৬
জামিল সাহেব খুবই উত্তেজিত ভঙ্গিতে বসে আছে। উত্তেজিত এবং আনন্দিত। সুরুজ মিয়া চেয়ারম্যান একজন হরবোলা খবর দিয়ে এনেছেন। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স। বড় বড় চোখ। ভয়ংকর রোগা। অতিরিক্ত লম্বার কারণেই বোধহয় খানিকটা কুঁজো। খালি পা। সবুজ একটা লুঙ্গি পরনে। এই শীতেও গায়ে পাতলা একটা ফতুয়া ছাড়া কিছু নেই।
নবনী এসে বসল বাবার পাশের চেয়ারে। শ্রাবণীও এল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। শাহেদও আছে। সে একটু দূরে বসেছে। মনে হয় তেমন উৎসাহ বোধ করছে না। দুটি পাজেরো জিপে অতিথি যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের একদল চলে গেছেন। অন্য একটা দল এখনো আছেন। মনে হয় তারা থেকে যাবেন।
শ্রাবণী বলল, ‘ব্যাপার কি?’
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘ব্যাপার নিজের কানে শোনেন আম্মা। এর নাম মোস্তাক হরবোলা। দুনিয়ার যত ডাক আছে মোস্তাক জানে। বাড়ি নবীনগর, খবর দিয়া আনছি।’
মোস্তাক কদমবুসি করতে এগিয়ে এল। নবনী ‘কী সর্বনাশ!’ বলে লাফিয়ে সরে যেতে গিয়েও যেতে পারল না। মোস্তাক শুধু যে নবনী এবং শ্রাবণীকে সালাম করল তা নয়, উপস্থিত সবাইকে আরেকদফা করল। কেউ তেমন আপত্তি করছে না। সবাই মজা পাচ্ছে।
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘মোস্তাক, শুরু কর।’
মোস্তাক দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। হরবোলার ডাক দেবার সময় মুখ দেখানোর নিয়ম নেই। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হয়। মোস্তাক যন্ত্রের মতো গলায় বলল,
উপস্থিত হাজেরাইন। আমার নাম হরবোলা মোস্তাক। বাড়ি নবীনগর।
পিতার নাম ইসহাক আলি। মা আমেনা বেগম। এক্ষণ শুনবেন পাখির ডাক। পাখির মধ্যে সেরা পাখি হইল কাউয়া। ভদ্র সমাজ যারে বলেন কাক।
মোস্তাক কাক ডাকতে লাগল। নবীন এবং শ্রাবণী স্তম্ভিত। এ তো সত্যি কাকের ডাক। মানুষের ডাক এ হতেই পারে না। কোনো মানুষের পক্ষে কাকের এমন ডাক অনুকরণ সম্ভব নয়।
‘ভদ্র সমাজ, কাকের বন্ধু হইল গিয়া আফনের কোকিল পক্ষী। দেখতে কাকের মতো। চেহারা আসল না, ভদ্রসমাজ আসল হইল গুণ। এইবার শোনেন কোকিল পক্ষীর ডাক।
মোস্তাক কোকিল ডাক ডাকতে শুরু করল। শ্রাবণী মুগ্ধ গলায় বলল, ‘আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপার!’
‘ভদ্র সমাজ, উপস্থিত হাজেরাইন। কোকিল পক্ষীর ডাক এক মতোন না।
একেক সমুয়ে একেক মতো। শীতকালে এক ডাক ডাকে, গরম কালে পৃথক এক ডাক ডাকে।
হরবোলা মোস্তাক বিভিন্ন ঋতুতে কোকিলের ডাক ডাকল। শ্রাবণী আবার বলল, ‘আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপার।’
পাখির পর হল পশুর ডাক—গুরু, ছাগল, শেয়াল।
তারপর হল পতঙ্গের ডাক—ঝিঁঝি পোকা, মৌমাছি, মশা, বোলতা।
জামিল সাহেব বললেন, ‘তুমি বাঘের ডাক পার না?’
‘জ্বি না স্যার। বাঘের ডাক কোনোদিন শুনি নাই। শুনলে পারব।’
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘একবার শুনলেই পারবে। বড়ই ওস্তাদ। এ স্যার মানুষের ডাকও পারে।’
নবনী বলল, ‘মানুষের ডাক আবার কী?’
মোস্তাক আলি বলল, ‘আছে, মানুষের ডাকও আছে।’
শ্রাবণী বলল, ‘দেখি শোনান তো। আমি মানুষের ডাক শুনতে চাই।’
‘শুনলে আফনে রাগ হইবেন।’
শ্রাবণী বিস্মিত হয়ে বলব, ‘কী অদ্ভুত কথা, শুনলে রাগ হব কেন?’
মোস্তাক সঙ্গে সঙ্গে অবিকল শ্রাবণীর মতো গলায় বলল, ‘কী অদ্ভুত কথা, শুনলে রাগ হব কেন?’
সবাই বিস্ময়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। সবার আগে কথা বললেন জামিল সাহেব। তিনি হতচকিত গলায় বললেন, ‘মানুষের ভয়েসের এমন রিপ্রডাকশান যে হতে পারে, আমার ধারণার বাইরে ছিল। অবিশ্বাস্য’ uncanny.
তিনি মানিব্যাগ বের করে দুটা নতুন একশ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন। মোস্তাক আবার কদমবুসি করে টাকা নিল। কদমবুসি একজনকে করল না, সবাইকে করল।
সুরুজ মিয়া তৃপ্ত গলায় বললেন, ‘এর চেহারা ভালো মানুষের মতো, কিন্তু আসলে বিরাট বদ। কেউ মারা গেলে সে করে কি- রাত-দুপুরে ঐ বাড়িতে উপস্থিত হয়। মরা মানুষের গলায় ঐ বাড়ির লোকজনের নাম ধরে ডাকে। বাড়ির ভেতরে তখন ভয়ে কান্দাকাটি শুরু হয়ে যায়। কত মার খেয়েছে বলার নাই। একবার তো মারতে মারতে হাত ভেঙে দিল।’
মোস্তাক আলি মনে হচ্ছে তার মার খাওয়ার কথা শুনে খুব মজা পাচ্ছে। খিকখিক করে হাসছে।’
শ্রাবণী বলল, ‘বাবা, আমি উনার পারফরমেন্সে মুগ্ধ হয়েছি। আমি কি আমার নিজের পক্ষ থেকে উনাকে কিছু গিফট দিতে পারি?’
‘অবশ্যই পার।’
শ্রাবণী গিফট আনার জন্যে উঠে গেল। নবনী লক্ষ করল, শ্রাবণী এখন আর খুঁড়িয়ে হাঁটছে না। ঠিকমতোই হাঁটছে। মনে হয় পায়ের ব্যথা সেরে গেছে। শ্রাবণী সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল। তার হাতে দুটা পাঁচশ টাকার নোট। সে মোস্তাক আলির দিকে নোট দুটি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার এই উপহার গ্রহণ করলে আমি খুব খুশি হব।’
মোস্তাক চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকাচ্ছে। হাত বাড়াচ্ছে না। সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। জামিল সাহেব বললেন, ‘ও দিচ্ছে, তুমি নিচ্ছ না কেন?’ নাও।’
মোস্তাক টাকা নিয়ে তৎক্ষণাৎ শিশুদের মতো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। সে তার দীর্ঘ জীবনে এক সঙ্গে কখনো এত টাকা পায় নি। শ্রাবণী দাঁড়াল না, নিজের ঘরে চলে গেল।
সুরুজ মিয়া বিব্রত গলায় বললেন, ‘কাঁদছিস কেন রে গাধা? কান্না বন্ধ কর্। মোস্তাক আলি আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগল। সুরুজ মিয়া মোস্তাকের হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলেন।
.
শ্রাবণীর ঘরের দরজা বন্ধ!
জামিল সাহেব দরজায় টোকা দিয়ে বললেন, ‘আসব মা?’
শ্রাবণী বলল, ‘এস বাবা।’
জামিল সাহেব ঘরে ঢুকলেন। মেয়ের বিছানায় পা তুলে বসলেন। তাঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি বললেন, ‘তোর ঘরে সিগারেট খাবার অনুমতি আছে তো?’
‘অনুমতি নেই, তবে তুমি খেতে পার।’
‘জানালাটা ভালো করে খুলে দে, ধোঁয়া চলে যাবে।’
শ্রাবণী জানালা খুলে দিল। জামিল সাহেব বললেন, ‘তোর সুন্দরবনের বাঘের খবর চলে এসেছে। লাস্ট সেনসারি রিপোর্ট। বাঘ-বাঘিনীর সংখ্যা সবই আছে। এই সঙ্গে স্পটেড ডিয়ারের সংখ্যাও আছে। এই যে কাগজটায় লেখা।’
‘থ্যাংকস বাবা। মেনি থ্যাংকস।’
জামিল সাহেব সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘নবনীকে দেখছি না। নবনী কোথায়?’
‘শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে নদীর দিকে হাঁটতে গেছে।’
‘ও দেখি সারাদিন হাঁটাহাঁটির মধ্যেই আছে। তোর হাঁটতে ভালো লাগে না?’
‘না।’
‘তোর পায়ের অবস্থা কি? ব্যথা সেরেছে?’
‘হুঁ।’
জামিল সাহেব চুপচাপ সিগারেট টানতে লাগলেন। শ্রাবণী বলল, ‘বাবা, আমার মনে হয় তুমি আমাকে কিছু বলতে এসেছ। এখন বুঝতে পারছ না বলা ঠিক হবে কিনা। দ্বিধার মধ্যে পড়েছ। বলে ফেল।
জামিল সাহেব বললেন, ‘একটু আগে তুই যে কাণ্ডটা করেছিস তা আমার পছন্দ হয় নি। সেই কথাই বলতে এসেছি।’
‘কোন কাণ্ডের কথা বলছ? হরবোলাকে যে এক হাজার টাকা দিয়েছি, সেটা?’
‘হ্যাঁ। এক হাজার কেন, ইচ্ছে হলে তুই পাঁচ হাজার টাকা দিবি—সেটা কোনো কথা না। কিন্তু যেখানে আমি দুশ টাকা দিয়েছি সেখানে তুই আমাকে ডিঙিয়ে এক হাজার টাকা দিলি। তুই আমাকে ছোট করলি।’
‘বাবা, আমি ওর কাণ্ডকারখানা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমরা যেমন মুগ্ধ হয়েছি, তুমিও লোকটাকে ঠিক সে রকম মুগ্ধ করবে। কিন্তু তুমি তাকে মাত্র দুশ টাকা দিলে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।’
‘এই দরিদ্র দেশে দুশ টাকা মাত্র না মা। তোর কাছে মাত্র মনে হয়েছে। ওর কাছে এই ছিল অপ্রত্যাশিত। ও প্রচণ্ড রকম খুশি হয়েছিল।’
‘হ্যাঁ, খুশি অবশ্যি হয়েছিল। কিন্তু তুমি তার খুশি হবার ক্ষমতা অতিক্রম করতে পার নি। আমি করেছি। এক হাজার টাকা পেয়ে কি রকম ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। ওর কান্না দেখে আমার নিজের চোখে পানি এসে গেল। যে কাজটা আমি করলাম সে কাজটা তুমি কেন করতে পারলে না? তোমার তো টাকার অভাব নেই।’
‘টাকা থাকলেই সব সময় এমন দেয়া যায় না। পাবলিক ফিগারদের দিকে সবার চোখ থাকে। সবাই বলবে, জামিল সাহেব দুহাতে টাকা ছড়ায়। কোথায় পায় এত টাকা?
‘কে কি ভাববে না ভাববে তাই মেনে আমাদের চলতে হবে?’
‘তোমাকে না চললেও চলবে। কিন্তু আমাকে চলতে হবে।’
শ্রাবণী নিচু গলায় বলল, ‘বাবা, আমি তোমাকে হার্ট করে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি কাউকেই হার্ট করতে চাই না। কিন্তু আমার ভাগ্য এত খারাপ যে সবাইকেই হার্ট করি।
জামিল সাহেব উঠতে উঠতে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এটা এমন কিছু না। Let us forget it.’
শ্রাবণী কাঁদছে। বাবা কঠিন কিছু বললেই তার চোখে পানি আসে।