৫
কিছুদিন মন্ত্রিত্ব করলে বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। মন্ত্রীরা কোনো কিছুতেই বিস্মিত হন না। জামিল সাহেবের ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। তিনি সুরুজ মিয়ার কর্মক্ষমতায় বিস্মিত হয়েছেন এবং বিস্ময় চাপা দেবার চেষ্টা করছেন না। সুরুজ মিয়া যা করেছেন তা হল ময়মনসিংহ থেকে একটা ফ্রিজ নিয়ে এসেছেন। ফ্রিজের সঙ্গে মেকানিক। মেকানিক এখন খুটখাট করে থ্রি-পয়েন্ট প্লাগ বসাচ্ছে। সুরুজ মিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছেন।
জামিল সাহেব বললেন, ‘এই ফ্রিজ আপনি নিজে কিনে এনেছেন?’
‘জ্বি স্যার।’
‘কেন?’
‘ঐদিন শুনলাম বেগম সাহেবের ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার অভ্যাস। উনার কষ্ট হইতেছে। শোনার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল।’
‘আমরা তো দুদিন পর চলে যাব, তখন ফ্রিজ কী করবেন?’
‘অসুবিধা কিছু নাই, স্যার। রেখে দিব। আপনারা হইলেন মেহমান। আমি থাকতে মেহমানের কষ্ট—এটা তো স্যার অচিন্তনীয়।
‘এরকম সেবাযত্ন সব মেহমানদেরই করেন?’
‘করার চেষ্টা করি, স্যার। তবে কেউ তো এদিকে আসেন না। রাস্তাঘাট ভালো না। তবু যাঁরা আসেন, যত্ন করার চেষ্টা করি। আমার ক্ষমতাও স্যার সামান্য। নাদান মানুষ।’
‘আপনার ক্ষমতা মোটেই সামান্য নয়। আমি বিস্মিত হয়েছি। আপনি কি কিছু চান আমার কাছে? আপনার কোনো তদবির আছে?’
‘জ্বি না স্যার, আমার কোনো তদবির নাই।
‘সত্যি বলছেন তো?’
‘জ্বি স্যার, সত্যি।’
ফ্রিজ লাগানো হয়েছে। হালকা শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। পানির বোতল ভর্তি করে রাখা হয়েছে। জাহানারা স্বস্তি বোধ করছেন। অনেকদিন পর আরাম করে পানি খাওয়া যাবে। তবে ফ্রিজের রং তাঁর পছন্দ হয় নি। কটকটে হলুদ রং। তাকালেই মাথা ধরে যায়।
জাহানারা বাইরের লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। সুরুজ মিয়ার সঙ্গে বললেন।
‘এত যন্ত্রণা করার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। ঠাণ্ডা পানি আমাকে খেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। যাই হোক, আপনাকে ধন্যবাদ।
সুরুজ মিয়া বিনয়ে নিচু হয়ে বললেন, ‘যা দরকার হবে আমাকে বলবেন বেগম সাহেব। কোনো সংকোচ করবেন না।’
‘শাহেদ পাখি শিকারের কথা বলেছিল শীতের পাখি। সম্ভব হবে?’
‘অবশ্যই সম্ভব হবে। এটা পাখি শিকারেরই জায়গা। গত বৎসর কমিশনার সাহেব আর তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন। পাখি শিকারের জন্যেই এসেছিলেন।
জাহানারা বললেন, ‘ব্যবস্থা করতে হবে নবনীর বাবাকে না জানিয়ে। উনি শুনলে রাগ করবেন। অতিথি পাখি মারা আইনে নিষেধ।’
‘সব কথা স্যারকে জানানোর দরকার নাই। উনি কিছুই জানবেন না। আমি নৌকা, বন্দুক সব ব্যবস্থাই করে রাখব। ভোররাত্রে যাওয়া লাগবে। দুই আম্মাও কি সাথে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, ওরাও নিশ্চয়ই যেতে চাইবে।’
‘কোনো অসুবিধা নাই বেগম সাব। আমি ব্যবস্থা করে খবর দিব।’
‘আপনি হুট করে চলে যাবেন না। নাশতা খেয়ে যাবেন।’
‘জ্বি আচ্ছা?’
সুরুজ মিয়া নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে দু একটা কাজ করলেন। বিকেলের মধ্যে খুঁটি বসিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা করলেন। ব্যাডমিন্টন খেলার সাজসরঞ্জাম ঘরেই ছিল। গত বৎসর কমিশনার সাহেব ব্যাডমিন্টন খেলতে চেয়েছিলেন। সব জিনিসপত্র যখন জোগাড় হল তখন তাঁরা চলে গেলেন। সুরুজ মিয়া যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন। এখন কাজে লেগেছে। এ জগতে কিছুই নষ্ট হয় না। এক সময় না এক সময় কাজে লাগে। মিনিস্টার সাহেবের পেছনে তার শ্রমও বৃথা যাবে না। এক সময় কাজে লাগবে।
.
বিকেল। রোদ পড়ে এসেছে।
শাহেদ খুব আগ্রহ্ নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে। একদিকে শাহেদ, অন্যদিকে শ্রাবণী। নবনীকে খেলার ব্যাপারে রাজি করানো যায় নি। সে নাকি জীবনে ব্যাডমিন্টন খেলে নি। শাহেদ বলল, ‘এটা এমন কোনো খেলা না যে শিখতে হয়। র্যাকেট হাতে নিলেই খেলা যায়। সাহস করে র্যাকেটটা হাতে নাও।’
নবনী বলল, ‘আমার এত সাহস নেই। আমি বরং দেখি। দেখতেই আমার ভালো লাগছে।’
শ্রাবণী বলল, ‘দেখতে তোমার মোটেই ভালো লাগছে না। তুমি খুব বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে।’
‘মোটেই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকছি না। তুই যে হেরে ভূত হচ্ছিস, দেখে ভালো
লাগছে।’
‘আপা, আমি হেরে ভূত হচ্ছি না। শাহেদ ভাই কেমন খেলে আমি বোঝার চেষ্টা করছি। যখন বোঝা হয়ে যাবে তখন বাজির খেলা খেলব। সিরিয়াস বাজি ধরে খেলা হবে।
‘কী বাজি?’
‘বাজির টার্মস এন্ড কন্ডিশানস পরে ঠিক করা হবে।’
শাহেদ নবনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রায় পনের বছর পর ব্যাডমিন্টন খেলছি। দারুণ লাগছে। আমি থরোলি এনজয় করছি।’
নবনী বলল, ‘তাহলে এনজয় করতে থাক। আমি একটু ঘুরে আসি। খেলা শেষ হলে একসঙ্গে চা খাব।’
‘ঠিক আছে। চা-নাশতা খেয়ে ইংরেজ সাহেবের স্ত্রীর কবর দেখে আসব। কোথায় যেন কবরটা?’
শ্রাবণী বলল, ‘জঙ্গলের ভেতর।’
.
ডাকবাংলো থেকে একা বেরুতে বেরুতে নবনীর ইচ্ছা করছিল না। সে রান্নাঘরে ঢুকে মাকে ধরল। আদুরে গলায় বলল, বলল, ‘মা, চল তো আমার সঙ্গে, ঘুরে আসবে। সারাক্ষণ রান্নাঘরে বসে থাকার জন্যে তুমি নিশ্চয়ই বেড়াতে আস নি। চল আমার সঙ্গে।’
‘কোথায়?’
‘পৃথিবীর সবচে’ বড় বটগাছ তোমাকে দেখিয়ে আনব।’
‘দিনের বেলা মনে করিস না কেন? এখন যাব কীভাবে? কাচ্চি বিরিয়ানি বসিয়েছি। এখন তো নড়াই যাবে না।’
নবনী একা একাই বের হল। গেটের বাইরে সেন্ট্রি পুলিশ দুজন একসঙ্গে স্যালুট দিল। নবনীর জানতে ইচ্ছে করল, স্যালুট দেয়ার সময় এরা কী ভাবে। কিছু নিশ্চয়ই ভাবে। তাদের ভালো লাগে না নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এরা কি শ্রাবণীকেও স্যালুট দেয়? শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
‘আম্মা, কোথায় যান?’
নবনী থমকে দাঁড়াল। সুরুজ মিয়া ছুটতে ছুটতে আসছেন।
সুরুজ মিয়ার মুখভর্তি পান। নবনীর কাছে এসে রাস্তার উপর পানের পিক ফেললেন।
টকটকে লাল পিক। নবনীর মনে হল, মানুষটা রক্ত-বমি করছে।
‘কোথায় যান আম্মা?’
‘কোথাও না। হাঁটতে বের হয়েছি। দৃশ্য দেখছি।’
‘দেখার কিছু নাই। গণ্ডগ্রাম জায়গা। কিছু গাছপালা।’
‘গাছপালাই আমার কাছে খুব সুন্দর লাগছে।’
‘রাস্তা খারাপ। বড় ধুলা। হাঁটার চাইতে নদীপথে যাওয়া ভালো। নৌকা একটা তৈরি রেখেছি ঘাটে। দুজন মাঝি আছে। যখন বলবেন নিয়ে যাবে।’
‘থ্যাংক ইউ।’
‘থানার একটা স্পিডবোট ছিল। তার আবার ডিজেল নাই। মেশিনেও কি জানি গণ্ডগোল। আমি ওসি সাহেবরে বললাম মেশিন সারাই করতে। ডিজেল আনতে। প্রয়োজনে কাজে না লাগলে স্পিডবোটের ফায়দা কি।’
‘আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। বেড়াতে ইচ্ছা হলে নৌকা তো আছেই।’
‘নৌকা আম্মা চব্বিশ ঘন্টা আছে। তোশক দিয়ে বিছানা করা। যখন ইচ্ছা মাঝিকে বলবেন। আমাকেও বলতে পারেন। আমি হলাম আম্মা আপনার বুড়ো ছেলে।
সুরুজ মিয়া সঙ্গে সঙ্গে আসছেন। নবনীর ভালো লাগছে না। সে একা একা হাঁটতে চাচ্ছিল। লোকটার মুখের উপর বলতেও পারছে না আপনি চলে যান। সুরুজ মিয়ার বোধহয় যাবার ইচ্ছাও নেই। হেলতে দুলতে আসছে। মনে হয় নবনীর সঙ্গে গল্প করে আরাম পাচ্ছে। নবনী লোকটাকে কী ডাকবে ভেবে পাচ্ছে না। শ্রাবণী কত সহজভাবে চাচা ডাকে। শ্রাবণীর মতো সহজভাবে চাচা ডাকতে পারলে মন্দ হত না।
‘চেয়ারম্যান সাহেব।!’
‘জ্বি আম্মা।’
‘ইংরেজ সাহেবের স্ত্রীর যে একটা কবর আছে সেটা কোথায়?’
‘কার কবর বললেন?’
‘ইংরেজ সাহেবের স্ত্রীর কবর। যে সাহেব এই ডাকবাংলোয় থাকতেন—তাঁর স্ত্রী। মহিলার নাম মারিয়া স্টোন।’
সুরুজ মিয়া বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এই রকম কোনো কবর তো আম্মা এই অঞ্চলে নাই। কবরের কথা আপনেরে কে বলেছে?’
নবনী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে কবরের ব্যাপারটা শ্রাবণীর বানানো। কোনো বইয়ে পড়েছে বোধহয়।
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘কবরের বিষয়টা কে বলেছে?’
‘মনে পড়ছে না, কে যেন বলেছে।’
‘আচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়া দেখব।’
‘আপনাকে খোঁজ নিতে হবে না। অন্য কোনো ডাকবাংলো সম্পর্কে শুনেছিলাম। এটার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি।’
নবনী সড়ক ছেড়ে পায়ে চলা পথ ধরল। সুরুজ মিয়া বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এই দিকে কই যান?’
‘একটা বটগাছ আছে। বটগাছটা দেখতে এসেছি।’
‘বটগাছ দেখার কী আছে, আম্মা?’
‘ঢাকা শহরে তো আর বটগাছ দেখার তেমন সুযোগ নেই। সুযোগ পাওয়া গেছে যখন, দেখে যাই।’
বটগাছের সামনে এসে নবনী থমকে দাঁড়াল। আজো প্রথম দিনের মতো বলতে ইচ্ছা করল, ‘হ্যালো মিস্টার বটগাছ, কেমন আছেন? বলা হল না। সঙ্গে সুরুজ মিয়া আছেন। তাঁর সামনে চুপ করে থাকাই ভালো।’
‘এই বটগাছটার বয়স কত হবে?’
‘বলা মুশকিল, আম্মা। তবে খুব পুরোনো গাছ।’
‘গাছের গুঁড়ি বাঁধানো। কারা বাঁধিয়েছে জানেন?’
‘জ্বি না আম্মা, জানি না। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখতেছি এই রকম।’
নবনী বলল, ‘আসুন, ঐ খানে গিয়ে বসি।’
‘না যাওয়াই ভালো, আম্মা।
‘না যাওয়াই ভালো কেন?’
‘জংলা জায়গা। কেউ আসে না। সাপ-খোপ থাকতে পারে।’
‘শীতকালে সাপ থাকবে না। আসুন যাই।’
বটের ঝুরির ফাঁক দিয়ে নবনী চট করে ঢুকে গেল। বাধ্য হয়ে পেছনে পেছনে সুরুজ মিয়া ঢুকলেন। তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটার সঙ্গে এসে দেখি একটা সমস্যায় পড়া গেছে। না এসেও উপায় ছিল না। একটা মেয়েকে এভাবে একা একা ছেড়ে দেয়া যায় না।
নবনী বটগাছের গুঁড়ির কাছে এসে অবাক হয়ে গেল। কী অদ্ভুত কাণ্ড! সে দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। চারদিক বটের ঝুরি দিয়ে ঘেরা। যেন বৃক্ষের দেয়াল। মনে হচ্ছে সুন্দর একটা দুর্গ। এই দুর্গের ভেতরে কেউ আসতে পারবে না। ভেতরটা খুব পরিষ্কার। একটা শুকনো পাতাও পড়ে নেই। সিমেন্টের বাঁধানো অংশটি বেশ প্রশস্ত। ইচ্ছে করলে যে কেউ শুয়ে থাকতে পারে। কালো সিমেন্ট। দেখলেই হিম হিম ভাব হয়।
নবনী বলল, ‘কী অদ্ভুত জায়গা দেখেছেন চেয়ারম্যান চাচা?’ এই প্রথম নবনী চাচা বলল, ‘তার খুব খারাপ লাগল না।’ সুরুজ মিয়া বললেন, ‘চলেন আম্মা যাই। ‘যাই যাই করছেন কেন? বসুন না।’
‘সন্ধ্যা হইতে বেশি বাকি নাই। চলেন যাই। আরেকদিন দিনের বেলায় আসলেই হবে।’
‘সন্ধ্যা হোক। দেখি এখান থেকে সন্ধ্যা হওয়া দেখতে কেমন লাগে।’
সুরুজ মিয়া খুবই দুশ্চিন্তায় গলেন। এই মেয়ে মনে হচ্ছে সমস্যায় ফেলে দেবে। জংলা জায়গায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে চাইলে তো বিরাট সমস্যা হবে। স্যার শুনলে শুধু যে মেয়ের উপর রাগ করবেন তা না। তার উপরও রাগ করবেন। রাগ করবারই কথা।
‘চেয়ারম্যান চাচা!’
‘জ্বি আম্মা।’
‘একটা কাজ করতে পারবেন?’
সুরুজ মিয়া শংকিত গলায় বললেন, ‘কী কাজ?’
‘আমি এখানে অপেক্ষা করি। আপনি শ্রাবণীকে নিয়ে আসেন। ও দেখুক কী সুন্দর জায়গা!’
‘আম্মা কী বললেন?’
‘আমি বলছি, যদি আপনার কষ্ট না হয় তাহলে শ্রাবণীকে একটু নিয়ে আসুন।’
সুরুজ মিয়া চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। মেয়েটার সঙ্গে আসা বিরাট বোকামি হয়েছে। এমন বোকামি তিনি সচরাচর করেন না। পনের বছর ধরে তিনি এই অঞ্চলের চেয়ারম্যান। বোকা লোকের পক্ষে এতদিন চেয়ারম্যান থাকা সম্ভব না। আজ মনে হচ্ছে তিনি নিজেকে যত বুদ্ধিমান মনে করেন আসলে তত বুদ্ধিমান নন।
‘আম্মা চলেন, আজ যাই। আরেকদিন দিনের বেলায় ছোট আম্মাকে নিয়ে আসবেন। বটগাছ তো চলে যাবে না আম্মা, এইখানেই থাকবে। গাছের তার জায়গা ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া সন্ধ্যাবেলা একা একা থাকা ঠিকও না। দুনিয়া তো ভালো জায়গা না। দুনিয়া খুবই মন্দ জায়গা। আপনি হইলেন মেয়ে মানুষ। আমাকে দেখেন, পুরুষ মানুষ, বয়শ পঞ্চাশের উপর—বলতে গেলে দিন শেষ। এই আমিই সন্ধ্যার পর একা বার হই না।’
‘কেন বার হন না? ভূতের ভয়?’
‘মানুষের চেয়ে বড় ভূত আর কিছু নাই। মানুষ হইল সবচে’ বড় ভূত। দুইবার আমারে মারার চেষ্টা করেছে। একবার বেড়া ভাইঙ্গা ঘরে ঢুইকা দাও দিয়া কোপ দিল সেই বছরই পাকা দালান দিলাম। আরেকবার সইন্ধ্যাকালে…’
নবনী বলল, ‘থাক, শুনতে চাচ্ছি না। চলুন ফিরে যাই।’
সুরুজ মিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘চলুন আম্মা।’
সারাপথ নবনী একটি কথাও বলল না। সুরুজ মিয়াও চুপ করে রইলেন।
.
নবনী গেট দিয়ে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
ডাকবাংলোর সামনে বেশ ভিড়। দুটা পাজেরো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা জিপের পেছনের চাকা পাংচার হয়েছে। চাকা বদল করা হচ্ছে। ডাকবাংলোর সামনে চেয়ার পাতা হয়েছে। চেয়ারেও দুটা দল। একটা দলের সঙ্গে আছেন জামিল সাহেব। অন্য দলটি খানিকটা দূরে। নবনীর মনে হল, বেশ উৎসব উৎসব ভাব। সন্ধ্যাবেলায় এত বড় দল কোথে কে এসেছে কে জানে। এরা কি এখানে থাকবে?
নবনী সবাইকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই ঠিক করল। ডাকবাংলোর পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকাই ভালো। কেউ দেখবে না। লাভ হল না। সবাই তাকে দেখল। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে তাকাল। জামিল সাহেব বললেন, ‘ঐ দেখুন আমার বড় মেয়ে, ওর নাম নবনী।’
নবনী স্লামালিকুম বলবে কি বলবে না কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। ঠিক করল, বলবে না। এতদূর থেকে স্লামালিকুম বলা অর্থহীন। চেঁচিয়ে বলতে হবে। এরচে’ মাথা নিচু করে হেসে ঘরে ঢুকে পড়াই ভালো।
পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় প্রথমই শ্রাবণীর ঘর পড়ে। ঘরে বাতি জ্বলছে। দরজা খোলা। শ্রাবণী মোড়ায় বসে আছে। টিনের বড় গামলা ভর্তি গরম পানিতে তার বাঁ পা ডুবানো। শ্রাবণীর হাতে বই, তবে গল্পের বই না। পাঠ্যবই। ফিজিক্সের বই।
`নবনী বলল, ‘তোর কী হয়েছে?’
‘পা মচকে ফেলেছি। শাহেদ ভাইয়ের একটা রং সার্ভিস রিটার্ন করতে গিয়ে—পা পিছলে আলুর দম।’
‘বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’
‘সিরিয়াস ব্যথা পেয়েছি। বিকট চিৎকার। মার ধারণা, পা ভেঙে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বুক ধড়ফড় শুরু হল। ইন্টারেস্টিং এক সিচুয়েশন। শাহেদ ভাই এমন মন খারাপ করলেন যেন তিনি নিজেই ব্যাডমিন্টন র্যাকেট দিয়ে বাড়ি মেরে আমার পা ভেঙেছেন।’
নবনী বলল, তোকে দেখে তো কিছু বোঝা মুশকিল। আসলে পা ভাঙে নি তো?’
‘না ভাঙে নি। ফোলা কমে গেছে। ভাঙলে এত তাড়াতাড়ি ফোলা কমত না।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে নবনী বলল, ‘আচ্ছা ভালো কথা ইংরেজ মহিলার কবরটা যেন কোথায়?’
শ্রাবণী হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কাছেই।’
‘নিয়ে যাবি আমাকে?
‘পা ফেলতে পারি না। নিয়ে যাব কীভাবে?’
‘মহিলার কবর যে বুঝলি কী করে?’
‘নাম লেখা আছে। মারিয়া স্টোন না কি যেন। নারে শেষে কবিতা আছে।’
‘কী কবিতা?’
‘The bells will ring
The birds will sing.’
‘রিং-এর সঙ্গে সিং-এর সহজ মিল।
শ্রাবণী বলল, ‘স্বামী বেচারা নিজেই বোধহয় লিখেছে, ভালো মিল পায় নি। কবর নিয়ে এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
‘এমনি।’
নবনী মার খোঁজে গেল। জাহানারা রান্নাঘরে ছিলেন না। বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ঘর অন্ধকার। তাঁর মাথার কাছে মিলু বুয়া দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার পর থেকে সে সব সময় মার কাছে থাকবে। নবনী বলল, ‘মা তুমি রান্নাঘর থেকে নির্বাসিত। ব্যাপার কি বল তো?’
জাহানারা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়।
প্রেসার মেপে দেব?’
‘না। তুই আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়া।’
নবনী ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এল। জাহানারা পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। নবনী বসল মার পাশে। জাহানারা মেয়ের কোলে একটা হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, ‘এতক্ষণ শাহেদ ছিল। তুই আসার একটু আগে গেল। তোর খোঁজেই বোধহয় গিয়েছে।’
‘আমাকে কোথায় খুঁজবে?’
‘কি না কি এক বটগাছ আছে। তোর সেখানে যাবার কথা। শ্রাবণী ওকে তাই বুঝিয়েছে।’
‘মা, শ্রাবণী যে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে তুমি জান?’
‘এই বয়সে সবাই মিথ্যা বলে।’
‘আমি বলতাম?’
‘বলেছিস নিশ্চয়ই। এখন মনে নেই।’
‘শ্রাবণী বানিয়ে বানিয়ে বলেছে— এখানে কোন জঙ্গলের মধ্যে নাকি এক ইংরেজ মহিলার কবর আছে। মারিয়া স্টোন নাম।’
‘আমাকেও বলেছে।’
‘ওর হাবভাব আমার ভালো লাগছে না, মা।’
‘ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না। ও ঠিকই আছে। আয়, আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।
‘কী নিয়ে কথা বলতে চাও?’
‘তোকে নিয়ে বলি। আজ শাহেদ তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলল।’
‘নিজ থেকেই বলল, নাকি তুমি জিজ্ঞেস করলে?’
‘নিজ থেকেই বলল, তার মা খুব অসুস্থ। তার মা চাচ্ছেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হোক।’
‘সে তো তার মায়ের অসুখের কথা কিছু বলে নি।’
‘শাহেদ কখনো তার সমস্যার কথা বলে না। ও অনেকটা আমার মতো।’
নবনী হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমার কি কোনো সমস্যা আছে, মা?’
‘আছে।’
‘কী সমস্যা?’
‘শুনতে চাস?’
‘হুঁ চাই। আমার ধারণা, তুমি এই পৃথিবীর একমাত্র সমস্যাবিহীন মহিলা। একটা পরিষ্কার রান্নাঘর। রান্নার জিনিসপত্র এবং ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি। এই কটা জিনিস পেলেই তোমার হয়ে গেল।’
জাহানারা বিছানায় উঠে বসলেন। নবনী লক্ষ করল, তার মা উত্তেজনায় অল্প অল্প কাঁপছেন। নবনী বলল, ‘কী ব্যাপার মা?’
‘না, কোনো ব্যাপার না। তুই আমার সমস্যার কথা শুনতে চেয়েছিস। সমস্যা শুনে যা।’
‘থাক মা, আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি এরকম করছ, আমার ভালো লাগছে না। মিলু বুয়া, তুমি মাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দাও তো।’
জাহানারা আবার শুয়ে পড়লেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘তোর এবং শ্রাবণীর বিয়ে হবার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি। বিয়ে হয়ে গেলেই আমার দায়িত্ব শেষ—তখন…’
‘তখন কী?’
জাহানারা বললেন, ‘এখন ঘর থেকে যা। কথা বলতে ভালো লাগছে না।’