ড্রাগনের মুখোশ

ড্রাগনের মুখোশ

একজনের গলা শোনা গেল, ‘ও মশাই শুনছেন?’

সেই গলার শব্দ শুনে সৈকত তাকিয়ে দেখল, জানালার ওপাশে নিজেরই বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন বিশু মিত্তির৷

তাঁকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাড়াতাড়ি জানলার কাছে গিয়ে সৈকত বলল, ‘হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? কোনো খোঁজখবর নেই, ফিরলেন কবে?’

বিশুবাবু হেসে জবাব দিলেন, ‘আজই সকালে ফিরেছি৷ হঠাৎই একটা জিনিসের খবর পেয়েছিলাম৷ তার খোঁজে এক জায়গায় গিয়েছিলাম৷’

‘কী জিনিস?’

বিশুবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি কি আমার বাড়ি এখন একবার আসবেন? তা হলে সেটা আপনাকে দেখাব৷’

বিকেল হয়ে আসছে৷ সৈকতের এখন কোনো কাজ নেই৷ কয়েক সপ্তাহ গল্পগুজব হয়নি বিশুবাবুর সাথে৷ সে বলল, ‘আমি আসছি৷’

সৈকত যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সে বাড়ি থেকে বিশুবাবুর বাড়ির পিছনের বারান্দার ব্যবধান হাত ছয়েকের৷ বিশুবাবুর বারান্দার মুখোমুখি দোতলার এ ঘরে মাস ছয়েক হল আছে সৈকত৷ একলাই থাকে সে৷ বিশুবাবুও একলাই থাকেন তাঁর প্রাচীন পৈতৃক বাড়িতে৷ এ পাড়ায় লোকজন কেউ কারোও সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করে না৷ কিন্তু সৈকতের ঘরের জানলা আর বিশুবাবুর বারান্দা মুখোমুখি হওয়ায় দুজনের মধ্যে বেশ একটা পরিচয় গড়ে উঠেছে৷ সৈকত বেশ কয়েকবার বিশুবাবুর বাড়ি গিয়েছে৷ বিশুবাবুর পার্কস্ট্রিটে একটা ছোটো কিউরিওশপ আছে৷ আর আছে এক অদ্ভুত শখ৷

তাদের দু-বাড়ির মধ্যে অনুচচ একটা প্রাচীর আছে৷ বিশুবাবুর বাড়ি যেতে হলে তিনটে বাড়ি পেরিয়ে যেতে হয় সৈকতকে৷ সৈকতের বাড়ির ঠিকানা চার নম্বর হরিপদ মিত্তির লেন, আর বিশুবাবুর আট৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এল সৈকত৷ কলকাতা শহরের মধ্যে আরও একটা লুকনো কলকাতা আছে, যেখানে শহরের লোকজনের কোলাহল, গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ প্রবেশ করে না৷ সরু-সরু সব গলি৷ তার দুপাশে রোয়াক আর দোতলার ঝুল-বারান্দাওলা পুরনো দিনের সব বাড়ি৷ দেড়শো-দুশো বছর তাদের বয়স৷ বাড়িগুলোর পাখিতোলা দরজা-জানলায় শেষ কবে রং হয়েছে কেউ বলতে পারে না৷ সদর দরজার গায়ে খসে যাওয়া পঙ্খের কাজ, বা মাথার উপর ছোট্ট কুলুঙ্গিতে শুঁড়ভাঙা, রংচটা ছোট্ট গণেশমূর্তি৷ কোনো বাড়ির চিলেকোঠা থেকে বটের ঝুরি নেমেছে৷ কোনোটার বারান্দার রেলিং ভেঙে ফোকলা হয়ে গিয়েছে৷ গলির রাস্তায় লোকজন বিশেষ থাকে না৷ নির্জন দুপুরে মাঝে-মাঝে শুধু টানা রিকশার টুংটাং ঘণ্টার শব্দ বা ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যায়৷ উত্তর কলকাতায় সৈকতদের এ পাড়াটা অনেকটা এমনই৷

তিনটে বাড়ি টপকে সৈকত পৌঁছে গেল বিশুবাবুর বাড়িতে৷ সদর দরজা দিয়ে সে বাড়িতে ঢুকতেই নিস্তব্ধ উঠোন থেকে একঝাঁক গোলা পায়রা ডানা ঝাপটিয়ে দোতলার কার্নিশের দিকে উড়ে গেল৷ উঠোন ঘিরে তিনদিকে সার-সার তালাবন্ধ ঘর৷ এক কোণের অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সৈকত গিয়ে ঢুকল বিশুবাবুর বৈঠকখানায়৷ সে ঘরে টেবিলের ওপাশে নিজের চেয়ারে তিনি বসে ছিলেন৷ সৈকত তাঁর মুখোমুখি টেবিলের এপাশে বসে ঘরে চারপাশ একবার দেখল৷ এ ঘরে ঢুকলে বেশ অদ্ভুত লাগে সৈকতের৷ মাথার উপর কড়িবরগা থেকে টেবিলের উপর নেমে আসা সেকেলে ঝুলন্ত বাতির কাঁপা-কাঁপা আলোয় সার-সার মুখ যেন চারপাশের দেওয়াল থেকে চেয়ে থাকে সৈকতের দিকে৷ নানারকমের সব মুখ৷ আসলে এগুলো সব মুখোশ৷ সারা পৃথিবী থেকে এগুলো সংগ্রহ করে এনেছেন বিশু মিত্তির৷ এটাই তাঁর শখ৷ মহিষের শিংওয়ালা আফ্রিকান উপজাতিদের কাঠের মুখোশ, ভয়ঙ্কর দেখতে রংচঙে তিববতি অপদেবতার মুখোশ, মধ্যযুগের সৈনিকদের ধাতব মুখোশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ডামিরা যে মুখোশ পরত, সেই মুখোশ৷ নানারকমের মুখোশ টাঙানো বিশুবাবুর বৈঠকখানাকে মুখোশের জাদুঘর বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ এমনকী, বিশুবাবুর নিজের মুখের মতো হুবহু দেখতে ল্যাটেক্সের তৈরি একটা মুখোশও তাঁর চেয়ারের ঠিক মাথার উপরই দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে৷ কেউ যেন তাঁর মাথা কেটে দেওয়ালের গায়ে বসিয়ে দিয়েছে৷ ইউরোপের কোনো দেশ থেকে নিজের এই মুখোশটা বানিয়ে এনেছেন তিনি৷

সৈকত দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে নেওয়ার পর বিশুবাবুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনার অন্তর্ধান রহস্য সম্বন্ধে এবার বলুন৷’

বিশুবাবু বললেন, ‘আমার মুখোশ সংগ্রহের বাতিকের কথা তো আপনার জানাই আছে৷ হঠাৎই এক অদ্ভুত মুখোশের খোঁজ পেয়ে আমি ছুটেছিলাম ভারত-ভুটান সীমান্তে এক জায়গায়৷’

‘সে কোন জায়গা?’ জানতে চাইল সৈকত৷

বিশুবাবু জবাব দিলেন, ‘সে জায়গা ম্যাপে তেমনভাবে আঁকা নেই, ট্রেক করে যেতে হয়৷ আপনাকে বললে ঠিক বুঝবেন না৷ পাহাড় আর জঙ্গল-ঘেরা সে জায়গায় ভুটানিদের এক প্রাচীন মন্দির মানে, ‘প্যাগোডা’ আছে৷ ড্রাগন প্যাগোডা৷ ভুটানের প্রাচীন আদিবাসী শরচপরা থাকে সেখানে৷ ভারী অদ্ভুত তারা৷ যে-কোনো পশুপাখি বা মানুষের গলার স্বর তারা হুবহু নকল করতে পারে৷ তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘ড্রাকো’ অর্থাৎ ‘ড্রাগন’ বলে৷ তারা যে ড্রাকো মুখোশ পরে, তা সংগ্রহ করতেই গিয়েছিলাম ওখানে৷’

সৈকত বলল, ‘এই অদ্ভুত জায়গার খোঁজ আপনি পেলেন কোথায়? মুখোশটা কই?’ এই বলে সে ঘরের দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাল সেটা খোঁজার জন্য৷

বিশুবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘এমনিতে ড্রাকোরা এই জঙ্গুলে জায়গা ছেড়ে বেরোয় না৷ কিন্তু দু-একজন লোককে তারা মাঝে-মাঝে বাইরে পাঠায় সভ্য পৃথিবী থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য৷ এক্ষেত্রে কিন্তু সভ্য পৃথিবী বলতে বোঝায় তরাইয়ের ছোটো-ছোটো গ্রাম৷ ওরকমই এক গ্রামে আমার এক এজেন্টের সঙ্গে এক ড্রাকোর যোগাযোগ হয়েছিল৷ আমি খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছবার পর সেই ড্রাকোই আমাকে নিয়ে যায় পাহাড়-জঙ্গল-ঘেরা তাদের আস্তানায়৷’

কথাগুলো বলতে-বলতে বিশুবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আবার ফিরে এলেন নিজের আসনে৷ তারপর টেবিল সংলগ্ন দেরাজ থেকে মাঝারি আকারের একটা চামড়ার ব্যাগ বের করে টেবিলের উপর রাখলেন৷ তার ভিতর থেকেই বেরিয়ে এল মুখোশটা৷ ড্রাগনের মুখোশ! বিশুবাবুর ঘরে ভয়ংকর দেখতে আরও অনেক মুখোশ আছে, কিন্তু এমন বীভৎস-হিংস্র মুখোশ এর আগে দেখেনি সৈকত৷ আঁশে ঢাকা মুখোশের মাথার দু’পাশে আঁকা ভাঁটার মতো হিংস্র চোখ, স্ফিত নাসারন্ধ্র দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, ছুঁচলো মুখমণ্ডলে হাঁ করা চোয়ালের উপর-নীচে সার-সার তীক্ষ্ণ দাঁত, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে লকলকে রক্তাক্ত সরীসৃপের চেরা জিভ৷ সব মিলিয়ে মুখোশটা যেন জিঘাংসার প্রতিমূর্তি৷ সৈকত চমকে উঠল মুখোশটা দেখে৷

বিশুবাবু বললেন, ‘ড্রাকোদের বিশ্বাস, এ মুখোশ পরলে নাকি অপদেবতাদের বশ করা যায়, নানা অতিপ্রাকৃত শক্তিকে জাগানো যায়!’

সৈকত বলল, ‘এ মুখোশটা ওরা আপনাকে এমনিতেই দিয়ে দিল?’

প্রশ্নটা শুনে বিশুবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিছু খরচ করতে হয়েছে, তবে তা বিশেষ কিছু নয়৷’

আর এর পরই সৈকতকে তিনি বেশ কিছুটা অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আমি এই মুখোশটা কয়েক দিনের জন্য আপনার কাছে রাখতে চাই, আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না?’

সৈকত বলল, ‘ঠিক আছে৷ কিন্তু আমার কাছে রাখতে চাইছেন কেন?’

মুখোশটা ব্যাগে ঢুকিয়ে তিনি বললেন, ‘আসলে এই দোতলাটা আমি রিপেয়ার করব৷ জিনিসপত্র সব সরাতে হবে৷ মুখোশগুলোও সব দেওয়াল থেকে নামাতে হবে চুনকাম করাবার জন্য৷ কয়েকদিন লাগবে কাজ মিটতে৷ এই মুখোশটা কয়েকদিন আপনার কাছে থাকুক৷ তারপর এটা এনে নতুন দেওয়ালে টাঙাব৷’

সৈকত আর এ প্রসঙ্গে কথা বাড়াল না৷ বিশুবাবু এর পর তাঁর অনুপস্থিতির সময়কালে শহরের খোঁজখবর জানতে চাইলেন৷ এই নিয়ে আলোচনা শুরু হল৷ শীতের বেলা, ঘণ্টাখানেক গল্পগুজবের পর মুখোশের ব্যাগটা নিয়ে সৈকত যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখন অন্ধকার নামতে শুরু করেছে৷

নিজের বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল সৈকত৷ তখনই পিছন থেকে ইংরেজিতে একটা প্রশ্ন কানে এল, ‘মি. বিশু মিত্রর বাড়ি এটা?’

সৈকত পিছন ফিরে দেখল গলির আধো-অন্ধকারে তার কয়েক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক৷ গায়ে একটা উইন্ডচিটার৷

টুপিটা মুখের উপর এমনভাবে নামানো, লোকটা মুখ বোঝা যাচ্ছে না৷

সৈকত জবাব দিল, ‘না, এটা ওঁর বাড়ি নয়, আপনি তিনটে বাড়ি পেরিয়ে যান৷ তারপর যে গলির মুখ, তাতে ঢুকে বিশু মিত্রর সদর দরজা৷’

 লোকটা তার কথায় মৃদু ঘাড় নেড়ে এগোল সে দিকে৷

দুই

বাড়ি ফিরে মুখোশের ব্যাগটা সৈকত যত্ন করে তার আলমারিতে রেখে দিল৷ পরদিন ভোরে উঠে আবার অফিসে ছুটতে হবে৷ সোমবার কাজের চাপ আবার বেশি থাকে৷ কাজেই রাত আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে দরজা-জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সৈকত৷ ঘণ্টা চারেক পর হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে গেল তার৷ সৈকতের মনে হল, বিশুবাবুর দোতলা থেকে যেন বার কয়েক আর্তনাদের শব্দ কানে এল৷ ঘুম চোখে উঠে জানলাটা খুলল সৈকত৷ কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই সে আর্তনাদ যেন থেমে গেল৷ জানলার তফাতেই নিঝুম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিশুবাবুর বাড়ি৷ কোনো আলো জ্বলছে না৷ হয়তো আর্তনাদের শব্দটা নিজের মনের ভুল৷ এই ভেবে শুয়ে পড়ল৷

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অন্য একটা শব্দ শুনতে পেল সে, কোকিলের ডাক৷ বিশুবাবুর বারান্দার দিক থেকেই এসেছে৷ জানলা খুলতেই ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ল সৈকতের ঘরে৷ কিন্তু পাখির ডাকটা বন্ধ হয়ে গেল৷ পাখিটাকেও দেখতে পেল না৷

সোমবার অফিসে কাজের বেশ চাপ থাকে৷ সপ্তাহের প্রথম দিন৷ সারাদিন আর বিশুবাবুর কথা মাথায় ছিল না সৈকতের৷ অফিস করে যখন সে পাড়ায় ফিরল, তখন গলির ল্যাম্পপোস্টে হলদেটে আলো জ্বলে উঠেছে৷ বিশুবাবুর বাড়ির কাছে এসে হঠাৎই কেন জানি তার মনে পড়ে গেল, গতকাল রাতে ঘুম চোখে শোনা আর্তনাদের কথা৷ বিশুবাবু তাঁর দোকান বন্ধ করে সাধারণত সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসেন৷ সৈকতরে এখন ফিরে তেমন কোনো কাজ নেই৷ তাই সে ঢুকে পড়ল বিশুবাবুর বাড়িতে৷

‘বিশুবাবু আছেন নাকি?’ হাঁক দিতে-দিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সৈকত পা রাখল বিশুবাবুর বৈঠকখানায়৷ নিজের চেয়ারে বসে কী যেন করছিলেন তিনি৷ সৈকত ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠে তার দিকে তাকালেন তিনি৷ বিশুবাবুর মাথায় টুপি, গলায় মাফলার, হাতে দস্তানা৷

সৈকত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বিশুবাবুর মুখোমুখি বসে জানতে চাইল, ‘সেজেগুজে বসে আছেন, বাইরে বেরোবেন নাকি?’

বিশুবাবু কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে, অস্পষ্ট ভাবে বললেন, ‘গলায় ভীষণ ব্যথা, ডাক্তার দেখাতে যাব৷’

সৈকত দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাতে-তাকাতে বলল, ‘পাহাড়ের দেশে গিয়েছিলেন তো, মনে হয় এটা তার রি-অ্যাকশন৷ দার্জিলিং থেকে ফিরে আমার একবার এরকম হয়েছিল৷’

বিশুবাবু তার কথায় শুধু ঘাড় নাড়লেন৷

সৈকত জানতে চাইল, ‘কোন ডাক্তারকে দেখাতে যাচ্ছেন?’

বিশুবাবু আবার অস্পষ্টভাবে বললেন, ‘দেখি কাকে পাই? গলায় খুব ব্যথা৷ সরি, কথা বলতে পারছি না৷’

তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন সম্ভবত বেরোবার জন্য৷

সৈকত উঠে পড়ল৷ তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, একটু সাবধানে থাকবেন৷ ওষুধপত্তর খেলেই ঠিক হয়ে যাবে৷’

সৈকতের ইচ্ছে ছিল, রাতের চিৎকারের শব্দের ব্যাপারে একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করে৷ বিশুবাবু কথা বলার মতো অবস্থায় নেই বলে সে আর কথাটা জানতে চাইল না৷ কিন্তু ঘর ছাড়ার আগে আরও একবার দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাতেই হঠাৎ কেন জানি তার মনে হল, এ ঘরে কী একটা জিনিস যেন অনুপস্থিত৷

সৈকত বাড়ি ফিরে এল৷ খাওয়া সেরে অন্য দিনের মতো ঠিক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে৷ কিন্তু মাঝরাতে এদিনও ঘুম ভেঙে গেল তার৷ তবে চিৎকার শুনে নয়, জানলাটা ভালো বন্ধ হয়নি৷ পাল্লাটা একটু ফাঁক করা৷ ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে৷ সৈকত উঠে জানলাটা বন্ধ করতে যেতেই তার এক চিলতে ফাঁক দিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল৷ চাঁদের আলো এসে পড়েছে সামনের কুয়াশামাখা বারান্দায়৷ সেই বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে সৈকতের জানলার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন বিশুবাবু৷ সৈকতের ঘরে বাতি নেভানো বলে তাকে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি৷ কিন্তু স্পষ্টতই তার ঘরটা দেখার চেষ্টা করছেন তিনি! তবে কি বিশুবাবু এত রাতে তাকে খুঁজছেন? সৈকত এই ভেবে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য পাল্লাটা খুলল, কিন্তু পরমুহূর্তেই বিশুবাবু অদৃশ্য হয়ে গেলেন কুয়াশামাখা ভুতুড়ে বারান্দার এক কোণে৷ আর এলেন না!

ভারী আশ্চর্য ব্যাপার তো! তাঁর তো ঠাণ্ডা লেগেছে৷ মাঝরাতে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে তিনি কী করছিলেন? অমন ভাবে অদৃশ্যই বা হলেন কেন? সৈকতের ব্যাপারটা বোধগম্য হল না৷ জানলা বন্ধ করে আবার সে বিছানায় এল৷ কিন্তু ঘুম আর এল না৷ আরও কিছুক্ষণ পর প্রায় শেষ রাতের দিকে স্পষ্ট দু’বার আর্তনাদ শুনতে পেল সৈকত৷ আর স্পষ্টতই সেটা ভেসে এল বিশুবাবুর বাড়ির দিক থেকেই৷ গলাটাও যেন বিশুবাবুরই৷ খাটে উঠে বসল সৈকত৷ অনেক ভেবেও ব্যাপারটার সে সমাধান করতে পারল না৷ এক সময় কোকিলের ডাক শোনা গেল৷ বিশুবাবুর বাড়ির দিক থেকে৷ ভোর হয়ে এল৷

অফিসে এদিন চাপ একটু কম ছিল৷ রাতে ঘুম হয়নি৷ টিফিনের পর চেয়ারে বসে একটু ঢুলছিল সৈকত৷ রাতের ব্যাপারটা মাঝে-মাঝেই মাথায় হানা দিচ্ছে৷ আশপাশের চেয়ারে বসে তার কলিগরা নিজেদের মধ্যে নানা কথা আলোচনা করছিল৷ কী একটা প্রসঙ্গে যেন একজন বলল, ‘আজকাল কলকাতা শহরে তো পাখিই দেখা যায় না!’

কথাটা কানে যেতেই সৈকত ঢুলুনি অবস্থাতেই বলল, ‘আমাদের পাড়ায় কিন্তু আছে৷ আজ ভোরেও আমি কোকিলের ডাক শুনেছি৷ গতকালও এই ডাকে আমার ঘুম ভেঙেছে৷’

এ কথা শুনে পাশের চেয়ারে বসা এক কলিগ বলল, ‘ঘুমের ঘোরে কী বলছেন মশাই! শীতের ভোরে কোকিল ডাকে? কোকিল তো বসন্তের পাখি!’

ঢুলুনি কেটে গেল সৈকতের৷ লোকটা তো ঠিকই বলল৷ ব্যাপারটা তো তার মাথায় আসেনি৷ তার পাড়ায় শীতে কোকিল ডাকে কী ভাবে? রাতের আর্তনাদের মতো এটাও তো এক রহস্যময় ব্যাপার৷ সৈকত ভেবে নিল ফেরার পথে একবার সে বিশুবাবুর বাড়িতে ঢুঁ মারবে৷

সন্ধের পর পাড়ায় ফিরে সে গিয়ে ঢুকল বিশুবাবুর বাড়িতে৷ তিনি তাঁর রিভলভিং চেয়ারে দেওয়ালের দিকে পিছন ফিরে বসে ছিলেন৷ সৈকত তার মুখোশ-ঘরে পা রাখতেই তিনি ‘আমি একটু আসছি’ বলে পাশের একটা ঘরে তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলেন৷ সৈকতের ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগল৷ সে ঘরে বসে দেওয়ালের গায়ের মুখোশগুলো দেখতে-দেখতে বিশুবাবুর প্রতীক্ষা করতে লাগল৷ কিন্তু আজও কেন জানি তার মনে হল, এ ঘরে কী একটা জিনিস যেন নেই৷ কিন্তু ব্যাপারটা সে ধরতে পারল না৷

মিনিট দশেক পরই বিশুবাবু ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসলেন৷ সিলিং থেকে নেমে আসা ফ্যাকাশে আলোয় তাঁর মুখটা কেমন যেন গম্ভীর মনে হল সৈকতের৷ সৈকত তাঁকে প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘আপনার শরীর কেমন আছে?’

‘ভালো না,’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন তিনি৷

একটু ইতস্তত করে সৈকত এর পর বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না৷ পরপর দু-রাত আপনার বাড়ি থেকে কেমন যেন চিৎকারের শব্দ শুনলাম৷ আপনারই তো গলা মনে হয়৷ ব্যাপারটা কী?’

বিশুবাবু কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলেন, ‘আমি চিৎকার করিনি!’

সৈকত একটু আমতা-আমতা করে বলল, ‘কিন্তু আমি তো স্পষ্ট শুনেছি…’

বিশুবাবু এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘বলছি তো, আমি ব্যস্ত আছি৷ বিরক্ত করবেন না৷ আপনি এখন আসুন৷’

সৈকত হতভম্ব হয়ে গেল তাঁর ব্যবহারে৷ আর থাকা চলে না৷ ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নীচে নেমে এল৷ একতলার উঠোন অতিক্রম করে সে যখন সদর দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছে, তখনই একতলার কোনো একটা বন্ধ ঘর থেকে সে শুনতে পেল একটা চিৎকার! কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ৷ গলাটা কার তা সে সঠিক ধরতে পারল না৷ তবে সেটা মানুষেরই গলার শব্দ৷ বিশুবাবু কাউকে তাঁর বাড়িতে আটকে রেখেছেন? রাতের শব্দটা তা হলে কি বিশুবাবুর নয়, সে লোকটারই আর্তনাদ? কিছু বুঝতে না পেরে সৈকত বেরিয়ে এল বাড়ি ছেড়ে৷ গলির মুখে পাশে বাড়ির রোয়াকে বসে ছিলেন অঘোরবাবু৷ একই পাড়ার লোক হিসেবে মুখ চেনাচিনি আছে তাঁর সঙ্গে৷ বিশুবাবুর সদর দরজা থেকে সৈকতকে বেরিয়ে আসতে দেখে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘বিশুবাবু কি বাড়িতে চিড়িয়াখানা খুলেছেন? দু-দিন ধরে দুপুরবেলা নানারকম পশুপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে?’

সৈকত একটু থমকে গেল তাঁর কথা শুনে৷ তারপর ‘জানি না,’ বলে হাঁটা লাগাল নিজের বাড়ির দিকে৷

তিন

বাড়িতে ফিরে এল সৈকত৷ বেশ অপমানিত বোধ করেছে সে বিশুবাবুর ব্যবহারে৷ সে ভাবল তার কাছে রাখা মুখোশটা কালই ফিরিয়ে দেবে বিশুবাবুকে৷ আলমারি থেকে ব্যাগটা নিয়ে মুখোশটা বের করে সেটা সৈকত একবার দেখল৷ তারপর মুখোশটা টেবিলে রেখে দিল৷

ঘরের কাজকর্ম, রাতের খাওয়া মিটে যাওয়ার পর বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সৈকত৷ জানলার পাল্লাটা ইচ্ছে করেই কিছুটা ফাঁক করে রেখেছে সে৷ সেটার ফাঁক দিয়ে বিশুবাবুর বারান্দা দেখা যাচ্ছে৷ ঘুম আসছে না সৈকতের৷ বিশুবাবুর বাড়ির ব্যাপারটা, তাঁর আচরণ বেশ গোলমেলে লাগছে৷ পুরো ব্যাপারটার মধ্যে নিশ্চিত কোনো রহস্য আছে৷ তাঁর বাড়ি থেকে আর্তনাদের শব্দ, পশুপাখির ডাক শোন যাচ্ছে কেন? অন্ধকার ঘরে শুয়ে রহস্যভেদের চেষ্টা করতে লাগল সে৷ বাইরে রাত বাড়তে লাগল, কুয়াশাও নামতে শুরু করল তার সঙ্গে৷ একটা কুকুর কোথায় যেন কেঁদে উঠল৷ পাড়াটা নিঝুম হয়ে গেল তারপর৷ এর কিছুক্ষণের মদ্যেই খাটে শোয়া অবস্থাতেই সৈকত দেখল, সন্তর্পণে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন বিশুবাবু৷ চাদর মুড়ি দেওয়া থাকলেও তাঁকে চিনতে পারল সৈকত৷ তারপর বিশুবাবু উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করলেন তার জানলার দিকে৷ সৈকত মড়ার মতো চুপচাপ শুয়ে তাকে লক্ষ করতে লাগল৷ বিশুবাবু মনে হয় এক সময় নিশ্চিন্ত হলেন সৈকত ঘুমিয়ে পড়েছে এই ভেবে৷ তিনি বারান্দা থেকে একটা লম্বা আঁকশি তুলে নিয়ে সেটা সৈকতের জানলার দিকে বাড়িয়ে তা দিয়ে পাল্লাটা বেশ অনেকটা ফাঁক করলেন৷ তারপর আঁকশি সরিয়ে নিয়ে একটা টর্চ বের করে আলো ফেললেন সৈকতের ঘরে৷ সরু টর্চের আলো সৈকতের দেহ ছুঁয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল ঘরের ভিতর৷ হঠাৎ আলোটা এসে থেমে গেল টেবিলের ওপর রাখা মুখোশটার ওপর৷ বিশুবাবুর মুখ থেকে চাদরটা খসে গিয়েছে৷ সৈকত দেখল, চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা বিশুবাবুর মুখটা কেমন যেন চকচক করছে৷ যেন আলো ফেলে এই জিনিসটা খুঁজছিলেন তিনি৷ আর এর ঠিক পরই হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল বিশুবাবুর বাড়ির ভিতর থেকে৷ ঠিক সেই মুহূর্তে সৈকতও উঠে বসে জানলা দিয়ে বলে উঠল, ‘বিশুবাবু ও বিশুবাবু, কী দেখছেন আপনি?’ পরমুহূর্তেই বিশুবাবু অদৃশ্য হয়ে গেলেন বাড়ির ভিতর৷

সৈকত সঙ্গে-সঙ্গে মনস্থির করে নিল এখনই সে যাবে বিশুবাবার বাড়ি৷ একটা বোঝাপড়ার প্রয়োজন৷ টেবিল থেকে মুখোশটা তুলে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় নেমে এল সৈকত৷ শীতের রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই৷ কুয়াশা মাখা রাস্তায় খয়াটে আলো ছড়াচ্ছে ল্যাম্পপোস্ট৷ গলি দিয়ে এগিয়ে সৈকত সোজা গিয়ে ঢুকল বিশুবাবুর বাড়িতে৷ অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বিশুবাবুর বৈঠকখানার দরজায় টোকা দিল সে৷

কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুললেন তিনি৷ চোখে-মুখে স্পষ্ট অসন্তাোষের ছাপ৷ তিনি বললেন, ‘এত রাতে আবার এসেছেন কেন?’

সৈকতও বেশ ঝাঁজের সঙ্গে জবাব দিল, ‘গল্প করতে আসিনি, কয়েকটা ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে এসেছি৷ কিছু প্রশ্ন আছে৷’

‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই,’ রুক্ষ ভাবে বললেন বিশুবাবু৷ এরপর তিনি সম্ভবত সৈকতের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই তাঁর নজর গেল সৈকতের হাতে ধরা মুখোশটার দিকে৷ তাঁর মুখের ভাব মুহূর্তের মধ্যে যেন বদলে গেল৷ বেশ মোলায়েম স্বরে তিনি বললেন, ‘দিন, মুখোশটা আমাকে দিন!’

সৈকত বলল, ‘এটা দিতেই তো এসেছি৷ কিন্তু তার আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে৷ আপনি আমার জানলায় লুকিয়ে উঁকি মারেন কেন? একটু আগে আঁকশি দিয়ে জানলা ফাঁক করে টর্চের আলো ফেলছিলেন কেন?’

বিশুবাবু কোনো জবাব না দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন সৈকতের দিকে৷ সৈকত ঘরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এর পর বলল, ‘আরও প্রশ্ন আছে৷ আপনার বাড়ি থেকে ইদানীং নানা ধরনের পশুপাখির ডাক শোনা যায় কেন? সবচেয়ে বড়ো কথা, রাতের বেলা কার চিৎকার ভেসে আসে আপনার বাড়ি থেকে?’

বিশুবাবু একই রকম চুপ করে রইলেন৷

সৈকত এক ঝলকে তাকিয়ে নিল ঘরের চারপাশ৷ মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, কী একটা জিনিস যেন ঘরে নেই৷ ব্যাপারটা সে ধরেও ধরতে পারছে না৷

বিশুবাবুকে চুপ করে থাকতে দেখে সে বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পেলাম না৷ কার চিৎকার শোনা যায়? আমার ধারণা, আপনি এ বাড়িতে কাউকে আটকে রেখেছেন৷ চিৎকারটা তারই৷ লোকটা পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে৷ সম্ভবত সে সেই জায়গার লোক, যেখান থেকে মুখোশটা আপনি এনেছেন৷ কিন্তু তাকে আটকে রেখেছেন কেন?’

বিশুবাবু তার কথা শুনে এবার কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘আপনার প্রশ্নের জবাব পেলে সত্যি মুখোশটা আমার হাতে দেবেন তো?’

‘হ্যাঁ, দেব৷’ জবাব দিল সৈকত৷

বিশুবাবু আর কোনো কথা না বলে ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বললেন৷

ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে এলেন তিনি৷ তাঁর পিছনে সৈকত৷ একতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা তালাবন্ধ ঘরে সামনে এসে বাইরে থেকে সুইচ টিপে ঘরের ভিতরের আলো জ্বালালেন তিনি৷ তারপর চাবি বের করে তালা খোলার আগে সৈকতকে তিনি বললেন, ‘দিন, মুখোশটা এবার দিন৷ আপনার সব কৌতূহলের নিরসন করছি আমি৷’ সৈকতের মনে হল, বিশুবাবুর গলাটা এবার কেমন যেন অন্যরকম শোনাল৷ সৈকত আর কথা না বাড়িয়ে এবার মুখোশটা তুলে দিল তাঁর হাতে৷

তালা খুলে ঘরে ঢুকল দুজন৷ ঘরের এক কোণে ধুলোর মধ্যে শুয়ে ছিল হাত-পা বাঁধা একজন লোক৷ তারা ঘরে ঢুকতেই লোকটা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল৷ আর সে লোককে দেখেই চমকে গেল সৈকত৷ আরে, এও তো বিশুবাবু! দুজন বিশুবাবু! একজন তার পাশে দাঁড়িয়ে, আর-একজন দড়ি বাঁধা অবস্থায় মেঝেয় বসে৷ কেমন করে সম্ভব?

আর এর পরই সৈকতের পাশে দাঁড়ানো বিশুবাবু হঠাৎ একটানে খুলে ফেলল তার মুখোশটা৷ সৈকতের পাশে এবার দাঁড়িয়ে আছে অন্য একটা লোক৷ তার চ্যাপ্টা নাক, নরুনচেরা চোখ, মাথায় ছোটো ছোটো চুল৷ ঠিক পাহাড়ি লোকদের মতো দেখতে৷ সৈকত এবার বুঝতে পারল, কেন তার বিশুবাবুর বৈঠকখানায় ঢুকলে মনে হচ্ছিল, কী একটা জিনিস যেন সে ঘরে নেই৷ যা ছিল না তা হল বিশুবাবুর সেই ল্যাটেক্সের মুখেশটা, যা পরে এতক্ষণ বিশুবাবু সেজেছিল তার পাশে দাঁড়ানো লোকটা৷ সে লোকটা এবার নিজেই সৈকতের উদ্দেশে বলল, ‘আমার নাম ড্রাকো থুপা৷ সেদিন আমিই আপনার কাছে এ বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ আপনাকে এ বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে পরে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আপনার বাড়িতেই আমাদের এই পবিত্র মুখোশটা চালান করেছেন বিশু মিত্তির নামে এই লোকটা৷ আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন আপনি একটা ব্যাগ নিয়ে এ বাড়ি থেকে আপনার বাড়িতে ফিরছিলেন৷ মুখোশের খোঁজেই আপনার ঘরে টর্চের আলো ফেলেছিলাম৷ আমাকে ক্ষমা করবেন৷ বিশুবাবু সেজে আপনাকে প্রতারিত করবার ইচ্ছে আমার ছিল না৷ বাধ্য হয়ে কাজটা করতে হয়েছে৷’

সৈকত এবার লোকটার দিকে তাকিয়ে, আর একবার বিশুবাবুর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত ভাবে লোকটাকে বলল, ‘এ সবেরে কী মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ বিশুবাবুকে কেন আপনি আটকে রেখেছিলেন?’

লোকটা এবার বিশুবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রথমে বলল, ‘এসব কথা ওঁকে জিজ্ঞেস করুন৷’ তারপর বলল, ‘উনি মুখোশটার খোঁজ দিচ্ছিলেন না, তাই৷ বিশ্বাস করে এ লোকটাকে আমার সঙ্গে আমার গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের এই পবিত্র মুখোশ মন্দির থেকে চুরি করে উনি পালিয়ে এলেন৷ তবে ওঁর মনে হয়, ধারণা হয়েছিল হয়তো আমি ওঁর পিছু নিতে পারি, তাই মুখোশটা আপনার কাছে উনি পাচার করে দিলেন৷ আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি আমার সঙ্গে আমার গ্রামে যেতে পারেন৷’

সৈকত লোকটার কথা শুনে বিশুবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কি ঠিক বলছে?’

সৈকতের কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলেন বিশু মিত্তির৷ সৈকত বুঝল, লোকটার কথা সম্ভবত মিথ্যে নয়৷ ড্রাকো থুপা নামের লোকটা এরপর সৈকতকে বলল, ‘পশুপাখির ডাকগুলো নিশ্চয়ই আপনার সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছিল? আসলে আমরা প্রকৃতির সন্তান, ওগুলো আমাদের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে৷ এবার আমি যাচ্ছি৷ অনেক দুর্গম পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে৷’

সৈকত বাধা দিল না৷ মুখোশটা নিয়ে ঘর ছেড়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরে কুয়াশায় হারিয়ে গেল লোকটা৷

মাথা নিচু করে বসে বিশুবাবু৷ সৈকত তাঁর বাঁধন খুলে দিয়ে কোনো কথা না বলে সে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *