তারানাথ তপাদারের গল্প – গৌর বৈরাগী

তারানাথ তপাদারের গল্প – গৌর বৈরাগী

তারানাথ তপাদারের মন ভালো নেই। তিনমাস হল ভলেনটারি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন। সকাল-বিকেল তখন হাঁটতে বেরচ্ছেন। যার সঙ্গেই দেখা হয় সে বলে, কেমন আছেন কাকাবাবু।

মনটা আমার ভালো নেই মহীম!

কেন ভাল নেই।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। খাচ্ছি দাচ্ছি বেড়াচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে মনখারাপটাও বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কী করা যায় বলতো মহীম!

মহীম শখের ডাক্তার। বই পড়ে ওষুধ দেয়। সে বলল,—কাকাবাবু কার্বোভেজ থার্টি খাবার পর একমাত্রা করে কদিন খান।

পর পর চারদিন কার্বোভেজ খেলেন তারানাথ। নো উপকার।

দিবাকর শুনে বলল, আসলে আপনার দরকার যোগব্যায়াম। যোগব্যায়ামে মনখারাপ-টনখারাপ সব সেরে যায়।

‘নিরুপমা যোগ ব্যায়াম কেন্দ্রে’ কয়েকদিন গেলেন তারানাথ। নিয়ম করে শ্বাসগ্রহণ শ্বাসত্যাগ।

পিসিমা বলল,—হ্যাঁরে তারা কিছু উপগার মালুম হচ্ছে?

না পিসি। ছল ছল চোখে তারানাথ বললেন। সেরকম কিছু বুঝছি না। আজকাল আবার ওটা যেন ক্রমশ ভেতরে চেপে বসছে।

সে আবার কী?

হ্যাঁগো, আগে লোককে মনখারাপের কথা বললে মনটা একটু হালকা হত, এখন বলার মতো লোককে আর রাস্তাঘাটে পাচ্ছি না।

কথাটা ঠিকই। মাসখানেকের ভেতর গোবিন্দপুরের সবাই মোটামুটি জেনে ফেলল তারানাথ তপাদারের মনখারাপ চলছে। কেউ বাজার যাচ্ছে হয়ত তার সঙ্গেই মনখারাপের সাতকাহন খুলে বসলেন। তার বাজারের বারোটা বেজে গেল। বিনোদের আজ দেরি হয়ে গেছে। জোরে জোরে প্যাডেল করে সাইকেল নিয়ে স্টেশন যাচ্ছে। আটটা দশের ট্রেনটা না-ধরলেই নয়। বিনোদ, বিনোদ বলে ডাক দিলেন তারানাথ। শোনো শোনো একটা খুব খারাপ খবর আছে ভায়া।

এমন কথা শুনে, আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। বলে চলে যাওয়া যায় না।

বিনোদকে থামতে হল। কী হয়েছে তারানাথদা বলে গলা নরম করে কাছে আসতে হল।

তারানাথ বললেন,—মনখারাপ, বড়ো মনখারাপ বিনোদ। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। খাচ্ছি, খেতে হয় বলে। কথা বলছি, বলতে হয় বলে। বেড়াচ্ছি, বেড়াতে হয় বলে। আসলে মনটা আমার একটুও ভালো নেই।

কথা বলা যখন শেষ হল তখন ঘড়িতে আটটা তিরিশ। বিনোদের ট্রেন এসে চলে গেছে।

এসব কথা জানাজানি হতে দেরি হয় না। মানুষের কত দরকারি দরকারি কাজ আছে। মনখারাপের কথা শুনতে গিয়ে কাজ পণ্ড হোক কেই বা চায়। আবার লোককে তার মুখের ওপর এখন থামুন মশাই, বলে চলে যাওয়াও যায় না। তাই সবাই এবার একটু ঘুর পথে বাজার যেতে লাগল। গলি, তারপর অন্য একটা গলি। এভাবে ট্রেন ধরতে লাগল কেউ কেউ, তারানাথ তপাদারের বাড়ির সামনের রাস্তাটা আপাতত ফাঁকা। এসব দেখে মনখারাপটা যেন আরও জাঁকিয়ে বসল ভেতরে। হাঁটতে হাঁটতে লোক খুঁজতে বেরলেন তারানাথ। বাজারের দিকে পা বাড়ালেন। আশ্চর্য আজ বাজারটাও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। একটাও চেনা লোক চোখে পড়ল না। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে দেখলেন কুঞ্জকে।

কুঞ্জ রিক্সা চালায়। একটা পুরোনো সুরোনো ফুলপ্যান্ট আর খালি গা কুঞ্জ বসে আছে রিক্সার সিটে।

ভাড়া যাবে নাকি?

কোথায় যাবেন কাকা?

ছুটিপুর।

ও পিসিমার ছোটো ননদের বাড়ি। বেশ যাব।

রিক্সায় উঠে বসলেন তারানাথ। ছুটিপুর যেতে দশ মিনিট। আসতেও তাই। তার মানে আধঘন্টা কথা বলার একটা লোক পেলেন। তারানাথ বললেন,—তুমি পিসিমার ননদের বাড়ি চেনো নাকি? তা আর চিনব না। কুঞ্জ হাসল। আমি তো লোকাল।

তাহলে তুমি আমার মনখারাপের কথাও শুনেছ নিশ্চয়ই।

না শুনিনি তো।

সে-কথা শোনাতেই তো তোমার রিক্সায় উঠলুম। ছুটিপুর আসলে ছুতো বুঝলে কুঞ্জ। যাব আর আসব।

কিন্তু মনখারাপ কেন আপনার মেশোমশাই?

সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। মনখারাপের গলায় কথা বললেন তারানাথ! এযে কী কষ্ট সে তুমি বুঝবে না। খাচ্ছি, খেতে হয় বলে। কথা বলছি, বলতে হয় বলে। বেড়াচ্ছি বেড়াতে হয় বলে। কিন্তু…

কিন্তু কী?

মন ভালো থাকছে না। পোড়া মনে কী যে হয়েছে কুঞ্জ। এইতো দেখো না কালকেই একটা স্বপ্ন দেখলুম।

কী স্বপ্ন মেশোমশাই?

রিক্সাটা বেশ জোরেই যাচ্ছে তখন। ছুটিপুরের দিকে গাছপালা বেশি, পুকুরও আছে বেশ কটা। হাওয়া হুটোপুটি করছে গাছপাতায়। পুকুরের জলে ঝাপাই ঝুরছে ক-টা বাচ্চা ছেলে। জলে সাদা হাঁস চরছে। গাছের ডালে ডালে পাখি ডাকছে। নীল আকাশ দিয়ে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। এর ভেতর দিয়েই রিক্সা চলেছে। আর তারানাথ বলে যাচ্ছেন তার মনখারাপের কথা।

তারপর বুঝলে কুঞ্জ একটা স্বপ্ন দেখলুম। বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন। পুরোটা মন খারাপে ভর্তি।

ঘন্টা খানেক বাদে বাড়িতে ফিরলেন তারানাথ।

পিসি বলল,—এখন কেমন মনে হচ্ছে তারা?

তারানাথ বললেন,—আজ শরীরটা আর মনটা অন্যদিনের চেয়ে হালকা লাগছে।

টানা ঘন্টাখানেক কথা বলে গেছেন তারানাথ। প্রথম প্রথম কুঞ্জ প্রশ্ন করেছে। তারপর তার প্রশ্ন শেষ। শুধু কথা বলে গেছেন তারানাথ। তারপর বুঝলে কুঞ্জ…।

আহা, মনখারাপের কথাটা যদি পেট খোলসা করে রোজ এরকম বলা যেত।

বেশ, তাহলে তো একটা হিল্লে হল তোর। রোজ দশ টাকা রিক্সা ভাড়ায় যাবে। সে আর কী হবে। কালও ওই কুঞ্জর রিক্সায় চাপবি।

2

পরের দিন আর কুঞ্জকে দেখলেন না তারানাথ। শুধু কুঞ্জ বলে নয়, রিক্সা দাঁড়াবার জায়গায় একজন রিক্সাওলাও নেই। রাস্তাতেও জনমনিষ্যি নেই। মনখারাপ যেন আরও বেড়ে গেল এতে। পিসি বলল,—কী আবার হল তোর?

আজ রিক্সাওলারা কেউই নেই।

বসো বাছা দেখছি। পিসি বলল। কুঞ্জ নেইতো কী হয়েছে। লোকের কি অভাব হয়েছে নাকি আমাদের গোবিন্দপুরে। পিসি গেট খুলে রাস্তায় নামল। এই যাব আর আসব। দশ মিনিট বাদেই পিসি এল। সঙ্গে ননীগোপাল। লোকটা রামকুঁড়ে। নিজের হাতটা নড়াতেও পরিশ্রম হয়। তাকে তারানাথের সামনে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তোকে কিছু করতে হবে না ননী। তুই শুধু চুপটি করে বসে বসে শুনবি। নে তারা এবার শুরু কর। শোনা হয়ে গেলে বলিস। পাঁচটা ট্যাকা মজুরি হিসেবে দেব।

তারানাথ শুরু করলেন। আমার খুব মনখারাপ জানো ননী। সবসময় মনখারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে যে কী কষ্ট তোমাকে কী বলব! খাচ্ছি, খিদে পাচ্ছে বলে। কথা বলছি, সে বলতে হয় বলে। বেড়াচ্ছি, বেড়াতে হয় বলে। কিন্তু মনখারাপ কিছুতেই যাচ্ছে না।

কথার ভেতরেই পিসি গরম গরম ফুলকো লুচি নিয়ে এল। সঙ্গে চা। ননী খাচ্ছে আর মন দিয়ে মনখারাপ শুনছে।

তারানাথ বলে যাচ্ছেন। প্রায় মাসখানেক চোখে আমার ঘুম নেই। দু-চোখ বুজলেই চোখের পাতায় নেমে আসছে ওই এক জিনিস। বলতে বলতে বেশ হালকা হয়ে যাচ্ছেন তারানাথ। ননীগোপাল লোকটা বেশ ভালো। অন্য লোক এটা সেটা প্রশ্ন করে। রামকুঁড়ে ননীর কথা বলতেও পরিশ্রম। তার ফলে তারানাথ মনখারাপের কথা টানা দু-ঘন্টা ধরে বলে গেলেন। মনটা সত্যি সত্যি আজ হালকা হয়ে গেল। সেই ভার বোধটা আর নেই। পিসি বলল, দেখলি তারা, আমাদের এখানে কথা শোনার লোকের অভাব নেই। তাহলে ননীই বহাল থাক। সকালে দু-ঘন্টা। বিকেলে দু-ঘন্টা।

পরের দিন সকালটা যখন দুপুরের দিকে চলে যাচ্ছে পিসি বলল তাহলে তো একবার দেখতে হয়।

পশ্চিমপাড়ায় জামরুল গাছের নীচে ননীগোপালের বাড়ি। পিসি দেখল, ননী তার ঘরের সামনে বসে চায়ে রুটি ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছে।

এত বেলায় চা রুটি খাচ্ছিস তুই?

ননীর বউ মুখ ঝামটা দিল। এইতো ঘুম ভাঙল বাবুর। আমার হয়েছে জ্বালা।

থাক থাক, ওকে বকো না বউমা। ননী আমাদের বড়ো কাজের ছেলে। অ ননী চ’ বাবা। আর এক কাপ চা আমার ওখানেই খাবি। সঙ্গে গরম গরম কচুরিও ভেজে দোব।

নহী হাত দুটো জোড়া করে উঠে দাঁড়াল। মাপ করো পিসি, ও তোমার গরম কচুরি আর পাঁচ টাকার কম্ম নয়।

বেশ বেশ তাহলে কত হলে তোর পোষাবে বল?

দরকার নেই আমার টাকার। ননীর সোজা সাপ্টা গলা। ঝাড়া দু-ঘন্টা ধরে মনখারাপের কথা শোনা কি চাড্ডিখানি কথা। অত পরিশ্রম আমার সইবে না পিসি।

শেষে শৈল ডাক্তারের কথা মনে পড়ল পিসির। পাড়ার অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। ভালো নাম শৈলজানন্দ বিশ্বাস, এম বি বি এস (ক্যাল) বয়স হয়েছে। দশ টাকা ভিজিটেও রুগি পত্তর হয় না তেমন।

পিসি বলল,—ও শৈল আমার তারাকে একবার দেখে দাও।

তারানাথকে আপাদমস্তক দেখে শৈল ডাক্তার বললেন,—কী অসুবিধে?

আজ্ঞে অন্য কিছু নয় ডাক্তারবাবু। শুধু মনখারাপ।

ডাক্তার ইঙ্গিতে শুতে বললেন তারানাথকে। ডাক্তার কল দিয়ে বুক দেখছেন, পিঠ দেখছেন, হাতে প্রেসারের ব্যান্ডেজ বেঁধে প্রেসার দেখছেন। আর ওদিকে তারানাথ অসুবিধের কথা বলেই যাচ্ছেন। সারাদিন জুড়ে বড়ো মনখারাপ ডাক্তারবাবু। এ যে কী কষ্ট সে কথা কী বলব আপনাকে। খাচ্ছি, খেতে হয় বলে। কথা বলছি, সে বলতে হয় বলে…

আর ঘুমোচ্ছি, ঘুমোতে হয় বলে। ঘুমের কথাটা বললেন ডাক্তারবাবু। কথা বলে হাসতে যাচ্ছিলেন উনি তখনই তারানাথ বলে উঠলেন, ওইটা বাদ ডাক্তারবাবু।

কোনটা?

ওই ঘুমটা। ওটাই তো নেই আমার। সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারি না।

তাই নাকি? কদ্দিন ঘুম নেই?

ওই ভলেনটারি রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই তো ঘুম নেই প্রায়।

আগে হত?

হ্যাঁ হত।

কী রকম হত?

তা বলতে নেই ভালোই হত ডাক্তারবাবু। বাড়ি থেকে অফিস যেতে প্রথম দু-ঘন্টার ট্রেনে জার্নি। গাড়িতে উঠে একবার সিটে বসলেই টানা দু-ঘন্টার ঘুম। ট্রেনের পর আধ ঘন্টার বাস জার্নি। বাসে হুড়োহুড়ি, গুঁতোগুঁতি, গায়ে গা। কিন্তু কী বলব, দু-হাতে বাসের রড ধরে কারো গায়ে হেলান দিয়ে দু-চোখ বোজাতে যা দেরি। আধ ঘন্টার ক্লিন ঘুম। আবার ফেরার সময়ও ঠিক অমন।

তার মানে সারাদিনে আড়াই আড়াই পাঁচ ঘন্টার টানা ঘুম। হ্যাঁ তা বলতে পারেন ডাক্তারবাবু। ঘুমের কথায় তারানাথ তপাদার অনেক দিন বাদে হাসলেন। সেই ঘুমটা এখন পালিয়েছে। নরম বিছানা, টান টান করে পাতা চাদর, ফুলো ফুলো বালিশ। তবু চোখে ঘুম নেই। ঘুমের বদলে পোড়া চোখে মনখারাপগুলো এসে বসছে। আমাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু।

এরকম এরকম সময়ে সব ডাক্তারবাবুরাই গম্ভীর হয়ে যান। শৈল ডাক্তারও গম্ভীর হয়ে কথার উত্তর না-দিয়ে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে বাড়িয়ে দিলেন পিসির দিকে।

পিসি বলল,—শৈল ছেলেটা আমার ভালো হবে তো?

আলবৎ হবে।

বাড়িতে এসে প্রেসক্রিপশন খুলে পিসি অবাক। ও তারা এ যে বাংলায় লেখা।

কয় দেখি। তারানাথ দেখলেন। সত্যিই বাংলায় লেখা প্রেসক্রিপসন। শৈল ডাক্তার পুরোনো দিনের লোক। তাই সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন। গোটা গোটা করে লেখা ‘দুই বেলা খাইবার পর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণ।’

পিসি বলল,—এ আবার কী ডাক্তারির ছিরি।

তারানাথ হাসলেন। পিসি রোগটা তোমার শৈল ডাক্তার বোধহয় ঠিকই ধরেছে। এটা গাড়ি ঘুম রোগ। ঘুমোবার জন্যে একটা গাড়ি মাস্ট।

কিন্তু গাড়ির তো অনেক দাম তারা।

সেই জন্যই তো সেকেন্ড হ্যান্ড। তারানাথ হাসলেন। সেকেন্ডই ভালো। চেপে বসলেই আপসে ঘুম চলে আসবে।

কিন্তু হোক সেকেন হ্যান্ড। পিসি বড়ো ভাবনার কথা বলল। একটা আস্ত গাড়ি কেনা বলে কথা। সে কি অতই সহজ নাকি।

তারানাথ বলল,—গোপীনাথ মান্নার গ্যারেজ আছে। ও অনেক খোঁজখবর রাখে। আগে ওর কাছেই দেখি।

গোপীনাথ সব শুনে বলল,—আপনি পুরোনো গাড়ি কিনবেন তাই তো?

তারানাথ বললেন,—হ্যাঁ।

আজকাল পুরোনো গাড়ি খুব কম দামে বিকোচ্ছে। গোপীনাথ হাসল। আপনি বিশে পাবেন, ত্রিশে পাবেন!

বিশ মানে, বিশ হাজার!

হ্যাঁ আমার কাছেই তো রয়েছে একটা। গোপীনাথ গোপন গলায় ফিসফিস করে বলল, অন্য কেউ হলে একটা আধলাও কমাতুম না। কিন্তু আপনি আমাদের ঘরের লোক। আপনি নিলে পনেরোয় দিয়ে দোব।

তাই!

হ্যাঁ তাই। ওই ইঞ্জিনটা শুধু একটু কমজোরি। কাজের চাইতে শব্দ হয় বেশি। আর ইঞ্জিন স্টার্ট হবার পর গাড়ি চালু হতে তিন মিনিট সময় নেয়। তো আপনার তো আর ঘড়ি ধরার ডিউটি নয়।

হ্যাঁ তা তো বটেই। তারানাথ বললেন। ইঞ্জিনের শব্দটা বরং উপকারই করবে আমার। চারদিকে হই হট্টোগোল, চিৎকার, চেঁচামেচিতেই ঘুমটা আমার জমে ভালো।

3

আজ বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতে পিসি আহ্লাদে আটখানা। পিসি বলল, আমায় কিন্তু কথা দিয়েছিস তারা।

হ্যাঁ হ্যাঁ আমার মনে আছে পিসি। তোমাকে নিয়ে একদিন কালীঘাট আর একদিন দক্ষিণেশ্বর যাব।

আর মায়ের বাড়ি জয়রামবাটী।

হ্যাঁ পিসি ওটাও। সব তীর্থই তোমাকে দর্শন করাব। নিজেদের গাড়ি ভাবনা কী। তবে আমার রোগটা তো সারাই আগে। কতকাল যে ঠিকমতো ঘুম হয়নি।

সেই ঘুম আজ নির্ঘাৎ আসবে। গাড়ি এসেছে। ড্রাইভারও রেডি। তিনজন এসেছিল তার মধ্যে ওই দাশুরথি দাসকে পছন্দ হল তার। লোকটার তারই মতো বয়স। ধীরেসুস্থে গাড়ি চালাবে।

কুড়ি বছর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা। তারওপর লোকটা ঘুমোতে ভালোবাসে।

শুনে তারানাথ বললেন, বাঃ বাঃ। সারাদিনে কত ঘন্টা ঘুম হয়।

বারো-চোদ্দ ঘন্টা তো বটেই।

চমৎকার। সুস্থ শরীরে ওই ঘুমটাই স্বাভাবিক। হাসলেন তারানাথ। তা দাশুরথি ঘুমটা কখন আসে।

ওর কোনো ঠিক নেই স্যার, যখন-তখন। দাশুরথি বলল,—কখনও রাতে আসে, কখনও দিনে। কখনও আবার গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুম।

সে কী! চমকে উঠলেন তারানাথ। গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুম।

ও আপনি ভাববেন না। কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা কি এমনি।

সে অবশ্য তোমার ব্যাপার। তারানাথ বললেন, তবে এটা কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। একটু সাবধানে ট্যাকল করতে হবে দাশুরথি।

সে আপনি ভাববেন না স্যার। দাশুরথি যেন ঘুম জড়ানো গলায় কথা বলেছ। এই কুড়ি বছরে কম গাড়ি তো পার করলুম না।

এটা কিন্তু সবার থেকে আলাদা। গোপীনাথ পই পই করে বলে দিয়েছে। স্টার্ট দেবার পর গাড়িটা চালু হতে তিন মিনিট সময় নেয়।

নিক না স্যার। স্টিয়ারিং তো আমার হাতে। যাবে কোথায় বাছাধন। কথা শেষ করে দাশুরথি একটা আদরের চাঁটি মারল গাড়ির বডিতে।

আজ সাফসুতরো করা হয়েছে। পিসি পুজোর ব্যবস্থা করেছে। চালকলা আর সন্দেশ দিয়ে দুটো নৈবিদ্যি। হরু ঠাকুর ঘন্টা নাড়িয়ে গাড়ি দেবতার মন্ত্র পাঠ করল। তেল সিঁদুর যখন পরানো হচ্ছে গাড়িকে তখন শাঁখ বেজে উঠল। পিসি বলল,—দুগ্গা দুগ্গা। দাশুরথি প্রস্তুত হয়েইছিল। চাবি ঘুরিয়ে চালু করল ইঞ্জিন।

ঝকর ঝকর, যাচ্ছি যাব, ঝকর ঝকর, যাচ্ছি যাব শব্দটা ইঞ্জিন থেকে রেরিয়ে আসতে শুনলেন তারানাথ। শব্দ আছে ছন্দও আছে। ধন্দ আর তাল মিলিয়ে গাড়িটা কাঁপছেও ভারি চমৎকার। কান বেশ ঝালাফালা হচ্ছে। আঃ বড়ো ভালো লাগছে তারানাথের। আর আশ্চর্য সেই হারিয়ে যাওয়া ঘুমটা যেন ফিরে আসছে। তারানাথ আর ভাবতে পারলেন না। এখনও গাড়ি চালুই হয়নি। এখনও দু-মিনিট আঠারো সেকেন্ড মতো বাকি। কিন্তু তাতে কী। পেছনের গদিতে মাথাটা রাখতেই গাঢ় ঘুম নেমে এল চোখজুড়ে।

একটা ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেল তারানাথের। গাড়িটা এইমাত্র থামল। হাত ঘড়িতে তারানাথ দেখলেন এক ঘন্টা দশ মিনিট সময় এরমধ্যে পেরিয়ে গেছে। তার মানে হিসেব মতো মগরায় বড়ো পিসির বাড়ি চলে আসার কথা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন তারানাথ। ওই তো শিবতলায় সেই গুমটিটা। তার পাশে একটা বড়ো গাছ। গাছের পাশেই তো সাদা রঙের বাড়ি। দাশুরথিকে টো টো ঠিকানা বলা ছিল। লোকটা রাস্তাটাও ভালো চেনে বোঝা যাচ্ছে। একেবারে বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি এনে দাঁড় করিয়েছে। শুধু একটা খটকা। বড়ো পিসির পুরনো বাড়িটা রং করে একেবারে নতুন হল কী করে।

তারানাথ সন্দেশের বাক্স হাতে নিয়ে নামতে যাবেন হঠাৎ দেখলেন বড়োপিসি গেট খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। ওফ কতদিন বাদে দেখা হচ্ছে। উত্তেজনা চেপে রাখতে পারলেন না তারানাথ। ডাকলেন, বড়োপিসি, বড়োপিসি। আমি তারা।

তারানাথ ভেবেছিলেন বড়োপিসি তার গলা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটা। তাহলে কি চিনতে পারল না।

তারানাথ আবার গলা তুললেন। ও বড়োপিসি, আমি মানকুণ্ডুর তারানাথ। গাড়ি কিনেছি। গাড়ি নিয়ে প্রথমেই তোমার বাড়ি এলুম।

ওদিকে কোনো হেলদোল নেই। আশ্চর্য যেন খুব অবাক হয়েছে এমনভাবে এগিয়ে আসছে। তারানাথ একগাল হেসে বললেন,—দুই বোনে এত মিল। ও পিসি, তোমাকে ঠিক পিসির মতো দেখতে।

পিসির মতো নয়। তোমার সামনে তোমার পিসিই দাঁড়িয়ে আছে তারানাথ। কথা ক-টা বলেই আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠল মানুষটা। হায় হায় একী হল। শুধু মনখারাপ নয়, এবার তোর মাথাটাও দেখছি খারাপ হয়ে গেল।

তারানাথ কিছু বুঝতে পারছেন না। সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তার তো সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হয়নি। এক ঘন্টা ঘুমের পর শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছে। তাহলে…

পিসি বলল,—ওরে তারা, আমি তোর বড়ো পিসি নয়। আমি তোর আসল পিসিই। আর এ বাড়িটাও মগরায় নয়, এটা মানকুণ্ডু নতুন পাড়া।

অবাক গলায় তারানাথ বললেন,—তার মানে?

তার মানে তোর সেকেন হ্যান গাড়ির চাকা এক পাকও ঘোরেনি।

তাইতো, তাইতো। ওই তো সাদা রঙের বাড়ি। ওই তো বাড়ির পাশে বড়ো বকুল গাছটা। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর গলায় তারানাথ বললেন,—দাশুরথি ব্যাপারটা কী হল?

দাশুরথি বড়ো একটা হাই তুলতে তুলতে পেছনে তাকাল। কী করব বলুন। ইঞ্জিন চালু হবার তিন মিনিট বাদে গিয়ার দিলাম। একসিলেটার দাবালুম। তাও গাড়ি চলে না। তখন চার মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে। আপনিই বলুন স্যার টানা চার মিনিট না—ঘুমিয়ে থাকা যায়?

তার মানে তুমিও আমার মতো…

দাশুরথি হাসল হা হা। তাহলে আর বলছি কী! টানা এক ঘন্টা ধরে ইঞ্জিন চালু ছিল। তেল ফুরিয়ে যেতে আপনার মতো আমারও ঘুমটা ভেঙে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *