বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু হাওয়ার দাপট রয়েছে তখনও। কর্দমাক্ত কাঁচামাটির রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এ পথের যেন শেষ নেই। ষ্টেশন থেকে জগদীশের গ্রাম যে কতদূর তা আমি জানি না। শুনেছিলাম, খুব বেশী দূরে নয়, কিন্তু এখনও আমরা জগদীশের গ্রামের সীমানায় আসতে পারিনি। দু’ঘণ্টার বেশী সময় ধরে আমরা হাঁটছি অথচ গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম না। মনটা বিচলিত হয়ে উঠল। আমি জগদীশকে শুধালাম, আর কতদূর জগদীশ?
কথাটা জগদীশের কানে যেতেই সে থমকে দাঁড়াল। বিস্ময়সূচক শব্দ করে বললে, তাইতো স্যার! আমরা কি তবে পথ ভুল করলাম। এত বেশী সময় লাগবার কথাতো নয়! তাছাড়া এ পথটা কেমন যেন অচেনা অচেনা ঠেকছে।
সে কি? মিঃ মুখার্জিকে আমি বললাম, হা হুতাশ করে কোন লাভ নেই, অন্ধকারের মধ্যে জগদীশ ভুল পথে এসে পড়েছে। আমার মনে হয় পুনরায় এগিয়ে না গিয়ে ষ্টেশনে ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অন্ততঃপক্ষে মাথা গুঁজে থাকবার একটা ঠাঁই মিলবে।
তাই বরং চলুন! আমরা ষ্টেশনেই ফিরে যাই। মিঃ মুখার্জি হতাশস্বরে বললেন।
আমরা তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পিছনের দিকে তাকিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। যাবো কোথায়? গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক, পথের কোন নিশানাই নজরে পড়ছে না। পরিবর্তে দেখা গেল ঘন ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। যা ভেদ করে এগুবার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে একটা প্রশ্ন সেখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আমাদের মনে, আমরা তাহলে এলাম কি করে? আর এলামই বা কোন পথ দিয়ে। নীলাভ আলোকে যে পথ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, সেই পথটাই বা গেল কোথায়?
হঠাৎ জগদীশের ভয়ার্ত চিৎকার আমাকে সচকিত করে তুলল।
সেই ঘনান্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কয়েক জোড়া জলন্ত চোখ। আগুনের গোলার মত সেই চোখগুলো স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। শির শির করে উঠল সারা শরীর। একটা ভয়াবহ অনুভূতি শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে লাগল।
জগদীশ প্রাণপণে রামনাম জপ করছে। মিঃ মুখার্জি আতংকে নির্বাক হয়ে গেছে। অপলক দৃষ্টি মেলে ঐ রক্তলাল চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মনে হল, চোখগুলো যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। চোখগুলো যেন অপেক্ষাকৃত হারে ক্রমান্বয়ে বড় আকার ধারণ করে এগিয়ে আসছিল। চোখের মালিকদের দেহগুলি কিন্তু এখনও আমাদের আগোচরে ছিল।
হঠাৎ মনে পড়ল হরিনারাণের কথা। আমার প্রথম রজনীর অভিজ্ঞতার কথা। যে গরুর গাড়ীতে করে হরিনারাণ আমাকে ডাকিনী ভিলাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই শকটের গরুগুলো ছিল ড্রাগন-গরু, যাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অগ্নি উদ্গীরণ হতে দেখেছি। যাদের চোখগুলো ছিল ঠিক এই রকমই বড় বড় আকারের এবং রক্তের মত লাল।
তাহলে এরা কি সেই ড্রাগন-গরু? ডাকিনী ভিলার পাইপ বেয়ে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল? হরিনারাণের হস্তক্ষেপের ফলে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম? কিন্তু এখন, এই অরণ্যের অন্ধকারে এদের আক্রমণ থেকে কে রক্ষা করবে আমাদের?
.
ভেবে কোন লাভ হবে বলে মনে হল না, বরং বিপদকে মোকাবিলা করাটাই যেন সংগত বলে মনে হল। আর মনে হওয়া মাত্রই আমার সাহস ফিরে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশ-বাতাস-অরণ্য কাঁপিয়ে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ শীসের মত কান্নার শব্দ। যে শব্দ মানুষকে মুহূর্তে দিশেহারা করে দেয়।
আমি মনকে শক্ত করে ফেলেছিলাম। ওই কান্নার শব্দ কানের মধ্যে দিয়ে মগজে ঢুকে অঘটন ঘটবার প্রয়াস চালালেও আমি নিজেকে নিজের আয়ত্বে রাখতে সমর্থ হলাম। পরিবেশ এখানে যতই ভয়ংকর হোক না কেন, ডাকিনী-ভিলায় রাত্রিবাসের চেয়ে নিশ্চয়ই নয় । তা ছাড়া, হরিনারাণ যখন আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তখন এটুকু আশা করা যায় যে এইসব অশুভ শক্তি আমার তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। এই কথাটা মনে উদয় হতেই আমার মানসিক শক্তি যেন দ্বিগুণিত হয়ে উঠল।
হঠাৎ একটা তীব্র চীৎকার করে মিঃ মুখার্জি ছুটতে লাগল দিগবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ ছুটে চলল মুখার্জিকে তাড়া করে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা বিরাট গরু ছুটে চলেছে মুখার্জিকে ধরবার জন্যে। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে আগুনের ঝলক। বুঝলাম এই সেই ড্রাগন-গরু। আমি চিৎকার করে মুখার্জিকে ফিরে আসতে অনুরোধ জানালাম কিন্তু আমার চিৎকার মুখার্জির কানে পৌঁছেছে বলে মনে হল না।
চমকে উঠলাম একটা তপ্ত অনুভূতিতে। আমার অদূরেই আর একটি ড্রাগন-গরু এসে হাজির হয়েছে। তার নিঃশ্বাসে নির্গত হচ্ছে ঝলকে ঝলকে আগুনের শিখা। সেই শিখায় যে তাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তারই কিছুটা আমার গায়ে এসে পড়ছে!
নিঃসহায় অবস্থায় আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্যকোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। জগদীশ ঠিক আমার পিছনটায় দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে আর অনর্গল রামনাম উচ্চারণ করছে। আমি নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম চরম পরিণতির অপেক্ষায়।
সপাং! সপাং! শব্দে পুনরায় চমকে উঠলাম। বুক থেকে যেন একটা দশমণী বোঝা নেমে গেল। ড্রাগন-গরু আর আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্বয়ং হরিনারাণ। তার হাতে উদ্যত চাবুক। মুহূর্তের মধ্যে ড্রাগন-গরু অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোপ-ঝাড়ের অভ্যন্তরে। আর কোন চোখই দেখা গেল না কোনদিকে।
আমি চিৎকার করে বললাম, হরিনারাণ প্লিজ। মুখার্জিকে বাঁচাও!
তোমাকে অযথা দায়িত্ব গ্রহণ করতে নিষেধ করেছি দাদা, হরিনারাণ বললে, কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছো না। কখন যে বিপদ ঘটে যায় তার ঠিক নেই। তোমার উচিত ছিল, সকালের ট্রেনেই এ স্থান ত্যাগ করে যাওয়া। তুমি তা না করে সারাটা দিন ঘুমিয়ে রইলে। তোমার প্রতি আমি যে দায়িত্বটুকু দিয়েছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করে ফেল।
তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো হরিনারাণ, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, কিন্তু মিঃ মুখার্জিকে তুমি বাঁচাও!
এখন আর তা সম্ভব নয় দাদা, −বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে হরিনারাণ বললে, আবার বলছি, নিজের ছাড়া অপরের কথা চিন্তা না করাটাই মঙ্গলজনক। মানুষ একদিন না একদিন মরবেই। সুতরাং মুখার্জির কথা ভুলে গেলেই তোমার পক্ষে সুখকর হবে। তাছাড়া আমাদেরও তো খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে। সুযোগ পেলে আমরা তার সদ্ব্যবহার করবোই। মুখার্জির মত শত শত লোককে যদি বাঁচাতে চাও তবে দেরী না করে যা বলছি তাই করো।
মাথাটা ঘুরে উঠল হরিনারাণের কথায়! মুখার্জি আর বেঁচে নেই ভাবতেই মনটা ভীষণ মুষড়ে পড়ল। আমি ছুটলাম মুখার্জির খোঁজে। আমাকে অনুসরণ করল জর্গদীশ।
জগদীশ সঙ্গে থাকায় মনে যথেষ্ট জোর পেলাম। একজন জীবন্ত মানুষের সাহচর্য আমার একান্তই- প্রয়োজন ছিল তখন। জগদীশও আমার উপর ভরসা রেখে নিজেকে সাহসী করে তুলেছিল। আর সেই কারণেই সে বেঁচে গেল এ যাত্রায়।
.
একটা ঝোপের ধারে মুখার্জি পড়েছিল। গা বরফের মত শীতল। বেচারা! ড্রাগন গরুর খোরাক হয়ে প্রাণটা হারাল। মনটা শক্ত করে ফেললাম, সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছুটতে হবে গয়ার পথে। বিষ্ণু পাদ-পদ্মে পিণ্ডদান করে এই সব হতভাগাদের পাপমুক্ত করতে না পারলে এমনতর বহু প্রাণ এদের হাতে বলি হবে।।
তুমি রাস্তা চিনে ষ্টেশনে যেতে পারবে জগদীশ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কোনদিকে যে ষ্টেশন তাই বুঝতে পারছি না স্যার। জগদীশ নিরাশ কণ্ঠে বললে, ব্যাপার-স্যাপার দেখে তো আমার পেটের মধ্যে পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে স্যার!
তাহলে এক কাজ করা যাক, −আমি বললাম, আজ রাতের মত আমরা এই বনের মধ্যেই অপেক্ষা করি, সকাল হলে দিনের আলোয় পথ চিনতে কষ্ট হবে না। আরও একটা কাজ আমাদের করতে হবে। মিঃ মুখার্জির সৎকারের ব্যবস্থা। তুমি বরং কিছু শুকনো ডাল-পালা জোগাড় করে আনো। মুখার্জির দেহটা দাহ করতে হবে তো!
সেই ভালো, জগদীশ আমার কথায় সায় দিয়ে বললে, মুখার্জি সাহেবের সৎকার করার ব্যবস্থা ক্রতে করতেই ভোর হয়ে যাবে।
আশেপাশের ঝোপ ঝাড় থেকে জগদীশ কাঠ সংগ্রহ করতে লাগলো, আমিও তাকে সাহায্য করতে লাগলাম। বরাত ভালো বলতে হবে। এদিকটায় মোটেই বৃষ্টি হয়নি। গাছপালাগুলো সব খটখটে শুকনোই ছিল। অসুবিধায় পড়তে হল না। রাশিকৃত গাছের ডাল-পালার মধ্যে মুখার্জির দেহটাকে চাপিয়ে দিয়ে অগ্নিসংযোগ করতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল ডাল-পালার স্তূপ।
আগুনের আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠল। যেটুকু ভয় অন্ধকারের মধ্যে দানা পাকিয়ে তখনও ভয় দেখাবার প্রয়াস পাচ্ছিল, তা দূর হল। মনটা বেশ হাল্কা হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই জগদীশ আমার আরও কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বললে, বড্ড ভয় করছে বাবু!
ভয় করছে! কি যে বল জগদীশ তার ঠিক নেই! আমি সাহস দিয়ে বললাম।
না বাবু, আমি ঠিকই বলছি, আপনি একবার চারিদিকটা লক্ষ্য করে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। জগদীশের গলার স্বর ভয়ের চোটে জড়িয়ে যাচ্ছিল।
সংক্রামক ব্যাধির মত আমার মনের মধ্যেও সংক্রামিত হল ভয় ভয় ভাব। চারদিক দৃষ্টিপাত করতেই মনে হল জগদীশ সত্যি কথাই বলছে। মুখার্জির চিতার আগুনে চারিদিক আলোকিত হলেও গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে কারা যেন সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। কয়েকটা বড় বড় গাছের মাথায় যেন কারা সব বসে আছে লোলুপ চোখে। শত সহস্র অদৃশ্য চক্ষু যেন আমাদের লেহন করে চলেছে। আমরা যেন এক সুপরিকল্পিত ফাঁদের মধ্যে পড়ে আটকে গিয়েছি। যেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন পথই খোলা নেই।
একটা দমকা হাওয়া এসে চিতার লেলিহান শিখাকে নাড়া দিয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে চারিদিকের গাছপালারাও যেন হিঃ হিঃ করে হেসে উঠে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ল। জগদীশ প্রচণ্ডভাবে ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বিড় বিড় করে কি যে বলল বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু তার হাতটা একদিকে প্রসারিত করে কিছু যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেদিকে তাকাতেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো। বড় বড় গাছগুলির মাথা থেকে বিরাট বিরাট ডানাওলা কতকগুলি জীব নেমে আসছিল আমাদের দিকে। অনেকটা শকুনের মত দেখতে কিন্তু আকারে শকুনের থেকেও অন্ততঃপক্ষে তিনগুণ বড়। মুখটা দেখলে সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে। এত বিশ্রী চেহারার মুখ বোধকরি কোন জন্তু বা জানোয়ারের নেই। একটা অদ্ভুত ধরণের কর্কশ ধ্বনি নির্গত হচ্ছিল ‘ওদের মুখ থেকে। সেই শব্দে শরীরের স্নায়ুগুলো আমাদের অবশ হয়ে আসছিল।
জগদীশকে সজোরে একটা ধাক্কা মেরে বললাম, সাহস হারালে মরতে হবে জগদীশ। কাপুরুষের মত মরবে কেন, বরং এসো চিতাগ্নি থেকে দুটো জলন্ত কাঠের টুকরো নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে কোন লাভ হবে না।
একলাফে একটা জলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম। জগদীশও একটা জলন্ত কাঠ হাতে তুলে নিল। কাঠদুটো ঠিক মশালের মত কাজ করল। হাতের দিকটায় তখনও আগুন ধরেনি। উঁচু করে ধরে আমরা প্রস্তুত হয়ে রইলাম, শকুনরূপী শয়তানের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে।
ভারী আশ্চর্য ব্যাপার! জানোয়ারগুলো আর এগুলো না। ঝটপট ডানার শব্দ করে উড়ে গেল বড় বড় গাছগুলোর মাথায়। অতিকায় অদ্ভুত জীবগুলোকে এখন আরও পরিষ্কার দেখতে পেলাম। যা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই আর ওদের দেখা গেলনা। ওরা যেন হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। পূবাকাশে তখন ভোরের আলোয় রং ধরছে। গাছগাছালি ঘিরে যে অন্ধকার বিরাজ করছিল তা যেন মূহূর্তে অপসৃত হয়ে গেল।
রাতের ভয় দিনের আগমনে সাহস হয়ে ফিরে এলো আমাদের মনে। আমি জগদীশকে নিয়ে বনের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি জরাজীর্ণ বাড়ী। চিনতে অসুবিধা হল না। এই সেই ডাকিনী ভিলা।
আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে ডাকিনী ভিলার দিকেই চলে এসেছিলাম। জগদীশ তাই নিজের গ্রামের পথ চিনতে পারেনি। হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুৎ ঝলকের মত মনের মধ্যে খেলে গেল। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। হরিনারাণ মুক্তি পাবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু গয়ায় পিণ্ডদান করলেই কি তারা মুক্ত হবে! যতদিন ওদের দেহ কববের মধ্যে থাকবে ততদিন ওরা রাতের অন্ধকারকে ভর করে উঠে আসবে কবরের বাইরে। আর ক্রয়ান্বয়ে একের পর এক শত শত মানুষ ওদের হাতের শিকার হবে। সুতরাং ওদের সত্যিকারের মুক্তি দিতে হলে মুখার্জি বাবুর মত ওদের দেহগুলোকে দাহ করা, দরকার।
কথাটা মনের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। শয়তানের বাসস্থান ডাকিনী ভিলাকে আজ যেন আমার ভালই লাগল। বিন্দুমাত্র ভয়ের উদ্রেক হল না। লোছার মরচে ধরা গেটটা খুলে এগিয়ে চললাম কবরখানার দিকে।
প্রথমেই ইলার কবরটা খুঁড়ে ফেললাম। আশ্চর্য। সেই মুখ, সেই চাউনি, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ইলা। শরীরের কোথাও কিছুমাত্র পচনের চিহ্ন নেই। তারপর খুললাম হরিনারাণের কবর। শান্ত সমাহিত সৌম্যমূর্তি হরিনারাণের। তেজদীপ্ত মুখমণ্ডল থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্বর্গীয় সুষমা। পর পর যতগুলি কবর ছিল সবগুলি থেকে তুলে আনলাম মৃতদেহগুলি।
হরিনারাণের দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হচ্ছিল, একটি মাত্র সৎ আত্মা কতগুলি অসৎ আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। এইসব সৎ আত্মার জন্যেই পৃথিবী আজ এত সুন্দর হয়েছে মানুষের কাছে। শত সহস্র অসৎ আত্মা থাকা সত্ত্বেও। …কিন্তু যদি সব আত্মাই অসৎ-এর যুপকাষ্টে নিজেদের বলি দেয় তবে? তাহলে পৃথিরী আর সুন্দর থাকবে না। নরকের কীটে ভরে উঠবে সুন্দরের থালা। প্রাণ থেকেও প্রাণহীন জীবন যাপন করবে ধরিত্রীর মানুষ।
.
কি ভাবছেন বাবু? জগদীশের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ভাই জগদীশ প্রচুর কাঠ আর ডালপালা দরকার। এইসব দেহগুলিকে দাহ করতে হবে। তা হলেই তোমাদের এ অঞ্চল ভয় মুক্ত হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই হতভাগ্যের দল মুক্তি পাবে।
জগদীশ কি বুঝলো বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সে কাল বিলম্ব না করে কাঠ সংগ্রহে মনোনিবেশ করল।
স্তূপীকৃত কাঠ আর গাছের ভালপালা দিয়ে তৈরী চিতায় শবদেহগুলি সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। একটি সৎ আত্মার জন্যে অনেকগুলো আত্মা শান্তি লাভ করলো।
কালো খাতাটা সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যের আগেই হাজির হয়েছি ষ্টেশনে। হরিনারাণের একান্ত অনুরোধ আমাকে রাখতে হবে।
যথা সময়েই শেষ গাড়ীটা এসে পৌঁছাল ষ্টেশনে। জগদীশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে আমার হৃদয়। আমি এক মহান দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি। গয়ায় গিয়ে এই কালো খাতার কালো মানুষগুলোকে বিষ্ণু পাদ-পদ্মে সমর্পন করতে।
-সমাপ্ত-