হয়েছিলাম। (এটি ভারতে প্রথম পুলিশ-পত্রিকা।) এই পত্রিকায় স্যর যদুনাথ সরকার, ডঃ সত্য লাহা ডঃ নরেন লাহা, ডঃ বিমল লাহা, ডঃ সুধীর মিত্র, ডঃ হরিপদ মাইতি, ডঃ অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় সহ ভারতের ও পৃথিবীর বহু মনীষী প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকেও আমরা লেখার জন্য অনুরোধ করি ও বলি: ‘বাংলা-সাহিত্যে পুলিশ হরিজন হয়ে আছে। আপনার পূত-কলমের স্পর্শে তারা উদ্দীপিত হোক। আপনার কাছে তাদের জন্য স্পেশাল ফেবার চাই।’ উনি লেখা দিতে না-পারলেও একটি উপদেশপূর্ণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পত্রে পুলিশের প্রতি এমন-কিছু উপদেশ ছিল যা তৎকালীন ইংরাজ-প্রভুরা মুদ্রণ করতে দিলেন না।

এরপর আমরা উভয়ে কলিকাতা পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সৃষ্টি করলাম। এতে অ্যাজিটেটররূপে উভয়ের কিছু বদনাম হলেও বহু ন্যায্য দাবি আদায় করা হয়। পরবর্তীকালে আমি তার অন্যতম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলাম। এতদসত্ত্বেও আমি ‘পুলিশ-মেডেল’, ‘সেবা মেডেল’ প্রভৃতি বহু পদকে ভূষিত হই এবং দ্রুতগতিতে পর-পর প্রমোশন পেতে থাকি। ইংরাজ কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে উদারতা ও সহনশীলতা লক্ষণীয়। রায়বাহাদুর সত্যেনবাবুও সরকার প্রদত্ত প্রতিটি ডেকরেশন প্রাপ্ত হয়ে সর্বোচ্চ পদে ওঠেন।

বাংলা-পুলিশ থেকেও একটি বেঙ্গল পুলিশ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছিল। পরে, গভর্নমেন্টের নির্দেশে উভয় পুলিশের পত্রিকা একত্রিত করে ‘দি পুলিশ জার্নাল’ বার হলে বাংলা-পুলিশের পক্ষে অমূল্য সমাদ্দার এবং কলিকাতা-পুলিশের পক্ষে আমাকে তার সম্পাদক করা হয়।

[স্বাধীনতার পর, ভারত সরকারের কলিকাতাস্থ ডিটেকটিভ ট্রেনিং-কলেজে ও ফোরেনসিক ল্যাবরেটরিতে আমি ভারতের প্রথম ক্রাইম-মিউজিয়ম স্থাপন করি। আমার দীর্ঘকাল যাবৎ সংগৃহীত প্রদর্শনী-সত্তার দ্বারা মিউজিয়মটি সজ্জিত করা হয়েছিল। পরে আমি মাউন্ট আবু কেন্দ্রিয় পুলিশ-ট্রেনিং কলেজে এবং ব্যারাকপুরস্থ প্রদেশ-পুলিশের কলেজেও সেই সম্ভার পাঠিয়েছিলাম। গড়ের মাঠে পুলিশ-প্রদর্শনীতেও বহুবার এই দ্রব্যগুলি প্রদর্শিত হয়েছিল।]

রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জির একজন ধর্মপ্রাণ আর্দালী ছিল। মাথার টিকিতে গিঁট বেঁধে, কপালে চন্দন লেপে সে পূজাকর্মে ব্যস্ত থাকতো। তাকে কোনও দিন পুলিশের ডিউটি দেওয়া হয় নি। প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করে ফেরার সময় সে একজন পকেটমারকে নামাবলীতে এবং দুজন ছিনতাইকারীকে কাপড়ের খুঁটে বেঁধে থানায় আনতো। এই লোকটির পুরানো পাপীদের চিনবার ক্ষমতা ছিল অদ্ভুত। অনবরত মুখে সীতারাম-সীতারাম বলে সে ওদেরকে ধরে থানায় আনতো।

[বিঃ দ্রঃ কিছু ধর্মপ্রাণ ইনস্পেক্টরও কলিকাতা পুলিশে ছিল। অফিসে বসার পূর্বে জনৈক ইনচার্জবাবুর এক সিপাহী গঙ্গাজলের ঘটি হাতে অপেক্ষা করতো। ইনচার্জবাবু চেয়ারে ও টেবিলে গঙ্গোদক ছিটিয়ে আসন গ্রহণ করতেন। ডিসপোজাল তথা মড়ার গতির কাগজে সই করতে হলে তিনি দুবার স্নান করতেন। প্রতি সন্ধ্যায় একজন মুশ্লিম সিপাহী আমজাদিয়া হোটেল থেকে তাঁর জন্য মটন-চপ আনতো। সেটি ভক্ষণ করে গঙ্গাজলে শুদ্ধ হয়ে তিনি সান্ধ্যস্নান করতেন। ওই সিপাহীটি ছুটি নিলে পরবর্তী জন ভুল করে তাঁর জন্য বিফ চপ আনতে থাকে। থানার হাবিলদার তা একদিন লক্ষ্য করে ধমকে বললে, ‘আৱে এ ক্যা করতা? তুহর নোকরি যাবে।’—ওই নতুন লোকটি ভুল শুধরে পূর্বের মতো মাটন-চপ নিয়ে এলে ইনচার্জবাবু চিৎকার করে বললেন, ‘কাহে খারাপ চীজ লে আতা? তুম কভি আমজাদিয়া-মে গয়া নেহী।…পরে অন্য এক সিপাহী সেই একই মাটন-চপ এনে দিলে তিনি সখেদে বলেন, ‘নাঃ। আমজাদিয়া আর ভালো-জিনিস তৈরি করে না।’]

ওই রকম ব্যক্তিগত কাজে সরকারী কর্মীনিয়োগ এবং সিপাহীদের আর্দালীরূপে ব্যবহার পরে আমি ও সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি বন্ধ করে দিই। ওদের দ্বারা বাজার-করানো বা ছেলে-ধরানো কাজ করালে ওরা নির্ভয়ে উৎকোচগ্রাহী হ’ত। এমন কি উৎকোচগ্রাহীদের নিকট হতে তারা উৎকোচের ভাগ জোর করে নিতো। অন্তঃপুরের সঙ্গে যোগ থাকায় অফিসাররা স্ত্রীদের ভয়ে ওদের কিছু বলতে সাহসী হতেন না।

জোড়াসাঁকো থানায় থাকাকালে পার্শ্ববর্তী সুকিয়া থানার বড়োবাবু কিছুদিন ছুটি নিলেন। তাঁর কাজ আমি করতাম প্রত্যহ জোড়াসাঁকো থেকে সুকিয়া থানায় গিয়ে। হঠাৎ একদিন ইংরাজ ডেপুটির আর্দালী ফোন করলো: ‘তুম কাহে নেহি মুর্গি ভেজা?’…আমি রেগে প্রতিবাদ করে তাকে কটূক্তি করেছিলাম। একটু পরেই ডেপুটি কমিশনার স্বয়ং থানায় উপস্থিত হয়ে আমাকে সেখানে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘ওঃ তুমি! মমতাজ মিয়া ছুটিতে বটে। আমার আর্দালীকে তুমি কিছু বলেছো?’ উত্তরে আমি বললাম যে ওর মুর্গির কথা কিছুই বুঝিনি।… শুনলাম, থানা হতে প্রত্যহ ওঁর কিচেনে একটি করে মুর্গি পাঠানো হ’ত। ডেপুটি সাহেব স্থানত্যাগ করলে আমি থানার হাবিলদারকে হুকুম দিলাম: ‘দেখো ভাই, বাজার-সে এক মুর্গি ভেজকে সাহেব-সে দাম লে নেও।’ হাবিলদার আমার মূঢ়তায় বিস্মিত হয়ে বললে, ‘দাম দেগা তো উনে হী কোহিকো ভেজকে বাজারসে লে-লেতা। দাম-উম সব-কুছ আপ-হি কো দেনে পড়ে গা, বাবুসাব।’

মমতাজ মিয়া সাহেব থানার প্রাঙ্গণে খোঁয়াড় করে কিছু লেগহর্ন মুর্গি পুষে ছিলেন। বিদেশ হতে আনা এই মুর্গিগুলির দাম সাধারণ মুর্গির চেয়ে অনেক বেশি। আমি ওগুলি হতে একটিকে তুলে সাহেবের কিচেনে পাঠিয়ে দিলাম। পরদিন পূর্বতন ইনচার্জের বিবি তা জেনে খোঁয়াড়ে চাবি দিলেন। আমার হুকুমে জনৈক সিপাহী রাত্রে বেড়া-টপকে অন্য একটিকে ধরে সাহেবকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্ত্রীর টেলিগ্রাম পেয়ে মমতাজ সাহেব ফিরে এসে আমাকে বললেন, ‘ঘুযুলবাবু, এ আপ ক্যা কিয়া? মেরি লেড়কা-লোককো জবাহ হুয়া।’ আমি দুঃখিত হয়ে বললাম, ‘জানি এরা লেড়কার মতো প্রাণের জীব। কিন্তু থানার চার্জ বুঝিয়ে দেবার সময় মুর্গির চার্জ বুঝিয়ে দেন নি কেন? মুর্গি কেনার মতো আমার অর্থ ছিল না।’

পরদিন পূর্বের মতো ছোট দেশী মুর্গি দেখে ইংরাজ ডেপুটি-সাহেব অগ্নিমূর্তি হয়ে মমতাজ মিয়া-কে ডেকে বললেন, ‘নয়াবাবু অনেস্টম্যান হো-কে আচ্ছি স্টাফ ভেজনে শেখা। তুম ঘুষ খাতা তঁভি ওইসেন আচ্ছি চিজ নেহি ভেজা।’ মমতাজ সাহেব কেঁউ কেঁউ করে অনুযোগ করে ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘ঘুষুলবাবু আপ মেরি সত্যনাশ কর চুকা।’

[এই সময় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পামার সাহেব পেশকারদের ঘুষ বন্ধ করতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিলেন: ‘অদ্য হইতে পেশকারদের আর্ট আনা পয়সা ‘ঘুষ দেওয়া চলিবে না।’ পরদিন পেশকারবাবু মক্কেলদের ডেকে বুঝিয়ে বলে দিলেন: ‘উহুঁ এখন থেকে আট আনার বদলে একটাকা। ওই দেখুন হাকিমের হুকুম। এখন রেট বেড়ে একটাকা হয়েছে।’]

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই-যে পেশকারবাবুদের উৎকোচ গ্রহণ হাকিমদের নাকের ডগায় সমাধা হ’ত। বহু হাকিম অবসর গ্রহণ করে তাঁদেরই পেশাকারদের তৈরি বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে থেকেছেন। …হঠাৎ পেশকারের হাত থেকে একটি টাকা টঙ করে মেঝেতে পড়লে হাকিম ধমকে বলেছেন: ‘কি হচ্ছে মশাই?’ পেশকারবাবু ‘কাগজ গুছাচ্ছি’ বললে হাকিম আবার বলেছেন: ‘মশাই, ভালো করে গুছান।’

থানার স্বল্পলোভী সিপাহী ও জমাদারদের রেট যথাক্রমে আট আনা ও একটাকা এবং সার্জেন্টদের পাঁচটাকা। এর কমে কেউ তাদের হাতে কিছু দিনে তারা অপমানিত বোধ করে তার নামে উৎকোচ-প্রদানের মামলা রুজু করতো।

শোনা গেছে, বহু বিট-কনস্টেবল গাড়োয়ানদের উদ্দেশে বলেছে: ‘এ গাড়োয়ান, একপাশ মে সাদা বয়েল আউর একপাশ-মে কালা বয়েল না চলি।’

একরাত্রে জনৈক ডেপুটি-হাকিম এবং তার মুন্সেফ -বন্ধু ছুটিতে স্টেশন থেকে রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলেন। জনৈক ডিউটি-সিপাহী রিকশাওয়ালাকে ডেকে বললে, ‘এ গাড়িমে যাতা কৌন?’ এতে হাকিমবাবু ক্ষেপে উঠে সিপাহী-মহারাজকে ধমক দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক বুঝে সিপাহী কিছুটা পিছু হটেছিল। কিন্তু তাঁর গালি না থামায় সে-ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঁদের দুজনকে রিকশা হতে নিচে নামিয়ে, দুজনের হাত রিকশা-চালকের গামছা দিয়ে বেঁধে, রদ্দা হাঁকাতে-হাঁকাতে থানায় আনলো। সেইরাত্রে থানায় আমি উপস্থিত ছিলাম। সিপাহীটি ওঁদের দুজনকে আমার সমুখে এনে একটা অদ্ভুত বয়ান দিয়েছিল:

‘হম নয়া রাস্তা-মে দো ঘড়িসে চার ঘড়িতক্‌ ডিউটিল থা। রাত আড়াই বাজে আন্দাজ এহি দো পুরানো চোর উত্তর-সে দক্ষিণ-তরফ যাতি থি। হমকো দেখকে ১নং আসামী (ডেপুটি হাকিম) ঝপটসে লপট গয়া ফুটকো পর, যাঁহা কাঙালিলোক শুয়ে থে উনকে বিচমে। আউর দোনং আসামী (মুন্সেফবাবু) এহি গামছা-মে মুখ ছিপাকে গ্যাসকো অন্দর ঘুস গ্যয়া। ওহি গামছা-সে দুনোকো পকড়কে তুরণ বাঁধ চুকা। নেহিতো রাঁতোমে এলাকামে এক বড়িয়া চুরিউরি হো যাতা থি।’

পরে এই সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মিগণও বিপদে পড়েছিলেন। কারণ, গভর্নমেন্ট ওদের ট্যাকসির বদলে রিকশা ব্যবহার করায় অত্যন্ত বিরূপ হয়েছিলেন। [কোনও এক সিভিলিয়ন-সাহিত্যিক (I. C. S) অন্য কজন বন্ধু-লেখকের সঙ্গে চিনেবাদাম খেতে-খেতে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রামে উঠলে আমরা গভর্নমেন্টে রিপোর্ট পাঠাই। তাতে ভদ্রলোক চাকুরি-জীবনে আর একটুও সুবিধা করতে পারেন নি। এ সময়ে পদমর্যাদা অনুযায়ী যানবাহন ব্যবহারে উচ্চপদস্থদের বাধ্য করা হ’ত।]

জনৈক ইংরাজ ডেপুটি-কমিশনার রাত্রে একজন সিপাহীকে পানের দোকানের সুমুখের বেঞ্চে পাগড়ি ও বেল্‌ট খুলে ঢুলতে দেখে মোটর থেকে নেমে সেগুলি তুলে গাড়িতে উঠলে, পান-বিক্রেতা সিপাহীটিকে জাগিয়ে দিয়েছিল। সিপাহী মোটরের নম্বরটি টুকে নেয়। তারপর সে উর্দিতে কাদা মাখিয়ে, জামার পকেট ছিঁড়ে, থানায় এসে এজাহার দিলো যে এক মাতোয়ালা সাহেব তাকে মেরে মাটিতে ফেলে জামা ছিঁড়ে তার কোমরের বেল্‌ট ও মাথার পাগড়ি ছিনিয়ে মোটরযোগে পালিয়েছে। আমি কোনোমতে তার মোটরের নম্বর টুকে নিয়েছি।…

তদস্তের সময় তার বিবৃতির সমর্থনে একজন মুটে একজন পানওয়ালা ও দুজন ভুজাওয়ালাকে সাক্ষীরূপে পাওয়া গেল। থানায় মোটরের আরোহী সেই সাহেবের নামে হুলিয়া-সমেত পাগড়ি চুরি, রাহাজানি ও পুলিশ-কর্মীকে প্রহার প্রভৃতি অভিযোগও লিপিবদ্ধ হ’ল। পরদিন রিপোর্টরুমে ডেপুটি সাহেব মামলার বিবরণ ও সাক্ষীসাবুত শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন যে বিলাতে ছাত্রাবস্থায় ইণ্ডিয়ান পুলিশ সম্বন্ধে বহু বিরূপ মন্তব্য শুনেছিলেন বটে কিন্তু সেগুলি যে এত দূর নির্মম সত্য তা তিনি কখনো কল্পনাও করেন নি।

অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার প্রভাতনাথ মুখার্জির নেতৃত্বে সত্যেনবাবু, আমি ও নীহার এই-সব অনাচার ও উৎপীড়ন বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলাম। ফলে উত্তর কলকাতা হতে উৎকোচ, জুয়া ও কোকেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। জনসংযোগের ফলে ওগুলির প্রতিটি সংবাদ আমাদের গোচরে এসেছে। এক থানার কর্মীরা। অন্য থানা এলাকায় মুফতিতে ঘুরে সিপাহীদেরও উৎকোচ গ্রহণ বন্ধ করেছিল।

তবে ভদ্র-মদ্যপদের প্রতি আমাদের ব্যবহার খারাপ ছিল না। ওইকালে উত্তর কলকাতায় ৭৯২ জন ভদ্র-মাতাল ছিল। এরা উচ্চাঙ্গের কথা বলতো ও ব্যবহারেও খুব অশিষ্ট হ’ত না। আমরা এদের সাবধানে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি। তখন লক্ষ্য করেছি যে ওদের প্রত্যেকের স্ত্রী সুন্দরী ও ভক্তিমতী। স্বামীদের জন্য ওই-সব সেবাপরায়ণা স্ত্রীদের ভাবনার অন্ত নেই। এতটা স্ত্রী-ভাগ্য অ-মদ্যপদের মধ্যে বড়ো-একটা দেখি নি। তৎকালে প্রবাদ এই-যে মাতালের স্ত্রীরা এবং পুলিশ-কর্মীদের মায়েরা অত্যন্ত সৎ ও স্নেহপ্রবণ হতেন। একজন মদ্যপ-অভিনেতাকে রাজপথে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি বলেছিলেন: ‘খবরদার! হম আলমগীর হ্যায়।’ অন্য এক অভিনেতা রিকশাচালককে দশটাকা দিয়ে তাকে ওই রিকশায় বসিয়ে নিজে গাড়ি টেনে এক পেট্রোল পাম্পে এসে বলেছিলেন: ‘এই গাড়িতে পেট্রোল দাও। ইঞ্জিন ভালো স্টার্ট নিচ্ছে না। গাড়ি বড়ো টলছে।’…এক নবীন অভিনেতা ধাত্রীপান্না নাটকে অভিনয় করে স্টেজ হতে নেমে এক ব্যক্তির জামার কলার চেপে ছুরি উচিয়ে বলে উঠেছিল: ‘এই শালা! বল্‌, উদয় কোথায়?’

একরাত্রে পুরু বনাতের ওভারকোট পরে দীর্ঘদেহ সোজা করে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। সেই শীতকালে হঠাৎ হাতের মুঠিতে শীকর কণার স্পর্শে ফিরে তাকিয়ে দেখি যে এক মদ্যপ আমার পিছনে মূত্রত্যাগ করছে। আমি ক্ষেপে উঠে তাকে ভর্ৎসনা করলে সে-ও অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘ও বাবা, তুমি মানুষ, আমি মনে করেছিলাম ল্যাম্পপোস্ট।’…কোনও এক সুসাহিত্যিক পাত্রের সবটুকু পানীয় গলায় ঢেলে বন্ধুদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন: “ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি মদ না খেলেও মদ্যপদের শ্রদ্ধা করেন।’… কোনও -এক অভিনেত্রীর বাড়ি তল্লাসীকালে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি উদাত্তকণ্ঠে বলেছিলেন: ‘চেনো নাকো মোরে? শোনো নাই মোর নাম? পুণ্য হেম যার দ্বারে রহিত দাড়ায়ে। আমি নাট্যসাম্রাজ্ঞী, রিজিয়া আমার নাম। আমি আদেশ করিতে জানি, আদেশ শুনি নাই কভু।’

তৎকালীন কলিকাতা-পুলিশ এই শ্রেণীর মাতালদের কখনও অসম্মান করেন নি। বরং সর্বতোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন ও নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন থেকেছেন। এই-সব প্রতিভাবান ব্যক্তিদের দ্বারা সমাজের বহুবিধ কল্যাণের সম্ভাবনা বুঝে তাঁরা ওঁদের প্রতি বরাবর সহৃদয় ছিলেন। কিন্তু এই বিদেশী-প্রথা মদ্যপান-অভ্যাস বহুব্যক্তির চরিত্র শিথিল করে—অনেকেই চরিত্রহীন হয়ে পড়েন। রক্ষিতার বদলে প্রায়শই তাঁরা বেশ্যাসক্ত হন। যে আসক্তি চরিতার্থ করতে মাত্র দশটাকাই যথেষ্ট, অহমিকার বশবর্তী হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার টাকা ব্যয় করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হন না। তাঁরা সম্ভোগ করবেন অথচ পূর্বপুরুষদের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না। এতে তাঁদের প্রতিভা নির্মূল ও স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়। পরে তাঁরাই পথের ভিখারীতে পরিণত হন। অনেকেই তা হয়েছিলেন।

‘হুজুর, একটি সুন্দরী নারীর সন্ধান পেয়েছি। আপনি অনুগ্রহ করে যদি একবার তার প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন…’ মোসাহেবের সবিনয় নিবেদন: ‘কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে, হুজুর। বেটিকে আপনার সামনে নিতে আসতে পারতুম, আসতেও সে রাজি, কিন্তু লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছে। হুজুরের উচ্চ রুচির কথা তার জানা আছে, সজ্জিত হতেও সে জানে, মুশকিল হয়েছে এই যে অঙ্গসজ্জার জন্যে একটিও স্বর্ণালংকার তার নেই।’

“এই কথা! আমি এখনই সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি।’ বলে জমিদারবাবু চেক বইখানা বার করে খসখস কি লিখে বাড়িয়ে দিলেন মোসাহেবের দিকে: ‘এই নাও। দশ হাজার টাকার সোনার গহনা কিনে ওকে দেবে। মনের মতো সাজতে বলবে। সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলে তুমি এসে আমাকে নিয়ে ষেও।’

মোসাহেবের সঙ্গে সেই সুন্দরীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন জমিদারবাবু। পান খেতে চাইলেন। নিখুঁতভাবে সজ্জিতা সেই সুন্দরী পরম যত্নে পান সেজে দিল। তিনি পান খেয়ে চলে আসতে চাইলেন। সুন্দরী স্বভাবতই তাঁকে আবার আসার জন্যে অনুরোধ করল। তাতে তিনি বিরক্ত হয়ে স্পষ্টস্বরে বললেন, ‘তোমার জানা থাকা ভালো, আমি এক মেয়েমানুষের বাড়িতে দুবার খাই না।’

আর-একবার এক জমিদার পুত্র ময়দানে বেড়াতে গিয়ে এক কুলটা নারী বক্ষ প্রদর্শন করলে তিনি তাকে তখনই আহ্বান করে গাড়িতে তোলেন এবং সোজা থানায় এনে ক্রুদ্ধস্বরে বলেন, ‘এই মেয়েলোকটি ভেবেছে কি। নারীবক্ষ কি আমি দেখি নি? আমার চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমি ও-জিনিস নিয়ে খেলা করছি আর আমাকেই কিনা…’

[ধনী রাজা ও জমিদারদের এই নির্বিচার যৌন মিলন এবং তৎসহ যৌনরোগ অন্য বিষয়ে একপ্রকার উপকারে এসেছিল। এতে কোনও রূপে একটি সন্তানের জনক হতে পারলে ভবিষ্যতে নানান ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। এক সন্তানের ফলেই পুরুষানুক্রমে বহুজনের হাতে জমিদারী বিভক্ত হয় নি।]

কিন্তু পুলিশের মুশকিল হ’ত এই যে এই-সব পড়তি ধনীপুত্ররা পূর্বঠাট বজায় রাখতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে নিজেরাই অপরাধী হয়ে যেতো। পরবর্তীকালে এদের বিরাট বাড়িগুলি বিড -গ্যাম্বলার ও নওসেরা দলের আশ্রয়স্থান হয়।

সেন্ট্রাল এভেনিউ তখন পুরোপুরি তৈরি হয় নি। চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ বস্তি-অঞ্চল। ওই জায়গাটা বৃত্তিগত পুরানো পাপীদের নিরাপদ আস্তানা হিসাবে পরিগণিত ছিল। সুসংগঠিত অপদলগুলি শহরকে নিজ-নিজ নির্দিষ্ট এলাকাতে ভাগ করে নেওয়ার ফলে এক-এলাকার লোক অন্য-এলাকায় ‘কর্ম’ করতে এলে খুনোখুনি ও মারামারি অনিবার্য হয়ে উঠতো। আপন আপন এলাকার খুঁটিনাটি অলিগলি তাদের নখদর্পণে থাকায় তারা গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হ’ত। থানার সামনে ঘোরাঘুরি করে পুলিশ-কর্মীদের চিনে নিয়ে সাবধান হয়ে যেতো। নিজেদের কর্ম-পন্থা সাবলীল ও সুষ্ঠু করবার জন্যে তারা নিজস্ব অফিস বা আড্ডা পর্যন্ত গড়ে তুলেছিল। প্রতি-দলে অধিনায়ক বা সর্দার ছিল একজন করে। সারাদিনের উপার্জন তার কাছে জমা দেওয়া হলে সর্দার প্রতিরাত্রে সকলকে সমান ভাগ দিত। এতে কোনোদিন একজনের আয় কম হলে কিংবা কিছুই না হলে সে দুঃখিত হ’ত না। এরা বিচিত্র চরিত্র।

সায়ান্স কলেজের ডঃ পালিতের কাঁধ থেকে দামী ছাতাখানা তুলে চোখের নিমেষে একজন উধাও। ডঃ পালিত দুটো ধাক্কা খেয়েছিলেন, সামলে নিয়ে যখন তাকালেন তখন ছাতার টিকিও দেখতে পেলেন না। তিনি জমাদারের কাছে গিয়ে নালিশ করেছিলেন, জমাদার বলেছিল আমাকে। জমাদারের বয়ান: ‘হুজুর, ইনে আপকো মাস্টার থি। তব তো উনকো ছাতা মিলনে চাহী।’

জমাদার তাঁকে ছোট-করিমের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ছোট-করিম সব শুনে বলেছিল: ‘হাঁ। উ তো হামারি এলাকা হোগা। পিছু দুনো ধাক্কা আপকো মিলি তো ওহী হামার আদমী থি। আইয়ে–’ বলে সে তাঁকে একটা মাঠকোঠায় নিয়ে এল এবং সেখানে রাশিকৃত ছাতা দেখে তিনি তো অবাক। বহুক্ষণ অনুসন্ধানের পরও তিনি নিজের ছাতাটি খুঁজে পেলেন না দেখে ছোট-করিম বলেছিল: ‘ওটা তাহলে এখনও জমা পড়ে নি। আধঘণ্টা পরে ওই ছাতা নিয়ে যাবেন।’

পুলিশ-কমিশনার সাহেবের এক বন্ধু মহারাজার জামাতা–তাঁর ঘড়িটি গুণ্ডারা ছিনতাই করে নিয়েছিল। ওই ঘড়ি উদ্ধারের কাজে থানার ইনচার্জবাবু বড়-করিমের সাহায্য গ্রহণ করলেন। তবে শর্ত হ’ল এই যে ঘড়ি উদ্ধারের পর কোনও মামলা রুজু করা চলবে না। বড়-করিম জামাতা-বাবাজীকে নিজের আস্তানায় এনে তাঁর চোখ দুটো পুরু কাপড়ে বেঁধে ছ্যাকড়া গাড়িতে তুলল এবং কিছুদূরে গহন বস্তি-অঞ্চলে এসে এক মাঠকোঠার সামনে থামল। চোখ খুলে দেওয়া হ’ল। দেওয়ালে বহুসংখ্যক মূল্যবান ঘড়ি টাঙানো রয়েছে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তার মধ্যে তাঁর ঘড়িটিও ছিল। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে একটি হীরকখচিত স্বর্ণনির্মিত ঘড়ি সনাক্ত করে নিজের বলে দাবি করায় বড়-করিম তাঁকে যথেচ্ছ গালিগালাজ করে বলেছিল: ‘হামলোকসে তু’লোক বড়িয়া চোর আছে। আপকো ঘড়ি ওই কোণা মে মজুত হ্যায়। একোভি ঘড়ি আপকো নেহি মিলেগা। যাও ভাগো—’ তাঁকে ঠিক সেইভাবে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ওরা নয়া রাস্তার মোড়ে ছেড়ে দিয়ে যায়।

ওরা নিজেদের জন্য একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নিয়েছিল। কোনও এক পিকপকেট-সর্দারকে তার রক্ষিতার গর্ভজাত পুত্রকে আদর করে বলতে শুনেছিলাম: ‘এশালে হামসে ভি বোড়ো চোর হোবে। এ শালে বেদাগী চোর আছে। হা হা হা।’ হাজতঘরে রাত্রে জোট বেঁধে বসে এবারকার কাম বা হিম্মত কার কত বেশি তা গর্ব করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতো।

প্রিভি কাউন্‌সিলে শরীকী মামলার জন্য কিছু সংখ্যক বড় বাড়ি হানাবাড়ি রূপে পরিচিত ছিল। শহরে রোজা না-থাকাতে ভূতের উপদ্রব বন্ধের জন্য পুলিশের ডাক পড়তো। আমি একরাত্রে এক প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখি যে এক গোল স্তম্ভের উপর চেয়ারে বসে এক দাড়িওলা ব্যক্তি পা দুলিয়ে ঘুষি দেখাচ্ছে। আর ওই নাতিদীর্ঘ গোলাকার স্তম্ভটি এ-কোণ থেকে ও-কোণে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো যাচ্ছে আর আসছে। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি বড়ো চেয়ারে ফোকর সৃষ্টি করে এবং কোমর স্থাপন করে লম্বা পা দুটি সাদা অয়েল ক্লথে জড়িয়ে বিভ্রমকারী স্তম্ভ রচনা করেছিল। তার ঝুলানো পা দুটি কৃত্রিম হলেও হাত মুখ ও দাড়ি নিজেরই ছিল।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বাড়িতে নাচ-গানের আসর করেন। প্রবাদ—তখনও গভীর রাত্রে সেখানে ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যেতো। জনৈক কোর্ট ইনসপেক্টর অধিক রাত্রি পর্যন্ত বকেয়া কাজ সেরে রাখছিলেন। হঠাৎ একজন দাড়িওয়ালা অদ্ভুত আকৃতির খিদমতকার দরজার ফাঁকে উকি দিলে তিনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

বিঃ দ্রঃ–অধিক ক্ষেত্রে এই-সব দৃশ্য মানসিক ভ্রমপ্রসূত হলেও কিছু ক্ষেত্রে ওগুলির ব্যাথ্যা পাওয়া কঠিন। পুলিশ ভূতে বিশ্বাসী হলে ‘কাওয়ার্ডিস’ অপরাধে চাকুরি বিচ্যুত হ’ত। কোনো বাড়িতে মাংস আনলে তা উধাও হয়ে সেই জায়গায় তরকারি নিক্ষিপ্ত হ’ত। এমন-কি এক ওঝার মন্ত্রের জন্য আনা শূকরের মাংস ও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এগুলি বাড়ির বিপথগামী তরুণেরা সূক্ষ্ম সুতার সাহায্যে সমাধা করেছিল। কিছু ক্ষেত্রে ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে দেওয়ালে সিনেমার ছবি ফেলে বা রেডিও রিসিভার ও স্বল্পশক্তি সম্পন্ন ট্রানজিসটারের সাহায্যেও ভয় দেখানো হয়ে থাকে।

এক রাত্রে এক তরুণ কণ্ঠস্বরে থানাতে ফোন এলো যে অতো নম্বর বাড়িতে একজন গলায় দড়ি দিয়েছে। ফোন পেয়ে আমি স্বয়ং এক জমাদার ও এক সিপাহী সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ তদন্তে চলে গেলাম। বাড়ির নম্বর ও গলির নাম জানা ছিল। গলির মোড়ে গিয়ে যখন উপস্থিত হলাম, আমাদের দেখে এক তরুণ বললে, “আরে আপনারা তো খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছেন। সোজা চলে যান, ডানদিকে মোড় নিলেই পেয়ে যাবেন।’ তাই গেলাম এবং বাড়ি পেলাম। কিন্তু কড়া নাড়তে হ’ল বহুবার। শেষে এক ব্যক্তি ঘুম থেকে জেগে উঠে উপরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং আমাদের দিকে দৃকপাত করেই বিরক্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘পুলিশ! আমাদের বাড়িতে পুলিশ! আমার বাবা ছিলেন রায়বাহাদুর আর আমাদের বাড়িতে কিনা…।’ যখন আত্মহত্যার বিষয় তাঁকে জানালাম, তিনি আঁতকে উঠে বললেন, “আরে রাম রাম! এ কী অলক্ষুণে কথা! কই আত্মহত্যার কথা আমরা তো কেউ জানি না…।” একটু পরে অন্য ঘরগুলিতে আলো জ্বলে উঠল এবং তারপরই বাড়ির মহিলারা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন। সত্যই—বাড়ির বারান্দাতে এক তরুণ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং মৃতদেহটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যে ছেলেটি আমাদের পথ দেখিয়ে এই বাড়ির হদিস দিয়েছিল সেই ছেলেটিই কড়ির ফাঁক দিয়ে দড়ি গলিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়েছে। তার সেই নাক চোখ ও ব্যাকব্রাশ করা চুল এবং নাকে প্যাসনে চশমা পায়ে লপেটা স্লিপার গায়ে ডোরা-কাটা সৌখীন নীল হাফসার্ট পরনে কালো পায়জামা।

‘হুম!’—একটু ভাবার পর আমার বিচলিত ভাব কমল এবং খানিক আশ্বস্ত হয়ে বাড়ির কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার মনে হয় এরা যমজ ভাই, অন্য ভাইটিকে অল্পক্ষণ আগে আমি দেখেছি। ডাকুন দিকি তাকে এখানে–’

উত্তর পেলাম: ‘না ওর কোনো যমজ ভাই নেই।’

শুনে ফের আমি বিচলিত হলাম। সত্যি বলতে-কি ভয় পেয়ে গেলাম একটু। কী করে এমন ঘটনা সম্ভব? আমি সিপাহীকে পাহারায় রেখে জমাদারের সঙ্গে থানায় ফিরতে চাইলাম। কিন্তু সিপাহী সবেগে ঘাড় নেড়ে জানাল যে তার নোকরি যায় তো যাক্ তথাপি ওই ভূতুড়ে বাড়িতে একাকী একমুহূর্ত কালাতিপাত করবে না। প্রকৃতপক্ষে সে দারুণ ভয় পেয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ওই বালক আমাদের সংবাদ দিয়ে খিড়কিপথে বাড়িতে ঢুকে আত্মহত্যা করেছিল।

[প্রকৃত ঘটনা বোঝা অসম্পূর্ণ থাকে বলেই ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি। সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করলে ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো কিন্তু তার আধিক্য মন্দ। তাতে বিপদ ঘটে। জনপ্রিয়তা উত্তম কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তা বিধ্বংসী।]

প্রভাতনাথ মুখার্জি

রায়বাহাদুর প্রভাতনাথ মুখার্জি কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। এই দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ব্যক্তিটি উত্তম শ্রেণীর অভিনেতা ছিলেন—অভিনয়ে প্রচুর প্রশংসা পান। স্যার চার্লস টেগার্ট গুণ্ডাদমনে এঁকে নিয়োগ করেন। এই কাজে তিনি সাহায্যকারী হিসাবে নিয়েছিলেন তিনজনকে: সত্যেন্দ্র মুখার্জি, বর্ধন ও আমি। আমাদের সাহায্যে তিনি পুলিশ-বিভাগ হতে দুর্নীতি দমনে বদ্ধপরিকর হন। গাছেরও খাবে আর তলারও কুড়োবে—অর্থাৎ উৎকোচ নেবে এবং প্রমোশনও পাবে এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। অপরাধীদের মধ্যে থেকে চর সংগ্রহ তাঁর পছন্দ নয় এইজন্য যে চরেরা তাতে প্রশ্রয় পায়—তারা নিজেরা দশটি অপরাধ করে বিরোধীদের দুটি বা চারটি অপকর্মের খবর দেয়। উনি সৎ ও সাধু কর্মীদের ভুলচুক উপেক্ষা করতেন কিন্তু অসাধু কর্মীদের সামান্য ভুলে তাঁর নিকট ক্ষমা নেই।

স্বল্পসংখ্যক পুলিশ-কর্মীদের দ্বারা শহরে অপরাধ-প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এজন্য উনি ট্রাপিজ অর্থাৎ ফাঁদ পাতা অধিক পছন্দ করতেন। নির্দিষ্ট পথে বা মাঠে দামী ঘড়ি ও আংটি পরে সালংকারা স্ত্রীর সঙ্গে পদব্রজে বা শকটে ছদ্মবেশী পুলিশ-কর্মী ঘোরা-ঘুরি করত। আর দূরে দূরে সশস্ত্র পুলিশ-কর্মীরা থাকত ফেরিওয়ালা প্রভৃতি নানান ছদ্মবেশে। আরও দূরে মোটর-বিহারী পুলিশ দূরবীন চোখে। ভূয়া বা অলীক ক্রেতা সেজে অপহৃত দ্রব্যাদি উনি প্রচুর উদ্ধার করতেন। ফলে, অপরাধীরা ব্যক্তিমাত্রকেই পুলিশ সন্দেহ করে অপকর্মে বিরত থাকত। এতদ্বারা প্রকৃত অপরাধীদের সহজে খুঁজে বার করা সম্ভব ছিল। এইভাবে একটিও নিরপরাধ ব্যক্তি দণ্ডিত না-হওয়ায় পুলিশ-বিভাগের সুনাম বাড়ে। তদস্ত করে সাক্ষী পাওয়ার পর গ্রেপ্তার করা প্রকৃত পন্থা নয়—গ্রেপ্তারের পর তদন্ত করা উচিত কাজ।

[অধুনা প্রিভেন্‌টিভ এ্যারেস্ট, প্রটেকটিভ এ্যারেস্ট, সুইপিং এ্যারেস্ট অর্থাৎ ঝাড়ু কেস, মাস এ্যারেস্ট প্রভৃতি শোনা যায়। কিন্তু এগুলি পুলিশের অক্ষমতার পরিচায়ক মাত্র। এতে শত্রুকে বন্ধু না করে বন্ধুকে শত্রু করা হয়।]

পাপের ভার পূর্ণ হলে পতন অনিবার্য। এজন্য দুষ্ট ব্যক্তিদের কিছুকাল বাড়তে দেওয়া ভালো। এতে তাকে বধ করার মতো সাক্ষী তৈরি হয়। এক্ষেত্রে শুধু নজর রেখে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। পাপের সংসারে পাপ সহবাস করলেও পুণ্যের সংসারে পাপ অসহনীয়। তাই সৎ-পরিবারের কেউ বেশ্যাসক্ত হলে প্রথমেই সে রোগগ্রস্ত হয়।

আমার উপরোক্ত মতবাদগুলি প্রভাতনাথ মুখার্জি সর্বান্তকরণে সমর্থন করতেন। তিনি বলতেন, ‘আজ হোক কিংবা কাল হোক পাপের প্রায়শ্চিত্ত একদিন তাকে করতেই হবে।’ আমি দু-একটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণ পেয়েছিলাম।

কোনও এক মদ্যপ সহকর্মীর সঙ্গে ভোররাত্রি চারটার সময় তল্লাসীতে বেরিয়েছিলাম। ফুটপাতে এক সন্ন্যাসী তখন নিদ্রামগ্ন। সহকর্মী পা আটকে তার ঘাড়ে পড়লেন হুমড়ি খেয়ে। রেগে গেলেন খুব। তিনি উঠে দাড়িয়ে সন্ন্যাসীর চুল চেপে ধরে জুতাসহ পদাঘাত করলেন। সন্ন্যাসী নীরবে সহ্য করলেন। প্রহার প্রশমিত হলে তিনি শুধু বললেন, ‘তোমার মঙ্গল হোক।’ তারপর ধুলো ঝেড়ে শান্তভাবে স্থানত্যাগ করে গেলেন, মুখে স্মিতহাসি। আমি প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সহকর্মীর সঙ্গে কলহ-রত হয়েছিলাম।

এই সময় পরিচিত এক প্রৌঢ় পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন। আমাকে কলহ না করে শান্ত হতে উপদেশ দিলেন। পরে বললেন, ‘ঘোষালবাবু ওকে কিছু বলবেন না। ওঁর রক্ষা নেই। ওই পুণ্যাত্মা সাধু প্রহৃত হয়ে যদি ওঁকে গালি দিতেন তাহলে শোধবোধ হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি তা না করে এঁকে আশীর্বাদ করে গেলেন। এ বড়ো ভয়ানক জিনিস–’

পর সপ্তাহে পানোন্মত্ত সেই সহকর্মী থানার ডায়েরিতে রাউণ্ড রিপোর্ট লিখলেন: চ্যালেঞ্জড কনস্টেবল নং ২৪৮০১০ এ্যাট দি জংশন অফ কনজাঙসন। (থানাতে মাত্র ৭০ জন কনস্টেবল বহাল ছিল।) তারপর এক পথচারীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠালেন। সেখানে ডাক্তাররা সেই ব্যক্তির দেহে প্রহারের জখম আছে রিপোর্ট লেখাতে উনি তাঁদেরকেও পিটুনি দিলেন। এই সংবাদ পেয়ে বড়ো সাহেব স্বয়ং তাকে সেখান থেকে ধরে এনেছিলেন। কয়েকদিন যাবৎ বিভাগীয় তদন্তের পর উনি কর্মচ্যুত হন নিজের দোষে। পরবর্তীকালে আমরা তাঁকে শীর্ণস্বাস্থ্যে এর-ওর কাছে অর্থভিক্ষা করতে দেখেছি।

[স্বল্প সংখ্যক কর্মীর উৎকোচ গ্রহণ মানেই উৎপীড়নের নামান্তর ছিল। তাঁরা উৎকোচের জন্য বহুজনকে ধরতেন ও ছাড়তেন। প্রভাতনাথ মুখার্জি এই ব্যাপারগুলি জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট কর্মিগণের নিকট কৈফিয়ৎ চাইতেন। এদের কারো কারো শেষ পরিণাম ভয়ংকর হতে দেখেছিলাম। একজন তো অস্থানে প্রহৃত ও নিহতও হয়েছিল। অন্যেরা সন্ত্রস্ত হয়ে ভয়ে ভয়ে গোপনে উৎকোচ নিতো এবং উৎকোচদাতার যথাসাধ্য উপকার করতো। তাঁরা উৎকোচ গ্রহণ করে নির্দোষীদের ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতিসাধন করেন নি—তাঁদের মধ্যে পাপ-পুণ্যের একটি পৃথক মূল্যায়ন আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম।]

কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও আমরা সততার জন্য বহু সহকর্মী, কিছু উকিল ও জনগণকে শত্রু করে তুলেছিলাম। এজন্য অন্যদিকে আমাদেরকে আত্মরক্ষার্থে সদা সজাগ থাকতে হ’ত। শুধু নিজেরাই সৎ থাকাটা যথেষ্ট নয়, আমরা অন্যকেও সৎ থাকতে বাধ্য করেছিলাম। এজন্য বহুজন উৎকোচ গ্রহণের পর রাত্রে নিদ্রা যেতে পারে নি।

আমার পুলিশী-গুরুরা কোনও মহিলার বাড়ি তল্লাসীতে কিংবা ওদের সহিত নিভৃত-সংলাপে ষথেষ্ট সাবধান হতে উপদেশ দিতেন। জন দুই বৃদ্ধ বা জন দুই বিশ্বাসী নারী সম্মুখে রেখে ওদের গৃহগমন বা কথোপকথন বিধেয়। একদিন মাত্র অসতর্ক মুহূর্তে এর বিপরীত কাজ করাতে আমার দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

মৃত মহারাজার দুই মাড়োয়ারী রানীর মধ্যে জহরত তছরুপের বিবাদ। আদালত তল্লাসী পরোয়ানা জারি করেছিলেন। আমি হুকুম-মোতাবেক ছোটরানীর গৃহে তল্লাসীতে গিয়েছিলাম। রীতি অনুযায়ী দুটি বৃদ্ধকে জবরদস্তি সাক্ষীরূপে সেখানে আনা হয়েছিল।

অপূর্বসুন্দরী গৌরবর্ণা বিংশতি বর্ষীয়া ছোটরানী দুয়ার খুলে দিলেন। আমাকে দেখে ব্যাপার অনুমান করে রীতিমত উত্তেজিত। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ঝড়ের বেগে বললেন, ‘নেহি নেহি, তল্লাসী নেহি হোগী। কেতনা রুপেয়া মাঙতা কহিয়ে তুম। বিশ হাজার-চালিশ হাজার। এ্যা ক্যা বোলত তভি নেহি?’—আমি তাঁর প্রতিটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি এবং তল্লাসী-কাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠি। তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন, থম-ধরা গলায় বলে উঠলেন, ‘বহুত আচ্ছা। ঠিক হ্যায়। তব ভিতরমে আও—।’ তর্কাতর্কিতে বিহ্বল হয়ে আমি ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। ক্রুদ্ধ ভদ্রমহিলা মুহূর্তে ঘরের দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে চাবি লাগিয়ে দিলেন। সিপাহী জমাদার সাক্ষী-দুজন আর বড় রানীর উকিলরা বাইরে রয়ে গেলেন।

বন্ধ ঘর। চতুরা মহিলা হঠাৎ ব্লাউজ ছিড়ে সুস্ফীত বক্ষ উন্মুক্ত করে চিৎকার শুরু করে দিলেন: ‘মেরি ইজ্জত লে লিয়া।’ ঘন ঘন এই চিৎকার করতে করতে তিনি টেলিফোনের নিকট ছুটে গেলেন এবং পর পর দুটি নাম্বার ডায়াল করে ব্যারিস্টার বি. সি. চ্যাটার্জি ও এ্যাডভোকেট কেশব গুপ্তকে স্বরচিত কাহিনী নিবেদন করলেন। তাঁর নিবেদনের বয়ান ছিল এই? ‘এক থানাদার আ’কে মেরি ইজ্জত লে লিয়া’। হম পচাশ হাজার রুপেয়া খরচা করনে তৈয়ার আপলোক ফৈসন লেকে তুরন্ত ইহাঁ পর আ’ যাইয়ে।’

আমি তো হতবাক। বিহ্বলভাবে পিছনের একটি সোফায় ঝুপ করে বসে পড়েছিলাম। বেশ অবশ লাগছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার রক্তশূন্য মুখভাব দেখে ভদ্রমহিলা করুণার বশবর্তী হয়ে হাঁক দিলেন: ‘রুকমানিয়া, এ রুকমানিয়া।’ পরিচারিকা রুকমানিয়া পাশের ঘর থেকে সংযোগকারী দরজা ঠেলে এ ঘরে আসতেই তিনি কৃত্রিম ধমকের সুরে বললেন, ‘দেখতা নেহি? বাবুকো পচনা আতা। পাংখা খুল দেও। আউর জলদি শরবত বানাকে লে আও।’

পরিচারিকা চলে যাবার পর তিনি আমার পাশেই বসলেন এবং দুহাতে আমাকে জড়িয়ে আদরে অতিষ্ঠ করে তুললেন। আমি অপ্রস্তুত। আদর করতে করতে তিনি বললেন ‘ক্যা বাবু, কাহে মেহি পর নারাজ হো’–-আমার দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। আমি কোনও কথা না বলে চুপচাপ চোখ বুজে বসেছিলাম। আমার গণ্ডদেশে ইঁদুরের দাঁতের মতো ছোট-ছোট দাঁত কুটকুট করে আলতোভাবে বসে যাচ্ছিল। ঠোঁটের নরম স্পর্শ পাচ্ছিলাম। তিনি ইচ্ছামত আমাকে ব্যবহার করছিলেন। আমার তরফ থেকে একটুও সাড়া ছিল না।

হঠাৎ দরজাতে ঠক ঠক শব্দ। ভদ্রমহিলা অসংবৃত বেশবাস সংযত করে নিয়ে দরজা খুলে দিলেন। এ্যাডভোকেট কেশব গুপ্ত ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি আগে থেকে আমাকে চিনতেন ও জানতেন। তাই ছোটরানী কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, ‘এ বাবু আপকো ইজ্জত লিয়া? নেহি, নেহি। ইয়ে বহুত আচ্ছা লেড়কা।’

ভদ্রমহিলা কিন্তু নরম হলেন না, বেশ উগ্রস্বরে বললেন, ‘ইজ্জত তো জরুর লিয়া হ্যায়।—ঘর উনে তল্লাসী কিয়া। উসমেই তো মেরি ইজ্জত গ’য়া। ইয়ে ভদ্রঘর কো বাবু। আউর কৈসন ইজ্জত লেগা।’

এই ঘটনার পর আমি বুঝেছিলাম যে পুলিশ-কর্মীর অবিবাহিত থাকা নিরাপদ নয়। এতে অনর্থক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয়। একদিন এই বিষয়ে একটু অদ্ভুত সুযোগ এসে গেল। এক সদ্য-আলাপী বন্ধুর সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন বর্ষাকাল। বৃষ্টি-ভেজা জুতো দুটো বারান্দায় খুলে রেখে ঘরে বসে গল্প করছিলাম। ফেরার সময় ঘরের বাইরে এসে দেখি, আমার জুতোজোড়া সেখানে নেই। জানা গেল, বন্ধুর রুচিশীলা কনিষ্ঠা ভগিনীর হুকুমে ভৃত্য ও-দুটো বাইরে ফেলে দিয়েছে। বেশ করেছে, কিন্তু খালি-পায়ে তো ফেরা যায় না। আমি ওই তরুণীরই স্লিপারে পা গলিয়ে থানায় ফিরে এসেছিলাম মনে মনে একটা জেদ পুষে। এতই যার রুচিজ্ঞান তাকে আমার জীবনের রুচির সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেললে কেমন হয়?

বাড়িতে আমাকে বার বার বিবাহের জন্য তাগিদ দিয়েছে। আমি গড়িমসি করেছি। অতএব বাড়িতে অমত হবে না বুঝে তড়িঘড়ি শুভকাজে নেমে পড়লাম। নিমন্ত্রণ-পত্র তৈরি করে ফেললাম একখানা। আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের নামের তালিকা যখন প্রস্তুত করছি তখন মূর্তিমান ভগ্নদূতের মতো ও-পক্ষের ঘটক এসে জানাল যে পাত্রীর পিসিমার এই বিবাহে ঘোরতর অমত। কারণ? তিনি লিখিত ভাবে দূরদেশ থেকে জানিয়েছেন, ‘সাবরেজিস্টার আবার হাকিম, তেলাপোকা আবার পাখি, ঘোষাল আবার বামুন।’ বুঝতে পারলাম কুলীন বলে ওঁরা কুল ভাঙতে কিছুতেই রাজি নন, কিন্তু এই ঔদ্ধত্যের সমুচিত একটা জবাব তো দিতে হবে। আমি লেখাটা কাছে রাখলাম। উকিল পশুপতি ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর মারফৎ একখানি মানহানির পত্র পাঠালাম। তার সারমর্ম এই: ‘ঘোষাল ব্রাহ্মণ নয় বলাতে আমার বিবাহ হওয়া ভার হয়েছে। আমি আমার স্বজাতিদের কাছে অত্যন্ত নিচু হয়ে গিয়েছি। আমার দেহের ওজন আট পাউণ্ড কমে গেছে। এই অপবাদে আমার মনোকষ্ট অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অতএব ক্ষতিপূরণ-স্বরূপ বিশ হাজার টাকা পত্রপাঠ আমার উকিল-মারফৎ পাঠানো হোক।’

এই অভিনব পত্র পেয়ে ওদের বাড়ি থেকে বিবাহের পুনঃপ্রস্তাব আসে। কিন্তু আর রাজি হই নি।

পরে, বারে বারে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে লাগল। বিবাহের উদ্যোগ চলছিলই কিন্তু পাত্র হিসাবে আমাকে যাঁদের পছন্দ আমার পাত্রী পছন্দ হয় না; আবার আমি যে পাত্রী পছন্দ করি তাঁরা আমাকে পছন্দ করেন না। আমাকে অপছন্দের কারণগুলি শ্রবণসুখকর নয়। দু-একটা নমুনা। কেউ বলে, ‘পুলিশের সঙ্গে বিবাহ কখনও নয়।’ কারো মন্তব্য: ‘বাংলা পাঁচের মতো মুখ।’ কারো বক্তব্য: ‘বাবা, অতো লম্বা লোক। বিয়ে হলে কনেকে তো টুলে উঠতে হবে।’ ফলে, আমি সনাতন বিবাহ-পদ্ধতিতে বিশ্বাসী হই এবং আমার অভিভাবকবর্গের উপর পরিশেষে সব ভার অর্পণ করি।

শ্যামপুকুর থানা

এই থানাতে মাত্র তিন বৎসর চাকুরি করার পর আমি ইনচার্জ-ইনস্পেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলাম। এই থানায় থাকাকালীন পাগলা-হত্যা ইত্যাদি কয়েকটি দুরূহ মামলার কিনারা করে সুনাম অর্জন করি। সে সময় জনসেবার জন্য আমার জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে ওঠে যে স্থানীয় অধিবাসীরা শ্যামপুকুর থানাকে পল্লীর নিজস্ব থানা বলে অভিহিত করত। প্রয়োজনবোধে পল্লীর মহিলারাও অসংকোচে পুলিশ-কোয়ার্টারে এসে অভিযোগ পেশ করে যেতেন। এই থানা পরিত্যাগকালে স্থানীয় জনগণ সভা করে একজন পুলিশ-কর্মীকে বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল সর্বপ্রথম। রাজনৈতিক কারণে পুলিশ-কর্মীরা জনপ্রিয় নিশ্চয় নয় কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই বিভাগের বহুজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।

[একবার এক ভদ্র পরিবারের সঙ্গে ট্রেনে আলাপ হওয়ার ফলে কথায়-কথায় কর্তাব্যক্তিটি তাঁর বালীগঞ্জের বাড়িতে সাদর নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তো এখন আত্মীয়দের মধ্যে পরিগণিত। আপনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করা হয় নি আপনি কী কাজ করেন?’ উত্তরে আমি একজন পুলিশ-কর্মী বলায় তিনি অসতর্কভাবে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সে কি! আপনি পুলিশ অফিসার। আমি মনে করেছিলাম ভদ্রলোক!’

