তৃতীয়াধ্যায়—দ্বিতীয়াহ্নিক : মনোনিরূপণ

তৃতীয়াধ্যায়ে–দ্বিতীয়াহ্নিকম্

আত্মেন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষে জ্ঞানস্য ভাবোঽভাবশ্চ মনসো লিঙ্গম্।।১।।

অনুবাদ

আত্মা এবং ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সম্বন্ধ (সত্ত্বেও) জ্ঞানের উৎপত্তি এবং অনুৎপত্তি মনের অনুমাপক।। ১।।

ব্যাখ্যা

মন যাঁহার দ্বারা পরিচালিত হয়, তিনি আত্মা;–আত্মার অস্তিত্বসাধক এইরূপ একটী হেতু কথিত হইবে। পরন্তু মনও তো দেখা যায় না, মনের অস্তিত্ব ও স্বরূপ সিদ্ধ না করিলে, আত্মার অস্তিত্বসাধক সেই হেতুও অসিদ্ধ হইবে; এই কারণে মনের অস্তিত্ব ও স্বরূপ সাধিত হইতেছে; আত্মা জ্ঞানবান্, অপর সকল বস্তুই জড়; সেই আত্মা দ্বিবিধ, জীব ও ঈশ্বর, অথবা জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। জীবাত্মা নানা, ঈশ্বর এক। জীবাত্মার জ্ঞান উৎপত্তি- বিনাশযুক্ত, ঈশ্বরের জ্ঞান অবিনশ্বর; জীবাত্মার জ্ঞানও বিবিধ—প্রত্যক্ষ, অনুমিতি এবং স্মৃতি। এতন্মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রধান। যে বস্তু বা বিষয়ের প্রত্যক্ষ হইবে, তাহার সহিত ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হইলে, আত্মাতে প্রত্যক্ষ হয়। তখন প্রত্যক্ষকর্তা বুঝিতে পারেন, আমি প্রত্যক্ষ করিতেছি। ইহা হইতে বুঝা গেল, প্রত্যক্ষে এই দুইটী আবশ্যক—এক বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ, আর আত্মা। কিন্তু দেখা যায়, এই দুইটী হইলেও সকল সময়ে জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। যখন তুমি কোন বিষয়চিন্তায় বা ইষ্টদেবতার চিন্তায় নিমগ্ন, তখন তোমার সম্মুখস্থ বস্তুও তোমার প্রত্যক্ষগোচর হয় না। তুমি ঘোর চিন্তায় মগ্ন, অথচ চাহিয়া আছ, সেই চক্ষুরিন্দ্রিয়ের সম্মুখে বিশ্বরঙ্গমঞ্চের যবনিকা উন্মুক্ত, কিন্তু অভিনয়দর্শন তোমার ঘটিতেছে না, কোকিলকুলের সঙ্গীত তোমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতেছে না—এমন তো অনেক সময়ে ঘটে; কিন্তু কেন ঘটে? না, তুমি তখন অন্যমনস্ক বলিয়া। অর্থাৎ আর একটী এমন বস্তু প্রত্যক্ষের পূর্ব্বে আবশ্যক, যাহার অভাবে তোমার তখন প্ৰত্যক্ষ হয় না। সেই বস্তু মনঃসন্নিকর্ষ, অর্থাৎ যে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করিবে, সেই ইন্দ্রিয়ের সহিত মনের সংযোগ থাকা আবশ্যক। যখন তুমি ঘোর চিন্তায় মগ্ন থাক তখন তোমার মন গূঢ়প্রদেশে অবস্থান করে। মন সেখানে থাকিলে চক্ষুঃ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সহিত তাহার আর সংযোগ থাকে না, সুতরাং প্রত্যক্ষও হয় না। এই কারণে মনকে বিভু বা দেহব্যাপী বলা যায় না। মন বিভু বা দেহব্যাপী হইলে সৰ্ব্বদা সকল ইন্দ্রিয়ের সহিতই তাহার সম্বন্ধ থাকিত, ঘোর চিন্তাকালেও তাহার অভাব হইত না। সুতরাং তদ্বারা প্রত্যক্ষের আপত্তিও নিবারিত হইত না। অতএব বুঝা গেল, মন আছে এবং তাহা সূক্ষ্ম। ইন্দ্রিয়ের সহিত সেই সূক্ষ্ম মনের সংযোগ না হইলে প্রত্যক্ষের অপর সকল কারণ থাকিলেও প্রত্যক্ষ হয় না। এই জন্য আমরা প্রচলিত কথাতেও বলিয়া থাকি—আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, আমার মন অন্যত্র ছিল।। ১।।

উপস্কারঃ

হেতুহেত্বাভাসবিবেকঃ আহ্নিকার্থঃ। ইদানীমাত্মপরীক্ষাশেষ বর্ত্তয়িষ্যন্ উদ্দেশ-ক্রমলঙ্ঘনেন মনঃপরীক্ষামবতারয়ন্নাহ।

মনোগতিমাত্মনো লিঙ্গং বক্ষ্যতি তদ্ যদি মনো জ্ঞানকরণত্বেন মূর্তত্বেন চ পরীক্ষিতং ভবতি তদা যৎপ্রেরিতং মনঃ ইন্দ্রিয়ান্তরাদভিমতবিষয়গ্রাহিণি ইন্দ্রিয়ে সম্বধ্যতে স আত্মেতি সিদ্ধং ভবতীত্যেতদর্থং ক্রমলঙ্ঘনম্। আত্মেন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষে সতি যস্মিন্ ইন্দ্রিয়সন্নিকৃষ্টে জ্ঞানস্য ভাব উৎপাদঃ অসন্নিকৃষ্টে জ্ঞানস্যাভাবোহনুৎপাদস্তন্মন ইত্যর্থঃ। ননু মনোবৈভবেঽপি করণধর্ম্মত্বাদেব জ্ঞানযৌগপদ্যমুপপদ্যতে, কিঞ্চ মনো বিভু বিশেষগুণশূন্যদ্রব্যত্বাৎ কালবৎ জ্ঞানাসমবায়িকারণসংযোগাধারত্বাদাত্মবৎ স্পর্শাত্যম্ভাভাববত্ত্বাদাকাশবদিত্যাদি বৈভবসাধক প্রমাণমিতি চেৎ মৈবম্। যদি মনো বিভু স্যাত্তদা সৰ্ব্বেন্দ্ৰিয়সন্নিকৃষ্টাত্ততঃ সৰ্ব্বেন্দ্ৰিয়কমেকমেব জ্ঞানং স্যাৎ, কার্য্যবিরোধান্নৈবমিতি চেন্ন। ন হি সামগ্রী বিরোধাবিরোধমাকলয়তি যেন চাক্ষুষত্বরাসনত্বাদিবিরোধায় বিভ্যেৎ, চিত্ররূপবৎ চিত্রাকারমেব বা স্যাৎ, ভবত্যেব দীর্ঘশঙ্কুলী-ভক্ষণস্থলে ইতি চেন্ন তত্রাপি ব্যাসঙ্গদর্শনাৎ, তর্হি রূপরসগন্ধস্পর্শান্ যুগপৎ প্রত্যেমীতি কথমনুব্যবসায় ইতি চেন্ন। শীঘ্রসঞ্চারিমনোজনিতেষু পঞ্চসু মৃত্যুপনীতজ্ঞানে যৌগপদ্যাভিমানাৎ, ব্যাসঙ্গোঽপি করণধর্ম্মাধীন ইতি চেন্ন উক্তোত্তরত্বাৎ। বুভুৎসাধীনো ব্যাসঙ্গ ইতি চেন্ন সৰ্ব্ববুভুৎসায়াং সৰ্ব্ববিষয়কসর্ব্বোদয় প্রসঙ্গাৎ বুভুৎসায়া অপি অভিমতার্থ- গ্রাহীন্দ্রিয়মনঃসম্বন্ধমাত্রফলকত্বাৎ, তস্মাজ্ঞানাযৌগপদ্যান্যথানুপপত্ত্যা সিদ্ধতি অণু মনঃ; ততোঃ ধৰ্ম্মিগ্রাহকমানবাধিতা বৈভবহেতবঃ কিঞ্চ মনোবৈভবে পাদে মে সুখং শিরসি মে বেদনেতি প্রাদেশিকত্বং সুখাদীনাং ন স্যাৎ, বিভুকাৰ্য্যাণামসমবায়িকারণাবচ্ছিন্নদেশে উৎপাদনিয়মাৎ, তবাপি সুখাদীনামণুদেশাপত্তিরিতি চেন্ন অসমবায়িকারণং বিভুকার্য্যং স্বদেশে জনয়ত্যেবেতি নিয়মাৎ, তথাচ নিমিত্তচন্দনাদ্যবচ্ছেদাদধিকদেশেঽপিজননাবিরোধাৎ, মমাপি নিমিত্তসমবধানানুরোধ ইতি চেন্ন উক্তনিয়মভঙ্গপ্রসঙ্গাৎ কিঞ্চাত্মনা বিভুনো মনসঃ সং- যোগোঽপি কথং স্যাৎ, অজোঽসাবিতি চেন্ন বিভাগস্যাপ্যজত্ব প্রসঙ্গাৎ, অবচ্ছেদভেদেনো- ভাবপ্যবিরুদ্ধাবিতি চেন্ন সংযোগবিভাগয়োরচ্ছেদভেদস্য স্বকারণাধীনত্বাৎ অজয়োস্তু তদভা- বাদিতি দিক্‌।।১।।

.

তস্য দ্রব্যত্বনিত্যত্বে বায়ুনা ব্যাখ্যাতে।।২।।

অনুবাদ

তাহার (মনের) দ্রব্যত্ব এবং নিত্যত্ব, বায়ুপরমাণু দ্বারা ব্যাখ্যাত হইয়াছে।।২।।

ব্যাখ্যা

বায়ুপরমাণু—গুণবান্ এবং দ্রব্যে আশ্রিত বা অসমবেত বলিয়া নিত্য দ্রব্য ইহা কথিত হইয়াছে। মনও সেইরূপ সুতরাং নিত্য দ্রব্য। যখন ইন্দ্রিয় এবং মনের সহিত সংযোগ মানিতে হইয়াছে তখন, তাহা যে গুণবান্ ইহা স্থির। তাহাকে যখন সূক্ষ্ম মানিতে হইয়াছে, তখন অতিসূক্ষ্ম অর্থাৎ পরমাণুস্বরূপ স্থির করাই যুক্তিযুক্ত। নতুবা মনের উৎপত্তি-বিনাশ স্বীকার করিতে হয়, অথচ অকারণ অপ্রামাণিক উৎপত্তি-বিনাশ স্বীকার নিরর্থক। যদি বল, মন যে উৎপত্তি-বিনাশ-যুক্ত তাহার প্রমাণ শ্রুতিতে আছে। তাহার উত্তরে আমরা বলি, মন যে মৃত্যুর পরেও থাকে এবিষয়ে প্রমাণও শ্রুতিতে আছে। আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ এই মনের সাহায্যেই হইয়া থাকে। সুতরাং শরীরের উৎপত্তি-লয়ের সহিত মনের উৎপত্তি-লয়ের সম্বন্ধ না থাকিলে, মনের উৎপত্তি অর্থে শরীরসম্বন্ধ মাত্রই জানিবে। অর্থাৎ মন নিত্য হইলেও,—জীবের জন্মজন্মান্তরের সহচর হইলেও, পশু-শরীর হউক, মানব শরীরই হউক, কোন একটী শরীরের সহিত সম্বন্ধ হইলে, তবে সুখ-দুঃখ ভোগ হয়, অন্যবিধ জ্ঞানাদিও হয়, নতুবা নহে। সুতরাং মনের এই যে কার্য্যকরী অবস্থা তাহা শরীরের সহিত সম্বন্ধ না হইলে হয় না; শরীরের সহিত এই সম্বন্ধের উৎপত্তি বা মনের কার্য্যকরী অবস্থার উৎপত্তিই মনের উৎপত্তি রূপে শ্রুতিতে কীৰ্ত্তিত হইয়াছে।। ২।।

উপস্কারঃ

ননু সুখাদ্যুপলব্ধিঃ করণসাধ্যা ক্রিয়াত্বাৎ রূপোপলব্ধিবদিত্যাদ্যনুমানাৎ যুগপজ- জ্ঞানানুৎপত্ত্যা বা যন্মনঃ সিদ্ধং তৎকরণতয়া তথাচ তস্য দ্রব্যত্বং নিত্যত্বঞ্চ কুত ইত্যত আহ।

যথাহবয়বিদ্রব্যানুমিতো বায়ুপরমাণুর্গুণবত্ত্বাৎ ক্রিয়াবত্ত্বাচ্চ দ্রব্যম্, যথা যুগপজ্ঞা- নানুপত্ত্যাহনুমিতং মনো গুণবত্ত্বাদ্ দ্রব্যং, ন হি তস্য ইন্দ্রিয়সংযোগমন্তরেণ জ্ঞানোৎপাদকত্বং যেন গুণবত্ত্বং ন স্যাৎ, কিঞ্চ সুখাদিসাক্ষাৎকারঃ ইন্দ্রিয়করণকঃ সাক্ষাৎকারত্বাৎ রূপাদি – সাক্ষাৎকারবদিতীন্দ্রিয়ত্বেন মনঃ সিদ্ধম্। ইন্দ্রিয়ত্বঞ্চ জ্ঞানকারণমনঃসংযোগাশ্রয়ত্বমিত্যযত্ন- সিদ্ধমেব মনসো দ্রব্যত্বম্, নিত্যত্বঞ্চ তস্যানাশ্রিতত্বাৎ, তস্যাবয়বকল্পনায়াং প্রমাণাভাবাদনা- শ্রিতত্বমিতি।।২।।

.

প্রযত্নাযৌগপদ্যাজ্ জ্ঞানাযৌগপদ্যাচ্চৈকম্।। ৩।।

অনুবাদ

যুগপৎ বিবিধপ্রযত্নের অনুৎপত্তি এবং যুগপৎ বিবিধজ্ঞানের অনুৎপত্তিহেতু (মন) এক।। ৩।।

ব্যাখ্যা

প্রত্যেক শরীরে মন এক একটা। যদি প্রত্যেক শরীরে অনেক মন থাকিত তাহা হইলে এককালে নানাবিষয়ে প্রযত্ন উৎপন্ন হইত, এককালে বিবিধ জ্ঞান হইত। পরন্তু তাহা হয় না, যেমন নানাব্যক্তির মনোভেদে মতভেদ হয়, সেইরূপ এক ব্যক্তির ও এককালে মতভেদ হইতে পারিত, এককালেই এক বিষয়ে প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি হইতে পারিত। এই সকল দোষ বারণের জন্য অন্যরূপ কার্য্যকারণভাব কল্পনা করিলে, নিরর্থক গৌরব হইয়া পড়ে। আবার অনেক মন স্বীকারের গৌরব তো আছেই। অতএব মন প্রতি শরীরে এক একটী।।৩।।

উপস্কারঃ

তৎ কিং প্রতিশরীরমেকমনেকং বেতি সন্দেহে নির্ণায়কমাহ।

মনঃ প্রতিশরীরমিতি শেষঃ। যদ্যেকৈকস্মিন্নপি শরীরে বহূনি মনাংসি স্যুস্তদা জ্ঞানপ্রযত্নানাং যৌগপদ্যং স্যাৎ যত্ন নর্ত্তকীকরচরণাঙ্গুলীষু যুগপৎ কৰ্ম্মদর্শনাদ যুগপদেব বহবঃ প্রযত্না উৎপদ্যন্তে ইতি মত তদযুক্তম্। মনসঃ শীঘ্রসঞ্চারাদেব তদুপপত্তেঃ অবিনশ্যদবস্থযোগাত্মবিশেষগুণানাং যৌগপদ্যানভ্যুপগমাৎ। এতেনৈকস্মিন্নপি শরীরে পঞ্চ মনাংসি তেষাং দ্বিত্রিচতুঃপঞ্চানাং তত্তদিন্দ্রিয়সংয়োগে দ্বে ত্রীণি চত্বারি পঞ্চ বা জ্ঞানানি যুগপজ্জায়ন্তে ইতি মতং নিরস্তং কল্পনাগৌরবপ্রসঙ্গাৎ, যৌগপদ্যাভিমানস্তু সমর্থিত এব, রসনেন্দ্রিয়াবচ্ছেদেন ত্বগিন্দ্রিয়সম্বন্ধেন মনসস্তিক্তো গুড় ইতি জ্ঞানদ্বয়যৌগপদ্যাপত্তিরপি করণধৰ্ম্মত্বাদেব নাস্তি, দ্বিত্রিচ্ছিন্নগোধাভুজগাদাবপি অবয়বদ্বয়ে কৰ্ম্ম খড়্গাদ্যভিঘাতাদ্বা মনস আশু সঞ্চারাদ্বা তদানীমেবাদৃষ্টেন পণ্ডমনোত্তরগ্রহণাদ্বা। যত্ত্ব মনোহবয়ব্যেব জলৌকাবৎ তৎসঙ্কোচবিকাশাভ্যাং জ্ঞানযৌগপদ্যাযৌগপদ্যে ইতি তৎ তদবয়বকল্পনাগৌরবপ্রতিহতমিতি দিক্‌।।৩।।

.

প্রাণাপাননিমেষোন্মেষজীবনমনোগতীন্দ্রিয়ান্তরবিকারাঃ সুখদুঃখেচ্ছাদ্বেষ প্রযত্নাশ্চাত্মনো লিঙ্গানি।। ৪।।

অনুবাদ

প্রাণ ও অপান (বায়ুর ক্রিয়া), নিমেষ ও উন্মেষ, জীবন অর্থাৎ ক্ষতস্থানপূরণাদি মনের পরিচালনা, অপর ইন্দ্রিয়ের বিকার, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং প্রযত্নও আত্মার অনুমাপক।। ৪।।

ব্যাখ্যা

কেবল যে সাক্ষাৎকারই অথবা জ্ঞানই আত্মার অনুমাপক, তাহা নহে। প্রাণক্রিয়া প্রভৃতিও আত্মার অনুমাপক। এই সূত্রে এই কথাই আলোচিত হইতেছে। প্রাণবায়ুর ক্রিয়া শ্বাস প্রশ্বাস, অপান বায়ুর ক্রিয়া মলত্যাগ ইত্যাদি যাহার প্রযত্নে সম্পন্ন হয়, তিনি আত্মা; বায়ুর স্বাভাবিক ক্রিয়া বক্রগতি, কিন্তু প্রাণবায়ু প্রভৃতির ক্রিয়া ঊর্দ্ধগতি ও অধোগতি; বায়ুর এই যে স্বভাববিপর্য্যয়, ইহা বিনা প্রযত্নে সম্পন্ন হয় না। সে প্রযত্ন আমরা প্রত্যক্ষতঃ বুঝিতে না পারিলেও প্রযত্ন যে আছে তাহা নিশ্চয়। নতুবা এমন স্বভাববিপর্য্যয় ঘটিত না। আমরা জানি, বায়ু যখন স্বয়ং প্রবাহিত হয়, তখন তাহা বক্রভাবেই গিয়া থাকে। কিন্তু আমরা তালবৃত্তসঞ্চালন দ্বারা বায়ুকে ঊর্দ্ধেও প্রবাহিত করিতে পারি, অধোদেশেও প্রবাহিত করিতে পারি। কিন্তু সেরূপ করা প্রযত্নসাপেক্ষ। সুতরাং প্রাণক্রিয়াদিস্থলেও এই যে বায়ুর অস্বাভাবিক গতি তাহাও প্রযত্নসাপেক্ষ বলিতে হয়, সেই প্রযত্নসম্পন্ন বস্তুই আত্মা। কর্ম্ম অনেকপ্রকার, কোন কোন কর্ম্মের কারণ সংযোগবিশেষ; বায়ুসংযোগে বৃক্ষাদির কম্পন ইহার দৃষ্টান্ত। অনেকস্থলে দেখা যায়, সংযোগ না হইলেও বা সমান সংযোগ থাকিলেও কখন কৰ্ম্ম উৎপন্ন হইতেছে কখন বা হইতেছে না। তুমি মন্দ মন্দ গমনে গৃহাভিমুখে চলিতেছ, এমন সময় তোমার মনে হইল, সিন্দুকের চাবিটী বাহিরে ফেলিয়া আসিয়াছ, তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে গৃহাভিমুখে ধাবিত হইলে। এই যে দ্রুতগমনরূপ কর্ম্ম, ইহার কারণ কি? ইহার কারণ প্রযত্ন। সেইরূপ চক্ষুর উন্মেষ-নিমেষরূপ যে কৰ্ম্ম তাহা কোন সংযোগবিশেষের অধীন নহে, সুতরাং প্রযত্নসাপেক্ষ। এই প্রযত্ন যাঁহার, তিনিই আত্মা। যাঁহার অস্তিত্বে ক্ষতস্থান পূর্ণ হইয়া যায়, তিনি আত্মা। ক্ষত হইলে তাহা যে আবার পূরিয়া উঠে ইহা জীবিতের চিহ্ন; আত্মার বিশেষ সম্বন্ধ যাহাতে আছে সেই জীবিত। সুতরাং ক্ষতপূরণাদিও আত্মার অস্তিত্বের অনুমাপক। ইচ্ছামত মনকে যে এক একবিষয়ে নিবিষ্ট করা হয়, এই মনোনিবেশ আত্মার অস্তিত্বের অনুমাপক। মন যাঁহার প্রেরণায় বিষয়বিশেষে নিবিষ্ট হয়, তিনি আত্মা। অপর ইন্দ্রিয়ের বিকার—অর্থে দৃষ্টান্তস্বরূপ রসনেন্দ্রিয়ের বিকার গ্রহণ করিতেছি; মনে কর, উত্তম অম্ল ফল পূর্ব্বে ভোজন করিয়াছ। সময়বিশেষে সেই ফল হাতে পাইলে, জিহ্বায় জল সরে। এই যে জলনিঃসরণ ইহা লোভপ্রযুক্ত, এই লোভ সেই ফলের অম্লরস-জ্ঞান মূলক; এই অম্লরস-জ্ঞান অনুমানমূলক, নতুবা সে সময়ে তো তাহার স্বাদ গ্রহণ হয় নাই, যে রসপ্রত্যক্ষ বলিবে। অনুমান করিতে হইলে ব্যাপ্তিজ্ঞান আবশ্যক। এই পরম্পরা দ্বারা বুঝা যাইতেছে—এই জ্ঞান-ইচ্ছার আধার একটী স্থির বস্তু আছে, তাহাই আত্মা। সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং অন্যান্য প্রযত্নের যিনি আশ্রয় তিনি আত্মা।। ৪।।

উপস্কারঃ

ইদানীং ক্ৰমলঙ্ঘনপ্রয়োজনমাদর্শয়ন্নেবাত্মপরীক্ষাশেষং বর্ত্তয়িষ্যন্নাহ।

প্রসিদ্ধিজ্ঞানমেব কেবলমাত্মনো লিঙ্গমিতি ন মন্তব্যং প্রাণাদয়োঽপি সন্তি আত্মনো লিঙ্গানি, তথাহি শরীরান্তশ্চারিণি সমীরণে প্রাণাপানলক্ষণে ঊর্দ্ধাধোগতী উৎক্ষেপণাবক্ষেপণে মুষলাদাবিব প্রযত্নং বিনানুপপদ্যমানে যস্য প্রযত্নাদ্ ভবতঃ স নূনমাত্মা, ন হি তির্য্যমনস্বভাবস্য বায়োরেবং স্বভাববিপর্যয়ো বিনা প্রযত্নাৎ, ন চ বিরুদ্ধদিক্‌ক্রিয়য়োবায়োঃ সলিলয়োরিবোর্দ্ধগতিঃ স্যাদিতি বাচ্যম্। এবং সত্যূৰ্দ্ধগমনমেব স্যান্নত্বরোগমনং ফুৎকারাদৌ বা তির্য্যগ্‌গমনম্, তথাচাস্তি কশ্চিৎ, যঃ প্রযত্নেন বায়ুমূর্দ্ধমধো বা প্রেরয়তি, সুষুপ্তিদশায়াং কথং প্রাণাপানয়োরূর্দ্ধাধোগতী ইতি চেন্ন, তদানীং যোগ্যপ্রযত্নাভাবেঽপি প্রযত্নান্তরস্য সদ্ভাবাৎ স এব জীবনযোনিঃ প্রযত্ন ইত্যুচতে। এবং নিমেষোন্মেষাবপি শরীরস্যাধিষ্ঠাতারমনুমাপয়তঃ তথাহি নিমেষস্তাবৎ অক্ষিপক্ষ্মণোঃ সংযোগজনকং কৰ্ম্ম উন্মেষস্তয়োরেব বিভাগজনকং কৰ্ম্ম। এতে চ কৰ্ম্মণী নোদনাভিঘাতাদিদৃষ্টকারণমন্তরেণ নিরন্তরমুৎপদ্যমানে প্রযত্নং বিনা নোৎপদ্যেতে। যথা দারুপুত্রকনর্ত্তনং কস্যচিৎ প্রযত্নাৎ তথাহক্ষিপক্ষ্মনৰ্ত্তনমপি, তেন প্রযত্নবাননুমীয়তে, এবং জীবনমপ্যাত্মলিঙ্গং তথাহি জীবনপদেন লক্ষণয়া জীবনকাৰ্য্যং বৃদ্ধিক্ষতভগ্নসংরোহণাদি লক্ষয়তি। তথাচ যথা গৃহপতিভগ্নস্য গৃহস্য নিৰ্ম্মাণং করোতি, লঘীয়ো বা গৃহং বৰ্দ্ধয়তি তথা দেহাধিষ্ঠাতা গৃহস্থানীয়স্য দেহস্যাহারাদিনা বৃদ্ধিমুপচয়ং করোতি, ক্ষতঞ্চ ভেষজাদিনা প্ররোহয়তি, ভগ্নঞ্চ করচরণাদি সংরোহয়তি। তথাচ গৃহপতিরিব দেহস্যাপ্যধিষ্ঠাতা সিধ্যতীতি। এবং মনোগতির প্যাত্মলিঙ্গং তথাহি মনস্তাবমূর্ত্তমণু চেতি পূর্ব্বপ্রকরণে সাধিতম্। তস্য চাভিমতবিষয়গ্রাহিণি ইন্দ্রিয়ে নিবেশনম্ ইচ্ছাপ্রণিধানাধীনম্, তথাচ যস্যেচ্ছাপ্রণিধানে মনঃ প্রেরয়তঃ স আত্মেত্যনুমীয়তে। যথা গৃহকোণাবস্থিতো দারকঃ কন্দুকং লাক্ষাগুটকং বা গৃহাভ্যন্তর এব ইতস্ততঃ প্রেরয়তি। ননু দারুপুত্রনওয়িতা গৃহপতিদারকো বা ন শরীরাদন্যো যো দৃষ্টান্তঃ স্যাৎ, কিঞ্চ শরীরমেব চৈতন্যাশ্রয়ঃ অহঙ্কারাস্পদত্বাৎ, ভবতি হি গৌরোহহং স্থূলোঽহমিত্যাদ্যহঙ্কারসামানাধিকরণ্যেন প্রত্যয়ঃ যত্ত্ব বাল্যেঽনুভূতং যৌবনে বার্ধক্যে বা স্মরতি। তত্র চৈত্রমৈত্রবচ্ছরীরভেদেঽপি স্মরণং ন স্যাৎ “নান্যদৃষ্টং স্মরত্যন্যঃ” ইতি তত্র চৈত্রমৈত্ৰয়োর্ভিন্নসন্তানত্বেন প্রতিসন্ধানং মাহস্তু বাল্যকৌমারভেদেঽপি সন্তানৈকত্বাৎ কার্য্যকারণভাবেন প্রতিসন্ধানমুপপৎস্যত ইতি তত্র ক্রমঃ। পিত্রানুভূতস্য পুত্রেণাপি স্মরণপ্রসঙ্গঃ, তত্র শরীরভেদগ্রহো বাধক ইতি চেৎ? বৃদ্ধেন বালশরীরাদ্ভেদেনৈব স্বশরীরস্য গ্রহাৎ প্রতিসন্ধানানুপপত্তেঃ অনুপলব্ধপিতৃকস্য বালস্য শরীরভেদাগ্রহস্যাপি সত্ত্বাৎ; মম শরীরমিতি মমকারসামান্যেনাহঙ্কারস্য ভানাৎ, মমাত্মেতত্রাপি তথেতি চেন্ন, ত মমকারস্যৌপচারিকত্বাৎ, রাহোঃ শির ইতিবদভেদেঽপি ষষ্ঠ্যুপপত্তেঃ, হিসাদিফলঞ্চ কর্ত্তরি ন স্যাৎ শরীরস্যান্যান্যত্বাৎ, পাতকমিচ্ছতো ভূতচৈতনিকস্য কৃতহানমকৃতাভ্যাগমশ্চ দোষ ইতি দিক্। ইন্দ্রিয়ান্তরবিকারাৎ খল্বপি দৃশ্যতে হি নাগরঙ্গস্য চিরবিল্লস্য বা রূপবিশেষসহচরিতং রসবিশেষমনুভূয় পুনস্তাদৃশং ফলমুপলভমানস্য রসগর্দ্ধি প্রবর্তিতো দন্তোদকসংপ্লবঃ। স চ নাম্লরসানুমিতিমন্তরেণ, অনুমিতির্ন ব্যাপ্তিস্মৃতিমন্তরেণ, সা চ ন সংস্কারং বিনা, স চ ন ব্যাপ্ত্যনুভবমন্তরেণ, স চ ন ভূয়োদর্শনমন্তরেণেতি। ইয়ং জ্ঞানপরম্পরা নৈকং কর্তারমন্তরেণ কার্য্যকারণভূতা সম্ভবতীতি। তথাচ গৌতমীয়ং সূত্রম্ “ইন্দ্রিয়ান্তরবিকারাৎ” ইতি। সুখাদয়শ্চ জ্ঞানবদেবাত্মলিঙ্গানি দ্রষ্টব্যাঃ। তথাহি সুখাদিকং ক্বচিদাশ্রিতং দ্রব্যাশ্রিতং বা কাৰ্য্যবস্তুত্বাৎ গুণত্বাদ্বা রূপাদিবদিতীতরবাধসহকৃতং সামান্যতো দৃষ্টমেব অষ্টদ্রব্যাতিরিক্তদ্রব্যাশ্রিতত্বং বিষয়ীকরোতি। ন হি পৃথিব্যাদ্যষ্টকানাশ্রিতা ইচ্ছা দ্রব্যাশিতেতি প্রতিজ্ঞা অষ্টদ্রব্যাতিরিক্ত- দ্রব্যাশ্রিতত্বং প্রকারমনাদায় পর্যবস্যতি। যত্র তু প্রথমং ন বাধাবতারস্তত্রাষ্টদ্রব্যা- তিরিক্তদ্রব্যাশ্রিতত্বং ব্যতিরেকিসাধ্যমিতি বিভাগঃ, ব্যাপকতাবচ্ছেদকপ্রকারিকৈবানুমিতিরিতি তু তুচ্ছম্। যেন বিনা প্রতীতিন পর্য্যবস্যতি তস্যৈব তত্র প্রকারত্বাৎ। অন্যথা দ্ব্যণুক কাৰ্য্যানাশ্রিতং সৎ ক্বচিদাশ্রিতম্ অবয়বিত্বাদিত্যাদাবকার্য্যাশ্রিতত্বপ্রকারিকানুমিতিন স্যাৎ।।৪।।

তস্য দ্রব্যত্বনিত্যত্বে বায়ুনা ব্যাখ্যাতে।।৫।।

অনুবাদ

তাহার (আত্মার) দ্রব্যত্ব এবং নিত্যত্ব বায়ু দ্বারা ব্যাখ্যাত হইয়াছে।। ৫।।

ব্যাখ্যা

জ্ঞানাদিগুণ আছে বলিয়া আত্মা দ্রব্য এবং অসমবেত অর্থাৎ আকাশবৎ নিরবয়ব বলিয়া নিত্য—ইহা বায়ুপ্রকরণের সূত্রানুসারে বুঝিবে।।৫।।

উপস্কারঃ

ননু সিধ্যতু আত্মা স্থিরঃ, স তু নিত্য ইতি কুতঃ, কুতশ্চ দ্রব্যমিত্যত আহ।

যথা বায়ুপরমাণোরবয়বকল্পনায়াং ন প্রমাণমতো নিত্যত্বং তথাত্মনোঽপি, যথা গুণবত্ত্বাদ্বায়ুপরমাণুদ্রব্যং তথাত্মাপীত্যর্থঃ।। ৫।।

.

যজ্ঞদত্ত ইতি সন্নিকর্ষে প্রত্যক্ষাভাবাদ দৃষ্টং লিঙ্গং ন বিদ্যতে।। ৬।।

অনুবাদ

সন্নিকর্ষ হইলে (ইনি) “যজ্ঞদত্ত” এইরূপ প্রত্যক্ষ না হওয়ায় (আত্মার) দৃষ্ট অনুমাপক নাই।। ৬।।

ব্যাখ্যা

আত্মা যে অনুমানগম্য নহেন, পরন্তু শাস্ত্রগম্য, বিবাদীদিগের এই মত তিনটী সূত্রে বিবৃত হইতেছে। অনুমান তিনপ্রকার,* ‘পূর্ব্ববৎ’ ‘শেষবৎ’ এবং ‘সামান্যতোদৃষ্ট’। যেস্থলে সাধ্য ও হেতুর ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষবিষয়ীভূত, সুতরাং সাধ্যও প্রত্যক্ষযোগ্য, কেবল ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ নাই বলিয়াই তখন তাহার প্রত্যক্ষ হয় না, সেই স্থলীয় অনুমান ‘পূৰ্ব্ববৎ’। যথা ‘পৰ্ব্বতো বহ্নিমান্ ধূমাত্’ এই স্থলীয় অনুমান। রন্ধনশালা প্রভৃতি স্থানে ধূম যে বহ্নিব্যাপ্য ইহা প্রত্যক্ষীকৃত; তবে পৰ্ব্বতে বহ্নিপ্রত্যক্ষ হয় নাই, কেননা পর্ব্বতের বহ্নি চক্ষুর অন্তরালে অবস্থিত। কিন্তু চক্ষুসন্নিকৃষ্ট হইলেই তাহাতে প্ৰত্যক্ষ হইতে পারে, অতএব উহা প্রত্যক্ষযোগ্য। আত্মার অনুমান এরূপ হয় না, কেননা আত্মা প্রত্যক্ষযোগ্য নহে। যজ্ঞদত্ত-দেহ চক্ষুর সন্নিহিত হইলেও এই আত্মা যজ্ঞদত্ত এরূপ প্রত্যক্ষ হয় না। অতএব আত্মা প্রত্যক্ষযোগ্য নহে। সুতরাং আত্মার সহিত চক্ষুর নিমেষ প্রভৃতি দৃষ্ট-হেতুরও ব্যাপ্তি-প্রত্যক্ষ কখনই হইতে পারেনা। অতএব আত্মার পূর্ব্ববৎ অনুমান নাই।।৬।।

[* বৈশেষিকে ব্যাখ্যাকর্তারা তিন প্রকার অনুমান বলিয়াছেন, পরন্তু উহা ন্যায়দর্শনসম্মত। বৈশেষিক-সূত্রকার মহর্ষির সম্মত নহে, তাঁহার মতে অনুমান দুইপ্রকার,—পূর্ব্ববৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট। শেষবৎ অনুমানই নহে, উহা সামান্যতোদৃষ্টের সাহায্যকারী মাত্র।]

উপস্কারঃ

পূৰ্ব্বপক্ষমাহ।

সন্নিকর্ষে সতি অয়ং যজ্ঞদত্ত ইতি চেৎ প্রত্যক্ষং নাস্তি তদা দৃষ্টং প্রত্যক্ষতে গৃহীতব্যাপ্তিকং লিঙ্গং নাস্তি। যথা বহ্নিনা প্রত্যক্ষেণ সহচরিতো গৃহীতো ধূমো বহ্নৌ দৃষ্টং লিঙ্গং তথাত্মসাধকং লিঙ্গং দৃষ্টং নাস্তীত্যর্থঃ।।৬।।

সামান্যতো দৃষ্টাচ্চাবিশেষঃ।।৭।।

অনুবাদ

সামান্যতোদৃষ্ট (অনুমান) হইতে এবং শেষবৎ অনুমান হইতে বিশেষ জ্ঞান হয় না।।৭।।

ব্যাখ্যা

‘এবং শেষবৎ অনুমান হইতে’ এই অংশ সূত্রস্থ চকারের অর্থ। পূর্ব্বপক্ষকারী বলেন, জ্ঞান কোথাও আছে, কেননা তাহা গুণ, এইরূপ যে সকল অনুমান তাহা সামান্যতোদৃষ্ট,—এখানে প্রকৃত সাধ্য আত্মবৃত্তিত্ব, তাহার সহিত হেতুর ব্যাপ্তিপ্রত্যক্ষ কোথাও হয় নাই। এই অনুমানে জ্ঞানের কোন স্থানে অস্তিত্ব মাত্র সিদ্ধি হয়, কিন্তু তাহার দ্বারা অষ্টদ্রব্যাতিরিক্ত আত্মার সিদ্ধি হয় না। আর জ্ঞান পৃথিবী প্রভৃতির গুণ নহে, যেহেতু তাহা বাহ্য প্রত্যক্ষের অবিষয় এবং মানস প্রত্যক্ষের বিষয়। এইরূপ অনুমান ‘শেষবৎ’ কেননা এখানে পরিশেষে স্থির করিতে হয়। যাহা পৃথিবী প্রভৃতির গুণ, তাহা যে বাহ্য প্রত্যক্ষের অবিষয় অথচ মানস প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত এরূপ হয়না; যথা রূপ, এইরূপ নিশ্চয় অগ্রে হয়, পরে বাহ্য প্রত্যক্ষের অবিষয়ত্ব ও মানস প্রত্যক্ষের বিষয়ত্ব দ্বারা জ্ঞান যে পৃথিবীগুণ নহে ইহা সিদ্ধ করা হয়। এই সাধ্য ও হেতু কোন এক স্থানে পরিগৃহীত হয় না, পরন্তু সাধ্যাভাব ও হেত্বভাব একত্র গৃহীত হয়। এই গ্রহণের পরিশেষে প্রকৃত অনুমান হয় বলিয়া ইহার নাম ‘শেষবৎ’। এই শেষবৎ অনুমান দ্বারা জ্ঞান পৃথিবীগুণ নহে, জলের গুণ নহে—এইরূপ স্থির হয়। এই ‘উহা নহে, ইহা নহে’ জ্ঞানে বিষয়ের স্বরূপপরিচয় হয়না, এমন কি কাটিতে কাটিতে নির্মূল হইতেও পারে। অতএব ঐ দুই অনুমানেও আত্মার সিদ্ধি হয় না।।৭।।

উপস্কারঃ

ননু প্রত্যক্ষদৃষ্টব্যাপ্তিকস্য দৃষ্টলিঙ্গস্যাভাবেঽপি সামান্যতো দৃষ্টমেব লিঙ্গং ভবিষ্যতি ন হি ততো নানুমিতিরিত্যাশঙ্ক্য পুনঃ পূৰ্ব্বপক্ষী আহ।

সামান্যতো দৃষ্টমপি লিঙ্গং ভবতি ন তু তত্র আত্মত্বেন অষ্টদ্রব্যাতিরিক্তদ্রব্যত্বেন বা স্যাদাত্মসিদ্ধিঃ, কিন্তু তেনেচ্ছাদীনাং ক্বচিদাশ্রিতত্বমাত্রং সিধ্যেৎ। তচ্চ নাত্মমননৌপয়িকমিত্যর্থঃ। তদেতদাহ অবিশেষ ইতি।।৭।।

.

তস্মাদাগমিকঃ।।৮।।

অনুবাদ

অতএব (আত্মা) শাস্ত্র মাত্র দ্বারা সিদ্ধ।। ৮।।

ব্যাখ্যা

ত্রিবিধ অনুমানই যখন কাজে আসিল না; তখন আত্মা অনুমান-সিদ্ধ নহে, পরন্তু আত্মা শ্রুতি-স্মৃতি দ্বারা সিদ্ধ। ‘স আত্মা’ ইত্যাদি শ্রুতি ‘অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যোঽয়ম্’ ইত্যাদি স্মৃতিই আত্মার প্রমাণ।। ৮।।

উপস্কারঃ

তৎ কিং যোহপহতপাপ্ মা স আত্মা ইত্যাদ্যাগমোহনর্থক এবেত্যাশঙ্ক্য স এবাহ। আগমমাত্রসিদ্ধ এবাত্মা ন ত্বনুমেয়ঃ দৃষ্টসামান্যতোদৃষ্টয়োর্লিঙ্গয়োরভাবাৎ। তস্মাৎ সম্যগুপনিষদাং শ্রবণাৎ তত্ত্বসাক্ষাৎকার উৎপদ্যতে ন তু মননপ্রণালিকয়া, তথাচ মননপ্রয়োজনকমিদং তন্ত্রমতন্ত্রম্, দৃষ্টং হি ভূতদশকনদীসন্তরণাদাবুপদেশমাত্রাদেব সাক্ষাৎকারিজ্ঞানম্।।৮।।

.

অহমিতিশব্দস্য ব্যতিরেকান্নাগমিকম্।।৯।।

অনুবাদ

‘অহং’ ইত্যাকার শব্দ অন্যত্র প্রযুক্ত হয়না বলিয়া, আত্মার সিদ্ধি হয়। সুতরাং আত্মা শাস্ত্রমাত্রসিদ্ধ নহে।।৯।।

ব্যাখ্যা

এই তিন সূত্রে যে পূৰ্ব্বপক্ষ উপস্থিত, তাহার উত্তর—কেবল শাস্ত্রই যে আত্মার একমাত্র প্রমাণ তাহা নহে—‘অহং’ (আমি) শব্দও আত্মার বিশেষ প্রমাণ। যে বস্তুকে লক্ষ্য করিয়া লোকে অহং শব্দ প্রয়োগ করে, এবং ‘অহং সুখী’ (আমি সুখী) এইরূপে যাঁহার প্রত্যক্ষও হয় তিনি আত্মা। সুতরাং মানস প্রত্যক্ষ এবং শব্দপ্রয়োগ হেতুক অনুমান আত্মার অস্তিত্বসাধক, কেবল শাস্ত্র নহে। শাস্ত্র হইতে আত্মার বিষয় জানিবে, পরে অনুমান দ্বারা শাস্ত্রোক্ত তত্ত্ব দৃঢ় করিবে, তাহার পর নিরন্তর ধ্যান করিবে, তখন সেই ধ্যানবলে আত্মার সাক্ষাৎকার হইবে। এই সাক্ষাৎকার হইলে, দেহাদির প্রতি যে আত্মত্বাভিমান আছে তাহা বিনষ্ট হইবে। তাহার ফল মুক্তি। এই জন্যই অনুমানপ্রধান ন্যায়-বৈশেষিক শাস্ত্র মোক্ষশাস্ত্র। অনুমানের দোষগুণ না জানিলে অনুমান করিবে কি উপায়ে? আত্মার যে অনুমান করিতে হয় তাহার প্রমাণ শ্রুতিতে আছে,— “আত্মা বারে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ” ইত্যাদি। অর্থাৎ আত্মসাক্ষাৎকার করিতে হইলে আত্মসম্বন্ধে বেদোক্ত উপদেশ গ্রহণ, অনুমান এবং নিরন্তর ধ্যান কর্তব্য। স্মৃতিতে আছে,—

“শ্রোতব্যঃ শ্রুতিবাক্যেভ্যো মন্তব্যশ্চোপপত্তিভিঃ।
মত্বা চ সততং ধ্যেয় এতে দর্শনহেতবঃ”।।

অর্থাৎ বিবিধ বেদবাক্য হইতে আত্ম-তত্ত্বের উপদেশ গ্রহণ, বহুবিধ উপযুক্ত হেতু দ্বারা অনুমান এবং পরিশেষে নিরন্তর ধ্যান—এই তিনটীই আত্মসাক্ষাৎকারের হেতু। অতএব কেবল শাস্ত্রকেই আত্মার জ্ঞাপক বলিলে চলিবে না। বিশেষতঃ সামান্যতোদৃষ্ট এবং শেষবৎ অনুমান দ্বারা পৃথিবী প্রভৃতি অষ্ট দ্রব্য হইতে অতিরিক্ত দ্রব্যের সিদ্ধি হয়। জ্ঞান পৃথিবী প্রভৃতির গুণ নহে, এই নিশ্চয়, পরে জ্ঞান কোথাও আছে এই ভাবের অনুমান, পরে আটটা দ্রব্যের অতিরিক্ত দ্রব্যে জ্ঞান আছে এইরূপ অনুমিতি হয়। এই স্থলের অনুমান সামান্যতোদৃষ্ট হয় এবং অগ্রে জ্ঞান কোথাও আছে এইরূপ নিশ্চয় করিয়া ইহা নহে উহা নহে’ এইরূপে নিষেধ করিলে শেষবৎ অনুমান হয়। জ্ঞান অন্য কোন দ্রব্যের গুণ এই নিশ্চয়ই শেষবৎ অনুমানের ফল। এই দুই অনুমান দ্বারাও আত্মার সিদ্ধি হইয়া থাকে। ‘অহং’ শব্দ প্রয়োগ দ্বারা যে আত্মসিদ্ধির কথা বলা হইয়াছে তাহা সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান দ্বারাও যে আত্মার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়, ইহা প্রদর্শনের জন্য।।৯।।

উপস্কারঃ

তদেবং ত্রিভিঃ সূত্রৈঃ পূৰ্ব্বপক্ষে সিদ্ধান্তবাদ্যাহ।
নাগমমাত্রং প্রমাণমাত্মনি কিন্তুঽমিতি-পদা_[?]_বা সার্ভিধেয়ং পদত্বাৎ ঘটাদিপদবৎ ইত্যনুমানাদপ্যাত্মসিদ্ধিঃ। ননু পৃথিব্যাদ্যেব তদভিধেয়ং স্যাদিত্যত আহ ব্যতিরেকাদিতি, পৃথিব্যাদিতোহহমিতি পদস্য ব্যতিরেকাদ্ব্যাবৃত্তেরিত্যর্থঃ। ন হি ভবত্যহং পৃথিবী, অহমাপঃ, অহন্তেজঃ, অহং বায়ুঃ, অহমাকাশম্, অহং কালঃ, অহং দিক্, অহং মন ইতি ব্যপদেশঃ প্রত্যয়ো বা, শরীরে ভবতীতি চেন্ন পরশরীরেঽপি তৎপ্রসঙ্গাৎ। স্বশরীরে ভবতীতি চেন, স্বস্যাত্মভিন্নস্যানিরুক্তেঃ মম শরীরমিতি বৈয়ধিকরণ্যেন প্রত্যয়াচ্চ। নন্বিদমপি সামান্যতোদৃষ্টমেব তচ্চ বিশেষাপর্যবসন্নমিতি দূষিতমেবেতি চেন্ন অহম্পদেঽহত্ত্বমাত্মত্বমেব প্রকারঃ। তথাচ পক্ষধর্ম্মতাবলাদেবাহত্ত্বস্য প্রবৃত্তিনিমিত্তত্বং পৰ্য্যবসন্নং তচ্চানন্যসাধারণমেবেতি বিশেষসিদ্ধেঃ এবং সামান্যতোদৃষ্টাদপি বাধসহকৃতাদ্বিশেষসিদ্ধিঃ। যচ্চোক্তং শ্রবণাদেব সাক্ষাৎকারঃ কিমনেনেতি তদযুক্তম্। ন হি মননমন্তরেণ সঙ্কশুকস্যাশ্রদ্ধামলক্ষালনম্, ন চ তদন্তরেণ তত্র নিদিধ্যাসনাধিকারঃ, ন চ নিদিধ্যাসনমন্তরেণ সবাসনমিথ্যাজ্ঞানোমূল- ক্ষমস্তত্ত্বসাক্ষাৎকারঃ, অভ্যাসাদেব হি কামাতুরস্যাকস্মাৎ কামিনীসাক্ষাৎকারঃ, ন হি শাব্দমানুমানিকং বা জ্ঞানং মিথ্যাজ্ঞানোমূলনক্ষমং দিত্মোহাদৌ দৃষ্টমিতি ভাবঃ। ননু তথাপি পরোক্ষে আত্মনি কথং সঙ্কেতগ্রহ ইতি চেৎ, ক এবমাহ নাত্মা প্রত্যক্ষ ইতি, কিন্তু মনসা সংযোগপ্রত্যাসত্যাত্মগ্রহঃ কথমন্যথাহং সুখী, জানামীচ্ছামি যতে দুঃখীত্যাদিপ্রত্যয়ঃ? নহ্যয়মবস্তুকঃ সন্দিগ্ধবস্তুকো বা, নীলাদিপ্রত্যয়বৎ। অস্যাপি নিশ্চিতবস্তুকত্বাৎ, ন লৈঙ্গিকঃ, লিঙ্গজ্ঞানমন্তরেণাপি জায়মানত্বাৎ, নাপি শাব্দঃ, তদনুসন্ধানানুবিধানাৎ, প্রত্যক্ষাভাসো হ য়মিতি চেৎ, তহি ক্বচিদনাভাসবিষয়োঽপি নহ্যপ্রমিতমারোপ্যতে ইত্যাবেদয়িষ্যতে।।৯।।

.

যদি দৃষ্টমন্বক্ষমহং দেবদত্তোঽহং যজ্ঞদত্ত ইতি।। ১০।।

অনুবাদ

আমি দেবদত্ত, আমি যজ্ঞদত্ত এইরূপ যদি প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় (তবে আর অনুমান কেন?)।। ১০।।

ব্যাখ্যা

পূৰ্ব্বসূত্রে অহং অর্থাৎ আমি এই জ্ঞান দ্বারা আত্মার প্রত্যক্ষ হয় ইহা বলা হইয়াছে। সেইজন্য বিবাদী আপত্তি করিতেছেন। যদি আত্মার প্রত্যক্ষই হয়, তবে অনুমান কেন? ‘দেবদত্ত’ ‘যজ্ঞদত্ত’ মনুষ্যবিশেষের নাম।। ১০।।

উপস্কারঃ

এবঞ্চেৎ কিমনুমানেনেতি পূৰ্ব্বপক্ষবাদী আহ।

ইতিশব্দো জ্ঞানপ্রকারমাহ দৃষ্টমিতি ভাবে-ক্তপ্রত্যয়ান্তম্, অন্বক্ষমিত্যধ্যক্ষং তেনায়মর্থঃ। অয়ং দেবদত্তঃ, অয়ং যজ্ঞদত্ত ইতি প্রকারকং দৃষ্টং দর্শনম্ অধ্যক্ষমেবাস্তি যদি কিমনুমানপ্রয়াসেন “ন হি করিণি দৃষ্টে চীৎকারেণ তমনুমিমতে ২ নুমাতারঃ”।।১০।।

.

দৃষ্টয়াত্মনি লিঙ্গে এক এর দৃঢ়ত্বাৎ প্রত্যক্ষবৎ প্ৰত্যয়ঃ।। ১১।।

অনুবাদ

আত্মা প্রত্যক্ষসিদ্ধ হইলেও (যদি) অনুমানের কারণকলাপ থাকে তাহা হইলে, সেই বিষয়েই দৃঢ় প্রত্যয় হয় (অতএব অনুমান নিরর্থক নহে)।। ১১।।

ব্যাখ্যা

এক বিষয়ে নানা প্রমাণ থাকিলে, সে বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ের জন্যই অনুমান আবশ্যক।। ১১।।

উপস্কারঃ

অত্র সিদ্ধান্ত্যাহ।

দৃষ্টে প্রত্যক্ষেণ গৃহীতে আত্মনি লিঙ্গে সম্ভূতসামগ্রীকে সতি এক এব একবৈষয়িক এব প্রত্যয়ঃ, প্রত্যয় ইতি নিরস্তসমস্তবিভ্রমাশঙ্কিত্বমাহ, কুত এবমিত্যত আহ—দৃঢ়ত্বাৎ প্রমাণসংপ্লবেনান্যথাভাবশঙ্কানিবর্ত্তনপটুত্বাৎ। তত্র দৃষ্টান্তমাহ প্ৰত্যক্ষবদিতি। যথা দূরাত্তোয়প্রত্যক্ষে সত্যপি সংবাদার্থং বলাকালিঙ্গেনাপি তদনুমানং তদুক্তম্ “প্রত্যক্ষপরিকলি তমপ্যনুমানেন বুভুৎসন্তে তর্করসিকাঃ” ইতি। ইদমত্রাকূতম্। যদ্যাত্মা কদাচিৎ প্রত্যক্ষে চৈতসে ভাসত এব তথাপি অহং গৌরঃ অহং কৃশ ইত্যাদিবিরোধিপ্রত্যয়ান্তরতিরস্কৃতো ন তথা স্থেমানমাসাদয়তি বিদ্যুৎসম্পাতসঞ্জাতজ্ঞানবৎ, তত্র লিঙ্গেন অনন্যথাসিদ্ধেন জ্ঞানান্তর- মুৎপদ্যমানং পূৰ্ব্বজ্ঞানমেব স্থিরীকরোতি। কিঞ্চ “শ্রোতব্যো মন্তব্য” ইত্যাদিবিধিবোধি – তস্যাত্মমননস্য ইষ্টসাধনত্বাবগতৌ অনুমিৎসয়াবশ্যমাত্মানুমানপ্রবৃত্তিঃ, তদ্ব্যতিরেকে নিদিধ্যা- সনাসম্ভবে সাক্ষাৎকারাভাবেঽপবর্গাসম্ভবাদিতি ভাবঃ। অহং দেবদত্তোহহং যজ্ঞদত্ত ইতি প্রতীতিদ্বয়াভিধানমাত্মনঃ প্রত্যাত্মবেদনীয়ত্বং সূচয়িতুম্।। ১১।।

.

দেবদত্তো গচ্ছতি যজ্ঞদত্তো গচ্ছতীত্যুপচারাচ্ছরীরে প্রত্যয়ঃ।। ১২।।

অনুবাদ

দেবদত্ত গমন করিতেছে, যজ্ঞদত্ত গমন করিতেছে, এই যে শরীরবিষয়ক ব্যবহার ইহা ঔপচারিক।।১২।।

ব্যাখ্যা

শরীরই—আমি দেবদত্ত ইত্যাদি প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত বস্তু, আত্মা। তুমি যাহাকে আত্মা বলিতেছ তাহা আত্মা নহে। তাহা আত্মা হইলে, দেবদত্ত যাইতেছে ইত্যাদি প্রত্যয় হইত না। তুমি যাহাকে আত্মা বল, সে বস্তুর তো গমনক্রিয়া নাই। এই আপত্তির উত্তর এই যে, দেবদত্তের মৃত্যুর পর তাহার মৃত শরীর ক্রোড়ে লইয়া তাহার মাতা রোদন করে—”ওরে দেবদত্ত তুই কোথায়?” এ বিলাপের বিষয় দেবদত্ত তো শরীর নহে, শরীর তো তখন তাহার ক্রোড়েই থাকে। সুতরাং ঐ শরীরের সহিত বিজাতীয় সম্বন্ধবিশিষ্ট আত্মাই ঐখানে দেবদত্ত শব্দের অর্থ। ‘আমি দেবদত্ত জানিতেছি’ ইত্যাদি স্থলেও ঐ আত্মাই দেবদত্ত শব্দের অর্থ; ইহাই মুখ্য অর্থ। আর দেবদত্ত যাইতেছে ইত্যাদি স্থলে শরীরেই দেবদত্ত শব্দের প্রয়োগ, ইহা মুখ্য অর্থে নহে, গৌণ অর্থে। “ওরে, দেবদত্ত! তুই কোথায়?” বা “আমি দেবদত্ত জানিতেছি” ইত্যাদি স্থলে দেবদত্ত শব্দের যে অর্থ—দেবদত্ত যাইতেছে এ স্থলে দেবদত্ত শব্দের সে অর্থ নহে। ‘আমি’ প্রত্যয়ের যাহা বিষয় তাহা আত্মা। এই ব্যাখ্যা উপস্কার মতের অনুরূপ।। ১২।।

উপস্কারঃ

ননু যদি যদি যজ্ঞদত্তোহহমিতি প্রত্যয় আত্মনি তদা যজ্ঞদত্তো গচ্ছতীতি গমনসামানাধিকরণ্যভানমনুপপন্নমিত্যত আহ

অস্তি হি অহং গৌরঃ অহং স্থূল ইতি প্রত্যয়ঃ। অস্তি চ মম শরীরমিতি ভেদপ্রত্যয়ঃ। তত্র দেবদত্তো গচ্ছতীতি গতিসামানাধিকরণ্যানুভবো ব্যবহারশ্চ ভাক্তঃ, মমেতি প্রত্যয়স্য যথার্থত্বাৎ। যদ্যপি দেবদত্তত্বং শরীরবৃত্তির্জাতিস্তেন দেবদত্তো গচ্ছতীতি মুখ্য এব প্রয়োগো যথার্থ এব চ প্রত্যয়ঃ তথাপি দেবদত্তপদং তদবচ্ছিন্নাত্মনি প্রযুক্তঞ্চেৎ তদৌপচারিকো বোদ্ধব্যঃ।।১২।।

.

সন্ধিগ্ধস্তূপচারঃ।।১৩।।

অনুবাদ

কিন্তু উপচার অর্থাৎ গৌণত্ব সন্ধিগ্ধ।। ১৩।।

ব্যাখ্যা

‘আমি যাইতেছি’ এরূপ প্রত্যয় হয়। সুতরাং দেহ ‘অহং’ বা আমি শব্দের মুখ্য না গৌণ অর্থ? এবিষয়ে সন্দেহ আছে। বিবাদীর ইহা অপর আপত্তি।। ১৩।।

উপস্কারঃ

অত্র শঙ্ক্যতে।

তুশব্দঃ পূৰ্ব্বপক্ষদ্যোতকঃ। আত্মশরীরয়োস্তাবদহমিতি প্রত্যয়ঃ প্রয়োগশ্চ দৃশ্যতে। তত্র ক মুখ্যঃ ক্ব বৌপচারিক ইতি সন্দেহঃ।।১৩।।

অহমিতি প্রত্যগাত্মনি ভাবাৎ পরত্রাভাবাদর্থান্তর প্রত্যক্ষঃ।। ১৪।।

অনুবাদ

‘অহং’ এইরূপ প্রত্যয় (কেবল) স্বকীয় আত্মায় আছে এবং অন্যত্র নাই। অতএব দ্রব্যান্তর অর্থাৎ আত্মাই সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয়।। ১৪।।

ব্যাখ্যা

পূর্ব্ব সূত্রোক্ত আপত্তির খণ্ডন এই যে, শরীরাদি হইতে বিভিন্ন নিরাকার আত্মা অহং-জ্ঞানের বিষয়—শরীর নহে। শরীর সেই প্রত্যয়ের বিষয় হইলে, ঐ প্রত্যয় বাহ্যেন্দ্ৰিয়জন্য হইত, মানস হইত না; লোকে যখন চক্ষু মুদ্রিত করিয়াও ‘অহং’ এইরূপ অনুভব করে, তখন সে প্রত্যয় যে মানস, তদ্বিষয়ে আর সন্দেহ কি? যদি বল, শরীরের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষই অহং বস্তুর চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ; তাহা হইলে, আমরা বলি, শরীরের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হইলে তদীয় রূপরসাদির ন্যায় তদীয় সুখাদিরও চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হইত। বিশেষতঃ শরীরে চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়সংযোগ না হইলে, ‘অহং সুখী’ এরূপ অনুভব যে হয় না, তাহাও নহে। অতএব অহং ও শরীর বিভিন্ন।। ১৪।।

উপস্কারঃ

সমাধত্তে।

অর্থান্তরমাত্মস্বরূপং প্রত্যক্ষং যত্র প্রত্যয়ে স প্রত্যয়োঽর্থান্তর প্রত্যক্ষঃ। অয়মর্থঃ, অহমিতি প্রত্যয়স্য প্রত্যগাত্মনি স্বাত্মনি ভাবাৎ পরত্র পরাত্মনি অভাবাৎ অর্থান্তরে স্বাত্মন্যেব মুখ্যঃ কল্পয়িতুমুচিতঃ, যদি তু শরীরে মুখ্যঃ স্যাৎ তদা বহিরিন্দ্রিয়জঃ স্যাৎ। ন হি শরীরং মানসপ্রত্যক্ষং মানসশ্চায়মহমিতি প্রত্যয়ঃ বহিরিন্দ্রিয়ব্যাপারমন্তরেণাপি জায়মানত্বাৎ। অহং দুঃখী সুখী জানে যতে ইচ্ছাম্যহমিতি যোগ্যবিশেষগুণোপহিতস্যাত্মনো মনসা বিষয়ীকরণাৎ, নায়ং লৈঙ্গিকো লিঙ্গানুসন্ধানমন্তরেণাপি জায়মানত্বাৎ, ন শাব্দঃ শব্দাকলনমন্তরেণাপি জায়মানত্বাৎ, তস্মান্মানস এব মনসশ্চ বহিরস্বাতন্ত্র্যেণ শরীরাদাবপ্রবৃত্তেরিতিভাবঃ। কিঞ্চ যদি শরীরে স্যাৎ পরশরীরে স্যাৎ, স্বাত্মনি যদি স্যাৎ তদাপি পরাত্মনি স্যাদিতি চেন্ন। পরাত্মনঃ পরস্যাতীন্দ্রিয়ত্বাৎ তদ্বিশেষগুণানামযোগ্যত্বাৎ। যোগ্যবিশেষগুণোপগ্রহেণ তস্য যোগ্যত্বাৎ, ন কেবলমাত্মন ইদং শীলং কিন্তু দ্রব্যমাত্রস্য, দ্রব্যং হি যোগ্যবিশেষগুণোপগ্রহেণৈব প্রত্যক্ষং ভবতি। আকাশমপি তর্হি শব্দোপগ্রহেণ প্রত্যক্ষং স্যাদিতি চেৎ, স্যাদেবং যদি শ্রোত্রং দ্রব্যগ্রাহকং ভবেৎ। আকাশ বা রূপবৎ স্যাৎ, আত্মনোঽপি নীরূপত্বং তুল্যমিতি চেৎ বহিদ্রব্যমাত্র এব প্রত্যক্ষতাং প্রতি রূপবত্ত্বস্য তন্ত্রত্বাৎ, প্রত্যগিত্যয়ং শব্দোহন্যব্যাবৃত্তমাহ।। ১৪।।

.

দেবদত্তো গচ্ছতীত্যুপচারাদভিমানাত্তাবচ্ছরীরপ্রত্যক্ষোঽহঙ্কারঃ।।১৫।।

অনুবাদ

(আপত্তি) দেবদত্ত গমন করিতেছে এই ব্যবহার যে ঔপচারিক (এরূপ উত্তর) আরোপিত; অতএব অহং ইত্যাকার প্রত্যক্ষ শরীরবিষয়কই হয়।। ১৫।।

ব্যাখ্যা

আমি কালো, আমি গৌরবর্ণ, আমি কৃশ, আমি স্থূল এইরূপ ভূরি ভূরি ব্যবহার রহিয়াছে। সর্ব্বত্রই উপচার——অর্থাৎ লক্ষণা বা গৌণার্থত্ব স্বীকার করিতে হইবে, এমন কথা কিছুই নাই; সুতরাং অপর সর্ব্বত্রই যদি অহং জ্ঞান শরীরকে অবলম্বন করিয়াই হয়, তাহা হইলে, ‘অহং সুখী’ ইত্যাদি স্থলেও শরীরকেই অহং বলিতে বাধা কি? গৌণ অর্থ মানিতে হয় বরং এখানেই মান। অতএব আত্মা অহংপ্রত্যয়ের বিষয় নহে, শরীরই বিষয়।। ১৫।।

উপস্কারঃ

পুনঃ শঙ্ক্যতে।

অহঙ্কারোহহমিতি প্রত্যয়ঃ স চ শরীরপ্রত্যক্ষঃ শরীরং প্রত্যক্ষং বিষয়ো যত্র স শরীরপ্রত্যক্ষঃ। দেবদত্তো গচ্ছতীত্যুপচারাত্তাবৎ প্রয়োগঃ প্রত্যয়ো বা ত্বয়া সমাহিতঃ স চোপচার আভিমানিকঃ। যতোহহং গৌরঃ, অহং কৃশঃ, সৌভাগিনোহহং পুনরুক্তজন্মেত্যাদয়ঃ প্রত্যয়াঃ প্রয়োগাশ্চোপচারেণ সমন্বয়িতুমশক্যা ইত্যর্থঃ।।১৫।।

অনুবাদ

সন্ধিগ্ধস্তূপচারঃ।।১৬।।

খণ্ডন এই,—এই যে আরোপ (বলিতেছ ইহাই) সন্ধিগ্ধ।।১৬।।

ব্যাখ্যা

দেবদত্ত গমন করিতেছেন, এইরূপ প্রয়োগ ঔপচারিক—অর্থাৎ গৌণার্থক। আমাদের এই সিদ্ধান্ত তোমরা বলিতেছ ভ্রান্ত, আমরা বলিতেছি অভ্রান্ত। সুতরাং সন্দেহই উপস্থিত। এই সন্দেহ নিবারণের জন্য ‘অহং’কে কেমন করিয়া বুঝা যায়, তাহা দেখা আবশ্যক। তাহাই দেখাইতেছি;—অন্ধ কুঠী সকলেই ‘অহং’ অনুভব করে। এক ব্যক্তি চক্ষু সত্ত্বেও যেমন ‘অহং’ বস্তু অনুভব করিয়াছে, অন্ধ হইলেও সেইরূপ অনুভব করে। বাহ্য বস্তুর অনুভবে যেমন তারতম্য হইয়া যায়, অহং অনুভবে সেরূপ ভেদ কিছুই হয় না। তবে একটা কথা মনে রাখিবে, এই যে দেবদত্ত গমন করিতেছেন, এইরূপ প্রয়োগ ইহাতে যে গৌণ অর্থ বলা হইয়াছে, তাহা ‘করিতেছেন’ এই অংশের যে ‘করণ’ তাহা চেষ্টাস্বরূপ, কিন্তু প্রযত্নস্বরূপ নহে, এই মতাভিপ্রায়ে। নতুবা—দেবদত্ত অর্থাৎ শরীরবিশেষের আত্মা, গমনের অনুকূলপ্রযত্নবিশিষ্ট, এরূপ অর্থ যদি দেবদত্ত গমন করিতেছেন এই বাক্যের হয়, তাহা হইলে গৌণ অর্থও স্বীকার করিতে হয় না। যদি বল দেবদত্ত গমন করিতেছেন এরূপ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়, তাহার উত্তরে আমরা বলি ঐটী চাক্ষুষপ্রত্যক্ষ নয়, উহা অনুমান মাত্র। চেষ্টা দেখিয়া প্রযত্নের অনুমান হয়। এই যে অপ্রত্যক্ষে প্রত্যক্ষত্বজ্ঞান, তাহাই উপচার বা ভ্রম। সুতরাং দ্বাদশ সূত্র হইতে যে ‘ঔপচারিক বা গৌণ’ এইরূপ কথা ব্যবহার করা যাইতেছে তাহার প্রকৃতার্থ ভ্রম এবং দেবদত্ত গমন করিতেছেন ইত্যাদি ব্যবহার না হইয়া ‘ইত্যাদি প্রত্যক্ষ’ এইরূপ হইবে। তাহা হইলে দাঁড়াইল এই যে, আপত্তিকারীরা বলেন দেবদত্ত গমন করিতেছেন ইত্যাদি প্রত্যক্ষ হয়, সুতরাং দেবদত্ত—দেবদত্তশরীর। ‘আমি যাইতেছি’ এরূপ প্রত্যক্ষেরও বিষয় হয়। সুতরাং আমি—এই শরীর মাত্র। ইহার উত্তর এই যে, দেবদত্ত গমন করিতেছেন ইহা প্রত্যক্ষ নহে, অনুমান মাত্র; আমি যাইতেছি ইহা প্রত্যক্ষ বটে, কিন্তু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ নহে, অন্ধকারেও এই প্রত্যক্ষ হয়। এখানে আমি বা অহং বস্তুও অন্তরের এবং যাইতেছির গমনপ্রযত্নও অন্তরের। এই অন্তরের বস্তু বিষয়ে যে প্রত্যক্ষ তাহা মানস। মানস প্রত্যক্ষ বিষয় এবং বহিঃপ্রত্যক্ষের অবিষয় অহং বস্তু শরীর নহে, তাহা এতদতিরিক্ত অদৃশ্য অস্পৃশ্য বস্তু।। ১৬।।

উপস্কারঃ

সিদ্ধান্তমাহ।

তুশব্দোহয়ং সিদ্ধান্তমভিব্যনক্তি, উপচারোহয়মাভিমানিকঃ। কিন্তু শরীর এবায়মহম্প্রত্যয় ইতি যদুক্তং তত্রাপি সন্দেহ এবেত্যর্থঃ। তথাচ প্রত্যয়স্যোভয়ত্রাপি কূটসাক্ষিত্বেন বিশেষাবধারণায় যতিতব্যম্। তত্র যত্নে ক্রিয়মাণে নিমীলিতাক্ষস্যাপ্যহমিতি-প্রত্যয়দর্শনাৎ শরীরভিন্নে বহিরিন্দ্রিয়াগোচরে বস্তুনি স মন্তব্যঃ, শরীরে ভবন পরশরীরেঽপি স্যাৎ চক্ষুনৈরপেক্ষ্যেণ চ ন স্যাৎ, অহং কৃশঃ স্থূলো বা সুখীতি কথং সামানাধিকরণ্যমিতি চেন্ন। সুখাদ্যবচ্ছেদকত্বেনাপি তত্র শরীরভনেসম্ভবাৎ সিংহনাদবদিদং গহনমিতিবৎ, অহত্ত্বমাত্রং শরীরে সমারোপ্যতে মনসোপস্থিতম্, ত্বগিন্দ্রিয়োপনীতমৌষ্ণ্যম্ উষ্ণং জলম্ উষ্ণঞ্চ শরীরমিতিবৎ।। ১৬।।

.

ন তু শরীরবিশেষাদ্যজ্ঞদত্তবিষ্ণুমিত্রয়োজ্ঞানং বিষয়ঃ।।১৭।।

অনুবাদ

যজ্ঞদত্ত এবং বিষ্ণুমিত্র উভয়েরই বিভিন্ন শরীরবিষয়ক (প্রত্যক্ষ হয় বলিয়া জ্ঞানবিষয়কও যে হয়, তাহা নহে।। ১৭।।

ব্যাখ্যা

অহং বস্তু জ্ঞানের আশ্রয়। সেই অহং বস্তু শরীর হইলে যজ্ঞদত্তবাবু যেমন বিষ্ণুমিত্রবাবুর শরীর প্রত্যক্ষ করেন, আবার বিষ্ণুবাবুও যজ্ঞবাবুর শরীর প্রত্যক্ষ করেন। সেইরূপ একে অপরের জ্ঞানাদির প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেন, কেননা যে যে দ্রব্য বাহ্য প্রত্যক্ষের বিষয়, সেই দ্রব্যের যে গুণ প্রত্যক্ষযোগ্য, তাহা বাহ্য প্রত্যক্ষের বিষয় হয়, ইহাই নিয়ম। শরীর বাহ্য প্রত্যক্ষের—অর্থাৎ চাক্ষুষ প্রভৃতি প্রত্যক্ষের যোগ্য; তাহার যে গুণ কোন না কোন প্রত্যক্ষযোগ্য—যথা রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, পরিমাণ ইত্যাদি তাহাও বাহ্য প্রত্যক্ষের—অর্থাৎ চাক্ষুষ প্রভৃতির বিষয় হয়। সর্ব্বত্র এই নিয়ম দেখিয়া নিশ্চয় করিতে পারি—শরীর ‘অহং’ বস্তু হইলে, জ্ঞান শরীরের গুণ হইত। তাহা হইলে উহাও রূপাদির ন্যায় অপরেরও বাহ্য ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য হইত; কেন না যাঁহার জ্ঞান তিনি তো জ্ঞানের প্রত্যক্ষ করেন। অতএব বাহ্য প্রত্যক্ষযোগ্য দ্রব্যের প্রত্যক্ষযোগ্য গুণ অপরেরই বা প্রত্যক্ষ না হয় কেন? এই আপত্তি খণ্ডন করিতে হইলে স্বীকার করিতে হয়, জ্ঞান শরীরগুণ নহে, জ্ঞান যাঁহার গুণ, তিনি শরীরাতিরিক্ত আত্মা।। ১৭।

উপস্কারঃ

সিদ্ধান্তমুপবৃংহয়ন্নাহ।

জ্ঞানমিতি যোগ্যং সুখদুঃখাদিকমাত্মগুণং লক্ষয়তি, যথা যজ্ঞদত্তবিষ্ণুমিত্রয়োঃ শরীরং পরস্পরভিন্নং তথা জ্ঞানসুখাদিকমপি ভিন্নমেব। তথাচ যথা যজ্ঞদত্তস্যেদং শরীরং তথা যজ্ঞদত্তস্য জ্ঞানে সুখাদৌ বানুৎপন্নে অহং সুখী জানে যতে ইচ্ছামীতি জ্ঞানাদিকং বিষয়ো ভবতি যোগ্যশরীরবিষয়কত্বেন তদীয়রূপাদিবত্তদীয়জ্ঞানাদীনামপি প্রত্যক্ষত্বসম্ভবাৎ, ন চ সম্ভবতি; তস্মাৎ জ্ঞানসুখাদীনাং শরীরাদন্য এবাশ্রয়ো বক্তব্য ইতি ভাবঃ। শরীরবিশেষাৎ শরীরস্য ভেদাদিত্যর্থঃ। তথাচ শরীরভেদং প্রাপ্য জ্ঞানং ন তু বিষয় ইতি ল্যবলোপে পঞ্চমী।।১৭।।

.

অহমিতি মুখ্যযোগ্যাভ্যাং শব্দবদ্ব্যতিরেকাব্যভিচারাদ্বিশেষসিদ্ধের্নাগমিকঃ।।১৮।।

অনুবাদ

‘অহং’ ইত্যাকারক মুখ্য (মুখ্যার্থঘটিত ব্যবহার) এবং যোগ্য (অভ্রান্ত প্রত্যক্ষ) এতদুভয় দ্বারা (এবং জ্ঞানাদি দ্বারাও) ব্যতিরেক সহকৃত অর্থাৎ ইতরবাধসহকৃত ব্যাপ্তি (জ্ঞান) সাহায্যে (সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান প্রভাবে) শব্দ দ্বারা যেমন (আকাশের বিশেষরূপে সিদ্ধি হয় তদ্রুপ,) আত্মারও বিশেষরূপে সিদ্ধি হয়। সুতরাং (আত্মা যে কেবল) শ্রুত্যুক্ত বলিয়াই স্বীকাৰ্য্য তাহা নহে।। ১৮।।

ব্যাখ্যা

অহং এই স্থানীয় অস্মৎ শব্দের মুখ্যার্থ যাহাতে আছে তাহা আত্মা। অবশ্য ইহাও অনুমান করিতে হয়। এবং জ্ঞানাদি দ্বারাও অনুমান করিতে হয়; তাহা হউক, সে অনুমান দ্বারাও বিশেষ সিদ্ধি হয়। বিশেষ অর্থে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক্ ও মন এই আটটী দ্রব্যের অতিরিক্ত দ্রব্যত্ব। অপরে অস্মৎ শব্দের মুখ্যার্থ হইতে পারে না, বা তাহাতে জ্ঞানাদি থাকিতে পারে না। এইরূপ বাধজ্ঞান থাকিলেই বিশেষ সিদ্ধি হইয়া থাকে। যেমন শব্দ দ্বারা আকাশের সিদ্ধি। তদ্ভিন্ন ‘অহং’ ইত্যাকারক অভ্রান্ত প্রত্যক্ষও তো আছে। সুতরাং বেদে আছে, অতএব আত্মা মান। কিন্তু আত্মা মানিবার যুক্তি কিছুই নাই এমন কথা মুখে আনিও না। এই সূত্রটী পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুক্তির একত্রোপসংহার।। ১৮।।

উপস্কারঃ

নম্বাত্মা ন প্রত্যক্ষঃ, নীরূপদ্রব্যত্বাৎ নিরবয়বদ্রব্যত্বাদ্বা আকাশবৎ, তথাচাহং কৃশো গৌরঃ ইতি বুদ্ধেঃ শরীরমেব বিষয়ো বাচ্যঃ। ক্বচিদহং সুখীত্যাদি ধীরপি যদ্যপ্যস্তি, তথাপ্যাশ্রয়মন্তরেণ ভাসমানানাং সুখাদীনাং শরীরে সমারোপ ইত্যেব কল্পয়িতুমুচিতম্। যথোষ্ণং সুরভি জলম্ ইত্যাশ্রয়মন্তরেণ প্রতীয়মানয়োরৌষ্ণ্যসৌরভয়োর্জ্জলে সমারোপঃ, ন ত্বেতদনুরোধে জলপ্রত্যয়স্যাপি প্রসিদ্ধজলমন্তরেণান্যবিষয়ত্বম্, তথাহমিত্যপি, অহস্ত্বং শরীর এব বাস্তবম্, সুখাদিকন্তু কদাচিত্তত্রারোপ্যতে তেনাত্মনি প্রত্যক্ষাকারং জ্ঞানং নাস্ত্যেব সুখাদ্যাধারত্বেন যৎ কল্পনীয়ং তদাগমসিদ্ধং ভবতু ন তত্রাপি গ্রহ ইত্যত আহ।

অয়মর্থঃ। অহং সুখী, অহং দুঃখীতি প্রত্যয়ো নাগমিকো ন শাব্দো নাপি লৈঙ্গিকঃ। শব্দলিঙ্গয়োরনুসন্ধানমন্তরেণাপি জায়মানত্বাৎ প্রত্যক্ষত্বে চ নীরূপত্বং নিরবয়বত্বঞ্চ যদ্বাধকমুক্তং তদ্বহিরিন্দ্রিয়প্রত্যক্ষতায়াং ভবতি। তত্র হি রূপবত্ত্বানেকদ্রব্যবত্ত্বয়োঃ প্রয়োজকত্বাৎ, মানসপ্রত্যক্ষতা চ তদন্তরেণাপি। ননু স্যাদেবং যদ্যাত্মনি প্রমাণং স্যাৎ তদেব তু নাস্তীত্যত আহ শব্দবদ্ব্যতিরেকাব্যভিচারাদ্বিশেষসিদ্ধেরিতি যথা ক্ষিত্যাদিষু দ্রব্যেষু শব্দস্য ব্যতিরেকোহব্যভিচারী নিয়তস্তেন তদাশ্রয়স্যাষ্টদ্রব্যাতিরিক্তস্যাকাশরূপস্য বিশেষস্য সিদ্ধিঃ, এবমিচ্ছায়াঃ পৃথিব্যাদিষু ব্যতিরেকস্যাব্যভিচারাৎ তদাশ্রয়েণাপি অষ্টদ্রব্যাতিরিক্তেন ভবিতব্যম্। নন্বেতাবতাপ্যানুমানিক এব আত্মা ন তু প্রত্যক্ষ ইত্যত আহ অহমিতি মুখ্যযোগ্যাভ্যামিতি অহমিতীতিকারেণ জ্ঞানাকারমাহ তেনাহমিতি জ্ঞানং শব্দলিঙ্গানুসন্ধানমন্তরেণ নিমীলিতাক্ষস্য যদুৎপদ্যতে তন্মুখ্যেন অহস্ত্ববতা যোগ্যেন প্রমাণসিদ্ধেন উপপাদনীয়ম্, ন তু শরীরাদিনা, তত্রেচ্ছায়া ব্যতিরেকাব্যভিচারাৎ। মুখ্যযোগ্যাভ্যামিত্যনন্তরম্ উপপাদনীয়মিতি পূরণীয়ম্। আত্মনি প্রমাণানি বহুনি গ্রন্থগৌরবভিয়া ত্যক্তানি ময়ূখেঽন্বেষ্টব্যানি।। ১৮।।

.

সুখদুঃখজ্ঞাননিষ্পত্ত্যবিশেষাদৈকাত্ম্যম্।।১৯।।

অনুবাদ

সুখ, দুঃখ এবং জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ে কোন প্রভেদ না থাকায়, আত্মা এক।।১৯।।

ব্যাখ্যা

আত্মা এক কি অনেক?—বেদান্তীরা বলেন আত্মা এক। ন্যায়বৈশেষিকাদি দর্শনমতে আত্মা অনেক। যাঁহারা এক বলেন, তাঁহাদের যুক্তি এই—আকাশ এক, কেন না, শব্দসমবায়িকারণত্ব আকাশে অভিন্ন বলিয়া, তদ্রূপ সুখদুঃখাদির উৎপাদকত্ব অভিন্ন বলিয়া আত্মাও এক। তবে শব্দ, যেমন নিমিত্ত ও সমবায়িকারণের সমাবেশভেদে বিভিন্ন দেশে উৎপন্ন হয়, তদ্রূপ অপর-কারণ-সমাবেশভেদবশতই সুখ-দুঃখাদিরও বিভিন্ন কালে ভিন্ন ভিন্ন দেহে উৎপত্তি হয়। অতএব আত্মা এক।।১৯।।

উপস্কারঃ

আত্মপরীক্ষাপ্রকরণং সমাপ্য ইদানীমাত্মনানাত্বপ্রকরণমারভতে। তত্র পূৰ্ব্বপক্ষসূত্রম্। এক এব আত্মা চৈত্রমৈত্ৰাদিদেহভেদেঽপি, কুতঃ সুখদুঃখজ্ঞানানাং নিষ্পত্তেরুৎপত্তের- বিশেষাৎ সর্ব্বশরীরাবচ্ছেদেন সুখদুঃখজ্ঞানানামুৎপত্তিরবিশিষ্টৈব যতঃ। যদ্যাত্মভেদসাধকং লিঙ্গ্যন্তরং ভবেত্তদা সিধ্যেদাত্মভেদঃ, ন চ তদস্তি, যথা তত্তৎপ্রদেশাবচ্ছেদেন শব্দনিষ্পত্তাবপি শব্দলিঙ্গাবিশেষাদেকমেবাকাশম্। যৌগপদ্যাদিপ্রত্যয়লিঙ্গাবিশেষাদেক এব কালঃ। পূর্ব্বাপরাদি- প্রত্যয়লিঙ্গাবিশেষাদেকৈব দিক্‌।।১৯।।

.

ব্যবস্থাতো নানা।। ২০।।

অনুবাদ

ব্যবস্থার জন্য অনেক আত্মা (স্বীকার করিতে হয়)।। ২০।।

ব্যাখ্যা

আত্মা এক হইলে জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, স্বর্গনরক ভোগের নিয়ম থাকে না। এক আত্মাই এক শরীরের আশ্রয়ে পাপ করে, অন্য শরীরের আশ্রয়ে পুণ্য করে, এক শরীরের ধ্বংস হয়, অন্য শরীরের উৎপত্তি হয়। কিন্তু সর্ব্বশরীরস্থায়ী সেই আত্মা তখন পরলোকের স্বর্গভোগী না নরকভোগী? ইহলোকে সে জীবিত না মৃত? কিছুরই ব্যবস্থা করা যায় না। যদি বল ভিন্ন ভিন্ন মন, সেই মনের সাহায্যে এই ভেদব্যবস্থা হয়। তাহা হইলেও সেই এক আত্মার নানা মনঃসংযোগ—এক কর্তার নানা উপায়, বেশ তো; সবগুলিই একেবারে ঘটুক! চাকরীর মাহিনালাভ এবং উগ্র মনিবের করতল দ্বারা কর্ণাপ্যায়ন যেমন যুগপৎ ঘটে, সেইরূপ স্বর্গ-নরকাদিও যুগপৎ ঘটিতে পারে, কিন্তু তাহা তো হয় না। আমি যখন সুখী, অন্যে তখন দুঃখী এই বৈষম্য আছেই। আর এ বৈষম্য প্রত্যক্ষসিদ্ধ। সুতরাং এই বৈষম্য-ব্যবস্থার জন্য আত্মার অনেকত্ব মানিতে হয়।। ২০।।

উপস্কারঃ

সিদ্ধান্তমাহ।

নানা আত্মানঃ কুতঃ ব্যবস্থাতঃ, ব্যবস্থা প্রতিনিয়মঃ। যথা কশ্চিদাঢ্যঃ, কশ্চিৎ রঙ্কঃ, কশ্চিৎ সুখী, কশ্চিদ্ দুঃখী, কশ্চিদুচ্চাভিজনঃ, কশ্চিন্নীচাভিজনঃ, কশ্চিদ্বিদ্বান্, কশ্চিৎ জান্ম ইতীয়ং ব্যবস্থা আত্মভেদমন্তরেণানুপপদ্যমানা সাধয়ত্যাত্মনাং ভেদম্, ন চ জন্মভেদেন বাল্যকৌমারবার্দ্ধক্যভেদেন বা, একস্যাপ্যাত্মনো যথা ব্যবস্থা তথা চৈত্রমৈত্ৰাদিদেহভেদেঽপি স্যাদিতি বাচ্যম্, কালভেদেন বিরুদ্ধধর্ম্মাধ্যাসসম্ভবাৎ।। ২০।।

.

শাস্ত্রসামর্থ্যাচ্চ।।২১।।

অনুবাদ

(আত্মা অনেক) কেননা যোগ্য শাস্ত্র আছে।।২১।।

ব্যাখ্যা

আত্মা এক, এ বিষয়ে শ্রুতি আছে; ইহা বেদান্তীরা বলেন। বৈশেষিক বলিতেছেন, সে সকল শ্রুতি অন্যভাবের; পরন্তু যাহা যোগ্য,—প্রকৃতপক্ষে যাহার মুখ্য অর্থ আছে, সেই শ্রুতি আত্মার অনেকত্বই বলিয়া থাকেন। ফলকথা এই, যাহা বাস্তবিক এক, তাহাকে ইহা দুই বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না; পরন্তু যাহা অনেক, তাহাকে এক বলা আছে। মনে কর একটী ব্রাহ্মণকে কেহ দুই জন বা চারি জন বলে না। পরন্তু ব্রাহ্মণ এক, ক্ষত্রিয় দুই, এইরূপে চার বর্ণ গণনা সকলেই করে। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ কি একজন? না শত শত সহস্ৰ সহস্ৰ ব্রাহ্মণ? তবে কিনা, সকলেই এক বর্ণ, এখানে জাতির একত্ব লইয়াই ব্রাহ্মণের একত্ব। সেইরূপ আত্মারও একজাতীয়ত্ব লইয়াই একত্ব উক্তি শ্রুতিতে আছে। আর ‘দ্বে ব্রহ্মণী’ ‘চেতনানাং” ইত্যাদিস্থলে শ্রুতিতে যে সংখ্যা নিৰ্দ্দেশ আছে, তদ্দ্বারা আত্মার স্পষ্ট অনেকত্ব সিদ্ধ হয়।। ২১।।

তৃতীয়াধ্যায়ে—দ্বিতীয় আহ্নিক সমাপ্ত।

উপস্কারঃ

প্রমাণান্তরমাহ।

শাস্ত্রং শ্রুতিঃ, তয়াপ্যাত্মনো ভেদপ্রতিপাদনাৎ শ্রয়তে হি “দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে” ইত্যাদি। তথা “দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে” ইত্যাদি।। ২১।।

ইতি শ্রীশাঙ্করে কণাদসূত্রোপস্কারে তৃতীয়াধ্যায়স্য দ্বিতীয়াহ্নিকম্। সমাপ্তশ্চায়ং তৃতীয়াধ্যায়ঃ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *