তুর্বসুর জবানি
১।
চেয়ারে বসে ঠকঠক করে কাঁপছিল ছেলেটা। ধবধবে ফর্সা। নিখুঁত কামানো গাল। একটু ভালো করে দেখলেই চোখে পড়বে প্লাক করা ভুরু, জেল দেওয়া লম্বা চুল, ঠোঁটে ছোঁয়ানো হালকা লিপস্টিক। সেই ঠোঁট এখন দাঁতে চাপা। ছেলেটার সামনের দাঁতটা ভাঙা। সস্তার গোলাপি টিশার্টে লেখা “অ্যাচিভার”। জিনসের প্যান্টের হাঁটুর জায়গাটা ছেঁড়া। অস্থির হয়ে পা নাচাচ্ছে ছেলেটা। প্রায় তার নাকের ডগায় উলটোদিকে আর একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। অমিতাভ মুখার্জি। শান্ত। নিশ্চল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলেটার দিকে। ছেলেটা সোজা তাকাতে পারছে না। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে মেঝের দিকে। চোখের হালকা আইলাইনার জলে ভিজে লেপটে গেছে। দুই-একবার হাতের পিছন দিয়ে মোছার চেষ্টা করেছিল। এখন আর করছে না। অমিতাভ মুখার্জি আবার সেই প্রশ্নটা করলেন, যেটা এর আগে বার তিনেক করেছেন।
“বললাম তো তোর কিছু হবে না। তোর নামও কেউ জানতে পারবে না। এবার বল বিশ্বজিৎকে খুন হতে হল কেন? তুই করিসনি জানি। সে ক্ষমতা তোর নেই। কিন্তু কারা করতে পারে?”
কথা হচ্ছিল বিশ্বজিতের বাড়িতে ওরই শোবার ঘরে বসে। পাশের ঘরে ওর পাগল মা ঘুমাচ্ছে। তাই অফিসারের গলার আওয়াজ একেবারে খাদে। চেয়ারে বসা ছেলেটাই বিশ্বজিতের বন্ধু। ওর মায়ের খেয়াল এতদিন এই ছেলেটাই রাখছিল। বিশ্বজিৎ পনেরো দিন ধরে নিখোঁজ। তাও সে তার কোনও খোঁজ করেনি। পুলিশে খবর দেয়নি। কেন? সেই উত্তর খুঁজতেই মর্গে বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে রাত আড়াইটায় আমি আর অফিসার মুখার্জি বিশ্বজিতের বাড়িতে। দরজা খুলে আমাদের দেখে; চমকেই গেছিল ছেলেটা। কিন্তু পালাবার চেষ্টা করেনি। বিশ্বজিৎ খুন হয়েছে শুনে খানিক হাউহাউ করে কাঁদল। তারপর এই দশা। অফিসার পকেট থেকে ডায়রি বার করেছেন। অন্য হাতে পেন
“তোর নাম কী বল আগে।”
ছেলেটা কী যেন বলল মিনমিন করে। শোনা গেল না।
“স্পষ্ট করে বল।”
“জি রামানুজ। রামানুজ তিওয়ারি।”
আমার আগেই মনে হয়েছিল ছেলেটির চেহারায় অবাঙালি ভাব আছে। এবার নিশ্চিত হলাম।
“বিহারি?”
“নেহি জি। ইউ পি। “
“ইউ পি-র কোথায়?”
“বেনারস।”
“বাংলা বুঝিস তো?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে এলি কীভাবে?”
“কামের ধান্দায়।”
“কী কাজ করিস?”
আবার চুপ। অফিসার আবার ধমকে উঠলেন, “কি রে? আমি কি সারারাত বসে থাকব নাকি এখানে?”
“ছিবড়ির কাম।”
এটাই ভেবেছিলাম। গোয়েন্দাগিরির লাইনে আসার পরে এই লাইনের বেশ কিছু কোড ওয়ার্ড বুঝি। ছিবড়ি মানে এরা পুরোপুরি পুরুষ কিন্তু পেটের তাগিদে হিজড়ার পেশা গ্রহণ করেছে। সাধারণত সমকামী বা উভয়কামী ছেলেরাই এই পেশায় আসে। অফিসারও দেখলাম এটা জানেন। হালকা একটা হাসি খেলে গেল তাঁর মুখে। তারপর বললেন, “এই বিশ্বজিৎ কি তোর পারিক?”
পারিক মানে পুরুষ বন্ধু, পার্টনার।
রামানুজ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।
“বিশ্বজিতের সঙ্গে আলাপ কী করে হল?”
ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মিশিয়ে রামানুজ যা বলল তার অর্থ, ছোটো থেকেই সে
আকুয়া, মানে দেহে পুরুষ আর অন্তরে নারী। এইজন্য স্কুলে সবাই তাকে বহেনজি, ভাবিজি বলত। বাবা ছিলেন ব্যাংকের দারোয়ান। সারারাত ডিউটি দিতেন। সকালে এসে পড়ে পড়ে ঘুমাতেন। ছেলের এই মেয়েলিপনা দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না তিনি। বেল্ট খুলে মারতেন আর বলতেন, “মর্দ বন শালে!” সবার সামনেই ছেলেকে বলতেন, “ছক্কা” আর “আটঠা”। একদিন রামানুজ আর সহ্য করতে পারেনি। বাবা সেদিন প্রচণ্ড মারছিলেন। হাতের সামনে জলের কুঁজোটা ছিল। সোজা সেটা উঠিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল বাবার মাথায়। বাবা উলটে পড়ে গেল। তারপর বেঁচে রইল না মরল সে জানে না। বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা কলকাতায়। ট্রেন ধরে কলকাতায় আসার সময়ই তার সঙ্গে শিউলির সঙ্গে দেখা হয়। শিউলি আর তার দলবল ট্রেনে ট্রেনে তালি বাজিয়ে টাকা নেয়। শিউলিও আগে ছেলে ছিল। এখন ছিন্নি করে খোজা হয়েছে। মেয়েদের মতো শাড়ি পরে। ফলস বুক লাগায়। শিউলির আগে অন্য নাম ছিল। গুরুমা-র দলে নাম লিখিয়ে শিউলি নাম হয়েছে। আগের নাম নাকি মুখে আনতে নেই। রামানুজ ভিড়ে গেল ওদের সঙ্গে। কিন্তু ও ছিন্নি করেনি। আর করেনি বলেই ছেলেমেয়ে হলে ঢোল বাজিয়ে ওর যাওয়া মানা। ওর নাকি পোস্টিং ট্রাফিক সিগন্যালে। সস্তার সালোয়ার কামিজ পরে। দুই হাতে সবুজ লাল রংবেরঙের চুড়ি। গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ালেই দুই হাতে ফটাক ফটাক তালি মেরে আবেদন করে, “আরে কিছু দে কে যাও রাজা… মেরে সালমান খান।” টাকা না দিলে গালাগাল আর দিলে হাতটা আলগা করে মাথায় ছুঁইয়েই পরের খদ্দের ধরতে দৌড়াতে হয়। রাত বাড়লে শুরু হয় পুলিশের উৎপাত। তখন তাদের খুশি করতে হত। সিগন্যালের পাশেই হাইওয়ের ধারে অনেকটা খোলা জায়গা আর ঝোপজঙ্গল। রাত বাড়লে সেখানেই যেতে হত রামানুজকে। সঙ্গে সেই রাতের ডিউটিতে থাকা পুলিশ। কখনও সেটা এক রাতে তিন-চারবারও। পুলিশ পয়সা দেয় না। সিগন্যালে দাঁড়াতে দেয় এই অনেক।
দিনের রোজগারের তিন ভাগ নেয় গুরুমা। এক ভাগ থাকে রামানুজের কাছে। এভাবে বছর পাঁচ-ছয় চলার পরে একদিন আচমকা হাওড়া স্টেশনে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা। বিশ্বজিৎই ওকে দেখে এগিয়ে এসেছিল। পাশে দাঁড়িয়েছিল। ও তখন একটা দোকান থেকে দশ টাকার শুকনো প্যাটিস কিনে খাচ্ছে। যেন হাওয়ার সঙ্গে কথা বলছে এমনভাবে সোজা তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বিশ্বজিৎ বলেছিল, “নাগিন হয়ে বিলার কাজ করছিস কেন? আমার সঙ্গে যাবি নাকি? ভাগ্য ঘুরে যাবে।” নাগিন হল হিজড়ে সমাজে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে হিজড়েরা, আর বিলা মানে সবচেয়ে কুৎসিতদর্শন, পুরুষালি হিজড়ে। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আগে কোনও দিন ভাবেনি রামানুজ। সেই প্রথম ভাবল। বিশ্বজিৎ দশ মিনিটের মধ্যে ওকে বুঝিয়ে দিল ওর মতো সুন্দরী হিজড়ার একজন স্থায়ী পারিক না থাকা লজ্জার। বিশ্বজিৎ নিজে ডবলডেকার, তার ছেলেমেয়ে দুই-ই চলে। প্রায়ই খিদিরপুরে হিজড়া খোলায় যায়। এখন ওর বাড়ি ফাঁকা। থাকার মধ্যে পাগল মা। রামানুজ চাইলে ওর সঙ্গে থাকতে পারে। সমাজে একজন স্থায়ী পারিক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে আর না করেনি। গুরুমা-ও তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। ছাড়ার আগে গলায় পরিয়ে দিয়েছিল একগাছি সোনার হার। যেন মেয়ে বিদায় হচ্ছে। সেই থেকে বিশ্বজিতের সঙ্গেই আছে রামানুজ। ঘরের বউয়ের মতো।
“কতদিন হল?”
“ছে-সাত মাহিনা তো হোবে।”
“ছে না সাত?”
রামানুজ হাতের কড় গুনে কীসব হিসেব করে বলল, “জি সাত।”
“পাড়ার লোক কিছু বলত না?”
“কেন?”
“বলত। মেরে সামনে। ও বহুত গুসসেওয়ালা আদমি থা। সব ডরতে থে উসসে।”
“কেন?”
“নেহি পতা। উসকে সাথ বড়ে বড়ে নেতাদের জান পেহচান ছিল”
“পনেরো দিন হল বিশ্বজিৎ নিখোঁজ। পুলিশকে খবর দিসনি কেন?”
“বিশ্বজিৎ নে হি মানা কিয়া থা। লাস্ট যেদিন বাড়িতে এল। সিধা দোকান থেকে এল। আঁখ লাল। ডরা হুয়া। যেইসে কোই ভূত দেখ লিয়া হো। আমাকে এসে বলল, জানু, তুই আমার মাকে দেখিস। আমি পালাচ্ছি। আমাকে ফোন দিবি না। খোঁজ করবি না। করলেই ওরা আমাকে মেরে ফেলাই দিবে। জান লিয়ে লিবে। তু শুধু মায়ের খেয়াল রাখিস। আমি চলে আসব। ওয়াপস। কবে জানি না।”
“তুই জিজ্ঞেস করিসনি কাকে এত ভয় পাচ্ছে?”
“কিয়া থা। বোলা কি কোই ভূত থা, যো আব জাগ উঠা হ্যায়। ও সবকো খা যায়েগা। আমি সোচলাম পাগল হো গয়া লেড়কা। যানে সে পহলে পকেট সে একঠো কাগজ নিকালকে মুঝে অউর কহা ইসকো সামহালকে রাখখো।”
“কোথায় সে কাগজ?”
চোখ মুছতে মুছতেই উঠে গেল রামানুজ। ফিরে এল ভাঁজ করা রুলটানা একটা খাতার
পাতা নিয়ে। সেই পাতায় ব্লু ব্ল্যাক কালিতে পরিষ্কার অক্ষরে লেখা, “হিলির ভূতকে জাগানোর সময় এসেছে। রমণপাষ্টি খেলা শুরু। আমি প্রথম দান দিয়েছি। এবার তোমার পালা।” নিচে প্রেরকের নাম লেখা নেই। দরকারও নেই। এই কাগজ, এই কালি, এই হাতের লেখা আমার বড্ড চেনা…
দেবাশিস গুহ। আর কেউ হতেই পারে না।
২।
মুখার্জির মুখ দেখেই বুঝলাম আমার মতো উনিও হাতের লেখা চিনেছেন। চেনার কিছু নেই। দেবাশিসদার এক নম্বর চ্যালা বলে কথা। তবে এ মানে কতটা বুঝেছেন তা জানি না। বার কয়েক জোরে জোরে লেখাটা পড়লেন। তারপর মাথা উঠিয়ে রামানুজকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই লেখার মানে কী?”
খুব স্বাভাবিকভাবেই রামানুজ জানাল সে বাংলা পড়তে পারে না, তাই মানে জানা সম্ভব না। অফিসার এবার ঘুরলেন আমার দিকে। “তুমি কিছু বুঝতে পারছ?”
“হিলির ভূত শব্দটা আমি আগে শুনেছি।”
“শুনেছ?
কোথায়?”
“অনেক পুরোনো একটা বাংলা নাটকে। “
“নাটক?”
“হ্যাঁ। বটতলার নাটক। শৈলচরণ সান্যাল নামে একজনের লেখা…” বলতে না বলতে অধীশদার কথাগুলো মনে পড়ে চমকে উঠলাম। ‘শুধু খুন না, রিচুয়ালিস্টিক খুন। সারা দেহ ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে চিরে দেওয়া। পারে অণ্ডকোশ কেটে নেওয়া হয়েছে। সে এক বীভৎস ব্যাপার।’ অবিকল একইভাবে খুন হয়েছেন দেবাশিসদা আর কিছুক্ষণ আগে বিশ্বজিৎ। এই দুজন আবার একে অপরকে চিনতেন। দেবাশিসদা হিলির ভূতকে জাগানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎকে। জাগাতে গিয়েই কি সে মরল? রমণপাষ্টি কেমন খেলা? কীভাবে সেই খেলার প্রথম দান দিলেন দেবাশিসদা? সেই দানের সঙ্গে কি তাঁরও মৃত্যু জড়িত? ভাবতে গেলে গোটা ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একশো বছর আগের ইতিহাস যেন অবিকল নিজেকে রিপিট করছে।”
“বিড়বিড় করে কী বলছ? পরিষ্কার করে বলো।”
অফিসারের কথা শুনে বুঝলাম মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে গেছিলাম। সব খুলে বললাম তাঁকে। শুধু কীভাবে সেই নাটকটা পেলাম সেটা বাদে। কারণ তা বলতে গেলে আবার ডিরেক্টরের গোটা গল্প ফাঁস করতে হয়। টেমারলেন পেলাম না। উত্তরাধিকার সূত্রে একটাই দামি জিনিস পেয়েছি, সেটার কথা বলতে মন চাইল না। অফিসারও দেখলাম “নাটক কোথা থেকে পেলে” জিজ্ঞেস করলেন না। গোটাটা খুব মন দিয়ে শুনে বললেন, “তুমি একবার নিজে ভালো করে নাটকটা পড়ো। আমাকেও দেখিয়ো। আর এখন বাড়ি চলো। তোমায় ছেড়ে দিয়ে আসছি। প্রায় ভোর হতে চলল। কালকে বেলার দিকে একবার তোমার অফিসে যাব। ফোন করে দ্যাখো এর মধ্যে কোনও খবর জোগাড় করতে পারো কি না।”
রামানুজকেও বলে আসা হল, সে যেন এই মুহূর্তে বিশ্বজিতের বাড়িতেই থাকে। তার আধার কার্ডের ছবি তুলে নিলেন অফিসার। তারও একটা ছবি। পালালে কাজে আসবে। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম ও পালাবে না। পালানোর হলে এতদিনে পালাত। হয়তো কোথাও একটা ভালোবাসা রয়ে গেছে বুকের ভিতরটাতে। নইলে দুইবেলা পারিকের পাগল মায়ের সেবা কেউ করে না। অফিসার নিজের গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। তখন প্রায় ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। ঘুম আসছে না। বারবার বিশ্বজিতের লাশটা চোখের সামনে ভাসছে। আর দেবাশিসদারটাও। দুটো খুনের মধ্যে যে কোনও কমন লিঙ্ক আছে, তা বুঝতে গোয়েন্দা হবার দরকার নেই। তারিণীচরণ থাকলে হয়তো আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি কেস সমাধান করে দিত। আমার জায়গায় তারিণী থাকলে কী করত? সূত্র বলতে তো কয়েকটা শব্দ। হিলি, ভূত, রমণপাষ্টি, শৈলচরণ, প্রিয়নাথ। ব্যস! আর প্রিয়নাথ যে এই কেস কিচ্ছু লিখে যাননি সে কথা তো অধীশদা বললেনই।
‘দারোগার দপ্তর’ বইটার দুই খণ্ড খাটের পাশেই বইয়ের র্যাকে রাখা ছিল। গতবার বইমেলায় ‘পুনশ্চ’-র স্টল থেকে কিনেছিলাম। কিছু পাব ভেবে না এমনিই ঘুম আসছিল না বলে আলগোছে বইয়ের প্রথম খণ্ডটা হাতে তুলে নিলাম। রয়াল সাইজের মোটা বই। সাতশো পাতার উপরে। খয়েরি মলাটে দুখানা ডুয়েল পিস্তলের মতো পিস্তল আঁকা। একদম শুরুতে লেখা ভুমিকা আগেই পড়া ছিল। সত্যি বলতে কী, ‘প্রিয়নাথের শেষ হাড়’ নিয়ে অফিসারকে যে জ্ঞানটা দিয়েছিলাম, সেটা এই ভূমিকা পড়েই। কিন্তু নানা কাজে আর এগোতে পারিনি। আজ আবার ভূমিকাটা দেখতে গিয়ে শেষে চোখ আটকে গেল। সম্পাদক অরুণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি মোক্তারপাড়া, চন্দননগর, হুগলী। আবার চন্দননগর! কিন্তু আসল চমকটা অপেক্ষা করছিল পরের পাতায়। সূচিপত্রে। একের পর এক কাহিনি। আর কী দারুণ সব রোমাঞ্চকর নাম! “যমালয় ফেরতা মানুষ”, “অদ্ভুত হত্যা”, “আসমানী লাস”। কিন্তু এসব কিচ্ছু না। আমার চোখ যেন আঠার মতো আটকে গেল পাতার শেষের দিকে। ৩১৭ পাতা থেকে শুরু হচ্ছে এক কাহিনি। দুই পর্বে। চলেছে ৩৪৪ পৃষ্ঠা অবধি। কাহিনির নাম “ইংরেজ ডাকাত (হিলি ও ওয়ার্নার নামক দুই দস্যুর অদ্ভুত বৃত্তান্ত)।
৩।
পড়া যখন শেষ হল ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। একটা আশার আলো গেছে। যদিও জানি না সেটা আদৌ কোনও কাজের কিছু হবে কিনা। অমিতাভ মুখার্জিকে ফোন করে তাঁকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অরুণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি নিশ্চিত, তাঁর বইতে যা আছে তিনি তার থেকেও বেশি কিছু জানেন। এই লেখার সঙ্গে তখনকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কাটিং, টীকা ইত্যাদি আছে। সেগুলোর সোর্স নিয়েও কথা বলতে হবে। পড়ে যতটুকু বুঝেছি এ এক ভয়ানক জটিল কেস। তাই যে সামান্য ব্লু-টুকু পাওয়া গেছে, সেটাকে ছাড়া যাবে না। ল্যাপটপ টেনে ফেসবুকে খুঁজতেই অরুণ মুখোপাধ্যায়কে পেলাম। সোস্যাল মিডিয়ার এই এক সুবিধে। প্রোফাইল দেখে নিশ্চিত হলাম ইনিই তিনি। কিন্তু আমি ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। মেসেজ করলেও কবে দেখতে পাবেন জানি না। চট করে মনে পড়ল রজতকাকুর কথা। রজত চক্রবর্তী। চন্দননগরেই থাকেন। বাবার এককালের বন্ধু। এখন রিটায়ার করে লেখালেখি করেন। উনি নিশ্চিত জানবেন ভদ্রলোকের ফোন নম্বর। কাকুকে ফোন করতে প্রথমেই খানিক বকা খেলাম এতদিন খোঁজ না নেওয়ার জন্য। তারপর কী করছি জিজ্ঞেস করলেন। গোয়েন্দাগিরি করছি শুনে একটু অবাক হলেন ঠিকই, কিন্তু তারপর “বাঃ বাঃ” বলে বেশ উৎসাহই দিলেন। ঠিকই ভেবেছিলাম। রজতকাকুর কাছেই অরুণবাবুর ফোন নম্বর পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। সময় নষ্ট করা যাবে না। ভদ্রলোক বিকেলের দিকে যেতে বললেন। ভালোই হল। এর মধ্যে অফিসার মুখার্জির সঙ্গে কথাবার্তা সেরে নেওয়া যাবে। আর হ্যাঁ। এবার সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি নামছে। কয়েক ঘণ্টা ঘুম দরকার…
বেলা ঠিক আড়াইটায় অফিসারের এসইউভি-টা বাড়ির তলায় এসে দাঁড়াল। গাড়িতে ফুল দমে এসি চালানো। উঠতেই ঠান্ডা হাওয়ায় হালকা কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতে না দিতেই অফিসার পিছন ফিরে বললেন, “এবারে বলো দেখি। এই হিলির ভূত কী জিনিস?”
“হিলির ভূত কী তা জানি না। তবে হিলিকে চেনা গেছে। প্রিয়নাথের দারোগার দপ্তরে এদের নিয়ে দুই পর্বের কাহিনি আছে। ১৮৮০-র দশকের শেষের দিকের ঘটনা। ওয়ার্নার নামে এক সাহেব ছিলেন ডালহৌসির সিঙ্গার কোম্পানির ম্যানেজার। প্রচুর বেতন, সম্মান সবই আছে। কলকাতার সাহেবসুবোদের ক্লাবে তাঁর নিত্য যাতায়াত। একদিন তিনি উত্তেজিত হয়ে পুলিশের কাছে এসে জানালেন তাঁর কোম্পানির দোকানের তালা ভেঙে প্রায় সাত হাজার টাকা আর বেশ কিছু গয়না চুরি গেছে। তখনকার দিনে এই টাকা অনেক টাকা। পুলিশ তদন্ত করে বুঝল দোকানের মেইন গেটে যে চাবস তালা লাগানো ছিল, সেটা ভাঙা হয়নি। খোলা হয়েছে। আর সেই স্পেশাল তালার চাবি একজনের কাছেই আছে। ওয়ার্নার। এত কাঁচা কাজ কেউ করবে বলে পুলিশ বিশ্বাস করেনি। ওয়ার্নারের পিছনে খোচর লাগল। দেখা গেল সম্প্রতি সে কলিঙ্গবাজারে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর ইউরোপীয় বেশ্যাদের ঘরে ঘন ঘন যেত। এদেরই একজনের হাতে সোনার বালা দেখে পুলিশের সন্দেহ হল। সে জানাল এই বালা ওয়ার্নারই তাকে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও কিছু গয়না পার্সেল করে ওয়ার্নার বোম্বেতে তার মায়ের কাছে ও পাঠিয়েছে। পুলিশ ওয়ার্নারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওয়ার্নার বারবার জানায় সে কিছু জানে না। এমনকি যে রাতে ঘটনাটা ঘটেছিল তার স্মৃতিও কিছুমাত্র নেই। ওয়ার্নারের মতো হাইপ্রোফাইল মানুষকে ধরতে পোক্ত প্রমাণ লাগে। কিন্তু বোম্বেতে সেই পার্সেল ট্র্যাক করার আগেই ওয়ার্নারকে কেউ খবর দিয়ে দেয়। ওয়ার্নার পালায়। এক বছর তার কোনও পাত্তা নেই। এক বছর বাদে রেঙ্গুনের জেলে এক কয়েদিকে নিয়ে যেতে গিয়ে ইংরেজ পুলিশ অফিসার ওয়ার্নারকে আচমকা রেঙ্গুনে দেখতে পান। ওয়ার্নার সেখানে নিজের নামেই চাকরি জুটিয়ে দিব্যি আছে। অফিসার কলকাতায় এসে ঘটনাটা জানান। ওয়ার্নারের নামে ওয়ারেন্ট বার হয়, তাকে রেঙ্গুন থেকে কলকাতায় এনে বিচার করা হয়। বিচারে ওয়ার্নার আবার বলতে থাকে তার কিছুই মনে নেই। শেষ অবধি তার চার বছরের জেল হয়।”
এটুকু বলে ব্যাকপ্যাকের বোতল থেকে একটু জল খাবার জন্য থামতেই অফিসার বলে উঠলেন, “এ তো ওয়ার্নারের কথা। হিলি কোথায়?”
“জানতাম আপনি ঠিক এটাই বলবেন। এইবার হিলির এন্ট্রি হচ্ছে। ওয়ার্নারকে হরিণবাড়ি জেলে রাখা হলে সেখানে তার সঙ্গে হিলির দেখা হয়। হিলি কীভাবে জেলে এল সে আর এক ঘটনা। হিলি ছিল পেশায় সৈন্য। ওয়ার্নারের মতো হোয়াইট কলার জবের লোক না। প্রকৃত যোদ্ধা। সারা গায়ে গুলির নিশান। ব্রিটিশ সেনার হয়ে মিরাটে পোস্টিং ছিলেন। একদিন আচমকা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কেন তা কেউ জানে না। লুকিয়ে আবার ফিরে যান ইংল্যান্ডে। সেখানে হিলিরও এক অন্ধকার জীবন শুরু হয়। প্রিয়নাথের ভাষায়, তিনি ‘ডাকাইতি ব্যবসা আরম্ভ করেন’। শুধু ডাকাতি না। খুনও। বিলাতে কোনও এক নামকরা ডিটেকটিভ, যাঁর নাম প্রিয়নাথ লেখেননি, তার কাছে ধরা পড়ে যায়। ফলে হিলি আবার ভারতে পালিয়ে আসে।
প্রথমে বোম্বাই ও পরে কলকাতায় এসে নামজাদা এক হোটেলে থাকত। আর রাতে অবাধে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি। শেষে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটের এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে হিলিকে আয়া জাপটে ধরে। সেও আয়াকে এক লাথিতে মাটিতে শুইয়ে যা করল, তা একমাত্র সুপারম্যানই করতে পারে। দাঁড়ান, আমি প্রিয়নাথের লেখাটার ছবি তুলে এনেছি। এই জায়গাটা শুনুন একটু, ‘পুলিশও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছাদের উপর গমন করিলে সে সেই ছাদের উপর হইতে এক লক্ষে অন্য আর একটি বাড়ির ছাদের উপর গিয়া পতিত হইল… সকলে মিলিয়া কেবল ‘চোর চোর’ বলিয়া চিৎকার করিতে আরম্ভ করিল। আর সেই চোরও লম্ফে লক্ষে দুই তিনটি বাড়ী অতিক্রম-পূর্বক অন্য আর একটি বাড়িতে গমন করিল’। তাহলেই বলুন, সুপারম্যান নয়তো কী!”
“তারপর?”
“তারপর পুলিশের সন্দেহ হল এই সেই হোটেল। কারণ তার আশেপাশের থেকেই চুরি হচ্ছে রোজ। মজার ব্যাপার পাহারাওয়ালা কমিটি তৈরির কথা হলে তাতে যাঁরা যোগ দিলেন, তাঁদের মধ্যে স্বয়ং হিলিও ছিল। কিন্তু বিধি বাম। হিলি তার চুরির সব সামগ্রী হোটেলের ঘরেই রাখত। একদিন আচমকা সেই ঘরে তল্লাশি হলে হিলি বমাল ধরা পড়ে। ১৮৮৮-তে তারও বিচার হয়ে জেল হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। তখন যাকে বাঙালিরা হরিণবাড়ি জেল নামে ডাকত। জেলে হিলি আর ওয়ার্নারকে একই সেলে রাখা হয়, যেহেতু দুজনেই ইউরোপিয়ান। দুজনে মিলে পালাবার প্ল্যান করে। কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই। তাই অসুস্থতার ভান করে দুজনেই ভরতি হয় হাসপাতালে। সেখানে সবার চোখের আড়ালে তালা ভাঙার জন্য লোহার তার, ধারালো স্ক্যালপেল চুরি করে জেলে নিয়ে আসে। ১৮৮৯ সালের ৫ মার্চ দুজনেই জেল থেকে পালায়। দারোগা প্রিয়নাথ তাদের ধাওয়া করে কীভাবে শুশুনিয়া পাহাড় থেকে গ্রেপ্তার করেন সে এক রোমহর্ষক কাহিনি। আর বললাম না। পড়ে দেখবেন। কিন্তু আমার কয়েকটা খটকা আছে।”
“কী খটকা?”
“প্রিয়নাথ কাহিনির একেবারে শেষে জানাচ্ছেন, হিলি-ওয়ার্নারকে ধরে প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলেই রাখা হয়। কিন্তু কলকাতাবাসী ইংরেজরা হিলিকে নিয়ে ভীত ছিলেন। তাই তাকে বোম্বাইতে নিয়ে যাবার প্ল্যান করা হল। ট্রেনে নিয়ে যাবার সময় নাকি হিলি চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ তাকে ধরে আনে। কিন্তু আজ সকালেই নেট ঘাঁটতে গিয়ে সমাচার চন্দ্রিকার একটা খবর চোখে পড়ল। তাতে লেখা, পুলিশ যাকে ধরে এনেছিল সে ‘হিলির ন্যায় দেখিতে হইলেও হিলি নয়’। সে নাকি বারবার বলছিল তাকে পুলিশ অকারণে ধরে এনেছে। হিসেব মেলানোর জন্য। সেই মুজতবা আলির পঁয়তাল্লিশ নম্বরের কেস। ওয়ার্নার কিছু বলেনি যখন, তার মানে হিলি জেলের বাইরে থাকলে তার কিছু সুবিধে নিশ্চয়ই হত। সন্দেহ আরও বাড়ে যখন দেখি ওয়ার্নারকে এই দেশে রাখা হলেও হিলিকে বিলাতে সাততাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। কেন? প্রিয়নাথ নিজেও লিখছেন, “সেই স্থানে গমন করিয়া হিলি কী রূপে দিনপাত করিতেছে সে সংবাদ আমরা পাই নাই।” কিন্তু নাটের গুরু ওয়ার্নার জেল থেকে মুক্ত হয়ে বাকি জীবন ভদ্রভাবে কাটিয়েছেন সে উল্লেখ প্রিয়নাথের লেখায় আছে। তাহলে কি ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিলি গেছিল? না ফেরার হয়ে গেছিল? না এমন কিছু করেছিল যা প্রিয়নাথ সহ গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তখন চেপে গেছিল? সেটাই জানতে হবে। আর জানতে পারলে হিলির ভূতকে খুঁজে বার করা খুব কঠিন হবে না।
“চন্দননগর আর কতক্ষণ, অমিতাভবাবু?”
৪।
বাড়িতেই ছিলেন অরুণবাবু। আমি আসব বলা ছিল, কিন্তু সঙ্গে পুলিশ আসবে এটা তিনি আশা করেননি। সদালাপী, অমায়িক মানুষ। বাঁশবেড়িয়ার কোনও এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অবসরে চলে গবেষণা আর লেখালেখির কাজ। ভদ্রলোকের বৈঠকখানায় বসে আর সময় নষ্ট না করে সোজা কাজের কথায় চলে এলাম। মুশকিল হল কেসের ব্যাপারে সমস্তটা বলা অনুচিত, এদিকে না বললেও যে সাহায্যের জন্য আমরা এসেছি, তার গুরুত্ব বোঝানো যাবে না। তাই আগেই অফিসারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছিলাম স্থান আর পাত্রের নামগুলো উহ্য রেখে ঘটনাটা বলব। প্রায় আধঘণ্টা লাগল আমার বলতে। শেষ হতেই অরুণবাবু যেন দারুণ চিন্তায় ডুবে গেলেন। খানিক অন্যমনস্কভাবে কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলালেন। তারপর “দাঁড়ান আপনাদের একটা জিনিস দেখাই” বলে উঠে চলে গেলেন ভিতরের ঘরে। গেলেন তো গেলেনই। আসার আর নাম নেই। প্রায় অধৈর্য হয়ে উঠেছি, এমন সময় আবার ধরে ঢুকলেন তিনি। হাতে একটা ধুলো পড়া ফাইল। ফাইল পাশে রেখে কথা শুরু করলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, “অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন, যে প্রশ্ন আজ আপনার মনে জেগেছে, ঠিক সেটাই চোদ্দো বছর আগে বই সম্পাদনার সময় আমার মনেও জেগেছিল। বইতে সব লেখা যায় না। লেখা উচিতও নয়। কিন্তু প্রিয়নাথ আর তাঁর কেস নিয়ে আমিও বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। ব্যাপারটা সাদা চোখে যতটা সরল লাগে ততটাও না। হিসেবমতো দারোগার দপ্তরে শুধু প্রিয়নাথের অভিজ্ঞতার কথাই থাকা উচিত। মানে তেমনটাই হওয়ার কথা। হচ্ছিলও। ১৮৯১ থেকে শুরু হয়ে ১৮৯৫ অবধি প্রিয়নাথের সবকটা গল্পই মৌলিক। কিন্তু বদল এল পরের বছর থেকে। এইটা দেখুন।” বলে অরুণবাবু একটা পাতলা জেরক্স করা কাগজের তাড়া আমার হাতে তুলে দিলেন। অরিজিনাল দারোগার দপ্তরের থেকে ফটোকপি করা। কাহিনির নাম “পিতৃশ্রাদ্ধ”। সেটা দেখতে না দেখতেই আরও একটা একইরকম কাহিনি আমায় দেখতে দিলেন অরুণবাবু। নাম “বাঁশী”। কিন্তু এগুলো দেখে আমি কী করব? যেন আমার মনের কথাই বুঝতে পেরে মৃদু হেসে অরুণবাবু বললেন, “এগুলো আপনাকে পড়তে হবে না। আমি পড়েছি। দুটোই অবিকল দুই বিলাতি কেসের বঙ্গীকরণ। প্রথমটার নাম ‘মাসগ্রেভ রিচুয়ালস’ আর দ্বিতীয়টা অনেকেই জানেন, ‘স্পেকেলড ব্যান্ড’। আর দুই ক্ষেত্রেই গোয়েন্দা একজনই।”
“শার্লক হোমস!” পাশ থেকে বলে উঠলেন অফিসার মুখার্জি।
“একেবারেই তাই। শুধু তাই নয়, ১৮৯৬-এর পর থেকে প্রিয়নাথের দারোগার দপ্তরে হোমসের একটা বড়ো প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। কাহিনিতে প্রিয়নাথের নিজের চালচলনও যেন অনেকটা হোমসের মতো। কোনও কারণে উনি হয়তো ওই সময় নিবিড়ভাবে শার্লক হোমসের চর্চা করে থাকবেন। আরও একটা ব্যাপার। যেটা আপনি বলছিলেন। এই ১৮৯৫-৯৬ সময়কালে কলকাতায় অদ্ভুতভাবে একের পর এক জাতিদাঙ্গা বাধতে থাকে। মূলত ঘটনাগুলো ঘটত কলকারখানায়। আমার কাছে সেসব পেপারকাটিংও আছে। সেই কেসে প্রিয়নাথ জড়িয়ে পড়েন। তারপর ধরুন শৈলচরণের খুন। সেটাও। এমন সব রোমাঞ্চকর কেসের কথা বাদ দিয়ে তিনি কেন হোমসের গল্প নিয়ে মাতলেন সেটাই আমার কাছেও আশ্চর্যের। আমি নিশ্চিত ওই ঘটনাগুলো লিখলে সেটা দারোগার দপ্তরের সেরা কাহিনিদের মধ্যে ঠাঁই পেত।”
“আচ্ছা এমনও তো হতে পারে কেসগুলো, যাকে বলে ক্লাসিফায়েড। মানে একান্ত গোপনীয়। ফলে চাইলেও প্রিয়নাথ এ নিয়ে কিছু লিখতে পারেননি।”
“হতেই পারে। কিন্তু আমি নিজে পারমিশান বার করে কলকাতা পুলিশের আর্কাইভ খুঁজেছি। সেখানেও কিচ্ছু নেই। কেউ যেন বড়ো একটা কাঁচি হাতে বসে কলকাতার ইতিহাসের গোটা একটা অধ্যায় মুছে ফেলে দিয়েছে।”
“কিন্তু কেন?”
“নো আইডিয়া। হয়তো কিছুই না। আমরা শূন্যে তাজমহল বানাচ্ছি। কিন্তু আরও একটা সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো এমন কিছু ঘটেছিল, যার প্রমাণ ইংরেজ সরকার রেখে যেতে চায়নি।”
“হিলি আর ওয়ার্নারকে নিয়ে কিছ বলুন। মানে প্রিয়নাথ যা লিখেছেন তার বাইরে।”
“একটা কথা প্রিয়নাথ লিখে যাননি। মানে তখনকার কলকাতায় লেখা মুশকিল ছিল। হিলি আর ওয়ার্নার পরস্পরকে চিনত না। কিন্তু চেনার পর কোনও দিন একে অন্যের বিরুদ্ধে যায়নি। বরং একসঙ্গে কাজ করেছে। হিলির সেই তথাকথিত পালিয়ে যাওয়া নিয়েও ওয়ার্নার নীরব। এই বন্ধুতা নেহাত অমূলক ছিল না। দুজনের মধ্যে একটা কমন ফ্যাক্টর ছিল। দুজনেই ছিল, যাকে পাক্কা সাহেবরা ব্যঙ্গ করে বলতেন, হাফ ব্লাড, এইট আনাস বা কান্ট্রি বর্ন।”
“মানে?”
“মানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বর্ণসংকর। ভারতীয় কলোনিয়ালিজমের সবচেয়ে উপেক্ষিত, নিগৃহীত জাতি। না ঘরকা, না ঘাটকা। ইংরেজরা তাঁদের ব্রিটন বলে মানে না। ভারতীয়রাও সামাজিক অবরোধ তুলে দিয়েছে। বেচারারা তবে যায় কোথায়? তাই তাঁদের একমাত্র কাছের মানুষ ছিলেন আরও একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। আর কেউ না। এভাবেই হিলি আর ওয়ার্নারের ঘনিষ্ঠতা হয়। প্রথম যখন ইংরেজরা এ দেশে আসে, তখন আসতেন মূলত পুরুষরাই। ফলে দেশীয় রমণীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা চলত। সাহেবরা ভালোও বাসতেন সেইসব দেশি বিবিদের। উইলিয়াম হিকি আর তাঁর দেশি বিবি জমাদারনির কথা তো বিখ্যাত। তাঁদের সন্তানদের পিতৃত্ব স্বীকারেও তাঁদের বাধা ছিল না। সন্তানরা বিলেতে গিয়ে পড়াশুনো করতেন। ছেলেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেন, মেয়েরা ভালো সাহেব বর জুটিয়ে বিয়ে-থা করে সুখে সংসার পাততেন। মোটামুটি ১৭৮৬ সাল অবধি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সুদিন চলেছিল। তারপরেই ওঁদের সংখ্যা এত বেড়ে গেল, ইংরেজ সরকার চিন্তায় পড়লেন। আসলে তো ওঁরা ভারতেরই লোক, এদিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, অস্ত্রে বলীয়ান। যদি কোনও দিন নেটিভদের সঙ্গে হাত মেলায় তো বিপদ।”
“বলেন কী? তারপর?”
“তারপর আবার কী? আইন করে তাঁদের বিলাতে পাঠানো বন্ধ হল। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। অসামরিক চাকরিতেও অধিকার সংকুচিত হল। তারপর এল মারাঠা যুদ্ধ, আর মহীশূর যুদ্ধ। নিজেদের স্বার্থে আবার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হল। কিন্তু তাঁরা আর আগের সম্মান পেলেন না। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময়ও কিন্তু এঁরা ইংরেজদের হয়েই লড়েছেন। তবু মহারানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নিয়েই তাঁদের টাইট দেওয়া শুরু করলেন। সেনাবাহিনীতে তাঁদের পদোন্নতি হত না। চাকরিতেও না। মাইনে ছিল একই পদের পাক্কা সাহেবদের থেকে ২০-২৫ টাকা কম। মিরাটের সেনাবাহিনী থেকে হিলির পালানোর এটাই কারণ বলে কেউ কেউ মনে করেন।”
“লন্ডনে হিলির গতিবিধি সম্পর্কে কিছু জানা যায়?”
“সেই চেষ্টাও করেছি। লন্ডনের টাইমস পত্রিকার কিছু কাটিং আছে আমার কাছে। এই যে”, বলে বেশ কিছু প্রিন্ট আউট বার করে দেখালেন। “লন্ডনে গিয়ে হিলি প্রথমে বেডলাম মানসিক হাসপাতালে কাজ নেয়। সেখানে ডাক্তার-গবেষক এলি হেনকি জুনিয়রের গবেষণাগারে সাফাইয়ের কাজ করত। কিন্তু বেশিদিন ভালো থাকা তার কপালে নেই। সে জুটে গেল এক ডাকাত দলের সঙ্গে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তার পিছনে লাগল। হিলি আবার পালিয়ে ভারতে এল। শুধুহাতে না। কিছু একটা চুরি করে। সেটা যে কী, পত্রিকা জানায়নি। শুধু লিখেছিল, “a thing of notable value”। এটা নিয়ে আর কোথাও কিছু পাইনি। এমনকি প্রিয়নাথের দপ্তরেও না। হিলি প্রথমে কলকাতায় আসে। কিন্তু পরে জানা যায় কলকাতায় হোটেলে থাকার আগে সে এক রাতে গঙ্গা পেরিয়ে হুগলী গিয়েছিল। কী কাজে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা নেই। তারপর কী হল সে তো আপনি জানেন। প্রিয়নাথ লিখেই গেছেন।”
“হিলি কি সত্যিই পালাতে পেরেছিল? না ধরা পড়েছিল?”
“দেখুন আপনার মতো আমারও উৎস এই পুরোনো কাগজ আর লেখা। যা ডকুমেন্টেড নেই, তা আমি বলি কী করে? তবে হিলির এই দেশের লোকের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। প্রিয়নাথ তাকে পাকড়াও করলেও সে প্রকাশ্যে তার বুদ্ধি আর সাহসের প্রশংসা করে। প্রিয়নাথ নিজেই সেটা লিখেছেন। হিলির পরের জীবন নিয়ে অনেক খুঁজেছি। পাইনি। অনেক বছর বাদে আবার হিলির নাম শুনে সত্যিই যেন মনে হচ্ছে হিলির ভূত ফিরে এল”, বলেই মুচকি হাসলেন অরুণবাবু। আমার হাতে হলুদ ফাইলটা দিয়ে বললেন, “আজকাল অন্য ধরনের লেখাপড়া করি। এটা আপনি নিয়ে যান। পুরোনো কিছু দারোগার দপ্তরের কপি আছে। খবরের কাগজের কাটিং আছে। যদি কাজে লাগে।”
এরপর আর কিচ্ছু করার নেই। ধন্যবাদ দিয়ে উঠে আসা ছাড়া। উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় কী একটা মনে পড়ায় অরুণবাবু বললেন, “ও হ্যাঁ। আর- একটা জিনিস”, বলেই আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন। বেরোলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাতে একটা পৃষ্ঠা।
“প্রিয়নাথের রিটায়ারমেন্টের পরে তিনি নিয়মিত ডায়রি লিখতেন। তাঁরই এক ডায়রিতে শেষ দুটো পাতায় তাঁর লেখা সব দারোগার দপ্তরের হদিশ আছে। নাম সহ। ২০৫টাই। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই লিস্টে একটা নাম বেশি আছে। দেখুন। ২০৬ নম্বর দিয়ে। আমি হলফ করে বলতে পারি এটা হয় লেখা হয়নি, আর হলেও পাণ্ডুলিপি থেকে আলোর মুখ দেখেনি। আপনি তো গোয়েন্দা। দেখুন না মশাই, যদি এই পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পান। দারুণ একটা ডিসকভারি হবে তাহলে।”
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম। ঘাড়ের কাছ থেকে অমিতাভ মুখার্জিও উঁকি দিলেন। ২০৫ নম্বরের কাহিনির নাম “নামকাটা সেপাই”, আর তার ঠিক নিচেই প্রথমবার দেখলাম শব্দটা। আবার দেখলাম। এই শব্দের মানে কী? কাগজে লেখা আছে—
২০৬। নীবারসপ্তক