ডাকিনী ভিলা – ৪

আমার চিন্তা ভাবনা যেন কোন অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। হরিনারায়ণের কথাগুলো মনে হচ্ছিল যেন বহুদূর হতে আসছে। কথা শেষ হতেই অমার চমক ভাঙলো। তাকয়ে দেখি হরিনারাণ নেই। সে চলে গেছে।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে কেবলমাত্র জানালাটা খুলে রাখলাম। প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে শরীর মন কাহিল হয়ে পড়েছিল। পা দুটোকে টেবিলের উপর তুলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। দৃষ্টি চলে গেল জানলার মধ্য দিয়ে দূরের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝোপ-ঝাড়ের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। ক্ষনেকের জন্যে ভুলে গেলাম সবকিছু। চোখের সামনে যা দৃশ্য ভেসে উঠল, আমার জীবনে তা কোনোদিন দেখিনি, চুম্‌কি আলোর ঝাড়। থরে থরে আলোকিত করে রেখেছে সামনের গাছ-গাছালিতে ভরা প্রান্তরকে। অপরূপ দৃশ্য। মোহিত না হয়ে পারা যায় না। মনে হয় কোটি কোটি শুভ্র বেলফুল ফুটে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সত্যি বলতে কি আমি কলকাতার লোক। একসঙ্গে অত জোনাকী পোকার সমারোহ কোনদিন দেখিনি। এ দৃশ্য লিখে প্রকাশ করা যায় না। এ দৃশ্য অনুভব করতে হয় মাত্র। যেন ফুলের চাদর দিয়ে সারা অঞ্চলকে মুড়ে রেখেছে।

তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে মনে হল, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক দিয়ে মহাশূন্যের গভীরতম প্রদেশে বিচরণ করছি আর অসংখ্য নক্ষত্র ঝিকমিক্ করে জ্বলছে মহাকাশের বুকে। আর সেই মহাকাশের মাঝখানে প্রাণের প্রতীক হয়ে আমি অনুভব করছি সৃষ্টি রহস্য। অনুভূতি অথবা আনন্দ অথবা আরও অন্য কিছু যার স্পর্শে আমার অন্তর ভরে উঠল এক অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে। আমি পলকহীন নেত্রে সেই অপার্থিব সুধা সঞ্চয় করতে লাগলাম মন-প্রাণ ভরে।

দেখতে দেখতে বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল একটা শব্দে। একটা শৃগাল জানলা দিয়ে লাফিয়ে ঢুবে পড়েছে ঘরের মধ্যে আমি কিছু করার আগেই একটা লোমশ হাত জানলা দিয়ে ঢুকে শেয়ালটাকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। একটা কাতর অন্তিম-ধ্বনি শোনা গেল শৃগাল-কণ্ঠের।

আমি দ্রুত জানলার ধারে গিয়ে ব্যাপারটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করতেই দেখতে পেলাম কয়েকহাত দূরে একটা না-মানুষ না-পশু শ্রেণীর জীব শৃগালটাকে তার মুখের কাছে চেপে ধরছে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই জীবটি ছুঁড়ে ফেলে দিল শৃগালটাকে। বুঝতে পারা গেল, শৃগালটি আর বেঁচে নেই। পিশাচটা ওর শরীরের সবটুকু রক্তই শুষে নিয়েছে।

ফিরে এসে চেয়ারটায় বসতে না বসতেই আবার ভেসে এল সেই অমানুষিক ধ্বনি। তীক্ষ্ণ, তীব্র কান্নার রেশ। তার কয়েক মিনিট পরেই জানলার ধারে দেখা গেল ইলাকে! লোভাতুর চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

ঘৃণায় সারা শরীর জ্বলে উঠল আমার। চীৎকার করে বলে উঠলাম দূর হও এখান থেকে। তুমি একজন গ্রাম্য লোককে হত্যা করেছো শয়তানী! দূর হয়ে যাও সামনে থেকে।

হরিনারাণ আমার বন্ধু। মৃত হলেও তার আত্মা অমর। প্রকৃতপক্ষে অমন সৎ আত্মা জগতে খুব কমই আছে। তোমরা শয়তানীরা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারবে না। তাছাড়া, হরিনারাণের কাছ থেকে তোমাদের ইতিবৃত্ত যা জানবার সব জেনেছি। তোমার মত জঘন্য আর কারুকে দেখেছি বলে মনে হয় না। হাঁস, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি প্রাণী থাকতে তোমার লোভ মানুষের রক্তের ওপর দেখে ঘৃণায় মন ভরে উঠছে। আর এক মুহূর্তও তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। আবার বলছি, আমার সামনে থেকে তুমি সরে যাও। তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।

চোখ দুটো জ্বলে উঠল ইলার। সে বলল, আপনি ভুল করেছেন। হরিনারাণ আপনাকে ভুল সংবাদে বিভ্রান্ত করেছে মাত্র। আসলে হরিনারাণ চায়না যে আমি এখানে আসি। আপনি বিশ্বাস করুন।

আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি না ইলা। –আমি বেশ জোর গলাতেই বললাম, প্লাটফরমের উপর সেই গ্রাম্য লোকটাকে জড়িয়ে ধরে তুমি তার রক্ত শোষণ করেছো। তার ফলে লোকটিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে! এটাও কি ভুল?

হো হো শব্দে হাসির ঝঙ্কার তুলে ইলা বলল, আপনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছেন, প্লাটফরমে কোন লোকই পড়ে নেই। আমি তো এইমাত্র ওদিক থেকেই আসছি।

মিথ্যা কথা! আমি ক্ষিপ্তের মত চেঁচিয়ে উঠলাম।

মিথ্যে নয়। –গলায় কাকুতি মিশিয়ে ইলা বলল এসব হরিনারাণের চালাকি। ও লোকটা আমাকে মুক্তি দিতে চায়না। তাই এসব বানিয়ে বলেছে। আপনি নিজের চোখে দেখে যান। আমার কথা মিথ্যে না সত্য!

আশ্চর্য! এত কথা বলার পর কি জানি কি হলো আমি সবকিছু ভুলে গেলাম ইলার কথায়। সাময়িকভাবে আমার অস্তিত্বকে হলাম বিস্মৃত। ইলা যা বলছে হয়তো ঠিক। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম। দেখতে হবে সত্যি সত্যিই কোন গ্রাম্য লোকের মৃতদেহ প্লাটফরমের উপর পড়ে আছে কিনা! যদি না থাকে তবে ইলার কথাকেই মেনে নেবো। বুঝবো হরিনারাণ আমাকে বোকা বানাচ্ছে।

প্লাটফরমের ওপর পা দিতেই ইলা চলে এলো আমার সান্নিধ্যে। একটা হিমশীতল স্পর্শ অনুভব করলাম আমার বাহুতে। মুখ ফেরাতেই ইলা আমার হাতটাকে স্পর্শ করেছে। ইলার চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন হয়ে গেলাম। ইলার চোখ দুটোর গভীরে দেখতে পেলাম নিজের ছায়াকে। বুঝলাম, এ দৃষ্টির হাত থেকে কোন মানুষের মুক্তি নেই। ইলা যেন আমাকে সম্মোহিত করছে তার দৃষ্টি দিয়ে।

দু’হাত দিয়ে ইলা আমাকে বেষ্টন করে চেপে ধরেছে তার দেহের সঙ্গে। আমার সংজ্ঞা লোপ পাবার আগে শুধু এইটুকুই মনে আছে, হরিনারাণের হাতের চাবুক সপাং সপাং করে ইলার গায়ে আঘাত করছে। আর হরিনারাণ চীৎকার করে বলছে, তোমাকে কতবার বলতে হবে। ইলা, আমাদের মুক্তির একমাত্র হাতিয়ারকে রক্ষা করতে হবে। তোমার লোভ ক্রমাগতই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শীগগির ছেড়ে দাও।

ইলা মূহূর্তের মধ্যেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। আর আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম প্লাটফরমের উপরে।

যখন জ্ঞান হলো তখন ভোর হয়ে এসেছে। পাখীদের স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। পূবের আকাশ ভরে গেছে সোনালী ছটায়। ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া নতুন জীবন বয়ে আনছে ঝলকে ঝলকে। আমি প্রাণ ভরে সেই তাজা হাওয়া ভরে নিলাম বুকে।

প্রথমেই আমি ছুটলাম প্লাটফরমের সেইদিকে যেখানে গ্রাম্য লোকটি ইলার শিকার হয়েছিল। কিন্তু কোন মৃতদেহ নজরে পড়লো না। আমি একটু অবাক হলাম। তাহলে সত্যিই কি আমি ভুল দেখেছি? হঠাৎ দেখতে পেলাম একটা ময়লা গামছা পড়ে রয়েছে একপাশে। হাতে করে তুলে নিলাম গামছাটা। একদিকে গামছার কোণায় গিঁট দিয়ে বাঁধ। রয়েছে একটি একশ’ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা। একটুকরো কাগজও ছিল তার মধ্যে। একজন উকিলের নাম ও ঠিকানা তাতে লেখা। বুঝতে পারলাম এই গামছার মালিক চলছিল শহর অভিমুখে তার উকিলের কাছে।

গতরাত্রে যে গ্রাম্য লোকটিকে দেখেছিলাম, এই গামছাটি যে তারই এমন প্রমাণ কোথায়? অন্য কোন ব্যক্তিরও হতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে গেলে নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে খোঁজ করা ছাড়া পথ নেই।

মনের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ কৌতূহল জমে উঠল এই মুহূর্তে। আমাকে এর শেষ দেখতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে এর আসল রহস্যটুকু। ইলা আর হরিনারাণের উদ্দেশ্যটুকুও পরিস্ফুট হয়ে উঠবে আমার কাছে।

আমি ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘরের দিকে তাকিয়ে রীতিমত চমকে উঠলাম। আশ্চর্য! ঘরে তালা দেওয়া। জানালাগুলি সব ভেতর থেকে বন্ধ। অথচ…অথচ…ভাবতে গিয়ে চিন্তাধারায় হোঁচট খেলাম, গতরাতে আমি এই ঘরের মধ্যেই বসেছিলাম হরিনারাণের মুখোমুখি।

মাথাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়লাম। নিজের উপর যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। যা কিছু দেখেছি যা অনুভব করেছি সবই ভুয়ো? সবই কি আমার মনের ভুল? কেমন করে সম্ভব? মানুষ কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে? অথবা এই ষ্টেশনে যেদিন এসে নেমেছিলাম সেই সময় থেকেই আমি একটানা ঘুমিয়ে রয়েছি আর এই সব বিদ্‌ঘুটে স্বপ্ন দেখছি? কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ঠিক নয় সে বিচারশক্তি যেন আমার লোপ পেয়ে গেছে এই মুহূর্তে।

সবকিছু চিন্তাজাল ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে ট্রেনের হুইসল-এর শব্দ ভেসে এলো দূর থেকে। সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ট্রেন আসছে এবং আমি তা দেখতে পাচ্ছি। আরও দেখতে পাচ্ছি। আরও দেখতে পেলাম কয়েকজন যাত্রী প্লাটফরমে অপেক্ষা করছে। ওরা যে কখন এসেছে টের পাইনি।

আমি দ্রুতগতিতে একজনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, আমাকে একটা খবর দিতে পারেন?

লোকটি অবাক হয়ে আমার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে সন্দেহের ছায়া ঘনীভূত হয়ে উঠেছে দেখতে পেলাম। আমি সেই গামছাটা নিয়ে লোকটির কাছে মেলে ধরে বললাম, আপনাদের কারুর হয়তো খোয়া গিয়ে থাকতে পারে। হয়তো আপনাদের গ্রামেরই কেউ হবে। যদি তাকে ফেরৎ দেন তো খুবই উপকার হবে।

লোকটি টুকরো কাগজের উকিলের নাম দেখেই বলে উঠল, হ্যাঁ আমাদের গ্রামের গদাই মোড়লের বলেই মনে হচ্ছে! গতকাল সন্ধ্যার গাড়ীতে তিনি উকিলের বাড়ী গেছেন। তাড়াতাড়িতে হয়তো গামছা পড়ে গিয়ে থাকবে।

লোকটির কথার কোন উত্তর না দিয়ে গামছাটাকে একরকম জোর করেই তার হাতে গুঁজে দিয়ে সরে এলাম। আবার আমি মানসিক চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। তাহলে সেই গ্রাম্য লোকটিই কি গদাই মোড়ল? সম্ভবতঃ সেই লোকটিই হবে। দেরী করে ষ্টেশনে আসার ফলেই ইলার খোরাক হয়ে মারা পড়েছে।

ট্রেনটি ষ্টেশনে এসে থামতেই ষ্টেশনমাষ্টার নেমে এলেন। আমাকে দেখতে পেয়েই চীৎকার করে বললেন, আরে মশাই, চললেন নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, এই ট্রেনেই যাবো।

না না, তা হয় না, ষ্টেশনমাষ্টার আত্মীয়সুলভ কণ্ঠে বললেন, দুপুরের ট্রেনে যাবেন। এখানে কথা বলার লোক বলতে কারুকেই পাই না। তবু কিছুটা সময় আপনার সঙ্গে কাটানো যাবে।

কথাটা শেষ হতে না হতেই হন্তদন্ত হয়ে তিনি ছুটলেন টিকিট কাউন্টার খুলতে। যে ক’জন যাত্রী ষ্টেশনে অপেক্ষা করছিল, টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ল। পয়েন্টসম্যান একটি সবুজ পতাকা নিয়ে নাড়তে লাগল। ট্রেনটি চলতে শুরু করলো।

আমি একাগ্রচিত্তে পয়েন্টসম্যানকে লক্ষ্য করছিলাম। একটু আগেই আমি যার হাতে টাকা সমেত গামছাটা দিয়ে এসেছিলাম সেই ভদ্রলোকই সবুজ পতাকা নিয়ে লাইন ক্লিয়ার দিচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে থাকায় উনি যে একজন রেলকর্মী তা বুঝতে পারিনি।

তখন ট্রেনটি প্লাটফরম ছাড়িয়ে যায়নি! খেয়াল হতেই ছুটলাম ট্রেন ধরতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ‘কালো খাতাটার’ কথা। তাইতো! খাতাটা গেলো কোথায়? খাতাটা না পেলে তা কোন কাজই হবে না! ফিরে এলাম নিজের জায়গায় যেখানে সারারাত শুয়েছিলাম। তন্ন তন্ন করে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও সেই খাতার হদিস পেলাম না।

মনের কোনে সন্দেহ দেখা দিল, যা কিছু দেখেছি সবকিছুই হয়তো আমার মনের অলীক কল্পনা মাত্র। অথবা একটা নিদারুণ দুঃস্বপ্ন। নতুবা ইলাকে মৃত জেনেও তার সঙ্গে আমি স্বাভাবিক আচার-আচরণ বজায় রাখলাম কি করে?

হরিনারাণ আমাকে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের ভিতরে বসতে বলবার পর আমি ও হরিনারাণ দুজনেই ঐ ঘরের মধ্যে বসেছিলাম। অথচ, সকালবেলায় তালা ঝুলছে দেখতে পেয়েছি। মাথাটা কেমন যেন ঘুলিয়ে যায় কথাগুলি চিন্তা করতে গিয়ে। অথচ তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

এদিকে ষ্টেশনমাষ্টার কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানিনা। চমক ভাঙলো তার কথায়। তিনি বলছেন, কি খুঁজছেন মশাই? কিছু হারিয়েছে নাকি?

বললাম, হ্যাঁ। তবে, তেমন কিছু নয়। চলুন, ঘরে গিয়ে বসা যাক, পরের ট্রেনেই ফিরবো।

ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই গোপন করে গেলাম। মিছিমিছি হাস্যস্পদ হয়ে কোন লাভ নেই ভেবে। ষ্টেশনমাষ্টারের সঙ্গে ঘরে ঢুকেই কিন্তু আমার আক্কেল গুড়ুম। রোমাঞ্চ আর বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেল। মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হল, আশ্চর্য!

কিসের, আশ্চর্য! –ষ্টেশনমাষ্টার ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

আমার দৃষ্টি তখন টেবিলের উপর। হ্যারিকেনের পাশে পড়ে রয়েছে সেই কালো খাতাটা। একে একে ভেসে উঠল গতরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা। এতক্ষণ যে সন্দেহ মনের মধ্যে দানা পাকিয়ে উঠেছিল সেই সন্দেহের নিরসন হলো। আমি স্বপ্ন দেখিনি অথবা মানসিক বিভ্রান্তিও নয়। গতরাত্রে আমি যে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরে বসেছিলাম কালে। খাতাই তার জলন্ত সাক্ষ্য। অথচ কে যে কখন তালা খুলল আর কখন যে তালা দিল বুঝতে পারলাম না।

আমি ষ্টেশনমাষ্টারকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা, আর গদাই মোড়লের কথাটাও বললাম! শুনেই ষ্টেশনমাষ্টার রীতিমত চমকে উঠলেন, বললেন আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন মশাই! এ জায়গাটার বড়ই দুর্ণাম রয়েছে! সেইজন্যেই এখানে কেউ রাত্রে থাকে না। আমার পয়েন্টসম্যান থাকে ওর গ্রামে। রোজ সকালে আসে আর সন্ধ্যায় শেষ। ট্রেন যাওয়ামাত্রই সে ফিরে যায় গ্রামে। একটা অভিশপ্ত জায়গা এটা। আমি আগের ষ্টেশনের কোয়ার্টারে থাকি। সকালের এই গাড়ীটায় আসি আর বিকালের শেষ ডাউনটায় ফিরে যাই। নেহাৎ চাকরি, তাই দায়ে পড়েই এমন জায়গায় চাকরি করি মশাই। অন্য ব্যবস্থা থাকলে কবেই চলে যেতাম। কিন্তু আপনি যা শোনালেন তাতে তো পেটের পিলে চমকে যাচ্ছে মশাই! আমি আজই কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাপারটা জানাবো। হয় এই ষ্টেশনটাকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করুক নয়তো আমাকে অন্য কোথাও বদলি করুক! উঃ কি মারাত্মক ব্যাপার মশাই?

তবে এর মধ্যে একটা কথা আছে! আপনি ইচ্ছে মতো বানিয়ে বানিয়ে গাল গল্প করে না থাকেন!

আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ অমন কথা বলবেন না মুখার্জিবাবু! বানিয়ে বলে আমার লাভ কি? তাছাড়া, আপনি তো জানেন। আমি কবে এসেছি এই ষ্টেশনে!

-হুম্! কথাটা মন্দ বলেননি, –মুখার্জিবাবু, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, যদি আপনার কথাই সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তবে বিপদের ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। আমি বরং পরের ষ্টেশনে ব্যাপারটা জানিয়ে দিই।

কথাটা শেষ করেই মুখার্জিবাবু ছুটলেন পরবর্তী ষ্টেশনের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করতে পারলেন না। শেষটার বিষণ্ণ চিত্তে গজ গজ করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, যত্ত সব ইয়ে! এই সময়েই বাবা লাইন খারাপ! দেখলেন তো স্যার্! দরকারের সময় সবকিছুই কেমন যেন বিকল হয়ে যায়।

–কেন! লাইনে আবার কি হলো? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–মাথা আর মুণ্ডু! –যত সব ইয়ে, রাগে রি রি করতে করতে মুখার্জিবাবু বললেন, বলুনতো এখন কি করি? আপনার কথা শুনে আমার তো বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে!

আপনার অত দুশ্চিন্তার কারণ নেই, –আমি সাহস দিয়ে বললাম আপনাকে সব কথাই তো বলেছি। হরিনারাণ চায় মুক্তি। সে এই অবস্থায় মোটেই থাকতে রাজী নয়। আমাকে ডেকে আনার উদ্দেশ্যটুকুও ওর সৎ প্রচেষ্টার সাক্ষ্য বহন করেছে। কালো খাতায় এইসব অভিশপ্ত আত্মার অধিকারীদের নাম-ধাম লেখা রয়েছে। এদের পিণ্ডদান করার সঙ্গে সঙ্গেই এরা পাবে মুক্তি। তারপর আর কোন ভয়ই থাকবে না। ওদের উপদ্রব থেকেও এ অঞ্চল মুক্ত হবে।

এই সময় পয়েন্টসম্যান এসে উপস্থিত হলো। ষ্টেশনমাষ্টার বললেন, জগদীশ, একটু চা-খাবারের ব্যবস্থা করো। সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত একটুও চা পেটে পড়েনি।

জগদীশ বলল, আজ কিন্তু পরোটা আর হালুয়া এনেছি মুখার্জিবাবু। বিস্কুট আনিনি।

বলো কী? মুখার্জীবাবু খুশীভরা মুখে বললেন, বেশ কাজের কাজ করেছো।

জগদীশ চা তৈরি করল স্টোভ জ্বেলে, আমরা হালুয়া পরোটা সহযোগে চা খেতে লাগলাম। জগদীশ আমাকে লক্ষ্য করে বলল, এই সাত-সকালে আপনি কোথা থেকে এলেন বাবু? আগে তো আপনাকে দেখিনি?

আমি ইচ্ছে করেই জগদীশের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, মুখার্জিবাবু, আমার কিন্তু বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমোতে চাই। কিন্তু পরের ট্রেনেই আমি যাবো, দয়া করে সেদিকটায় একটু খেয়াল রাখবেন!

আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন, মুখার্জিবাবু সহাস্যে বললেন, আজ আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে ছাড়বো।

এত গভীর ঘুমে যে মানুষ আচ্ছন্ন হতে পারে, এর আগে কোনদিন অনুভূত হয়নি। হয়তো গত দু’রাত্রির জাগরণের জন্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোথা দিয়ে কখন যে সারাটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, ঘুণাক্ষরে টের পাইনি।

প্রথমটা আমি বুঝতেই পারিনি যে আমি একটা অখ্যাত রেল ষ্টেশনে ঘুমুচ্ছিলাম। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম মিঃ মুখার্জিকে বিরস বদনে বসে থাকতে! কিছু সময় হা করে চেয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে! কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। এমন একটা অখাদ্য ষ্টেশনে এসে পড়লামই বা কি করে, তাও স্মরণে আসছিল না।

আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিঃ মুখার্জি বললেন, ঘুম ভাঙলো? আচ্ছা ঘুমই ঘুমিয়েছেন মশাই! সেই সকাল থেকে এই সন্ধ্যে পর্যন্ত! এদিকে যে সর্বনাশের মাথায় পা হয়ে গেছে। এ্যাঁ! কি বললেন? আমি চমকে উঠে প্রশ্ন করলাম, ধীরে ধীরে সব কথাই আমার মনের পটে ভেসে উঠেছিল। কেমন ভাবে এই ভয়ানক রেল ষ্টেশনে হাজির হলাম। ড্রাগন গরুর গাড়ীতে চেপে ডাকিনী ভিলায় যাওয়ার পথে সেই রোমহর্ষক ঘটনাসমূহ। তারপর সেই ডাকিনী ইলার খপ্পর থেকে কোনরকমে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসা। সবকিছুই জলের মত ভেসে বেড়াতে লাগল মনের মধ্যে।

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলাম। এই মুহূর্তেই আমাকে এই অভিশপ্ত স্থান ত্যাগ করতে হবে। আমি উৎকণ্ঠিত চিত্তে শুধালাম, শেষ ট্রেনটা আসতে কত দেরী মুখার্জিবাবু?

বিষন্ন মুখে মুখার্জি বললেন, সেই কথাটাই বলছি মশাই, বিপদ যখন আসে তখন এমনি করেই আসে। আজ আর কোন ট্রেনই এ-পথে আসবে না।’

কেন! কেন! –আমি চীৎকার করে উঠলাম।

এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে গাড়ীটা লাইনচ্যুত হয়েছে। “মিঃ মুখার্জি বললেন, এইমাত্র আগের ষ্টেশন থেকে খবর এসেছে।

তাহলে কি হবে? এদিকে যে সন্ধ্যে হয়ে এলো মুখার্জিবাবু? আমি মুষড়ে পড়লাম।

এখন আর কিছু করার নেই। আজ রাতের মত জগদীশের সঙ্গে ওর গ্রামেই গিয়ে আশ্রয় নিই। কাল সকালে এসে না হয় একটা কিছু করা যাবে। মিঃ মুখার্জি দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে বললেন।

ছটফট করছিল জগদীশ। সে ব্যাগ্রকণ্ঠে বলল, তাড়াতাড়ি করুন মুখার্জিসাহেব! সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। একটু পরেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। আমার মনটা খুব ভালো বলছে না।

এই যে আমার হয়ে গেছে। তালা লাগিয়ে মিঃ মুখার্জি বললেন, চলো আমারও মনটা খুব ভালো বলছে না জগদীশ।

আমরা তিনজনেই প্লাটফর্মের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে পা চালালাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন ঝড় উঠল। ধূলোর ঝড়। সোঁ সোঁ করে বাতাসের গোঙানির সঙ্গে চারিদিক ঘিরে ধূলোর অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমরা এক পাও অগ্রসর হতে পারলাম না। প্রচণ্ড হাওয়ার বেগ আমাদের পিছন দিকে ঠেলে ফেলছিল। তারসঙ্গে ধূলো ঢুকে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। জগদীশ বা মিঃ মুখার্জি যে সেই ধূলিঝড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল দেখতেই পেলাম না। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপতে শুরু করে দিল আমার। এমনতর একটা পরিস্থিতির মধ্যে যে পড়তে হবে, আগে তার বিন্দুমাত্র হদিশ করতে পারিনি।

আমি দু’হাত দিয়ে চোখ দুটো চাপা দিয়ে বসে পড়লাম প্লাটফরমের উপরে। অনুভব করলাম, যেন ক্রোধোন্মত্ত দৈত্য হুঙ্কার ছেড়ে মেদিনী দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে চাইছে। তার পায়ের চাপে পাহাড়-অরণ্য জনপদ সবকিছু গুড়িয়ে রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ধূলোর ঝড়ের মধ্যে দিয়ে।

চোখে হাতচাপা দিয়ে বসলেও ঠিকমত ঠিকমত টাল সামলাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল হয়তো এখুনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। চ্যাং দোলা করে আছড়ে মারবে মাটির বুকে। জীবনে বহুবার বহু ঝড়ের মধ্যে পড়েছি কিন্তু আজকের মতো এমনতর প্রলয়ঙ্করী ঝড়, কল্পনাতেও স্থান পায়নি। মড়, মড় শব্দে গাছ উপড়ে পড়ছে বুঝতে পারছি অথচ চোখ খুলে দেখবার উপায় নেই।

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে আমাকে তিন-পাক ঘুরিয়ে দিল। একরকম গড়াতে গড়াতে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দেওয়ালে এসে ঠেক খেলাম। তারপরই মনে হল, প্রকৃতি যেন শান্ত হয়ে আসছে। ঝড়ের গতিবেগ যাচ্ছে কমে।

ঝড় থামবার সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এলো। আমি তখনও একইভাবে বসে রয়েছি প্লাটফরমের উপর। কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সকালের ট্রেনটা ছেড়ে দিয়ে খুবই যে

অবিমৃষ্যকারীতা হয়েছে একথা মনে হতেই মিঃ মুখার্জির উপর ভীষণ রাগ হলো। সে যদি না আমাকে আশ্বাস দিত তাহলে নিশ্চয়ই এই অভিশপ্ত জায়গা থেকে আমি অনেক অনেকদূরে চলে যেতে পারতাম।

সারা শরীর ভিজে সপ সপ্ করছে। আমি গলা ছেড়ে মিঃমুখার্জিকে ডাকতে লাগলাম। না ডেকে তখন আমার কোন উপায়ওছিল না। রাতের আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। বৃষ্টির জন্যে জোনাকী পোকার আলোও তখন কোনদিক থেকে দেখা যাচ্ছিল না।

অদূরেই একটা গাছের তলায় মিঃ মুখার্জি ও জগদীশ আশ্রয় নিয়েছিল। আমার চীৎকারে মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হল। জগদীশ ভীতকণ্ঠে বলে উঠল, আর দেরী করবেন না স্যার! শীগগির চলুন। অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধ্যের পর এখানটায় থাকা ঠিক নয়! গা ছম্‌ম্ম্ করছে!

জগদীশের কথা মিঃ মুখার্জির কানে গেছে বলে মনে হলো না। তিনি উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করছিলেন। আমার কছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, আপনি কি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।

আমি বললাম, কই, তেমন কিছু তো শুনতে পাচ্ছি না। বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর গাছের পাতায় পাতায় ঝোড়ো হাওয়ার দাপটের শব্দ ছাড়া আর কিছু তো কানে আসছে না!

আমার কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ শীষের মত সেই ভয়াবহ কান্নার ধ্বনি আকাশ বাতাসে রণরণিয়ে উঠল। মিঃ মুখার্জি সভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে শুরু করলেন। জগদীশ তার গলায় দোদুল্যমান যজ্ঞোপবীত ডান হাতের মুঠোয় ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় নাম জপ করতে লাগল, রাম রাম হরে রাম।

মিঃ মুখার্জিও হয়তে। রাম নাম জপ করবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছিল না, শুধু একটা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া। আমিও বেশ ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু জগদীশ আর মিঃ মুখার্জির অবস্থা দেখে যেন আমার সাহস ফিরে এল। মনে পড়ল, এ কান্না আমি বহুবার শুনেছি। এ কান্না সেই রক্তলোলুপ পিশাচী ডাকিনীর কান্না। মনে পড়ল, হরিনারাণ আমার সহায়! সে সব সময়েই ছায়ার মত আমার পেছনে থেকে সব রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে।

সজোরে মুখার্জিকে নাড়া দিয়ে বললাম, ভয় কি মিঃ মুখার্জি, আপনি কি কখনো শকুনের কান্না শোনেন নি। গভীর রাতে শকুনের ডাক ঠিক যেন দুগ্ধপোষ্য শিশুর কান্নার মত শোনায়। চলুন, আমরা জগদীশের গ্রামের দিকে রওনা হই।

আমার কথায় কাজ হল! মুখার্জি কাঁপা গলায় বললেন, ওঃ, তাই বুঝি? চলো, চলো জগদীশ, আর একমুহূর্তও এখানে নয়। কি কুক্ষণেই এমন ধরণের চাকরী নিয়েছিলাম যে এখন পৈত্রিক প্রাণটাই খাবি খেয়ে মরছে।

জগদীশ মেঠো পথ ধরে হন্ হন্ করে এগিয়ে চললো, আমরা চললাম জগদীশকে অনুসরণ করে। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু জগদীশ বা মিঃ মুখার্জি যে বিষয়টা লক্ষ্য করেছে তা মনে হল না।

সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। জোনাকিরাও যেখানে আলো জ্বালাতে সাহস পাচ্ছে না। এমনতর ঘনান্ধকারের মধ্যেও আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের চলার পথটুকুকে একটা অতি ক্ষীণ নীলাভ আবছা আলোয় পথটি আলোকিত হয়ে আছে। আর সেই আলোয় পথ চিনে আমরা এগিয়ে চলেছি জগদীশের গ্রামের দিকে।

ব্যাপারটার কোনরকম ব্যাখ্যাই করতে পারলাম না। এই আবছানীলাভ দ্যুতির কেন্দ্রস্থল কোথায়? অথচ ভারী অদ্ভুত লাগল পশ্চাদদিকে দৃষ্টিপাত করে। পেছন দিকটা ছিল কালোয় ভর।। নিকষকালো সেই অন্ধকার। যেন পেছন থেকে সেই অন্ধকার আমাদের তিনজনকে গ্রাস করতে আসছে তার কালো কালো বিরাটকায় ভয়ংকর মুখ নিয়ে।

চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। কয়েক সেকেণ্ডের বেশী সেদিকপানে তাকানো যায়না। সামনের দিকের ঐ নীলাভ আলোক দৃশ্যটাই যেন আমাদের প্রাণ। সেই আলো যেন আমাদের বড় আপন অন্ততঃপক্ষে পেছনে ফেলে আসা অন্ধকারের চেয়ে।

আমার মনের ভাবনা বা মনের কথা মুখার্জিকে বললাম না। যতক্ষণ না জগদীশের গ্রামে পৌঁছাই ততক্ষণ না বলাই ভালো, অযথা বেচারা ভয় পেয়ে যাবে আমার কথায়। সুতরাং যেমন নীরবে পথ হাঁটছিলাম তেমনি নীরবে এগিয়ে চললাম জগদীশকে অনুসরণ করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *