২
নবনী ভেবেছিল ডাকবাংলোয় পৌঁছানোমাত্র সে বকা খাবে। তার বাবা বন ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী জামিল চৌধুরী নিশ্চয়ই থমথমে মুখে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর সামনে একটা হ্যাজাক লাইট। একটু দূরে সাহেব শুকনো মুখে দাড়িয়ে। ওসি সাহেবের পেছনে মাধবদি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরুজ মিয়া। সুরুজ মিয়া হাত কচলাচ্ছেন এবং তেলতেলে মুখে হাসছেন। এই মানুষটা ননস্টপ হাসতে পারেন। বকা খেলেও হাসেন। পান খাওয়া লাল দাঁত সর্বক্ষণ বের হয়ে থাকে। তবে তাতে তাঁকে খারাপ লাগে না। মনে হয়, ধবধবে সাদা দাঁতে এই মানুষটাকে মানাত না।
নবনীর খোঁজে নিশ্চয়ই লোকজন বের হয়ে গেছে। ডাকবাংলোর সামনে পুলিশের দুজন সেন্ট্রি থাকে। তারা নবনীর খোঁজে গেছে। ঝোপঝাড়ে পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ফেলছে। চারজন আনসারের একটা দল আছে, তারাও নিশ্চয়ই বের হয়েছে। নবনীর মা জাহানারা অস্থির হয়ে পড়েছেন। তাঁর বুক ধড়ফড় করছে। সামান্য উত্তেজনাতেই তাঁর বুক ধড়ফড় করে।
নবনী যা ভেবে রেখেছে তার কিছুই হল না। আজ দিনটা বোধহয় তার জন্যে শুভ। জামিল সাহেব বারান্দায় বসা। তাঁর মুখ গম্ভীর নয়, হাসি হাসি। ওসি সাহেব এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সুরুজ মিয়ার পান খাওয়া লাল দাঁত দেখা যাচ্ছে।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় সেন্ট্রির পুলিশ দুজন একসঙ্গে স্যালুট দিল। নবনীর অস্বস্তি লাগছে। এরা সব সময় তাকে স্যালুট দেয় কেন? সে তো কেউ না। তারচে’ বড় কথা স্যালুট দিলে নবনীর কী করণীয়? সে কি হাত তুলে সালাম নেবে? না মাথা ঝুঁকিয়ে হাসবে? বাবাকে জিজ্ঞেস করা দরকার। কখনো মনে থাকে না।
জামিল সাহেব মেয়েকে দেখে উঁচু গলায় বললেন, ‘কাণ্ড দেখে যা।
নবনী কাছে এসে কাণ্ড দেখল। জামিল সাহেবের পায়ের কাছে প্রকাণ্ড এক চিতল মাছ ধড়ফড় করছে। নবনী বলল, ‘কী সর্বনাশ, এত বড় মাছ হয়!’
সুরুজ মিয়া হাসিমুখে বললেন, ‘হয় আম্মা, ক্বচিৎ হয়। এরে বলে রাজ-চিতল। গলাটা লাল। স্যারের ভাগ্যে মাছটা ছিল।’
নবনী বলল, ‘আপনি এনেছেন এই মাছ?’
‘জ্বি আম্মা। সামান্য জিনিসে স্যার খুশি হবেন ভাবি নাই। স্যার খুশি হয়েছেন। আমার একেবারে চোখে পানি এসে গেছে।’
সুরুজ মিয়ার চোখে আবার পানি এসে গেছে। সত্যি সত্যি পানি। এক জন বয়স্ক লোক যার মাথার বেশিরভাগ চুল পাকা সে এত সহজে কেঁদে ফেলতে পারে? নবনী ভেবে পাচ্ছে না, এই লোকটা আসলেই কাঁদছে, না যে কোনো পরিস্থিতিতে চোখে পানি আনার দুর্লভ ক্ষমতা আয়ত্ত করেছে?
জামিল সাহেব দরাজ গলায় বললেন, ‘খুশি হবারই কথা। এত বড় মাছ আজকাল তো চোখে পড়ে না। মাছটার ওজন কত হবে মনে হয়?’
‘ওজন করাই নাই স্যার। ওজন করায়ে নিয়ে আসি।’
‘না, থাক থাক, দরকার নেই।’
‘অবশ্যই দরকার আছে স্যার। আপনার মুখের কথা হুকুমের বাবা। ওসি সাহেব, মাছটা ধরেন তো। একলা পারব না। ত
দুজন মাছের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শূন্যে ঝুলিয়ে যে দ্রুততার সঙ্গে বের হয়ে গেল তাতে মনে হয় আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওজন না নিলে একটা বিপর্যয় ঘটে যাবে। জামিল সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।’
‘কী সারপ্রাইজ?’
‘বোস আমার পাশে। এখন অনুমান কর।
‘আমার M. Sc. রেজাল্ট হয়েছে?’
‘উঁহু। শাহেদ এসেছে।’
‘কী বললে?’
‘হ্যাঁ শাহেদ। আমি চেয়ারম্যান সুরুজ মিয়ার সঙ্গে গল্প করছিলাম, হঠাৎ দেখি সুটকেস হাতে হেলতে দুলতে কে যেন আসছে। চেহারা দেখছি, তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছে না। যা ভেতরে যা।’
নবনী ভেতরে গেল না। বসে রইল। বাবার সামনে থেকে উঠে যেতে এখন লজ্জা লাগছে।
জামিল সাহেব বললেন, ‘কি, এখন খুশি তো? যা ভেতরে যা।’
নবনী নিচু গলায় বলল, ‘যাব। তাড়া তো কিছু নেই।’
জামিল সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে আনন্দিত গলায় বললেন, ‘ছোট ব্যাপার নিয়ে তোরা যে ঝগড়া মাঝেমধ্যে করিস, আমি রীতিমতো আতংকগ্রস্ত হই। তোদের বিয়ের ঝামেলা আমি এবার চুকিয়ে ফেলব। আর দেরি করা যাবে না।’
‘বাবা, তোমাকে তো বলেছি রেজাল্ট না হলে বিয়ে করব না।’
‘আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। রেজাল্টের খুব বেশি দেরি আছে বলে তো মনে হয় না। এই সপ্তাহেই বের হবার কথা না? মা, আমাকে কফি দিতে বল তো।
নবনী উঠে গেল। ঘরের ভেতর ঢুকতে তার লজ্জা লাগছে। চট করে শাহেদের সামনে সে পড়তে চাচ্ছে না। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। পা ভর্তি ধুলো। নবনী ধরেই নিয়েছিল শাহেদের সঙ্গে তার দেখা হবে না। দেখা হলেও সৌজন্য কথাবার্তার মতো হবে। “কেমন আছ?” “ভালো” জাতীয় অর্থহীন আলাপ।
.
জাহানারা রান্নাঘরে। সমুচা ভাজছেন। পনীরের সমুচা। ভাগ্যিস, ঢাকা থেকে পনীর নিয়ে এসেছিলেন। পনীরের সমুচা শাহেদের খুব পছন্দ। সে মিষ্টি খেতে পারে না। ডাকবাংলো ভর্তি হয়ে গেছে মিষ্টিতে। এত মিষ্টি কী করবেন তিনি জানেন না। ডাকবাংলোয় ফ্রিজ নেই। ইলেকট্রিসিটি যখন আছে একটা ফ্রিজ থাকতে পারত। তিনি ঠাণ্ডা পানি ছাড়া খেতে পারেন না। শীতকালেও তাঁর বরফের কুচি মেশানো ঠাণ্ডা পানি চাই।
নবনী রান্নাঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, বাবা কফি চাচ্ছে।’
জাহানারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শাহেদের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
‘এখনো হয় নি।
‘তুই এতক্ষণ ছিলি কোথায়?’
‘একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।
‘শাহেদ যে এসেছে শুনেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কিন্তু তোর বাবাকে বলেছিলাম—শাহেদ চলে আসবে। আজ সকালেও কেন জানি মনে হয়েছে।
‘তোমার অসাধারণ ইএসপি ক্ষমতার জন্যে অভিনন্দন। এখন বাবাকে কফি করে দাও।’
‘কফি দেয়া যাবে না। সবাইকে এক সঙ্গে চা-নাশতা দেব। তুই যা, শাহেদের সঙ্গে কথা বলে আয়।’
‘তোমার কোনো সাহায্য লাগবে না?’
‘না, সাহায্য লাগবে না। আমি কবে তোর সাহায্য নিয়েছি? তুই রান্নাঘর থেকে যা তো।’
রান্নাবান্নার ব্যাপারে জাহানারা কারোর সাহায্যই নেন না। ডাকবাংলোয় এক জন বাবুর্চি আছে। তিনি নিজেও তাদের অনেকদিনের পুরোনো বুয়া মিলুকে সঙ্গে এনেছেন। এরা কেউ কিছু করছে না। শুকনো মুখে দূরে দূরে ঘুরছে। এদের কারোরই খাবার কোনো জিনিসে হাত দেয়ার হুকুম নেই। জাহানারার খারাপ ধরনের শুচিবায়ু আছে। নিজে তা স্বীকার করেন না। কেউ এই প্রসঙ্গে কিছু বললেও রেগে যান।
বাবুর্চিকে দিয়ে খাবার জিনিসে হাত না দেওয়ানোর পেছনে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে ‘হাত দিয়ে তারা কখন কী করে তার ঠিক আছে? কিছুক্ষণ আগেই হয়তো নাক ঝেড়ে এসেছে। বেশিরভাগ মানুষই নাক ঝাড়ার পর হাত ধোয় না। মুছে ফেলে। আর যদি-বা ধোয়, কজন সাবান ব্যবহার করে? এরা অন্য জিনিসে হাত দিচ্ছে, দিক। কিন্তু খাবার জিনিসে হাত দেবে, সেই খাবার আমি খাব—তা হবে না।
মিলু বলল, ‘আপনের গরম লাগতেছে, সমুচা আমি ভাজি?’ জাহানারা বললেন, ‘না। তুই দূরে থাক। এই ঘর থেকে চলে যা।’ মিলু একটু সরে গেল কিন্তু ঘর থেকে বের হল না।
.
মিলু প্রায় কুড়ি বছর ধরে তাদের সঙ্গে আছে। দশ বছর বয়সে ভিক্ষা করতে এসেছিল। জাহানারা তার সুন্দর মুখ দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘ভিক্ষা করছিস কেন, বাসায় কাজ করবি? মিলু বলল, ‘না।’ তিনি মেয়েটাকে একটা জামা দিলেন। পাঁচটা টাকা দিলেন। বলে দিলেন, ‘যদি কাজ করতে ইচ্ছে হয় চলে আসিস।’ মেয়েটা পরের দিনই চলে এল। তিনি বললেন, ‘কি রে থাকবি?’
‘হুঁ।’
‘নাম কি তোর?’
‘কুদরতী।’
‘হুঁ না বল জ্বি। ‘জ্বি।’
‘পা ছুঁয়ে সালাম কর।’
মিলু পা ছুঁয়ে সালাম করল।
‘জাহানারা বললেন, ‘তোর চেহারা ছবি সুন্দর। তুই ভালোমতো থাক তোর ভালো হবে। বয়সকালে বিয়ে দিয়ে দেব। তোর বয়েসী মেয়ে পথেঘাটে ঘোরাও ঠিক না। থাকবি তো ঠিকমতো?’
‘হুঁ।’
‘হুঁ না-বল জ্বি।’
‘জ্বি।’
‘ভালোমতো থাকবি। আদব কায়দা শিখবি। কাজকর্ম শিখবি। সময় কালে আমি টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়ে দেব।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
জাহানারা তাঁর কথা রেখেছেন। মিলুর বিয়ে দিয়েছেন তাঁদের ড্রাইভার রহমতের সঙ্গে। বিয়ের পরেও মিলু ঘরেই আছে। ছেলেপুলে হয় নি। একদিক দিয়ে সুবিধাই হয়েছে। ছেলেপুলে হয়ে গেলে নিজের কাছে রাখতে পারবেন না। যেখানে যান নিজের সঙ্গে রাখেন।
.
শাহেদকে কোথাও পাওয়া গেল না। ডাকবাংলোর সর্ব পশ্চিমের ঘরটা নবনীর ছোট বোন শ্রাবণীর। আর তিন মাস পরেই তার আইএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। ছুটি কাটাতে এসেও সে নিরিবিলি পড়বে এই অজুহাতে ডাকবাংলোয় সবচে’ সুন্দর ঘরটা নিয়ে নিয়েছে। এই ঘরটা নাকি নিরিবিলি। তার ঘরের সঙ্গের বারান্দাটা নদীর দিকে। বারান্দায় দাঁড়ালেই নদী দেখা যায়। শীতকাল বলেই নদী শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। নদীর চেয়েও যা চোখে পড়ে তা হল নদীর চর। চাঁদের আলোয় বালির চর চিকচিক করে। অদ্ভুত লাগে দেখতে। শ্রাবণী এখানে আসার আগে দু সুটকেস ভর্তি বই নিয়ে এসেছে। এক সুটকেসে পাঠ্যবই। এক সুটকেসে গল্পবই। পাঠ্যবইয়ের সুটকেসের তালা খোলা হয় নি। গল্পের বইয়ের সুটকেস খোলা হয়েছে। সে ক্রমাগত গল্পের বই পড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বই তার আগেই পড়া। একবার না, কয়েকবার করে পড়া। তারপরেও এমন ভাবে পড়ছে যেন নতুন বই।
নবনী ঘরে ঢুকে দেখল, শ্রাবণী খাটে পা ঝুলিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাতে বই। গলায় লালরঙা মাফলার। শ্রাবণীর গলায় লালরঙা মাফলারের মানে হল টনসিলের সমস্যা হয়েছে। কিছুদিন পর পর তার টনসিলের সমস্যা হয়। ঢোঁক গিলতে পারে না। সে কাউকেই কিছু বলে না। একটা লাল মাফলার গলায় পেঁচিয়ে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়—।
নবনী বলল, ‘তোর কি গলাব্যথা?’
শ্রাবণী বই থেকে মাথা না তুলে বলল, ‘হুঁ।’
‘জ্বর আসে নি তো, গাল লাল লাগছে।’
‘এসেছে। একশ এক পয়েন্ট ফাইভ।’
‘কী পড়ছিস?’
‘নির্বাচিত ভূতের গল্প। এখন পড়ছি পরশুরামের মহেশের মহা যাত্রা।’
‘আজ কি সারাদিনই বই পড়লি?’
‘হুঁ। মাঝখানে একবার বাবা মাছ দেখতে ডাকলেন। মাছ দেখলাম। বাবাকে খুশি করার জন্যে বিকট চিৎকার দিলাম—‘ও মাগো! এটা কী? মাছ নাকি? ওয়াক থু। মাছ এত বড় হয়?’
নবনী হেসে ফেলল। শ্রাবণী হাসল না। পা নাচাতে লাগল। নবনী বলল, ‘যত দিন যাচ্ছে ততই একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার হয়ে দাঁড়াচ্ছিস। ব্যাপারটা কেউ লক্ষ করছে না।’
শ্রাবণী হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কেউ যে করছে না তা না, কেউ কেউ করছে। আচ্ছা আপা, এখন তুমি যাও। ভূতের গল্প একনাগাড়ে পড়তে হয়। মাঝখানে ইন্টারাপশান হলে পড়াই মাটি। মনে হচ্ছে তুমি শাহেদ ভাইকে খুঁজছ। খুঁজে না পেয়ে বিব্রত বোধ করছ। কাউকে মুখ ফুটে জিজ্ঞেসও করতে পারছ না। উনি গোসল করার জন্যে কুয়াতলায় গেছেন। ডাকবাংলোয় একটা কুয়া আছে, তুমি জান কিনা জানি না। কুয়ার পানি অসম্ভব পরিষ্কার। শাহেদ ভাই সেই পরিষ্কার পানিতে গা ধুবেন।’
‘এই ঠাণ্ডায় কুয়ার পানি?’
‘হ্যাঁ। উনার যেহেতু টনসিলের সমস্যা নেই, ঠাণ্ডা পানিতে কিছু হবে না।’
‘কুয়ার পানিতে গোসলের বুদ্ধি কি তুই দিয়েছিস?’
শ্রাবণী পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘হুঁ। গতকাল কুয়ার পানিতে আমি গোসল করে ঠাণ্ডা লাগিয়েছি। আজ লাগাবেন শাহেদ ভাই। আপা, এখন কি তুমি যাবে? গল্পটা শেষ করতে চাই। তুমি এক কাজ কর, কুয়ার পাড়ে চলে যাও। আমার বারান্দা দিয়ে নামার সিঁড়ি আছে। এস, তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
‘দেখাতে হবে না।
নবনী কী করবে ঠিক ভেবে পেল না। শেষ পর্যন্ত কুয়াতলার দিকে রওনা হল। ডাকবাংলোর জায়গাটা অনেক বড়। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। পেছনে রীতিমতো আম কাঁঠালের বাগান। নবনীরা দুদিন পার করে দিয়েছে, এখনো ডাকবাংলোর চারপাশ ভালো করে দেখা হয় নি। সে জানতই না—এদের কুয়াতলাও আছে। ডাকবাংলোয় সাধারণত কুয়া থাকে না।
শাহেদ গোসল শেষ করে হি-হি করে কাঁপছে। তার গায়ে মোটা টাওয়েল। শাহেদ একা নয়। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে হারিকেন। মালীও আছে। সে এতক্ষণ পানি তুলে দিচ্ছিল।
নবনী কুয়াতলার পাশে এসে দাঁড়াল। সহজ গলায় বলল, ‘কেমন আছ?’
শাহেদ বলল, ‘খুব খারাপ আছি। শ্রাবণীর কথা শুনে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়েছি। সে বলেছে কুয়ার পানি গরম। আমি সরল মনে বিশ্বাস করেছি।’
‘বললেই তো ওরা পানি গরম করে দিত।’
‘তা তো দিতই।’
‘তোমার আসতে অসুবিধা হয় নি?’
‘হয়েছে। অনেক ঝামেলা করে আসতে হল।
‘এলে কেন ঝামেলা করে?’
শাহেদ হাসল। নবনী চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও নিতে পারল না। মনে মনে ভাবল, ‘এত সুন্দর করে মানুষ হাসে কীভাবে?’
‘আমি হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায় খুশি হয়েছ তো?’
নবনী জবাব দিল না। সে প্রচণ্ড খুশি হয়ে গেছে। তার এত আনন্দ হচ্ছে। ভাগ্যিস কেউ তা বুঝতে পারছে না। নবনী চায় না কেউ বুঝে ফেলুক।
‘আমি আসব—এটা নিশ্চয়ই আশা করনি?’
‘না।’
‘খুশি হয়েছ কিনা তা তো বললে না।’
নবনী হালকা গলায় বলল, ‘প্রচণ্ড রাগ করেছি। রাগে অন্ধ হয়ে গেছি। কেন এলে?’ বলেই হেসে ফেলল।
তারা ডাকবাংলোর দিকে এগুচ্ছে। নবনী কেয়ারটেকারের হাত থেকে হারিকেন নিয়ে নিয়েছে। সে যাচ্ছে আগে আগে, শাহেদ পেছনে পেছনে আসছে।
‘নবনী।’
‘উঁ।’
‘আমি যে হঠাৎ এখানে এসে তোমাকে চমকে দেব তা আগে থেকে ঠিক করা। সব প্রি-প্ল্যানড। প্রচণ্ড রকম ঝগড়া তোমার সঙ্গে হল, সেই ঝগড়াও কিন্তু প্ল্যানের একটা অংশ। যাতে তুমি ধারণা কর আমি আসব না। অবশ্যি পুরো ব্যাপারটা আমি যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে হয় নি।’
‘তুমি কীভাবে চেয়েছিলে?’
‘আমি ঠিক করে রেখেছিলাম গভীর রাতে উপস্থিত হব। তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছ। আমি তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খুব ক্যাজুয়েল ভঙ্গিতে বলব, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দাও তো নবনী। হা-হা-হা।’
নবনী বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে অকারণে ঝগড়া করেছি। তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি লজ্জিত, খুব লজ্জিত। আমি ক্ষমা প্রার্থনা করে তোমার কাছে দীর্ঘ চিঠি লিখছি।’
‘আমি কিন্তু কোনো চিঠি পাই নি।’
‘তুমি পাও নি। কারণ আমি চিঠি পাঠাই নি। চিঠি এখানেই আছে।’
‘পড়তে পারব?’
‘দেখতে পারবে। কিন্তু পড়তে পারবে না।’
‘পড়তেই যদি না পারি তবে দেখে কী লাভ?’
‘আমি আঠার পাতার একটা চিঠি লিখেছি। এটা জানবে। চিঠি না দেখলে কী করে বুঝবে।’
‘সত্যি আঠার পাতার চিঠি?’
‘হুঁ।’
‘বল কী। আমি তো শুদ্ধ বাংলায় আঠারটা লাইন লিখতে পারি না। বাংলায় চিঠিপত্র লিখতে গিয়ে যা সমস্যা হচ্ছে। এক জন সেক্রেটারি রেখেছি। সে নাকি বাংলায় অনার্স করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে আমার চেয়েও কম বাংলা জানে। সেদিন আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল—স্যার Acceptance এর সুন্দর বাংলা কী হবে?’
‘তুমি কী বললে?’
‘আমি কিছুই বললাম না। ওর দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রইলাম। Acceptance এর সুন্দর বাংলা যদি আমি জানতাম তাহলে ওকে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে রাখতাম?’
‘সেটাও একটা কথা।’
.
জাহানারা নাশতার অনেক আয়োজন করেছেন। পনীরের সমুচা ছাড়াও লুচি ভেজেছেন। মুরগির কোরমা করেছেন। আলুর চপ তৈরি হয়েছে। ডাকবাংলোর খাবার ঘরে খাবার দেয়া হয়েছে। সবাই গোল হয়ে বসেছে। টেবিলটা বেশি বড়। মনে হচ্ছে কনফারেন্স রুম। তারা যেন খেতে বসে নি, জরুরি আলোচনায় বসেছে। শ্রাবণীর গলায় মাফলার নেই। মনে হয় গলাব্যথা কমেছে। এখন ইলেকট্রিসিটি নেই। হ্যাজাক জ্বলছে।
জাহানারা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের ইলেকট্রিসিটি এত ঘন ঘন যায় কেন?’
‘আমাদের বলছ কেন? বিদ্যুৎ তো আমার দপ্তর না। আমার হল বন এবং খনিজ সম্পদ। বনের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন থাকলে বল।’
শ্রাবণী বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে।’
‘কী প্ৰশ্ন মা?’
‘বাংলাদেশের বনে মোট কতগুলো ময়ূর আছে বাবা?’
‘কতগুলো ময়ূর আছে তা তো বলতে পারব না। তবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার কতগুলো আছে তা বলা যাবে। গত বৎসর সেনসাস হয়েছে।’
‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার কতগুলো আছে?’
‘অফ হ্যান্ড বলতে পারব না মা। সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।’
‘উনাকে কী করে জিজ্ঞেস করবে। এখানে তো টেলিফোন নেই।’
‘ওয়্যারলেসে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেব। সব থানায় ওয়্যারলেস আছে।’
শাহেদ বলল, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা জানা কি খুব দরকার শ্রাবণী?’
শ্রাবণী বলল, ‘হ্যাঁ দরকার। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঠিক সংখ্যা না জানলে আমি আজ রাতে ঘুমাতে পারব না।’ জামিল সাহেব হো-হো করে হেসে উঠলেন।
.
সুরুজ মিয়া মাছ নিয়ে ফিরে এসেছেন। চর ওজন হয়েছে একচল্লিশ কেজি। জামিল সাহেব বললেন, ‘বাহ্ বাহ্, এক মনের বেশি। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার।’
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘পাল্লা-পাথর নিয়ে এসেছি। আপনার সামনে একবার মাপব।’
‘কোনো দরকার নেই।’
‘স্যার, শখ করে এনেছি। আপনার সামনে একটু মাপি।’
মাপা হল। একচল্লিশ কেজি দুশ গ্রাম। শ্রাবণী বলল, ‘আপনি তো বললেন, একচল্লিশ কেজি। দুশ গ্রাম বেশি হল কেন?’
‘যখন প্রথম ওজন নিয়েছিলাম, মাছটা জিন্দা ছিল। এখন মাছটা মারা গেছে। মৃত্যুর পর ওজন বেড়ে যায় মা।’
‘কেন?’
‘মৃত্যুর পর মাটির টানে বাড়ে।’
জামিল সাহেব বললেন, ‘সুরুজ মিয়া আপনি অনেক ঝামেলা করেছেন। এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। মেনি থ্যাংকস।’
‘মাছটা কাটায়ে তারপর যাব স্যার। এত বড় মাছ সবাই কাটতে পারে না। পেটি নষ্ট হয়ে যাবে। মাছ কাটার লোক এবং বঁটি নিয়ে এসেছি।’
‘ভালো করেছেন।’
জামিল সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ‘মাছ যে কাটবে সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো? আমার স্ত্রী আবার এইসব ব্যাপারে খানিকটা কি যেন বলে শুচিবায়ুর মতো আছে।’
সুরুজ মিয়া হাসিমুখে বললেন, ‘আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না, স্যার। আমি তারে সাবান দিয়ে গোসল করায়ে তারপর মাছের কাছে নিয়ে যাব। ময়লা হাতে মাছ ছোঁয়াও ঠিক না। আমি এখনি তারে গোসলে পাঠায়ে দেই।’
শ্রাবণী বলল, ‘চেয়ারম্যান চাচা, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরি একটা কথা আছে। অসম্ভব জরুরি!’
‘কী কথা মা?’
‘সবার সামনে বলা যাবে না। আপনি আমার সঙ্গে বারান্দার ঐ মাথায় আসুন।’
সুরুজ মিয়া বিস্মিত এবং আনন্দিত মুখে এগুলেন। বিস্মিত ও আনন্দিত হবার মূল কারণ হচ্ছে— মন্ত্রী সাহেবের মেয়ে তাকে চাচা ডাকছে। আফসোসের ব্যাপার হল, ডাকটা বাইরে কেউ শুনতে পায় নি। ওসি সাহেব সামনে নেই। সে শুনলেও কাজ হত। আর দশ জনের কাছে বলত।’
সুরুজ মিয়া বললেন, ‘কী কথা আম্মা?’
‘আপনি কি আমার জন্যে একটা জিনিস জোগাড় করে দিতে পারবেন?’
‘অবশ্যই পারব। এখানে না পাওয়া যায়, ঢাকা থেকে নিয়ে আসব। রাত একটায় একটা ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে লোক পাঠায়ে দিব।’
‘ঢাকা থেকে আনতে হবে না। আমার মনে হয় এখানেই পাওয়া যাবে। হয়তো আপনার বাড়িতেই আছে।’
‘জিনিসটা কী?’
‘একটা মই।’
‘মই! মই কী জন্যে?’
‘এই ডাকবাংলোর ছাদে উঠার ব্যবস্থা নেই। আমি মই দিয়ে ছাদে উঠব।’
‘আমি এখনি মই নিয়া আসতেছি।’
‘এখনি আনার দরকার নেই। এখন আনলে বাবা দেখে ফেলবেন, রেগে যাবেন। আপনি বরং কাল সকালে নিয়ে আসবেন। নটার আগে। নটা পর্যন্ত বাবা ঘুমিয়ে থাকেন। তিনি কিচ্ছু জানতে পারবেন না।’
সুরুজ মিয়া ভীত গলায় বললেন, ‘স্যার যদি রাগ করেন তাহলে কাজটা করা কি ঠিক হবে আম্মা?’
‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনি তো আর জানেন না কি জন্যে আমি মই চেয়েছি। আমি আপনার কাছে চেয়েছি। আপনি সরল মনে এনে দিয়েছেন।’