অন্য একদিন এক সভাস্থলে ইউনিফর্ম-পরিহিত অবস্থায় উদ্যোক্তাদের অনুরোধে আমাদের আহার্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। আমরা যখন আহাররত, দূর থেকে তা দেখে এক বালক বিস্ময়ে বলে উঠেছিল, ‘ও দাদা ওই দেখ। পুলিশ খাচ্ছে।’ আজব-জীব পুলিশেরা যে খাদ্য গ্রহণ করে তা তার ধারণার বাইরে ছিল।]

শ্যামপুকুর থানা এলাকায় বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিকের বাস ছিল। যেমন: সজনীকান্ত দাস, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত, মল্লকবি কর্মযোগী রায়, চিত্রশিল্পী যামিনী রায় প্রভৃতি আরও অনেকে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘ছন্দা’, উপেন্দ্রবাবুর ‘বিচিত্রা’, সজনীকান্তের ‘শনিবারের চিঠি’, শৈলজাবাবুর ‘পত্রিকা’ এবং কর্মযোগীর ‘রোচনা’ এই এলাকা থেকেই প্রকাশিত হ’ত।

সেকালে প্রতিটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এক-একটি সাহিত্যিক-গোষ্ঠী ছিল। পত্রিকা অফিসে তাঁদের নিয়মিত আগমন ঘটত ও আড্ডা বসত। বাংলা সাহিত্য তার ফলে অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। আর-একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সঙ্গে সম্পাদকদের মধুর সম্পর্ক তো ছিলই, নবাগতরাও তা থেকে বঞ্চিত হতেন না। সম্পাদকেরা উঠতি-সাহিত্যিকদের রচনা মনোযোগ সহকারে পাঠ করতেন ও প্রয়োজন হলে সংশোধন করে পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। নতুন লেখকেরা তার ফলে রচনা কার্যে উৎসাহিত ও সম্পাদকগণের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠতেন।

এই সূত্রে বহু সাহিত্যিক ও সম্পাদকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্যলাভ করেছিলাম। তাঁদের নানাভাবে সেবা করার সুযোগ যেমন পেয়েছিলাম তেমনি পত্রিকাগুলিতে বহুবিধ রচনা প্রকাশ করে আনন্দিত হয়েছিলাম। সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, দেব-দম্পতি রাধারাণীদিদি ও নরেনদা, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, যুবনাশ্ব ও দিনেশ দাসের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল আগে থেকেই। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার অফিসে সম্পাদক উপেন্দ্রনাথের মাধ্যমে সাহিত্যাচার্য শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং ওই আড্ডায় বহু সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছি। আমার লেখা প্রকাশের ব্যাপারে আড্ডাধারী এক সাহিত্যিক একদা রসিকতা করে বলেছিলেন: ‘ওর লেখা না ছাপলে সম্পাদকের বাড়িতে পুরনো চোরেরা হানা দেবে।’

আমার লেখা বিচিত্রা, বসুমতী, ভারতবর্ষ, কল্লোল, পাঠশালা, রামধনু, মৌচাক, অর্চনা, অভ্যুদয়, শনিবারের চিঠি, রোচনা, বাঁশরী, ছন্দা, প্রকৃতি, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, বঙ্গলক্ষ্মী, রঙমশাল এবং পূজাবার্ষিকী আনন্দবাজার ও যুগান্তর প্রভৃতি নানা পত্র-পত্রিকায় গল্প উপন্যাস প্রবন্ধাদি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।

ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও ডঃ কালিদাস নাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়েছিলাম অন্য সূত্রে। প্রথম দুজনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র বিস্মৃত তবে ডঃ নাগের সঙ্গে পরিচয় তাঁর গ্রেটার ইণ্ডিয়া মুভমেন্টের সময়। তাঁর আন্দোলন যখন চলছে তখন আমি ছাত্র। সেই আন্দোলনে আমি সাহায্য করেছিলাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তৎকালে শ্যামপুকুর এলাকাতে দুটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি সংগীত-বিদ্যালয় প্রধানতঃ আমার চেষ্টাতে স্থাপিত হয়েছিল।

হেমেন্দ্রকুমার রায় মানুষটাই একখানি কবিতা। বাড়িতে অর্থাভাবে বাজার হচ্ছে না—তিনি হঠাৎ পেলেন কুড়ি টাকা। সংসার খরচের জন্য আট টাকা দিয়ে বাকি টাকায় ফুল কিনে ফেললেন আর জ্যোছনা রাতে নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে গঙ্গাবক্ষে বিহার করে বেড়ালেন। পরদিন আবার সংসার খরচের চিন্তা। তবু, প্রতিদিন তাঁর লেখার টেবিলে কিছু টাটকা ফুল থাকা চাই, সেইদিকে তাকিয়ে তিনি লিখতে ভালবাসতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন যে প্রকাশকদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ের ব্যাপারে এই সৌখিনতা বিশেষ কার্যকর ছিল।

শরৎচন্দ্রের একবার একটি আধুলি হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বেশ কিছুদিন শোকাত হয়েছিলেন। বহু বৎসর পরে, তাঁর উত্তরাধিকারীর বিশ হাজার টাকা মূল্যের মোটরগাড়ি চুরি হয়ে গেলেও তাঁকে কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। শরৎচন্দ্র জীবদ্দশাতে বিখ্যাত হলেও তাঁর গ্রন্থাবলীর বিক্রয়-সংখ্যা বাড়ে মৃত্যুর পরই। তিনি প্রায়ই বলতেন যে বসুমতী সাহিত্য-মন্দির কর্তৃক প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ পুস্তক ও গ্রন্থাবলী তাঁকে সাচ্ছল্যদান করেছিল।

বঙ্কিমচন্দ্রের পর সজনীকান্ত স্যাটায়ারধর্মী সাহিত্য-রচনায় সুখ্যাত হন। এজন্য তাঁর পত্রিকার অফিসে যশলোভী লেখকেরা প্রায়ই উৎপাত করতেন। তাঁর অফিস ঘরেই সুরেশচন্দ্র মজুমদার, প্রফুল্লচন্দ্র সরকার, নলিনীকান্ত সরকার, দিলীপকুমার রায়, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে আমি অস্তরঙ্গভাবে পরিচিত হই। এই সময়ে শুভো ঠাকুরের ‘ভবিষ্যৎ’ এবং আশু চট্টোপাধ্যায়ের ‘অগ্রগতি’ জনপ্রিয় পত্রিকা।

মল্লকবি কর্মযোগী রায়ের বাড়িতে হুমায়ুন কবীর লালমিয়া প্রভৃতি বহু গুণী মানী ব্যক্তি নিয়মিত আসতেন। এঁরা অনেকেই তখন ছাত্র। কবিতা রচনা শিক্ষার সঙ্গে শরীর গঠনের জন্য কুস্তি ও ডনবৈঠক অভ্যাস করতেন প্রতিদিন। তাঁর এক ছাত্র তার কবিতা ছাপা হয় নি বলে এক সম্পাদককে ঘুষি মেরে চিৎ করে দিয়েছিলেন।

একরাত্রে তাঁর গৃহে গানের আসর বসেছিল। দিল্লি থেকে ওস্তাদ আজমল খাঁ এসেছিলেন। বহুজনের মতো আমিও সেখানে নিমন্ত্রিত। বাংলার সুখ্যাত গায়ক অনাথনাথ বসু তবলা সংগতকার। গাইতে গাইতে ওস্তাদজী হঠাৎ ধমকে উঠে বললেন, ‘বাবু, ছাত পিটাও মাৎ।’ প্রতিবাদে অনাথবাবু আসর ত্যাগ করে চলে যান। ওস্তাদজী তখন হাটু গেড়ে বসে উপর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘পাংখা বন্ধ কর দিজিয়ে। বাবুজি, গানা উড় যায়গা।’ তারপর দুনাদু দুনাদু দুউ-উ গাইতে গাইতে পার্শ্বে উপবিষ্ট এক ব্যক্তির চোখে আঙুল পুরে দিয়েছিলেন। আহত শ্রোতাটিকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। এর আগে এক কীর্তন-গায়ককে ভাবাবেগে খোলসুদ্ধ একজনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিলাম। এই-সব গায়কদের উৎপাতের জন্য অমৃত-সমান রবীন্দ্রসংগীতের দ্রুত প্রসার ঘটেছিল।

পুলিশ-কর্মীদের মধ্যে খানসাহেব খোন্দকার হোসেন রেজা, যতীনন্দ্রাথ মুখার্জি, যতীন্দ্রনাথ লাহিড়ী, রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, চন্দ্রশেখর বাগচি, শৈলেন মজুমদার, মণি বসু, জগৎ ভট্টাচার্য, প্রভাতনাথ মুখার্জি, পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী, হেমচন্দ্র লাহিড়ী, নলিনী সেন, মহেন্দ্ৰ মুখার্জি ও মনোহর পণ্ডিত একালে উল্লেখ্য ছিলেন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশ জনই পরবর্তী কালে অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনার পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *