তিউমা
নাথুলা পাস থেকে গ্যাংটকে ফেরার জন্য রওনা হতেই নতুন মার্শাল জিপটা যে হঠাৎ বিগড়ে যাবে, তা আমরা কেউ ভাবিনি৷ তিন বন্ধু কলকাতা থেকে সিকিম বেড়াতে এসেছি৷ পাহাড়ি রাস্তা বলে গ্যাংটকের স্ট্যান্ড থেকে বেশি ভাড়া দিয়ে ঝকঝকে গাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম৷ তবু বিপত্তিটা হল! ড্রাইভার ছেলেটা সিকিমিজ, নাম তাশি৷ আমাদেরই সমবয়সি৷ অর্থাৎ তারও বয়স চবিবশ-পঁচিশ হবে৷ সেও বেশ বিব্রত ব্যাপারটাতে৷
‘নতুন গাড়ি৷ তেমন কিছু বড়ো গণ্ডগোল হওয়ার নয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে,’ এই আশ্বাস দিয়ে রাস্তার একপাশে গাড়ি রেখে বনেট খুলে সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল গাড়িটা ঠিক করার৷ দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে৷ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম অন্যান্য টুরিস্ট গাড়িগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে গিরিবর্ত্ম বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে৷ তখনও আমাদের মনে কোনো শঙ্কা দেখা দেয়নি৷ গাড়িটা নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে৷ তারপর আর ফিরতে কতক্ষণ লাগবে, এই ভেবে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিকিম হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম৷ সময় এগিয়ে যাচ্ছে৷ প্রায় বিকেল হয়ে গেল৷ আর আসল বিপদটা এল ঠিক তারপরই৷ হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেল আকাশ৷ তার আড়ালে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের চুড়োগুলো৷ তারপরই শুরু হল ঝিরঝির বৃষ্টি, তার সঙ্গে প্রবল ঠাণ্ডা বাতাস৷ বনেট বন্ধ করে আমরা জিপের ভিতরে উঠে বসলেও কনকনে বাতাস যেন হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে৷ অন্ধকার আরও যেন ঘন হয়ে আসছে৷ এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমরা৷ কৌশিক আমাকে বলল, ‘বিজন, এভাবে ঠাণ্ডার মধ্যে যদি জিপে রাতে কাটাতে হয়, তবে তো জমে হিম হয়ে যাব৷ সকাল পর্যন্ত বাঁচব কি না কে জানে!’
তাশির মুখও গম্ভীর৷ সে বাইরের আকাশটা দেখার চেষ্টা করছে৷ অর্ণব বলল, ‘বিকল্প কিছু করা যায় না? যদি রাতটা কোথাও কাটানো যায়?’
তাশি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আকাশটা সুবিধের নয়৷ সম্ভবত তুষারপাত শুরু হবে৷ এখানে হোটেল না থাকলেও বর্ডার ফোর্সের ক্যাম্প রয়েছে৷ কিন্তু সেখানে বাইরের লোককে ঢুকতে দেবে না৷ টুরিস্টদের শেষ গাড়িটাও নীচে নেমে গেল৷’
আমি অর্ণবের সুরে বললাম, ‘অন্য কোনো উপায়?’
তাশি মুহূর্তখানেক চিন্তা করে বলল, ‘একটা উপায় আছে৷ কিছু দূরে একটা বৌদ্ধ মঠ আছে৷ পরিত্যক্ত গুম্ফা৷ মিনিটদশেকের পথ৷ ওখানে গেলে ঠাণ্ডার হাত থেকে কিছুটা বাঁচা যাবে৷’ বাইরে ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হল৷
তাশি বলল, ‘জলদি ঠিক করুন, তুষারপাত বাড়লে ওখানে আর যেতে পারব না৷’
আমরা ওখানে যাব ঠিক করলাম৷ রুকস্যাক সঙ্গে নিয়ে জিপ থেকে নেমে পড়লাম৷
অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে! তার সঙ্গে বৃষ্টি আর তুষারপাত৷ প্রথমে পাথুরে রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা নীচে নামার পর সে রাস্তা ছেড়ে একটা পায়ে চলা শুঁড়িপথ ধরলাম৷ সে পথ কিছুটা এগিয়ে প্রবেশ করেছে পাহাড়ি বাঁশবনের ভিতর৷ তেমন আলো না থাকায় পায়ের নীচে জমে থাকা পচা পাতার রাশি পেরিয়ে শুধুমাত্র অনুমান করে তাশি আমাদের নিয়ে সামনে এগোতে লাগল৷ বৃষ্টি-বাতাস আর ঝিঁঝি পোকার কলতান মিলিয়ে এক অপার্থিব পরিবেশ খেলা করছে জঙ্গলের মধ্যে৷ সকলে নিশ্চুপ৷ আমি একবার শুধু তাশিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জায়গাটার নাম কী?’
‘তিউমা গুম্ফা,’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল তাশি৷
দশ মিনিটের পথ, অথচ আধঘণ্টা ধরে চললাম আমরা৷ তারপর বাঁশবন ফাঁকা হয়ে গেল৷ আমরা এসে দাঁড়ালাম ছোটো একটা সমতল জায়গায়, সেখানে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে ঢালু ছাদওয়ালা, কাঠের তৈরি মনাস্ট্রি, ‘তিউমা গুম্ফা’৷ প্রচণ্ড জোরে কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাল৷ কিছুক্ষণের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ৷ দৃশ্যমান হয়ে উঠল অতি প্রাচীন, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মনাস্ট্রির প্রবেশতোরণের দু’পাশের মাথায় বসানো কাঠের তৈরি তিববতি অপদেবতার মুখ৷ বৃষ্টিও শুরু হল প্রচণ্ড জোরে৷ নিজেদের বাঁচাতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম মঠের সামনের বারান্দায়৷ মনে হল, যাক, রক্ষা পাওয়া গেল৷ কিন্তু সে ধারণা যে ভুল, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম৷ পোশাক ভিজে গিয়েছে৷ তাতে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম৷ বাতাস আরও বাড়ছে৷
হঠাৎ অর্ণব বলল, ‘আরে ভিতরে একটা আলো জ্বলছে না?’
তাশি বলল, ‘কোথায় আলো? এখানে তো কোনো মানুষ থাকে না৷’
কিন্তু সত্যিই মঠের ভিতরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে থেকে ক্ষীণ একটা আলোর রেশ যেন ভেসে আসছে! এগোলাম সেদিকে৷ দুটো ঘর পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম একটা বড়ো ঘরে৷ সম্ভবত মঠের প্রেয়ার রুম৷ আর সেখানেই আমরা দেখতে পেলাম তাকে৷ ঘরের একপ্রান্তে প্রদীপ জ্বলছে৷ পাশে উঁচু একটা বেদির উপর বসে আছেন মুণ্ডিতমস্তক এক লামা৷ তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত৷ পরনে শুধু লাল রঙের একটা সারং বা লুঙ্গির মতো পোশাক৷ ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে তিনি বসে আছেন৷
আমরা পায়ে-পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর সামনে৷ ভালো করে তাঁর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, লোকটার অনেক বয়স৷ অতি বৃদ্ধ৷ ভ্রূ-চোখের পাতায় রোমের কোনো চিহ্ন নেই৷ উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে বক্ষপিঞ্জরের সব কটা হাড় যেন গোনা যাচ্ছে৷ দেহকাঠামোর উপর চামড়াটা কোনোভাবে যেন আটকে আছে চোখের পাতা বোজা৷ এক ঝলক দেখলে মনে হবে, প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই এই শরীরে৷
তিনি চোখ না খুললেও তাশি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলল, ‘আমরা টুরিস্ট৷ রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে৷ বৃষ্টি হচ্ছে, খুব ঠাণ্ডা৷ তাই এখানে এসেছি৷ রাতটা থাকব৷’
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ তারপর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমাদের বসতে বললেন তিনি৷ সামনে থাকা কাঠের মেঝেয় বসে পড়লাম আমরা৷ স্থানীয় মানুষরা লামাদের খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে৷ পাছে সন্ন্যাসী বিরক্ত হন, তাই তাশি ইশারায় আমাদের চুপ থাকতে বলল৷ প্রদীপের ম্লান আলোয় অস্পষ্ট ঘরের চারপাশ৷ শুধু চোখে পড়ল বেদির কাছাকাছি থাকা রংচটা, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কিছু কাঠের থাম৷ গায়ে খোদিত অদ্ভুত সব মুখ৷ কোনটা ড্রাগনের, কোনটা ভয়ংকর তিববতি অপদেবতার, কোনোটা বা হিংস্র অজানা কোনো প্রাণীর৷ ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে একইভাবে বসে আছেন লামা৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন শীত ভাবটা কেটে গিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হতে লাগল৷ সময় এগিয়ে চলল৷ আস্তে-আস্তে ঠাণ্ডার পরিবর্তে গরম লাগতে লাগল৷ ঘরটা বদ্ধ বলেই কি এরকম মনে হচ্ছে? তাকিয়ে দেখি, কৌশিক তার উইন্ডচিটারের চেনটা খুলল৷ অনির্বাণের কপালেও বিন্দু-বিন্দু ঘাম৷ অর্থাৎ ওদেরও গরম লাগছে৷ অথচ মাত্র আধঘণ্টা আগে এই ঘরে ঢুকেছি৷ গরমের জন্য আমাদের একটা অস্বস্তি শুরু হল ভিতরে৷ ঠিক এসময় লামা আবার হাত নেড়ে ইশারা করলেন৷ স্পষ্ট ইঙ্গিত৷ এবার বেরিয়ে যাও!
বাইরের ঝড়বৃষ্টির শব্দ যেন আর কানে আসছে না৷ ঘরটা গুমোট লাগছে৷ সন্ন্যাসীকে আর বিরক্ত না করে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা৷ দেখলাম, সত্যি ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়েছে৷ অন্ধকার পুরোপুরি নেমে গিয়েছে৷ তাশি বলল, ‘আর বোধ হয় ঝড়বৃষ্টি হবে না৷ দুর্যোগ কেটে গিয়েছে৷ তবে রাতটা বারান্দাতেই কাটাতে হবে৷’
অর্ণব বলল, ‘তাতে কোনো সমস্যা নেই৷ ওই প্রেয়ার রুমের চেয়ে এই জায়গা ভালো৷ যা গরম ওখানে, আমি তো ঘেমে গিয়েছি৷’
কৌশিক বলল, ‘আমারও তো হাঁসফাঁস লাগছিল৷ বাতাস ঢোকে না বলেই মনে হয় ঘরটা ওরকম’ আমিও সায় দিলাম তার কথায়৷
বারান্দায় থাকা কিছু ভাঙা কাঠের তক্তার উপরই বসার ব্যবস্থা করলাম৷ রুকস্যাকে থাকা বিস্কিট আর জলের বোতলের সদ্ব্যবহার করলাম আমরা৷ এক সময় আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠল৷ চাঁদের আলোয় জেগে উঠল তুষারধবল পর্বতশ্রেণি৷ এক অপূর্ব দৃশ্য!
অর্ণব সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস এখানে এলাম৷ না হলে এই দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম৷ আচ্ছা তাশি, এই গুম্ফার নাম তো তিউমা! মানে কী?
তাশি জবাব দিল, ‘শব্দটা সিকিমিজ নয়, তিববতি৷ আমি শব্দের মানে জানি না৷ ছোটোবেলা থেকে শুনছি, এর নাম তিউমা গুম্ফা৷’
আমি বললাম, ‘শব্দের মানে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে৷’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে,’ কথাটা কানে এল আমার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এবং স্পষ্ট বাংলায়৷ চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি আমাদের কিছুটা তফাতেই কাঠের পাটাতনের উপর বসে আছেন একজন৷ পরনে পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক৷ এতক্ষণ চাঁদ ওঠেনি বলে তাঁর অস্তিত্ব আমরা খেয়াল করিনি৷ মুখ বোঝা যাচ্ছে না৷ সামরিক টুপিতে তাঁর মুখ ঢেকে আছে৷
বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর বিজন তাঁর উদ্দেশে বলল, ‘আপনি বাঙালি? এখানেই থাকেন?’
লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ, বাঙালি৷ এখানেই বহুবছর ধরে আছি৷ সামরিক বাহিনীর লোক৷ আপনারা?’
আমরা এরপর নিজেদের পরিচয় দিয়ে গুম্ফায় রাত কাটানোর কারণ জানালাম৷
লোকটা শুনে বলল, ‘আমি কর্নেল মজুমদার৷ আপনাদের চিন্তা নেই৷ চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই এখানে৷ নিশ্চিন্তে রাত কাটান৷ সামরিক বাহিনীর লোক ছাড়া বর্ডার অঞ্চলে রাতে কেউ থাকে না৷’
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ তারপর তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করার উদ্দেশ্যেই কৌশিক বলল, ‘তিউমা শব্দের মানে আপনি জানেন?’
কর্নেল মিত্র বললেন, ‘হ্যাঁ, জানি৷ আপনারা অতীন্দ্রিয়বাদ শব্দের অর্থ বোঝেন? তিববতি অতীন্দ্রিয়বাদ শাস্ত্রে ‘‘তিউমা’’ শব্দের মানে হল, কোনো বিশেষ শক্তির সঞ্চার করা৷ কোনো-কোনো তিববতি লামা ধ্যানের মাধ্যমে নিজের শরীরে যা সৃষ্টি করতে পারেন বা পারতেন৷’
আমি তাঁর কথা শুনে বললাম, ‘অতীন্দ্রিয়বাদ বলতে আপনি কি কোনো অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের কথা বলছেন? কোনো একটা বইয়ে আমি যেন পড়েছিলাম যে, কোনো-কোনো লামাদের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি থাকে৷ তারা চোখ বন্ধ অবস্থায় অনেক দূরের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারেন৷ দেহকে পালকের মতো হালকা করে বাতাসে ভাসতে পারেন! এমনকী, প্রকৃতিকেও যোগবলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ তিউমা সেরকম কিছু?’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘অনেকটা তাই বলতে পারেন৷’
আমি সঙ্গে-সঙ্গে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনি তো এই অঞ্চলে বহুদিন রয়েছেন৷ অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীও নিশ্চয়ই দেখেছেন৷ আপনি বিশ্বাস করেন এসব?’
মুহূর্তখানেক চুপ করে কর্নেল মজুমদার বললেন, ‘হ্যাঁ, করি৷ কারণ সেরকম এক ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি৷’
‘করেছেন? কী সেই ঘটনা?’ সাগ্রহে জানাতে চাইলাম আমি৷
গল্প শুনে সময় কাটানোর জন্য কৌশিক আর অর্ণবও বলল, ‘গল্পটা কি আমরা জানতে পারি!’
দূরে জ্যোৎস্নালোকিত পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবার পর কর্নেল মজুমদার বললেন, ‘গল্প নয়, সত্যি ঘটনা৷ তবে খুব বড়ো কাহিনি নয়, আসলে তার অন্তর্নিহিত ব্যাপারটাই আসল৷ শুনতে চাইছেন যখন বলি৷’
শুরু করলেন তিনি, ‘ওই যে পাহাড় দেখছেন, ওটাই আমাদের দেশের সীমান্ত৷ এখানে ছোটোখাটো গণ্ডগোল সবসময়ই লেগে থাকে৷ স্ট্র্যাটেজিক কারণে দু-দেশের সেনা অন্যের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করার জন্য এসব করে৷ অনেকটা মক ফাইটিংয়ের মতো৷ হয়তো কোনো রাতে সীমান্তের ওপাশ থেকে দুটো মর্টার শেল উড়ে এল৷ আমাদের রকেট লঞ্চারও তার জবাব দিল৷ এরকম একটা ব্যাপার৷ আমি বহুদিন আগের ঘটনা বলছি৷ তখন আমি কর্নেল হইনি৷ আমি লেফটেন্যান্ট৷ ওই পাহাড়ের মাথায় এক জায়গায় আমাদের একটা অ্যামিউনিশন রুম ছিল৷ আমরা বলতাম, বারুদ ঘর৷ তার দায়িত্বে ছিলাম আমি৷
এরকমই মে-জুন মাস৷ প্রবল বর্ষা নামল৷ সাধারণত বর্ষা আর শীতে প্রাকৃতিক অসুবিধের কারণেই সীমান্তে উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসে৷ সেবারও তার ব্যতিক্রম ঘটল না৷ সীমান্তে বেশ শান্তির পরিবেশ৷ হঠাৎ খবর এল, গ্যাংটক থেকে পাহাড়ে ওঠার মুখে ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ নীচে থেকে তলব আসায় বিগ্রেডিয়ার ব্যাটেলিয়ান নিয়ে ছুটলেন রাস্তা ঠিক করতে৷ বারুদ ঘর আগলানোর জন্য আমি আর কয়েকজন উপরেই রইলাম, আর রইল ওয়াচটাওয়ার থেকে নজরদারির জন্য কিছু লোক৷
‘সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি৷ তার সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো বাতাস৷ পাঁচহাত দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ যে সময়ের কথা, সেসময় এখনকার মতো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নজরদারির কোনো ব্যাপারই ছিল না৷ ওয়াচটাওয়ার আর দূরবিনই ভরসা৷ বৃষ্টি বা তুষাঝড় হলে কোনোপক্ষই কারও গতিবিধি বুঝতে পারে না৷ আর এই ব্যাপারটাই কাজে লাগাল শত্রুসেনা৷ আমাদের লোকবল যে কমে গিয়েছে দুদিনের জন্য, সেখবরও মনে হয় পেয়েছিল তারা৷ দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে ওপাশের ঢাল বেয়ে উঠে এসে বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যার অন্ধকারে এক বিশাল বাহিনী আক্রমণ করল আমাদের৷ গুটিকয়মাত্র লোক আমরা৷ লড়াই একটা হল ঠিকই৷ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম আমরা৷ তাদের লক্ষ করে গুলি চালাতে-চালাতে আমাদের অংশের ঢাল বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম৷ সেই অন্ধকার রাতে কে কোথায় ছিটকে গেলাম, খেয়াল নেই৷ এক সময় আমি বেশ কিছুটা নীচে নেমে এলাম৷ পাহাড়ের ঢালে কিছুটা সমতল মতো জায়গা৷ তার চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা৷ আর তার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা অস্পষ্ট কাঠামো৷ একটা বৌদ্ধ মঠ৷ যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায় সেখান থেকে, যদি লোক মারফত গ্যাংটকের পথে আরও নীচে যেখানে বিগ্রেডিয়ার আছেন, সেখানে খবর পাঠানো যায়, এই আশায় ছুটলাম সেদিকে৷
দরজা খুললেন একজন বৃদ্ধ লামা৷ তিনি মঠাধ্যক্ষ৷ সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলতেই তিনি মঠের ভিতর ঢুকিয়ে নিলেন আমাকে৷ মঠটা আসলে একটা আশ্রয় শিবির, যদিও আমি সেখানে আগে পা রাখিনি৷ সীমান্তের ওপাশ থেকে কিছুদিন হল একদল তিববতি শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে৷ তার মধ্যে অধিকাংশই শিশু৷ যাই হোক, আমি তখন ক্লান্ত, প্রবল ঠান্ডায় প্রায় অবসন্ন৷ সেই বৃদ্ধ লামা আমাকে মঠের ভিতর নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুললেন৷ তিনি বললেন, ‘আলো না ফুটলে কিছু করা যাবে না,’ এই বলে প্রার্থনা করতে বসলেন তিনি৷ আমি আলো ফোটার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম৷
ভোর হল৷ বৃষ্টিও কিছুটা ধরল৷ বৃদ্ধ লামা একজন সন্ন্যাসীকে নীচে পাঠিয়ে দিলেন বিগ্রেডিয়ারের কাছে খবর পৌঁছনোর জন্য৷ কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অন্য বিপত্তি শুরু হল৷ পাহাড়ের মাথার উপর থেকে মঠের আশপাশে আছড়ে পড়তে লাগল মর্টার শেল৷ বুঝতে অসুবিধে হল না, মঠটাকে ওরা উপর থেকে কোনোভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে৷ এইসব বৌদ্ধ মঠ বা তিববতি শরণার্থীদের উপর ওদের খুব রাগ৷ তাই মঠটাকে ধ্বংস করতে চায় ওরা৷ মঠের বাচচাগুলো তখন জেগে উঠেছে৷ আতঙ্কে তারা ছোটাছুটি শুরু করল৷ যে শেলগুলো আশপাশে এসে পড়েছিল, সেগুলো দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো আমাদেরই শেল৷ অর্থাৎ বারুদঘর দখল করে শত্রুরা আমাদের অস্ত্রেই আমাদের ঘায়েল করছে৷ একটা শেল মঠের একদম গায়ে এসে পড়ল৷ ছোটো একটা ঘর ছিল সেখানে৷ সঙ্গে-সঙ্গে তা ছাই হয়ে গেল৷ কিন্তু এরপরই ভাগ্যক্রমে আবার প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল৷ আকাশ ঢেকে গেল মেঘে৷ উপর থেকে মঠের অবস্থান অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় শেল ফাটাও বন্ধ হল৷
‘সময় এগোতে লাগল৷ দুপুর হল৷ বৃষ্টি মৃদু হতেই আবার শেল উড়ে এল৷ মঠের সামনের জঙ্গলটা ছারখার হয়ে গেল৷ কিন্তু আবারও প্রবল বৃষ্টি আমাদের বাঁচাল৷ তবে এভাবে তো ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বেশিক্ষণ বাঁচা যাবে না৷ মেঘ যদি কেটে যায়, ওরা ধ্বংস করে দেবে মঠ৷ আমরা হিসেব করে দেখলাম, মঠের লোক নীচে গিয়ে খবর দিয়ে যখন লোক আনবে, তখন মাঝরাত হয়ে যাবে৷ তার মধ্যে একটা না-একটা গোলা ধ্বংস করে দেবে মঠ৷ এতগুলো শিশুর প্রাণ যাবে! স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ মঠাধ্যক্ষর মুখে৷ তিনি বললেন, ‘কী করা যায় বলুন তো?’
আমি বললাম, ‘যদি কেউ বারুদঘরে গিয়ে ওটা উড়িয়ে দিয়ে আসতে পারত৷ অস্ত্র আর বারুদ ঠাসা একটাই ঘর৷’
বৃদ্ধ লামা বললেন, ‘আমি যাব৷ কোনোভাবে যদি বারুদ-ঘরে ঢোকার সুযোগ পাই, তবে উড়িয়ে দেব সেটা৷ আত্মসমর্পণের অছিলায় আমি সেখানে যাব৷ দেখি যদি ঢুকতে পারি৷’
আমি বললাম, ‘কী বলছেন আপনি! কিন্তু সে ঘরে কোনো অস্ত্র নিয়ে ওরা আপনাকে ঢুকতে দেবে না৷ একটা দেশলাই পর্যন্ত নিয়ে নয়৷ তা ছাড়া ঘটনাটা ঘটাবেন কীভাবে? আর আপনিও তো ফিরবেন না!’
লামা শুধু হাসলেন৷ তারপর বললেন, যেখানে এতগুলো প্রাণের ব্যাপার, সেখানে আমার প্রাণটা বড়ো কথা নয়৷ আমার কোনোকিছুর দরকার নেই, শুধু ঢুকতে পারলেই হল৷ আমি ধ্বংস করে দেব বারুদ ঘর,’ এই বলে সেই লামা প্রার্থনা কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানে বসলেন৷ তারপর মঠ ছেড়ে বেরিয়ে রওনা দিলেন ওই পাহাড়ের উপর শত্রুসেনা পরিবৃত বারুদ ঘরের দিকে৷ তার সঙ্গে অস্ত্র দূরের কথা, পরনের সারং ছাড়া একটা কুটো পর্যন্ত নেই৷ তিনি পৌঁছে গেলেন সেখানে৷ শত্রুসেনারা তাঁকে বন্দি করে হাত-পা বেঁধে তাকে বারুদ ঘরে নিয়ে গেল জেরার করার জন্য৷ তারপর মাত্র কিছু সময়৷ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে শত্রুসেনা সমেত উড়ে গেল বারুদ ঘর৷ রক্ষা পেল এই তিউমা মঠ,’ কথা শেষ করলেন কর্নেল৷
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আসল ব্যাপারটাই তো বুঝলাম না৷ বারুদ ঘরটা তিনি ওড়ালেন কীভাবে?’
কর্নেল শুধু জবাব দিলেন, ‘তিউমা!’ তারপরই যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলেন৷
কোথায় গেল লোকটা? প্রার্থনা কক্ষে নাকি? তার খোঁজে আমরা গেলাম সেখানে৷ অদ্ভুত ব্যাপার! সেখানে কর্নেল বা সেই লামা কেউ নেই! শুধু বেদির সামনে সেই প্রদীপটা জ্বলছে৷ আর বাতাসে একটা গরম ভাব এখনও আছে ঘরের মধ্যে৷ সারারাত আর সেই লামা বা কর্নেলের দেখা পেলাম না আমরা৷
পরদিন গাড়ি ঠিক করে ফেরার সময় আমাদের কাছে লিফট চাইলেন ইন্দো-টিবেটান ফোর্সের এক সেনা অফিসার৷ ভদ্রলোকের বাবা নাকি এক সময় তিববতি শরণার্থী হয়ে এই দেশে এসেছিলেন৷ গ্যাংটকের পথে জিপে ফিরতে-ফিরতে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে৷ আমরা আগের রাতে গাড়ি বিভ্রাটের কারণে তিউমা মঠে রাত কাটিয়েছি শুনে তিনি বললেন, ‘জানেন, ওই মঠ নিয়ে একটা গল্প আছে৷ বহুকাল আগে একবার সীমান্তের ওপাশের সেনারা নাথুলা পাসে আমাদের একটা আর্টিলারি অ্যামিনিউশন রুম দখল করে নিয়েছিল৷ তিউমা মঠের প্রধান লামা ওই বারুদ ঘরে গিয়ে সেটা ধ্বংস করে এই এলাকাটাকে বাঁচায়৷’
তার কথা শুনে অর্ণব বলল, ‘হ্যাঁ, সে গল্প আমরা শুনেছি৷ কিন্তু কীভাবে ধ্বংস করলেন?’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘তিউমা! আপনার বিশ্বাস করবেন কি না জানি না৷ কিছু-কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যোগবলে দেহের উত্তাপ প্রচণ্ড বাড়িয়ে তুলতে পারেন, যার প্রভাব বাতাসেও পড়ে৷ সেই মঠাধ্যক্ষ নিজের দেহের উষ্ণতা এত বাড়িয়ে ফেলেছিলেন যে, আগুন লেগে যায় ঘরে৷ মজুদ বারুদে বিস্ফোরণ হয়ে উড়ে যায় ঘর৷’
আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, ‘সত্যি এরকম হতে পারে?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ হয়৷ ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য ১৮৯১ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বৈজ্ঞানিক এই দেশে আসেন তিববতি ধর্মগুরুর আমন্ত্রণে৷ বিজ্ঞানী দলের নেতা ডক্টর বেনসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হয় তিনজন প্রাচীন লামার৷ তিনি দ্যাখেন, ওই তিন লামা ধ্যানে বসে তাদের হাত-পায়ের আঙুলের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়িয়ে ফেলেছিলেন৷ অতীন্দ্রিয়বাদ সম্মিলিত তিববতি শাস্ত্রেও এই ব্যাপারে লেখা আছে৷ বারুদ ঘরে গিয়ে নিজের দেহে ‘‘তিউমা’’ উৎপাদন করেছিলেন সেই লামা৷’
বিস্মিত আমরা৷ ভদ্রলোক এর পর বললেন, ‘তবে আর-একটা কথা৷ সেদিন সেই বারুদ ঘর অভিযানে লামার সঙ্গী ছিলেন আরও একজন৷ তিনি ছিলেন বাঙালি৷ মজুমদার ছিল তাঁর পদবি৷ তিউমা লামার সঙ্গে আত্মত্যাগের জন্য তাঁকে মরণোত্তর ‘‘কর্নেল’’ উপাধি প্রদান করা হয়৷ কেউ-কেউ বলে, দুর্যোগের রাতে আজও নাকি দেখা যায় সেই কর্নেল আর বৃদ্ধ লামাকে৷’
ভদ্রলোকের কথা শুনে চমকে উঠলাম আমরা৷ বুঝতে পারলাম, গতকাল রাতে সেই প্রার্থনা কক্ষে ঢুকে কেন প্রবল ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম আমরা৷ আর কেনই বা হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন সেই কর্নেল আর সেই যোগী পুরুষ!