তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে – ১০

১০

স্পিডবোটের মেশিন বিকল হয়েছে।

স্টার্ট দিলে ভট্ ভট্ শব্দ ঠিকই হয়, প্রপেলার ঘোরে না। সুরুজ মিয়া বললেন, ‘এ তো বড়ই যন্ত্রণা হল!’ স্পিডবোটের চালক প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার গা বেয়ে ঘাম পড়ছে। কোনো কাজ হচ্ছে না। তারা মাঝনদীতে থেমে আছে। অল্প বাতাস আছে। নৌকা দুলছে। শ্রাবণী বলল, ‘আমার তো এই অবস্থাটা ভালো লাগছে। ভট্ ভট্ শব্দে মাথা ধরে গিয়েছিল। চেয়ারম্যান চাচা!’

‘জ্বি আম্মা।’

‘আপনি এক কাজ করুন। আমাদের দুজনকে নামিয়ে দিন। আমরা চায়ের ফ্লাস্ক, খাবারদাবার নিয়ে এখানেই নেমে যাই। আপনারা দেখুন কিছু করতে পারেন কিনা। করতে না পারলেও ক্ষতি নেই। শাহেদ ভাই, স্পিডবোট চালু না হলে আপনার কোনো সমস্যা আছে?’

‘কোনো সমস্যা নেই।’

সবুজ মিয়া বললেন, ‘ফিরতে খুব সমস্যা হবে আম্মা। বেজায় সমস্যা— ফিরতে হবে উজানে।’

শাহেদ বলল, ‘ফেরার সময় আসুক, তখন দেখা যাবে।’

তারা নেমে পড়ল। শ্রাবণী বলল, ‘চলুন শাহেদ ভাই, আমরা কোনো একটা গাছের নিচে বসি। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে সুন্দর একটা গাছ খুঁজে বের করা। আপনি ক্যামেরা এনেছেন না?’

‘এনেছি।’

‘তাহলে চুপচাপ বসে আছেন কেন? ছবি তুলুন। ইস, আমার দারুণ লাগছে।’

‘তোমার পায়ের ব্যথা কি সেরে গেছে?’

‘সারে নি, এখনো ব্যথা নিয়েই হাঁটছি। আর আপনি এমনই মানুষ যে একবার ভদ্রতা করেও বলেন নি—শ্রাবণী, আমার হাত ধরে ধরে হাঁট। নাকি আপনি চান না আমি আপনার হাত ধরি?’

শাহেদ বলল, কষ্ট করার কোনো দরকার নেই। আমার হাত ধর।’

‘এটা বলতে গিয়ে আপনার গলা কিন্তু কেঁপে গেছে শাহেদ ভাই।’

‘গলা কাঁপবে কেন?

শ্রাবণী খিলখিল করে হাসছে।

শাহেদ বলল, ‘দেখি আমার হাত ধর তো।’

শ্রাবণী বলল, ‘কেউ আবার কিছু মনে করবে না তো? আমাদের স্পিডবোটের চালককে দেখুন—কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে।’

‘তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।’

শাহেদ বলল, ‘তোমাকে এত খুশি লাগছে কেন?’

‘জানি না কেন। জ্বর আছে বলেই হয়তো। গায়ে জ্বর থাকলে আমার খুব ফূর্তি লাগে।’

‘তুমি অদ্ভুত মেয়ে।’

শ্রাবণী শাহেদের হাত ধরল। শাহেদ বলল, ‘তোমার হাত এমন গরম কেন?’

‘জ্বর এসেছে, এই জন্যে গরম। শাহেদ ভাই, আপনি কি জানেন যে আমার মধ্যে ভালুক-স্বভাব খুবই প্রবল।

‘সেটা আবার কী?’

‘ভালুকদের ঝপ করে জ্বর আসে। আবার ঝপ করে চলে যায়। আমার এখন জ্বর এসেছে। আবার চলেও যাবে।

তারা একটা শিমুল গাছের কাছে এসে দাঁড়াল। শ্রাবণী বলল, ‘এই গাছটা আমার পছন্দ হয়েছে। আসুন, এই গাছের নিচে বসে চা খাওয়া যাক।’

শাহেদ বলল, ‘গাছটা কাঁটায় ভর্তি।’

শ্রাবণী বলল, ‘কাঁটা ভর্তি গাছই আমার ভালো লাগে। গোলাপ গাছও কাঁটা ভর্তি, শাহেদ ভাই!’

‘হুঁ।’

‘আপনি কি আপাকে বিয়ের ব্যাপারে সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন?’

‘কেন বল তো?’

‘এমনি জিজ্ঞেস করছি।’

শাহেদ চুপ করে রইল। শ্রাবণী বলল, ‘সব ঠিকঠাক করে ফেললে ভিন্ন কথা। ঠিকঠাক করে না ফেললে নিজেকে ভালো করে জিজ্ঞেস করুন— আপার জন্যে আপনি কতখানি ভালবাসা আলাদা করে রেখেছেন?’

শাহেদ বলল, ‘ঐ প্রসঙ্গ থাক।’

‘ঐ প্রসঙ্গ থাকবে কেন? আপনার কি মনে হয় না ঐ প্রসঙ্গটা খুব জরুরি।’

‘আজ থাক। অন্য সময় আলাপ করব। আজ হৈচৈ করতে এসেছি। চল হৈচৈ করি।’

শ্রাবণী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আপাকে ফেলে এসে আপনি যে আমার সঙ্গে হৈচৈ করছেন, আপনার খারাপ লাগছে না?’

‘আচ্ছা শ্রাবণী, তুমি কী শুরু করেছ বল তো! চা দাও। চা খাই।’

শ্রাবণী বলল, ‘আসুন, গান শুনতে শুনতে চা খাই।’

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তুমি গান গাইবে? গান জান তুমি?’

‘মোটামুটি জানি, তবে না জানার মতোই। দরজা বন্ধ করে যখন গান গাই তখন মনে হয়—ভালোই তো হচ্ছে—খোলামাঠে গান কেমন লাগবে জানি না। রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। আমি কাঁধের ঝোলায় একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসেছি। আপনার কি ধরনের গান পছন্দ? রবীন্দ্রসংগীত না ধুম-ধাড়াক্কা। আমার কাছে সবই আছে।’

শ্রাবণী গান দিয়ে দিল। অরুন্ধতী হোমের গলায় অপূর্ব গান—

ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না—
ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে
একি খেলা মোরা খেলেছি, শুধু নয়নের জল ফেলেছি—

.

শাহেদ অবাক হয়ে দেখল, শ্রাবণীর চোখ ভিজে উঠেছে। সে অবাক হয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে রইল। কী অপূর্ব লাগছে এই শ্যামলা মেয়েটিকে!

শ্রাবণীর চোখ দিয়ে টপ্‌ টপ্ করে পানি পড়ছে। সে অশ্রুজল লুকানোর কোনো চেষ্টা করছে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *