তিমির বিদার – ১০

১০

বিশু কাকার অ্যাটেন্ড্যান্ট ঝানুদা এই সময়ে এসে ডাকল— রুণু, এই রুণু! বোধহয় কয়েকবার ডেকেছে। আমি একেবারে অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়াভরা একটা গর্তে পড়ে যাচ্ছিলাম, শুনতে পাইনি।

—কী রে? পীরিত-টিরিত মচাচ্ছিস? না কি?

—অ্যাঁ? আমি একেবারে চমকে উঠেছি।

—তোকে বিশুদা ডাকছে।

আইব্বাস! বিশুদা আমাকে আউট অফ টার্ন ডাকছে! শালা! কপাল খুলে গেল মনে হচ্ছে!

ভেতরে ঢুকে দেখি ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা বিশুদা এগজিকিউটিভদের ঘুরন-চেয়ারে। বিশুদা বোধহয় এভরি-ডে একটা নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। এক্কেবারে আনকোরা নতুন। না হলে এত কড়কড়ে এত সাদা হওয়া সম্ভব নয়। অনেক রকমের নীল-ফিল আমি ব্যবহার করে দেখেছি— ও রকম হয় না। এ খাতে বিশুদার খরচ কত কে জানে? সে যতই হোক, পাবলিক দেবে। বিশুদা ওয়েটিং রুম দিয়েছে। পাবলিক ওকে পায়জামা-পাঞ্জাবিটুকু আর দিতে পারবে না?

বিশুদা বললে— আয় আয় রুণু। বোস। ওই পড়ো বাড়িটাতে এখনও পড়ে আছিস? —আমার মুখে কোনও দুঃখ কিংবা খোশামোদের বাক্য কেন যেন আসে না। বলি— এ-ই! একটু হাসি।

—তোকে একটা কাজ দিচ্ছি। দ্যাখ দিকি করতে পারিস কি না!

বুকের ভেতরটা লাফিয়ে ওঠে উড়ুক্কু মাছের মতো। কী কাজ? এল ডি সি না এইচ ডি সি? না কি আরও ভাল কিছু!

—বাইরে পতিতকাকাকে দেখলি?

—হ্যাঁ।

—কেমন দেখলি?

—ফ্রাষ্ট্রেটেড দেখাচ্ছিল।

—পাঁচ বছর রিটায়ার করে গেছে। পেনশন পাচ্ছে না। শালার সরকার যা এনেছিস না! পতিতকাকাকে দেখ, তোর নিজের ফ্রাসট্রেশন কমে যাবে। পাঁচ বছর পেনশন নেই। মানে রোজগার নেই। পঁয়ষট্টি বছর বয়স হল, সেটা সার্টিফিকেটে। কোন না আরও দু’চ্চার লুকিয়েছে মানে সত্তরের কাছে গেছে বয়স। নো রোজগার। হেঁটে-হেঁটে জুতো ক্ষয়ে গেল। আমি একটা চিঠি দিচ্ছি। তুই ওঁকে নিয়ে হুগলি ডি-আই অফিসে যা। একা পাঠাতে সাহস পাচ্ছি না, বুঝলি। কমজোর, হতাশ লোক। ট্রেনে অক্কা পেলে মুশকিল আছে। যাকগে তুই ওঁকে সঙ্গে করে হুগলি ডি-আই অফিসে নিয়ে যাবি। ডি-আইয়ের হাতে চিঠিটা দিবি। অন্য কারও হাতে দিবি না। কেষ্ট বলে একটা খচরা আছে, সেই কেস ঘুলোচ্ছে কাকার স্কুলের সঙ্গে যোগসাজশে। তার হাতে দিবি না। নতুন ডি আই লোকটা নিরপেক্ষ। যদ্দূর শুনছি। দ্যাখ দিকিনি গিয়ে!

যাব্বাবা! চাকরি ভেবে এসেছিলাম। জুটল বেগার? পতিতকাকার এমন অবস্থা যে ট্রেনে পটোল তুলতে পারে! মুশকিলটা তো তখন আমারই হবে। বিশুদা পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করল— এই নে তোর পথ খরচা। —তবু ভাল।

উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পা ঠুকে একটা মিলিটারি সেলাম ঠুকি। —জো হুকুম। বিশুদা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে হাসে, বলে— দ্যাটস লাইক এ গুড বয়।

পতিতকাকা বললেন— দিয়েচে? সত্যি বলচো রুণু, বিশু শেষ পর্যন্ত দিল? ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যে! তার ওপর তুমি সঙ্গে যাচ্চ। খুব একটা রিলিফ হচ্চে। ট্রেন ধরতে, ভিড় ঠেলতে, দাঁড়াতে যেন আর জোর পাচ্চি না। তোমার খুব অসুবিদে করে যাচ্চ না তো!

—না না। আমি তো বেকার বসে আছি।

একবার ভাবলাম পাতাল রেলে যাই। এসপ্লানেড থেকে হাওড়ার বাস ধরব। টার্মিনাস, বসতে পাওয়া যাবে। কিন্তু পতিতকাকাকে বলতে তিনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন— ওরে বাবা অত সিঁড়ি নামতে উঠতে বাবা আমি পারব না। শেষ পর্যন্ত রথতলার মিনিতে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটে অর্থাৎ বারোটা পাঁচে হাওড়া পৌঁছোই। কী ভাগ্য বর্ধমান লোক্যাল তখন দাঁড়িয়ে ছিল, কাকাকে দাঁড় করিয়ে দৌড়ে টিকিট কেটে আনি। একটা কামরায় যদি বা উঠে পড়েছি লাস্ট মিনিটে দেখি দুটো বেঞ্চি জুড়ে এক দল ছেলে তাস খেলছে। আচ্ছা তো! কাকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্রোতের মতো ঘামছেন।

বিবেচনার আশায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উত্ত্যক্ত হয়ে অবশেষে বলি— একটু সরে বসুন। বয়স্ক মানুষ দাঁড়াতে পারছেন না।

একজন বললেন— আচ্ছা রবিন, এতক্ষণ তোমার হাতে ইস্কাবনের সাহেব নিয়ে বসে আছ? নাও এখন ট্রাম্পড্‌ তো হয়ে যাবেই! তোমার মতো গর্দভের সঙ্গে বসা মানে…।

—আরে চটছ কেন— আর একজন বলল— রবিন নভিস এটা তো মানবে? একটু ধৈর্য ধরো। সবে তো রং চিনল!

আমি আর দ্বিতীয় কথা বলি না। ঠেসে এক জনকে সরিয়ে দিয়ে পতিতকাকার জন্যে জায়গা করে দিই। সসংকোচ সেখানে বসে রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে যাবেন, ঠেসা লোকটি ধাঁ করে ঘুরে বসে আমার দিকে কয়েকটা বারুদের গোলা ছুড়ে দিল। বেশি বয়সও নয়। আমার থেকে জোর বছর পাঁচেকের বড়।

—আস্পদ্দা তো কম নয়? তুমি কে হে বাহাদুর?

আমি বলি— তোমার যম। কে যেন আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো ঠেলে বার করে দিল।

—যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা। অন্য একজন মারমুখো হয়ে ওঠে। ঠেসা লোকটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে— তুমি? তুমি বলছ? যম?

আমি বলি— হ্যাঁ, তুমি ‘তুমি’ বললে আমাকেও বলতে হয়। আর ‘যম’টিও এগজ্যাজারেশন নয়। বিখ্যাত প্রোমোটার আর চাকলাদারকে চেনো? আমি তার চিফ সিকিওরিটি ম্যান। বিশ্বনাথ মল্লিককে চেনো, এম এল এ আমি তাঁরও মাসলম্যান। বেশি গড়বড় করলে… কথা শেষ করি না। তারপর বলি— আমার সঙ্গের ভদ্রলোক বয়স্ক অসুস্থ, ওঁকে বসতে দিতে হবে। ট্রেনটা তাস পেটবার জায়গা নয়। নিজেদের কোলের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে যত খুশি খেলো না, কে বারণ করেছে? অন্য লোকের জায়গা হাম্‌ করতে দোব না। সমস্ত কথাগুলোই বলি খুব শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে।

তাস পার্টির একজন মাঝবয়সি লোক বললেন— তুমি সেদিনের ছোকরা। আমাকে ‘তুমি’ করে বলছ।

—আপনারা ‘আপনি’ বললেই আমিও আপনি বলতে পারি। এই তো দেখুন, শুরু করে দিলাম।

গুম হয়ে চার বর্ধমান-যাত্রী তাস-টাস তুলে বসে রইল।

পতিতকাকা খুব ঘামছেন। আমি বলি— কিছু যদি মনে করেন—আপনাদের কারও কাছে খাবার জল আছে?

মাঝবয়সি ভদ্রলোক একটা প্লাস্টিকের বোতল বার করে দিলেন। আমি সামান্য একটু জল পতিতকাকার ঘাড়ে-মুখে ছিটিয়ে দিই, বলি—হাঁ করুন কাকা, একটু জল খান।

—আমার লাগবে না বাবা।…

—আপনি এখন আমার রেসপনসিবিলিটি কাকা, যা বলব শুনতে হবে। হাঁ করুন, দেখি। —খানিকটা জল খাইয়ে বোতলটা ফেরত দিই। মেনি মেনি থ্যাঙ্কস দাদা!

ভদ্রলোক একটু নড়েচড়ে বসেন। বোতলটা তখনও হাতে ধরা।—আপনি একটু খাবেন নাকি?

—আমি বলি, না, আমি চালিয়ে দিতে পারব।

—খান না।

—দরকার নেই। থ্যাঙ্কস।

হুগলি স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্ম হেঁটে রিকশা ধরেছি, পতিতকাকা বললেন, বাপরে। তুমি কি সত্যিই ওই চাকলাদার লোকটার সিকিওরিটিম্যান না কি? রুণু?

আমি হেসে বলি— যেমন বিশুদার মাসলম্যান তেমনি আর কী? কী জানেন কাকা, এই লোকগুলো আসলে কাওয়ার্ড। এদের ভয় দেখাতে হয়।

—আমি তো ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছি। ট্রেনে কলার ধরে তোমাকে দু’ঘা দিলে তো…

—আরে গতস্য শোচনা নাস্তি। কাকা, যা হয়ে গেছে বা যা হতে পারত হয়নি— তা নিয়ে বৃথা ভাববেন না।

ঠুনঠুন রিকশা চলেছে, পতিতকাকা বললেন— বেশ বলেছ বাবা, ‘যা হতে পারত হয়নি’ ‘বৃথা ভাবনা’ বেশ বলেছ! দেখো তুমি সাকসেসফুল হবে।

—আপনার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক কাকা। এখন যে কাজে চলেছি সে কাজে আগে সাকসেসফুল হই!

—আশা খুবই কম রুণু। পাঁচ বছর হয়ে গেল। স্কুলের সব্বাই পেয়ে গেছে, আমার পরে হেডমাস্টারমশাই রিটায়ার করলেন, নিজের খাতাপত্র সব আপ-টু-ডেট করে রেখেছিলেন, সার্ভিস বুকও সার্ভিস শেষ হবার আগেই আন-অফিসিয়ালি জমা পড়ে গেছিল, মাসখানেকের মধ্যে সব পেয়ে গেলেন। নির্লজ্জতাটা ভাবতে পারো? একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হেড অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেরটা গুছোচ্চে?

—অন্যরাও সব পেয়ে গেল তো বলছেন, আপনি কি হেড মাস্টারের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন?

—দূর দূর, তুমিও যেমন? ঝগড়া করার দম-আমার আচে? টুইশনিতে ডুবে আছি।

—কেন পতিত কাকা, এখন তো আপনাদের স্কেল ভাল হয়ে গেছে।

—আরে সময়মতো মাইনেটা কবে পেয়েছি বলো! তা ছাড়া আমাদের এজ গ্রুপ বেনিফিট তেমন পেল কই! ছেলেটাকে ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে বাঙ্গালোরে এঞ্জিনিয়ার হতে পাঠিয়েছি। ওর ঝোঁকটা আছে তো! তা খর্চা কত! মেয়ের বিয়ে গেল! গিন্নির হার্টের ব্যামো, জলের মতো টাকা বেরিয়ে যায়। প্রতিদিন ব্যাচ পড়াই, কোনওমতে চালিয়েচি, চালাচ্চি রুণু, যে কোনওদিন বুড়ো ঘোড়ার মতো পড়ব আর মরব!

—তা আপনাদের নতুন হেডমাস্টার?

—আরে সে তো আমাদের হাঁটুর বয়সি। কোনও কথাই শুনতে চায় না। খালি ফাজলামি! মাস্টারমশাই, আমি এখনও কিছুই জানি না। ক্লার্কদের হাতে। ওদের কথা শোনাতে পারছি না। আপনি একটু চেষ্টা করুন না! শুনলে অবাক হবে রুণু, আমি বুড়োমানুষ বিয়ারের বোতল কিনে দিয়ে এসেছি, তবে আমার পঁচিশ বছরের পরিচিত ক্লার্ক যুগলবাবু কাগজপত্রগুলো তৈরি করে দিয়েছেন।

ডি-আই অফিসে ঢুকে এই মতো কথাবার্তা হল।

কেষ্টবাবু—আপনি আবার এসেছেন?

—পাওনা-গণ্ডা তো কিছুই পাইনি, আসব না? গ্র্যাচুইটি, পেনশন, পাঁচ বছরের এরিয়ার, রিভাইজড স্কেলের…

—হ্যাঁ হ্যাঁ, পুরো পৃথিবীটাই তো আপনার পাওনা।

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে কড়া গলায় বলি—এত বাতেল্লা কীসের এখানে? অ্যাঁ? বহোৎ বহোৎ বাওয়ালি শুনছি!

চোখে যথাসম্ভব তাচ্ছিল্য নিয়ে কেষ্ট নামধারী বললেন—ইটি কে মাস্টারমশাই?

—ইটি ওনার বডিগার্ড। আমি বলি। —কেস কে হ্যাজাচ্ছে পাঁচ বছর ধরে দেখতে এসেছি।

—বাপরে, আপনি কি ভোটে-টোটে দাঁড়াচ্ছেন না কি, মাস্টারমশাই? এমন একখানা বডিগার্ড! —লোকটা চোখ কপালে তুলে যেন ভিরমি খাচ্ছে এমনি ভাবে বলল…

—আমি বলি—কিচাইন মাৎ কর, যা হয়েছে হয়েছে। ফার্দার লোকসান যাতে না হয় তাই এম এল এ সাহেব আমাকে ফিট করেছেন। ইংরেজি বাংলা সব কাগজের জন্য চিঠিপত্তর রেডি। নাম ধাম সুদ্ধ বের করে দোব। জার্নালিস্ট ফেউ লাগিয়ে দেব পেছনে, চাকরি নট, এঁর পুরনো হেডুর পেনশন বন্ধ। নতুন হেডুকে শো-কজ। মানবাধিকার কমিশন কেস করবে। সমঝ লিয়া!

—বাব্বা! তেল তো কম নয়? পলিটিক্যাল লিডার আবার সম্পাদকেষু আবার হিউম্যান রাইটস? ত্র্যহস্পর্শ যে দেখচি। —তাচ্ছিল্য লোকটার সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে। তারপর ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে বলল—হুলিগান এনে ভাল করেননি মাস্টারমশাই।

পতিতকাকা একেবারে ভয়ে জড়সড় হয়ে বললেন—ও হুলিগান নয়, ভাই। আসলে ট্রেনে আজকে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে কতকগুলো লোকের সঙ্গে তাইতেই… রক্ত এখন গরম তো… আমার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকালেন একবার।

আমি বলি—যাকগে ফালতু কথা ছাড়ুন, আমাদের ডি-আইকে একটা চিঠি দেবার আছে, বলে কাউন্টারের দরজা খুলে ঢুকতে যাচ্ছি, লোকটা হাঁ হাঁ করে তেড়ে এল, —কার হুকুমে এখানে ঢুকছ হে ছোকরা?

—আমার ওপরতলার নির্দেশ আছে সোজা ডি-আইয়ের কাছে গিয়ে চিঠিটা দিতে হবে। এখানে কেষ্ট বলে কে এক মাল আছে তাকে যেন ইগনোর করি।

রাগে টকটকে লাল হয়ে গেছে লোকটার মুখ। সেই অনুপাতে ফ্যাকাশে পতিতকাকা।

—আমাকে তুমি অপমান করছ? কোন সাহসে?

—আপনাকে তো কিছু বলিনি! সেই কেষ্টা লোকটা নাকি এক নম্বরের…

পতিতকাকা আমার কনুই টেনে ধরে বললেন—রুণু কী করচ? ইনিই কেষ্টবাবু!

—আপনিই? তাই বলুন। ভাবছিলাম পাঁচ বছর ধরে শিক্ষকের পেনশন আটকে রেখে আবার বাতেল্লা দেয় এমন মাল এখানে ক’টা আছে! ভাল, এখন যেতে দিন।

—জানো, মন্ত্রীর চিঠি পর্যন্ত আমার কাছেই দিতে হয়! মন্ত্রী আমাকে ফোন করলে তবে…

—বিশেষ ইনস্ট্রাকশান আছে আপনার কাছে না দিতে, মাস্টারমশাই আসুন, বলে ভেতরে ঢুকে যাই। ডি-আইয়ের ঘরের কাটা দরজা দিয়ে ঢুকি।

—নমস্কার সার, বিশ্বনাথ মল্লিক এম এল এ কি আপনাকে কোনও ফোন করেছিলেন? আমরা ওঁর চিঠি নিয়েই আসছি।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—আসুন সার আসুন, আমি আপনার অপেক্ষাই করছিলাম। —আমি দাঁড়িয়ে থাকি। পতিতকাকা বসেন, দরদর করে ঘামছেন। আমি চিঠিটা এগিয়ে দিই, ভদ্রলোক জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন—জল খান, জল খান। ছি ছি ছি পাঁচ বছর ধরে…

—অন্তত পনেরোবার যাতায়াত করেচি ভাই। একবার ইস্কুল একবার ডি-আই অফিস। এখন এই রোদে খুব রিসকি হয়ে যাচ্চে আসা-যাওয়াটা। তাই বিশু এই রুণুকে সঙ্গে দিল। ভাল ছেলে। তবে অল্প বয়স তো! রক্ত গরম, অন্যায্য জিনিস সইতে পারে না। ও কেষ্টবাবুকে খুব চটিয়ে দিয়েচে।

—তাই নাকি? ডি-আই একটু হাসলেন—আমি তো চটাতে পারছি না, অন্য কেউ কাজটা করে দিলে ভালই। শুনুন মাস্টারমশাই, আপনাকে আর আসতে হবে না, কেষ্টবাবু অর নো কেষ্টবাবু মাস দেড়েকের মধ্যে আপনার পাওনা-গণ্ডা আমি বার করে দিচ্ছি। একদম ভদ্রলোকের এক কথা।

পতিতকাকার অবস্থা দেখে ভদ্রলোক রসগোল্লা আনালেন, নুন-চিনির শরবত সঙ্গে। —অত দূর এখন যাবেন, একটু খেয়ে নিন।

বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা খেয়ে নিই। কোন সকালে চা-মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছি। পতিতকাকাও নিশ্চয়ই এতদূর আসার জন্যে তৈরি হয়ে আসেননি।

বেরোবার সময়ে কেষ্টবাবুর পাশ দিয়ে দৃক্‌পাত না করে বেরিয়ে আসি। ভস্ম করে দিচ্ছে লোকটা। আমাদের দু’জনকেই।

আমি বলি—কাকা আপনি কি বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বেরিয়েছেন!

—না বাবা। তুমি?

—আমিও না।

—চলুন স্টেশনে গিয়ে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।

—আমার লাগবে না। তুমি খাও, নিশ্চয় খাবে বাবা।

—আগে চলুন তো!

স্টেশনের কাছাকাছি একটা মোটামুটি দোকানে—ভাত, ডাল আর মাছভাজা খেলাম দু’জনে। আমার গ্যাঁটের কড়ি খর্চা করে। খেয়ে দেয়ে ছায়া-ছায়া দেখে একটা গাছের তলায় বসি, প্ল্যাটফর্মের ওপরেই। এক বোতল মিনার‍্যাল ওয়াটার কিনি।

পতিতকাকা বললেন—রুণু, কাজ হবে তো?

—আলবৎ হবে কাকা!

—কিন্তু কেষ্টবাবু যে!

—আরে বাবা ডি-আই তো নিজে বললেন কেষ্টবাবু অর নো কেষ্টবাবু!

—কী জানো এসব জায়গায় একটা ক্লার্কের যা প্রতাপ, অফিসারদের তা নেই!

—দেখা যাক। দেড় মাস তো টাইম দিয়েছেন!

—তুমি বাবা অত তেরিয়া মেজাজ না দেখালেই পারতে, কিছু মনে কোরো না।

—কাজ হবে কাকা, দেখবেন, গ্যারান্টি। ওই কেষ্টবেটা চোর আর কারও সঙ্গে অমন করতে সাহস পাবে না। কী জানেন? এসব প্রশ্রয় পেলেই বাড়ে। কাজটা যে খারাপ করছে এ জ্ঞান কি আর ওর নেই? আপনারা গিয়ে হাতজোড় করেন, বাপু বাছা করেন, তাতে ওর মীন ইগো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এখন ও প্রথমটা জ্বলবে, ফুঁসবে। তারপর বাড়ি গিয়ে নিজের অজান্তেই ভাববে। কেন অমন হল! আপনার মুখ, আরও যাঁদের যাঁদের সঙ্গে অমন করেছে সবার মুখ ওর চোখের সামনে ভাসবে। একটু না একটু শিখবেই ঘটনাটা থেকে।

—তোমার অনেক আশা রুণু, তোমরা সব ছেলেমানুষ, রক্ত গরম, আশা করো, স্বপ্ন দেখো, আমাদের ও পাট শেষ। রিয়্যালিটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছি।

আমি সাধারণত মাথা খুব গরম করতে পারি না। ইচ্ছে হল কাউকে আচ্ছা করে প্যাঁদানি দিই, কিন্তু ওই ইচ্ছে পর্যন্তই। ওই যে সীমা। আমার একটা সীমা আছে, কালো পাথরের দেয়ালের মতো! কিন্তু পতিতকাকার সমভিব্যাহারে আমার যে অভিযান তা সব অর্থেই দুঃসাহসী। ওঁকে ভাবিত মুখে বাড়ি পৌঁছে দিই। চারটে বাজছে, বাড়িতে আর ঢুকি না। সোজা সাইটে চলে যাই। দীপে বসে বসে ঢুলছে। আমি ওকে ঠেলে তুলি।

—কী রে সে-ই যে বিশুদার কাছে গেলি—একেবারে বেপাত্তা!

আমি স-ব বলি। তারপর চিন্তিত মুখে বলি—আচ্ছা দীপু, আমি কি হিরো-ফিরো হয়ে যাচ্ছি না কী বল তো! একটা কি চেঞ্জ আসছে?

দীপু অবাক গলায় বলল—যাব্বাবা, তুই তো বরাবরই হিরো! পাড়ার মেয়েগুলো সব তোর নামে মুচ্ছো যায়, আমার দুটো বোন, শামুর বোন, ওদিকে নিমকি আর শিমকি, গদার ভাগ্নী কুর্চি…

—থামলি কেন? আরও কতক চাট্টি বল।

—আরে এ তো গেল মেয়েদের কথা! ছেলেরা! ছেলেগুলোরও তো তুই হিরো—ধর সঞ্জু, বাদাম, মুস্তাফা, খলিল, রাজু, এই জুনিয়রগুলো তো আছেই, তার ওপর আছে তোর ব্যাচমেটরা যেমন ধর পানু, সত্য, শামু, গদা, আমি…।

আমি তেড়ে উঠি—আমাকে তোরা একটা গুডি-গুডি বাধ্য ভালমানুষ, যাত্রাদলের বিবেক গোছের ইমেজ দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিস, না? দাঁড়া শালা, এমনি মুখ ছোটাব যে সমশের পর্যন্ত ঘাবড়ে যাবে!

দীপু বলল—সে তুই ছোটা না, তাতে করে তোর হিরো হওয়া আটকাচ্ছে না।

মনটা কেমন খিঁচড়ে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *