তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে – ১২

১২

নবনী একা একা বটগাছের গুঁড়ির বাঁধানো অংশে বসে আছে। রাত অনেক হয়েছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চারদিকে সুন্দর জোছনা। নবনীর মনে হচ্ছে সে একটা দুর্গের ভেতর আছে। বৃক্ষের দূর্গ। এই দুর্গ ভেদ করে কেউ তার কাছে আসতে পারবে না। ক্রমাগত ঝিঁঝি ডাকছে। শীতের বাতাস বইছে। নবনীর ঘুম পাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে এখানে ঘুমিয়ে পড়তে। এত ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু তার মন শান্ত। মনে হচ্ছে তার কোনো দুঃখবোধ নেই। সে কি নিজেই গাছ হয়ে যাচ্ছে? গাছদের জীবনে নিশ্চয়ই কোনো তীব্র দুঃখবোধ থাকে না।

‘আপা!’

নবনী তাকাল। শ্রাবণী এসেছে। সে আসবে নবনী জানত। সে শ্রাবণীর জন্যেই অপেক্ষা করছিল। শ্রাবণী এসে বসল বোনের পাশে। নবনী বলল, ‘দেখেছিস কী সুন্দর!’

শ্রাবণী বলল, ‘হ্যাঁ।’

নবনী বলল, ‘ইংরেজির ঐ অধ্যাপক ভদ্রলোকের মতো আজ সারারাত আমি এখানে বসে জোছনা দেখব।

শ্রাবণী বলল, ‘আমিও দেখব। আমি তোমার জন্যে চাদর নিয়ে এসেছি, আপা। নাও, চাদরটা গায়ে দাও।’

নবনী কোনো আপত্তি করল না। চাদর গায়ে দিল। শ্রাবণী বলল, ‘আপা শোন, আমার দিকে তাকাও। আমার দিকে তাকিয়ে একটা কথা শোন।’

নবনী তাকাল। শ্রাবণী খুব সহজ স্বরে বলল, ‘এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে বেশি আমি কাউকে পছন্দ করি না। তুমি যে কত ভালো একটা মেয়ে তা শুধু আমি জানি। আর কেউ জানে না। কেউ কোনোদিন জানবেও না। আমি কি তোমাকে কষ্ট দিতে পারি আপা? ভুলেও ভেব না তোমার প্রিয়জনকে আমি কেড়ে নেব। তোমার যে প্রিয় সে আমারও প্রিয়।’

নবনী ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল।

শ্রাবণী বলল, ‘আমি তোমার জন্যে অসম্ভব সুন্দর একটা জীবন চাই। এমন সুন্দর জীবন, যা শুধু গল্পে উপন্যাসে পাওয়া যায়। আমি কখনো চাই না, তোমার জীবনটা মার মতো হয়। আমি যা করেছি এই জন্যেই করেছি। তোমার যত ভ্রান্তি ছিল সব দূর করে দিলাম। এমনিতে তুমি কিছু বুঝতে পারছিলে না। কাজেই খুব কঠিনভাবে তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম।

‘মার ব্যাপারটা তুই জানতি?’

‘কেন জানব না, আপা? আমার অনেক বুদ্ধি।’

নবনী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি এত বোকা হয়েছি কেন রে শ্রাবণী? আল্লাহ্ কেন আমাকে এত বোকা করে বানাল?’

নবনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শ্রাবণী তার বোনকে শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। শ্রাবণীকে এখন একটা বৃক্ষের মতোই লাগছে। যেন সে বোনের চারদিকে কঠিন দেয়াল তুলে দিয়েছে। যেন এই দেয়াল ভেদ করে পৃথিবীর কোনো মালিন্য নবনীকে স্পর্শ করতে না পারে।

আকাশ থেকে জোছনা গলে গলে পড়ছে। শীতের বাতাসে যেন সেই জোছনা ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শ্রাবণী ফিসফিস করে বলল, ‘কাঁদে না আপা। কাঁদে না।’

সমাপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *