ডোডোর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়

ডোডোর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়

খাবার টেবিল থেকে উঠে দুমদুম করে নিজের ঘরে চলে এল ডোডো৷ ধড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজাটা৷ তারপর একলা ফাঁকা ঘরে আর কীভাবে রাগ দেখাবে ভেবে না পেয়ে ঝপাস করে নিজের খাটের ওপর শুয়ে পড়ল৷ আর অমনি ঠিক তার কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, আহা অত রাগ করছিস কেন? দেখবি সব ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে৷

কথাগুলো শুনেই মাথাটা আবার সাংঘাতিক গরম হয়ে গেল ডোডোর৷ তক্ষুনি উঠে বসে কানের ভিতর আঙুল পুরে এমনভাবে ঝাঁকাল যেন কান থেকে পোকা বার করার মতো কথাগুলো বার করে দিতে চাইছে৷ যদিও নিজে ভালোমতোই জানে ওসব করে কোনো লাভ নেই৷ কথাগুলো তো আসলে কেউ বলেনি৷ ফাঁকা ঘরে কে তার কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলতে আসবে? এটা আসলে তারই মনের ভুল৷ তার মাথার ভিতরে থাকা কথাগুলোই মনে হয় যেন কানের পাশে ফিসফিস করে কে বলছে৷ তাই কানের সঙ্গে মাথাটাও একটু ঝাঁকিয়ে নিল ডোডো৷ যদিও মেজাজটা ভালো হল না মোটেই৷ আসলে ডোডোর কেমন যেন একটা বিশ্বাস আছে যে তার এই মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ফিসফিসে গলা যা বলে সেটা শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়৷ কিন্তু আজ তো তার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ এক্ষুনি এ-নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে এক পক্কড় ঝগড়া হয়ে গেছে তার৷ বাবা যদিও নীচু গলায় ডোডোর পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু মা একেবারে রণং দেহি মূর্তিতে দাঁড়িয়ে সব বানচাল করে দিলেন৷ মাঝখান থেকে মালতী মাসি চমৎকার কষা মাংস আর পরোটা বানিয়েছিল সেটা ভালো করে খাওয়া হল না ডোডোর৷

আসলে ডোডো ওরফে অর্ক সেনগুপ্ত হল একজন মাউন্টেনিয়ার৷ পাহাড়ে চড়তে সে ভালোবাসে৷ ছোটবেলা থেকেই পাহাড় তাকে ভীষণভাবে টানে৷ ডোডো যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন থেকেই সে পাড়ার ক্লাবের মেম্বার হয়ে শুশুনিয়া পাহাড়ে ট্রেক করতে গেছিল৷ তারপর যত বড় হয়েছে, তত পাহাড়ের উচ্চতাও বেড়েছে৷ সবুজ ঘাস আর ঘন জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেছে বরফের রাজ্যে৷ ছুঁতে চেয়েছে নীল আকাশ৷ ডোডোর মা-বাবা তাকে কখনও বাধা দেননি৷ বাবা চিরকাল উৎসাহই দিয়েছেন৷ মা অতটা না হলেও বরফের চূড়ায় দাঁড়ানো ছেলের সানগ্লাস পরা ছবি বেশ গর্বের সঙ্গে সাজিয়ে রেখেছেন বসার ঘরের তাকে৷ কিন্তু এবার যেন সবই কেমন উল্টেপাল্টে গেল৷

কলকাতার নামকরা মাউন্টেনিয়ার প্রীতম বসু মানে বোঁচাদা যখন ডোডোকে কথাটা বলেছিল, তখন ডোডো প্রথমটায় যেন বিশ্বাসই করতে পারেনি৷ এভারেস্ট অভিযানে যাবে বোঁচাদারা৷ তার জন্য যে দলটা ভাবা হয়েছে তার মধ্যে ডোডোর নামও রয়েছে৷ আনন্দে-উত্তেজনায় ডোডোর মনে হচ্ছিল যেন তার বুকটা ফেটে যাবে৷ ইচ্ছে হচ্ছিল বোঁচাদাকে জড়িয়ে ধরে নাচে৷ বোঁচাদা অবশ্য গম্ভীরভাবেই বলেছিল, সত্যিকথা বলছি ডোডো, তোর নামটা প্রথমে লিস্টে ছিল না৷ কিন্তু আমাদের অসীম লাস্ট মোমেন্টে জানিয়ে দিল যে ও যেতে পারবে না৷ তখনই আমার তোর কথা মনে পড়ল৷ তোর বয়সটা অবশ্য একটু কম, কিন্তু এক্সপিরিয়েন্স আছে৷ তুই পারবি৷ কিন্তু মুশকিল হচ্ছে হাতে আর সময় একদম নেই৷ যারা আমাদের ট্রিপটা স্পনসর করছে, তাদের কাছে নামের লিস্ট পাঠিয়ে দিতে হবে সোমবার মানে কালকের মধ্যে৷ সেজন্য বাড়িতে একটু কথা বলে নে৷ টাকা-পয়সার ব্যাপার আছে তো৷ তা ছাড়া বাড়ির লোকেরা যদি আপত্তি করে তাহলে আবার….

ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না বোঁচাদা, কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল ডোডো, আমার মা-বাবার কোনও আপত্তি হবে না৷ তুমি আমার নামটা ঢুকিয়ে আর যা যা কাজ এগোনোর করে রাখো৷ আমি আজ রাতেই বাড়িতে কথা বলে তোমাকে ফোন করব৷

বড় মুখ করে কথাগুলো বোঁচাদাকে বলে এসেছিল ডোডো৷ ভাবতেও পারেনি কথাটা বলামাত্র মা ওরকম কঠিনভাবে না বলে দেবেন৷ অবশ্য তার মা যেরকম মানুষ, তাতে ভাবা যে উচিত ছিল সেটা এখন বুঝতে পারছে৷ দু-বছর আগেই তাদের পাড়ার একটি মেয়ে এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে মারা গেছে৷ তারপর থেকেই ডোডোর পাহাড়ে চড়া নিয়ে মা যে একটু খুঁতখুঁতে হয়ে গেছে সেটা সে বুঝতে পারত৷ কিন্তু ডোডোর এভারেস্ট অভিযানের ইচ্ছেয় এরকম সাংঘাতিকভাবে ভেটো দেবে সেটা আন্দাজ করতে পারেনি৷ আর মা যদি একবার না বলে দেন, তাহলে হ্যাঁ করানো প্রায় অসম্ভব৷ বাবার দ্বারা হওয়ার নয়৷ এদিকে বাবা ছাড়া তো এমন কেউ নেই যে মাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারে৷ লোকের দাদু, দিদিমা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, পিসি, মামা কত কিছু থাকে৷ ডোডোর কেউ নেই৷ তার মা-বাবা দুজনেই একমাত্র সন্তান, ডোডোও তাঁদের একমাত্র সন্তান৷ দু-পক্ষেরই মা-বাবা মারা গেছেন বহুদিন৷ দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকতে পারে, কিন্তু তাদের কারুর সঙ্গেই কোনও যোগাযোগ নেই৷ আসলে মায়ের কাছে ডোডো শুনেছে, চাকরি জীবনের প্রথমদিকে বেশ কয়েকবছর তার বাবা মধ্যপ্রদেশের এক দুর্গম জায়গায় পোস্টেড ছিলেন৷ ডোডোর সেখানেই জন্ম হয়৷ তবে ডোডোর যখন বছর দু-এক বয়স, তখন বাবা অন্য চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন৷ ডোডো কলকাতাতেই বড় হয়েছে৷ মধ্যপ্রদেশের সেই জায়গার কোনও স্মৃতিই তার নেই৷

ডোডো এটা বুঝতে পারে যে সে একমাত্র সন্তান বলেই সম্ভবত, তার সম্বন্ধে মা-বাবা বিশেষ করে মা একটু বেশি সাবধানী৷ তার মানে কিন্তু এই নয় যে মা তাকে কিছুই করতে দেন না বা ঘরে আটকে রাখেন৷ খেলাধুলো, সাঁতার কাটা, পাহাড়ে চড়া সবই ডোডো ছোটবেলা থেকে করেছে৷ কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই মা আগেভাগেই যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে ছেলে কতটা নিরাপদ সেটা বুঝে নিয়েছেন৷ ডোডোর ক্ষেত্রে কোনওরকম ঝুঁকি মা নিতে রাজি নন৷ এতদিন ডোডো যেসব ট্রেকিং করেছে তার মধ্যে দু-একটা কিছুটা দুর্গম হলেও প্রাণের ঝুঁকি ছিল না৷ কিন্তু এভারেস্টের ক্ষেত্রে তো সেটা বলা যাবে না, অতএব মা বেঁকে বসেছেন৷

মুশকিল হচ্ছে, মায়ের এরকম স্বভাব জানা সত্ত্বেও ডোডোর কিন্তু চিরকালই একটু ঝুঁকির দিকে ঝুঁকে পড়া অভ্যাস৷ বিপদ যেন তাকে ডাকে৷ তবে আশ্চর্য ব্যাপার হল বিপদে পড়লেও ক্ষতি কিন্তু হয় না৷ মাথার মধ্যে ওই ফিসফিসানি যেন তাকে সাবধান করে দেয়, বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দেয়৷ ডোডো নিজে মনে করে এটা আসলে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়৷ মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন৷ একদম ছোটবেলায় ক্রেশে থাকত৷ কিন্তু তারপর থেকে একলা বাড়িতে থাকাটাই অভ্যাস৷ স্কুলবাস থেকে নেমে, নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে খাবার খেত৷ তারপর বারান্দায় বসে আপনমনে খেলত৷ ডোডোর বেশ মনে আছে, তার বন্ধু ছিল আসলে তার ছায়াটা৷ নিজের ছায়ার সঙ্গে সে দিব্যি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত৷ ছায়াও ঘাড় নেড়ে, হেসে, মাথা ঝাঁকিয়ে তার সব কথা শুনত৷ কথাটা একদিন মাকে বলাতে মা খুব হেসেছিল৷ তারপর থেকে আর কাউকে কখনও বলেনি ডোডো৷ কিন্তু ছায়ার সঙ্গে এই খেলাটা অনেকদিন চলেছে৷ কখন এটা বন্ধ হল আর মাথার মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হল সেটা এখন আর বলতে পারবে না ডোডো৷

তবে প্রথম যেদিন এই ঘটনাটা খেয়াল করেছিল, সেটা স্পষ্ট মনে আছে৷ সেদিন ওদের স্কুলে ফুটবল ম্যাচ ছিল৷ সেভেন থেকে টেন, এই চারটে ক্লাসের চারটে টিম৷ সেভেনের সঙ্গে খেলবে ক্লাস নাইন আর এইটের সঙ্গে ক্লাস টেন৷ ডোডো তখন ক্লাস সেভেন৷ ফুটবলটা সে চিরকালই ভালো খেলে৷ তাই ক্লাসের টিমে চান্স পেয়েছে৷ রোগা-পাতলা চেহারা৷ কিন্তু বল নিয়ে দৌড়োয় পাঁকাল মাছের মতো৷ অর্ক একবার পায়ে বল পেলে যে কেড়ে নেওয়া কঠিন সেকথা জানে স্কুলের ছেলেরা৷ সেদিনও পায়ে বল পেয়েই উল্টোদিকের গোলের দিকে পাঁইপাঁই করে ছুটছিল ডোডো৷ চোখের কোণ দিয়ে দেখেছিল নাইনের ডিফেন্ডাররা দৌড়ে আসছে৷ সবার আগে প্রসিত৷ পর পর দু-বার ফেল করে ক্লাস নাইনেই আছে৷ লম্বা-চওড়া দু-দিক থেকেই ডোডোর অন্তত দেড়া৷ কিন্তু ডোডো ভয় পায়নি মোটেই৷ সে জানত তার পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার মতো স্কিল প্রসিতের নেই৷ কিন্তু প্রসিতের মাথায় যে অন্য বুদ্ধি আছে সেটা তখনও বুঝতে পারেনি৷ বুঝল যখন ততক্ষণে সে ল্যাং খেয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে৷ আর তক্ষুনি প্রথমবার কানের কাছে শুনেছিল সেই ফিসফিস শব্দ, বাঁদিকে গড়িয়ে যা, বাঁদিকে গড়িয়ে যা এক্ষুনি৷

কিচ্ছু না ভেবে শুধুমাত্র রিফ্লেক্সে বাঁদিকে গড়িয়ে গেছিল ডোডো৷ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিল আর এক সেকেন্ড দেরি করলে প্রসিতের বুট পরা পায়ের লাথি এসে লাগত তার পাঁজরে৷

বাড়ি এসে কথাটা কাউকে বলেনি ডোডো৷ কারণ তার ভয় ছিল, এসব কথা শুনলে মা হয়তো তার ফুটবল খেলাটাই বন্ধ করে দেবেন৷ তবে ওই ফিসফিসানিটা নিয়ে সে আর বিশেষ মাথাও ঘামায়নি৷

দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল, তার প্রায় মাসখানেক পর৷ সেটা একটা রীতিমতো দুর্ঘটনাই বলা চলে৷ ডোডো তখন সুখেন্দু স্যারের কোচিংয়ে পড়ত৷ স্কুলফেরতা একেবারে টিউশন পড়ে আসাটাই ছিল নিয়ম৷ কিন্তু তখন গরমের ছুটি চলছে৷ তাই স্যারের ক্লাসটা হচ্ছিল সকালে৷ সুখেন্দু স্যারের বাড়িটা বেশ দূরে৷ তবে ডোডোদের বাড়ির কাছাকাছি যে বাসস্ট্যান্ড সেখান থেকে সোজা বাস আছে৷ ভোরবেলা ঘুমচোখে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ডোডো গিয়ে বাসে উঠেছিল৷ বাসটা প্রথমটায় চলছিলও বেশ ঢিকঢিকিয়ে৷ কিন্তু হঠাৎ একই রুটের আর একটা বাস পিছনে আসায় পড়িমরি করে ছুটল৷ দুটো বাসের এই রেসটা দিব্যি লাগছিল ডোডোর৷ রাস্তায় একটা চওড়া খাল পড়ে৷ সেই ব্রিজটা পেরিয়ে একটু গেলেই স্যারের বাড়ি৷ বাসটা যখন ব্রিজে উঠছে তখন ডোডো সিট ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ আর ঠিক সেই সময় স্পিডের মাথায় কন্ট্রোল হারিয়ে ব্রিজের রেলিং ভেঙে বাসটা ঝুলে গেল খালের দিকে৷ বাসটা কিন্তু জলে পড়েনি৷ মাঝখানে আটকে গেছিল৷ কিন্তু ডোডো দরজার কাছে ছিল বলে ছিটকে খালের জলে পড়ে গেছিল৷ সে তখনও সাঁতার জানে না৷ পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাঁকপাঁক করে যখন তলিয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হয়েছিল কে যেন তাকে ঠেলে ওপরের দিকে তুলে দিতে দিতে কানের কাছে ফিসফিস করছে, আলোর দিকে যা…. আলোর দিকে যা….

ডোডো যদিও আলো দেখতে পায়নি, কিন্তু কোনওরকমে মাথাটা একটু উঠতেই চুল ধরে একজন টেনে নিয়ে গেল ডাঙার দিকে৷ আসলে ততক্ষণে আশপাশের ছেলেপুলেরা জলে নেমে পড়েছে৷ তাদেরই একজন ডোডোকে উদ্ধার করেছিল৷ কিন্তু জলের নীচ থেকে কে যে তাকে ঠেলে তুলল, সেটা ডোডো আদৌ জানে না৷ পরে তার মনে হয়েছিল প্রাণ বাঁচাতে নিজের শরীরটাকে ভাসিয়ে রাখার একটা প্রাণপণ চেষ্টা হয়তো সে করেছিল যেটা সেই মুহূর্তে কাজে লেগেছিল৷

এত মারাত্মক না হলেও এই কানের কাছে ফিসফিস সে আরও অনেকবার শুনেছে৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পক্স হয়েছিল ডোডোর৷ অসুস্থ অবস্থায়, সিক বেডে পরীক্ষা দেওয়ার ভয়ে আগের রাতে সে যখন একলা একলা আকুলভাবে কাঁদছে, তখনও যেন সেই মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মনটা চুপিচুপি সান্ত্বনা দিয়েছিল তাকে৷ আশ্চর্যের ব্যাপার অত শরীর খারাপ নিয়েও পরীক্ষা দিতে কিন্তু কোনও কষ্ট হয়নি ডোডোর৷ মনে হয়েছিল সে যেন শুধু কলমটা ধরে আছে, তার হয়ে লিখে দিচ্ছে অন্য কেউ৷

উচ্চ-মাধ্যমিকের আগের দিন যখন অ্যাডমিট কার্ড হারিয়ে ফেলে পাগলের মতো অবস্থা তখনও ঠিক একইভাবে মাথার ভিতরে কেউ যেন বলে দিয়েছিল কার্ডের সন্ধান৷

এরকম হতে হতে কেমন যেন একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে ডোডোর৷ সে মনে করে যে তার কোনও বিপদ হবে না৷ বিপদের সম্ভাবনা যদি থাকে, তাহলে তাকে সতর্ক করে দেবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মানে ওই ফিসফিসে গলা৷ সে যদি খুব আন্তরিকভাবে কিছু চায়, আর ওই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি যদি বলে যে তার ইচ্ছেপূরণ হবে, তাহলে সেটাও নিশ্চিত হবেই৷

ডোডোর সবথেকে বিরক্তি লাগছিল কারণ তার এই যে আত্মবিশ্বাস, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ওপর এতটা ভরসা সেটা যেন ভেঙে যাচ্ছে৷ কালকে সকালের মধ্যে যদি বোঁচাদাকে কনফার্ম করা না যায়, তাহলে লিস্ট থেকে বাদ পড়তে হবে৷ মায়ের রাজি হওয়ার কোনও মাত্র লক্ষণ নেই৷ অথচ সেই ফিসফিসে গলা ক্রমাগত তাকে আশ্বস্ত করে যাচ্ছে৷ পুরো ব্যাপারটার জন্য নিজের ওপরেই নিজের একটা গুমগুমে রাগ হল ডোডোর৷ আর সেটা সামলাতে না পেরে খানিকটা চেঁচিয়েই বলে ফেলল, এই এক হয়েছে উটকো ঝামেলা৷ সারাক্ষণ কানের কাছে খালি ফিসফিস ফিসফিস৷ এবার মনে হচ্ছে নিজের জন্যই একটা ভূতের ওঝা ডেকে আনতে হবে৷

একলা ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছিস ডোডো?

দরজার কাছে মায়ের গলা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় ডোডো৷ কিন্তু এখন তো সে রেগে আছে৷ তাই গম্ভীরভাবে বলে, সে খোঁজে তোমার দরকার নেই৷ আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও৷

ডোডোর ঘরে মায়ের একটা পুরোনো আলমারি আছে৷ সেটা থেকে কোনও কাগজপত্র বার করতেই সম্ভবত ঘরে এসেছিলেন মা৷ তাই ছেলের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে আলমারিটা খুলে দু-একটা জিনিস বার করে নিয়ে চলে যান৷ মা বেরিয়ে যেতেই ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয় ডোডো৷ তারপর ফের খাটে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে৷ কিন্তু কোনওভাবেই মাকে রাজি করানোর কোনও উপায় মাথায় আসে না৷ ভাবতে ভাবতে মাথা যখন রীতিমতো গরম হয়ে উঠেছে, তখন ফের কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে, অত ভাবছিস কেন, দেখবি সব ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে৷

এইবার রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বিছানায় উঠে বসে ডোডো৷ দু-হাত শক্ত মুঠি করে প্রতিজ্ঞা করে পরদিন সকালে উঠেই সে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে৷ তার কোনও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দরকার নেই৷ এই ফিসফিসানি বন্ধ করার জন্য যা যা করা দরকার সবই সে করবে৷

মাথা ঠান্ডা করার জন্য উঠে জল খায় ডোডো৷ ঘাড়ে মাথায় জল দেয়৷ দরজা অল্প ফাঁক করে দেখে পাশের ঘরের আলো নিভে গেছে৷ মা-বাবা তার মানে শুয়ে পড়েছেন৷ ঘড়ির কাঁটাও বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ৷ শুয়ে পড়বে ঠিক করে আলো নেভাতে গিয়ে ডোডো দেখে আলমারির সামনে একটা খাম পড়ে আছে৷ সম্ভবত মা জিনিস বার করার সময় পড়ে গেছে৷ খামটা তুলে নিতে তার ভিতর থেকে দুটো ছবি বেরিয়ে পড়ে৷ দুটো বাচ্চা ছেলের ছবি৷ একটা বোধহয় বছর চারেকের৷ আর একটা নেহাতই ছোট৷ প্রথম ছবিটাতে বড় ছেলেটা ছোটটাকে কোলের মধ্যে চেপ্টে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ দ্বিতীয়টাতে বড়টা একটা ট্রাইসাইকেলে বসা৷ পিছনের সিটে ছোটটা বসে আছে৷ ছবির বাচ্চা দুটোর কোনওটাই ডোডোর চেনা নয়৷ ছোটটার ফুলো ফুলো গাল৷ দিব্যি ট্যাঁপাটোঁপা৷ বড়টার জোড়া ভুরু আর হাসিতে হালকা একটা চেনা চেনা আভাস৷ মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে বাচ্চা দুটো কে, কথাটা ভাবতে ভাবতে ছবি দুটো খামে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ে ডোডো৷ ঘুম যখন প্রায় এসে গেছে তখন হঠাৎ মনে হয়, তার বিছানার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ চমকে উঠে ডোডো দেখে ছবির দুটো ছেলের মধ্যে বড়টা এসে দাঁড়িয়েছে খাটের ধারে৷ তবে ছেলেটা এখন আর ছোট নেই৷ বেশ বড় হয়ে গেছে৷ ডোডোর থেকেও খানিকটা বড়৷ ডোডোকে তাকাতে দেখেই, ছেলেটা মুচকি হেসে বলে, কী রে চিনতেই পারলি না আমায়? ভাবছিস ওঝা ডাকবি নাকি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবি?

ধড়মড় করে উঠে বসে ডোডো৷ কেউ কোত্থাও নেই৷ তাহলে কি সে ঘুমিয়ে পড়েছিল? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল? এত স্পষ্ট স্বপ্ন? ছেলেটার গালের হাসির ভাঁজ পর্যন্ত তার চোখের সামনে ভাসছে৷ অস্থির মনে বিছানায় ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে ডোডো৷

প্রতিমা মানে ডোডোর মাকে অফিস যেতে হয় বেশ সকাল সকাল৷ রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি৷ তাই সকালে ডোডোর যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেছে৷ মা বেরিয়ে গেছেন৷ ফিরতে ফিরতে দুপুর তিনটে৷ কিন্তু ডোডোর মনের ভিতরটা এমন অস্থির লাগছিল যে সে কলেজ গেল না৷ প্রতিমা ফিরে ছেলেকে বাড়িতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেও মুখে কিছু বললেন না৷ মা কাপড় বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ডোডো৷ তারপর সরাসরি খামটা নিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এটা কার ছবি মা?

প্রতিমা চমকে উঠে, ছেলের হাত থেকে প্রায় খামটা ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, এটা তুই কোথা থেকে পেলি?

তোমার আলমারির সামনে পড়ে ছিল৷ কাল যখন কীসব বার করলে, তখনই মনে হয় পড়ে গেছে৷ কিন্তু ছবিটা কার, তুমি এত আপসেটই বা হচ্ছ কেন?

ছবির খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন প্রতিমা৷ ডোডো বুঝতে পারে, মায়ের চোখ দুটো ক্রমশ জলে ভরে যাচ্ছে৷ তারপর একটু সামলে নিয়ে বলেন, এই একদম ছোট বাচ্চাটা হচ্ছ তুমি আর অন্যটা তোমার দাদা সূর্য৷

আমার দাদা! আমার কোনও দাদা আছে নাকি?…..

ডোডো রীতিমতো হতবাক৷

আছে নয় ছিল৷ সূর্য আমাদের প্রথম সন্তান৷ তোমার থেকে চার বছরের বড়…..

কোনওদিন তো এসব কথা শুনিনি মা৷

বলিনি কোনওদিন৷ বলার তো দরকারও হয়নি৷ নিজের বুকের ভিতর পুষে রাখা যন্ত্রণাকে কে আর খুঁড়ে বের করতে চায় বলো৷ আমি আর তোমার বাবা ছাড়া আর বিশেষ কেউ জানেও না৷ আমরা তখন মধ্যপ্রদেশে থাকতাম৷ ওখানেই সূর্য মারা যায়৷ তার বছরখানেক পরেই তোমার বাবা ওই চাকরিটা ছেড়ে দিলেন৷ আসলে ওখানে আমরা আর থাকতে পারছিলাম না…….

কী হয়েছিল মা, কী করে দাদা মারা গেল?

প্রতিমা অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বিকেলে তুই সামনের বাগানে খেলা করতিস৷ তখন অল্প অল্প হাঁটতে শিখেছিস৷ সেদিন বাগানের গেট খোলা পেয়ে রাস্তার দিকে চলে গেছিলি৷ সূর্য একটু পরে গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখে তুই প্রায় মাঝরাস্তায় আর ভীষণ জোরে একটা ট্রাক আসছে৷ ও কোনওরকমে তোকে ঠেলে সরিয়েছিল, কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেনি৷ ট্রাকের চাকায় ছোট্ট শরীরটা পিষে……ভাইকে খুব ভালোবাসত সূর্য৷ ভাই-অন্ত প্রাণ ছিল…

দরদর করে চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে প্রতিমার৷ নিঃশব্দে বসে থাকে ডোডো৷ নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে প্রতিমা বলেন, এইজন্যই আমি তোর সম্বন্ধে এত সাবধানী ডোডো৷ একবার সন্তান হারানোর শোক সহ্য করেছি তো৷ আর সেদিন তোকে বাঁচানোর জন্য একজন ছিল, আজ তো কেউ নেই বাবা…..

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ডোডো বলে, তুমি চিন্তা কোরো না মা৷ সেদিন যে ছিল সে আজও সবসময় আমার পাশে থাকে৷

ডোডোর বাবা ভারী আশ্চর্য হয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রতিমা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে পাঠালেন বোঁচাদার সঙ্গে কথা বলে এভারেস্ট এক্সপিডিশনের লিস্টে ছেলের নামটা ঢোকাতে৷ ডোডো অবশ্য খুব একটা আশ্চর্য হয়নি৷ বোঁচাদাও খুশিই হয়েছিলেন৷ পরের স্টেপগুলো সবই এগোল স্বচ্ছন্দে৷ নানা ব্যস্ততার মধ্যে দিন কেটে গিয়ে কেমন যেন হুহু করেই এসে পড়ল যাত্রা শুরুর সময়৷

পিঠে রুকস্যাক বেঁধে মা-বাবাকে প্রণাম করে বেরোল ডোডো৷ প্রতিমা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন৷ অনেকদিনের অভ্যাস৷ গেটের কাছ থেকে ছেলে একবার হাত নাড়ে৷ সবুজ টি-শার্ট আর জিনস পরা ডোডো হাত তুলল৷ প্রতিমা স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তার পাশে আরও একজন হাত নাড়ছে৷ মুখটা ভালো বোঝা যায় না৷ কিন্তু হাসিটা বড্ড চেনা৷

দুগগা দুগগা…ওদের সাবধানে রেখো ঠাকুর…..

অস্ফুটে ঠোঁট নড়ল মায়ের৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *