তীরে এসে তরি ডুবল
অফিসেও সকলে জিজ্ঞাসা করছে রিম্পাকে, পিকু আর সুমনের কথা৷ খবরের কাগজে বেরিয়েছে খবরটা৷ আর জানতে বাদ নেই কারো৷ আজ মীনাক্ষীদি আমতা আমতা করে বলেই ফেলল, ‘রিম্পা, সুমনের জামিন পেয়েছ? আর ছেলেটাকেও কি জেলে রেখেছে?’ রিম্পার সব রাগ গিয়ে পড়ছে ওই ছেলের ওপরে৷ এত অবাধ্য ছেলে কেন যে হল৷ পিকু যে কেন ওই জিনিস নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে গেল, কে জানে৷ এত বারণ করা সত্ত্বেও কোনো কথা শোনে না ছেলেটা৷ ভালো হয়েছে, জয়ন্ত খুন হয়েছে৷ না হলে হয়তো চাপের মুখে পিকুকেই ফাঁসিয়ে দিত৷ সুমন বাড়ি এসে কী বলবে, সেটা ভেবেই ভয় করছে রিম্পার৷ রগচটা লোক৷ এমনিতে শান্ত স্বভাবের হলে কী হবে, রাগলে যেন চণ্ডাল৷ পুলিশের বড়োকর্তার গাড়ি চালায়, পুলিশের সঙ্গে সব অপারেশনে যায় বলে বেশ গর্ব করত সুমন৷ তাকে যে লকআপে কাটাতে হবে, ভাবতেই পারেনি ও৷ সব রাগ উগরে দেবে রিম্পার ওপরে৷ কেন সে ছেলের খোঁজ রাখেনি—এটাই মূল কারণ হবে বকার৷ দুজনের ইনকামে সংসারটা চলে যায় ঠিকই, কিন্তু বিয়ের পর থেকে শখপূরণের দু-পয়সা তো দিতে পারেনি সুমন৷ এতদিন পর্যন্ত তো নিজের মায়ের খরচ একাই চালাত৷ এই বছরখানেক রিম্পার দেওর গাড়ি চালানোর কাজটা পেল বলে মায়ের খরচ কিছুটা দিতে পারছে৷ রিম্পার কত শখ ছিল, ছাদে উঠে বিকেলের হাওয়ায় ঘুরবে৷ একটা ছোট হলেও ছাদের স্বপ্ন দেখতো ও৷ বাপের বাড়িতে টিনের চালের বাড়ি ছিল, তাই বন্ধুদের ছাদে গিয়ে স্বাদ পূরণ করতে হয়েছিল৷ সুমনের ঢালাই বাড়িতে ঢুকেই তাই ভেবেছিল, ছাদে ঘুরতে পারবে৷ সেগুড়ে বালি৷ ন্যাড়া ছাদ একটা থাকলেও সিঁড়ি নেই৷ এত বছরে সে আশা পূরণ হয়নি রিম্পার৷ আশা কর্মী হিসাবে জয়েন করেছে বছর দুয়েক হল, তার আগে তো আরও অবস্থা খারাপ ছিল৷ এসব বলতে গেলে শুনতেই চায় না সুমন৷ ভেবেছিল, কিছু কিছু করে জমিয়ে সিঁড়ি করবে, দোতলায় একটা ঘর করবে৷ জমিয়েওছে কিছু৷ কিন্তু সুমনকে তার বড্ড ভয়৷ টাকা কোথায় পেলে বলে যে অশান্তি করবে, সেটা আর বলার নয়৷ এ দু-দিন কিছুই রান্না করেনি সেভাবে৷ খাওয়ার লোক দুটোই বাইরে থাকলে আর কি রাঁধতে ইচ্ছে করে? হাতের কাজগুলো চটপট সারছিল রিম্পা৷ ইদানীং সন্ধের দিকে বেরোতে বেশ ভয় করছে ওর৷ জয়ন্ত খুন হবার পর থেকেই গা ছমছম করছে৷ চোখের সামনে যেন ভাসছে দৃশ্যটা৷ তাই হাতের কাজ সেরে বিকেল বিকেল বেরিয়ে বাইরের কাজগুলো সেরে আসবে রিম্পা৷ রিম্পার বাড়ির পাশের প্রতিবেশীরাই আসল শত্রু, ওর ঘরের কথা বলে বেরিয়েই যেন আনন্দ৷ ফোনটা ভালো করে ক্লিন করার পরেও কেমন একটা ভয়-ভয় করছে রিম্পার৷ কেউ দেখেনি তো! ওর ভাবনার মাঝেই দেখতে পেল, লগ্নজিতাম্যাডামের গাড়িটা এসে দাঁড়াল বিজয়দের বাড়ির সামনে৷ তড়িঘড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেল রিম্পা৷ জানালা দিয়ে দেখল, বিজয়দের বাড়িতেই ঢুকল ম্যাডাম৷ বিজয়ের ওই হিংসুটে বউটা যে ওর সম্পর্কে ভালো কথা বলবে না, সেটা রিম্পা ভালোই জানে৷ কিন্তু কিছু করারও নেই৷
লগ্নজিতা পরিষ্কার দেখল, ওকে দেখে রিম্পা এগিয়ে না এসে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে গেল৷ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়েই বিজয়ের বাড়িতে ঢুকল৷ বিজয়ের একটা সাইকেলের গ্যারেজ আছে পাড়ার মোড়ে৷ তাই পাড়ার সব খবর ওর নখদর্পণে৷ গ্যারেজ বন্ধ করে দুপুরে খেতে এসেছে বাড়িতে৷ পুলিশ দেখে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রথমে৷ তারপর বলল, ‘বসুন অফিসার৷ জয়ন্ত খুনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন তো? শুনুন অফিসার, এ পাড়ায় আরও গোটা চারেক খুন হবে খুব তাড়াতাড়ি এ আমি বলে দিলাম৷’
সুশোভন বলল, ‘কী করে বুঝলেন?’
বিজয় রাগত স্বরে বলল, এসব কাঁচা টাকার ব্যাবসা করবে দিয়ে বহুদিন বাঁচবে তা-ই হয়? মরবে মরবে, সব ক-টা মরবে৷ এই যেমন জয়ন্ত মরল, তেমনি উৎপল মরবে, রাঘব মরবে, জলধরস্যার মরবে, তপনদা মরবে, রিম্পাবউদি মরবে৷ বিজয় সব দেখে শুধু, বলে না কিছুই৷ টাকার লোভ বড়ো লোভ৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এদের সকলের সঙ্গেই কি জয়ন্তর যোগাযোগ ছিল?’
বিজয় হেসে বলল, জয়ন্ত খুন হয়েছে বলেই ও অপরাধী আর এরা সব তুলসীপাতা এমন নয়৷ ওর দোকানটা ডেরা ছিল ঠিকই, কিন্তু এরা সব একেকটি জিনিস৷ সবাই মিথ্যে বলছে৷ সবাই বলছে৷ জলধরস্যার সব জানে, স্কুলের ছাত্ররা রোজ ওই স্কুলে গিয়ে নেশার জিনিস খাচ্ছে, ও জানে না বললে চলবে? পনেরোই আগস্ট পতাকা তুলেই ভাষণ দেয়, আমি মানুষ গড়ার কারিগর৷ হাতির মাথা কারিগর৷ শুধু বদবুদ্ধি দেয়৷ একমাত্র ছেলে মারা যাবার পরেও লোকটার কোনো শোক নেই, জানেন ম্যাডাম৷ কী পিশাচ দেখুন৷ তারপরেও টাকা টাকা করে গেল লোকটা৷ আর ভাইপোটাও হয়েছে আরেক রকবাজ৷ আরে আমরা গরিব ঘরের মানুষ৷ বাপ খেতে পেত না তো পড়াবে কী? তোদের সব এত সুযোগ থাকতেও লেখাপড়া না শিখে বাজে কাজ করিস? ওই তো দত্তদের মেয়েটাকে লাইন মারে৷ দত্তদার পয়সা আছে, এক মেয়ে৷ ব্যস, কার্তিক মার্কা চেহারা নিয়ে পিছনে পড়ে গেল৷
লগ্নজিতা বলল, ‘সুশোভন, ঋতিকারা গোস্বামী৷ নোট প্যাড খুলে মেলানোর কিছু নেই৷ এটা এ পাড়ার কোনো দত্ত৷’
বিজয় একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে, ‘আর আমাদের পাশে এই হয়েছে এক ঢলানি মেয়েছেলে৷ কেন রে, অমন ভালো স্বামী, সে ঘরে থাকতে একবার জয়ন্ত, একবার তপনদা— এদের গল্প শেষ হয় না৷ তপনদা তো মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসে৷ স্কুল ছুটি থাকলে ব্যাটা এখানে এসে রোদ পোহায়৷ আর রিম্পাবউদির পিরিত কত৷ সুমনদা তো চোখ থাকতেও অন্ধ৷ আর কী বলব বলুন৷ রিম্পাবউদি সব জানত৷ ছেলে তো শুধু চকোলেট বিক্রি করত পঞ্চাশ টাকায়, আর বউদি কী করে, জানেন? পাড়ার অল্পবয়েসি সুন্দরী মেয়েদের মডেল করবে বলে কোথায় যেন পাঠায়৷ তারা রোজ সকালে সেজেগুজে বেরিয়ে যায়, ফেরে সেই মাঝরাতে৷ কোথায় যায়, কে জানে! মেয়েগুলোর সাজপোশাক, চুল-টুল বদলে যায়৷
বিজয়ের বউ বলল, অন্ধকার স্টুডিয়োতে ছবি তোলা হয় মেয়েদের৷ নেশার জিনিস খাইয়ে দিয়ে এসব করে৷ আমি ওই উত্তরাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছিলাম তোরা কী কাজ করিস রে যে এত টাকা পাস৷ তখন ও বলেছিল, কোনো খারাপ কাজ করতে হয় না৷ শুধু ছবি তুলতে হয়, ভিডিও করতে হয়৷ ওরা সুন্দর সুন্দর ড্রেস দেয় সেগুলো পরে৷ ড্রেস না মাথা, পোশাক না পরে ছবি তুলে আসে৷ সুশোভন বলল, ম্যাডাম কলকাতাতেও মনে হচ্ছে নীল ছবির শুটিং চলছে পুরোদমে৷ মাঝখান থেকে ফাঁসে রাজ কুন্দ্রা৷
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনাকে অফার করেনি কোনোদিন?’
বিজয়ের স্ত্রী বলল, সেই থেকেই তো ঝামেলা আমার রিম্পার সঙ্গে৷ বলেছিল, নিজে দু হাতে রোজগার করবি, চিন্তা কীসের? দুটো ছবি তুলবি, কাজ শেষ৷ থোড়ি লোকের বিছানায় যাচ্ছিস? সুমনদার সঙ্গেও তো রোজ ঝগড়া লাগে৷ নেহাত সুমনদা মানুষটা শান্ত প্রকৃতির তাই সেভাবে কিছু বলে না৷
বিজয় বলল, ‘ম্যাডাম, ওই তপন মহান্তির বাউল বাউল ভণ্ডামিতে একদম পাত্তা দেবেন না৷ একখানা জিনিস লোকটা৷ ওই স্কুলের আরও দুজন আছে৷ একজন হচ্ছেন বলাকা ম্যাডাম আরেকজন অগ্নিভস্যার৷ বাচ্চাদের গান-নাটক শেখানোর নাম করে কী শেখায় কে জানে৷ ওই স্কুলের বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথাতে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না, ম্যাডাম৷ জলধরস্যারের পেয়ারের লোক বলাকাম্যাম আর অগ্নিভস্যার৷ বাকিরা তো ভয়েই চুপ করে থাকে৷ স্কুলের ভিতরের রাজনীতি জানতে আমার বাদ নেই৷ ওই স্কুলে সরকার থেকে যত সাইকেল দেওয়া হয় সব প্রথমে আসে আমার কাছে৷ হেডস্যারকে খুব ভালো করে চিনি৷ নামও চাই, পয়সাও চাই৷ চরিত্রহীন মাস্টার৷ ও জানত না, পিকু এসব করে— এটা আমি বিশ্বাস করি না৷ জলধরবাবুও জানত আর রিম্পা বউদিও জানত৷ সব মরবে৷ জয়ন্তটা বোকা তাই আগে মরল৷ কে গাড়ি চাপা দিল তোর প্রাণের বন্ধু উৎপল৷ দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বসে চা না খেলে এদের চলত না৷ টাকা বড়ো গোলমেলে জিনিস৷ জয়ন্তর বউটা নাকি কোন হসপিটালে ভরতি আছে৷ সব মিথ্যে কথা৷ কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, কে জানে!’ বিজয় বলল, ‘শুনুন ম্যাডাম, একটা কথা বলি, জয়ন্ত মানুষটা প্রথমে খারাপ ছিল না৷ চিনতাম তো বহু আগে থেকে৷ বিয়ে হবার পর থেকেই শুরু হল এসব সমস্যা৷ সাধারণ ঘরে অত সুন্দরী বউ নিয়ে হবেটা কী? সিনেমা তো করবে না৷
লগ্নজিতা বলল, ‘বিজয়, আমরা এখন আসছি৷ তুমি একটু চোখ-কান খোলা রেখো৷ কিছু অন্যরকম দেখলেই এই যে আমার ফোন নম্বর, কল করে দেবে৷ আর শোনো, এই টাকাটা রাখো৷ পুলিশের সঙ্গে থাকার জন্য এটা তোমার পুরস্কার৷
বিজয় হেসে বলল, ‘ম্যাডাম আমি কিছু দেখলেই জানাব আপনাকে৷’
সুশোভন বাইরে বেরিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, এই সুমনদার স্ত্রী তার মানে ঘোরালো আছে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘সে তো আছে৷ কিন্তু চলো, তার বক্তব্যটা একবার শুনে আসি৷’
সুমনের বাড়ির সামনে এসে দেখল, ঘরে তালা ঝুলছে৷ সুশোভন বলল, ম্যাডাম, পালাল নাকি?
লগ্নজিতা হেসে বলল, আপাতত৷ চলো, স্কুল তো ছুটি৷ নাহলে বিজয়ের কথামতো বলাকা আর অগ্নিভর সঙ্গেও একটু গল্প করে আসা যেত, বুঝলে৷ যা-ই হোক চলো, আপাতত উৎপলের মামাবাড়িতে একটু চা খেয়ে আসি৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ছেলেটা কিন্তু মারাত্মক মিথ্যাবাদী৷ কী লেভেলের মিথ্যে বলে ঋতিকাকে ফাঁসিয়েছে, ভাবলেই অবাক লাগছে৷ ঋতিকাকে সত্যিটা বলা উচিত ছিল, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা সিটবেল্টটা বেঁধে বলল, ‘সুশোভন, তোমরা কয় ভাই?’
সুশোভন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি একা, ম্যাডাম৷ ভাইবোন কেউ নেই৷ কেন বলছেন?’
লগ্নজিতা গাড়িটা স্টার্ট করে বলল, গুগলে ম্যাপ চালু করো৷ না মানে ঋতিকা আর উৎপলের ব্রেকআপ চাইছ তো, তাই ভাবছি, তোমার ভাইয়ের বউ করে নিয়ে যেতে চাইছ হয়তো৷’ সুশোভন বিরক্ত হয়ে জানালার দিকে তাকাল৷ ম্যাডামের এই এক দোষ৷ গুরুত্বপূর্ণ সময়েও এসব মজা করা৷
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘আরে চটছ কেন? এদের প্রেমপর্বের এমনিই ইতি ঘটবে, চিন্তা কোরো না৷ এমন বখাটে টাইপ ছেলের সঙ্গে ওই কালচার্ড ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হয় না রে বাবা৷’ সুশোভন বলল, ‘টাইটানিক সিনেমায় হয়েছিল৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘বিয়েটা হয়নি কিন্তু, ছেলেটা ডুবেছিল৷ প্রেমটা হয়েছিল মাত্র৷ এনিওয়ে, ওর লাভলাইফের লাস্টিং ডেট নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার দরকার নেই৷ আমাদের একটাই লক্ষ্য, জয়ন্তকে কে খুন করল? এই ড্রাগস কীর্তির পিছনে কে কে ছিল? এরা কি একটা টিম হয়ে কাজ করত? এদের হেড কে? কারণ এই চুনোপুঁটিরা এমন একটা চক্র চালাত এটা আমি বিশ্বাস করি না৷ এরা জাস্ট পদাতিক সৈন্য ছিল৷ সেনাপতি কে ছিল, মাস্টাব মাইন্ডটাকে খুঁজে বের করতে হবে৷ তাই এদের ব্রেকআপ নিয়ে ভেবে লাভ নেই৷ উৎপলটাকে তোলাই যায়, কী বলো? জয়ন্তকে যে লরিটা ধাক্কা দিয়েছে, সেটা উৎপলের লরি এটুকু প্রমাণই যথেষ্ট৷ কান টানলে জলধরের সক্রেটিস কপচানো বেরিয়ে যাবে৷ গুরু বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল বলে শিষ্য জলধর তার স্টুডেন্টদেরও বিষ খাওয়াতে সাহায্য করছে৷ এইটুকুটুকু ছেলেরা ড্রাগ অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ছে, সুশোভন৷ এটা একটা বড়ো ক্রাইম৷ উনি কিছু জানতেন না বললে চলবে কেন? স্কুলের সুনাম বজায় রাখার এটা উপায়? লোকটার জ্ঞান দেওয়ার টেকনিক আর ওই নিরীহ সৎ টাইপের ভাবভঙ্গি দেখে আমার জাস্ট অসহ্য লাগছিল৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, চায়ের দোকানদারটাও বলল, ওটা উৎপলের লরি ছিল৷ আর রাঘবের কেসটা কী? এ আগ বাড়িয়ে এসে খবর দিতে চাইছে কেন? এ নিজেও তো এসবের সঙ্গে যুক্ত৷ তাহলে?
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরশুম৷ বুঝলে সুশোভন৷ প্রেমে দাগা পেলে শত্রু হতে কতক্ষণ৷ রাঘবের গার্লফ্রেন্ডকে উৎপল ভাগিয়ে নিয়েছিল৷ সে এখন উৎপলের এক্স অবশ্য৷ সেই থেকেই সামনে বন্ধুত্ব রাখলেও ভিতরে বিজবিজে রাগটা রয়ে গেছে৷ এদিকে তেমন কিছু করতেও পারছে না, কারণ স্কুলের অনুষ্ঠানের যাবতীয় ক্যাটারিং রাঘব পায় জলধরবাবুর মাধ্যমে৷ তাই ভাইপোকে কিছু করলে জেঠু চটবে৷ টাকা বড়ো বালাই৷ সুতরাং ওপরে বন্ধুত্ব থাকলেও রাঘব সুযোগ খোঁজে৷ জয়ন্ত ছিল রাঘবের বেশি ঘনিষ্ঠ৷ তারপর জয়ন্ত আচমকাই উৎপলকে বেশি ভরসা করতে শুরু করল, সুতরাং জয়ন্তর ওপরে ওর রাগ বাড়ল৷ কারণ বিজয়ের কথা মতো রাঘব আগে রেগুলার এদের আড্ডায় এলেও ইদানীং খুব কম আসছে৷ উৎপল আর জয়ন্ত রেগুলার বসত৷ দলে ভাঙন ধরেছিল৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, তাহলে রাঘব জয়ন্তকে মারবে উৎপল কেন? এ লজিক তো মেলে না৷
লগ্নজিতা বলল, ‘আরেকটা গল্প তৈরি হয়েছে, সুশোভন৷ রিসেন্ট একটা বেশ বড়ো কাজ রাঘব পেয়েছে জয়ন্তর দ্বারা৷ সেটা নিয়ে উৎপল একটু থ্রেটও করেছিল জয়ন্তকে৷ স্কুলের সিকিউরিটি বলল, জয়ন্ত আর উৎপলের মধ্যে তর্কাতর্কিতে রাঘবের নামটা বার বার আসছিল৷ গল্পের ভিতরে গল্প আছে৷
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম জয়ন্তর বউটাকে খুঁজে কেন পাওয়া যাচ্ছে না বলুন তো? একটা ছেলে বিয়ে করল, বউ এই পাড়ায় বছর দুয়েক থাকল, তারপরে যদি চলেও গিয়ে থাকে তাহলেও কেউ তার খবর জানবে না, এটা কেমন গোলমেলে ঠেকছে৷ মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে কেউ বলতে চাইছে না৷ জয়ন্তর বউয়ের কথা বললেই ওই অনীতাও কেমন চুপ করে থাকছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘একটা জিনিস কিন্তু ক্লিয়ার, ওই জয়ন্তর বউটা এই অঞ্চলের বিষয়টা অপারেট করত৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওর বউই ওকে খুন করিয়ে দেয়নি তো?’
লগ্নজিতা বলল, ‘না-দেওয়ার তো কিছু নেই৷ পিনাক মণ্ডল ধরা পড়ার পরে জয়ন্তর দোকানটাই টার্গেট হবেত্ত এটা তো অজানা নয়৷ জয়ন্তকে ধরা গেলে ড্রাগসের হদিশও পাওয়া যেত৷ দোকানে অথবা বাড়িতে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত৷ তাহলে বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যেত৷ এখনও অবধি পিকুর ওই একটা লজেন্স ছাড়া হাতে কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি, সুশোভন৷ তার কারণ জয়ন্তর খুন হয়ে যাওয়া৷ তাই জয়ন্তকে বাঁচিয়ে রাখলে অনেকেই আমাদের নাগালে চলে আসত৷
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ডানদিকে৷ উৎপলের বড়োমামার বাড়ির বেলটা যখন বাজল তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দুটো৷
লগ্নজিতা বলল, সুশোভন গৃহস্থের বাড়িতে তো আমাদের খেতে দেবে না, দেখো তো কাছেপিঠে কী রেস্টুরেন্ট আছে৷ বেরিয়ে একটু চাইনিজ খাব আজ৷
দরজা খুলল একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক৷ এর ছবিই ঋতিকা ফেসবুকে দেখিয়ে বলেছিল, এটা উৎপলের বড়োমামা৷ না, ভদ্রলোক একেবারেই এডিটিং অ্যাপ ব্যবহার করেন না৷ ফেসবুক প্রোফাইলে যেমন দেখতে লাগছিল, সামনেও তা-ই৷ দুপুরবেলা বাড়িতে দুজন অপরিচিত লোক দেখে একটু অবাক হয়েই বললেন, আপনারা?
সুশোভন বলল, ‘আমি উৎপলের বন্ধু, মামা, ও আছে?’ মামার চোখে তখনও বিস্ময়-মাখানো অবিশ্বাসী দৃষ্টি৷ সুশোভন ল্যাংটোবেলার বন্ধুর মতো একটু বেশিই আপন হয়ে বলল, বদমাশটা কি আমায় ডেকে এখন নিজেই বেপাত্তা হল নাকি?
মামা এতক্ষণে একটু নিশ্চিন্ত হলেন যেন৷ ভাগনা নিজেই ডেকেছে বন্ধুকে বলেই হয়তো আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, ‘আরে না না, কোথাও যায়নি, এই তো লাঞ্চ করে শুয়ে আছে৷ আসলে ও কদিনের জন্য এখানে আছে, তার কারণ বাড়িতে বসে কাজে কনসেনট্রেইট করতে পারছে না৷ ওর জেঠু, জেঠিমা বড়ো জ্বালাচ্ছে৷ তাই বাড়িতে কাউকে জানায়ওনি তেমনভাবে৷ এসো তোমরা, ভিতরে বোসো, ওকে ডেকে দিচ্ছি৷
সুশোভন আর লগ্নজিতা ভিতরে ঢোকার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল উৎপল৷ ওর মামা বললেন, ‘তোরা কথা বল৷’ উৎপলের চোখে বিস্ময়৷
লগ্নজিতা হেসে বলল, এই মামারই এখন-তখন অবস্থা তা-ই না উৎপল? হাসপাতালে রাত জাগতে হচ্ছে এঁর জন্যই তো৷
উৎপল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাতে আপনাদের কী? কে আপনারা? এখানে কেন এসেছেন?’
সুশোভন বলল, ‘একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করা যার স্বভাব, তার নিশ্চয়ই একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ারও স্বভাব আছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘জয়ন্তকে খুন করলে কেন?’
উৎপলের মুখ মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেল৷ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল, ‘কে আপনারা? আমি কাউকে খুন করিনি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সুশোভন, উনি মনে হয়, নিজের গাড়ির নম্বর ভুলে গেছেন, অথবা নিজের লরির খালাসিকেও চেনেন না৷ ওকে একটু মিষ্টি করে বুঝিয়ে বলো, ওর খালাসি স্বীকার করেছে, জয়ন্তকে ওদের লরিই ধাক্কা দিয়েছে৷ সুতরাং এখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং চলবে না৷
উৎপল পায়ে জুতো দুটো গলিয়ে মামার উদ্দেশে বলল, ‘মামা আমি একটু আসছি৷’ মামা ভিতর থেকে কিছু একটা বলল সেটা শোনা গেল না৷ উৎপল বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘দেখুন, আমি জয়ন্তদাকে মারিনি৷ আমি কেন মারব বলুন তো? জয়ন্তদা কি আমার কোনো ক্ষতি করেছিল? লোকটাকে আমি চিনি না, সারাদিন লরি পড়ে ছিল স্কুলের সামনে যেখানে থাকে৷ এই লোকটা মোটা টাকা দিয়ে বলেছিল, আধা ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেবে তাই রাজি হয়েছিলাম৷ কী করে জানব বলুন এমন কীর্তি করতে পারে? শুভর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল৷ শুভ নিশ্চয়ই বলেছে আপনাদের বিষয়টা৷ আমরা কেউ জানতাম না লরি নিয়ে ছেলেটা ঠিক কোথায় যাচ্ছে৷ বলছিল, ইট না তুললে কাজ হবে না৷ ম্যাডাম, আমি সত্যিই জানি না এর বেশি কিছু৷ জয়ন্তদার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা ছিল না৷ শুধু শুধু একটা লোককে কেন মারব?
লগ্নজিতা বলল, ‘দরদাম নিয়ে একটা ঝগড়া তো জয়ন্ত মারা যাবার মাত্র তিন দিন আগেই আপনার সঙ্গে হয়েছিল৷ ব্লু হেভেনের ম্যানেজারের সঙ্গে কি দাম নিয়েই তো আপনার ঝামেলা হয়েছিল গত শুক্রবার? তারপরেই কি জয়ন্তকে বলেছিলেন, তুমি শুধু নিজের পেট ভরাবে বললে তো হবে না? ব্যাবসা সকলের, তাই সবার সুবিধে দেখতে হবে৷
উৎপল ধপ করে বসে পড়ল একটা ভাঙা বেঞ্চে৷ মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস করুন আমি কিছু জানি না৷’
সুশোভন বলল, জানার তো দরকার নেই৷ আমরা তো জানি৷ দোষ স্বীকার করতে তো বলা হয়নি, শুধু থানায় যেতে বলা হয়েছে৷ না গেলেও কোনো সমস্যা নেই, আমরাই ধরে নিয়ে যেতে পারি৷
উৎপল তীব্র আক্রোশে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘প্রমাণ ছাড়া এভাবে অ্যারেস্ট করতে পারেন না৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, সব পারি শুধু আষাঢ়ে গল্প দিতে পারি না৷ আমার লরিটা অন্য একজন নিয়ে গেল, তাকে আমি চিনি না আর সেই অচেনা ব্যক্তি মুহূর্তে একজনকে খুন করে দিল তারপরেও আমি থানায় এসে কমপ্লেইন্ট না লিখিয়ে চুপচাপ মামাবাড়িতে এসে গা-ঢাকা দিলাম তা-ই তো? এই টাইপের গল্প বলার সময় জিভকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন তো ওর লজ্জা করে কি না বলতে৷’ উৎপলকে গাড়িতে তুলে সোজা থানার লকআপে চালান করে লগ্নজিতা বলল, ‘এ বিশ্বাসদা মেয়েটা যদি কিছু না বলে তো লকআপে রাখো একরাত৷ আজ খুব টায়ার্ড৷’
অনীতা প্রায় ককিয়ে উঠে বলল, ‘ম্যাডাম আমি কিছু করিনি৷ সত্যিই আমি আর কিছু জানি না৷’
বিশ্বাসদা, যেটা বললাম, ওটা করুন৷