তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে – ১১

১১

জাহানারার ঘর অন্ধকার। তিনি দরজা-জানালা সব নিজের হাতে বন্ধ করেছেন। নবনী অন্ধকার ঘরে তার মার পাশে বসে আছে। তার কেমন ভয় ভয় লাগছে। তার মনে হচ্ছে, মা যেন ঘোরের জগতে চলে যাচ্ছেন। কথাবার্তা ছাড়া ছাড়া। মার মধ্যে কি কোনো পাগলামি ভর করেছে? কেমন তীক্ষ্ণ গলায় কথা বলছেন। যেন মা না, অন্য কেউ। নবনী বলল, ‘এরকম করছ কেন?’

‘তোকে একটা কথা বলব।’

‘এমন কী কথা যে বলার জন্যে দরজা বন্ধ করতে হবে?’

‘কিছু কথা আছে অন্ধকারে বলতে হয়। আলোতে বলা যায় না।’

‘মা, আমি শুনতে চাচ্ছি না।

‘তোকে শুনতে হবে।

‘মা প্লিজ, আমি শুনতে চাচ্ছি না। আমার ভয় লাগছে।’

জাহানারা তীব্র গলায় বললেন, ‘ভয় আমারও লাগছে। জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছি ভয়ে ভয়ে। আর ভালো লাগছে না। আমি মুক্তি চাই। আমি আরাম করে ঘুমাতে চাই। কত রাত আমি ঘুমাই না তুই জানিস?’

‘মা তুমি শুয়ে থাক। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।’

‘তুই আমাকে ঘুম পাড়াবি, তুই?’

জাহানারা উঠে বসলেন। হড়হড় করে বিছানা ভাসিয়ে বমি করলেন। নবনী ভয় পেয়ে ডাকল—‘মিলু বুয়া! মিলু বুয়া!’

জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, ‘ওকে এখন ডাকিস না। আমার কথা শেষ হোক, তারপর ডাকবি। শোন নবনী, ঐ মিলুর বাচ্চা কাচ্চা কেন হয় না জানিস? এগার বছর হল বিয়ে হয়েছে। কোনো ছেলেপুলে নেই। হবেও না কোনো দিন। কেন তুই শোন।’

‘মা প্লিজ!’

‘খবরদার প্লিজ বলবি না। খবরদার বললাম, আমার কথা শেষ করতে দে। মিলুর যখন সতের বছর বয়স তখন ওর পেটে বাচ্চা এসে গেল। তোর অতি ব্যস্ত বাবা নিজে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। বাচ্চা নষ্ট হল। তোর বাবার বুদ্ধি তো খুব বেশি। কাজেই বুদ্ধি করে লাইগেশনও করিয়ে আনল। এতে খুব সুবিধা—ছেলেপুলে হবার ভয় নেই। যন্ত্রণা নেই। বুঝতে পারছিস কিছু? কাল রাতের কথা শুনবি? কাছে আয়, কানে কানে বলি। মিলু আমার মাথা টিপে দিচ্ছিল। তোর বাবা তাকে আমার ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গেল। কোনো রকম লজ্জা নেই, কোনো সংকোচ নেই। স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এই স্বাভাবিক ব্যাপার রাতের পর রাত, বছর পর বছরের চলছে। আমরা যখন বাইরে কোথাও যাই, মিলুকে সঙ্গে নিতে হয়। নবনী, আমার কথা বুঝতে পারছিস রে বোকা মেয়ে?’

জাহানারা আবারো হড়হড় করে বমি করলেন। নবনী ফিসফিস করে বলল, ‘মা তুমি অসুস্থ।’

জাহানারা বললেন, ‘হ্যাঁ আমি অসুস্থ। বাকি সবাই সুস্থ। তোর বাবা সুস্থ, তুই সুস্থ, শ্রাবণী সুস্থ। শুধু আমি বাদ পড়ে আছি। শুধু আমি। আমার চিকিৎসা দরকার। আমার খুব ভালো চিকিৎসা দরকার।’

‘মা প্লিজ!’

‘খবরদার, আমার কাছে আসবি না। যা দরজা খোল। তোর বাবাকে ডেকে আন, পুলিশ দুটাকে ডেকে আন। আনসারদের ডেকে আন। চেয়ারম্যান সুরুজ মিয়াকে আন। যে যেখানে আছে সবাইকে ডাক। আমি সবাইকে বলব। জনে জনে ডেকে বলব। তারপর ঘুমাব। আরাম করে ঘুমাব। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু আমি ঘুমাতে পারি না।’

দরজায় শব্দ হচ্ছে। মিলু ক্ষীণ গলায় ডাকল–‘আম্মা দরজা খুলেন। কী হইছে আম্মা?’

জাহানারা চাপা গলায় বললেন, ‘মেয়েটা আমারে আম্মা ডাকে। মিষ্টি করে আম্মা ডাকে। দরজা খুলে দে নবনী। আমার মেয়ের জন্যে দরজা খুলে দে।’

নবনী দরজা খুলে বের হয়ে এল। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। নবনীর পেছনে পেছনে জাহানারা বের হয়ে এলেন। উঁচু গলায় বললেন–‘তোমরা সবাই কোথায় –আমার কথা শুনে যাও। আস সবাই। আস। খুবই মজার গল্প। হি-হি-হি।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *