তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে – ৮

নবনী খুব ভোরে ঘর থেকে বের হল। শ্রাবণী তখনো ঘুমাচ্ছে। কোলবালিশ জড়িয়ে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। তার শোয়া দেখে মনে হবে বাচ্চা একটা মেয়ে। প্রচণ্ড শীতেও গায়ে কখনো লেপ থাকে না। ভোরবেলার দিকে খুব শীত পড়ে। আজো পড়েছে। শ্রাবণীর গায়ে লেপ নেই। কোলবালিশ জড়িয়ে সে শীতে কাঁপছে। ঘর থেকে বের হবার সময় নবনী ছোট বোনের গায়ে লেপ তুলে দিল। কেমন বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে থাকে। বড় মায়া লাগে!

নবনীর নিজেরও শীত লাগছে। শাড়িটা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে সে ডাকবাংলোর মূল বারান্দায় চলে এল। শাহেদ বারান্দায় বসে আছে। এত ভোরে সে কখনো ওঠে না। শাহেদ নবনীকে দেখে খুশি খুশি গলায় বলল, ‘গুড মর্নিং প্রিন্সেস’। নবনী বলল, ‘গুড মর্নিং।’

শাহেদ বলল, ‘আজ কেন জানি ভোর পাঁচটার সময় ঘুম ভেঙে গেছে। তারপর হাজার চেষ্টা করেও ঘুম আসে না। শেষমেষ বারান্দায় এসে বসে আছি। কী প্রচণ্ড কুয়াশা হয়েছে দেখছ?’

‘হ্যাঁ, খুব কুয়াশা।’

‘আজ তো আবার স্পিডবোটে করে বেড়াতে যাবার কথা। কুয়াশা না কাটলে যাব কীভাবে? রওনা হতে অনেক দেরি হবে।’

নবনী কিছু বলল না। শাহেদ বলল, ‘তোমার ঘুম ভেঙেছে, ভালো হয়েছে। চল কুয়াশার মধ্যে হেঁটে আসি। মর্নিং ওয়াক। তার আগে আমাকে চা খেতে হবে। নবনী, চা বানাতে পারবে?’

‘পারব না কেন?’

‘তাহলে দয়া করে চা বানিয়ে নিয়ে এস। আমি কুয়োতলায় যাচ্ছি। কুয়োতলা বেশ একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা। শ্রাবণীর কথা প্রথম বিশ্বাস করি নি। এখন দেখি কুয়োতলায় বসে চা খেতে অন্যরকম লাগে।!’

‘তুমি যাও কুয়োতলায়, আমি চা নিয়ে আসছি।’

নবনী রান্নাঘরে ঢুকে দেখে জাহানারা ইতিমধ্যেই চুলায় কেতলি বসিয়ে ময়দা মাখছেন। লুচি তৈরি হবে। জাহানারা বললেন, ‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন রে নবু?’

‘কেমন দেখাচ্ছে?’

‘মনে হচ্ছে শরীর খুব খারাপ। রাতে ঘুম হয় নি?’

‘হয়েছে।’

‘জ্বর-টর আসে নি তো নবু?’

‘উহুঁ।’

‘দেখি কাছে আয়, গায়ে হাত দিয়ে দেখি।’

‘তুমি তো ময়দা মাখছ। গায়ে হাত দেবে কী করে?’

জাহানারা বললেন, ‘তুই আমার গালের সঙ্গে তোর গাল লাগা। তাতেই বুঝব।’

নবনী এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। জাহানারা নবনীর মুখ দেখতে পেলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন নবনী কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাঁর বুকে একটা ধাক্কা লাগল।

‘নবু, মা, কী হয়েছে তোর?’

‘কেন জানি মা কিচ্ছু ভালো লাগছে না।’

‘ভালো না লাগার মতো কিছু কি হয়েছে?’

‘না।’

‘তুই তো মাঝে মাঝে অকারণেই শাহেদের সঙ্গে ঝগড়া করিস। ঝগড়া হয় নি তো?’

‘না, ঝগড়া হয় নি। দুকাপ চা বানাও তো মা।’

‘তুই বানিয়ে নিয়ে যা। আমার হাত বন্ধ। শাহেদের কাপে চিনি আধ চামচ বেশি দিবি। ও চিনি বেশি খায়। ঐ তাকের উপর টি-ব্যাগ আছে।’

নবনী চা বানাচ্ছে। জাহানারা ময়দা মাখা বন্ধ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি অবশ্যি প্রায়ই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যত দিন যাচ্ছে, মেয়েটা ততই সুন্দর হচ্ছে। এত সুন্দর যে মাঝে মাঝে মেয়েটাকে তাঁর রক্ত-মাংসের

মানুষ বলেই মনে হয় না।

নবনী বলল, ‘মা, তোমার জন্যে এক কাপ চা বানাব?’

‘না।

‘না কেন? খাও না মা। মেয়ের হাতে বানানো চা খাওয়া যায়। এস, আমরা দুজনে বসে চা খাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

নবনী শাহেদের চায়ের কাপ হাতে উঠে গেল। খাবার ঘরে গিয়ে ডাকল, ‘মিলু বুয়া’! মিলু দৌড়ে এল। নবনী খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘এই চা-টা তোমার শাহেদ ভাইকে একটু দিয়ে আস তো। কুয়োতলায় আছে। পিরিচ দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাও।’

মিলু চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ‘আম্মার শইল রাইতে খুব খারাপ গেছে।’

‘কী হয়েছে?’

‘মাথাত নাকি খুব যন্ত্রণা হইছে। বারিন্দার এই মাথায় ঐ মাথায় হাঁটছেন।’

‘ডাকলে না কেন আমাকে?’

‘ডাকতে চাইছিলাম। আম্মা নিষেধ করল।’

‘তুমি চা নিয়ে যাও, মিলু বুয়া। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

.

জাহানারা মেয়ের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না রাতে তাঁর শরীর খারাপ করেছিল। তবে তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নবনী বলল, ‘গত রাতে তোমার একেবারেই ঘুম হয় নি, তাই না?’

‘হয়েছে কিছু। চেয়ারে বসে বসে ঘুমিয়েছি।’

‘মিলু বুয়া বলছিল খুব নাকি মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল?’

‘মাথার যন্ত্রণা তো সব সময়ই হয়। সেটা কিছু না।’

‘আমার মনে হয় ভালোমতো ডাক্তার দেখানো উচিত। নয়তো পরে হঠাৎ ধরা পড়বে মাথায় টিউমার হয়েছে। আমরা আগে কিছু বুঝতে পারি নি। এবার ঢাকা গিয়ে তুমি খুব ভালো করে চিকিৎসা করাবে।’

‘আচ্ছা করাব।’

‘কথা দিচ্ছ কিন্তু মা।’

‘আচ্ছা।’

নবনী চা শেষ করে বাবার খোঁজে গেল। জামিল সাহেব এমনিতে খুব ভোরে ওঠেন। ফজরের নামায পড়েন। এখানে এসে নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে। তিনি ভোরে উঠতে পারছেন না। আজ তাঁরও ব্যতিক্রম হয়েছে। তিনি ফজর ওয়াক্তে উঠে নামায পড়েছেন এখন আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়বেন কিনা ভাবছেন। নবনীকে ঢুকতে দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, ‘আমার বড় মেয়ে কেমন আছেন গো?’

‘ভালো আছি, বাবা।’

‘ছুটি কেমন লাগছে?’

‘খুব ভালো লাগছে।’

‘আজ তোদের প্রোগ্রাম কি?’

‘স্পিডবোটে করে পাখি দেখতে যাব।’

‘যা কুশায়া পড়েছে! রওনা হতে হতে বেলা হয়ে যাবে। আসল দৃশ্য কিছু দেখতে পাবি না।’

‘নকলটাই দেখব, বাবা। আসল দৃশ্যের চেয়ে নকল দৃশ্য সব সময় অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং হয়।’

জামিল সাহেব হো-হো করে হাসলেন। মনে মনে বললেন, বাহ্, মেয়েটা তো খুব সুন্দর করে কথা বলল। মেয়ে দুটার সঙ্গে কথা বলাই হয় না। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে মিটিং-এ। বাকি সময়টা আজেবাজে লোকদের তদবির শুনে। সিনিয়রকে ডুবিয়ে জুনিয়র প্রমোশন পেয়েছে, সেই তদবির। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় বদলি করে দিয়েছে, বদলি ফেরানোর তদবির। একজন এসেছিল ওয়াসার পানির লাইন কেটে দিয়েছে- লাইন বসানোর তদবিরে। সামান্য পানির লাইন বসানোয় মন্ত্রীর তদবির লাগে। ঘাড় ধরে লোকটাকে বের করে দেবার ইচ্ছা হয়েছিল। তা করেন নি বরং হাসিমুখে তার সমস্যা শুনেছেন, এবং সেক্রেটারিকে বলেছেন ওয়াসার একজিকিউটিভ ইনজিনিয়ারকে বলে দিতে। মন্ত্রী পর্যন্ত যারা পৌঁছতে পারে তারা ক্ষমতাবান মানুষ। এদের অগ্রাহ্য করতে নেই।’

তিনি কাউকে অগ্রাহ্য করেন না। সবার সমস্যাই শোনেন। শুধু নিজের মেয়েদের কোনো কথা শোনার সময় পান না। ছুটির সাত দিন পুরোপুরি মেয়েদের সঙ্গে কাটাবেন ভেবেছিলেন—তাও হচ্ছে না।

‘নবনী মা, বোস তো আমার পাশে।’

নবনী বসল। জামিল সাহেব বললেন, ‘মার মুখটা এমন মলিন কেন? কী হয়েছে আমার মার?’

‘আমার কিছু হয় নি, বাবা। সম্ভবত মার কিছু হয়েছে। রাতে ঘুমাচ্ছে না।’

‘এটা তো নরম্যাল। সে রাতে কখনো ঘুমায় না। আমার ধারণা, ঘুম এলেও জেগে থাকে।’

‘এরকম করতে করতে দেখবে একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

‘তা তো পড়বেই। কিন্তু তোর মাকে কে বোঝাবে? আমার সাধ্যের বাইরে। আমি চেষ্টা কম করি নি।’

‘অনেক চেষ্টা করেছি। এখন হাত ধুয়ে ফেলেছি। তোরা চেষ্টা করে দেখ কিছু করতে পারিস কিনা। মনে হয় না পারবি। তোর মার কথা বাদ দে। তোদের কথা বল। ছুটি কেমন লাগছে?’

‘একবার তো বলেছি বাবা—ভালো লাগছে।’

‘এখানে যা দেখার দেখেছিস?’

‘হুঁ।’

‘মনু মিয়ার দিঘি দেখেছিস।’

‘না। সেটা আবার কোথায়?’

‘সুরুজ মিয়াকে বললেই নিয়ে যাবে। নৌকায় যেতে হবে। এখান থেকে তিন-চার মাইল হবে।’

‘বিরাট দিঘি?’

‘মোটামুটি বিরাটই আছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল পানি লাল। গাঢ় লাল। ভয়ে কেউ দিঘিতে নামে না। অদ্ভুত মিথ আছে দিঘি নিয়ে। সুরুজ মিয়া জানে নিশ্চয়ই।’

‘পানি লাল কেন, বাবা?’

‘ঠিক জানি না। কে যেন বলেছিল লাল শৈবালের কারণে পানি হয়েছে লাল। এসব তোদের সায়েন্সের ব্যাপার। তোরাই তো ভালো জানবি।’

‘আমি আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু জানি না, বাবা। শ্রাবণী হয়তো জানে। তার কাজই বই পড়া।’

.

কুয়াশা কেটেছে।

স্পিডবোট চলে এসেছে। রওনা হতে দেরি হবে। সুরুজ মিয়া ছাতা আনতে গেছেন। রোদ চড়লে ছাতা না থাকলে কষ্ট হবে। শ্রাবণী বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। আজ এই প্রথম সে শাড়ি পরল। নবনীকে বলল, ‘তোমার মুক্তার কানের দুলজোড়া আমাকে দাও তো আপা।’ নবনী দুল পরিয়ে দিল। শাহেদ বলল, ‘শ্রাবণীকে তো আজ অদ্ভুত লাগছে! নবনী দেখেছ, কী অপূর্ব লাগছে শ্রাবণীকে?’

নবনী বলল, ‘হ্যাঁ অপূর্ব লাগছে।’

শাহেদ বলল, শাড়ি হচ্ছে অসম্ভব সুন্দর একটা পোশাক। শোন শ্রাবণী, এখন থেকে তুমি সব সময় শাড়ি পরবে।’

শ্রাবণী বলল, ‘আচ্ছা শাহেদ ভাই, আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। বলুন তো দেখি আমি, আপনি এবং একটি শাড়ি। এি তিন জিনিসের মধ্যে একটা সুন্দর মিল আছে। মিলটা কোথায়?’

শাহেদ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি তো মিল পাচ্ছি না।’

‘না ভাবলে পাবেন কী করে? ভেবে তারপর বলুন। আপা, তুমি বলতে পারবে?’

‘না, আমি বলতে পারব না।’

শ্রাবণী হাসতে হাসতে বলল, ‘মিলটা হল তিনটিরই শুরুর অক্ষর হচ্ছে ‘শ’।’ শ্রাবণী, শাহেদ এবং শাড়ি।

নবনী ছোটবোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। নিজেকে সামলে নিল।

শ্রাবণী বলল, ‘আপা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। এস আমার সঙ্গে।’

‘কোথায় যাব?’

‘খানিকটা দূরে যেতে হবে। মিনিট দশেক হাঁটতে হবে।’

‘ডাকবাংলোর ভেতরে বলা যাবে না?’

‘না।’

শাহেদ বলল, ‘আমি কি তোমাদের সাথে আসতে পারি?’

‘না। বোনে বোনে কথা হবে, এখানে আপনার কোনো স্থান নেই।’

‘আমি সঙ্গে আসি। তোমাদের কথা বলার সময় না হয় দূরে সরে যাব।’

‘অসম্ভব। আপনাকে নেয়াই যাবে না।’

.

নবনী এবং শ্রাবণী হাঁটছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জংলামতো একটা জায়গায় এসে শ্রাবণী থমকে দাঁড়াল। আপার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন এই বনের ভেতরে ঢুকতে হবে।’

নবনী বলল, ‘কথাগুলি কি বনের ভেতর ঢুকে বলবি?’

‘কথা না। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।’

‘কী জিনিস?’

‘মারিয়া স্টোনের কবর। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছিলে। তুমি ভেবেছিলে আমি মিথ্যা কথা বলছি। আমি সত্যি কথাই বলি, আপা। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের সত্যি কথা মিথ্যার মতো মনে হয়। আমি সে রকম একজন। এস বনে ঢুকি, বেশিদূর যেতে হবে না। অল্প কিছুদূর গেলেই দেখবে।

নবনী ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি তোর কথা বিশ্বাস করছি। আমি দেখতে চাচ্ছি না।’

তোমাকে দেখতে হবে। এতদূর এসে তুমি না দেখে যেতে পারবে না।

‘তুই কেন আমার সঙ্গে এরকম করছিস?’

‘তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী ভাববে, তা হবে না।’

‘আমি তোকে মিথ্যাবাদী ভাবছি না।’

‘এক সময় ভেবেছিলে।

‘হ্যাঁ, এক সময় ভেবেছিলাম। I am sorry for that.’

‘এস আপা, দুমিনিটের মাত্র পথ। চোরকাঁটা আছে। শাড়ি খানিকটা উপরে তুলতে হবে। ভয় নেই, কেউ দেখবে না।’

তারা কবরের কাছে এসে দাঁড়াল। একটা কালো পাথরের ক্রসচিহ্ন। পেছনে কালো পাথরে খোদাই করে লেখা, মারিয়া স্টোন। দীর্ঘ ইংরেজি কবিতা। এপিটাপ। প্রথম দু লাইন—

The bells will ring,
The birds will sing.

শ্রাবণী বলল, ‘আপা দেখলে?’

‘হ্যাঁ দেখলাম।’

‘শাহেদ ভাই সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছি সেগুলিও যে সত্যি তা কি তুমি বিশ্বাস করছ?’

নবনী জবাব দিল না। শ্রাবণী বলল, ‘পাখি দেখতে যাবার জন্যে আমরা সব তৈরি হয়ে আছি। এখন আমি যদি বলি শাহেদ ভাই, আপনি আপাকে নিয়ে যান। আমার মচকানো পা আবার ব্যথা করছে। আমি যেতে পারব না। তাহলে শাহেদ ভাই যাবে না। সে থেকে যাবে। আমি কি প্রমাণ করব?’

‘না।

‘যা সত্যি তা স্বীকার করে নেয়াই কি ভালো না? আমি জানি এখন তোমার কষ্ট হচ্ছে। এটা কিন্তু অনেক ভালো। কষ্টটা বিয়ের পর হবার চেয়ে আগে হওয়াই ভালো।’

‘তুই চুপ কর্।’

তারা নিঃশব্দে ডাকবাংলোয় ফিরে এল। ডাকবাংলোর গেটের কাছে শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মতো সাদা টুপি। তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। শাহেদ চেঁচিয়ে বলর, ‘তোমরা এত দেরি করেছ? যাত্রার সব আয়োজন সম্পন্ন। ডাকবাংলোয় ঢোকার দরকার নেই—তোমরা এখান থেকে সরাসরি স্পিডবোটে উঠবে। তোমাদের ব্যাগ-ট্যাগ সব তোলা হয়েছে। পানির বোতল নেয়া হয়েছে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা নেয়া হয়েছে।’

শ্রাবণী বলল, একটা ক্ষুদ্র সমস্যা হয়েছে, শাহেদ ভাই।’

‘কী ক্ষুদ্র সমস্যা।’

‘হাঁটতে গিয়ে আমার মচকে যাওয়া পা গর্তে পড়েছে। আমার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ব্যথায় আমি ছটফট করছি। কাজেই আমি যেতে পারছি না। আমাকে গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে হবে।’

শাহেদ হতভম্ব গলায় বলল, ‘সে কী?’

‘তাতে আপনাদের প্রোগ্রামের কোনো রকম হেরফের হবে না। আপনি আপাকে নিয়ে যাবেন। হৈচৈ করে আসবেন।’

নবনী এক দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। শাহেদ বলল, ‘তিনজন মিলে যাব ঠিক করেছি, এখন দুজন যাব, তা কি করে হয়! তাছাড়া পাখি শিকারে তোমার আগ্রহই সবচে’ বেশি ছিল।’

‘আগ্রহ এখনো আছে। সুন্দর সুন্দর পাখি গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য খুব ইন্টারিস্টেং হবার কথা কিন্তু উপায় নেই। পায়ে দারুণ ব্যথা।’

শাহেদ বলল, ‘তাহলে প্রোগ্রাম বাদ দেয়া যাক। তোমার পায়ের ব্যথা কমুক, তারপর যাব। আজই যেতে হবে এমন তো কথা নেই। নবনী, তুমি কী বল?’

নবনী সহজ গলায় বলল, শ্রাবণীর পায়ের ব্যথা-ট্যথা কিছুই নেই। ও ভালোই আছে। ও যাবে পাখি দেখতে। ও তোমার সঙ্গে তামাশা করছে। আমি যেতে পারব না। আমার পাখি শিকার ভালো লাগে না। তাছাড়া মার শরীর খুব খারাপ। আমি মার সঙ্গে থাকব। একজন ডাক্তার এনে মাকে দেখাব।’

শাহেদ বলল, ‘তুমি কি সত্যি যাবে না?’

‘না। তাতে অসুবিধা নেই। তুমি শ্রাবণীকে নিয়ে ঘুরে এস। এঁরা কষ্ট করে এত আয়োজন করেছেন। এখন না যাওয়া ঠিক হবে না।’

শাহেদ বলল, ‘সেটাও সত্যি।’

নবনী বলল, ‘দেরি না করে তোমরা রওনা হয়ে যাও।’

নবনী ডাকবাংলোয় ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পিডবোট চালু করার ভট্ ভট্ শব্দ কানে এল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *