৯
নবনী নিজের ঘরে শুয়ে আছে। ভুল বলা হল। নিজের ঘর না, শ্রাবণীর ঘর। এই মুহূর্তে ডাকবাংলোয় তার নিজের কোনো ঘর নেই। নবনীর ইচ্ছা করছে, শ্রাবণীর মতো কোলবালিশ জড়িয়ে নিশ্চিত মনে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে। খুব ক্লান্ত লাগছে। মন ক্লান্ত হলেও শরীরও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘরটায় প্রচুর আলো। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়া, ঘরে রোদ ঢুকছে। চোখে আলো লাগছে। চারদিক অন্ধকার করে শুয়ে থাকলে বোধহয় ভালো লাগত। বিছানা থেকে উঠে পর্দা টেনে দিতেও ইচ্ছা করছে না। আল্সী লাগছে।
আস্তে করে কে যেন দরজায় হাত রাখল। নবনী বলল, ‘কে? জামিল সাহেব বললেন, ‘আমি।’
‘এস বাবা।
জামিল সাহেব এসে ঢুকলেন। তাঁর মুখও বিষণ্ন। তিনি বললেন, ‘হঠাৎ তোর আবার কী হল?’ নবনী বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, ‘বুঝতে পারছি না। খুব ক্লান্ত লাগছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন আরাম করে ঘুমাচ্ছি না।’
‘বেড়াতে এসে সবাই একসঙ্গে অসুখ বাধিয়ে ফেলা তো কোনো কাজের কথা না। যাই হোক, আমি শামসুদ্দিনকে খবর দিয়েছি…’
‘শামসুদ্দিন কে?’
‘ডাক্তার। এমবিবিএস। শুনেছি ভালো ডাক্তার।’
নবনী বলল, ‘বাবা, চল আমরা ঢাকায় চলে যাই। এখানে আর ভালো লাগছে না।’
জামিল সাহেব বললেন, ‘সেটাই ভালো। আমিও একটু আগে তাই ভাবছিলাম। এখানে হঠাৎ বড় ধরনের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে মুশকিলে পড়ে যাব। নবনী, তুই শুয়ে না থেকে বরং উঠে বস। শুয়ে থাকলে অসুখকে প্রশ্রয় দেয়া হয়।’
নবনী উঠে বসল। জামিল সাহেব বললেন, ‘তুই তোর পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত না তো?’
‘না।’
‘আমার মনে হয় পরীক্ষার রেজাল্টের চিন্তাই তোকে আপসেট করে রাখছে। এত চিন্তা করতে নেই- যা হবার হবে। আমার ধারণা, ভালোই হবে।’
নবনী হাসতে হাসতে বলল, ‘পরীক্ষা ভালোই হবে। আমি পরীক্ষার সব প্রশ্নের জবাব জানি। অন্য কোনো প্রশ্নের জবাব জানি না।’
‘এর মানে কি?’
‘কোনো মানে নেই, বাবা। কথার কথা বললাম।’
জামিল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘ছুটি কাটানোর ব্যাপারে আমরা এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। ছুটি ব্যাপারটা কালচারে নেই। আমাদের ছুটি মানে মামার বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসা। তার ফল এই হয়েছে যে সত্যিকার অর্থে ছুটি কাটানো বিষয়টা আমরা জানি না। বাইরে বেড়াতে এলে হাজারো সমস্যায় হাবুডুবু খাই। একজন রাতে ঘুমায় না। একজনের বিষণ্নতা রোগ হয়। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে।’
নবনী বলল, ‘তুমি কি আমার উপর রাগ করছ, বাবা?’
‘না, রাগ করছি না। তুই যেমন কথার কথা বললি, আমিও কথার কথা বললাম।’
জামিল সাহেব উঠে পড়লেন। নবনী বলল, ‘বাবা, তুমি কি যাবার আগে জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে যেতে পারবে?’
‘পারব।’
জামিল সাহেব জানালার পর্দা টেনে দিলেন। দরজা ভিজিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘর অবশ্যি পুরোপুরি অন্ধকার হল না। এই ভালো। ঘুমানোর জন্যে অন্ধকার ভালো। চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্যে দরকার আধো আলো আধো অন্ধকার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, শাহেদের সঙ্গে তার পরিচয়— এরকম আধো আলো এবং আধো অন্ধকারে। তারা তখন থাকত শ্যামলী। জামিল সাহেব মন্ত্রী হন নি। তবুও বেশ ক্ষমতাবান মানুষ। বাড়িতে দারোয়ান আছে, মালী আছে, কুকুর আছে। একদিন বর্ষাকালে ভর সন্ধ্যাবেলায় নবনী শুয়ে আছে— তার মাথা ধরেছে। মিলু বুয়া এসে বলল, ‘একজন লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছে।’
নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের কোনো ছাত্র?’
‘জিজ্ঞেস করি নাই।’
‘জিজ্ঞেস করে এস। আর ছাত্র যদি না হয় তাহলে জিজ্ঞেস কর আমার কাছে কী চায়?’
মিলু বুয়া ফিরে এসে জানাল—‘ছাত্র না। ভদ্রলোক একটা জরুরি কাজে এসেছেন নবনী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে কারোরই কোনো জরুরি কাজ নেই—চলে যেতে বল।’
মিলু বলল, ‘আপনে নিচে গেলে ভালো হয় আফা—সাথে অতবড় একটা ছবি নিয়া আসছে।’ নবনী নিচে নামল। বসার ঘরে ঢুকে প্রথমে যে জিনিসটা চোখে পড়ন, তা হল বিশাল একটা পেইনটিং। বর্ষার ছবি। আকাশে ঘন কালো মেঘ। খোলা প্রান্তরে কয়েকটা তাল গাছ। ছবিটা দেখেই মনে হচ্ছে—এই বুঝি বৃষ্টি নামল। ছবি থেকে চোখ ফেরানো কষ্ট। এত সুন্দর ছবি যে নিয়ে এসেছে সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর চেহারা, ভদ্র একজন যুবক। মেরুন রঙের একটা হাফশার্ট, সাদা প্যান্ট। মানুষটা হাসছে খুব সুন্দর করে।
নবনী বলল, ‘কী ব্যাপার?’
যুবক বলল, ‘আমার নাম শাহেদ। ছবিটা কি আপনার পছন্দ হয়েছে?’
‘খুব সুন্দর ছবি। ছবি নিয়ে এসেছেন কেন?’
‘ছবি যদি আপনার পছন্দ হয় আপনি কিনতে পারেন। আমাকে ছবির সেলসম্যান বলতে পারেন।’
নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি কি মানুষের বাড়ি বাড়ি ছবি বিক্রি করেন?’
‘অনেকটা তাই।’
‘এই ছবি আপনার আঁকা?’
‘আমার এক বন্ধুর আঁকা। আমি ছবি আঁকতে পারি না। ভালো ছবি, মন্দ ছবিও বুঝি না।’
‘দাম কত?’
‘আমার বন্ধু দশ হাজার টাকা চাচ্ছে।’
‘কী সর্বনাশ!’
‘দশ হাজার টাকা শুনে কী সর্বনাশ বলা ঠিক হচ্ছে? এই টাকা তো আপনাদের কাছে কিছুই না।’
নবনী হেসে ফেলে বলল, ‘আমার বাবার কাছে সম্ভবত কিছুই না। কিন্তু আমার কাছে অনেক টাকা। এই মুহূর্তে আমার কাছে দুশ টাকা আছে। যাই হোক, আপনি ছবি রেখে যান। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করব।’
‘কবে খোঁজ নিতে আসব?’
‘কাল আসুন।
‘জ্বি আচ্ছা।
শ্রাবণী সব শুনেই বলেছে, ‘আপা, ঐ ভদ্রলোক তোমার কাছে ছবি বিক্রি করতে আসেন নি। ছবি বিক্রি করতে এলে বাবার কাছেই আসতেন। তিনি তোমার কাছেই এসেছেন। মিলু বুয়াকে বলেছেন— এ বাড়ির বড় মেয়ে নবনীকে ডাক।’ তিনি তোমার নাম জেনেই এসেছেন। আমার ধারণা, ভদ্রলোক তোমাকে কোথাও দেখেছেন, দেখার পরই তাঁর মাথা খারাপের মতো হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। তিনি তোমার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে সুন্দর একটা অজুহাত বের করেছেন। দশ হাজার টাকা খরচ করে নিজেই ছবিটা কিনেছেন।’
নবনী বলল, ‘তোর রিসেন্টলি পড়া কোনো উপন্যাসে কি এরকম কিছু আছে?’
‘উঁহু নেই। তবে আমার অনুমান সত্যি। বাজি রাখতে চাও? পাঁচশ টাকা বাজি।’
‘পাঁচশ না। দুশ টাকা বাজি। আমার কাছে দুশ টাকা আছে।’
‘বেশ দুশ টাকা।’
শ্রাবণী বাজি জিতে গেল। সব বাজিতেই সে জিতে যায়। বাজির ভাগ্য সবার ভালো থাকে না।
.
দরজায় টোকা পড়ছে। নবনী বলল, ‘কে?
মিলু বলল, ‘বড় আফা, আম্মা আপনেরে ডাকে।
নবনী দরজা খুলে বের হয়ে এল।
জাহানারা ভেতরের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মুখ শুকনো। চোখ লাল। তঁর মাথার চুল ভেজা। মাথা দপদপ করছিল। কিছুক্ষণ আগেই মাথায় পানি ঢেলেছেন। চুল শুকায় নি।
নবনী বলল, ‘ডেকেছ মা?’
জাহানারা বললেন, ‘তোর কী হয়েছে?’
নবনী বলল, ‘কিছু হয় নি তো।’
‘আমার কাছে লুকাবি না। বল্ কী হয়েছে?’
নবনী চুপ করে রইল। জাহানারা বললেন, ‘শ্রাবণী কেন এমন সেজেগুজে হাসতে হাসতে গেল, আর তুই কেন দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছিস?’
নবনী মার দিকে তাকিয়ে রইল। জাহানারা ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, ‘মিলু, মিলু!’
মিলু ছুটে এল। জাহানারা বললেন, ‘আমাকে মাথাধরার ওষুধ এনে দে। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।’
নবনী বলল, ‘মা, তুমি শুয়ে থাক। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার খুব শরীর খারাপ।’ জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ঠিকমতো পা ফেলতে পারছেন না। নবনী এসে জাহানারার হাত ধরল। জাহানারা বললেন, ‘তোকে আমি কিছু কথা বলব, তুই আয় আমার সঙ্গে।’